খুন,পর্বঃ- ০৯

0
650

খুন,পর্বঃ- ০৯
ক্রাইম থ্রিলার
যাবেদ খাঁন আবু বকর

পিটপিট করে চোখ খুললেন যাবেদ। সমস্ত দেহ-ই তার ব্যথায় টইটম্বুর। ঘাড় ফেরাতে পারছেন না তিনি। বহু কষ্টে সম্পূর্ণ চোখ খুলে তাকালেন। চোখ মেলে তাকিয়েও বুঝতে পারলেন না কোথায় আছেন। নিম্ন আলোয় আলোকিত হয়ে আছে সম্পূর্ণ রুমটি। তবে কোথা হতে আসছে আলোটি আর কীভাবেই বা সম্পূর্ণ রুমকে আলোকিত করে তুলছে তা বুঝার কোনো কায়দা নেই। হাত-পা নাড়াতে চাইলেন কিন্তু বাঁধা পেয়ে গেল নড়াচড়া। বেশ অবাক হলেন হাত পা নড়াচড়া বাঁধা পাওয়ায়। ভালো করে হাত-পায়ের দিকে ভালো করে তাকালেন। হাত-পায়ের দিকে ভালো করে তাকাতেই বেশ চমকে গেলেন। একটি চেয়ারের উপর তাকে বসিয়ে হাত দু’টি চেয়ারের পেছন দিকে নিয়ে একত্র করে রশি দিয়ে বেশ শক্ত ভাবে বেঁধে রেখা হয়েছে। এবং পা দু’টো চেয়ারের পায়ার সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। হকচকিয়ে উঠলেন এইরূপ কাণ্ডে। বাঁধন ছোটাবার জন্য হাত-পা এদিক-সেদিক ছুটাছুটি করতে লাগলেন। কিন্তু ফল সরূপ শূন্য। এখানে কীভাবে এলেন তিনি!আর কে-ইবা দুঃসাহস দেখিয়ে তাকে বেঁধে রেখেছে এরকম ভাবে! আর কেনোই বা বেঁধে রেখেছে তাকে! এ সকল প্রশ্নগুলো জট পাকিয়ে যাচ্ছে তার মনে। ক্রুদ্ধ হয়ে চেহারায় রাগী ভাব ফুটিয়ে পূর্ববর্তী ঘটনা মনে করার চেষ্টা করতে লাগলেন। স্মৃতিচারণ করার জন্য মস্তিষ্কে প্রেশার দিতেই চোখের সামনে ভেসে এলো পূর্ববর্তী ঘটনা।

গভীর রাত সেই সাথে নির্জনতায় ঘেরাও করা পরিবেশ। পায়ের পদদলিতর ফলে খটখট আওয়াজ তুলে এক হাতে ছুরি ও অপর হাত পকেটে পুরে কালো কাপড়ে আবৃত করে গা ঢাকা দিয়ে মাথায় হুডি পরিধেয় করে এগিয়ে চলেছেন যাবেদ। হঠাৎ করে কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই সাদা ধোঁয়া আবদ্ধ হয়ে গেল স্থানটি। নিশ্বাস নিতে পারছেন না তিনি। ধীরে ধীরে নিচের দিকে ঢলে পড়তে লাগলো তার দেহটি। হাজার চেষ্টা করেও চোখ খোলা রাখতে পারছেন না। ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে এলো তার চোখ। পরবর্তীতে কী হতে চলেছে সে সম্পর্কে অবগত নন তিনি।

অতঃপর আর কিছুই মনে নেই তার। চোখ খুলে তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন এইরূপ বাঁধা অবস্থায়।

