খুন সিরিজ তৃতীয় সিকুয়েন্স,দ্বিতীয় পর্ব
গল্প:- মাস্টার অব মাইন্ড গেম
লেখা:- যাবেদ খান আবু বকর
তিন.
ফোনের শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে নজর করলেন এমপি রজবান। বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে খুব। একধ্যানে মুগ্ধ হয়ে দেখছিলেন তা। চারদিকে ঘোর অন্ধকার; কিন্তু বাড়ির আশেপাশের বাতিগুলো আঙিনাকে অনেকটা দিনের মতো ফকফকা করে রেখেছে। বেলকনিতে বসে বৃষ্টি ভেজা তাজা বাতাসের সাথে ঝুম বৃষ্টি উপভোগ করাটা সত্যিই অনেক প্রশান্তিদায়ক। যা বৃষ্টি হলে হরহামেশাই উপভোগ করেন তিনি। কিন্তু তার এই উপভোগ্য মুহূর্তে ব্যাঘাত ঘটালো ফোন কলটি। কলটা এসেছে ইন্সপেক্টর রবিনের নাম্বার থেকে। সাত-পাঁচ না ভেবে কল রিসিভ করে কানে তুলে নেন। ওপাশ থেকে ভেসে আসে রবিনের ভয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর।
‘ স্যার, আমি একটা বিপদে পড়েছি। একটা ঝামেলা হয়ে গেছে। যে করেই হোক, আমাকে বাঁচান। ‘
ইন্সপেক্টরের এরকম কথায় একটু ভড়কে যান তিনি। ভাবতে লাগলেন, কী এমন হলো? যার দরুন একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর একজন এমপির দোরগোড়ায় এভাবে আতংকিত হয়ে সাহায্য চাচ্ছে! মস্তিষ্কে প্রশ্নটা বেশ কড়া করে আঘাত হানে। কিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক রেখে প্রশ্ন করলেন,
‘ কী হয়েছে? এত ভয় পাচ্ছ কেন? আমাকে খুলে বলো। আমি দেখছি কী করা যায়! ‘
মুহূর্তেই অপরপাশ থেকে কম্পিত কণ্ঠে ভেসে আসে,
‘ স্যার, ফোনে এতকিছু বলা সম্ভব না। অনেক বড় বিপদে পড়েছি। আপনি বরং শহরের উত্তরদিকের জঙ্গলের দিকে আসেন। ‘
আচমকা এরকম কথায় অনেকটা বেসামাল হয়ে পড়েন তিনি। মৃদু ক্রোধ নিয়ে প্রত্যুত্তর করলেন,
‘ তোমার মাথা ঠিক আছে রবিন? বাহিরে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি হচ্ছে। আর এখন রাত বাজে এগারোটা চল্লিশ। ‘ কান থেকে ফোনটা নামিয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে সময়টা দেখে নিলেন। পুনরায় বলতে লাগলেন।
‘ এই সময় তুমি আমাকে বাসা থেকে বেরুতে বলছ! ‘
‘ স্যার, প্লিজ একটু আসুন। অনেক বড় বিপদে পড়েছি। সামনাসামনি না বললে হবে না।’ অনেকটা রোদনভরা কণ্ঠ করে বলল সে।
‘ আচ্ছা আচ্ছা। আমি এক্ষুনি বেরুচ্ছি। ‘
‘ জি স্যার। আমি সেখানেই আছি। আপনি জলদি করে আসুন, আমাকে বাঁচান। ‘
কলটা কেটে দেয় রবিন। বেলকনিতে বসা থেকে উঠে পড়েন। পা বাড়ান বাড়ির গ্রেজের দিকে। গাড়িতে চড়ে নিজেই চালাতে লাগলেন। অন্যান্য সময় গাড়ি ড্রাইভ করার জন্য ড্রাইভার আছে। কিন্তু কোনো গুরুত্বপূর্ণ মিটিং থাকলে বা এরকম কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তিনি নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছোন। গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে বৃষ্টিমুখর মুহূর্ত উপভোগ্য করে তোলার জন্য একটি ঠান্ডা হিন্দি গান ছাড়লেন। বলা যায় এটি তার অন্যতম আরেকটি অভ্যাস।
তিন.
