#খুঁত -২
আয়েশা নিজে নিজেই কোন মতো ফোস্কা পড়া হাত আপাতত কিছু সময়ের জন্য ব্যন্ডেজ করলো। ফোস্কা পড়া জায়গাটুকু আড়াল করতে। রান্না না হোক অন্তত ঘরদোর গোছাতে হবে। আসিফ এসে সব কিছু এলোমেলো দেখলে মানুষজন না মেনে তাদের সামনেই চেচামেচি শুরু করতে পারে।আর রান্নার ব্যপারটা অন্য ভাবে সামলাতে হবে ভেবে নিলো আয়েশা।
আসিফের অন্য সব কিছু ভালো কিন্তু এই খুতখুতে আর বদ মেজাজী স্বভাব একটা মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলতে যথেষ্ট। ইদানিং বিরক্ত লাগে আয়েশার এসব।
_________
কলিং বেল বাজতেই স্বাভাবিক ভাবে দরজা খুললো আয়েশা। দরজায় আসিফ হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে হাতে এক তোড়া ক্যালেন্ডুলা ফুল নিয়ে। আয়েশার এটা পছন্দ সে জানে। আয়েশাকে হালকা বেগুনি রঙের জামদানী শাড়ির সাথে মুক্তোর জুয়েলারি বেশ মানিয়েছে। বিপত্তি বাধলো ঠিক তখন, আসিফের হাত থেকে আয়েশা যখন বা হাতে ফুল নিলো।
আসিফ ওর লুকানো ডান হাত দেখার চেষ্টা করল। তারপর ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল, ” এই তোমার ডান হাতে কিছু হয়েছে?”
“ওই সামান্য একটু… ”
আসিফ আরো কিছু জিজ্ঞেস করত।কিন্তু ততক্ষণে গেস্টরা এসে গেছে। আয়েশা লক্ষ্য করল শুধু আসিফের কলিগই আসে নি তার পেছনে আরো কিছু মানুষ আছে সম্ভবত। সে কি! অয়েশার বাবার বাড়ির সব লোকজনও আছে। তার সাথে ওর শাশুড়ী, অর্পা ভাবি আর তার দুই মেয়ে। আসিফ ওর পেছনে দাঁড়িয়ে ফিসফিসসিয়ে বলল,
” হ্যাপি বার্থডে আয়েশা।”
আসিফ ওর জন্মদিন মনে রেখেছে! আয়েশা ভাবতেই পারে নি ওর জন্মদিনেও কেউ ওকে এভাবে সারপ্রাইজ দেবে কোনদিন। আসিফের পিছু পিছু রুমে গিয়ে আয়েশা পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো ওকে। বলল, “মাঝে মাঝে আপনাকে এত ভালো লাগে কেন বলুন তো?”
আসিফ ওকে নিজ থেকে সরালো। এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বলল,” ইউ আর সো মাচ চাইল্ডিশ আয়েশা।”
তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো,
” এই তোমার হাতে কি হয়েছে বললে না?”
আয়েশা কি বলবে বুঝতে পারলো না। সে আরেকটা অঘটন ঘটিয়েছে। হাত পোড়ার কথা বললে সেটাও বলতে হবে। কিন্তু এতে এতগুলো মানুষের মাঝে আসিফ কি রিয়াক্ট করবে কে জানে!
