কয়েন,পর্ব_৬

0
826

কয়েন,পর্ব_৬
বড়_রহস্য_গল্প
পৃথা_সামন্ত_ঘোষ

কাজের মেয়েটি বোধহয় হুকুমের অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষন । সুনন্দিতার ইশারায় সে উঠে গেল সিঁড়ি ভেঙে । সুনন্দিতা আলিশার দিকে ফিরে বললেন — আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা… আলেখ্য এর মধ্যে কিভাবে জড়িত ! ঈশা আলেখ্য ছোটবেলার বন্ধু ওরা । আর শুধু ওরা কেন , আমরা দুটো ফ্যামিলিই ভীষণ ভাবে ভালো বন্ধু । একজনের ক্রাইসিসে আরেকজন সবসময়েই এগিয়ে এসেছি আমরা । ঈশা আমার মেয়েই ছিল বলতে পারেন । আমার ছেলের সাথে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে.. আজ বহুদিন । এনগেজমেন্টের রাতে এমনকিছু হতে পারে চিন্তার অগোচরে ছিল সেটা । আলেখ্য বা আমরা কেউই সেদিন বাগচী হাউসে রাতে স্টে করিনি । তাহলে আলেখ্যর দিকে আঙ্গুল উঠছে কেন… ঠিক বুঝতে পারছিনা ।

— সেটারও কারণ আছে । আগে বলুন তো আলেখ্য এখন কোথায় ?

— ওর বাবার বিজনেস পারপাসে মুম্বাই গেছে , আমাদের অবর্তমানে সবটা ওকেই তো সামলাতে হবে !

— আপনি শিওর যে আলেখ্য মুম্বাই গেছে !

— মানে ! কি বলতে কি চাইছেন আপনি ?

— আমি যদি বলি আলেখ্য মুম্বাই যায় নি ! কলকাতাতেই কোথাও লুকিয়ে আছে ?

— আপনি যা বলবেন সেটাই বুঝি ধ্রুবসত্য বলে মেনে নিতে হবে ? বলছেন যে … কি প্রমান আছে ?

— নাহ , প্রমান সত্যিই নেই । আসলে আমি একটা গেস করছিলাম জাস্ট ! ভাবছিলাম হতেও তো পারে… আলেখ্য এই মুহূর্তে কলকাতাতেই রয়েছে !

— গেস !

— আজ্ঞে !

দেখা গেল সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসছেন মিস্টার দাশগুপ্ত , আলেখ্যর বাবা । আলিশা বসে বসে দেখলো… উনি নেমে এলেন , পিচন পিছন মেয়েটি । সোফায় বসতেই আলিশা নিজের দুইহাত জোর করে বলে উঠলো — নমস্কার মিস্টার দাশগুপ্ত ! আমি আলিশা সোম । ইশার কেসটা আমার আন্ডারে । আমি আজ এখানে কিছু প্রশ্ন করতে এসেছি.. কারণ আমি , একটু থেমে আলিশা আবার বলে — আমি নিজে আলেখ্যর নাম সাস্পেক্ট লিস্ট থেকে বার করে দিতে পারছিনা কিছুতেই ।

ভদ্রলোক কিছুক্ষন আমাকে দেখলেন । তারপর বললেন — আপনার ধারণা খুন টা আলেখ্য করেছে ?

— না , একেবারেই তা নয় । আমি শুধু চাইছি.. আপনারা আমাকে কো অপারেট করুন । দ্যাটস ইট !

— কি কো অপারেশন চাইছেন ! কিভাবে সাহায্য করতে পারি বলুন !

— বিজনেসের কাজে আলেখ্য কি সত্যিই বাইরে গেছে ?

সুনন্দিতা বিরক্ত স্বরে বলে উঠলেন — তখন থেকে এই প্রশ্ন করে চলেছে । কি আশ্চর্য্য ! একই প্রশ্ন আমাকেও করেছে । অদ্ভুত !

মিস্টার দাশগুপ্ত হাত দেখিয়ে থামালেন সুনন্দিতাকে । আলিশার দিকে ফিরে বললেন — আপনার কেন মনে হচ্ছে বলুন তো… আলেখ্য এই খুনের সাথে জড়িয়ে আছে ! আমার কিন্তু এটা একেবারেই এবসার্ড বলে হচ্ছে ! মনে হচ্ছে আপনি খুনিকে খুঁজে না পেয়ে আমার ছেলেকে টার্গেট করার চেষ্টা করছেন !