একটি কালো আলখাল্লা পরিহিত লোক কম্পিউটারের সামনে বসে কিছু একটা করছেন। end বাটনে ক্লিক করে কল কাটলেন। রুম জুড়ে নীল আলোর ছড়াছড়ি। কিন্তু সেই আলোতেও লোকটার মুখ সম্পূর্ণ অস্পষ্ট। কম্পিউটারের কী-বোর্ডের উপর হাত রাখলেন। কিছুক্ষণ চেপে কল করলেন একটা নাম্বারে। কিছুক্ষণ রিং হতেই ওপাশ হতে ভেসে এলো,
‘ হ্যালো স্যার…’
কথাকে সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে লোকটি একটি বয়স্ক কণ্ঠ করে বলতে লাগলেন,
‘ রবিন, আমি একটা বিপদে পড়েছি। এই মুহূর্তে তোমার সাহায্য আর প্রয়োজন। কোথায় আছ তুমি? ‘ অনেকটা উদ্বিগ্ন ভাব নিয়ে কথাগুলো বললেন লোকটি।
‘ বাসায় আছি স্যার। আর তাছাড়া আপনি একজন এমপি। সবচেয়ে বড় কথা, ময়দানের সবচেয়ে বড় খেলোয়াড়। আপনার পথের কাটা আবার হলো কোন পাগল?’ অনেকটা হাসির মুড নিয়ে কথাটা বলল সে।
‘ এত কথা বলার সময় নেই। শহরের উত্তরদিকে জঙ্গলের কাছে আধঘন্টার মাঝে তুমি আসো। আমি তোমার অপেক্ষায় আছি। ‘ উদ্বিগ্নতা এখনো স্বর থেকে নেমে যায়নি।
‘ স্যার…! মামলা কি সত্যিই অনেক ক্রিটিকাল? ‘ চেহারার একটা চিন্তিত ভাব এনে প্রশ্ন করল ইন্সপেক্টর রবিন।
‘ এত কথা বলার সময় নেই। তুমি দ্রুত আসো। ‘ তাড়া দেখিয়ে কথাটি বললেন অজ্ঞাত লোকটি।
‘ আচ্ছা স্যার। আমি এক্ষুনি আসতেছি। আপনি একটু অপেক্ষা করুন। ‘
চার.
ইন্সপেক্টর রবিন বাসা থেকে বেরিয়ে গ্রেজে ঢুকে পড়েন। গাড়িতে উঠে স্টার্ট করে দেন। ছুটে চলেন নির্দিষ্ট স্থানের লক্ষ্যে। কলটা এসেছিল এমপি রজাবন সাহেবের নাম্বার থেকে। সে বিপদে পড়েছে শুনে ছুটে চলছে সেদিকে।
অপরদিকে আলখাল্লা পরিহিত অজ্ঞাত লোকটির ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠেছে হাসি। হাসির ধরণটা অনেকটা পৈশাচিক। কম্পিউটার বন্ধ করে ডেস্কের ড্রয়ার খুলেন। দুটো নাইন এমএম মডেলের ডেজার্ট ইগল বন্দুক দেখা যাচ্ছে। একটি হাতে তুলে নেন। পাশেই দুটো সাইলেন্সার পড়ে আছে। দ্রুত একটি সাইলেন্সার হাতে নিয়ে বন্দুকের নলে যোগ করে নেন। দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েন। কোমরে গুঁজে নেন বন্দুকটি। তবে কোমরে বন্দুকটি রাখার আগে বন্দুকের ম্যাগজিন চেক করতে ভুলেননি। ছয়টি বুলেট আছে ম্যাগজিনে। শান্তভাবে বেরিয়ে পড়েন কক্ষটি থেকে। শিকার তার জালে ধরা দিয়েছে। শিকারি তার শিকারকে কোনোমতেই হাতছাড়া করতে চায় না। বৃষ্টিও বেশ জোরেশোরেই নেমেছে। বৃষ্টির আওয়াজ খানিকটা ফ্রাইপ্যানে মাছ ভাজার মতো। কিন্তু তা উপেক্ষা করে লোকটি বেরিয়ে পড়ে শিকারকে হজম করতে। লোকটি আলখাল্লা পরে বাহিরে আসতেই বৃষ্টির ফোঁটাগুলো তার দেহে ছুঁয়ে দিচ্ছে। কিন্তু আলখাল্লার জন্য দেহের লোমকূপের গোড়ায় স্পর্শ করতে পারছে না তারা। কিন্তু আলখাল্লার উপরে পড়া পানিগুলো তার দেহে একটা অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি করছে। বৃষ্টির শব্দটা অনেকটা কাছ থেকে অনুভব করছেন তিনি। তাছাড়া বৃষ্টির সাথে যুক্ত হয়েছে থেমে থেমে বাতাস।
