কয়েন,পর্ব_২

0
564

কয়েন,পর্ব_২
রহস্য_গল্প
পৃথা_সামন্ত_ঘোষ

কুশলবাবুর জেরা শেষ হয়েছে ততক্ষণ । অফিসার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কনস্টেবলটিকে কিছু নির্দেশ দিচ্ছেন হাত নাড়িয়ে । আলিশা কুশলবাবুর উল্টোদিকের সোফায় এসে বসলো ।

— বলুন মিস সোম ! ওদের কি এবার ডাকবো ?

— এখানে নয় , ওদের রুমেই কথা বলবো আমি । কিন্তু এক এক করে ।

— বেশ , আসুন , আমার সাথে ।

একতলার করিডোর বরাবর হেঁটে গিয়ে ডানহাতের একটা ঘরের দরজায় নক করলেন ভদ্রলোক । একজন মাঝবয়সী সাধারণ চেহারার ভদ্রমহিলা এসে দাঁড়ালেন দরজার ওপারে ।

— দাদা আপনি , আসুন ! আমাকে ডাকলেই তো পারতেন !

— আমি না ,ইনি কথা বলবেন তোমাদের সাথে । ইনি আলিশা সোম , ডিটেক্টিভ । এই কেসটা ইনভেস্টিগেট করছেন উনিই । যা জিজ্ঞেস করবেন ঠিক ঠাক ভাবে বলবে । তারপর আলিশার দিকে ফিরে বললেন — প্রথমে কার সাথে কথা বলবেন ?

— এঁর সাথেই বলি ! বাকিদের এক এক জন করে ডেকে নেবো । আপনি এবার একটু বিশ্রাম নিন মিস্টার বাগচী । আমি এদিকটা দেখে নিচ্ছি ।

ক্লান্ত , অবসন্ন দৃষ্টি মেলে আলিশার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলেন কুশল বাগচী । তারপর কিছু না বলে উল্টো দিকে ফিরে ধীর পায়ে হেঁটে গেলেন করিডোর বরাবর । আলিশা ফিরলো ভদ্রমহিলার দিকে ।

— ভিতরে যাওয়া যাক !

— আসুন ।

ঘরের ভিতর বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় মোবাইল হাতে একটি বছর বাইশের ছেলে , তার পাশে লুঙ্গি পরে বসে একজন ভদ্রলোক , গায়ে চাদর । আলিশাকে দেখে উঠে বসলো ছেলেটি । ভদ্রলোক বললেন — আপনি !

— উনি ডিটেক্টিভ । ঈশার কেসের ব্যাপারে উনিই তদন্ত করছেন । তাই জিজ্ঞাসাবাদ করতো এসেছেন । দাদা বলে গেলেন । তোমরা এখন বাইরে যাও , সোফায় গিয়ে বসো , আমার হলে একে একে তোমরাও আসবে । একটানা কথাগুলো বলে থামলেন ভদ্রমহিলা ।

ভদ্রলোক আর তার ছেলে সাথে সাথে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে । আলিশা ঘরের একটামাত্র চেয়ারে বসে ভদ্রমহিলাকে বসতে বললো । তিনি বসলে সে বলল — আপনার নাম কি ?

— রমা কর্মকার ।

— কি করেন ?

— বাড়িতেই থাকি , কাজ করি । চাষবাস আছে , জমিজমা আছে , আমাদের চলে যায় ।

— বাড়ি ?

— বর্ধমানের কাছে ……

— আচ্ছা । এখানে কি কাজে আসা হয়েছিল ? ঘরের চারিদিকে চোখ বোলাতে বোলাতে বলে আলিশা ।

— ওই যে ছেলেটাকে ডাক্তার দেখাতে । ওর টিবি হয়েছিল তো ! প্রতি চারমাস অন্তর তাই চেকআপ করাতে আসতে হয় ।

— টিবি ? সেকি !

— হ্যাঁ দিদিমণি ! তাই জন্যেই তো আসা !

— ঈশা কেমন ছিল ? আপনার কেমন লাগতো ওকে ?

— দারুন ভালো মেয়ে ছিল । সকলের সাথে সুন্দর করে কথা বলতো । সকলের কথা ভাবতো । গতকালই আমাকে এই চাদরটা দিলো । আলিশা দেখলো… রমার গায়ে জড়ানো একটা কালো রঙের স্টোল ! সেটা যে বেশ দামি… সেটা এতক্ষন নজরে তেমন আসেনি তার , এবার সে ভালো করে সেটা লক্ষ্য করলো । শুনলো রমা বলছেন — কে জানতো যে এমন কিছু একটা কান্ড ঘটে যাবে ! এই বাড়িতে আর কি কোনোদিন আসতে ইচ্ছে যাবে !

