কয়েন,পর্ব_৪

0
631

কয়েন,পর্ব_৪
রহস্য_গল্প
পৃথা_সামন্ত_ঘোষ

মর্গে পৌঁছে রুপম জানালো — আজ বিকেলের আগে বডি রিলিজ করবে এরা । আপনার কি কাজ আছে এখানে , এখনই মিটিয়ে নিন । আপনি নিশ্চয়ই বিকেলে আর এদিকে আসবেন না !

— এখানে এসে আর কি করবো ? চলুন ভিতরে যাওয়া যাক তাহলে !

— হ্যাঁ চলুন । বলে গেট পেরোতেই পিছন দিক থেকে একটা গাড়ির শব্দ ভেসে এলো কানে । দুজনেই দাঁড়িয়ে পড়ে পিছন ফিরে দেখলো… ড্রাইভারের সিট থেকে একজন যুবক নেমে আসছে কালো রোদচশমায় নিজের চোখদুটোকে ঢেকে । নেমে হেঁটে আসছে তাদেরই দিকে । আলিশা চেয়ে রইলো সেই আগন্তুকের দিকে । যুবক কাছে এসে পরিচয় দিলো নিজের — নমস্কার , আমি আলেখ্য । ঈশা…. আমার ফিয়ান্সে ছিল । আপনি তো বোধহয় আলিশা সোম… ঠিক বলছি ?

— কিকরে জানলেন ? আমাকে চেনেন আপনি ?

— যেটুকু চিনলে সামনে থেকে চিনতে পারা যায়… সেটুকু অবশ্যই চিনি । পেপারে দেখেছি আপনার নাম , সেই সাথে ছবিও ।

— বাহ ! ভালো লাগলো শুনে । কিন্তু আপনি এখন এখানে…. কোনো দরকার ?

রুপম বেশ কিছুক্ষণ উশখুশ করতে করতে এবার বলে ওঠে — হ্যাঁ , কিন্তু আপনি এখন এখানে কেন ? বডি তো বিকেলের আগে রিলিজ করবে না ! সেটা জানতেন না !

— জানতাম , জেনেই এসেছি । আজ দুপুরের ফ্লাইটে আমাকে একটু মুম্বাই যেতে হচ্ছে । একটু চুপ করে থেকে বলে ওঠে — ওর সাথে আর তো দেখা হবে না… তাই এইসময়টায় এলাম । ভাবলাম এখন তো কেউ আসবেনা !

আলিশা কিছু বললো না । রুপম বললো — কতোদিনের জন্যে যাচ্ছেন কলকাতার বাইরে ?

— তিনদিন ।

— আলেখ্য ! আলিশা উচ্চারণ করলো নামটা । বললো — আমি আজ একবার আপনার সাথে বসতে চাইছিলাম । আপনার ফ্লাইট কখন ?

— ওই চারটে পঞ্চাশ নাগাদ । বাড়ি থেকে আড়াইটার মধ্যে বেরিয়ে পড়বো ।

নিজের কব্জি উল্টে সময় মাপল আলিশা । বললো — তাহলে তো বসা যেতেই পারে , এখন সবে সাড়ে এগারোটা বাজে । চলুন এখানকার কাজটা মেটাই , তারপর আপনার বাড়ি ।

— এখন বাড়ি যাবেন ! এখানেই কোথাও বসে যাওয়া যেতো !

— না আলেখ্য ! আমি যেখানে সেখানে যেকোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে ঠিক পছন্দ করিনা । বলতে পারেন.. এটা আমার প্রোটোকল !

— ঠিক আছে । চলুন তাহলে !