কখনো তার গতিপথ নমনীয়। আবার কখনো ছুটে চলেছে তীব্র গতিতে। তার সাথে সঙ্গ দিয়ে ঢেউ খেলে চলেছে গাছের পাতাগুলো। একবার এদিকে তো আরেকবার ওদিকে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে অসহায় মনে হচ্ছে নারকেল এবং সুপারি গাছকে। এদের দুজন একবার ডানে আরেকবার বামে মাথা দুলিয়ে চলেছে।
এই ঝুম বৃষ্টিতে রাতের আঁধারে ব্যাঙ অথবা কিছু পোকামাকড় ব্যতীত রাস্তায় তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আজকের রাস্তাটা যেন অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেকটা নীরব। কারণটা কি বৃষ্টি নাকি ভিন্ন কিছু? শহরে কিছুক্ষণ পরপরই থেকে থেকে বৃষ্টি নামছে। যার কারণে অধিকাংশ লোক কদিন যাবত সন্ধ্যাতেই বাড়ি ফিরে এসেছে। এটি যেন শিকারির জন্য আরও একটি বাড়তি সুবিধা। কোনো ঝামেলা ছাড়াই শান্তি মতো নিজের কাজ সম্পাদন করতে এটি খুব উপকার করবে। যার হেতু রাস্তায় ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়ানো কুকুরগুলোও বৃষ্টি থেকে বাঁচতে আশ্রয় নিয়েছে কোনো দোকানের নিচে কিংবা ভিলার তলায়। ঘড়িতে টকটক করে কাটা চলতে চলতে ঘন্টার কাটাটা এগারো স্পর্শ করেছে। এবং মিনিটের কাটাটা বারো পেরিয়ে পুনরায় এক স্পর্শ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। শিকারি আলখাল্লার সাথে বুট জুতো পরে ঠকঠক আওয়াজ তুলে সোডিয়াম লাইটের আলোর নিচ দিয়ে হেঁটে চলেছেন। উদ্দেশ্য জালে ফেঁসে যাওয়া শিকারকে হজম করা। হাঁটতে হাঁটতে শিকারি পৌঁছে গেল তার বিছানো জালের কাছে। দূর থেকে একটি গাড়ির আলো তার চোখে পড়ছে। কোমরে গুঁজে রাখা বন্দুকটি হাতে নেন। গাড়িটা তার থেকে ছয় থেকে সাত মিটার দূরত্বে আসতেই বন্দুকটা হাতে নিয়ে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়েন। পরিষ্কার হয়, হাতে ফরেনসিক গ্লাভস পরা। গাড়ির ভেতরে আছেন এমপি রজবান। ইন্সপেক্টর রবিন ভেবে দ্রুত গাড়ির দরজা খুলে হাতে ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। তা দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে শিকারির। এতক্ষণ যে এটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। এমপি রজবান গাড়ি থেকে বেরিয়ে ছাতা মেলে মাটিতে পা রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই শিকারি তার কভু লক্ষ্যভ্রষ্ট না হওয়া হাতে প্রথম গুলি ছুড়েন। সাইলেন্সার লাগানোর ফলে মৃদু একটা শব্দ হয়। বন্দুক থেকে নির্গত গুলি সোজা আঘাত হাতে তার লক্ষ্য বস্তু রজবানের কপাল বরাবর। ছিটকে পেছনে পড়ে যেতে নেন তিনি। কিন্তু প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হাতে দ্বিতীয় গুলিটি ছুড়েন শিকারের হৃৎপিণ্ড বরাবর। হার না মানা বন্দুকের গুলি বাতাসের চেয়েও দ্বিগুণ গতিতে যেয়ে আঘাত