কয়েন,পর্ব_৩

0
587

কয়েন,পর্ব_৩
রহস্য_গল্প
পৃথা_সামন্ত_ঘোষ

কিছু সময় পরে আলিশা উঠে বসে বেডসাইড টেবিলের ওপর রাখা ল্যাম্পশেডটা জ্বালালো । পাশে রাখা ব্যাগটা থেকে বের করে আনলো ঈশার ঘর থেকে খুঁজে পাওয়া ডায়রিটা । প্রথম পাতা খুললো । সেখানে লেখা আলেখ্যকে নিয়ে ঈশার কিছু নিজস্ব অনুভূতির গল্প । পাতা ওল্টালো আলিশা । সেখানেও লেখালেখির মূল বিষয় সেই আলেখ্য । দ্বিতীয় পাতা ওল্টাতেই ঈশা থমকে গেল । দেখলো সেই পাতায় বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে… ওরা কেউ আমাকে বাঁচতে দেবে না । কিছুতেই বাঁচতে দেবে না ।

গোটা পাতায় আর একটি আঁচড়ও টানেনি সে । আলিশা টানটান হয়ে বসলো । আবার একবার পড়লো লেখাটা । ঝটিতি হাতে ওল্টালো পরের পাতা । সেখানে আবার ঈশা লিখেছে আলেখ্যর আর তার নিজের কথা । আলেখ্যর ওপর তার নির্ভরতার কথা , আর লিখেছে… আলেখ্যকে কিছু বলার কথা !

পরের পাতায় সে লিখেছে তার জ্বর হয়েছে । বাড়িতে কেউ নেই । আলেখ্যর কথা তার ভীষণ মনে পড়ছে । কিন্তু সকলের অনুপস্থিতিতে আলেখ্যকে এভাবে বাড়িতে ডাকতেও তার ইচ্ছা করছেনা । এনা নাকি বাড়িতেই ছিল , একটু আগেই বেরিয়ে গিয়েছে । বাড়িতে কেউ নেই জেনেও তাকে একলা ফেলে চলে গেছে । যাওয়ার সময় শুধু বলার গেছে তার ফিরতে রাত হবে । বাবা মাকে বলে দিতে ।

এই পর্যন্ত পড়ে ডায়রিটা মুড়ে রাখলো আলিশা । তার দৃষ্টি চলে গেল বন্ধ দরজার নিচের সরু একফালি আলোর দিকে , ফাঁক দিয়ে ঘরের ভিতর এসে পড়েছে একটুকরো আলো.. ড্রইং রুমের । রৌনক জেগে আছে এখনও ! ভাবে আলিশা । ঈশা কি বলতে চেয়েছিল আলেখ্যকে ? কেন তাকে এরা বাঁচতে দেবে না ? এই এরা…. কারা ?

এনা আর আলেখ্যর সাথে একবার দেখা করতে হবে । এনাও আলেখ্যকে ততটাই চেনে , যতটা চিনতো ঈশা । ঈশা আর এনার সম্পর্কের সমীকরণ এখনো অবধি তার কাছে পরিষ্কার নয় । বাইরের কেউ নয়… ঈশার খুনি যে ঈশার খুব কাছেরই কেউ… সেকথা দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ । কিন্তু খুনের মোটিভ টা এখনও তার কাছে ধোঁয়ার চেয়েও বেশি অস্পষ্ট , জটিল এবং প্রায় দুর্ভেদ্য । কারণ মোটিভ হতে পারে অনেক গুলো !

বিছানা থেকে উঠে পড়লো আলিশা । দরজাটা খুলে বেরিয়ে এসেছে ড্রইংরুমে । রৌনক সোফায় বসে টিভি দেখছে । ক্রিকেট ম্যাচ । আলিশার ওপর চোখ পড়তেই সে বলল — কিরে ! ঘুমাসনি ?

— না , ঘুমাইনি । কেসটা স্টাডি করছিলাম । তোর সাথে কিছু কথা ছিল । তোর খাওয়া হয়েছে ?

— না ,খাবো । তুই বল কি বলবি ?