মর্গের ভিতর প্রবেশ করলো তিনজন । হিমশীতল ঘরের বারো নম্বর ড্রয়ার টেনে খুলে দিয়ে সরে গেল একজন স্টাফ । তার ভিতর রক্তশূন্য নিথর হয়ে শুয়ে আছে ঈশা । আলিশা চেয়ে রইলো তার দিকে । পাশ থেকে আলেখ্যর চাপা ফোঁপানোর আওয়াজ আসছে কানে । আলিশা ফিরলো তার দিকে । দেখলো… আলেখ্যর চোখদুটো লাল হয়ে ফুলে উঠেছে । সে বললো — আপনি বাইরে অপেক্ষা করতে পারেন । কারণ আমি ইশাকে আরেকটু ভালোভাবে অবসার্ভ করবো একবার । আপনি এমনিতেই মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়তো… আরও বেশি খারাপ লাগতে পারে… ঈশাকে সামনে থেকে এভাবে দেখলে !

— না আলিশা , আমি ঠিক আছি । বলে চোখদুটো মুছে ফেললো আলেখ্য ।

সব কাজ গুছিয়ে ওরা বেড়িয়ে পড়লো বাইরে । রুপম চলে গেলে আলেখ্যর সাথে রওনা হলো আলিশা আলেখ্যর বাড়ির দিকে । চুপচাপ ড্রাইভ করছে আলেখ্য । অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে একটা চওড়া কালো গেটওয়ালা একটা দুধসাদা বাড়ির সামনে দাঁড়ালো গাড়িটা । হর্ন বাজাতেই দারোয়ান দরজা খুলে দিয়ে সরে দাঁড়ালো এক পাশে । গাড়ির পথটুকুর দুপাশে সবুজ ঘেরা লন , তাতে ফুটে আছে রঙবেরঙের গোলাপ , থোকা থোকা গোলাপ ফুটে আছে গোটা বাগানটা জুড়ে । একজন মালি উবু হয়ে বসে মাটি আলগা করছে খুব মনোযোগ দিয়ে । গাড়ির শব্দে সে ফিরে দেখলো একবার । গাড়িবারান্দার নীচে এসে গাড়ি থামালো আলেখ্য । দুজন নেমে এলো একসাথে । আলেখ্য বললো — আসুন !

মিস্টার বাগচীর ম্যানশনের প্রায় আড়াইগুন আলেখ্যদের এই ম্যানশন । আলিশা পা রাখলো বাড়ির সিঁড়িতে । বাড়িতে ঢুকেই… চিৎকার করে সে ডাকলো তার মাকে । একটু পরেই দোতলা থেকে নেমে এলেন একজন মধ্য পঞ্চাশের রূপসী মহিলা । আলেখ্যর সাথে মুখের আদল মিলে মিলে যায়… ইনিই আলেখ্যর মা ।

— মা , ইনি আমার সাথে কথা বলবেন বলে আমাদের বাড়ি এসেছেন । ওঁকে ছাদে নিয়ে গিয়ে কথা বলি !

— কি বিষয়ে কথা বলবেন ? ঠিক চিনলাম না তো একে ?

— আলিশা সোম , ডিটেক্টিভ । ইশার কেসটা দেখছেন । আঙ্কল ওঁকে হায়ার করেছেন ।

— ওহ ! ঠিকআছে… আলিশাকে দেখতে দেখতে বললেন ভদ্রমহিলা ।

আলিশা সৌজন্যসূচক একটু হাসি ছুঁড়ে দিলো তাঁর দিকে । তারপর আলেখ্যর পিছন পিছন উঠে এলো তাদের ছাদে । ছাদের উপর একটা গদি মোড়া দোলনা লাগানো । অন্যদিকে বসার ছোটো আয়োজন ও রয়েছে । একটা ছোট চৌকোনা টেবিল আর তিনটে চেয়ার পাতা । সেখানেই বসতে বললো আলেখ্য তাকে । নিজেও বসলো তার উল্টোদিকে , মুখোমুখি ।

— বলুন ! কিভাবে সাহায্য করতে পারি ! আমার বাড়ির অবস্থাও কাল থেকে ইশার বাড়ির মতোই বলতে পারেন । মা , বাবা সকলেই ঈশাকে ভীষণ ভালোবাসতো । ইশার মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছে ওরাও ।

— বুঝতে পেরেছি সেটা । আপনার কথা বলুন । কি কাজে যেতে হচ্ছে মুম্বাই ?

