খুন সিরিজ তৃতীয় সিকুয়েন্স,অন্তিম পর্ব
গল্প:- মাস্টার অব মাইন্ড গেম
লেখা:- যাবেদ খান আবু বকর
ছত্রিশ.
প্রশ্নের বাণে বিদ্ধ হয়ে চমকে ওঠে এমপি পদপ্রার্থী কামাল নামের লোকটি। সে এত পরিমাণেই ভয় পেয়েছে যে, ভয়ের দাপটে কণ্ঠনালি দিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে শব্দও বুনন হচ্ছে না। সেদিকে বিন্দু পরিমাণ ভ্রুক্ষেপ নেই অ্যাজেন্ট যাবেদের। তার প্রয়োজন প্রশ্নের জবাব। এর বাইরে গিয়ে সাসপেক্ট ভয় পেয়ে মারা যাক কিংবা আধমরা হয়ে বেঁচে থাকুক তাতে তার কিছু যায় আসে না। তিনি তার উদ্দেশ্যে অনড়। পুরোনো স্বভাব এখন অবধি ছাড়তে পারেননি। অবশ্য তিনি কখনো চেষ্টাই করেননি, সাসপেক্ট কিংবা ক্রিমিনালদের প্রতি মমত্ববোধ দেখানোর। তিনি তার কাজ এবং উত্তর অবধি সীমাবদ্ধ। এরপর গিয়ে তারা ভাড়মে যাক। তা তার দেখার কিংবা মাথা ঘামানোর বিষয় না। আকস্মিক তিনি কণ্ঠটাকে চড়াও করে তেজী স্বরে বললেন,
‘ কথা বলছিস না কেন? কী বিষয় নিয়ে কথা হতো তোর সাথে?’
ধমকের ধাক্কায় কেঁপে ওঠে লোকটি। নিজেকে আস্বস্ত করে ফের কণ্ঠনালি দিয়ে শব্দ বের করার চেষ্টা করল।
‘ আ…আমারে ফো..ফোন..’ সাথে সাথে গর্জে উঠলেন অ্যাজেন্ট। রাগে চিৎকার সুরে বলতে লাগলেন,
‘ তোতলাচ্ছিস কেন? সোজাসাপটা বল!’
‘ সাব, আমা..রে ফোন দিয়া একদিন কয়, হেগো লগে নাকি রজবানের লগে কী ঝামেলা হইছে। ‘ ঢোক গিলার জন্য থামে লোকটি। কিন্তু অ্যাজেন্ট যেন এতটুকু সময় অবধি তাকে বিরতি দিতে চাচ্ছেন না। প্রশ্ন করে বসেন,
‘ পরে? ‘
‘ আমারে কয়, হেরে খুন করত। হের পরিবারের সবাইরে খুন করব। ‘
কথার মাঝে ফোঁড়ন কেটে পাশ থেকে বলতে লাগলেন জুনিয়র ফারহান।
‘ এরপর তুই ওদের সাথে মিলে রজবান আর রবিন স্যারের মার্ডার পরিকল্পনা করলি। তাই তো? ‘
কড়া নজরে সিনিয়র তার দিকে তাকালেন। চোখের মাঝে বিদ্যমান আগুনের ঝলক দেখে আর ঠোঁট নাড়ানোর সাহদ হয়ে উঠেনি তার। সিনিয়র তার দিকে ধ্যান না দিয়ে লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘ এরপর? ‘
কামাল একটা ঢোক গিলে বলতে আরম্ভ করল পুনরায়,
‘ সাব, কী করতাম কন? চাইর বছর আগে রজবাইন্না ক্ষেমতায় আইছে। ক্ষেমতায় আইয়াই আমার বিজনেসডা বন্ধ কইরা দিছে। আমি যাই করবার যাই না কেন, রজবাইন্না আর রবিন্না আইয়া সেইহানে সমস্যা করবই। হেরলাই অগো লগে মিল্লা মারইন্না পিলান বানাই। ‘
‘ সবসময় কি শুধু ফোনেই কথা হয়েছে? নাকি সামনাসামনিও দেখা হয়েছে? ‘ প্রশ্নটি ছুড়ে দিয়ে অ্যাজেন্ট তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন লোকটির চোখের দিকে। হাতের দিকেও দৃষ্টি দিলেন। লোকটি হাত স্বাভাবিক রেখে ডান দিকে চোখগুলো ভিড়িয়ে প্রশ্নের জবাব দিলো,
‘ না সাব। ফোনেই কতা অইছে। কহনো সামনাসামনি দেহা অয় নাইকা। ‘
‘ ঠিক আছে। ‘
চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েন অ্যাজেন্ট। লোকটা যেভাবে ছিল, ঠিক সেভাবেই রেখে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগলেন। তা দেখে চেয়ার ছেড়ে তার পিছু ধরলেন জুনিয়র। কক্ষটি থেকে বের হয়ে কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই ফারহানের কক্ষে এসে পৌঁছুলেন তারা। অ্যাজেন্ট দ্রুত পায়ে কক্ষের উচ্চপদীয় আসনটি নিজ কব্জায় নিয়ে নিলেন। চেয়ারে হেলান দিয়ে ভাবতে লাগলেন কিছু একটা। এমতাবস্থায় নজর পড়ল ঘড়ির দিকে। প্রায় পৌণে এক ঘণ্টার কাছাকাছি সময় যাবত ইন্টারোগেশন করতেছিল এক অশিক্ষিত লোকের। তিনি যেন বেশ বিরক্তই হলেন। এর কারণও রয়েছে বেশ কিছু। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ, ক্ষমতাসীন লোক কিংবা রাজনীতিবিদ তার দুই চোখের বিষ বলা যায়। কোনোভাবেই এদের দেখা বা সহ্য করতে পারেন না তিনি। এরা একজনের দোষ অপরজনের ঘাড়ে চাপাতে ব্যস্ত থাকে। আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ গুণ হলো, অধিকাংশ রাজনীতিবিদই অশিক্ষিত। যে দেশে এদের মতো অশিক্ষিত রাজনীতিবিদ থাকবে, সে দেশে রাজনীতি মানেই মূর্খতা।