— বেশ , মেনে নিলাম । কিন্তু আলেখ্য এখন কোথায় ? মুম্বাই না কলকাতা ?

— মুম্বাই ! আমার অফিসের কাজে সে সেখানে গেছে।

— বেশ , ঈশার সাথে শেষ ওই দিনই দেখা হয়েছিল আপনাদের ?

— হ্যাঁ ।

— ঈশার ঘটনাটার পরে বাগচী পরিবারের সাথে আর কোনো যোগাযোগ হয়েছে আপনাদের !

মিস্টার দাশগুপ্ত কিছু বলতে যাচ্ছিলেন , আলিশা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো — আই হ্যাভ নট ইয়েট ফিনিশড মিস্টার দাশগুপ্ত ! এই প্রশ্নটা করছি , কারণ… ঘটনার পর ওই বাড়িতে বেশ কয়েকবার যাতায়াত করেছি আমি । মানে কাজের সূত্রেই আর কি ! আপনারা এতো ক্লোজ , আপনার ভাবী পুত্রবধূর এমন অকাল এবং দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু হলো , অথচ আপনাদের কারোকে সেইখানে একটি বারের জন্যেও দেখা গেল না কেন ?

মিস্টার দাশগুপ্ত গম্ভীর স্বরে উত্তর দিলেন — ঈশা আমার মেয়ের মতোই ছিল । তার মৃত্যু আমাকে একইরকম শোকস্তব্ধ করেছে । নিয়মিত কথা হয় কুশলের সাথে আমার , তবে সত্যি বলতে গিয়ে ওঠা হয়নি তেমন !

— একবারও কি গিয়েছিলেন ?

— ফিউনেরলের সময় ছিলাম তো , আমি , সুনন্দিতা সবাই ছিলাম । সেদিন আপনাকে তো দেখলাম না !

আলিশা অল্প হেসে প্রশ্নটা সযত্নে এড়িয়ে গিয়ে বলল — বেশ , তাহলে ভালো । জানি আপনারা ব্যস্ত মানুষ ! অনেক দায়িত্ব আপনাদের । তারই মধ্যে চেষ্টা করবেন হিউম্যানিটিটুকু বজায় রাখতে , এটা আমার তরফ থেকে ছোট্ট একটা সাজেশন বলতে পারেন । যদিও আমার মতো সাধারণ একটি মেয়ের মতামত নেওয়া বা না নেওয়া সম্পূর্ণ আপনার ব্যক্তিগত পছন্দ !

মিস্টার দাশগুপ্ত নিজের মাথাটা ওপর নীচে দুবার নেড়ে স্থির হয়ে গেলেন । সুনন্দিতা হঠাৎ বলে উঠলো — আপনার অন্য কোনো প্রশ্ন আছে ! আমাদের একটু বেরোতে হবে , একটু কাজ আছে ।

— অবশ্যই , আমার হয়ে গেছে । আপাতত আর কোনো প্রশ্ন নেই । ধন্যবাদ আমাকে নিজেদের মূল্যবান সময় থেকে সময় দেওয়ার জন্যে । আজ তাহলে আসি !

ম্যানশন থেকে বেরিয়ে এসে ক্যাবটা দেখতে পেলো আলিশা । কথার ফাঁকে বুকিং সেরে রেখেছিল সে , সময় বেশি নেই হাতে । ক্যাবটায় বসতেই চলতে শুরু করলো সেটা । শহরের রাস্তা বরাবর ছুটে একসময় নিউটাউনের রাস্তা ধরলো । নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে নেমে এলো আলিশা ক্যাব থেকে । দারোয়ানের দেওয়া এড্রেস অনুযায়ী খুঁজে খুঁজে পৌঁছে গেল বারো তলায় আলেখ্যর ফ্ল্যাটের দোর গোড়ায় । বার্নিশ করা কালো রঙের দরজাটায় সোনালী নেমপ্লেতে জ্বলজ্বল করছে আলেখ্য দাসগুপ্তর নাম । সরে এলো আলিশা , লিফট তাকে আবার পৌঁছে দিলো বিল্ডিংটার ছাদে । ছাদের একটা প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে বার করলো সে ফোনটা । কল করছে রুপম দেবরায়ের নম্বরে ।

— বলুন , কি খবর ? কোথায় আছেন ?