ঘাড় ঘুরিয়ে চার পাশ দেখতে চেষ্টা চালালেন যাবেদ। কিন্তু বড্ড কষ্ট হচ্ছে তার। মাথা প্রচণ্ড রকমের ভার হয়ে আছে। মনে হচ্ছে মাথার উপর কেউ একজন বিশাল আকারের একটি পাথর তুলে দিয়েছেন। আর উক্ত পাথরটি তিনি তার মাথায় বহন করে বসে আছেন। বহু কষ্টের সহিত ঘাড় তুলে কাঁপা কাঁপা মাথায় চারপাশ দেখতে লাগলেন।

চার দেয়ালে তৈরি একটি আবদ্ধ রুমে তাকে চেয়ার বন্ধি করে রাখা হয়েছে। রুমের গন্ধটাও কেমন সুবিধার ঠেকছে না তার। ভ্যাপসা গন্ধ সেই সাথে যুক্ত হয়েছে রক্ত ও মাংস পঁচা গন্ধ। এ সকল গন্ধগুলো মিলে যেরকমম দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয় ঠিক তেমনি একটি বাজে গন্ধ ভেসে আসছে তার নাকে। এরকম সুনসান রুমে তাকে চেয়ারে বন্ধি করে রাখার কোনো কারণ খুঁজে পান না তিনি। রেগে গিয়ে চওড়া কণ্ঠে বেশ জোরেশোরে বলতে লাগলেন,
-“আমাকে এখানে বন্ধি করে লুকোচুরি খেলছিস কে? যদি সাহস থাকে তবে সামনে এসে উপস্থিত হ!”

পুনরায় রুমটিতে থমথমে পরিবেশ বিরাজমান। একটু আগেই যাবেদের চিৎকারের কণ্ঠে রুমের চার দেয়ালও যেনো ঝংকার দিয়ে উঠেছিলো। কিন্তু এখন আর সেই রকম পরিবেশ নেই। আগের মতো পুনরায় নীরবতার গ্রাসে পরিবেশ। রুমের ভেতরে কেবল যাবেদের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। এছাড়া আর কোনো শব্দ কানে ঠেকছে না যাবেদের। পুনরায় রেগে কিছু বলতে যাবেন তিনি, তার পূর্বেই নীরবতা বিরাজমান রুমের মাঝে গমগম শব্দে মুখরিত হয় দেয়ালগুলো। কিছু সময় অতিবাহিত হতেই বেশ মোটা কণ্ঠে ভৌতিকতা সূরে ভেসে আসতে লাগলো,
“হ্যাপি ডেথ ডে টু ইউ। হ্যাপি ডেথ ডে টু ইউ।”

এরকম একটি ঘটনায় বেশ চমকে গেলেন যাবেদ, সেই সাথে বেশ অবাক হলেন এরকম মোটা কণ্ঠে ভৌতিকতা সূরে এরূপ কথা শুনে। ধীরে ধীরে আওয়াজটি গাড়ো হতে লাগলো। হঠাৎ চার দেয়ালের মধ্য হতে একটি দেয়াল চিড়ে অতি সূক্ষ্ম হয়ে তেজস্ক্রিয় আলো ভেসে এলো যাবেদের দিকে। ধীরে ধীরে আলোটির স্থান আরো বড় হতে লাগলো। বড় হতে লাগলো দেয়াল চিড়ে ভেসে আসা আলোর দৈর্ঘ্যের আকার। মূলত বদ্ধ রুমে হালকা আলোতে আলোকিত রুম হয়ে থাকার ফলে বাহিরের অধিক আলো এখন তেজস্ক্রিয় আলোর বরাবর। দেয়াল চিড়ে ভেসে আসা আলোটি মূলত দরজা খোলার ফলে ঘটেছে। এইরূপ ভাবে দরজা খুলে যাওয়ার ফলে বেশ চমকে গেলেন যাবেদ। দরজা খুলে গেলেও কারো অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে না ভেবে কিঞ্চিৎ থমকে গেলেন। হঠাৎ গুটিগুটি পায়ে হেঁটে কেউ একজন দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। অজ্ঞাত লোকটির হাতে একটি চকচকে ছুরি। অতি তেজস্ক্রিয় আলোর ফলে অজ্ঞাত লোকটির অবয় ব্যাতিত তেমন কিছুই বোঝার সম্ভব হচ্ছে না যাবেদের পক্ষে। কে এই অজ্ঞাত লোক ভেবে পাচ্ছেন না তিনি পরক্ষণেই মনের ভেতরে কিছু একটি ভেবে চমকে উঠলেন।