ব্যক্তিগত চিন্তা বাদ দিয়ে ফের ভাবনায় মশগুলো। কিছু একটা ভাবার চেষ্টা করছেন তিনি। ফারহান তার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিছু বলছেনও আবার নড়ছেনও না। তিনিও পর্যবেক্ষণ করছেন তার সিনিয়রের কার্যক্রমকে। অনুধাবন করার চেষ্টা করছেন, তার সিনিয়র আদতে কী করতে চেষ্টা করছেন। আচমকা তার উদ্দেশ্য হাঁক দেন তার সিনিয়র। বলে ওঠেন,
‘ ফারহান, ঘণ্টাখানেক তো হয়ে এলো। দেখো তো, ছেলেটার ব্যাপারে কোনো থানা থেকে তথ্য এসেছে কি না! ‘
তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলতে আরম্ভ করলেন জুনিয়র,
‘ একটু অপেক্ষা করুন স্যার। চেক করে জানাচ্ছি। ‘
কথাটি বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন কক্ষ থেকে। অপরদিকে সিনিয়র ভাবনায় পড়ে গেলেন। উঠে গেলেন তিনি চেয়ার ছেড়ে। পা বাড়ালেন কর্কবোর্ডের দিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে বাম হাত প্যান্টের পকেটে এবং ডান হাত মৃদু মুষ্টিবদ্ধ করে থুতনির নিচে ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা কেমন যেন একেবারেই ভিন্ন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে লক্ষ করছেন কর্কবোর্ডে থাকা সার্কেলের মাঝে বিদ্যমান সকল কিছু। কিছু কম কম মনে হচ্ছিল এতক্ষণ। অবশেষে খুঁজে পেলেন, কী কম রয়েছে। তিনি পেছনে হেঁটে টেবিলের কাছে উপস্থিত হলেন। একটি কাগজের পাশাপাশি হাতে নিলেন একটি কলমও। সেখানে চারজনের নাম লিখলেন। প্রথমজন রাহেলা, তার নামের পাশে প্রথম ব্রাকেট টেনে লিখে দিয়েছেন ফারহানের স্ত্রী। দ্বিতীয়জন, ফারহানের মেয়ে রাইসা। তৃতীয়জন হলো, এমপি পদপ্রার্থী কামাল। চতুর্থজন হলো, সেদিন রাতে ধরা পড়া সেই ছেলেটি। সাইমুনের কাছ থেকে তিনি জানতে পেরেছেন, ছেলেটের প্রাথমিক নাম ছিল, তুরাগ। সেই অনুসারে নামকরণ করে কাগজ তিনটি নিয়ে এগিয়ে গেলেন কর্কবোর্ডের দিকে। অবশ্য কাগজের টুকরোগুলো ফারহান আগে থেকেই কেটে রেখেছিলেন ছোটো ছোটো করে। যেন কর্কবোর্ডের জন্যই কাগজগুলো কাটা হয়েছে। টুকরো কাগজগুলো নিয়ে পা বাড়ালেন কক্ষের কর্নারে। এমতাবস্থায় প্রবেশ করলেন জুনিয়র। ডেকে ওঠেন তিনি। কিন্তু সিনিয়র তার ডাকে সারা দিলেন না। কিন্তু একটা হাত উঁচু করে ইশারায় তাকে আদেশ করলেন থামার। আদেশ পেয়ে তা মান্য করলেন জুনিয়র। হাতে একটি ফাইল নিয়ে এগিয়ে গেলেন সিনিয়রের পিছুপিছু। সেদিকে ধ্যান নেই অ্যাজেন্টের। তিনি তার কাজে ব্যস্ত। কর্কবোর্ডের মধ্যখানে পিন দিয়ে আটকানো আছে প্রাইভেট নাম্বার সেটা সেখানেই রাখলেন তিনি। ডান পাশে কামাল এবং তুরাগের কাগজটি দুটো পিন দিয়ে আটকে দিলেন। পাশেই ইন্সপেক্টর রবিনের ছবি আটকে দিলেন পিন দিয়ে। তার নিচেই পিন দিয়ে আটকালেন এমপি রজবানের ছবি। ঠিক তার নিচে এমপির ছেলের ছবি আটকালেন। এবং সর্বশেষ নিচে পিন দিয়ে আটকে দিলেন এমপির ছেলের বউয়ের ছবি। এবার এগুলেন বাম পাশে। প্রথমে পিন দিয়ে আটকে টাঙালেন ফারহানের স্ত্রী রাহেলা লেখা কাগজটি। তার নিচে ঝুলালেন জুনিয়রের মেয়ের নামের কাগজটি। তার নিচে ড. নয়ন নামের কাগজটি। অবশেষে একটা মৃদুকারে অর্ধেক সার্কেল তৈরি করলেন অ্যাজেন্ট। হাতে ফিতা নিয়ে ডান দিকের পিনগুলো এক ফিতায় বদ্ধ করে প্রাইভেট নাম্বারে এসে থামেন। এবং বাম দিক থেকে ফিতা টেনে এনে থামেন প্রাইভেট নাম্বারেই।
ভাবনার ঘোর এবার তীব্র হলো। অর্থাৎ ডান দিকে থাকা লোকগুলোর সাথে কানেকশন আছে, এবং সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে প্রাইভেট নাম্বারটির সাথে। আর বাম পাশের লোকগুলোর মধ্যে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি যুক্ত নেই, এরা সরাসরি কিংবা এদের সাথে সরাসরি যুক্ত হয়েছে প্রাইভেট নাম্বার। কর্কবোর্ডটি ধরে একটু ঘুরিয়ে দিলেন। এরপর চলে গেলেন নিজ আসনে। এবার স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে বোর্ডটি। নিজের কাজ শেষ করে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন জুনিয়রের দিকে। প্রশ্ন রাখলেন তার উদ্দেশ্যে,
‘ এবার বলো, কী হয়েছে? কীসের জন্য তখন ওভাবে ডাকছিলে? ‘