— আপনি বাগচীদের ওখানে গিয়েছিলেন ?

— হ্যাঁ , একটু আগেই ফিরলাম । আপনি কোথায় ?

— একটা এড্রেস একটু নোট ডাউন করে নিন । এক্ষুনি একবার আসতে হবে আপনাকে । বাই দ্য ওয়ে… রৌনকের কেসটা কতদূর এগোলো ? আর এনা আর ত্রিদিববাবুর বেল কি হয়ে গেছে ?

— এনাকে একটু আগে বেল করিয়ে নিয়ে গেছেন মিস্টার বাগচী , ত্রিদিববাবু কাল ছাড়া পাবেন ।

— ওকে ।

— আরে মশাই , একটু সবুর করুন ! এখন বলুন তো কোথায় আসতে হবে ?

— এড্রেসটা হোয়্যাটস্যাপে সেন্ড করছি । ফোর্স আনবেন তো সাথে ?

— কি ব্যাপার বলুন তো ? আপনি কি রহস্যের যবনিকা পতন করে ফেলেছেন নাকি ?

— অনেকটা । তবে আপনার সাহায্য প্রয়োজন ।

— হা হা হা ! শেষ অবধি এই অধমের প্রয়োজন পড়লো তাহলে ! এড্রেসটা পাঠান , পৌঁছচ্ছি । কোথায় জায়গাটা ?

— নিউটাউন । আলেখ্যর নিজের ফ্ল্যাট এটা । আমি ওর বিল্ডিংয়ের ছাদে দাঁড়িয়ে কথা বলছি । এবার ভিতরে যাবো , ব্যস্ত রাখবো ওকে । আপনি পৌঁছে যান তাড়াতাড়ি ।

— একদম ।

ফোনটা রেখে কয়েক পল দূরে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো আলিশা । তাজা বাতাস ফুসফুসে টেনে নিল প্রাণ ভরে । এবার সে নেমে আসছে নিচে , আলেখ্যর ফ্ল্যাট বারো তলায় ।

দরজায় বেল বাজার বেশ কিছুক্ষণ পর খালি গায়ে শর্টস পরা অবস্থায় ঘুম চোখে দরজা খুলে দাঁড়ালো আলেখ্য । সামনে আলিশাকে দেখে ঘুম ভাব ছুটে গিয়ে তার দুই চোখে ফুটে উঠেছে অপার বিস্ময় এবং কিছুটা ভয় !

— আপনি ! এখানে কিভাবে এলেন ? আমি আজই ফিরেছি মুম্বাই থেকে । ফিরে এই ফ্ল্যাটে একটু রেস্ট করছিলাম । আলেখ্য নিজের স্বপক্ষে যুক্তি সাজানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালালো ।

— চলে এলাম হঠাৎ ! ভিতরে আসতে বলবেন না ! নাকি না জানিয়ে দুম করে উপস্থিত হলাম বলে… বিরক্ত করলাম নাকি সমস্যায় ফেলে দিলাম !

— ইটস অল রাইট , আসুন । বলে সরে গেল আলেখ্য দরজা ছেড়ে ।

ফার্ণিশড ফ্ল্যাট , সবকিছুই রয়েছে । দেখে মনে হয় যেন… নিয়মিত যাতায়াত করা হয় এখানে । সোফায় বসতে বসতে আলিশা বললো — মুম্বাই থেকে ফিরে বাড়ি গেলেন না কেন ?

— এমনি , কোনো কারণ নেই ।

— ঈশা আসতো এখানে ?

সামান্য চমকে উঠে আলেখ্য আলিশার দিকে তাকালো । তার পরেই বলছে — হ্যাঁ আসতো ।

— আর এনা ! সেও আসতো ?

এবার বেশ বিব্রত লাগছে আলেখ্যকে । আলিশার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে সে বলল — এখানে এনার আসার কোনো কারণ ছিল কি ?

— সেটা তো আপনিই বলতে পারবেন আলেখ্য ! আমি তো শুধু প্রশ্ন করলাম ।

— না , আসতো না ।

— বেশ , চলুন ভিতর টা একটু দেখা যাক । বলে দাঁড়িয়ে পড়লো আলিশা ।

আলেখ্যও সাথেসাথে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে বললো — সার্চ ওয়ারেন্ট এনেছেন ?