— ব্যবসার কাজেই যাচ্ছি । জানি , এই সময়ে শহরের বাইরে থাকাটা দৃষ্টিকটু , কিন্তু কিছু করার তো নেই আমার ! বাবার বয়স হয়েছে , এখন সব দায়িত্ব আমার ওপর ।

— ঠিক । ইশার সাথে শেষ কখন কথা হয়েছিল ?

— ওইদিন রাতে । আমাদের এনগেজমেন্ট হলো । বাড়ি ফেরার পর ফোন করেছিলাম , তখন ।

— কটা নাগাদ ?

— সাড়ে বারোটা কি একটার আশেপাশে । এক মিনিট , আমি চেক করে বলছি । বলে নিজের ফোনটা ঘাঁটতে লাগলো সে । একটু পরে বললো — একটা বাজতে দশ নাগাদ কল করেছিলাম । কল ডিউরেশন ষোলো মিনিট শো করছে ।

— বেশ । নিশ্চয়ই দারুন খুশি ছিল ঈশা সেদিন ! ছোটবেলার প্রেম বিয়েতে পরিণতি পাচ্ছে… !

— হ্যাঁ , খুশি ছিল । কিন্তু ও আমাকে কিছু একটা বলবে বলেছিল । আমি তখনই কথাটা বলতে বলেছিলাম ওকে । ও বললো অন্য দিন বলবে । ওই মুহূর্তটা ও নষ্ট করতে চায়না । দেখুন , আর শোনাই হলো না সেটা ।

আলিশা একটু চুপ করে থেকে কি যেন চিন্তা করছে । একটু পরে বললো — ঈশা কি খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে ছিল ?

— তা কিছুটা ছিল । সকলের সাথে মিশতো , কিন্তু খুব গভীরে নয় । নিজের সমস্যার কথা চট করে শেয়ার করতো না কারো সাথে ।

— আর আপনার সাথে ?

অল্প সময় নিয়ে আলেখ্য বললো — আমাকে ও খুব বিশ্বাস করতো । বোধহয় আমাকেই একমাত্র সব কথা বলতো ! কি বলতে চেয়েছিল… কে জানে ! ছোট্ট একটুকরো দীর্ঘশ্বাস ছিটকে এলো আলেখ্যর কথাগুলোর সাথে ।

— এমনি দিনে যাতায়াত ছিল ওর বাড়িতে আপনার ? যেতেন নিশ্চয়ই মাঝেমধ্যে !

— খুব কম । আমরা বাইরেই মিট করতাম বেশি । বাড়িতে তেমন একটা যেতাম না , ঈশা পছন্দ করতো না ।

— কেন ? কারণ কি ছিল ?

— ঠিক জানিনা । আসলে আমি জানতে চাইনি কোনোদিন । কারণ… কেন জানিনা মনে হতো… ও যেটা করে… সেটা ভালোই করে ! আমি তাই জোর করিনি কোনোদিন ।

— হুঁ । ওই বাড়িতে আপনার আরো একজন বন্ধু থাকেন তো ! তার সাথে কেমন সম্পর্ক আপনার ?

— এনার কথা বলছেন ?

— হ্যাঁ ।

— এনাও ভালো মেয়ে । তবে ইদানিং ইশার সাথে ওর দূরত্ব তৈরি হয়েছিল কিছুটা । সেটা অবশ্য এনা বলেনি , বলেছিল ঈশা ।

— দুরত্বটার কারণ কি ছিল বলে মনে হয় আপনার ?