যাবেদের দিকে ধীরে পায়ে হেঁটে এগিয়ে আসছেন অজ্ঞাত লোকটি। লোকটির দেহের উপর থেকে তেজস্ক্রিয় আলোর রেশ কমতে লাগলো। তবে আলোর রশ্মি চকচকে ছুরির উপর পরতেই তা চিকচিক করে প্রতিফলন ঘটছে আলোর। ধীর পায়ে হেঁটে এসে অজ্ঞাত লোকটি উপস্থিত হলেন যাবেদের কাছে। অজ্ঞাত লোকটি কিছু বলার পূর্বেই বেশ রাগী কণ্ঠে বলে উঠলেন যাবেদ,
-“আহ্! তো তুই সেই মিস্টার মাইকেল। হোয়াট এ ব্রিলিয়ান্ট প্লানার। আমার সামনে উপস্থিত হলি নিজের আসল চেহারা নিয়ে। নিজেকে তো এখন সেলিব্রিটি ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে। তোর মতো একজন প্লানা মাস্টারের আসল চেহারা দেখার সৌভাগ্য ক’জনের আর হয়!

বেশ কিছুক্ষণ অজ্ঞাত লোকটি হেসে বলে উঠলেন;
-“মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও বেশ হাসির কথা বলিস। সেই ছোট্টকাল থেকেই তোর এই বদ অভ্যাসটা বলা চলে।”
-“তা ঠিক বলতে পারিস। তবে এটাও ভালো করেই জানিস আমি কখন খুব বেশি হাসি। অল্প হলে-ও জানিস কারণ একসময় যে তুই আমার বন্ধু ছিলি।”
-“রাখ তোর বন্ধুত্ব। এতদিন কোথায় ছিলো তোর বন্ধুত্ব।”
-“পুনরায় বোকার মতো কথা বললি তুই। আমি ভেবে পাচ্ছি না তোর মতো একটা বলদ মার্কা ছেলে এতবড় প্লান করে এগিয়ে চললো কীভাবে? বন্ধুত্ব ছিন্নটা আমি নয় তুই করেছিলি। তোর ভালো লাগছিলো না আমাকে তাই করেছিলি। কথা বলার আগে ভেবে নিবি নয়তো পরিনাম বড় খারাপ হবে।”
-“ভাই ডায়লগ বাজী বন্ধ কর। কয়েক মিনিট পরেই তোর ভয়ানক মৃত্যু আমার হাতে হতে যাচ্ছে। এতটা ভয়ানক মৃত্যু দেবো যা দেখে যে কারো রুহ্ কেঁপে উঠবে। আচ্ছা! সে যাইহোক,আমি কাউকেই মৃত্যুর আগে শেষ ইচ্ছা জিজ্ঞেস করিনা। কিন্তু যেহেতু তুই আমার বন্ধু ছিলি যার ফলে তোকে শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করার কসম নিলাম।”
-“ভালো করেছিস। কসম যখন খেয়েছিস তখন তোকেই করতেই হবে। ঘাবড়ানোর কিছুই নেই। তুই আমাকে আগে থেকেই চিনিস। আমি মৃত্যুকে ভয় পাইনা। আমি মৃত্যুর সহিত লড়াই করতে অধিক পছন্দ করি। আর কারো কাছে জীবন ভিক্ষা চাওয়াটা মোটেও কাম্য করে না যাবেদ।”
-“বহু ডায়লগ দেখালি। এবার তো বল না তোর শেষ ইচ্ছা। এতো বকবক শোনার মতো সময় আমার হাতে নেই।”
-” আরে ভাই, আমার কথাটা শেষ করতে দিবি তো! সে যাইহোক। তোর লাইফ স্টোরিটা শোনার জন্য আমার মন বড় ব্যাকুল হয়ে আছে। যখন তোর মন খারাপ থাকতো হাজার চেষ্টা করেও শুনতে পারিনি তোর মনের কথা। আজ আমার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী আর কসম দেওয়ার অনুযায়ী তোর ছোটোবেলা থেকেই কাহিনিটি বলা শুরু করে দে।”
-“বেশ ভালো কথা মনে করেছিস। কাউকে বলতাম না কিন্তু তোকে যখন কসম দিয়েছি তোর শেষ ইচ্ছা পূরণ করব তবে না করলে কেমন দেখায়। তবে শোন,