— না , সে বস্তু নেই আমার কাছে । তবে আমার কাজে বাধা দিলে আপনি নিজেই বিপদে পড়বেন , আপনি যে সব কথা ঠিকঠিক বলেননি , সেটা আপনি আমার চেয়ে আরও ভালো জানেন । তাই কো অপারেট করাটা আপনার জন্যে মনে হয় বেটার অপশন , তাই না ! চলুন , ভিতরের ঘরগুলো দেখবো ।

থ্রি বিএইচ কে ফ্লাটটার করিডোরের শেষ প্রান্তে একটা বন্ধ দরজা । করিডোরের বাম পাশে লাগোয়া পরপর দুটো ঘর । আলিশা ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকলো ঘরগুলো । দেখে মনে হচ্ছে… ঘরগুলো তেমন ব্যবহার হয়না , তবে ঝাড়পোঁচ করা হয় নিয়মিতই ! দরজার বাইরে অপেক্ষমান আলেখ্যকে সে বলে — ঘরগুলো ইউজ হয়না না ?

— না , আমি এখানে কমই আসি ।

— বাই দ্য ওয়ে ! এনার বেল কি হয়ে গেছে ?

— আমি কেমন করে জানবো সেটা বলুন তো ? বললাম তো আপনাকে জাস্ট ফিরলাম একটু আগে ।

— কটার ফ্লাইটে এলেন ?

থতমত উত্তর দিলো আলেখ্য — এগারোটা বাইশ ।

ঘরটা থেকে বেরিয়ে এলো আলিশা । তাকিয়ে আছে বন্ধ দরজাটার দিকে ।

— ঘরটা খুলুন ।

— ওই ঘরটা ইউজ করা হয়না ।

— আমি দেখবো । বলতে বলতে সেদিকে এগিয়ে যায় আলিশা । আলেখ্য পিছন পিছন এগিয়ে আসে । দরজার হাতল ঘোরাতেই খুলে গেল দরজা । এই ফ্ল্যাটের মাস্টার বেডরুম এটাই , ঘরের চেহারা দেখে মালুম হয় সেটা । ঘরের মাঝে গোলাকার বিছানার ওপর পাতা চাদরটা ঘেঁটে আছে ভীষণ রকম , মৃদু সুবাসে ভরে আছে ঘরটা । পায়ের কাছে নরম ব্ল্যাংকেট টা আধখোলা অবস্থায় পড়ে রয়েছে অবহেলায় । ঘরে কেউ নেই । একপাশে রাখা একটা ডাবল সিটার সোফা সেট । আলিশার চোখে পড়লো… সোফার হাতল থেকে ঝুলছে একটা লেডিস টপ ! মুহূর্তেই আলিশা পৌঁছে গেছে বাথরুমের দরজার সামনে । আলেখ্য এসে বললো — কি চাইছেন বলুন তো ! এভাবে আমার পিছনে পড়েছেন কেন ?

উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলোনা আলিশা , জোরে জোরে টোকা দিচ্ছে দরজায় । আলেখ্য খামচে ধরেছে নিজের চুলগুলো , মাথা নেড়ে চলেছে পাগলের মত । কিছুক্ষন পর দরজাটা খুলে গেল একটা খুট শব্দ করে । সামনে দাঁড়িয়ে….. এনা ! তাকিয়ে আছে আলিশার চোখের দিকে ।

সামান্য পিছিয়ে গেল আলিশা । বললো — পালানোর চেষ্টা করবেননা কেউ , লাভ নেই কোনো । এতক্ষনে পুলিশ ঘিরে ফেলেছে বিল্ডিং । আলিশার কথা শেষ হতেই বেজে উঠলো ডোরবেল । আলিশা আলেখ্যর দিকে তাকিয়ে তাকে দরজা খুলতে বললো । তবু এক পাও সড়লোনা সে । আলিশা ধমকে উঠে বললো — কিহল ! দরজাটা খুলে দিন আলেখ্য ।

ঢিমে পায়ে হেঁটে গেল আলেখ্য ঘরের বাইরে । রুপম বাগচী তার দলবল নিয়ে এসে পড়েছে , তাদের পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে ।