— আসলে কিছুই না হয়তো সেটা… সিবলিং রাইভালরি বলে এটাকে । আমি যেমন বাবা মায়ের এক ছেলে… আমার কোনো রাইভাল নেই । ভালোবাসা ভাগ করতে হয়নি কোনোদিন । ওদের ক্ষেত্রে সেটা হয়েছে । ঈশা পড়াশোনায় বরাবরই ভালো ছিলো । ফার্স্ট হতো প্রতি বছর । এনাও ভালোই করতো , কিন্তু ঈশাকে বিট করতে পারতো না । আঙ্কল প্রতিবছর ইশার রেজাল্টের অনারে পার্টি থ্রো করতেন । এনাও উপস্থিত থাকতো সেখানে । তবে চুপচাপ এক কোনে বসে থাকতো দেখতাম । আঙ্কল ওকেও বলেছিলেন… ইশার মতো রেজাল্ট করলে ওর অনারেও পার্টি থ্রো করবেন । চেষ্টা করেও এনা করতে পারেনি সেটা । আন্টিও দেখতাম বরাবর ইশাকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন । ঈশা কি খাবে , কি করবে… সব বিষয়েই ওনার কথাই ছিল শেষ কথা । ইশার পর এনার টার্ন আসতো । ফ্যামিলি ফটোগ্রাফ তোলার সময়েও ঈশা আন্টির পাশে আর এনা থাকতো আঙ্কলের পাশে । আন্টি ইশাকে একটু বেশিই প্যাম্পার করতেন , এনা সেটা পেতনা । ধীরে ধীরে এনা নিজের ফ্যামিলি থেকে ডিট্যাচড হয়ে গেল । ইশার সাথে ওর দূরত্ব বাড়তে শুরু করলো ।

— আপনার সাথে কথা হয় ওর ? আপনি তো ওরও বন্ধু !

— খুব একটা না । ও ওর নিজস্ব সার্কেলের মধ্যেই ভালো থাকে ।

— যাই হোক ! দেখুন আলেখ্য ! ইশার মৃত্যু হয়েছিল দেড়টার আশেপাশে । আপনার সাথে কথা বলার ঠিক আধ ঘন্টা পরে । শ্বাসরোধ হয়ে এবং ছুরির আঘাতে মৃত্যু হয়েছিল ওর । পাশের ঘরে থেকেও এনা কোনো চিৎকার শোনেনি , শোনেননি একই তলায় থাকা মিস্টার এবং মিসেস বাগচী ! আজ বাড়ির চাকর হঠাৎ খুন হয়ে গেল । সবটা কেমন সাজানো বলে মনে হচ্ছে না !

— আপনি এসব কথা আমাকে কেন বলছেন ?

— বলছি , তার কারণ… ইশার মৃত্যর কারণ হিসেবে আপনার নামটাও হয়তো উঠে আসতে পারে যখন তখন ! তার জন্যে নিজেকে কিন্তু প্রস্তুত রাখবেন @

— আমার নাম ? চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো আলেখ্য । তার দুই চোখে অবিশ্বাস দানা বাঁধছে ।

— এখনই এত উত্তেজিত হলে চলবে আলেখ্য ? বসুন !

আলেখ্য দুই হাত নিজের পকেটে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো — ঈশাকে আমি ভালোবাসতাম । ইনফ্যাক্ট আজও বাসি । ওকে খুন করার মত কোনো কারণই কোনোদিন ছিল না । তাই আপনার কথাগুলো আমি সত্যিই সিরিয়াসলি নিলাম না আলিশা । আপনি হয়তো জানেননা , আমার মা কি দিয়ে ওকে আশীর্বাদ করবে… সেটা অবধি কেনা হয়ে গিয়েছিল । ওর মৃত্যুর পর শোকের ছায়া একইরকম ভাবে নেমে এসেছে এই বাড়িতেও ।

উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো আলিশা । বললো — বেশ ! মেনে নিলাম আপনার কথা । তাহলে ঈশাকে ভালোবেসে একাই কাটিয়ে দেবেন তো বাকি জীবনটা ?

আলেখ্য একটু দূরে ঝুলতে থাকা দোলনাটার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো — আমার তো তাইই ইচ্ছা !