হানে লক্ষ্য বস্তুতে। ছাতাসহ উলটে পড়ে যায় শিকারি। রক্তে তলিয়ে যাচ্ছে আশপাশ। কিন্তু বৃষ্টির পানিতে ধুয়েমুছে যাচ্ছে রক্তগুলো। অধিক পানির সংস্পর্শে এসে রক্তের লোহিত কণিকাগুলো তাদের ভারসাম্য হারিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। পা বাড়িয়ে গাড়ির সম্মুখে চলে আসেন অজ্ঞাত লোকটি। আকাশ থেকে এখনো অঝোর ধারায় জমিনে পতিত হচ্ছে বৃষ্টি। গাড়ির সামনের ডিকির উপর আধো বসা আকৃতিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শিকারি। গাড়িটি ল্যামবরগিনি মডেলের। এইতো, এমপি রজবান সাহেব মাসখানেক আগে হাতে পেয়েছেন। কারখানা থেকে পারসোনালি ব্যবহার করার জন্য গাড়িটি তৈরি করেছে কোম্পানি। দেশে আনতে আনতে খরচ পড়েছে প্রায় আড়াই কোটির কাছাকাছি।
এত টাকার উৎস কোথা থেকে তা তদন্ত করার জন্য কোনো কমিটি বসেনি। এত বড় এমপির উপর কমিটি বসানোর ক্ষমতা আছে নাকি?
অপরদিকে গাড়ির উপর আধবসা হয়ে অজ্ঞাত লোকটি অপেক্ষা করছেন তার পরবর্তী শিকারের জন্য। বেশি নয় স্বল্প কিছু সময় অপেক্ষা করতেই মুচকি হাসি ভেসে উঠে তার দুই ঠোঁটের কোণে। যে শিকারের অপেক্ষায় বসে ছিলেন, সে শিকার অবশেষে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। শিকারির একটু আগে দাঁড়িয়ে গুলি করা স্থানে এসে গাড়ি থামাল শিকার। যেন তিনি অত্যাধিক ক্যালকুলেশন করেই সেখানে দাঁড়িয়েছিলেন। আলখাল্লা পরিহিত লোকটির দিকে ইন্সপেক্টর রবিন একবার তাকালেন। কিছু না ভেবে ছাতা হাতে নিয়ে গাড়ির দরজা খুললেন। বেরিয়ে এলেন তিনি। পা বাড়ালেন আলখাল্লা পরিহিত লোকটির দিকে। গাড়ি দেখে নিশ্চিত হয়েছেন, গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি এমপি রজবান। কিন্তু তার পরীক্ষায় সূক্ষ্ম ভুল ছিল। যার হেতু ধরতে পারেননি, কোনটা রজবান আর কোনটা তার শিকারি। কিন্তু শিকারি ভুলকে প্রশ্রয় দেন না। সে তার চাল চেলে বসলেন। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাতটা চোখের পলকে উঁচু করে প্রথম গুলি ছুড়লেন রবিনের হৃৎপিণ্ড বরাবর।
রবিন কিছু বুঝে উঠার আগেই একটা গুলি এসে আঘাত হানে তার বুক বরাবর। কোমরে থাকা বন্দুকটা যে বের করে হাতে নেবে তাও সে ভুলে গেছে। বন্দুকের আঘাতে পেছন দিকে হেলে গেল। কিন্তু শিকারি তার পরবর্তী বন্দুকের গুলি ছুড়তে ভুলেনি। রবিন পেছন দিকে হেলে যেতে ছাতাটা মাথা থেকে সরে যায়। সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে লক্ষ্য বরাবর পরবর্তী গুলি ছুড়েন। অব্যর্থ নিশানা আঘাত হানল তার কপালের মধ্য বরাবর। সাথে সাথে পেছন দিকে চিৎ হয়ে লুটিয়ে পড়ল জমিনে। দেহটা দুটো কাঁপুনি দিয়ে স্থির হয়ে গেল। বুক এবং কপালের ক্ষত স্থান থেকে রক্তের স্রোত বয়ে যেতে লাগল আশেপাশে। কিন্তু বৃষ্টির পানি তার সাথে করে রক্তগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে নিয়ে যাচ্ছে।
পাঁচ.