★■◆●

বাগচী ম্যানশনের সুবিশাল লিভিংরুমটায় আজ ঈশার শোক সভার আয়োজন হয়েছে আজ । বাগচী দম্পতিকে দুপুরের মধ্যে সব মিটিয়ে ফেলার অনুরোধ করেছে আলিশা । আজ বিকেলে সকলকে উপস্থিত থাকতে বলেছে সে । আলেখ্য এবং এনা এখনও লকাপেই আছে । আজ তাদের ও নিয়ে আসা হবে এখানে স্পেশাল প্রটেকশনে । রুপম দেবরায় তার ফোর্স নিয়ে উপস্থিত থাকবে এখানেই । ত্রিদিববাবু এবং তাঁর ফ্যামিলিও থাকবে এবং থাকবে আলেখ্যর বাবা মাও ।

এই মুহূর্তে আলিশা দাঁড়িয়ে লিভিংরুম আর করিডোরের দেওয়াল ঘেঁষে । ঠিক উল্টোদিকের দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড় করানো ইশার হাসি হাসি একটা মুখ । একে একে প্রত্যেকে মালা , ফুলে সাজিয়ে দিচ্ছে ইশার ছবিটাকে । আলেখ্য আর এনা একটু দূরে পাশাপাশি বসে । চোখদুটো দুজনেরই মাটির দিকে । মিস্টার বাগচী বসে আছেন ইশার ছবির ঠিক সামনে । হাত দুটো জোর করে বসে তিনি পাথরমূর্তির মতো ! মিসেস বাগচী তাঁর বিপরীত দিকে , তাঁর ও বসার ভঙ্গিমা খানিক ওঁরই মতো । ত্রিদিববাবু ও তাঁর স্ত্রী বসে আছেন তাঁর ঠিক পিছনেই । আলেখ্যর বাবা মা এসে পৌঁছননি এখনও । সোহম পায়চারী করতে করতে নিজের মোবাইলে কিছু একটা করছে , চোখদুটো তার কুঁচকে রয়েছে । রুপম দেবরায় একটু পরেই বোধহয় এসে পড়বেন ! বাকি অতিথিদের বিদায় নেওয়ার অপেক্ষায় সময় গোনে আলিশা ।

ত্রিদিববাবুর স্ত্রী একটা থালায় প্রসাদী মিষ্টি সাজিয়ে আলিশার সামনে এসে দাঁড়ায় । আলিশা কপালে আঙ্গুল ঠেকিয়ে প্রণাম করে , মিষ্টি নেয়না ।

— কি হলো ! প্রসাদ নাও । নিতে হয় ।

— আমি কিছু খাবোনা আন্টি ! আমাকে জোর করবেন না ! আপনি অন্যদের দিন । অনুষ্ঠানটা যত তাড়াতাড়ি মিটবে আপনাদের জন্যেই ভালো !

বিরক্ত এবং রাগী দৃষ্টিতে আলিশাকে দ্বগ্ধ করার চেষ্টা করলেন ভদ্রমহিলা । তারপর কিছু না বলে সরে গেলেন অন্যদের মিষ্টি দিতে । আলিশা আরও কিছুক্ষণ একভাবে দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে হেঁটে গেল মিসেস বাগচীর পাশটায় । ওঁর পাশে বসে বললো — ঠিক আছেন ?

— ঠিক না থেকে উপায় কি বলো ? আমরা ভাবি মরে যাবো ! যাবো বললেই কি যাওয়া যায় ? এই যে দেখো , ইশার মুখটা আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে । অথচ ও কোথাও নেই । কিন্তু আমি আছি । স্বার্থপরের মতো আমি কিন্তু ঠিক আছি ! দুচোখ থেকে দুবিন্দু জল ঝরে পড়ে নিঃশব্দে মিসেস বাগচীর কোলের উপর ।

আলিশা হাত রাখে ওঁর কাঁধে । বলে — আমি জানি , আপনি অনেক স্ট্রং ! আপনি যে ভয়ঙ্কর একটা স্ট্রাগলের মধ্যে দিয়ে গো থ্রু করছেন , সেটাও জানি । কিন্তু কয়েকটা কথা আপনাকে বলতে আসলাম , জানি ভালো লাগবেনা । তবু বলছি… আপনি আপনার এক মেয়ে , শুধু এক মেয়ে নয়.. আপনার প্রিয় মেয়েকে হারিয়েছেন , কিন্তু আপনার আরও একটি মেয়ে আছে… যে আপনার এই মেয়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী , আবার যার প্রতিহিংসা পরায়ণ বা শুধুই হিংসাপরায়ন মানসিকতার নেপথ্যে কোথাও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে আপনারাই দায়ী , মিসেস বাগচী !