সামান্য হাসলো আলিশা । তারপর ছাদের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলো । আলেখ্যও নেমে এলো তার সাথে । ঘড়ির কাঁটা এখন ঠিক দুটোর ঘরে পৌঁছেছে । আলিশা বিদায় নিলো । একটা ক্যাবে উঠে বসে সে কল করলো রূপমকে — হ্যালো , একটা ইনফরমেশন জোগাড় করতে হবে । হেল্প করবেন ?

— কি ?

— চারটে পঞ্চাশে মুম্বাই যাওয়ার ফ্লাইটের প্যাসেঞ্জার লিস্ট টা একটু দরকার ছিল , আলেখ্য আজ সত্যিই মুম্বাই যাচ্ছে কিনা… জানাটা দরকার ।

— ওকে , হয়ে যাবে । জানাচ্ছি । বলে ফোন কেটে দিলো রুপম ।

রুপম লোকটা ততোটাও খারাপ নয় , যতটা আলিশা তাকে ভেবেছিল.. সে রৌনককে কল করলো একটা । টুকটাক কথা বলে ফোনটা রাখতেই টুং শব্দে একটা মেসেজ ঢুকে পড়লো ফোনের ভিতর ।

★■◆●

চাকরটির নেইল ডেব্রিসের ডি এন এ রিপোর্ট এসে পৌঁছেছে আজ । সেই সাথে বাকি জিনিসের ফরেনসিক রিপোর্ট । ডি এন এ রিপোর্ট অনুযায়ী যার কথা উঠে আসছে… তিনি হলেন ত্রিদিববাবু । কিন্তু ইশার ঘর থেকে উদ্ধার করা ফিঙ্গারপ্রিন্ট গুলো কোনোটাই ওঁর নয় ! সেই ফিঙ্গারপ্রিন্টগুলো সবগুলোই… এনার । কিচেন স্ল্যাবের ছুড়িগুলোর মধ্যে একটা ছুরিতে ব্লাডস্ট্রেইন পাওয়া গেছে , কিন্তু… কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায়নি তাতে । ছুরিতে যে ব্লাডস্ট্রেইন পাওয়া গেছে , সেটা মৃত চাকরটির ।

মাথাটা এলোমেলো হয়ে যায় আলিশার । এই কেসটা তাকে এভাবে দূর্বিপাকে ফেলবে… কিছুক্ষন আগেও সেকথা বুঝতে পারেনি সে ! রিপোর্টগুলো দেখে সে নিজের মাথাটা দুই হাতে খামচে ধরে বসে রইল কিছুক্ষণ । রুপম বললো — আপাতত দুজনকেই কাস্টডিতে নিয়ে নিচ্ছি । এরাই হলো প্রাইম সাস্পেক্ট । বুঝলেন ?

কোনো উত্তর দেয়না আলিশা । একভাবে বসে থাকে মাথা নিচু করে ।

থানা থেকে বেরিয়ে যায় রূপমের হুড খোলা জিপসি টা ধুলো এবং ধোঁয়া উড়িয়ে । আজ আলিশা কুশল বাগচীর বাড়ির পথ না ধরে নিজের বাড়ির পথ ধরে । তার মস্তিষ্কের গভীরে অনেকগুলো প্রশ্ন জমেছে । সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বার করা ভীষণ রকম প্রয়োজন । বাড়ি পৌঁছে দরজার লক খুলতেই সেলফোনটা বেজে উঠলো… মিস্টার বাগচী যে ফোনটা করবেন… আন্দাজ করেছিল আলিশা ।

— আলিশা ! এসব কি ? এরা এনাকে কেন নিতে এসেছে ? আমার ভাই কেই বা কেন….

