খুন সিরিজ তৃতীয় সিকুয়েন্স,চতুর্দশ পর্ব
গল্প:- মাস্টার অব মাইন্ড গেম
লেখা:- যাবেদ খান আবু বকর
তেত্রিশ.
চারিদিকে সরব পড়ে গেল ইন্সপেক্টর ফারহানের স্ত্রী রাহেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধিন অবস্থায় মারা গেছেন। বডি পোস্টমর্টেমের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো, মিডিয়ার সামনে সরাসরি বলেছেন তিনি, আমার স্ত্রীর খুনিদের না ধরা অবধি আমি আমার স্ত্রীর জানাজা পড়াব না।
ব্যাপারটা তিনি এতটা স্ট্রিক্টলি বলেছিলেন যে, সেখানে উপস্থিত থাকা অধিকাংশ মানুষের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছিল। সচারাচর এরকম কঠিন স্বরে একজন মানুষ তখনই বলতে পারেন, যখন তার মাঝে ফুটন্ত ক্ষোভগুলো লাভার মতো ওথলাতে থাকে। ফারাহানের মাঝে বিদ্যমান ক্ষোভগুলো তার চোখে ছাপ দেখা দিচ্ছিল। চোখের দুই কোটরে মৃদু অশ্রুজল ভেসে উঠেছে। কিন্তু তিনি তা পাত্তা না দিয়ে একাই ভেতরদিকে হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ভীড়ের ফলে পারেননি।
হাসপাতালের ভেতর থেকে অ্যাজেন্ট যাবেদ বেরিয়ে এলেন। পা বাড়ালেন পার্কিং লটের দিকে। রুক্ষমূর্তি রূপ নিয়ে তার পিছুপিছু হেঁটে আসছেন ফারহান। পার্ক করে রাখা গাড়িতে পেছন সিটে উঠে বসেন অ্যাজেন্ট। ড্রাইভিং সিটে গিয়ে উঠে বসেন তার অ্যাসিস্ট্যান্ট। গাড়ি নিয়ে ছুটতে থাকে। এখন আর হাসপাতালের প্রধান গেইট বন্ধ করা নেই। খুলে দেওয়া হয়েছে। প্রতিনিয়ত গাড়ি আসছে আর যাচ্ছে হাসপাতালে। ডিআইজির মেয়ে মারা গেছে! ছোটোখাটো ব্যাপার নাকি? গাড়ি নিয়ে ফারহান চলে এসেছেন থানায়। গাড়ি নিয়ে ভেতরে ঢুকে ডাকলেন তার সিনিয়রকে।
‘ স্যার, চলে এসেছি। ‘
ধ্যানে পড়ে ছিলেন অ্যাজেন্ট। কারও ডাক শুনে ঘোর ভাঙে তার। অ্যাসিস্ট্যান্টের দিকে তাকালে বুঝতে পারেন, ডাকটা সেই তাকে দিয়েছে। ভ্রু কুঁচকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? প্রত্যুত্তরে তার অ্যাসিস্ট্যান্ট মৃদুকণ্ঠ নিয়ে বললেন,
‘ থানায় চলে এসেছি। ‘