মিসেস বাগচী শান্ত দৃষ্টি মেলে তাকালেন আলিশার দিকে । আলিশা বললো — আপনি বিদুষী , চিন্তনের ব্যাপ্তি আপনার অনেক । আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন… আমি কি বলতে চাইছি !

উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে মিস্টার বাগচীর পাশে গিয়ে বসে আলিশা । — কেমন আছেন আঙ্কল ? আর মাত্র কিছুক্ষন । তারপরেই খুনিকে তুলে দেবো আপনার হাতে ।

— আমিও তারই অপেক্ষা করছি আলিশা । তবে , কি বলতো ! তাতেও তো ঈশা ফিরে আসবেনা ! ও আর কোনোদিন ফিরে আসবেনা । ঝাপসা হয়ে আসা চোখদুটো পাঞ্জাবীর হাতায় মুছে নিয়ে মিস্টার বাগচী বললেন — তবে একটা কথা তোমাকে আমি বলে দিলাম আলিশা , যদি প্রমাণিত হয়… এনা যুক্ত ইশার খুনের সাথে , আইন ওকে যা সাজা দেওয়ার দেবে । আমি আর কোনোদিন ওর মুখোদর্শন করবোনা । এই বাড়িতে ও আর কোনোদিন আসবেনা । দৃঢ় স্বরে বলে ওঠেন কুশল বাগচী ।

আলিশা বলে — এই কেসের শেষটুকু শুনলে আপনি শুধু এনা নয় , আরো অনেকেরই মুখোদর্শন করতে চাইবেননা আঙ্কল !

মিস্টার বাগচী সামান্য অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন আলিশার দিকে । গলা নামিয়ে বললেন — ত্রিদিব আর আলেখ্য ?

— এখন এসব আলোচনা নয় আঙ্কল ! আর একটু অপেক্ষা করুন ।

রুপম দেবরায় এসে পড়েছেন তাঁর দলবল নিয়ে । বাংলোর হাতায় , লনে , ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তারা পাহারায় । অতিথিরা এবার বিদায় নিচ্ছে ধীরে ধীরে ।
সকলে বিদায় নিলে সকলকে বসতে বললো আলিশা । আলেখ্যর বাবা মা এসে পৌঁছননি এখনও । আলেখ্য , এনা এদের ফোনগুলো আলিশা নিজের কাছেই রেখেছে , ইশার ফোনটাও সেই প্রথম থেকেই রয়েছে তার নিজের কাছে । সেদিন ইশার রুমের দেওয়ালের সেই কালো রঙের কারণ খুঁজতে ওর ঘরে ঢোকার পর বেডসাইড টেবিলের তলা থেকে ওর ফোনটা খুঁজে পেয়েছিল সে । যদিও এটাই একমাত্র ফোন তার নয় বলেই… এই ফোনটার হিসেব চায়নি কেউই । আলিশার তাতে বেশ সুবিধা হয়েছে । আলেখ্যর ফোনটা বের করে আলেখ্যর হাতে দিলো সেটা আলিশা — বাবা মাকে তাড়াতাড়ি আসতে বলুন ! এখন এখানে ওনাদের প্রেসেন্সটা জরুরি !

আলেখ্য যন্ত্রচালিতের মতো ডায়াল করে বললো — তোমরা কোথায় ? তাড়াতাড়ি এসো ।

— হ্যাঁ হ্যাঁ , ঠিকাছে । তাড়াতাড়ি ।

ফোন রেখে বললো — আর পাঁচ মিনিট লাগবে বললো ।

— বেশ । আমি তাহলে ততক্ষণ একটু সোহমের সাথে কথা বলি ! কি সোহম ! ফোনটা কোথায় তোমার ?

— ফোন আছে । কেন ?

— সবসময় ফোনে কি যেন করতে থাকো , দেখি ! এখন দেখছি চুপ করে বসে আছো ! তাই ! আচমকা গলা বদলে বলে উঠলো — ফোনটা দাও ।

সোহম চমকে উঠে বললো — হ.. হঠাৎ ফোন দেবো কেন আপনাকে ?