নীল রহমান মাইকেল। জন্ম তার একটি বড়লোক পরিবারে বলা চলে। তেমন হাই প্রফাইলের বড়লোক না হলে-ও মিডল ক্লাস চাইতে বেশ বড়লোক বলা যায়। দেখতে সুনতে বেশ সুন্দর ছিলেন তিনি। কবির মাহমুদ ও শায়লা বেগমের ছেলে নীল রহমান মাইকেল। অবশ্য তার নাম মাইকেল নন তবে তিনি এই নামটি ব্যবহার করতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। বেশ বড়লোক পরিবারে নীল রহমানের। তবে বাবা-মায়ের সাথে সময় কাটাবার জন্য বাবা-মায়ের সঙ্গি হিসেবে সময় পান নি তিনি। কবির মাহমুদ ও শায়েল বেগম দু’জনেই চেয়েছিলেন টাকা দিয়ে সংসার গড়তে। দু’জনেই টাকা পেছনে ছুটতেন ছেলে দেওয়ার মতো সময় তাদের নেই। নীল রহমান বড় হতে লাগলে কাজের লোকদের কাছে। তারাই সর্বক্ষণ নীল রহমানকে সাথে রাখতেন এবং খেয়াল রাখতেন। নীল রহমানের এগারো বছর হতেই তার মা পরলোকে গমন করলেন। এর কারণ হিসেবে অবশ্য নীল রহমানকেই বলা যায়।

পরিবারের কাছে তেমন সময় না পেয়ে মানুষিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে লাগলেন তিনি। নিজের খামখেয়ালি মেজাজ নিয়ে সর্বদা কাটাতে লাগলেন। অবশ্য এতে কবির মাহমুদ এবং শায়েলা বেগম নিজেও মানা করতেন না কারণ তারা নীল রহমানকেও অধিক পরিমাণে সময় দিতে পারতেন না। যার ফলে তার মর্জিতেই সকল কিছু বাধ্যগত থাকতো।

নীল রহমানের মানুষিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার পেছনে অবদান রয়েছে কবির মাহমুদ ও শায়লা বেগমের ঝগড়া। প্রায় সময় দেখা যেতো তাদের দু’জনের মাঝে ঝগড়া লেগে আছে।আর এই ঝগড়ার প্রতিদান সরূপ নীল রহমানের মানুষিক ভারসাম্য আরো হারিয়ে ফেলছিলেন। তার প্রচুর ইচ্ছে হতো মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে, ইচ্ছে হতো বাবাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে। কিন্তু সে সুযোগ সে পাইনি। মাত্র ৬ বছরে পা রাখতেই আলাদা রুম বরাদ্দ করে দেওয়া হলো তাকে। রাতের বেলায় অন্ধকারে একা একা বেশ ভয় অনুভব করতেন তিনি, কিন্তু তবুও মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। এরকম ভাবে চলতে চলতে নিজেকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দিলেন। হয়ে গেলেন অন্ধকারী নিশাচর। রাতের আঁধারকেই তার বড্ড আপন মনে হয়। অবশ্য তিনি বড্ড আপন করেই চলতেন। রুম থেকে তেমন বেরুবার কোনো প্রয়োজন হয়নি তার। অবশ্য এর কারণ হিসেবে ধরা যায় কেউ তার খবর নেয় না। কাজের লোক রান্না তৈরি করে দিয়ে চলে যায়। তার যখন প্রয়োজন হয় নিজের টা নিজেই খেয়ে নেয়। অবশ্য টেবিলে সবকিছু সারিবদ্ধ ভাবে সাজিয়ে রাখা হয়। নিজেকে বেশ একা মনে হয় তার। নিজের রুমকে তিনি অন্ধকারে আচ্ছাদিত করে রাখত। সেই সাথে নিজেকেও রুমের অন্ধকারে লুকিয়ে নিতো। এতে করে তার অন্ধকারের সঙ্গে বেশ মিল হয়ে যায়। নয় বছরে পা রাখতেই একটি বদভ্যাস তাকে ঘিরে বেড়ে উঠতে লাগলো। অন্যের কান্না শুনতে তার কাছে বেশ ভালো লাগতো।