সোফার অন্য প্রান্তে এসে বসলো আলিশা । বললো — কেসটা খুব অদ্ভুত জানিস ! একজনের মৃত্যুর পিছনে অনেকগুলো মোটিভ ! এক্সট্রিম লেভেল পর্যন্ত ভাবনার অবকাশ থাকলে সেগুলো প্রতিটাই বেশ স্ট্রং ! মেয়েটি মানসিক ভাবেও ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েছিল । ওর একটা ডায়েরি এনেছি , তাতে লিখেছে দেখছিলাম । ওর ফিয়ান্সে আলেখ্য নামের একটি ছেলে । তার ওপর অসম্ভব ভাবে নির্ভরশীল ছিল ঈশা । তুই বুঝতে পারছিস তো ? রৌনকের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে আলিশা ।

— শুনছি এবং বুঝছি । তুই বলতে থাক ।

— না , এটুকুই । তুই বল.. কি মনে হলো ?

— দেখ এটুকু শুনে কিছুই বলা সম্ভব নয় । তবে তুই বললি না… ভীষণ ডিপেন্ড করতো ! এটা কি তুই জেনে বলছিস নাকি আন্দাজে ?

— জেনেই বলছি , হয়তো মানসিক ভাবে অসম্ভব নির্ভর করতো ঈশা আলেখ্যর ওপর.. যেটা আমার খুব স্ট্রেঞ্জ লাগছে ।

— কেন ?

— কারণ… ঈশা বা এনা যে পরিবেশে বড় হয়েছে বলে বুঝলাম… তাতে তাদের মধ্যে এত বেশি ডিপেন্ডেন্স তৈরি হওয়ার কথা নয় ! ঠিক যেমন এনার হয়নি । এরা খুব স্বাধীন পরিবেশে বড় হয় । কিন্তু ঈশা এমন উল্টো ছিল কেনো ? ইউসুয়ালি আর্থিক স্বাচ্ছন্দ বেশি হলে মানুষের মনের সূক্ষ অনুভূতি গুলো হারিয়ে যায় । আর এই দুই বোন সেই পরিবেশেই বড় হয়েছে । তা স্বত্বেও ঈশা অন্যরকম ছিল । কি এমন ঘটেছিল তার জীবনে যার জন্যে তার মধ্যে এতখানি পরনির্ভরশীলতা জন্মে গেছিলো ! ইউসুয়ালি বড়সড় কোনো ধাক্কা খেলেই এমনটা হওয়া পসিবল ।

— তুই যখন একদিনের মধ্যে মোটিভগুলো সবকটা বুঝে ফেলেছিস..উইথ টাইমস স্পেসিফিক মোটোটাও ঠিক খুঁজে পেয়ে যাবি ।

— বলছিস তাহলে ? বলেই আলিশা আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো । তার মনে পড়লো… ব্যাগে রাখা তিনজনের ফোটোটা একটিবার রৌনককে দেখানো উচিত ! রৌনকের দিকে ফিরে বললো — একটা জিনিস দেখাবো তোকে । এক্ষুনি আসছি ।

বলে বেডরুমের দরজা খুলে ঘরের ভিতর থেকে বের করে নিয়ে এলো খামটা । রৌনক হাত বাড়িয়ে খামটা নিলো তার হাত থেকে । আলিশা বললো — এতে একটা ফোটো আছে , ওদের তিনজনের । দেখ… বলে রৌনকের পিছন থেকে সেও চেয়ে রইলো খামটার দিকে । রৌনক ফোটোগুলোর মধ্যে থেকে তিনজনের ফোটোটা বের করে নিয়ে এলো । আলিশা বললো — বলতো ঈশা কোনজন ?

— এটাই হবে , কজ বাকিগুলোতে ওই রয়েছে ছেলেটির সাথে । এ কে ! মেয়েটির ফিয়ান্সে নাকি !

— হুম ! আর এটা হলো এনা । টুইন্স এরা , বাট দেখ কোনো মিলই নেই চেহারায় । এমনকি… স্বভাবেও দুজন একেবারেই আলাদা ।

— এমন হয় । আমিও দেখেছি এরকম । বলে ওঠে রৌনক ।

— একেই এরকম কমপ্লিকেটেড একটা কেস , তার ওপর এই কেসটায় আমার মাথার ওপর আবার জুটেছে এক রাইভাল !

— সে আবার কে ?