‘ওহ’ আলতো কণ্ঠে শ্রাগ করলেন অ্যাজেন্ট। এরপর গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন তিনি। পা বাড়ালেন থানার ভেতর দিকে। তার পিছুপিছু অ্যাসিস্ট্যান্টও কম যায় না। গাড়ি সেখানেই লক করে তার পিছুপিছু দ্রুত হেঁটে তার পাশে এসে উপস্থিত হন। দুজনে একত্রে থানার ভেতরে প্রবেশ করেন। সিনিয়রকে পথপ্রদর্শন করছেন ফারহান। তবে তাকে এই মুহূর্তে থানায় দেখে সেখানে থাকা অফিসারগণ বেশ চমকেছেন। চমকে যাবারই কথা। তার স্ত্রী মারা গেছে, কোথায় তিনি সেখানে বসে কান্নাকাটি করবেন। তা না করে উলটো থানায় কী করছেন? তাও একটা খাম্বার মতো লম্বা লোকের সাথে? কালোজামের খাম্বা বললেও মন্দ না। কিন্তু তাদের ভাবনা এবং চাহনি দুটোকেই অগ্রাহ্য করে এগিয়ে গেলেন ফারহান নিজের কক্ষের দিকে। তার রুমটা একদম এক কর্ণারে। অবশ্য থানার সবচেয়ে সুন্দর স্থানে তার রুমটি তাও বলা যায়। তারা দুজনে কক্ষে ঢুকতেই অ্যাসিস্ট্যান্ট দরজা আটকে দেন। সেদিকে লক্ষ্য করেন না অ্যাজেন্ট। তার নজর রুমের এক কর্নারে থাকা কর্কবোর্ডের দিকে। খয়েরি রঙের কর্কবোর্ডে ঝুলছে বেশ কিছু ছবি আর তথ্য। সেগুলোর মাঝে আবার সুতো দিয়ে একটার সাথে আরেকটার সংযোগ বুঝানোর চেষ্টা করেছে। অ্যাজেন্ট যা বুঝার বুঝে গেছেন। তিনি দ্রুত টেবিলের উপরে থাকা একটি কাগজে লিখলেন, ড. নয়ন। পরবর্তী আরেকটা কাগজে লিখলেন প্রাইভেট নাম্বার। এরপর এগিয়ে গেলেন কর্কবোর্ডের দিকে। এমপি রজবান হতে শুরু করে ড. নয়নের নামসহ বোর্ডের চারপাশে সংস্থাপন করলেন। এবং সবকিছুর মধ্যখানে পিন দিয়ে আটকালেন প্রাইভেট নাম্বার লেখা কাগজটি। এরপর ফিতা টেনে একটি অংশ অপরটির সাথে জুড়ে দিতে শুরু করলেন তিনি। কাজ শেষ করে দাঁড়ালেন দুকদম পেছনে এসে। তিনি এবং তার অ্যাসিস্ট্যান্ট দুজনে কর্কবোর্ডের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকালেন। কোনোকিছু মিসিং গেছে? নাহ, কিছুই মিসিং যায়নি।
সবচেয়ে অবাক বিষয় হলো, প্রত্যেকটি ঘটনাগুলো এসে একটা যোগসূত্রে এসেই গাঁথছে। আর তা হলো প্রাইভেট নাম্বার। তারচেয়েও অবাক করা বিষয় হলো, সেলে গুলি খেয়ে মারা যাওয়া ছেলেটির কল রেকর্ড থেকেও সেই প্রাইভেট নাম্বারটি খুঁজে পেয়েছে। তৎক্ষণাৎ অ্যাজেন্টের মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে শুরু করে। ফারহানের পরিবারের দিকে আক্রমণ করার অনেক কারণ থাকতে পারে। কিন্তু এমপির পরিবারের সাথে কার এমন সত্রুতা থাকতে পারে যে, তার সম্পূর্ণ পরিবারকেই ধূলিসাৎ করে দিতে ইচ্ছে হলো! তাছাড়া এরমাঝে ইন্সপেক্টর রবিন অ্যাড হলো কী করে? প্রশ্ন করে বসেন ফারহানকে।