— যা হচ্ছে হতে দিন আঙ্কল ! এনার ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যাচ করে যাচ্ছে সাসপেক্টের সাথে আর ত্রিদিববাবুর সাথে ম্যাচ করছে আপনার চাকরটির আঙ্গুলের নখে জমে থাকা ডব্রিসের ডিএনএ রিপোর্ট । এখানে আমার কিছুই করার নেই ।

— আমার এক মেয়ে আরেক মেয়েকে খুন করেছে… এটাই মেনে নিতে হবে শেষ পর্যন্ত ?

— দেখুন , এখন কিছুই এভাবে বলা সম্ভব নয় । এটা সত্যি হতেও পারে আবার নাও হতে পারে । আমি আপনাকে একটা কথাই এখন বলবো… এর বাইরেও হয়তো কিছু সত্যি রয়েছে , যেটা এখনও ঢাকা পড়ে রয়েছে অন্ধকারের চাদরে । সবটা পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত আমি কিছুই বলতে পারবো না মিস্টার বাগচী !

— এনা তাহলে ঐ পুলিশ স্টেশনেই থাকবে এখন ?

— আগামীকাল সকালের আগে তো আর কিছু সম্ভব নয় ! বেল তো তার আগে আর সম্ভব নয় , তাই না ? আপনি বরং আপনার ল ইয়ারের সাথে আজ কথাটা বলে রাখুন , যাতে আগামীকাল এনার বেল টা উনি করে দিতে পারেন ।

— তাই করি !

— আর ত্রিদিব বাবু ! ওঁর কি হবে ?

— ও কি সত্যি মেরেছে রাজুকে ? কিন্তু কেন মারলো ? আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা !

— ধৈর্য্য হারালে তো চলবে না আঙ্কল ! আচ্ছা , একটা কথা আমাকে বলুন তো ! ঈশা বা এনাকে কি মোটা টাকা পকেট মানি দিতেন আপনি ?

— প্রতি মাসে একটা এমাউন্ট আমি ওদের দুজনের ব্যাংকে জমা দিতাম । অটোমেটিক ট্রানযাক্ট হতো । কিন্তু কেন বলতো ? কেন জানতে চাইছো ?

— সেই টাকার কোনো হিসেব আপনি নিশ্চয়ই কোনোদিন চাইতেন না !

— ঈশা নিজেই এসে হিসেব করতে বসতো আমার কাছে । এনা সেভাবে হিসেব দেয়নি কোনোদিন । যদিও আমি দুজনের কারো কাছেই কোনোদিন হিসেব জানতে চাইনি ।

— আপনি জানতেন , গত বছর ত্রিদিব বাবুকে তাঁর ছেলে সোহমের জন্যে ল্যাপটপ কিনে দেওয়ার জন্যে ঈশা ত্রিশ হাজার টাকা দিয়েছিল ! বলেছিল ঈশা এটা আপনাকে ?

— না , আমি তো জানিনা ! আমাকে না জানিয়ে এতগুলো টাকা দিয়ে দিল ? ত্রিদিবের প্রয়োজন হলে আমার কাছে চাইতে পারতো ! আমি তো সাহায্য করি ওদের !

— আপনি একটা কথা বোধয় আমাকে সত্যি বলেননি আঙ্কল !

— কি সত্যি বলিনি ?

— ত্রিদিব বাবুর মুখে শুনলাম উনি আপনার খুব কাছের কোনো আত্মীয়… অথচ আপনি আমাকে বলেছিলেন… উনি আপনার দূর সম্পর্কের আত্মীয় ! কেন ?

— একটা সময় খুব যাতায়াত ছিল ওদের বাড়ি । বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের সাথে থেকেওছি ওদের বাড়িতে বেশ কয়েক বছর । সেই সূত্রে আজও ওদের যে কোনো প্রয়োজন পড়লে আমিই ওদের সাহায্য করি , এতদিন তাইই তো করে এসেছি ! ও হঠাৎ ইশার থেকে কেন টাকা নিলো ?

— সেটাই জানার চেষ্টা করছি আঙ্কল । আমি কাল একবার আপনার বাড়ি যাবো । মিসেস বাগচীর সাথে কথা বলাটাও জরুরি !