— আপনার ছেলে কী করে ?

— ছেলে এই সবে পড়াশোনা শেষ করে ব্যবসা করবে বলে ভাবছে ।

— হুম ! কি ব্যবসা ?

— ঈশার খুনের সাথে ওর ব্যবসার কি সম্পর্ক দিদিমণি ? আপনি কি ওকে সন্দেহ করছেন নাকি ? ও কিন্তু কিচ্ছু করেনি !

— আরে থামুন থামুন ! যেটা জিজ্ঞেস করছি সেটা বলুন । হাত তুলে রমাকে থামিয়ে দিয়ে বলে ওঠে আলিশা ।

রমা বলে — মোবাইলের দোকান দেবে বলে ভেবেছে । বর্ধমান স্টেশনের কাছে ।

— বাহ ! ঠিকাছে আপনি ওকে পাঠিয়ে দিন এবার । প্রয়োজন পড়লে ডাকবো আপনাকে আবার ।

ঘাড় কাত করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন রমা । একটু পরে ছেলেটি এসে দাঁড়ালো দরজার কাছে ।

— এসো ।

ছেলেটি ঘরের ভিতর ঢুকে দাঁড়িয়ে রইলো ।

— নাম কি তোমার ?

— সোহম কর্মকার ।

— মোবাইলের দোকান কবে খুলছো তাহলে ?

সোহম সামান্য চমকে উঠে সোজা হয়ে বসে বললো — আপনি কিকরে জানলেন সেটা ? মায়ের থেকে জেনেছেন , তাইনা ?

— সেটা খুব ইম্পরট্যান্ট নয় , তুমি বলো… কবে খুলছো দোকান ?

— ঠিক নেই । টাকা জোগাড় হয়নি এখনো ।

— বাবা কি বলছেন ? দেবেন নাকি দেবেন না ?

— বাবার কাছে অতো টাকা নেই , বুঝতে পারছেননা… এই বাড়িতে আমাদের পজিশন টা ঠিক কি ! অথচ একসময় আমার দাদুর কাছেই মানুষ হয়েছেন আজকের এই কুশল বাগচী । এখন সব ভুলে গেছেন উনি ।

আলিশা সাথে সাথে বলে উঠলো — তাহলে কি করবে ভাবছো ?

— টাকা জোগাড় করবো । যেভাবেই হোক !

— ঈশাকে কেমন লাগতো তোমার ? একই বয়সী বোধহয় তোমরা ! না ?

— ঈশা আর ওর মা বিদিশা কাকিমা… এই বাড়িতে এই দুজন ভালোমানুষ ছিল , এখন শুধু কাকিমাই রয়ে গেল । ঈশা খুব ভালো ছিল । কোনোদিন বুঝতে দিতনা… ওরা বড়লোক , আমরা গরীব ! একসাথে ওর ঘরে বসে কত গল্প করেছি , মুভি দেখেছি ! এনা কিন্তু কোনোদিন ডাকেনি । এনা আসতোও না যখন আমরা গল্প করতাম ! এনা বোধহয় হিংসা করতো ঈশাকে !

— কেন ?

— হয়তো ইশাকে দেখতে সুন্দর ছিল… তাই !

— ইশাকে এনা হিংসা করতো… এমন কোনো ঘটনার সাক্ষী ছিলে তুমি ? থাকলে আমাকে বলতে দ্বিধা কোরোনা । তোমরা সবাই এখন এক নৌকার যাত্রী , সবাই কিন্তু সন্দেহের আওতার মধ্যে । সুতরাং যা জানো সবটা বলো ।

— আমার চোখে তেমন কিছু পড়েনি কোনোদিন ! আমরা তো খুব কমই আসি এখানে । এনা ঈশার সাথে তেমন মিশতো না , এটুকু আমি বুঝতে পেরেছিলাম । ইশাকে তেমন পছন্দ করতো না এনা ।

— তাই ? কিন্তু আমার যে একটু অন্যরকম মনে হচ্ছিল এতক্ষন !

— কি মনে হচ্ছিল ?

— থাক সে কথা । তোমার টিবি হয়েছিল শুনলাম ! কিকরে হলো ?