‘ ফারহান, এমপির পরিবার আর ইন্সপেক্টর রবিনের মৃত্যুর তেমন কোনো কানেকশন কি পেয়েছিলে কোনো তদন্তে? ‘
‘ তেমন কিছুই পাইনি। ‘
সরাসরি উত্তর প্রদান করেন অ্যাসিস্ট্যান্ট। কিন্ত তৎক্ষণাৎ ভাবনায় লিপ্ত হয়ে পড়েন। আচমকা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলতে আরম্ভ করেন,
‘ স্যার, পেয়েছিলাম একটা। ‘ থেমে যান। ঢোক গিলে ফের ব্যস্ত হয়ে পড়েন নিজ বক্তব্য প্রদানে। ‘ এমপির ছেলের বউ বলেছিল, কোনো একটা বিজনেস ডিল নাকি তাদের বাসায় হয়েছিল। আর তখন তাদের মাঝে বনাবনি হয়নি। এরপর লোকটি হুমকি দিয়েছিল। ‘ বক্তব্য শুনেই প্রশ্ন ছুড়ে দেন সিনিয়র,
‘ এরপর আর এই বিষয় তদন্ত করেছিলে? ‘
প্রত্যুত্তরে মলিন মুখ পান অ্যাজেন্ট। তিনি যা বুঝার বুঝেছেন।
‘ আচ্ছা, এই এমপির সাথে তার বিপক্ষের নেতার সখ্যতা কেমন? ‘
প্রত্যুত্তরে ফের একটা মলিন চেহারা পেলেন যাবেদ। পরপর দুটো প্রশ্নের উত্তরেই একই রকম ভঙ্গিমা দেখে ভীষণ রকমের বিরক্ত হলেন। কিছু বললেন না তারপরেও। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি পুনরায় প্রশ্ন ছুড়লেন,
‘ বিরোধী দলের উপর কোনো তদন্ত চালিয়েছ? ‘
এবারও জবাবে ফারহানের মলিন মুখ। রাগ যেন সিনিয়রের উপচে পড়ছে। তবু নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললেন,
‘ এই মুহূর্তে বিরোধী দলের নেতার উপর তদন্ত শুরু করো। তার ব্যবহৃত প্রত্যেকটা ফোনের গত এক মাসের কল ডিটেইলস আমি আগামী বিশ মিনিটের মাঝে আমার টেবিলে চাই। দ্রুত যাও! ‘ আদেশ মান্য করতে মুহূর্তের মাঝেই অ্যাসিস্ট্যান্ট বেরিয়ে পড়লেন কক্ষ থেকে। ছুটলেন কাজের উদ্দেশ্যে। অপরদিকে সিনিয়র কর্কবোর্ডের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পা বাড়ান ডেস্কের দিকে। ডেস্কের ফ্রন্ট চেয়ারে গিয়ে বসে পড়েন তিনি। ভাবনায় মশগুল হয়ে পড়েন। এ অবধি শোনা প্রত্যেকটি ঘটনা একটি অপরটির সাথে মিলানোর চেষ্টা করছেন। যদি সফল হন এই ভাবনায় মস্তিষ্ককে সায় দিচ্ছেন। তবে তিনি এতটুকু অনুধাবন করতে পেরেছেন, কেসে সামথিং ইজ মিসিং। যেটা গুরুত্ব থেকেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু। কিন্তু নজরে না পড়ার কারণে সঠিক ফায়ছালা অবধি পৌঁছাতে পারছেন না।
চৌত্রিশ.