অন্যের কান্না যখন তার কানে আসতো তখন মনে হতো অমৃত সুধা পান করছেন। আর তার কানের কাছে কেউ নিম্ন আওয়াজে গুনগুন শব্দ করে গুঞ্জন করছে। তার বদভ্যাসের প্রথম পরিক্ষার শিকার হয় তাদের বাসার পাশের বাসা নাদিয়া খাতুনের মেয়ে। বাচ্চা মেয়েটির বয়স ৭ বছরের মতো হবে। অবশ্য সাদিয়া খাতুনকে তাদের বাসায় কাজের জন্য রাখা হয়েছে। সেই সুবাদে নিজের ছোট্ট মেয়েটিকে নিয়ে তাদেরদের বাসায় আসতেন। কোনো একদিন পুরোনো দিনের মতো সেদিনও তার মেয়েকে নিয়ে কবির মাহমুদের বাড়ি কাজের জন্য এসেছিলেন। তিনি বাসার ভেতরে কাজ করছিলেন আর তার বাচ্চা মেয়েটি সুইমিং পুলের কাছেই খেলা করছিলেন। নীল রহমান মূলত ঘরের ভেতরেই সময় কাটাতেন কিন্তু সেদিন কিসের জন্য বাহিরে বের হয়েছিলাম তা আজ-ও জানতে পারেননি। বাহিরে বেরিয়ে আসতেই দেখতে পেলেন বাচ্চা মেয়েটি হাতে বল নিয়ে গুটিগুটি পায়ে সুইমিংপুলের কাছে খেলছে। ভয়ানক বদভ্যাস মাথায় চাড়া দিয়ে উঠলো তার।গুটিগুটি পায়ে হেঁটে বাচ্চা মেয়েটির কাছে এসে উপস্থিত হলেন। বাচ্চা মেয়েটি তার দিকে মায়ার দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাতে থাকা বলটি এগিয়ে দিচ্ছিলো তার সাথে খেলার জন্য।

কিন্তু তিনি তো আর খেলার জন্য আসেনি। তিনি এসেছেন তার প্রথম খুনের সূচনা ঘটাতে। মায়া জাল যে তার উপর কাজ করে না সেটি হয়তো বাচ্চা মেয়েটি জানতো না। বিন্দু পরিমাণ বাচ্চাটির প্রতি তিনি মায়া না দেখিয়ে বাচ্চা মেয়েটির মুখের উপর লাথি মারলেন নীল রহমান। বাচ্চা মেয়েটি লাথির ধকল সইতে না পেরে ছিটকে সুইমিংপুলে গিয়ে আছড়ে পড়লো। বাচ্চা মেয়েটি পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছিলো তবুও হাতড়ে চলেছিলো একটু বাঁচার আশায়। কিন্তু সেদিকে ধ্যান দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন না নীল রহমান। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন বাচ্চা মেয়েটি কী করে মারা যাচ্ছে। কীভাবে হাত পা ছোড়াছুড়ি করছে পানিতে। বাচ্চা হওয়ার দরুন মেয়েটি বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি এ লড়াইতে। অধিক পরিমাণে পানি খাওয়ার ফলে শ্বাস-প্রশ্বাসের কার্য না চালাতে পেরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে পানির নিচে তলিয়ে গেল বাচ্চা মেয়েটির দেহ। বাচ্চা মেয়েটি নিস্তেজ হয়ে পানির তলায় চলে যেতেই হেঁটে নিজ রুমে চলে এলেন নীল রহমান।