ফারহান দ্রুত দাঁড়ানো থেকে চেয়ার টেনে বসে পড়লেন তাতে। দ্রুত বাড়িয়ে দিলেন ফাইলটি তার সিনিয়রের দিকে। কাজগুলো করতে যেয়ে প্রচুর উৎফুল্ল হয়ে পড়েছেন তিনি। যেন কাঙ্ক্ষিত কোনোকিছু পেয়ে গেছেন। কিন্তু চালালেন না কোনো কথা বলার প্রয়াস অবধি। যেন তার কিছু বলার প্রয়োজনই নেই। তার ভাবনা, সে যেই ফাইলটা তার সিনিয়রকে দিয়েছে, এতেই যথেষ্ট তার সিনিয়র সব বুঝে ফেলার জন্য। সিনিয়র প্রথমে ফাইলের বাইরে থাকা কাগজগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলেন। কাগজগুলো দেখা শেষ হলে নজর বোলালেন ফাইলটির দিকে। ২২৩ নং কেস ফাইল এটি। প্রথমে একটু বিরক্ত হলেন, এই ফাইল এখানে কেন? এর গুরুত্ব কী! কিন্তু পরক্ষণেই ধারালো দৃষ্টি নিয়ে শুরু করলেন দেখা। বুঝতে পেরেছেন, ফাইল যখন ফারহান এনে দিয়েছে, এরমানে বর্তমান কেসটির সাথে ২২৩ নাম্বার কেসের নিশ্চয়ই কোনো না কোনো যোগসূত্র রয়েছে। কাজেই হেলাফেলা করে দেখার সুযোগ নেই। কয়েক পৃষ্ঠা উলটাতেই দুটো ছবি দেখে চমকে ওঠেন। সেই সাথে তার দুই চোখ খুশিতে চকচক করছিল। যেন তিনি এতক্ষণে সঠিক খেই খুঁজে পেয়েছেন। এমনকি এতক্ষণ তিনি যেই পথে হাঁটছিলেন, তাও সঠিকই ছিল।
সাইত্রিশ.
একটি পরিত্যক্ত কারখানায় দাঁড়িয়ে আছেন ফারহান এবং তার সিনিয়র অফিসার যাবেদ। চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। আঁধারের গহ্বরে হারিয়ে গেছে সুন্দর প্রকৃতি। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তাদের দুজনের। তাদের সম্মুখে সটানভাবে দাঁড়িয়ে আছে দুজন যুবক। একজন সাধারণ পোশাক, শার্ট-প্যান্ট পরলেও পাশের ছেলেটি একেবারে স্যুট-কোট পরা। দেখলে মনে হবে, কোনো কোম্পানির হয়তো চেয়ারম্যান। তারা দুজন বয়সে ফারহানের থেকেও ছোটো হবে। অনেকটা তুরাগের সমবয়সী। তাদের দুজনকে ছেলে দুটি যেন ভীষণ চমকেছে। তবে তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে আশপাশ থেকে আরও গোটা দশেক ছেলে বেরিয়ে এসেছে। অনেকটা চক্রাকারে ঘিরে ধরেছে তাদের। স্যুট-কোট পরা ছেলেটি জুনিয়র অফিসারকে দেখে কিঞ্চিৎ উচ্চস্বরে বলতে আরম্ভ করল,
‘ কী ইন্সপেক্টর সাহেব? মেয়েরে নিতে আসছেন নাকি? স্ত্রী হারিয়ে একা হয়ে গেলেন, এখন কি মেয়ে দিয়ে একাকিত্ব ঘুচাবেন নাকি? আর সাথের এই খাম্বাটা কে? আগে তো কখনো দেখি নাই। ‘
পাশ থেকে সিনিয়র অফিসার বলে ওঠেন,
‘ কে মারা গেছে আর কে মরেনি তা নিয়ে তোমার ভেবে লাভ আছে তানভির? একে একে তোমার চার বন্ধুর টিকিট কেটে গেল, পরবর্তী লিস্টে তোমার নাম ওঠা দরকার নয় কি?’ বলা মাত্রই তিনি তার কোমর থেকে ডেজার্ট পয়েন্ট নাইন এমএম ক্যালিবারের বন্দুকটি বের করে ট্রিগার চেপে বসেন। নাইন এমএম সাইজের গুলিটি গিয়ে সোজা আঘাত হানে তার লক্ষ্যবস্তুতে। পাশের ছেলেটির কপালের মধ্যস্থান ভেদ করে মাথার ওপাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে গুলিটি। চকিত হয়ে পড়ে উপস্থিত সকলে। স্বয়ং ফারহান নিজেও বুঝে উঠতে পারেননি, ঠিক কী হলো! এটা তো হবার কথা ছিল না। আর হবার কথা থাকলেও এমন অকস্মাৎ তো মোটেই নয়। তানভির নামের ছেলেটি যেন চোখের পলক ফেলতে অবধি ভুলে গেছে। এমনটা সে কল্পনাও করেনি। প্রথমত সে এমনিতেই চমকে গেছে তাদের উপস্থিতিতে। তার মাঝে এরকম একটা ভয়ানক ঘটনা! তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুটির কপাল ভেদ করতেই ছিটকে পেছন দিকে পড়ে যায় সে। চিত হয়ে পড়ার সাথে সাথে রক্তে মেখে যাচ্ছে মেঝে। গলগল করে রক্ত গড়িয়ে পড়তেছে। তবে এই স্বল্প সময়ের মাঝে তার বন্ধু আপন নীড়ে ফিরে গেছে। নাইন এমএম সাইজের একটি গুলি মস্তিষ্কে আঘাত করার পরেও বেঁচে থাকার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। মিরাকল না হলে তো সম্ভবই না। কিন্তু তার বন্ধুর ব্যাপারে কোনো মিরাকল ঘটেনি। সত্যি সত্যিই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে বন্ধুর নিথর দেহ। হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে সে। নাকের কাছে হাত নিয়ে অনুভব করার প্রয়াস করল, শ্বাস-প্রশ্বাসের কার্য চলছে কি না! কয়েক সেকেন্ড হাত রাখতেই অনুধাবন করতে পারল, বেঁচে নেই, নেই আর এই পৃথিবীতে। সে যেন এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না। আদতেও কি এরকমটা হয়েছে নাকি শুধু তার মনের ভ্রম!