যখন অ্যাজেন্ট ভাবনায় বিভোর, তখনই তার উঁড়ু কাঁপিয়ে বেজে ওঠে তার ফোন। ভাবনা থেকে ছিটকে পড়েন। ফের ভাবনায় মনোযোগ না দিয়ে বরং পকেট থেকে ফোনটা বের করে আনেন। একটা আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে। একটু বিচলিত হয়ে যান। তার নাম্বার খুব কম মানুষেরই জানা। তখনই কিছুক্ষণ আগের করা কাজটির কথা মাথায় আসে। দ্রুত কলটি রিসিভ করে কানে তুলতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে ডা. নয়নের কণ্ঠস্বর। বলতে শুরু করেন তিনি।
‘ স্যার, পরিকল্পনা সফল। ‘
একটা মুচকি হাসি প্রদান করেন অ্যাজেন্ট ফারহান। শীতল কণ্ঠে বলতে লাগেন,
‘ এখন আপনি আপনার বাকি কাজটুকু সেরে ফেলুন। আপনার আমানত আপনাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরচেয়ে উত্তম আর কিছু আছে? ‘
তারা দুজনে যখন কথোপকথনে ব্যস্ত, তখনই কক্ষের মাঝে হাতে কতগুলো কাগজ নিয়ে প্রবেশ ঘটে ফারহানের। সিনিয়রকে কথা বলতে দেখে কৌতূহল জাগে নিজ মনের মধ্যে। চোখের ইশারায় জানতে চান, কী হয়েছে? কে করেছে। তার সিনিয়রও তাকে চোখের ভাষা ব্যবহার করেই জবাব দেন।
‘ সব ঠিক আছে। পরিকল্পনা মতোই সব হয়েছে। ‘
ফারহানকে জবাব দিয়েই তিনি ড. নয়নকে বলেন,
‘ আমরা আমাদের দেওয়া কথা রেখেছি, এবার আপনি আপনার দেওয়া কথাকে রাখুন। ‘
কথা শেষ করেই কলটা কেটে দিয়ে ফোনটা পকেটে রেখে দিলেন পুনরায়। ফারহানের হাতে থাকা কাগজগুলো নিজের দিকে দিতে বললেন। তখনই চমকপ্রদ একটা কথা বলেন জুনিয়র।
‘ স্যার, এই কল রিপর্টগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, প্রাইভেট নাম্বার থেকেও তাকে একাধিকবার কল করা হয়েছে। এবং তাও প্রত্যেকটি কলই দুই মিনিটের আগেই কেটে দিয়েছে কলার। ‘
‘ দ্যাটস দ্য পয়েন্ট! আমার বারবার মনে হচ্ছিল, এই কেসের সাথে তিনি যুক্ত আছেন। ‘ একটু থামলেন অ্যাজেন্ট। গম্ভীর কণ্ঠস্বর করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ উনার নাম কী যেন? ‘
‘ কালাম ‘ সরল মনে এক শব্দে প্রত্যুত্তর করলেন। কিন্তু নামটা শুনে ভাবনায় মত্ত হয়ে যান তার সিনিয়র। আচমকা বলতে লাগলেন,
‘ কালাম…কালাম…কালা….! এক মিনিট, বছর দুই আগে না কালাম নামের একজনকে ড্রাগসের মামলায় অ্যারেস্ট করেছিল পুলিশ। কিন্তু প্রমাণ না পেয়ে জামিন পেয়ে যায়। এটা কি সেই কামাল?’
‘ জি স্যার ‘ অ্যাসিসটেন্টের জবাব পজিটিভ পেয়ে তিনি যেন আরও উৎসুক হয়ে পড়লেন। যেন তিনি সব ঠিকভাবেই ধরতে পেরেছেন! তাকে ভাবনায় মশগুল হতে প্রথমবারের মতো প্রশ্ন ছুড়লেন অ্যাসিস্ট্যান্ট।