— এসিপি সাহেব । উনিও এই কেসটা ইনভেস্টিগেট করছেন । প্রবাবলী ওনার ওয়াইফ নিজের ইনফ্লুয়েন্সই ওনাকে হায়ার করেছেন । আমি শিওর নই , বাট আই ফেল্ট লাইক ! তুই ঠিক বুঝতে পারছিস না । এই কেসটা খুব অদ্ভুত । তার ওপর সে লোকটাও তেমনই অদ্ভুত ! কি অকারণ ইগো ! ভীষণ বিরক্তিকর লোক ! ওর থেকে কোনো হেল্প আমি পাবোনা বলেই ধরে রেখেছি । তবু কাল একবার থানায় যাবো ।

— ইগো টিগো তো শুনেছি প্রেম ট্রেম করলে হয় । তোরা কি বাই এনি চান্স ! রৌনক হাসতে হাসতে বলে উঠলো ।

— রৌনক ! বাজে ইয়ার্কি বন্ধ করে কেসটা নিয়ে একটু ভাব । আমি সেই জন্যই এলাম তোর সাথে কথা বলতে । হেল্প কর মাথাটা হালকা করতে !

— ওকে । দেখ , আমি যেটুকু বুঝলাম … তুই অনেকগুলো মোটিভের মাঝে আটকে গেছিস । কোন মোটিভটা সবচেয়ে বেশি জোরালো… সেটা ঠিক বুঝতে পারছিসনা । আমি তোকে কিভাবে হেল্প করবো জানিনা । তোর মত করে সূক্ষ সূক্ষ্ণ ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে রহস্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছনো আমার পক্ষে সম্ভব নয় । তবে একটা কথা আমি তোকে বলতে পারি । এই কেসটা সলভ কেউ করতে পারলে… সেটা তুইই পারবি । আর অকোয়ার্ড কোথাও একা যাওয়ার থাকলে আমাকে জানাস , বডিগার্ড হয়ে সঙ্গে যাবো । আর কোনো হেল্প লাগলে বলিস ।

— থ্যাংকস রৌনক । কাল থানায় যাবো , তারপর ঈশার মায়ের সাথে একবার…. না , কাল না , মিসেস বাগচীকে পরশু মিট করবো । কাল যাবো আলেখ্যর বাড়ি । আলেখ্যর সাথে কথা বলার পর এনার সাথে কথা বলবো ।

— অফিস অফ করবো ?

— না না , কাল এসব জায়গায় আমি একাই যাবো । সত্যিই কোনো অকোয়ার্ড জায়গায় যেতে হলে বলবো তোকে ।

— ওকে ।

— চল গুড নাইট ।

আলো নিভিয়ে শুতে চলে গেল দুজন । আলো নিভে যেতে অন্ধকার ঘরের দেওয়াল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো রাস্তায় জ্বলতে থাকা ল্যাম্প পোস্টের নরম আলো… চুপিসারে ।

সকাল সকাল আজ আলিশাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে দিয়েছে রৌনক । উঠে ঝটফট তৈরি হয়ে নিলো আলিশা । দুটো ব্রেড কোনোরকমে গলাদ্ধকরণ করে দৌড়োলো ক্যাব ধরতে । এখন তার প্রথম গন্তব্য… থানা ।

ইয়াং অফিসারটির নাম এসিপি রুপম দেবরায় ।দরজার গায়ে জ্বলজ্বল করছে তার নাম । তার সামনে গিয়ে যখন দাঁড়ালো সে ফোনে ব্যস্ত ছিল । ইশারায় বসতে বললো আলিশাকে । আলিশা বসে পড়লো একটা চেয়ারে । ফোন শেষ করে আলিশার দিকে ফিরলো রুপম দেবরায় ।

— বলুন আলিশা ।

— যেগুলো দেখবো বলেছিলাম কাল , ওগুলো রেডি আছে ? সময় নষ্ট না করে কথাগুলো বললো আলিশা ।

— আপনি , এতো আগে আসবেন জানলে করে রাখতাম । এখন তো একটু অপেক্ষা করতে হবে আপনাকে । রুপম বলে উঠলো ।

— কতক্ষন ?

— এই আধা ঘন্টা ধরুন !

— ওকে । আমি বাইরে ওয়েট করছি । রেডি হলে আমাকে ডাকবেন তাহলে !

— আপনি…. বসতে পারেন এখানেই । চা কফি নেবেন কিছু ?