এই পর্যন্ত বলে থেমে গেলেন আগত মাইকেল। তার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি লেগে আছে। দেখতে বেশ ভালো লাগলেও এরকম ঘটনায় হাসার ফলে তাকে কুৎসিত লাগছে। বেশ কিছুটা রেগে গিয়ে যাবেদ বলে উঠলেন;
-“ছিঃ একটা মানুষ কতটা খারাপ হলে একটা বাচ্চা মেয়েকে এই ভাবে মারতে পারে।”
যাবেদের কথাটি তিরস্কার করে বেশ উচ্চস্বরে হাসি দিয়ে বলতে লাগলেন মাইকেল;
-“এটা তো সবে শুরু।”
-“আচ্ছা শায়লা বেগমের মৃত্যুর পেছনে হাত আছে নীল রহমানের বলতে? আচ্ছা তারপরে কি হয়েছিলো?”
পুনরায় অতিতের স্মৃতিতে ডুব দিলেন মাইকেল।

বাচ্চা মেয়েটিকে তার মা বেশ কিছুক্ষণ যাবত না দেখার ফলে খোঁজ করার জন্য বাসা থেকে বেরিয়ে এলেন। এমনিতেও নাদিয়া খাতুন বেশ রোগাপটকা। সুইমিংপুলের কাছে যেতেই মেয়েকে পানির তলায় ডুবে থাকতে দেখে তিনি হার্টেটাক করলেন। মেয়ের মৃত্যুর শোক তিনি কাটাতে না পেরে জগৎ ছাড়লেন। সময় যেতে লাগলো কিন্তু দমে যায়নি অথবা থেমে যায়নি নীল রহমান। মানুষ খুন না করলেও রোজ একটি করে প্রাণী ধরে বিভিন্ন রকম সাজা দিয়ে চলেছেন তিনি। এভাবেই চলতে লাগলো সময়। ধীরে ধীরে খুনের প্রচন্ড নেশায় তাকে আঁকড়ে ধরতে লাগলেন।

নীল রহমানের বয়স তখন এগারো। হঠাৎ একদিন রাতে কবির মাহমুদ ও শায়লা বেগমের রুম থেকে চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। সকল শব্দগুলো তিনি শুনছিলেন তবে তেমন আমলে নিচ্ছিলেন না নীল রহমান। কিন্তু তার মা শায়লা বেগমের একটি কথা তার মাথায় গেঁথে গেল। ধ্যান দিয়ে শুনতে লাগলেন কবির মাহমুদ ও শায়লা বেগমের কথাগুলো। শায়লা বেগমের শেষের বলা একটা কথাই মনে গেঁথে রইলো নীল রহমানের।
” আমি ডিভোর্স চাই। আমি তোমার থেকে নিজেকে মুক্তি চাই।”

কবির মাহমুদ সেদিন অনেকবার বলেছিলেন,
– “আমাদের ছেলে নীলের কথা একটা বার অন্তত ভেবে দেখো।”

কিন্তু সেদিন নীলের মা শায়লা বেগম শুনেনি। অতঃপর এক পর্যায়ে কবির মাহমুদ শায়লা বেগমের কাচজে হার মেনে বললেন,
-“ওকে। তবে কাল সকালে খাওয়া দাওয়া করে উকিলের কাছে যাওয়া যাবে।”