‘ স্যার, কী ভাবছেন এত? ‘
‘ ভাবছি, এই কেসের প্রত্যেকটা ঘটনার সাথে যুক্ত আছে প্রাইভেট নাম্বার। আর এই প্রাইভেট নাম্বারের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত আছে কালাম। ‘ অ্যাজেন্ট দম ফেলে থামতেই ফের প্রশ্ন করেন জুনিয়র।
‘ তাহলে আমরা কেন প্রাইভেট নাম্বারটাকে ট্রেস করছি না স্যার? ‘
হা হয়ে গেলেন জুনিয়রের এমন প্রশ্ন দেখে সিনিয়র। বুঝতে পারলেন, বেচারার মাথা এই মুহূর্তে আদতেই ঠিক নেই। নতুবা এত এত কেস সামলেছে, অথচ এই সামান্য বিষয়টা নিয়েও তাকে প্রশ্ন করছে! অস্বাভাবিক বিষয় যেন।
‘ ভুলে গেলে নাকি? প্রাইভেট নাম্বারগুলো ভিন্ন কোড দিয়ে বানানো। যা প্রতি সেকেন্ডে দশ থেকে বারোটি স্থান প্রদর্শন করে। পুনরায় রিফ্রেশ করলে আবার স্থান পরিবর্তন হয়ে যায়। তো সঠিক লোকেশন কোথায় পাবে তুমি? ‘ প্রশ্নের জবাব পেয়ে নিজেকেই নিজে বেকুব বলে দোষারোপ করতে শুরু করলেন জুনিয়র। কিন্তু সেদিকে পাত্তা দিলেন না তার সিনিয়র। তিনি তার কর্মে ব্যস্ত। আচমকা বিরবির করে বলতে আরম্ভ করলেন, হোয়াট আর মাই মিসিং….হোয়াট আর মাই মিসিং…! আচমকা প্রশ্ন ছুড়ে দেন জুনিয়রের দিকে।
‘ এই, আমি শুনেছি, তুমি যখন এমপির ছেলের বউয়ের খুনিকে ধরে এনেছিলে, তখন তোমার সন্দেহ হয়েছিল, এই কাজটি সম্পূর্ণ ওর নয়। এমনটা কেন মনে হয়েছিল তোমার? ‘
একটু দ্বিধায় পড়ে যান ফারহান। এই মুহূর্তে কিছুই মাথায় আসছে না। তাছাড়া তার সিনিয়র এগুলোর ব্যাপারে জানল কী করে? সে তো বলেনি তার সিনিয়রকে! তবে..! সেদিকে ভাবনা বাদ দিয়ে সিনিয়রের জবাব নিয়ে ভাবতে আরম্ভ করলেন। কোমল কণ্ঠে দুশ্চিন্তা বিজড়িত স্বরে বিবৃতি দিলেন,
‘ সেদিন রাহেলা আমাকে কল করেছিল কিছুক্ষণ আগে। এরপরেই আমি এমপির বাসায় ছুটে যাই। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেহরক্ষীদের মৃত পাই। তাছাড়া সম্পূর্ণ বাসা তন্নতন্ন করে খুঁজেও মেয়েটাকে কোত্থাও পাইনি। তখনই আমার সহকারী আমাকে কল করে লাইভের ব্যাপারে জানায়। ‘ তাকে থামান সিনিয়র। পালটা অনুসন্ধানসূচক প্রশ্ন করেন,
‘ এখানে কোনো অস্বাভাবিক বিষয় উপস্থিত ছিল বা মনে হয়েছে? ‘
‘ জি স্যার। দেহরক্ষীদের মৃতদেহ, মেয়েটাকে কিডন্যাপ করে নেওয়া, ছেলেটার একার পক্ষে অসম্ভব ছিল বলা যায়। ‘ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানান জুনিয়র। সিনিয়র ভাবনায় পড়ে যান। কিছু একটা মস্তিষ্কে চলছে তার। ভাবনারত অবস্থাতেই জিজ্ঞেস করেন,
‘ ছেলেটার ব্যাক হিস্ট্রি দেখেছ? কোথায় বড়ো হয়েছে, কোথায় কী করত বা কোথাও কেস ছিল কি না!’