আলিশা তাকালো সোজাসুজি । ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে তুলে বললো — না অফিসার , আমি বোধহয় বাইরেই স্বচ্ছন্দ বোধ করবো ।

বলে উঠে দাঁড়ালো সে । রুপম বলে উঠলো — এজ ইউ উইশ !

ব্যাগ কাঁধে আলিশা বেরিয়ে এলো বাইরে । ঠিক এমন সময়ে একটা ফোন এলো আলিশার ফোনে । স্ক্রিনে ফুটে উঠছে মিস্টার বাগচীর নম্বর । আলিশা কানে চাপলো যন্ত্রটা — বলুন মিস্টার বাগচী !

একটু থেমে মিস্টার বাগচী বললেন — আমাকে আঙ্কল বলতে পারো । আমার মেয়েদের বয়সীই হবে বোধহয় তুমি ।

— নিশ্চয়ই আঙ্কল । বলুন !

— আজ বাড়ির চাকরটা খুন হয়ে গেল । এইমাত্র দেখে এলাম… রান্নাঘরের মেঝেতে রক্তে ভাসছিল । অদ্ভুত গলায় কথাগুলো বলে উঠলেন ভদ্রলোক । আলিশা বেশ বুঝতে পারছে তাঁর মানসিক অবস্থা ! সে বলল — এই মাত্র ?

— হ্যাঁ , তাই তো ফোনটা করলাম । আমার মিসেস বোধহয় থানায় জানাচ্ছে ! তুমি আসবে তো ?

এক দিনের মধ্যেই ভদ্রলোক আলিশার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন । আলিশা বললো — আমি এখনই আসছি আঙ্কল ! আমি থানায় এসেছিলাম..
ইশার ব্যাপারে কথা বলতে আর কিছু এভিডেন্স দেখতে । এই কাজটা সেরে নিয়ে আমি পৌঁছে যাচ্ছি কিছুক্ষনের মধ্যে । আর পুলিশও নিজের কাজ ঠিক ই করবে । এখন রাখি ! আমি পৌঁছে যাবো ।

— ঠিক আছে । বলে ফোনটা কেটে দিলেন কুশল বাগচী ।

ফাইলগুলো রেডি করে ডাক পাঠালো রুপম দেবরায় । অওটোপসি রিপোর্টটা একটু আগেই এসে পৌঁছেছে । দেখছে রুপম দেবরায় । হাতঘুরে সেটা এবার আলিশার হাতে এসে পৌঁছলো । আলিশা খুঁটিয়ে পড়লো রিপোর্টটা । অদ্ভুত রিপোর্ট !

আলিশার মৃত্যুর কারণ এখানে একটি নয় বরং দুটি । ছুরির আঘাতের সাথে সাথে আরো একটি কারণ লেখা রয়েছে সেখানে । আলিশা চোখ তুলে রূপমের দিকে তাকায় । রুপমের দৃষ্টিও এই মুহূর্তে তারই হাতে ধরে থাকা কাগজটার দিকে । রুপম এবার তার দিকে তাকিয়ে বলল — কিছু বুঝলেন ?

আলিশা কিছু বললো না । মৃত্যুর সময় দেড়টার আশেপাশে… মনে মনে বিড়বিড় করলো শুধু ! রুপম বললো — কেসটা যতটা সহজ ভাবছিলাম , ততটা ঠিক নয় বলে মনে হচ্ছে । ওই বাড়িতে আজ আরও একটা মার্ডার হয়েছে । আমি এখন ওখানেই বেরোবো , আপনি কি আসবেন ?

— আর বাকি এভিডেন্স গুলো ? ওগুলো যে দেখা হলো না ! বললো আলিশা ।

— আমি সাথে নিয়ে নিচ্ছি , গাড়িতে যেতে যেতে দেখে নিন । আসুন ! আর দেরি করা যাবেনা ।

এসিপির গাড়িতে বসে ফাইলগুলো দেখতে শুরু করলো আলিশা । ঈশার নখের ফাঁকে যে ডেব্রিস পাওয়া গিয়েছিল… সেটার ডিটেইলস রিপোর্ট লিখেছে । খুঁটিয়ে পড়লো আলিশা । কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলো জানলার বাইরে তাকিয়ে !