শিকারি পা বাড়ালেন হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িরটির দিকে। গাড়ির দরজা খুলে মাথা ভেতরে ঢুকালেন। ড্রাইভিং সিটের পাশে ড্রয়ার টান দিয়ে খুললেন। বেরিয়ে এলো একটি লাইসেন্সকৃত বন্দুক। বড়লোক কিংবা রাজনৈতিক কর্মকর্তারা প্রত্যেকে তাদের গাড়ির চালক সিটের পাশের ড্রয়ারে বন্দুক রাখেন। যাতে করে যাত্রাপথে কোনো বিপর্যস্ত কিংবা দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। এর ফায়দা লুটলেন শিকারি। বন্দুকটা হাতে নিয়ে ম্যাগজিন খুললেন। দুটো বন্দুকের গুলি সুনিপুণভাবে খুলে পকেটে পুরে নেন। পুনরায় ম্যাগজিন বন্দুকে লোড করে নিলেন। লক পজিশনে করে গাড়ির দরজা খোলা রেখেই পা বাড়ালেন এমপি রজবানের মৃত দেহের দিকে। কাছে গিয়ে বসে পড়লেন। লক করা বন্দুকটা তার ডান হাতে ধরিয়ে দেন। তর্জনী আঙুল ছাড়া পরবর্তী তিন আঙুল বন্দুকের হাতলের সাথে জুড়ে দিলেন। তর্জনী আঙুলটি ট্রিগারের সাথে সূক্ষ্মভাবে রাখলেন। এতটা সুনিপুণভাবে কাজটি করেছেন কেউ বুঝবে না যে এটি অন্য কেউ ধরিয়ে দিয়েছে। বরং দেখলে মনে হবে, তিনি নিজেই বন্দুক ধরে রেখেছেন।
লোকটি ইন্সপেক্টর রবিনের মৃত দেহের দিকে পা বাড়ালেন। তার বন্দুকটি পেলেন কোমরের পেছন দিকে। এতে করে একটা মৃদু হাসি দিলেন লোকটি। মৃদু স্বরে বললেন, ‘ ইন্সপেক্টর রবিন, তুমি চতুর হলেও একটু বোকামি করে ফেলেছ। এবং তোমার বোকামিটাই তোমার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘
আর কিছু বললেন না। কোমর থেকে বন্দুকটা বের করে পূর্বের মতো এবারও বন্দুক থেকে ম্যাগজিন বের করে দুটো গুলি খুলে তার পকেটে নিয়ে নেন। পূর্বের মতো এবারও রবিনের হাতে ধরিয়ে দেন বন্দুক। সুনিপুণ হাতেত কাজ। দেখলে মনে হবে যেন, রবিন নিজেই বন্দুকটা ধরে রেখেছেন। শিকারি তার কাজ শেষ করা গুনগুন করে ইংলিশ গান করতে করতে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পড়লেন। একটু আগে চালানো বন্দুকটা হাতে নেন। ম্যাগজিনটা খুলে পকেটে রাখা চারটে বুলেট অতি দ্রুততার সহিত লোড করে নেন। পুনরায় ম্যাগজিন বন্দুকে লোড করে কোমরে গুঁজে রাখেন। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে রেখেছেন শিকারি। মনখুলে শ্বাস নিচ্ছেন। সে তার শিকারকে ভক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এখন কেবল অপেক্ষায় আছেন কাল সকাল হবার। মিডিয়ায় সম্প্রচারিত খবর তাকে আরও তুষ্টি প্রদান করবে।
ছয়.