মাথা নিচু করে নেন প্রশ্ন শুনে। প্রত্যুত্তর পেয়ে যান সিনিয়র। তবে কিছু বলেন না কিংবা কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখান না। বরং শান্ত স্বরে শ্রাগ করলেন।
‘ তাহলে এক কাজ করো, জেলা পর্যায়ের সমস্ত থানাগুলোতে ছেলেটার ব্যাপারে কোনো রিপোর্ট থাকলে জানতে চেয়ে আবেদন করো। এবং দ্রুত তা জানানোর ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করো। ‘
‘ ঠিক আছে স্যার। ‘
বিনা বাক্য ব্যয়ে সিনিয়রের কথা মেনে নিলেন। কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যেতে নিলেই পেছন থেকে ডেকে ওঠেন তার সিনিয়র।
‘ ফারহান শোনো ‘
পেছন ঘুরে দু কদম এগিয়ে প্রতিক্রিয়া জানান,
‘ জি স্যার? ‘
‘ অপজিশন নেতা কালামকে এক্ষনই থানায় আসার জন্য বলো। যদি জানায়, সে আসতে পারবে না বা অন্য কিছু। তবে সরাসরি বলবে, তার উপর তোমার সিনিয়র এক্সট্রা চার্জশিট তৈরি করছেন। কালবিলম্ব না করেই যেন দ্রুত আসে। নতুবা অ্যারেস্ট করে আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়ে টর্চার করতেও আমি পিছুপা হবো না। বলে দিয়ো। ‘
রাগে তার গা রিরি করছে। কেন এমনটা হচ্ছে তা তিনি নিজেই অনুধাবন করতে পারছেন না। তবে প্রচণ্ড রকমের রাগ হচ্ছে। অবশ্য হবারই কথা। এতগুলো ক্লু মিসিং হলো কী করে তা তিনি ভেবেই পাচ্ছেন না। অবশ্য কারও দোষ দিয়েই লাভ হবে না। কেননা পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। পুরোই টালমাটাল অবস্থা। অবশ্য তিনি এও বুঝতে পেরেছেন, খুনিরা ভালো করেই জানে, এরকম টালমাটাল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারলে খুব সহজেই তারা পার পেয়ে যেতে পারবে। এবং তারা তাদের কাজ সঠিকভাবে করতে পারবে। তাছাটা এরকম পরিস্থিতি দাঁড় করাতে পারলে কেস দুর্বল হয়ে পড়বে, সঠিক তদন্তের অভাবে কেস হয় আনসলভ অবস্থায় ক্লোজ করে দেওয়া হবে। নতুবা এই কেসটা নিয়ে আর কেউ কাজ করতে চাইবে না। আবার যে কাজ করছিল এটা নিয়ে, সে-ও এটা নিয়ে সামনে আগাতে পারবে না। ইমোশনালি এটাচ হয়ে গেছে।
খুনিদের মাইন্ড পড়ে নিয়েছেন অ্যাজেন্ট যাবেদ। তিনি বুঝতে পারছেন, কতটা প্রপার প্ল্যানিং করেছেন, তা কেবল তারাই জানে। হ্যাঁ তারাই। একজনের কাজ এটা নয়। একাধিক লুকিয়ে আছে এই কেসের পেছনে। তবে তারা ভাবতে পারেনি, তাদের আনসলভ কেসকে সলভ করার জন্য কাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে! তবে তিনি এটাও অনুধাবন করতে পেরেছেন, ঘটমান প্রত্যেকটি ঘটনার সাথে শুধু প্রাইভেট নাম্বারই একটা সংযোগ স্থাপন করে না। আরও কোনো না কোনোভাবে সংযুক্ত আছে একে অপরের সাথে। হয়তো পূর্বের কোনো ঘটনার সাথে সংযোগ রয়েছে। যখন তিনি ভাবনায় বিভোর, তখন কক্ষের দরজা থেকে