— জানিনা , ব্যাস হয়ে গেল ।

— এখন একদম ফিট ?

— হ্যাঁ , ফিট । এখন রোজ মাঠে তিন কিলোমিটার করে দৌড়োই ।

— তাহলে এখনও চেকআপ করাতে হচ্ছে কেন ?

— ওই মা জোর করে , আসলে ভয় পায় বুঝলেন !

— হুম । ঠিকাছে , বাবাকে পাঠিয়ে দাও এবার ।

সোহম চলে যাওয়ার একটু পরেই ভদ্রলোক এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন গলা খাঁকারী দিয়ে ।

— আসুন , বসুন ।

— হ্যাঁ , আমি ত্রিদিব কর্মকার । কুশল আমার ভাই হয় ।
— শুনেছি । দূরসম্পর্কের ভাই , তাই তো ?

ভদ্রলোক একটু থমকে যাওয়া গলায় বললেন — ও তাই বলেছে বুঝি ?

আলিশা কিছু না বলে স্থির চেয়ে রইলো ভদ্রলোকের দিকে । শুনলো উনি বলছেন — একটা সময়ে পিঠোপিঠি বড় হয়েছি জানেন ম্যাডাম ! এক থালায় ভাত মেখে আমার ঠাকুমা আমাদের দুজনকে খাইয়ে দিয়েছে , মাঠে কাদা মাখামাখি করে ফুটবল খেলেছি কত ! কখনো ও আমাকে অঙ্ক বুঝিয়ে দিয়েছে , কখনো আমি ওকে ইতিহাস । ক্লাসে ওর আমার মাঝে বসার সাহস হয়নি কোনোদিন । সেসব হয়তো ও আজ আর মনে রাখেনি , তবে আমি সেসব আজও কিছুই ভুলিনি । চাষাভুষো মানুষ তো !

— পড়াশোনা ছেড়ে দিলেন কেন ?

— ছাড়িনি তো ! করেছি । তবে আমার ওর মতো মাথা ছিলোনা । ক্লাস নাইনে ফেল করলাম , পরের বছরও তাই । বাবা তখন পড়াশোনা ছাড়িয়ে চাষের কাজে ঢুকিয়ে দিলো । কিন্তু কুশলকে বাবা লেখাপড়া করিয়েছিল । ওর মাথাটা ভালো ছিলো বলে বাবা খুব গর্ব করতো ওকে নিয়ে । আমিও সবার কাছে ওকে আমার ভাই বলে পরিচয় দিতে বেশ গর্বই করতাম ! এখনো গর্ব করি আমি ওকে নিয়ে । কিন্তু ও যে আমাকে এতটা দূরের করে দিয়েছে… এটা আমি ভাবিনি ।

থমথমে মুখটা নিচের দিকে সামান্য ঝুঁকিয়ে বসে রইলেন ত্রিদিববাবু । আলিশা বলে উঠলো — ঈশার সাথে কেমন সম্পর্ক ছিল আপনার ?

— ভাল । যেটুকু দেখা হতো… তাতে বরাবর আন্তরিকতা পেয়েছি ওর ব্যবহারে । ভারী নরম মনের মেয়ে ছিল সে ।

— কেমন ! কোনো ঘটনা ?

— হ্যাঁ , এই তো গতবার যখন এলাম , ছেলে একটা ল্যাপটপ দেওয়ার জন্যে খুব ধরেছিল । ঈশা জানতে পেরে পুরো টাকাটা আমার হাতে তুলে দিয়ে বললো — কাকা , এটা রাখো ।

আলিশার কপালে ছোট্ট দুটো ভাঁজ জমলো । সে বলল — কতদিন আগে ?

— গতবছর নভেম্বরের শেষ দিক নাগাদ হবে !

— আপনি ওকে জিজ্ঞেস করেননি… এতগুলো টাকা কোথায় পেলো সে ? তার তো কোনো আয় ছিল না ! সে কি কুশল বাবুকে জানিয়ে টাকাটা দিয়েছিল আপনাকে ?

— না , আমি জিজ্ঞেস করিনি । মাথায় আসেনি আমার ।

— অভিভাবক হিসেবে এই টুকু জানার দায়িত্ব কি পালন করা উচিত ছিল না আপনার ? কারো থেকে টাকাটা সে ধার করেছিল কিনা… তাই বা কে বলতে পারে !