দুপুর দিকে স্টেশনে ক্লান্ত শরীরে কিছু ফাইল দেখছিলেন ইন্সপেক্টর ফারহান আহমেদ। এমন সময় কক্ষে ছুটে আসে সাইমুন। তার ছুটে আসা দেখে ফাইল থেকে মাথা তুলে সেদিকে তাকান। বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে সে। কিঞ্চিৎ ভ্রু-জোড়া কুঁচকে এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। ইশারায় পাশে থাকা চেয়ারে বসার আদেশ দিলেন। টেবিলের উপর রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে তার দিকে এগিয়ে দিলেন। গ্লাস হাতে পানি নিয়ে এক চুমুকে পুরো পানি খেল। এখন একটু স্বস্তি লাগছে তার। মুখ খুললেন ফারহান আহমেদ,
‘ তোমাকে কতদিন বলছি? এভাবে হন্তদন্ত করে হয়রান হয়ে আমার রুমে আসতে হবে না। আস্তে ধিরে এলেও তো হয় তাই না? ‘ স্বাভাবিক স্বরে কথাগুলো বললেও মিশে ছিল চাপা শাসন।
‘ স্যার….! আমি আজকে ইচ্ছে করে দৌড় দিইনি। একটু আগে কল এসেছিল….। আমিহ.. আমিহ… রিসিভ করলাম। ‘ থেমে গেল। এতটুকু বলতেই হাঁপিয়ে গেছে সে।
‘ এরপর কী হলো? এলিয়েন কল করেছিল নাকি? তোমাকে কি তাদের গ্রহে নিতে চায়?’ একটু মজার ছলে প্রশ্ন করলেন তিনি।
পুনরায় বলতে লাগল সাইমুন,
‘ওপাশ থেকে কেউ একজন বলল, শহরের উত্তরদিকের জঙ্গলের ধারে দুটো মৃত দেহ পাওয়া গেছে…..!’ আবার একটু থামলেন। ঢোক গিলে আবারও বলতে লাগলেন,
‘ আর দেহ দুটো শহরের এমপি রজবান সাহেবের এবং আমাদের ডিপার্টমেন্টেরই পাশের থানার ইন্সপেক্টর রবিন স্যার। ‘
ভয়ার্ত কণ্ঠের সাথে চেহারার ভাব প্রকাশ করল সে। আবার বলতে লাগে,
‘ আমি…আমি…আমি এত পরিমাণে ভয় পেয়েছি,কল্পনাও করতে পারবেন না স্যার। ‘ এখনো বড় বড় দম ওঠানামা করছে তার। খুব মনোযোগ সহকারে তার কথাগুলো শুনছিলেন ফারহান আহমেদ। প্রত্যুত্তর করলেন,
‘ তুমি হলে বীর। বীরদের সামান্য কারও মৃত্যুর সংবাদে ভয় পাওয়া মানায়? চলো। স্পট ঘুরে আসা যাক। ‘
‘ আপনি সাথে থাকলে স্যার, এলিয়েনের দেশে যেতেও আমার আপত্তি নেই। ‘ স্বাভাবিক হয়ে দম ফেলল সে।
‘ থাক, আর ইয়ারকি করতে হবে না, চলো। ‘
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তার সাথি হল সাইমুন। কক্ষ থেকে বেরিয়ে দুটি ভ্যানে মোট ২০ জন সাধারণ পুলিশ অফিসারসহ তারা রওনা দিলেন। ভ্যান দুটো তাদের পিছুপিছু আসছে। সাইমুন এবং ফারহান আহমেদ আলাদা গাড়িতে করে যাচ্ছেন। গাড়ি ড্রাইভ করছে সাইমুন।