ট্রিগার চেপে বন্দুকটা আনলক করে আগের স্থানে রেখে দিলেন অ্যাজেন্ট। তার এহেন কাণ্ডে সকলে একটা ঘোরে মাঝে চলে গেছে। ঘোর ভেঙে দেহরক্ষী ধরনের একজন লোক তার দিকে দৌড়ে আসা শুরু করে হাতে বড়ো সাইজের ছুরি নিয়ে। মুচকি হেসে দেন তিনি। বুটের পাশ থেকে পকেট নাইফটি বের করে আনেন। ডান হাতে তুলে নেন তা। বাম হাত দিয়ে লোকটির ডান হাতের আঘাতকে রুখে দেন। এরপর নিজের ডান হাতে থাকা নাইফ দিয়ে প্রথমে আঘাত করেন লোকটির হতের কনুইয়ের উপরে। এরপর ফলা কাটেন ঘারে। পরের আঘাতটি করেন সরাসরি ঘাড়ে। টাস করে একটি শব্দ হয়। গলগল করে রক্ত বেরুতে থাকে। ঘাড়ের হাড় ভেঙে গেছে নিশ্চই। তাছাড়া ধমনীও বোধ হয় কেটে গেছে। লোকটাকে ছেড়ে দিতেই সে তার বাম হাত দিয়ে ডান দিকের আঘাতপ্রাপ্ত ঘাড় চেপে ধরে। এরপর লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে। মোচড়াতে শুরু করে সে। মৃত্যুর সাথে লড়াই করার স্বাদ ভোগ করছে এখন। স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে নিয়েই জুনিয়ের দিকে তাকালেন অ্যাজেন্ট। চাপা কণ্ঠে আদেশ দিলেন,
‘ ফারহান, ডান পাশে চেয়ারে রাখা রাইসার কাছে যাও তুমি। দ্রুত!’
সিনিয়রের আদেশ পাওয়ামাত্রই মান্য করতে ডান দিকে ছুটে যায়। পরিত্যক্ত এবং ফাঁকা পড়ে থাকা কারখানার ডান পাশে একটি চেয়ার রয়েছে। যেখানে তার মেয়ে ঢলে পড়ে যায়। দূর থেকে মেয়েকে ফের দেখতে পেয়েই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। তাছাড়া মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব হচ্ছে যেন। তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন এমতাবস্থায় ফের ট্রিগার চাপার শব্দ কানে আসে। পেছন ফিরে দেখেন, তার দিকে এগিয়ে আসা একটা লোক মৃদু হাওয়ায় উড়ে মাটিতে পড়ে গেছে। লোকটির হাতে লম্বা একটি এসএস অ্যালুমিনিয়াম পাইপ ছিল। যেটা ছিটকে পড়ে তারই পাশে। দূরে দৃষ্টি রাখতেই নজরে পড়ে, অ্যাজেন্ট তার বন্দুকসহ তারই দিকে তাক করে আছেন। বুঝতে পারলেন, কাজটি তার স্যারের। তিনি তার পথে পা বাড়ালেন।
অপরদিকে অ্যাজেন্ট তার জুনিয়রকে আদেশ করতেই সে তা পালন করতে ছুটে যায়। তখন নজরে আসে তার, একজন লোক তার দিকে অ্যালুমিনিয়াম পাইপ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আঘাত করার উদ্দেশ্যে। দেরি না করে পুনরায় কোমর থেকে বন্দুক বের করে তাক করেন লোকটির মাথা বরাবর। অব্যর্থ নিশানা। সঠিক লক্ষ্যে গিয়ে আঘাত হানে গুলিটি। লোকটি তৎক্ষণাৎ মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে যায়। শব্দ শুনে জুনিয়র তার দিকে তাকালে একটা মুচকি হাসি উপহার দিলেন। জানেন না, বিষয়টি সে লক্ষ্য করেছে কি না। ধান সরিয়ে কাজে লেগে গেলেন। উপস্থিত বাকি আটজন দেহরক্ষীর দিকে নজর বোলালেন। এরপর হাতে থাকা বন্দুকের চারটি গুলি চোখের পলকে চার দেহরক্ষীর দিকে তাক করেই ট্রিগার চেপে দিলেন। ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটল যে, কেবল বন্দুক চলার শব্দ এবং চারজন দেহরক্ষী দাঁড়ানো থেকে লুটিয়ে পড়া অবধিই সবাই বুঝতে পারল। এরমাঝে যে কী হয়েছে তা কারও বোধগম্য নয়। কেবল শব্দ আর মেঝেতে লুটিয়ে পড়া চারটি দেহই দেখতে পেল তারা। কিন্তু থেমে গেলেন না অ্যজেন্ট। তিনি যেন আজ না থামার পণ নিয়েছেন। সামনের বাম কোমরের কাছ থেকে আরও একটি নাইন এমএম ক্যালিবারের বন্দুক বের করে পরপর চারটি গুলি ছুড়ে দিলেন অবশিষ্ট চার দেহরক্ষীর দিকে। লক্ষ্য তাদের হৃৎপিণ্ড এক কপালের মধ্যভাগ। দুজন দেহরক্ষীর হৃৎপিণ্ডে এবং বাকি দুজনের কপালের মধ্যভাগেই আঘাত হেনেছে গুলি। লুটিয়ে পড়ল তারাও। হাঁটু ভেঙে বসে আছে একমাত্র তানভীর নামের ছেলেটি। কী থেকে কী হয়ে গেল সে যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না! তার দিকে কয়েক কদম হেঁটে এগিয়ে গেলেন অ্যাজেন্ট। এরপর হাঁক ছেড়ে উচ্চ আওয়াজে বলতে আরম্ভ করলেন,
‘ এত কম সংখ্যক সৈন্য নিয়ে আমার মোকাবেলা করলে কি হবে? মিস্টার তানভীর ওরফে রবার্ট হ্যারিসের ছোটো ভাই! ‘
‘ আ..পনি কী করে জা..নলেন, আমি রবার্ট হ্যারিসের ছো…টোভাই! কে.. আ…পনি!’ চমকে তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন ছুড়ে দেয় সে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, তার ভয়ানক এবং দীর্ঘদিন পুষে রাখা অতীত তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি কী করে জানল!’ প্রত্যুত্তরে একটা অট্টহাসি দেন অ্যাজেন্ট।
‘ তোর ভাই রবার্ট এবং তোর মৃত্যু আমার হাত ধরেই! অ্যাজেন্ট যাবেদ, ডিডো সংস্থার সবচেয়ে দক্ষ অফিসার।’
‘ তুউ..তুই না ম..রে গে..ছিস! ‘
অ্যাজেন্টের মুখ থেকে তার পরিচয় পাওয়ার সাথে সাথে অর্ধ বসা থেকে ছিটকে পড়ে যায় ছেলেটি! এতদিন যাকে ভেবে এসেছিল মারা গেছে, আজ সেই মানুষটা তারই সামনে! উত্তেজিত হয়ে পড়ে সে। প্রফুল্ল হয়ে কোমর থেকে বন্দুক বের করার চেষ্টা করল। কিন্তু তাকে সেই সময়টা দিলেন না অ্যাজেন্ট। তার আগেই লক্ষ্যের হৃৎপিণ্ড বরাবর ট্রিগার চাপেন। টং করে শব্দ হয়ে সাই করে একটি নাইন এমএম সাইজের গুলি বেরিয়ে যায় বন্দুকের নল থেকে। চোখের পলকে গুলিটি আঘাত হানে ছেলেটির বাম বুকে। এগিয়ে যান ছেলেটির দিকে। কাছাকাছি দূরত্বে হাঁটু মুড়ে বসেন। কথা বলতে শুরু করলেন বন্দুক নাড়িয়ে,
‘ তোর ছবি আমি যেদিন প্রথম দেখেছিলাম, সেদিনই তোর ভাই আমার হাতে মারা গেছিল। আফসোস করিস না। এখনই তোর ভাইয়ের সাথে দেখা হবে তোর। দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটবে। ‘ কথাটা বলেই বন্দুকের শেষ গুলিটি করলেন ছেলেটির কপালে। বন্দুকটা কেশে উঠে লক্ষ্যবস্তু ভেদ করার প্রয়াস করল। কিন্তু সফল সে। বন্দুকের গুলিটি মাথা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছে। কল্পনায় ডুবে গেলেন অ্যাজেন্ট। রবার্টকে সেদিন এনকাউন্টার করার পর যখন তার ঘরে তল্লাশির জন্য যায়, সেখানেই প্রথম দেখতে পায় তানভিরের হাস্যজ্বল চেহারা। তখন তদন্ত করার আর প্রচেষ্টা করেনি তারা। অবশ্য তেমন পরিস্থিতিই ছিল না।
আটত্রিশ.