— না , ম্যাডাম , সেটা জানিনা । ঈশা মাঝেমধ্যেই আমাদের এটা ওটা কিনে দিতো , তাই আমার মাথায় এই কথাটা একদম আসেনি । তবে এখন মনে হচ্ছে… আসা উচিত ছিল । ও দিলো বলেই আমিও হাত পেতে টাকাটা নিয়ে নিলাম… এটা আমি ঠিক করিনি । ভদ্রলোক নিজের ঘাড়টা দুপাশে নাড়াতে নাড়াতে বললেন ।

— যাই হোক ! ত্রিদিববাবু , আজ আমি আর কিছু প্রশ্ন করবো না আপনাকে । এবার আমি উঠবো । যদি প্রয়োজন পড়ে… আবার ডাক পড়বে ।

— আমাকে কি এখন এখানেই থাকতে হবে ?

— হ্যাঁ , আপাতত কিছুদিন ।

বেরিয়ে আসে আলিশা । করিডোর দিয়ে হেঁটে যায় লিভিংয়ের দিকে । দরজা দিয়ে বেরোনোর সময় কনস্টেবলটিকে নিজের একটা কার্ড দিয়ে বলে — এটা আমার নম্বর । কিছু অন্যরকম দেখলে আমাকেও একটা ফোন করে দিও ।

— স্যার যদি…

— তোমার স্যার বারণ করলেও তুমি শুনবেনা । কারণ ওনার মতো আমিও এই কেসটা ইনভেস্টিগেট করছি । মিস্টার বাগচী আমাকে হায়ার করেছেন । সুতরাং বুঝতেই পারছো আমার জানাটাও সমান ভাবে ইম্পরট্যান্ট !

— আচ্ছা ম্যাডাম !

বাগান পেরিয়ে গেট অবধি এসে রেজিস্টারে সই করে বেরিয়ে পড়লো আলিশা । খানিক এদিক ওদিক বিনা উদ্দেশ্যে ঘুরে বেড়ানোর পর একখানা হলদে রঙের ট্যাক্সি ধরলো সে বাড়ি ফেরার জন্য । ট্যাক্সি বাইপাসে পড়তেই… রৌনকের ফোন এলো একটা ।

মস্তিষ্কের ভিতর জটিলতার রূপবিন্যাসে ব্যস্ত ছিল সে এতক্ষন । সেই কাজে বাধা পড়লো । ফোনটা কানে চেপে আলিশা বললো — বল , কি হয়েছে ?

— ফিরেছিস ?

— না , ফিরছি । তুই বারবার কল করছিস কেন ?

— অন্যদিন ও তো করি !

— করিসনা রৌনক ! আমি কনসেনট্রেট করতে পারছিনা । বাড়ি ফিরি… তারপর ঠান্ডা মাথায় কথা বলবো । এখন প্লিজ রাখ ।

— কেস সিরিয়াস মনে হচ্ছে !

— হ্যাঁ , বেশ কমপ্লিকেটেড !

— সাবধানে ফের , রাখলাম ।

ফোনটা কেটে দিলো রৌনক । আলিশা ফিরতে চেষ্টা করলো তার ভাবনাগুলোর মূলস্রোতের গভীরে । পরপর সাজাতে আরম্ভ করেছে সে খটকাগুলোকে মনের পাতায় । বাড়ি ফিরে বসে পড়তে হবে লিখতে । আলাদা আলাদা ফোল্ডারে সেভ করে রাখতে হবে ছোট বড় প্রতিটা ডিটেইলস ।

বাড়ি ফিরেই ল্যাপটপটা কোলের কাছে টেনে নিল আলিশা । দ্রুত হাতে টাইপ করছে ফোল্ডারের নাম…. ঈশা ! যখন যে খুনের কিনারা করে সেই মৃত ব্যক্তির নামেই সে ক্রিয়েট করে ফোল্ডারটা , ওর মনে হয়… এটা সেই ব্যক্তির প্রতি নিঃশব্দ এক বার্তা হিসেবে থেকে যাবে স্মৃতিতে ।

খটকা ১ — ঈশার চিৎকার কেউ শুনতে পেলোনা কেন !

খটকা ২ — ইশা আর এনা পরস্পরের বন্ধু ছিল নাকি শত্রু ! বন্ধু হলে… এনগেজমেন্টের পর বোনের সাথে নিজের খুশি কেন সে শেয়ার করেনা ?

খটকা ৩ — তিনজনের ফোটো আলাদাভাবে সযত্নে কেন রাখা ছিল সাদা খামে !