আয়েশা শুধু বলল, “হুট করে ওয়াশরুমে পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছি। ব্যাথা করছে তাই ব্যান্ডেজ করে রেখেছি।”
” খুব বেশি ব্যাথা পেয়েছো নাকি? হাড় টাড় মচকে গেল না তো?” বেশ উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল।
” না না। হালকা লেগেছে।তুমি খেতে এসো। সবাইকে খাবার বেড়ে দেই।” আয়েশা কথা কাটানোর চেষ্টা করলো।খাবার টেবিলে বাধলো আসল বিপত্তি। আসিফ দু এক বার খেয়েই খাবার আর মুখে তুলছে না। রাগে কটমট করছে বোঝাই যাচ্ছে। আয়েশা ব্যাপারটা লক্ষ্য করার পর থেকে ভুলেও আর তার দিকে তাকানোর সাহস করছে না।
এর মধ্যে আয়েশার ছোট ভাই ইরাম হুট করে হাসতে হাসতে বলে বসলো, ” আপা বিয়ের পর দেখি তোর রান্না একদম মেসের খালাদের মতো হয়ে গেছে। মুখে তোলা যাচ্ছে না, কিন্তু খেতে হচ্ছে।”
আয়েশা ইশারায় ইরামকে চুপ করতে বলল। এই ছেলেটা এখনো শিখলো না কোথায় কি বলতে হয়। তাও আবার এমন একজন দুলাভাই এর সামনে এসব ইয়ারকি করেই যাচ্ছে।
আসিফের কিছু কলিগ ইরামের কথা শুনে মুখ টিপে হাসতে শুরু করলো। কলিগদের একজন আবার আসিফের ভার্সিটি লাইফের ফ্রেন্ড।সে তো বলেই বসলো,
” খেতে এলাম ভাবির রান্না। আর তোর শালা তো দেখি তোর বৌ কে মেসের খালা বানায়ে ছাড়লো। ”
আসিফ রাগ সংবরণ করতে না পেরে শাশুড়ীর সামনেই ইরামকে বলল,” কোথায়, কখন কি বলতে হয় বাসা থেকে শেখায় নি বুঝি? তুমি তো এতটাও ছোট নও ইরাম।”
আয়েশা বেশ বুঝতে পারলো আসিফ এবার একটা হুলুস্থুল কান্ড ঘটাবে। শুনেছে ঝড় ওঠার আগে আকাশ থমথমে থাকে৷ এই জন্য হয়ত আসিফ খেতে বসে সব কিছু টের পেয়েও থমথমে হয়ে ছিলো। এরই মাঝে ইরাম দিলো বাতাসের এক ঝটকা। ব্যাস এবার আসিফকে আর কে থামায়!
আসিফ থমথমে স্বরে বলল,” রুমে এসো কথা আছে।”
ভীষণ ভয় পেলো আয়েশা। রেগে গেলে তাকে দেখতে ভীষণ ভয় লাগে যে! মাঝে মাঝে তো মনে হয় এবার বুঝি মেরেই ফেলবে। কেমন চোখ সরু কিরে দাত কিড়মিড় করে। আয়েশা ওর পিছু না গিয়ে সেখানে দাঁড়িয়েই বলল,
” একটা ভুল হয়ে গেছে। আমি আপনাকে একটা মিথ্যা বলে ফেলেছি আপনি রাগ করবেন তাই । রান্নাটা আসলে আমি করি নি। পাশের বাড়ির বুয়াকে বলেছিলাম একটু হেল্প করতে আর কি! কিন্তু উনার রান্না যে এত খারাপ তা তো জানতাম না। এরপর থেকে আর এমন কিছু করব না প্রমিস। ”
সবার সামনে আয়েশার এমন উত্তর আসিফকে আরও বেশি করে যেন চটিয়ে তুললো।
“এই মেয়েটা তার কলিগ আর বন্ধুদের সামনে এসব বলে তাকে কতটা ছোট করছে তা কি সে বুঝতে পারছে না। রান্না করতে পারে নি ঠিক আছে কিন্তু মিথ্যের আশ্রয় নিতে গেলো কেন! আর সবার সামনে এভাবে কাচুমাচু হয়ে সব স্বীকার করে কি প্রমাণ করতে চায় আয়েশা? সে তাকে খুব অসহায় বানিয়ে রেখেছে? সবাই কি তাকে কতটা নীচ ভাববে এখন? এসব ভেবে ক্রোধে আসিফের শ্বাস প্রশ্বাসের বেগের সাথে বাড়তে থাকে রাগের মাত্রা।
রাগ সংবরণ করতে না পেরে আয়েশার গালে হাতই তুলে ফেললো সবার সামনে। আসিফের বন্ধু উঠে এসে না থামালে আজ বাড়াবাড়ি কিছু একটা হয়ত হয়েই যেত।
