#খুঁত,পর্ব-০১
স্পৃহা_নূর
হাতের বেশখানিকটা পুড়ে গেছে। আয়েশা দাঁতে দাঁত চেপে বেসিনের ট্যাপ ছেড়ে হাতে পানি ঢালছে। এখনো অনেক রান্না বাকি। কিভাবে কি হবে কে জানে!
এদিকে আসিফের আসবার সময় হয়ে আসছে। আজ অফিস থেকে ফেরার সময় শুধু আসিফই আসবে না, আসিফের সব কলিগরাও আসবে। নতুন বিয়ের পর ওর কলিগরা বায়না ধরেছে নতুন বৌয়ের হাতের রান্না খাবে। আসিফ অফিস থেকেই একটু পর পর অয়েশাকে টেক্সট করছে। রান্না কতদূর, কি কি আইটেম রান্না হচ্ছে, বাড়ি ঠিক মতো গোছানো হয়েছে কি না.. এসব হাজারো প্রশ্ন।
সেসব টেক্সটের উত্তর দিতে গিয়েই অন্যমনস্ক হয়ে আয়েশার হাতটা পুড়লো। বাড়িতে এমন কেউ নেই যে এ অবস্থায় তাকে একটু সাহায্য করবে। এদিকে আসিফ ভীষণ জেদি আর গোছানো মানুষ। কোন কিছু উনিশ-বিশ দেখলেই হুট করে রেগে যাওয়া তার আর একটি বদ অভ্যাস। অগোছালো কোন কিছুই তার পছন্দ না। এইত বিয়ের দিন,
আসিফের সাথে সবে পা দিয়েছে শশুর বাড়িতে আয়েশা। বেখায়েলে হুট করে দরজার চোকেটে আটকে গেল তার বেনারসি শাড়িটা। টান পড়তেই কাধের কাছে, ব্লাউজের সাথে সেফটিপিন লাগানো আচলের কিছু অংশ হালকা ভাবে ছিড়ে গেল বোধহয়। সাথে সাথেই পাশে দাড়ানো আসিফ কি করে যেন তা টের পেল।চট করে আয়েশার কাধে হাত রাখলো। এত অচেনা মানুষের মাঝে আয়েশার মনে হলো, হ্যা, আসিফই এখানে তার একমাত্র ভরসার মানুষ। অপ্রস্তুত হয়ে অসহায় চোখে আসিফের দিকে তাকালো সে।
আসিফ তার কাধে হাত রাখলো ঠিকই কিন্তু আয়েশার চোখে চোখ রাখলো সরু চোখে অদ্ভুত এক ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে। এমন রুঢ় দৃষ্টি দেখেই আয়েশার চোখে পানি চলে এলো৷ সে কি নিজের ইচ্ছেতে এমন করেছে নাকি! বেখায়ালে হঠাৎ হয়ে গেছে।
আসিফ রুমে আসার সঙ্গে সঙ্গে কোমরে হাত গুজে কিছুটা বিরক্তি আর রাগ মেশানো গলায় আয়েশার সামনেই, আসিফ তার বড় ভাবিকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
” এই জন্য বাচ্চা মেয়েছেলে বিয়ে করতে চাই নি। কোন আক্কেলে এই মেয়ে এমন একটা কান্ড ঘটালো? ”
অয়েশা মাথা নিচু করে কাদো কাদো হয়ে বলল,” আমি তো ইচ্ছে করে এমন কিছু করি নি।”
অসিফের রাগ যেন আরও দ্বিগুন বেড়ে গেল। বলল,” তোমাকে কিছু বলেছি আমি? আমার আর অর্পা ভাবির মধ্যকার কথায় কেন নাক গলাও তুমি? ”
বিছানায় বসে আয়েশার দিকে তাকিয়ে আসিফ রাগে গোজ গোজ করতে থাকলো। অর্পা ওর মাথা থেকে পাগড়ি খুলে নিয়ে বেড সাইডের টেবিলে রাখলো। সেখানে রাখা এক গ্লাস পানি আসিফের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল,
“আসিফ এত মাথা গরম করলে চলে? এত রাগ করার মতোও কিন্তু কিছু হয় নি৷ ”
আসিফ কোন উত্তর দিলো না৷ পুরোটুকু পানি এক নিশ্বাসে খেয়ে নিলো।
অর্পা আরো বলল, ” তুমি যতটা ছোট আয়েশাকে ভাবছো ও কিন্তু এতটাও ছোট নয়। তোমার চেয়ে মাত্র তো ছয় বছরের ছোট। তোমার ভাইয়াও তো আমার চেয়ে বয়সে কত বড়।”
“আর সেজন্যই তো আপনি..” আসিফ বলতে গিয়ে থেমে গেল। মৃত ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল। অর্পা আসিফের হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে আয়েশার পাশে বসিয়ে দিলো৷ তারপর আয়েশার কানে কানে কিছু বলল। আয়েশা সে সব শুনে আসিফের দিকে তাকাচ্ছিলো আর মিটি মিটি ভাবে হাসছিলো । অর্পা যাবার সময় আয়েশার হাতে একটা পানও গুজে দিলো।
অর্পা যাবার সাথে সাথেই আয়েশাকে আসিফ বেশ জোরে একটা ধমক দিলো।
” সমস্যা কি তোমার? পাগল ছাগলের মতো আমার দিকে তাকিয়ে তখন থেকে হেসেই যাচ্ছ।”
আয়েশার এবার একটু জোরেই হাসি পেলো। বলল,
পাগল তো আমি না। পাগল তো হলেন আপনি। চৈতা পাগল। চৈত্র মাসে যে পাগল হয়। ভাবি বলল এই এক মাস এই জন্যই নাকি আপনার মাথা গরম থাকবে।চুলের প্রতিটা ডগায় রাগ থাকবে। আপনি রেগে গেলেও আমি যেন কিছু মনে না করি৷ এক মাস পর নাকি আপনি আবার পানির মতো ঠান্ডা হয়ে যাবেন? সত্যি এমন করেন আপনি? আচ্ছা পাগল তো আপনি!”