আধঘন্টার মাঝে মার্ডার স্পটে পৌঁছে গেলেন তারা। চারদিকে টিভি,মিডিয়া চ্যানেলের লোকজন ছাড়াও সাধারণ জনগণের ভিড় লেগে আছে। কয়েকজন পুলিশ অফিসার গাড়ি থেকে নেমেও পুরো যায়গাটার আশেপাশে নো এন্ট্রি টেপ ঝুলিয়ে দিচ্ছে। সাথে কে পুলিশকে এখানের খবরটি জানিয়েছিল, তার খোঁজ করছেন সাইমুন। গাড়ি থেকে বেরিয়ে মৃত দেহ দুটির কাছে উপস্থিত হলেন ফারহান আহমেদ। মৃত দেহ দুটো দেখে নিশ্চিত হলেন, সাইমুনের শোনা ঘটনাটি তাহলে সত্য। মৃত দেহ দুটোর চারপাশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন তিনি।
ইতোমধ্যে আগত টিভি চ্যানেলগুলো তাদের লাইভ রিপোর্ট করা শুরু করে দিয়েছেন। তরতর করে বাড়ছে তাদের ভিউয়ের সংখ্যা।
সাত.
কালো আলখাল্লা পরা পা থেকে মাথা অবধি সম্পূর্ণ ঢাকা একজন লোক একটি বদ্ধ রুমে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু দাঁড়িয়ে আছেন বললে ভুল হবে, বরং একটি কাচের বোর্ডের দিকে মুখ করে বেশ কিছুক্ষণ যাবত কিছু একটা দেখে চলেছেন। হাতে রয়েছে একটি রেড মার্কার। একটু এঙ্গেল থেকে প্রদশর্ন করলে স্পষ্ট হয়, লোকটি কাচের বোর্ডে ঝোলানো কিছু ছবির দিকে গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছেন। ছবিগুলো আঠা ব্যবহার করে বোর্ডে ঝোলানো হয়েছে। মোট চারটি ছবি। একটি ছবি পর পর এরো চিহ্ন দেয়া আছে। কিন্তু অস্বাভাবিকভাবে প্রথম এবং দ্বিতীয় ছবির উপর রেড মার্কার দিয়ে ক্রস চিহ্ন দেয়া আছে। প্রথম ছবিটি এমপি রজবানের। এবং এরো চিহ্ন দিয়ে তার পাশের ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে ইন্সপেক্টর রবিনকে। বাকি ছবিগুলোতে এখনো রেড মার্কারের ক্রস চিহ্ন পড়েনি। সেদিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছিলেন তিনি। এমন সময় দেয়ালে ঝুলানো টিভি থেকে জনপ্রিয় খবর পাঠ চ্যানেল থেকে লাইভ সম্প্রচারিত খবর ভেসে আসতে লাগল।
‘ জঙ্গলের ধারে পাওয়া গেছে শহরের এমপি রজবান এবং ইন্সপেক্টর রবিনের মৃত দেহ। দুজনের হাত থেকেই উদ্ধার করা হয়েছে বন্দুক। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা যাচ্ছে, তাদের দুজনের মাঝে বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে। এবং এতে উভয়ই বন্দুকের গুলিতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মারা যান। ইতোমধ্যেই মার্ডার স্পটে পুলিশ এসে নো এন্টি টেপ ঝুলিয়ে দিয়েছেন। এবং ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টসহ বাকি অফিসারগণ চারপাশে ক্লু খুঁজছেন। ইন্সপেক্টর ফারহান আহমেদ চারপাশে নজর বোলাচ্ছেন। হয়তো ঘটনার পূর্ণাঙ্গ চিত্র অনুধাবন করার চেষ্টা করছেন। আপাতত কিছুই বলা যাচ্ছে না। তাই আগামী আপডেট পেতে আমাদের সাথেই যুক্ত থাকুন। ধন্যবাদ। ‘
— চলবে —