কড়া নাড়ার শব্দ ভেসে আসে কানে। মাথা তুলে দরজার দিকে তাকান তিনি। দেখতে পান, ফারহানের পাশে একজন মধ্যবয়সী লোক। পর্যালোচনা করে বুঝতে ভুল করলেন না, এটাই কালামের সেই লোকটি। চেয়ারের ব্যাকরেস্টে হেলান দিয়ে লোকটির দিকে তাকালেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। লোকটির তার দিকে এগিয়ে আসা, মুভমেন্ট সবই পর্যবেক্ষণ করলেন। কিন্তু কিছুই বললেন না। বুঝতে পেরেছেন, তাকে এভাবে হুমকিস্বরূপ ডেকে আনাটা মোটেও পছন্দ করেননি তিনি। এমনকি তার এরকম ব্যাকরেস্টে হেলান দিয়ে বসে থাকাটাকেও ভালোভাবে নেননি। কিন্তু তাতে তার কিছুই যায় আসে না। কেসের সিলসিলায় এরচেয়ে বড়ো বড়ো লোকেদেরকে দৌড়িয়ে ছেড়েছে। সেখানে সে কোন ক্ষেতের মূলা? এমপিও নন, এমপির ক্যান্ডিডেট সবে। লোকটি এসে রাগচটা ভাব নিয়ে তার সামনে থাকা একটা চেয়ার টেনে তাতে বসে পড়লেন। অ্যাজেন্টও ব্যাকরেস্ট থেকে হেলান ভেঙে সোজা হয়ে বসলেন। হাত দুটো দুজনেরই টেবিলের উপরে। লোকটি গরম দেখিয়ে তেজি স্বর নিয়ে বলতে আরম্ভ করতে চাইলেন। কিন্তু তাতে বাধা প্রদান করলেন অফিসার। বাধা পেয়ে তৎক্ষণাত বেকুব বনে গেলেন। কিন্তু সেদিকে ধ্যান দিলেন না অ্যাজেন্ট। চওড়া কণ্ঠে বলতে লাগলেন,
‘ নিজেকে মহারথী ভেবে ভুল করবেন না। এটা বাড়ি কিংবা অফিস নয়। কাজেই দেশের নাগরিক হিসেবে আইনের কাজে যখন, যে অবস্থায়, যেভাবে, যেথায় ডাকা হবে, সেথায় সে অবস্থাতে তখনই আপনাকে আসতে হবে। এবং আমাদের সাথে কো-অপারেট করতে হবে। নতুবা ভিন্ন পন্থা আমাদের জন্য খোলা আছে। ‘ লোকটির চেহারার দিকে তাকালেন অ্যাজেন্ট। বুঝতে পারলেন, বেচারা মোটেও ভাবতে পারেনি, তাকে এভাবে হুমকি দেবে থানার ভেতরেই কেউ! হরহামেশাই থানার ভেতর ঢুকে তাদের মতো ক্যান্ডিডেট লোকেদের ক্ষমতা কম নয় তা প্রমাণ করে বা দিয়েছে। কিন্তু আজ যেন মুখফুটে কোনো কথাই বেরুচ্ছে না। ফের বলতে আরম্ভ করলেন অ্যাজেন্ট,
‘ আর একটা কথা মনে রাখবেন, আমি আপনার ক্ষমতা বা লোকজন দেখে পাই না। বরং উলটাপালটা করলে কিছুক্ষণ আপনি আমাকে ভয় পেতে বাধ্য হবেন। কাজেই কো-অপারেট করা ছাড়া আপনার আর কোনো অপশন নেই। আরও একটা মনে রাখবেন, সম্পূর্ণ সময়টা আমি যা যা প্রশ্ন করব, তার উত্তর দিতে হবে আপনাকে। আর মোটেও গরম দেখানো যাবে না। তবে ভেবে নেবেন, আপনি নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছেন। ‘
অ্যাজেন্টের হুমকি কাজে দিয়েছে। বেচারার ভোজবাজি ছুটে গেছে সব। যতটা ভাব-গতিক নিয়ে কক্ষের ভেতরে এসেছিল, তার ছিটেফোঁটাও নেই। যেন বিড়াল বনে গেছেন। আর এমনটাই চেয়েছিলেন অ্যাজেন্ট যাবেদ। এবার তিনি তার প্রসিডিওর কাজ শুরু করলেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন একে একে।
– চলবে –