— ঠিক আছে । ও তো বাড়িতেই আছে । খাওয়া দাওয়া বন্ধই করে দিয়েছে একরকম প্রায় ! জানিনা কি হতে চলেছে এই বাড়িতে ! কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা । ভেঙে পড়া স্বরে বলে উঠলেন কুশল বাগচী ।

— আমি এখন রাখছি আঙ্কল । সাবধানে থাকবেন , আমি কাল সকালে আসছি ।

ফোনটা রেখে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে রইলো আলিশা । জটগুলো ক্রমশ আরও জটিল হয়ে উঠছে যেন ! ঘটনাগুলোকে এক সুতোয় সাজাতে চাইছে সে , কিন্তু পারছেনা । সমস্তটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বারবার । রুপম দেবরায় আজ হয়তো খুব খুশি… কেল্লা মাত করে ফেলেছে বলে আনন্দের জোয়ারে ভাসছে হয়তো ! কিন্তু আলিশা জানে… এর বাইরে আরও কিছু সত্যি জানা বাকি থেকে গেছে , ঢাকা রয়ে গেছে পর্দার আড়ালে…. !

ত্রিদিব বাবু খুন করেছেন… কিন্তু কেন ? পুরোনো শত্রুতা ! যার কথা সেদিন বলেছিলেন তিনি ! কিন্তু খুন যদি তিনি করেই থাকেন… সেটা চাকরকে কেন করলেন ? ইশার ঘর থেকে পাওয়া এনার ফিঙ্গারপ্রিন্টস যেসব জিনিস থেকে পাওয়া গিয়েছিল… তার মধ্যে ছিল ইশার মোবাইল ফোনটাও । দরজার হাতলেও পাওয়া গেছে তার ফিঙ্গারপ্রিন্টস ! অর্থাৎ ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে… এনা ইশার ঘরে এসে খুন করলো ঈশাকে । তারপর তার ফোনটা তুলে নিলো নিজের হাতে । কিন্তু কেন ? আর তাই যদি হয়.. ত্রিদিব বাবু তার দুদিন পর চাকরটাকে খুনই বা কেন করলেন ! আর সেদিন কোথাও কোনো হাতের ছাপ কেন পড়লো না ! আলেখ্য আজ সত্যিই মুম্বাই যাচ্ছে কিনা… এখনও জানায়নি রুপম ।

এইসব ভাবতে ভাবতে আর শুয়ে থাকতে পারলোনা আলিশা । ডায়েরির বাকি পাতাগুলো সেদিনের পর আর ওল্টানো হয়নি । আলো জ্বালিয়ে সেটাই টেনে আনলো কাছে । দেখলো পরের পাতায় ঈশা লিখেছে ….

আলেখ্য আবার বাইরে গেছে । আজ ফেরার কথা ছিল , ফিরতে পারেনি । আটকে গেছে কাজে । ফোনটাও বন্ধ । লাস্ট মেসেজ পাঠিয়েছে..
ফোন অফ থাকলে চিন্তা কোরোনা , ফোনটা চার্জ আউট হয়ে গেছে । প্রায় তিন ঘন্টা টানা চেষ্টা করে যাচ্ছি.. পাচ্ছিনা । এনার বোধহয় একটা এফেয়ার হলো এবার ! দেখছিলাম হেসে হেসে কথা বলছে কারো সাথে ! অনেক্ষন ধরে । জিজ্ঞেস করতে এড়িয়ে গেল । বলবে হয়তো যখন ওর বলতে ইচ্ছা হবে !