খটকা ৪ — এনার সাথে তার মায়ের সম্পর্ক কেমন ! বাবার সাথেই বা কেমন তার সম্পর্ক ! এনার কথা বারেবারে এড়িয়ে গিয়ে ঈশার কথাই কেন বলছেন বাগচী দম্পতি ?

খটকা ৫ — রমা কি জানে কিছু ? ছেলের ব্যাবসা নিয়ে প্রশ্ন করতেই এমন ঘাবড়ে কেন গেল সে ?

খটকা ৬ — সোহম কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য ? যদিও পূর্ব ইতিহাস যেটুকু সে বলেছে… তা মিথ্যে নয় , সেটা তার বাবা ত্রিদিব কর্মকারের জবানবন্দিতে বোঝা যায় ! বোঝা যায়… এনাকে আর কুশলবাবুকে অপছন্দ করলেও ঈশা আর তার মাকে বেশ পছন্দ করতো সে । যে কোনো কারণেই হোক.. ছেলেটির ওপর আলিশার কোনোভাবেই বিশ্বাস আসেনা । সে এই পয়েন্টের পাশে বড় করে একটা স্টারমার্ক এঁকে রাখলো ।

খটকা ৭ — অসুখ সারিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠার পরেও এত ঘন ঘন ট্রিটমেন্টের জন্যে ডক্টরের কাছে কেন আসতে হয় তাদের ?

খটকা ৮ — ত্রিদিব বাবুকে অতোগুলো টাকা কেন দিয়েছিলো ঈশা ! শুধুই কি মহানুভবতা ছিল নাকি অন্য কিছু !

খটকা ৯ — টাকাটা ঈশা কোথায় পেলো ? মেয়েদের হাতে যথেচ্ছভাবে খরচ করার জন্যে কুশল বাগচী কি এরকমভাবেই টাকা তুলে দিতেন ? যদি তা না হয়… তাহলে কিভাবে জোগাড় করলো সে টাকা ?

এই পর্যন্ত লিখে ল্যাপটপ টা মুড়ে রাখলো আলিশা । ভালো লাগছেনা । বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের ভিতর পাইচারী করতে শুরু করলো সে… হাতদুটোকে নিজের পাজামার পকেটে রেখে । আলিশার শেষ তোলা ছবিটাও এখনো তার দেখা হয়নি অফিসারটিকে তেমন সুবিধার বলে মনে হলোনা । কতটুকু কি সাহায্য সেখান থেকে পাবে… বেশ সন্দিগ্ধ সেই বিষয়ে আলিশা । অথচ একটিবার ছবিটা দেখাও তার জন্যে ভীষণ প্রয়োজন । পোস্টমর্টেম রিপোর্টটাও দারুন জরুরী । আলিশা টেবিলের ওপর রাখা ফোনটা চার্জ থেকে ডিসকানেক্ট করে হাতে তুলে নিলো । ডায়াল করছে মিস্টার বাগচীর নম্বর….

অফিসারের নম্বরটা নিয়ে ফোনটা কেটে দিয়ে কিছুক্ষণ জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো সে । মনটা ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে তার । কখনো না দেখা , অচেনা ঈশা নামের মেয়েটির জন্যে তরল বাষ্প জমছে আলিশার মনের গোপন অলিন্দে । এক ধরণের অদম্য জেদ জন্ম নিতে থাকে সেই তরল থেকে… জেদটাকে ঢেকে ফেলে সদ্য প্রাপ্ত নম্বরটায় ডায়াল করলো আলিশা । রিং হচ্ছে ওপ্রান্তে….

— হ্যালো ! ইন্সপেক্টর বার্মা বলছি ।

— নমস্কার ! আমি আলিশা সোম । সকালে আলাপ হলো !

— ওহ হ্যাঁ , মনে পড়েছে ! কিন্তু আপনি আমার নম্বর….

— বাধ্য হয়েই নিতে হলো মিস্টার বাগচীর কাছ থেকে । দায়টা যে আমার ওপরেও বর্তেছে !

— বলুন কি জানতে চান ?

— ঈশা বাগচীর শেষ ছবিগুলো দেখাটা প্রয়োজন , আর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট টা… ওটাও । আর একটা জিনিস , ওর ঘর থেকে পুলিশ যা যা খুঁজে পেয়েছে , সেগুলো একবার আমি দেখতে চাই । প্রয়োজন হলে আমি থানাতেও আসতে পারি ।

— ঠিক আছে , চলে আসুন ।

— আজ নয় কাল যাবো । রিপোর্টটা কি পেয়ে গেছেন ?