ফারহানের এগিয়ে দেওয়া কয়েকটি কাগজ এবং ফাইল ঘেটে দেখতে থাকেন অ্যাজেন্ট যাবেদ। একটি পর্যায় চমকে ওঠেন তিনি। কাগজগুলো মূলত কুমিল্লা জেলা সদর থেকে পাওয়া কেসের প্রিন্ট কপি। সেখানে সাড়ে তিন বছর আগে পাঁচ বন্ধু একজন মেয়েকে ধর্ষণের আরোপে ছয় বছরের কারাদণ্ড পেয়েছে। সবচেয়ে হতভম্ব করে দেওয়া বিষয়টি হলো, মেয়েটি আর কেউ নয়, বরং এমপি রজবানের ছেলের বউ ছিল। এবং পাঁচ বন্ধুর মাঝে একজন হলো সেলের ভেতরে এনকাউন্টারে মারা পড়া তুরাগ। যার উপর ধর্ষণের প্রধান আরোপ রাখা হয়েছে। বাকি চার বন্ধু সহযোগী হওয়ায় তাদেরও সমপরিমাণ শাস্তি দিয়েছে আদালত! চারজনের মাঝে একজনের নাম, তানভীর। আরেকজনের নাম, বরুণ। বাকি দুজনের নাম শামসুল এবং জীবন। কাগজগুলো ঘাটা শেষ হলেই ফাইল খুলে নজর বোলাতে শুরু করেন। সেখানে উঠে আসে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য! বছরখানেক আগে শামসুল এবং জীবন নেশাদ্রব্য বিষয়ক পুলিশি এক মহড়ার মারা পড়ে দুজন। পুলিশের উপর গুলি ছুড়ে তারা। ফলে পুলিশও পালটা আক্রমণ করতে বাধ্য হয়। আর এতে করে মারা যায় দুন। আর এই সম্পূর্ণ মিশন লিড দিচ্ছিলেন ফারহান নিজেই। অ্যাজেন্ট বুঝতে পারলেন, এই কেস শুধু একটি সূত্রেই গাঁথা নয়। নানান সূত্র থেকে একে অপরের সাথে জড়িয়ে গেছে।
তানভীর নামের ছেলেটিকে চিনতে পেরেছেন অ্যাজেন্ট। ছেলেটার ছবি প্রথম দেখেছিল সাড়ে তিন বছর আগে জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক মিশন অথবা প্রতিশোধের দিন। প্রতিদ্বন্দ্বীকে বিদায় জানিয়ে যখন চারিদিকে তল্লাশি করা হচ্ছিল, তখন এই ছেলের একটা ছবি সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়। সেই প্রথম এবং শেষবারের মতো দেখেছিল ছবিটা। এরপর আর কখনো নজরে আসেনি। কাগজে নজর বুলিয়ে তাদের পাঁচজনের অ্যারেস্ট হবার দিনটি দেখলেন। রবার্টকে চিরতরে শেষ করার দুদিন আগে তারা অ্যারেস্ট হয়। বুঝে গেলেন, কেন তখন বা এই দীর্ঘ সময়ের মাঝে তাদের দেখা পায়নি। জেল থেকে দুই বছরের মাথায় বেরিয়ে পড়ে চার বন্ধু। কিন্তু বেরিয়ে তার ছয়মাস পরেই পুলিশের গুলিতে মারা পড়ে। তুরাগ নামের ছেলেটিও তার ছয়মাস পর জেল থেকে রেহাই পেয়ে যায়। ছাড়িয়ে নেয় ক্ষমতা।
‘ রজবানের ছেলের বউকে রেপের ঘটনা কি আদৌ সত্য? ‘ জুনিয়রের কাছে প্রশ্ন রাখলেন অ্যাজেন্ট।
‘ আধা সত্য আর আধা বানোয়াট। রেপ করার চেষ্টা করছিল, কিন্তু আমি শুনেছি, পারেনি। ‘ সাদাসিধা উত্তর।
‘ তবে ছয় বছর জেলের আদেশ আসলো কীভাবে? ‘
‘ রজবান স্যার নাকি তার ক্ষমতা ব্যয় করে তার ছেলের বউয়ের সাথের এই ঘটনাকে আধা সত্যকে আরও মিথ্যে সংযোগ করে বাকিটা উপস্থাপন করেন। ‘ একটু ভাবুক হয়ে বললেন ফারহান।
‘ এক মিনিট, রজবানের ছেলের বউয়ের বাবার বাড়ি কোথায়? ‘ মাথায় চটজলদি প্রশ্নটি চেপে বসে।
‘ কুমিল্লাতেই শুনেছি!’ গা-ছাড়া ভাব দেখিয়ে উত্তরটি দিলেন তিনি। বুঝতে পেরেছেন, তার স্যার কোনো না কোনো ক্লু খুঁজতেছেন। কিন্তু তার কাছে কেন যেন বিষয়টা পছন্দ হলো না।
‘ রবিন যেই থানার ইন্সপেক্টর ছিল, সেই থানায় কল করো তো। ‘ আদেশ স্বরে কথাটি বললেন তার জুনিয়রের উদ্দেশ্য করে। বরাবরের মতো আদেশ মান্য করলেন ফারহান। পাশের থানায় কল দিলেন। ধরলেন সাব-ইন্সপেক্টর। নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, তার বড়ো স্যার কথা বলতে চান। এরপর ফোনটি তার সিনিয়রের দিকে বাড়িয়ে দেন। এগিয়ে ফোন হাতে নেন। এরপর তুলে নেন কানে।
‘ হ্যালো। ‘ ফোনের এপাশ থেকে আওয়াজ দিলেন অ্যাজেন্ট। ওপাশ থেকে ভেসে আসে সাব-ইন্সপেক্টরের কণ্ঠস্বর।
‘ হ্যালো স্যার, কাফি স্পিকিং। ‘ স্যালুট ভঙ্গিতে কথাগুলো ভেসে এলো।
‘ কাফি, একটা বিষয় জানার ছিল। তোমাদের রবিন স্যারের লাস্ট পোস্টিং কোথায় ছিল? কুমিল্লা কি না কনফার্ম করে জানাও তো আমাকে। ‘ হাতে একটি কলম নিয়ে আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে কথাগুলো বললেন।
‘ একটু অপেক্ষা করুন স্যার। ‘