পরের পাতায় লিখেছে…

আলেখ্য আজ আমাকে নিয়ে ডিনারে গিয়েছিলো । আংটিটা দেখালো । খুব সুন্দর দেখতে হয়েছে । দুবাই থেকে কিনে এনেছে এটা । আমাদের এনগেজমেন্টের দিন এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে । এসব কথা সেটাই মনে করিয়ে দিতে থাকে । কদিন পরে জীবনটা হয়তো বদলে যাবে আমার ! কলকাতার বাইরে যদি প্লেসমেন্ট হয়… আমাদের তখন হবে লং ডিস্ট্যান্ট রিলেশনশিপ । কে জানে… কি হবে তখন ! আলেখ্যর সাথে রোজ রোজ আর দেখা হবে না , মা , বাবা কেউ থাকবেনা কাছে !

এনা প্রেমটা সত্যিই করছে । আমাকে কিছুই বলছেনা । অনেক রাত পর্যন্ত আলো জ্বলতে দেখি ওর ঘরে । আলেখ্যর সাথে কথা শেষ করে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেই লাগোয়া ঘরের আলো ঠিক চোখে পড়ে । এনা ঘরের মধ্যে ঘুরেঘুরে কথা বলে ফোনে । কাল আমি আলেখ্যকে বলবো এটা । ওও নিশ্চয়ই খুশিই হবে শুনে !

বেল বাজছে , আলিশা ডায়রিটা মুড়ে রেখে দিল বিছানার পাশের টেবিলে । গিয়ে খুলেছে দরজা । সামনে দাঁড়িয়ে রৌনক , তার মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা । হালকা নীল শার্টের কলার আর কাঁধে রক্তের ছোপ । দু পা পিছিয়ে আসে আলিশা । ঘরে এসে দাঁড়ায় রৌনক ।

— কি করে হলো ? থেমে থেমে কথাগুলো বলে আলিশা ।

— বুঝতে পারলাম না । পিছন থেকে কেউ…. আমি পড়ে গেলাম রাস্তার মধ্যে ।

— কোথায় হলো ?

— এই তো বাড়ির কাছেই । সেন্স আসতে দেখলাম রাস্তার ওপর শুয়ে আছি আমি , আমার দিকে তাকিয়ে কতগুলো চেনা অচেনা মুখ । ওদের মধ্যে দুজন সাথে গেল , স্টিচ করিয়ে এই পৌঁছে দিয়ে গেল । কিন্তু কেন মারলো আমাকে… তোর কারনে নয় তো আলিশা ?

— তুই বস আগে । ওষুধ পত্র কি দিলো ? দেখি !

— কিনে নিয়েছি , নিয়ম করে খেয়ে নিতে হবে , ব্যাস ! আর একটু সাবধানে চলাফেরা করিস ! বলা যায়না কিছুই !

— শোন , একটা এফ আই আর করিয়ে নিই ,চল !

— আমি এখন আর পারছিনা আলিশা । মাথায় অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে রে , কাল নাহয় চল !

— তোকে একজন মারার চেষ্টা করলো , আর তুই এফ আই আর না করেই চলে এলি ! অদ্ভুত লোক তো তুই ?

— সব কিছুর সলিউশন প্রতিবাদ নয় । কিছু সময় ডাইজেস্ট করতেও শিখতে হয় ।

— খুব ভালো , আজ না গেলেও কাল যাবি । আমি আমার কোনো রিস্কে তোদের জড়াতে চাইনা ।

— ওকে… তাই হবে ।

ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে গরম করতে করতে জিজ্ঞেস করে আলিশা — কারোকে দেখতে পেলি না , না রে ?

— না , কিছুই দেখতে পাইনি আমি । ওই মুহূর্তে শুধু অন্ধকার নেমে এসেছিল চোখের সামনে । আর কিছু না ।

একটা মেসেজ এলো আলিশার ফোনে । রুপম দেবরায় পাঠিয়েছে আজকের কলকাতা – মুম্বাই ফ্লাইটের চেকলিস্ট । আলিশা ব্যস্ত হলো… আলেখ্য দাসগুপ্তর নামটা সেখানে আছে নাকি নেই… তার ওপর নির্ভর করে আছে কেসের গুটি সাজানো ।

|| এরপর ||

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here