শায়লা বেগম আর কিছু বললেন না কিন্তু এদিকে নীল রহমানের মনে তার মায়ের জন্য হতে লাগলো বিশাল ঘৃণা। বহুদিন হলো লোকজনের মৃত্যু তিনি দেখেন না। খুব ইচ্ছে হলো তার মায়ের মৃত্যু দেখার। রাত ভর মায়ের মৃত্যুর জন্য ফাঁদ পাতার পরিকল্পনা করতে লাগলেন।

সকাল ৮টা বাজতেই ঘুম থেকে উঠেই দৌড়ে রান্না ঘরে প্রবেশ করলেন নীল রহমান। অবশ্য তিনি বহু আগেই ঘুম থেকে জেগেছেন। রাতে তার ঘুম নেই বললেই চলে। খুন্তি হাতে নিয়ে রান্না ঘরের গ্যাস পাইপটি মুটামুটি আকারে ছিদ্র করে দিলেন। কার্যটি শেষ করেই দ্রুত রুম ত্যাগ করলেন। তিনি জানেন আরেকটু পরেই তার মা ঘুম থেকে উঠেই কফি রান্না করতে যাবেন। রান্না ঘর থেকে নীল রহমান বেরিয়ে গেলেও নজর রেখেছিলেন সেদিকে।

আনুমানিক পনেরো মিনিট পরেই রান্না ঘরে প্রবেশ করলেন নীল রহমানের মা শায়লা বেগম। অবশ্য শায়লা বেগমের একটি বদভ্যাস আছে। যা হলো রান্না করার সময় তিনি রান্না ঘরের দরজা আটকে নেন। আর এর ফায়দাটি ভালো ভাবেই কাজে লাগালেন নীল রহমান। শায়লা রহমান রান্না ঘরে প্রবেশ করে একটি পাত্রে করে পানি নিয়ে চুলার উপর রাখলেন। অতঃপর দরজাটি আটকে দিয়ে চুলায় আগুন জ্বালানোর প্রচেষ্টা করলেন। অতঃপর যা ঘটার তাই হলো। চুলা জ্বালানোর জন্য আগুন জ্বালাতেই “ভুমম” করে সঙ্গে সঙ্গে একটি শব্দ হলো। শব্দের তালে তালে সম্পূর্ণ বাড়িটি কেঁপে উঠলো। রান্না ঘরটির চার দেয়ালের ইট চারদিকে ছিটকে উড়ে গেল। শায়লা বেগমের দেহ আগুনে পুড়ে মেঝেতে পরে আছে। এরকম শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে যায় কবির মাহমুদের। শব্দের উৎস খুঁজতে দ্রুত রুম থেকে বাহিরে এলেন। শব্দটি রান্না ঘরের দিক থেকে আসার ফলে তিনি সেদিকেই ছুটতে লাগলেন। এতটা বিকট শব্দ হওয়ার ফলে বেশ ভয় পেয়ে যায় নীল রহমান। তবে তিনি ভয়ের চাইতে শব্দটি উপভোগ করেছিলেন বেশি। তিনিও লোক দেখানোর জন্য ছুটে এলেন তার বাবার পিছুপিছু।