রিপোর্টের বাকি অংশে চোখ বোলাতে বোলাতে… একটা ছবিতে চোখ আটকে গেলো তার ।ক্রীমরঙা দেওয়ালের নিচের দিক জুড়ে এবং মেঝের কিছুটা জায়গা জুড়ে কালচে রঙের ছোপ । কিন্তু কেন ? ঘরের প্রত্যেকটা জিনিষ নিখুঁত ভাবে সাজানো , অর্থাৎ অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতেই সারা হয়েছে সবটুকু । ঈশার শরীরটা নির্মমতা আর নির্দয়তার সাক্ষী স্বরূপ পড়ে রয়েছে বিছানার ওপর… রক্তাক্ত ।

আলিশা কাগজটা থেকে চোখ সরিয়ে রুপম দেবরায়ের দিকে তাকিয়ে বলল — ইশার বডি বোধয় আজ রিলিজ করবে , তাই না ?

— হ্যাঁ , করার কথা তো কিছুক্ষনের মধ্যেই । কিন্তু ওদিকে চাকরটাও মার্ডার হলো । দেখা যাক… কখন কি হয় !

— তারপর একবার মর্গেও যাবো । ঈশাকে কাছ থেকে একটি বার দেখতে চাই আমি ।

— দেখুন ! দেখে যদিও কি বুঝবেন জানিনা ।

রূপমের জন্যে বরাদ্দ একখানা জিপসি গাড়ি । সে গাড়িতে শীতেও বেশ ঠান্ডা লাগে , কারণ হুড অফ করা তাতে । কলকাতা শহরে এমন অদ্ভুত গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়ানোর কারণ জানতে ইচ্ছা হলেও , আপাতত সেই ইচ্ছাকে দমিয়ে রাখলো আলিশা । মিস্টার বাগচীর ম্যানশনের সামনে পৌঁছলো ওদের গাড়ি ।

দরজা খুলে দাঁড়ালো এনা । তার চোখের তলায় কালিমার হালকা আভা.. চোখ এড়ালো না আলিশার । গতদিনের তুলনায় আজ তাকে বেশ বিষন্ন এবং শ্রান্ত দেখাচ্ছে ! রুপম বলে উঠলো — আপনার বাবা মা আর বাকিরা কোথায় ? ডাকুন সবাইকে ।

আলিশা কিছু না বলে পা বাড়ালো লিভিংরুমের ভিতরে । এনা বললো — বসুন , ডাকছি ।

— আপনিও আসবেন , আপনাকেও দরকার আছে…. আমার ! আলিশা এনার চোখে চোখে রেখে বললো ।

— হ্যাঁ , নিশ্চয়ই ।

বলে ভিতরে চলে গেল এনা । কিছু পরে একে একে সকলেই উপস্থিত হলো লিভিংরুমে । মিস্টার বাগচী আলিশা আর রুপমকে নিয়ে গেলেন বাড়ির কিচেনে । সুন্দর কিচেন…চারিদিকে রুচির ছাপ সুস্পষ্ট… তার মেঝেতে নিথর একটা শরীর বিস্ফারিত এবং যন্ত্রণাক্লিস্ট চোখদুটো মেলে স্থির হয়ে পড়ে রয়েছে । গলার কাছে জমে রয়েছে রক্ত । গলা থেকে গড়িয়ে রক্ত নেমে এসেছে সাদা ফরাসের ওপর । এখনো জমাট বাঁধেনি , অর্থাৎ ভোরের দিকেই হয়েছে খুব সম্ভবত । অত্যন্ত ধারালো কোনো অস্ত্র দিয়ে কেটে দেওয়া হয়েছে লোকটার গলার নলি । আলিশার মনে হলো… হতেই পারে খুনি একটি অস্ত্রই ব্যবহার করেছে দুটো খুন করতে ! অস্ত্রটা এখনো অবধি বেপাত্তা , ঠিক খুনির মতো বা হয়তো এখানেই কোথাও আছে , এই কিচেনেই ! সে কিচেনের স্ল্যাবের দিকে সরে গেলো… যেখানে বিভিন্ন মাপের অনেকগুলো ছুরি উডেন স্ট্যান্ডে একসাথে রাখা রয়েছে । অন্যকোথাও কোনোকিছুই ছড়ানো বা ছিটানো অবস্থায় পড়ে নেই ।