মিনিটখানেক পরেই ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসে কাফির কণ্ঠধ্বনি।
‘ জি স্যার, রবিন স্যারের সর্বশেষ পোস্টিং ছিল কুমিল্লা। এরপর সেখান থেকে ট্রান্সফার হয়ে এই থানায় এসে জয়েন করেছিলেন। ‘
‘ ঠিক আছে। ধন্যবাদ তোমাকে। ‘ হাত থেকে কলম রেখে মুচকি হাসি দিয়ে বললেন। ফারহানকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘ এই ছেলেগুলোর ব্যাপারে তথ্য আছে? ‘
প্রত্যুত্তরে ফারহান গরগর করে বলতে শুরু করলেন,
‘ কুমিল্লা জেলা সদর থানা থেকে জানিয়েছে। তারা যখন তদন্ত করেছিল, তখনকার তথ্য দিয়েছে। ‘
‘ কী! ‘ উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করলেন। প্রত্যুত্তর করতে ফারহান বড়োসড়ো একটা শ্বাস নিলেন। এরপর বিবৃতি দিতে শুরু করলেন,
‘ তারা জানিয়েছে, ওরা পাঁচ বন্ধু। এর আগেও পাঁচ বন্ধুকে ড্রাগস তল্লাশিতে ধরা পড়েছিল। কিন্তু প্রত্যেকবারই ছাড়া পেয়ে যেত টাকার জন্য। পাঁচ বন্ধুর মাঝে লিডার হলো তানভীর। ছেলেটার একটা বড়ো ভাই আছিল। রবার্ট না কী যেন নাম বলছিল। ‘
হাতের ইশারায় ফারহানকে থামিয়ে দিলেন অ্যাজেন্ট। আচমকা নিজেই বলতে লাগলেন,
‘ এখন ছেলেটার ভাই অনেকদিন যাবত নিখোঁজ আছে। তাই তো? ‘
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেন ফারহান। যা দেখে হেসে ফেলেন অ্যাজেন্ট। তার ধারণা তবে সঠিক।
‘ ফারহান, তুমি কি জানো, এটা কোন রবার্ট.?’ প্রচণ্ড রকমের শান্ত শোনালো অ্যাজেন্ট যাবেদের কণ্ঠস্বর। প্রত্যুত্তর জানালেন জুনিয়র।
‘ না তো স্যার! ‘ সোজাসাপটা জবাবের পাশে কিঞ্চিৎ উৎসুক ভাব জমা দিলেন তিনি।
‘ তোমার আমার মোলাকাত যেই কেসের মাধ্যমে হয়েছিল, সেই কেসের মাস্টারমাইন্ড কে ছিল মনে আছে? ‘ প্রশ্নটি করে চুপ হয়ে যান অ্যাজেন্ট। জুনিয়রকে ভাবনায় মশগুল করে দেন। যার প্রতিফলন পাওয়া যায় কয়েক মুহূর্তের মাঝেই।
‘ এ..এটা সেই র..র..রবার্ট?’ প্রশ্ন রাখলেন সিনিয়রের কাছে। তার প্রশ্নের জবাবে অ্যাজেন্ট মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলেন। তার সম্মতি পেয়ে ছেলেটা যেন মুহূর্তের মাঝে থমকে গেলেন। সেদিকে ধ্যান দিলেন অ্যাজেন্ট। আদেশ করলেন,
‘ ওদের বর্তমান লোকেশন এক্ষুনি আমি চাই। যে-কোনো মূল্যে ওদের ঠিকানা তুমি কালেক্ট করো। ‘
‘ আমাকে দুই মিনিট সময় দিন স্যার। ‘ আকুতি স্বরে কথাটি রাখলেন তিনি। এরপর রুম থেকে বেরিয়ে পড়লেন। ফিরলেন কিছু সময় পরে। হাতে দুটো প্রিন্ট কাগজ। বাড়িয়ে দিলেন সিনিয়র অফিসারের দিকে।
উনচল্লিশ.
‘ স্যার, আমি কিন্তু সবগুলো প্রশ্নের জবাব পাইনি। ‘ গাড়িতে বসতে বসতে সিনিয়রের উদ্দেশ্য করে কথাটি বললেন ফারহান। তার কথা শুনে পাত্তা না দিয়ে জানালা দিয়ে মাথা বের করলেন। এরপর তাকালেন পেছন দিকে। নজরে এলো তার, গোটা দশেক পুলিশ অফিসার কারখানার ভেতরদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মরদেহগুলো একত্র করে ব্যবস্থা নিচ্ছে। অবশ্য আদেশ দিয়ে এসেছে ফারহানই। মাথা ভেতর দিকে নিয়ে গাড়ির পেছন সিটে দৃষ্টি রাখলেন। ফারহানের মেয়ে রাইসা শুয়ে আছে সিটে। এখনও জ্ঞান ফিরেনি। অ্যাজেন্ট কিছু না বলে কেবল হাতের ইশার যাবার নির্দেশ দিলেন। দুজনের মাঝে নীরবতা যেন ঝেঁকে বসেছে। বেশকিছু পথ এগিয়ে যাবার পর যাবেদ নিজেই প্রশ্ন রাখলেন,
‘ কোন প্রশ্নের জবাব পাওনি তুমি? ‘
জুনিয়র যেন এতক্ষণ এরই অপেক্ষা করছিলেন। গড়গড় করে বলতে শুরু করলেন,
‘ এমপি স্যারের পরিবার আর রবিন স্যারকে মারার কারণ পেলাম খুঁজে। কুমিল্লার ঘটনার প্রতিশোধে এরকমটা করেছে। কিন্তু ওদের গ্যাংয়ের লিডার কে ছিল? আর এই হ্যাকারটা কে? তাছাড়া আমার উপর আক্রমণ করল কেন? ‘
আরও কিছু প্রশ্ন করার চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু থামিয়ে দিলেন সিনিয়র। বললেন,