কথা শেষ হবার সাথে সাথে আসিফ রুম থেকে চলে গেল।কিছুক্ষন পর পাশের রুমে চেচামেচি শুনে আয়েশা ধীর পায়ে কিছুটা এগিয়ে গেল।
সে শুনতে পেল আসিফ চেচাচ্ছে। সম্ভবত তার মাকে বলছে ,” আম্মা এই মেয়েকে আমি তালাক দেবো। অদ্ভুত রকম বেয়াদব এই মেয়ের সাথে আমি থাকবো না।”
আসিফের চেচামেচিতে আয়েশা তার শাশুড়ী মায়ের কথা তেমন শুনতে পাচ্ছে না। সে শোনার চেষ্টায় দরজার কাছে এগিয়ে যেতেই হুট করে আসিফের বাহুর সাথে খেলো নাক বরাবর ধাক্কা। আসিফ আবারও তাকে কিছু বলল না। বাইরে বেরিয়ে আবার চেচিয়ে বলল,
” আই কান্ট লিভ উইথ দিস চাইল্ডিশ গার্ল।”
আসিফের দাদী সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো , “তাইলে আমার মতো বুড়ি কাউরে বিয়া করবি?”
আসিফ রুমে ঢুকে সমস্ত রাগ যেন দরজার ওপর ঝারলো। প্রথমে সজোরে একটা লাথি দিলো৷ তারপর অতি রাগে ছিটকিনি আটকাতে গিয়ে নিজের হাত কেটে ফেললো।
আয়েশা আস্তে করে বলল,” লাগলো বুঝি?”
” আমি তো পাগল।পাগল ছাগলদের মধ্যে ব্যাথা বেদনার অনুভূতি নাই। ” দাত কেলিয়ে উত্তর দিলো সে।
আয়েশা এবার আর কোন কথা বলল না। ওয়াশরুম থেকে শাড়ি চেঞ্জ করে এসে দেখে আসিফ কাটা নখে ব্যান্ডেজ লাগাচ্ছে। আয়েশার ইচ্ছে করলো এই কাটা নখে একটা গুতো দিয়ে বলতে, ” সামান্য ব্যাপারে এত চেচামেচি করার এনার্জি কই পান শুনি? আপনার গলা কি কোন পাওয়ার হাউজ? আপনার তো কোম্পানির চাকরি না করে ভন্ড কোন রাজনৈতিক দলের নেতা হওয়া উচিত ছিল। সারাদিন কাকের মতো কা কা করে ভাষন দিতেন। সেই ভাষন আমি টিভিতে শুনতাম। ”
আয়েশা যখন এসব ভাবছিলো অসিফ তার দিকে এমন ভাবে তাকালো যেন সে আয়েশার মনে মনে বলা সব কথা শুনতে পেয়েছে। তারপর গম্ভীর গলায় বলল,
” এই আয়েশা একটু আগে যে শাড়িটা পড়ে ছিলে সেটা দাও তো।”
আয়েশা ভাবলো আসিফ হয়ত তাকে বিয়ের শাড়ি গোছাতে হেল্প করবে বলে চাইছে শাড়িটা। কিন্তু না! আসিফ শাড়িটা নিয়েই সঙ্গে সঙ্গে কাচি দিয়ে কাটতে শুরু করলো।
” এই শাড়ির জন্য এত ঝামেলা। শাড়ি রেখে লাভ কি! আর খুঁত ওয়ালা জিনিস আমার একদম পছন্দ নয়।”
আয়েশা ভাবির কথা শোনার পর থেকে আগের সব ঘটনা হালকা ভাবে নিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছিলো এতক্ষণ। কিন্তু এবার তার সত্যিই কান্না পেয়ে গেলো। নিজের বৌয়ের বিয়ের শাড়ি বিয়ের রাতেই কেউ এভাবে কুচি কুচি করে কাটে বুঝি?
সে রাতের কথা আর মনে করতে চায় না আয়েশা৷ তবুও আজ হাত পুড়ে যাবার পর থেকে তার আবার ভয় হচ্ছে। আসিফ বাড়ি এসে কি না করে ফেলে আবার! রান্নাগুলোও এখনো শেষ হয় নি। সারা বাড়ি গোছানো বাকি। এদিকে পোড়া হাতটাতেও বুঝি খুঁত লেগে গেলো।