আয়েশার মা নির্বাক হয়ে তার একমাত্র জামাইয়ের এসব কর্মকান্ড দেখছে। তবে কি আয়েশা ভালো নেই? কখনো কিছু মুখ ফুটে বলে না মেয়েটা।আসিফের মা তার দিকে চেয়ে শুধু বলল,” বেয়াইন কিছু মনে করবেন না। ছেলেটাকে ছোট থেকে এত শাসন করেছি তবুও এমন কেন করে বুঝতে পারি না। ”
আয়েশার মা বলল,” শাসনই শুধু করেছেন হয়ত। সঠিক শিক্ষাটা দেয়া হয় নি।শাসন আর শিক্ষা দেবার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। আর ছোট থেকে শাসন করলে এমন হবারও কথা ছিলো না। ” উনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন মেয়েকে আর এখানে রাখবেন না।
ইরাম দৌড়ে গিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরলো। বলল, ” আপা চল বাড়ি যাই৷ তোর আর এখানে থাকতে হবে না।”
আয়েশা এ কথার কোন উত্তর দিলো না। রুমে গিয়ে মূর্তির মতো শান্ত কিন্তু শক্ত ভাবে বসে রইলো। চোখ দিয়ে পানি পড়লেও মুখে কান্নার কোন প্রতিক্রিয়া জানান দিলো না ।
গেস্ট চলে যাবার পর আসিফ রুমে এসে শান্ত গলায় বলল,
” আয়েশা তুমি ঠকাতেও শিখে গেছো? তোমার কি মনে হয় আমি তোমার হাতের রান্না চিনি না? আমার গেস্ট এর জন্য রান্না করতে তোমার ঝামেলা মনে হলে আগেই বলে দিতে পারতে। আমি বাইরে থেকে খাবার কিনে আনতাম দরকার হলে। এতটা ছোট করলে আমায় তুমি?”
আয়েশা শুধু বলল, ” আমার পুরো কথা শোনা উচিত ছিলো আপনার। ”
“আরও কিছু বলার বাকি আছে তোমার?”
আয়েশা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে হাতের ব্যান্ডেজ খুলে বলল, ” আমার হাত পু’ড়ে গেছে। গরম তেল পড়ে ফোস্কা পড়ে গেছে। গেস্ট আসবে তাই এর মধ্যে এসব বলে ঝামেলা বাড়াতে চাই নি। বিয়ের দিন থেকে মনে করে আসছেন আমি চাইল্ডিশ। কিচ্ছু করতে পারি না। আপনার সংসার সামলাতে পারব না। ঠিকমতো গুছিয়েও রাখতে পারি না সব।এখন আমার সত্যিই মনে হচ্ছে আমি আমার পক্ষে হয়ত সম্ভবও না। এতটা পারফেক্ট এতটা গোছানো হওয়া। অনেক তো চেষ্টা করলাম। আর কত? ”
আসিফ নিজের হাত আয়েশার দিকে বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,” দেখি কতটা পু’ড়িয়ে ফেলেছো? ”
” যতটা আপনি আমার মন পু’ড়েছেন তার চেয়ে অনেক কম।”
” এত আবেগের কথা আমি বুঝি না আয়েশা। আমি সব কিছু প্র্যাক্টিক্যালি ভাবতে পছন্দ করি। ”
তারপর আসিফ আবার গম্ভীর হয়ে বলল,”হাত পু’ড়িয়ে ফেলেছো সেটা আগে বললে সমস্যা কি ছিলো? ”
” বললে আপনি আবার আমাকে খোটা দিতেন।বলতেন ‘ইউ আর সো মাচ চাইল্ডিশ আয়েশা’। তারপর হয়ত বলতেন সামান্য রান্না পারে না এমন মেয়েকে তালাক দেবো। ভয় পাই আমি আপনাকে কেন বোঝেন না? আর এভাবে আমার গায়ে হাত তুলে আপনি আমাকে না নিজেকে ছোট করেছেন সবার সামনে।” কথা শেষে আয়েশা নাক ফুলিয়ে ফোপাঁতে শুরু করলো।
” আমাদের হয়ত আর এক সাথে সাথা সম্ভব নয় আসিফ। আমি গত এক বছরে অনেক ধৈর্য ধরেছি নিজেকে অনেক পাল্টানোর চেষ্টা করেছি। আপনার জন্য নিজেকে এভাবে পাল্টাতে পাল্টাতে হয়ত আমি আর নিজেকেই খুঁজে পাবো না। ”