ঝোলা জ্যাকেটের পকেট থেকে নিজের গ্লাভসগুলো বার করে এনে দুই হাতে পরে নিলো সে সেগুলো ।ম্যাগনিফাইং গ্লাস টা বের করে আনলো । তারপর নিচু হয়ে ঝুঁকে দেখতে থাকলো ছুড়িগুলোকে… তার অনুসন্ধিৎসু চোখের ওঠা পড়া চললো কিছুক্ষন । তারপর দুই ভ্রুর মাঝে জমে উঠলো ঈষৎ গভীর ভাঁজ আর সেই সাথে তার ঠোঁটের কোণে একটা মৃদু হাসি খেলে গেল । সে গ্লাসটা আবার পকেটে চালান করে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালো । তারপর রূপমের উদ্দেশ্যে বলল — আমি এই ছুড়িগুলোকে ফরেনসিকে পাঠাতে চাই । সোর্সে আমার নামটা কাইন্ডলি মেনশন করে দেবেন ! আর একটা ব্যাপার… এই পার্টিকুলার ছুরিটা একটু আলাদা রাখার ব্যবস্থা করবেন ।

রুপম যেন সামান্য বিরক্ত ! বললো — আপনি নিজেই কথা বলে নিন না !

— ওহ , থ্যাংকস ফর দ্য এক্সিস অফিসার ! এটা হলে তো খুবই ভালো হয় । আলিশা মনে মনে বেশ খুশি হলো । একটা দুঃচিন্তা তার দূর হলো । সে ভেবেছিল ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের ব্যাপারে রূপমের কথাই হয়তো শেষ কথা ! ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টকে সবটুকু বুঝিয়ে দিয়ে আবার সে এসে বসলো মৃত চাকরটির পাশে । আঙুলের নখের ফাঁকে লক্ষ্য করছে কিছু । পাশ থেকে রুপম বলে উঠলো — ওটা বলে দিয়েছি আমি ।

ফরম্যালিটিস মিটিয়ে বডি নিয়ে যাওয়া হলে আলিশা এসে দাঁড়ায় লিভিংরুমে । সেখানে এখনো বসে বাড়ির সবাই । আলিশা বললো — এনা , আমি তোমার সাথে আলাদা ভাবে একটু কথা বলতে চাই । তার আগে আমি ইশার ঘরটা আরো একবার দেখতে চাই… এবং সেটা একা ।

এনা উত্তর দিলো — আসুন ! আমি নিয়ে যাচ্ছি ।

— না এনা , এখন তোমাকে লাগবেনা , আমি একা যেতে পারবো । তারপর তোমার সাথে কথা বলবো , ঠিকাছে ?

সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় ইশার ঘরে এলো আলিশা । ঠিক যা খুঁজতে সে এই ঘরে আজ এসেছে সেটা চোখে পড়তেই সেদিকে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সে….

বেশ কিছুক্ষণ পর নীচে নেমে এসে এনার সাথে একতলার একটা ঘরে এসে বসলো দুজন । দরজাটা বন্ধ করে দিলো আলিশাই । ঘরটা বেশ সাজানো গোছানো । শুধু কেউ থাকে কিনা সেটা বোঝা গেলোনা । এনা ড্রেসিং টুলের ওপর বসে পড়ে আলিশাকে একটা চেয়ার দেখিয়ে দিল বসার জন্য , বললো — বলুন কি জানতে চান ?

— আমি তোমার আর ইশার সম্পর্কের বিষয়ে কিছু জানতে চাই বা বলতে পারো… তোমার চোখে ঈশা ঠিক কেমন ছিল… সেটা জানতে চাই !

একটু চুপ করে থাকলো এনা । বিছানার উল্টো দিকের দেওয়ালে একটা বড়সড় স্মার্টটিভি আর তার ঠিক নীচে একটা খর্বকায়া কাবার্ডের ওপর রাখা তাদের দুই বোনের একখানা মাঝারি মাপের ফটো , ফ্রেমবন্দি । আলিশা দেখলো… সেই দিকেই চেয়ে আছে এনা । আলিশা তাগাদা দিলো আবার — বলো এনা !