রুপম দেবরায় এবার এগিয়ে এসেছে — এই , চুপচাপ ফোন বের কর । কো অপারেট না করলে সোজা লকাপে ভরে দেবো । বুঝেছিস ! যা জিজ্ঞেস করা হবে… সোজা ভাবে উত্তর দিবি । বের কর ফোন !

ফোন বেরিয়ে এলো সোহমের পকেট থেকে । আলিশা সেটা হাতে নিয়ে নিলো । সোহম বসে আছে থম হয়ে । মুখটা ঝুঁকে পড়েছে সামনের দিকে । আলিশা বললো — আপনারা বুঝতে পারছেন , ফোনটা ওর কাছ থেকে নিয়ে নিতে ও এমন মুষড়ে পড়লো কেন ?

সবার দৃষ্টি এখন সোহমের দিকে স্থির । দরজা দিয়ে হেঁটে আসছেন দাশগুপ্ত দম্পতি । আলিশা বলে উঠলো — আসুন আসুন , আপনাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম । ওঁরা বসলে সে বলল — যেটা বলছিলাম ! ও মুষড়ে পড়েছে এই কারণে… কারণ এই ফোনে এমন একটা ভিডিও ক্লিপ আছে , যেটা দেখিয়ে ঈশাকে ও ব্ল্যাকমেইল করতো !

ত্রিদিববাবু চোখ নামিয়ে নিলেন , ওঁর স্ত্রী হতবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন ছেলের দিকে । মিস্টার বাগচী উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠলেন — ব্লাডি সোয়াইন ! তোর এতো বড় সাহস ! ত্রিদিবদা তোমাদের জন্যে আমি যা করেছি , তার প্রতিদান দিলে ?

— প্রতিদানের হিসেব তুই করিসনা কুশু । ওটা তোকে মানায় না । আমার ছেলে অন্যায় করেছে মানছি । কিন্তু তুই ও কিছু কম অপরাধ করিসনি ।

— আমি অপরাধ করেছি ?

— যে বাবা আমাকে না পড়িয়ে তোকে পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষ করলো , তার মৃত্যুশয্যায় একটিবার গিয়ে দাঁড়ালিনা পর্যন্ত ! কতবার ফোন করেছি তোকে , আমি , সোহম ! তুই আসিসনি । এক লাখ টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিলি ।

— তোমরা বরাবর টাকাটাই তো চেয়েছো ! আমার মেয়েকে ব্যাকমেইল করতে টাকার জন্যেই তো ! জানিনা , আর কত টাকা দিলে তোমাদের ঋণ শোধ করা হবে !

— আঙ্কল বসুন , ত্রিদিববাবু… আপনিও বসুন । আমি এখনো কিছুই বলিনি… আপনারা এখনই এতো উত্তেজিত হয়ে পড়লেন ! শান্ত হোন । আপনারা প্রত্যেকে । আজ ইশার শোক সভায় ইশার আত্মার শান্তি কামনা করে আমি শুরু করলাম ইশার মৃত্যুরহস্য । আমি বলে যাবো , আপনারা শুনবেন । আপনারা যারা এখানে উপস্থিত , তারা প্রত্যেকেই ঈশাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন , তাকে জানতেন , চিনতেন । তাই আমি যা বলবো… তা যদি কোথাও , কোনোভাবে অসংগতিপূর্ণ বলে মনে হয়… আমাকে থামাতে পারেন ।

— আর নিজের মনগড়া কাহানি বলতে থাকেন যদি ! আলেখ্য বলে ওঠে ।

— সেক্ষেত্রেও থামাতে পারেন । আর কারো কোনো জিজ্ঞাস্য ! কোয়ারিজ !

ঘর জুড়ে পিন ড্রপ সাইলেন্স ! গ্র্যান্ডক্লকটায় সন্ধ্যে ছটা বাজলো ঢং ঢং শব্দ তুলে । আলিশা রুপম দেবরায়ের দিকে তাকালো । দরজায় পাহারা দিচ্ছে দুজন সশস্ত্র উর্দিধারী । আলিশা বলে উঠলো — তাহলে আমি এবার শুরু করি ?

||চলবে ||

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here