— না , কাল সকালে পাবো । তবে দেখুন আলিশা… আপনাকে একটা কথা বলে রাখি । আপনি ইনভেস্টিগেট করছেন করুন , কিন্তু আমাকে ইনফ্লুয়েন্স করবেননা কোনোভাবে । আমি রিপোর্ট জমা দেবো আমার মতো করে , আপনি আপনার মতো কাজ করবেন ।

সামান্য হাসলো আলিশা । বললো — গোয়েন্দার সাথে কাজ করার অভ্যাস নেই মনে হচ্ছে.. নাকি গোয়েন্দাদের এভাবেই অপছন্দ করেন ?

— না , আগে কখনো হয়নি এমন । আমার কাজটা আমি নিজেই করেছি । এবারও তাই করতে চাই ।

— অল দ্য ভেরি বেস্ট অফিসার । কাল দেখা হচ্ছে তাহলে । গুড নাইট !

— গুড নাইট ।

নটার ঘন্টা বেজে উঠলো গম্ভীর জলতরঙ্গের মতো । রৌনকের দেখা নেই এখনও । আলিশা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো । ম্যাগি করে খেয়ে নেবে । আজ একটু আগে শুয়ে পড়বে সে , একটা দিন তাড়াতাড়ি উঠতে পারেনা সে ঘুম থেকে । আগামীকাল অনেকগুলো কাজ আছে । ম্যাগিটা বানানো শেষ হতেই বেল বেজে উঠলো ।

দরজা খুলে দেখলো রৌনক দাঁড়িয়ে । তাকে ম্যাগির বাটি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রৌনক বলে উঠলো — ম্যাগি খাচ্ছিস ? আমার জন্যে বানিয়েছিস ?

— না , আমার মত বানিয়েছি । তুই খেলে বানিয়ে নে ।

— নাহ , থাক ! অফিস থেকে ফিরে হাত পুড়িয়ে রান্না করতে আর ইচ্ছা করেনা ।

— হুম !

— এনি ওয়ে… তুই এত আপসেট কেন আজ ?

— আপসেট নই , একটু ভাবনার মধ্যে ডুবে আছি । দ্যাটস ইট !

রৌনক সোফার ওপর হাত পা ছড়িয়ে বসতে বসতে বললো — কেসটা কি ? মার্ডার ?

— হ্যাঁ ।

— বল , শুনি !

— না রে , আজ কথা বলতে ইচ্ছা করছেনা । আর তাছাড়া তুই তো আজ বললি… তোর ওপর ডিপেন্ড না করতে… তাই তুই ইচ্ছা করেই আজও আমাকে ডেকে দিসনি ! কিরে ! এখন আমার কেস শুনে কি করবি ? আমাকে খানিক জ্ঞান , উপদেশ দিবি , শেষে বলবি… তোকে কে মানবে… ডিটেক্টিভ হিসেবে ! শোন রৌনক… তোর ওপর আমি ডিপেন্ড করিনা , বন্ধু হিসেবে , বেস্ট ফ্রেন্ড হিসেবে সবকিছু শেয়ার করি । তুই তাড়াতাড়ি উঠে পড়িস রোজ , আমি উঠতে পারিনা । তাই ডেকে দিতে বলি… তুই আমি একসাথে না থাকলে কি আমার জীবনটা থেমে যাবে বলে মনে হয় তোর ? না রে , ঠিক চলবে ।

— এই এই লি ! কি হয়েছে তোর ? তুই এসব কেন বলছিস ? তখন বললি বাড়ি ফিরে কথা বলবি ! রৌনক আলিশার বাঁ কাঁধে হাত রেখে বললো ।

— আমাকে আজ কথা বলাস না । আমি আজ একটু আগে শুয়ে পড়বো । তোর খাবার ফ্রিজে রাখা আছে , গরম করে খেয়ে নিস । গুড নাইট ।

ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো আলিশা । ঘরের সব আলো নিভিয়ে বিছানার পাশের হলুদ আলোটা জ্বালিয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে চুপ করে শুয়ে রইলো কিছুক্ষন । তারপর চোখ দুটো বন্ধ করে নিয়ে অপরাধ বিজ্ঞানজগতের অতল গভীরে পারি জমালো ধীরে ধীরে ।

||এরপর…||

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here