আধপোড়া রান্না ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলেন নীল রহমান ও তার বাবা। কবির মাহমুদ ভেতরে প্রবেশ করে মেঝেতে তার স্ত্রী শায়লা বেগমের ভয়ানক লাশ দেখে সেখানেই কান্নায় ভেঙে পড়েন।বেশ কিছু স্থান উলঙ্গ হয়ে আছে সেই সাথে পরিধান কৃত কাপড়ের পোড়া অংশগুলো পুড়ে যাওয়া চামড়ার সাথে লেগে আছে শায়লা বেগমের। রান্না ঘরের বেশ কিছু স্থানে এখনো আগুন জ্বলছে। লোকজনের সমাগম ইতিমধ্যেই উপচে পড়ছে। কবির মাহমুদ রান্না ঘরের বাকি স্থানের আগুনগুলো নেভানোর চেষ্টা করতে লাগলেন ক্রন্দন চোখে চেহারায় মলিনতা ভাব নিয়ে। বাবার চোখে অশ্র দেখে চিৎকার করে কান্না করতে লাগলেন নীল রহমান। কিন্তু তিনি কেন কান্না করছেন সেটা তার ও বুঝে আসছে না। বাসার আশে-পাশে মানুষ এসে ভীড় জমা করে ফেলেছেন। এম্বুলেন্স এসে শায়লা বেগমের পোড়া লাশটি উঠিয়ে নেন। এবং পোস্টমর্টেম করার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যান। পরবর্তীতে গোচর হয় আসল রহস্য। আগুন লাগার মূল কারণ গ্যাস পাইপ লিক। আর রুমের ভেতরে অধিক পরিমাণে গ্যাস জমা হওয়ায় আগুনের সংস্পর্শ পাওয়ার ফলে বিস্ফোরণ ঘটেছে।

ঐ ঘটনার পর কিছুদিন অতিবাহিত হতেই কবির মাহমুদ পুনরায় বিয়ে করলেন। তবে নীল রহমান তার মতো তিনি থাকতেন। অচেনা মহিলাটির দিকে তাকানোর বিন্দু পরিমান প্রয়োজন বোধ করিনি। অবশ্য কবির মাহমুদের দ্বিতীয় স্ত্রীয়ের নাম রুমা বেগম। নীল রহমান রুমা বেগমকে কখনো তার ধারে কাছে ঠেসতে দেয়নি। শায়লা বেগমের মৃত্যুর থেকে তার বদল হতে শুরু করলো। তিনি এতোদিন তার মায়ের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতা পাননি। এখন আর শায়লা বেগম নেই তাই বাঁধা দেওয়ার ও কেউ নেই। তিনি নতুন করে আকাশে উড়তে শুরু করলেন। সবাই ভাবতে লাগলেন মায়ের অকাল মৃত্যুতে তার আচরণ এরূপ হয়েছে। অবশ্য তার কারণেই হয়েছে। তিনি পেয়ে গেছেন স্বাধীনতা। তার স্বাধীনতাকে সবাই একগুঁয়ে হিসেবে ভেবে নিতো। নিজ মন মোতাবেক পড়ালেখা করতে শুরু করলেন তিনি। বেশ ভালোই মাথার ব্রেন্ট ছিলো তার। স্কুলে তিনি তার মতো থাকতেন আর রাত হলে শুরু পশুপাখির উপর অত্যাচার। ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলেন তিনি।
ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ভর্তি হলেন ভার্সিটিতে। কোনো এক মায়ায় জড়িয়ে গিয়ে শুরু হলো নীল রহমান আর সাদিয়ার ভালোবাসা। বেশ ভালোই কাটছিলো তাদের সময় কিন্তু মাঝ পথে মায়ায় জড়িয়ে বন্ধুত্ব হয়ে গেল যাবেদের সাথে। কবির মাহমুদ নীল রহমানের ভালোবাসার খবরটি জানতেই আচমকা তার উপর শুরু করলেন অমানবিক নির্যাতন। অমানবিক নির্যাতন বলতে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ।
,
,
,
— ” ক্রাইম থ্রিলার ” —
— ” খুন ” —
— ” যাবেদ খাঁন আবু বকর ” —

চলবে

গল্পটি কি থেকে কি হয়ে চলেছে কেউ কি ভেবে পাচ্ছেন? গল্পটি আমি আর লম্বা করতে চাচ্ছি না। আগামী পর্বেই সকল রহস্য সমাধান এবং অন্তিম পর্ব। আর আসলেই কি যাবেদ মারা যাবে? এবার নায়ক আর ভিলেন দু’জন এক সাথেই কি দেহ ত্যাগ করবে? কি মনে হয় আপনার?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here