— হুম ! বলে কথা শুরু করলো এনা — একই ক্লাস , একই স্কুল ছিল আমাদের । সেকশন ও খুব বেশি চেন্জ হতোনা । হালকা একটা রেষারেষি ছিল তাই ছোট থেকেই । বরাবর মনে হতো ওর থেকে আমাকে আরও ভালো করতে হবে । ওও হয়তো তেমনটাই ভাবতো ! ভালো রেজাল্ট করতো বরাবর । আমিও ভালোই করতাম । কিন্তু মাঝেমাঝে ও আমাকে বিট করে ফেলতো । রাগ হতো… তবে আমি শুনেছি সিবলিং রাইভালরি ইস ভেরি কমন নাও এ ডেজ ! এমনিতে আমরা ভালো বন্ধু ছিলাম । ক্লাস টেন পর্যন্ত খুবই ভালো বন্ধু ছিলাম আমরা ।

— আর তারপর ?

— তারপর… আমার অন্য অনেক বন্ধু হলো , ওরও নতুন নতুন বন্ধু হলো অনেক । ধীরে ধীরে আমরা ডিস্ট্যান্ট হতে থাকলাম ।

— আর কিছু ?

— মানে ? কি জানতে চাইছেন বলুন তো আপনি এক্সাক্টলি ?

— সবটুকুই… কোনো রাখঢাক না রেখে সবটা জানতে চাইছি এনা । তোমার বোন বা দিদির মৃত্যুটা কিন্তু স্বাভাবিক নয় ! খুনিকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব দিয়েছেন তোমার বাবা আমার ওপর । তোমাদের বাড়ির চাকরটাও যে অকারণে খুন হয়নি… সেটাও তুমি বুঝতেই পারছো । সুতরাং সবটা বলো । আলেখ্যকে তুমি কতটা চেনো এনা ? আলিশা বলে উঠলো এনাকে ঈষৎ চমকে দিয়ে ।

এনা উত্তর দিলো — ও আমাদের বাবার পার্টনারের ছেলে । ছোটো থেকেই চিনি ।

— ইশার সাথে ওর সম্পর্কটা কতদিনের ?

— বছর তিনেক কি চারেক হবে !

— কার তরফ থেকে এসেছিল প্রস্তাব ? বাবা মায়েরাই কথা বলে নিয়েছিলেন নাকি নিজেরা ?

— না…. ওরা নিজেরাই পছন্দ করেছিল দুজন দুজনকে । আমি প্রথমদিকে জানতাম না কিছু , পরে জেনেছি ।

— কার তরফ থেকে এসেছিল প্রস্তাব ?

— আলেখ্যই প্রপোজ করেছিল ঈশাকে , আমি অন্তত সেটুকুই জানি । ইশার ভার্শন এটাই ছিল ।

— ইশাকে দেখতে তোমার একদম উল্টো !

— ওকে দেখতে মায়ের মতো ছিল , আমাকে বাবার মতো দেখতে । বাই দ্য ওয়ে… আপনি আগের দিনেও এই কথাটা একবার বলেছিলেন , না ? কেন বলুন তো ! এই কথাটা বারবার কেন বলছেন ? রেগে বলে উঠলো এনা কথাগুলো । তারপর একটু চুপ করে থেকে বললো — সরি ! এভাবে বলাটা ঠিক হয়নি আমার , আমি জানি আপনি আপনার কাজ করছেন । কিন্তু ইশার মৃত্যুর জন্য আমি সত্যিই দায়ী নই । বাবা মায়ের মতো আমিও চাই আপনি ইশার খুনিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব , খুঁজে বার করুন মিস সোম !

সামান্য হাসলো আলিশা , বললো — ইটস অল রাইট ! আমি মনে করিনি কিছু । ইশার খুনি ধরা পড়বে শিগগিরই । শুধু তোমরা এভাবেই কোঅপারেট করতে থেকো । আজ আসি এনা । এখান থেকে মর্গে যেতে হবে একবার , ঈশাকে সামনে থেকে একবার দেখে আসি !

নীচে নেমে এসে সকলের কাছে বিদায় নিয়ে রূপমের গাড়িতে উঠে বসলো আলিশা । রুপম বললো — আপনার জন্যেই ওয়েট করছিলাম , দেরি করলেন এত !

— রিয়ালি সরি ! আচ্ছা , চলুন এবার ! যাওয়া যাক !

গাড়ি চলতে শুরু করলো । আলিশা প্রশ্ন করলো — এখান থেকে কতক্ষন লাগবে পৌঁছতে ?

||এরপর….. ||

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here