‘ আস্তে, একটা একটা উত্তর শোনো। ওদের দলের প্রধান ছিল তানভির। তুমি ওদের গ্রুপ ছবি দেখনি? সেখানে নজর করলেই তো লিডারের প্রভাব দেখা যায়। আর হ্যাকারও তানভিরই। ওর এডুকেশন কোয়ালিফিকেশন দেখোনি? আইটি ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট! তো এ দিয়ে তো সহজেই বুঝতে পারার কথা!’ থামলেন অ্যাজেন্ট। গাড়ি ঘণ্টায় সত্তর কিলোমিটার গতিতে চলছে। স্টেয়ারিং ধরে বাকি প্রশ্নের উত্তর শোনার জন্য উৎসুক হয়ে আছে ফারহান। তার উৎকর্ষতার পরিমাণ কমাতে সিনিয়র অফিসার ফের বলতে আরম্ভ করেন।
‘ আর..তোমার উপর আক্রমণ করার কারণ হলো ভাইয়ের প্রতিশোধ নেওয়া। তুমি আর আমি যে এই কেসের তদন্ত করছিলাম, মনে আছে নাকি ভুলে গেছ? ‘ প্রথমে জড়রা লাগলেও এরপর গড়গড় করেই বলতে পারলেন। তিনি যেই প্রশ্ন রেখেছেন তার প্রত্যুত্তরে সাথে সাথে ফারহান জবাব দেন,
‘ না স্যার, ভুলব কী করে? ‘
কিন্তু তার এই কথাকে পাত্তা দিলেন না অ্যাজেন্ট। তিনি তার বক্তব্য ফের ধরলেন,
‘ আমি বছরখানেক আগে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করেছিলাম। আর তাতে খবর প্রচার করেছিলাম, আমি মারা গেছি। এটা একদিক থেকে আমার এখন প্ল্যাস পয়েন্ট হিসেবেই কাজ করছে। তো ওরা জানে আমি মারা গেছি, তাই আমার সাথে না পেরে সব ঝাল তোমার উপর মেটানোই ছিল ওদের মূল উদ্দেশ্য। ‘
‘ বুঝলাম। ‘ ভবুক হয়ে বললেন ফারহান। তা দেখে সামনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন রাখলেন সিনিয়র।
‘ তোমার মাথার সব প্রশ্নের জট খুলেছে? আর কোনো প্রশ্ন আছে? ‘
‘ আপাতত এখন আর মনে পড়তাছে ন। মনে পড়লে কমুনে। ‘ মুচকি হাসি দিলেন অ্যাজেন্ট। পকেট থেকে ফোন বের করে একটি নাম্বার ডায়েল প্যাডে তুললেন। এরপর কল বাটনে চাপ দিয়ে কানে তুলে নিলেন। ওপাশ থেকে শীতল কণ্ঠে ভেসে আসে ডা. নয়নের কণ্ঠস্বর।
‘ আসসালামুয়ালাইকুম স্যার। ‘
সালামের জবাব দিলেন অ্যাজেন্ট। এরপর জিজ্ঞেস করলেন,
‘ ওখানের কী অবস্থা? সব ঠিক আছে তো? ‘
প্রত্যুত্তরে আস্থা জানালেন ডা.। বললেন,
‘ কোনো চিন্তা করবেন না। সব ঠিক আছে। ‘
‘ আসছি তবে। ‘ হাসি দিয়ে কলটা কেটে দেন।
চল্লিশ.
কনফারেন্সে বসেছেন ফারহান। তার পাশে বসে আছেন ডিআইজি ও তার অ্যাসিস্ট্যান্টসহ আরও পুলিশ এবং উপরি কর্মকর্তাগণ। তার সামনে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের মাইক রাখা আছে। রুমের এক কর্নারে দাঁড়িয়ে আছেন অ্যাজেন্ট। তার দিকে জুনিয়র একবার চোখ ফিরে তাকালেন। তিনি চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করলেন। সিনিয়রের আশ্বাস পেয়ে জুনিয়র অফিসার ফারহান বলতে আরম্ভ করলেন,
‘ আমরা আসামীদের শনাক্ত করে তাদের ঠিকানায় যাই অ্যারেস্ট করার জন্য। কিন্তু সেখানে যেতেই তারা আমাদের গুলিবর্ষণ করেন। ফলে আমরাও পালটা হামলা চালাই। এতে হতাহতের সৃষ্টি হলেও আমাদের টিমের কেউই তেমন আহত হয়নি। তবে গোলাগুলিতে আসামী পক্ষের সবাই ঘটনাস্থলে মারা পড়ে। ‘
তিনি থামলে পাশ থেকে এক মিডিয়া কর্মী দাঁড়িয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন রাখে,
‘ স্যার, আমরা জানতে পেরেছি, আপনার মেয়েকে নাকি তারা কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছিল। এখন সে সুস্থ আছে। আপনার স্ত্রীও এখন সুস্থ আছেন এবং জ্ঞান ফিরেছে তার। তবে আপনি না আমাদের সামনে সেদিন বক্তব্য দিলেন, আপনার স্ত্রী মারা গেছেন! তবে আবার তিনি বেঁচে ফিরলেন কী করে?’
একটা হাসি দেন ফারহান। পরক্ষণেই বলতে আরম্ভ করেন,
‘ দেখুন, সম্পূর্ণ ঘটনা আপনাকে আমি বলব না। তবে এতটুকু বলব যে, পুলিশের কেবল প্ল্যান-এ-ই থাকে না। বরং প্ল্যান-বি-ও থাকে। ‘
এরপরই তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে যান। নজর করেন কোণে দাঁড়িয়ে থাকা তার সিনিয়রের দিকে। তাকে দেখে একটা মুচকি হাসি দিলেন অ্যাজেন্ট। এরপর পেছন ফিরে রুম থেকে বেরিয়ে যাবার উদ্দেশ্যে পা ফেলতে ফেলতে ঠোঁটের কোণে ফের তীব্র আকারে হাসি ঝুলিয়ে দেন। দীর্ঘদিন পর পুনরায় ১৮০°-এর চালটা চেলেছেন। যেখানে প্রতিপক্ষ ০° তে দাঁড়িয়ে থেকে পেছনে ১৮০° এঙ্গেলে কী হচ্ছে তা জানতে কিংবা বুঝতে পারে না!
– সমাপ্তি –