আসিফ কি যেন ভেবে জানালার দিকে তাকিয়ে শুকনো ভাবে হাসলো। তারপর আবার বলল,” সিরিয়াসলি আয়েশা, ইউ আর সো মাচ চাইল্ডিশ। এমন আর করবে না,এসব আর বলবেও না।চলো, ওঠো ডাক্তার দেখাতে হবে। হাতের অবস্থা তো বারোটা বাজিয়েছ।”
আয়েশা আসিফের সাথে যাবে না বলে দিলো। ইরামকে নিয়ে সে নিজেই গেল ডাক্তার দেখাতে। আসিফ কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না এ বিষয়ে। কিন্তু আয়েশার পিছু পিছু ঠিকই গেলো। সেখানে ইরাম বা আয়েশা কেউই তার সাথে কোন কথা বললো না৷
ডাক্তার যখন আয়েশাকে ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিচ্ছিলো আসিফও পাশে ছিলো। সে বার বার ডাক্তারকে বলল, ” বাচ্চা মানুষ একটু সাবধানে ব্যান্ডেজ করুন না।”
আয়েশা বিরক্ত হয়ে বলল,” ইরাম তোর দুলাভাইকে বলে দে, আঠারো বছরের পর সরকারি মতে কেউ বাচ্চা থাকে না। সেখানে আমি আঠারো পার করেছি পাচ বছর আগেই। আর আমাকে ছোট বলে সে নিজে যে বুইড়া ব্যাটা সাজতে চান। সরি তার এই উনত্রিশ বছরের কচি চেহারায় তা সম্ভব না।”
আসিফ কোন উওর দিলো না। আয়েশার এই স্বভাবটা তার বিরক্ত লাগে কোথায় কার সামনে কি বলতে হয় বুঝতে চায় না। তবে আজ বাড়িতে বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে বলে এখন আর কোন কথা বাড়াতে চায় না সে। মাঝে মাঝে কিভাবে যে এত রাগ উঠে যায় কে জানে।
আয়েশা লক্ষ্য করলো, আসিফ বার বার ডাক্তার কে জিজ্ঞেস করছে
“এই পো’ড়ার দাগ কত দিনের মধ্যে ঠিক হবে? দাগ থেকে যাবে না তো? ডান হাতে এমন দাগ থাকলে কেমন বিশ্রি দেখায়। যেমন করে হোক দাগটা যেন ঠিক হয়। চোখের সামনে এমন খুঁত! ”
আয়েশার ইচ্ছে করলো জিজ্ঞেস করতে,” খুঁতওয়ালা শাড়ির মতো খুঁতওয়ালা হাতও কেটে ফেলবেন?”
তবে তার আসিফের সাথে আর কোন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। হসপিটাল থেকে ইরামের সাথে নিজের বাড়ি চলে গেলো। আসিফ শুধু বলল, ” একেবারে চলে যাচ্ছ?”
আয়েশা বলল,” আমার হাতে খুঁত হয়ে গেছে। আমি আর থেকে কি করব? আপনি বরং নিখুঁত কাউকে নিয়ে নতুন করে…. ”
কথা শেষ করার আগেই আসিফ বলল,” এবার বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে আয়েশা।”
” বাড়াবাড়ি কে বেশি করে তা সবাই জানে।”
এর মধ্যে প্রায় দেড় মাস কেটেও গেলো।আয়েশার হাতও ঠিক হলো। আসিফও রইলো সেই একই। তবে দু মাসে আসিফ বেশ কয়েক বার তাকে নিতে গিয়েছে। শেষ বার আয়েশা নিজের রুমের দরজা পর্যন্ত খোলে নি।
তবে এসবের পরিবর্তন এলো প্রায় দেড় মাস পর আয়েশার যখন সে জানতে পারলো সে আর একা নেই। তার মাঝে আসিফের ছোট্ট একটা অস্তিত্ব বেড়ে উঠছে।
আয়েশা কেমন চুপচাপ হয়ে গেলো। মাঝে মধ্যে অজ্ঞানও হয়ে পড়ে। সে মনে মনে আসিফকে প্রায়ই একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে সে,
” আমাদের বেবি কোন খুঁত নিয়ে জন্মালে কি করবেন আসিফ? ওকে রাখবেন না? নাকি মেরে ফেলবেন?”