খুন সিরিজ তৃতীয় সিকুয়েন্স,দশম পর্ব

0
180

খুন সিরিজ তৃতীয় সিকুয়েন্স,দশম পর্ব
গল্প:- মাস্টার অব মাইন্ড গেম
লেখা:- যাবেদ খান আবু বকর

চব্বিশ.
গাড়ি চালিয়ে বাড়ির কাছে পৌঁছে গেলেন কোনোমতে। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য অনুভব হচ্ছে তার। কোনোকিছু মস্তিষ্ক গ্রহন করছে না! পদদলিত করে গেট পার করে বাড়ির এরিয়ায় প্রবেশ ঘটান। পড়ে আছে গেটের কাছে কনস্টেবল রনি এবং দিলিপের রক্তে রঞ্জিত হওয়া দেহ। হাঁটু মুড়ে বসলেন। চেক করলেন দুজনের হাতের নার্ভ। অনুভব করতে অক্ষম হলেন রক্ত চলাচল। যা বুঝার বুঝে গেছেন তিনি। পৌঁছে গেছেন দুজনেই নিজ নিজ ঠিকানায়। উঠে দাঁড়িয়ে পা বাড়ালেন বাড়ির ভেতর দিকে। অনুভব করলেন, তার পা যেন চলছে না। আসাড় হয়ে আসছে পা দুটো। শরীরের সমস্ত ভার ছেড়ে দিয়েছে পায়ের উপর। পদ ফেলে এগিয়ে যেতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! কিছুদূর অগ্রসর হতে নজরে আসে, গার্ড দুজনের মৃতদেহ পড়ে আছে। নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হবার প্রয়োজন নেই। দিলিপ ও রনির মরদেহ দেখে এটা বুঝতে সক্ষম। নিজের দেহের সাথে যুদ্ধ করে বহু কষ্টে দরজার কাছে উপস্থিত হন। দরজাটা খোলাই ছিল বিধায় খোলার কষ্ট করতে হয়নি তাকে। পা ফেলে ঘরে প্রবেশ করতেই শরীরে কাঁপুনি দিয়ে ওঠে। মেঝেতে রক্তের ফোয়ারা দেখে মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়ে। একটু সামনে অগ্রসর হয়ে সম্পূর্ণ ড্রয়িংরুমে চোখ বোলাতেই শরীরের কাঁপুনির মাত্রাটা তীব্র হয়ে যায়। এবার শুধু শরীর নয়, বুকসহ হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত কাঁপছে সমানতালে। পায়ের জোর সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছে। পারল না আর দাঁড়িয়ে থাকতে। পা দুটো ভাজ করে আধো বসে গেলেন। কান্নায় ভেঙে পড়লেন মুহূর্তে। রাহেলার বাম ডান দিকের বুক থেকে রক্ত নির্গত হয়ে মেঝে তলিয়ে গেছে। টান হয়ে শুয়ে আছে সে। এই ভয়ানক দৃশ্য দেখার আগে নিজে কেন মরে গেল না বলে অভিশাপ দিচ্ছেন ফারহান। এমন সময় কানে শব্দ এলো আরও দুটো গাড়ি আসার। কিন্তু সেদিকে দেখার কিংবা ভাবার সময় নেই। চোখের পলকে ছুটে গিয়ে রাহেলার রক্তাক্ত দেহটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলেন। কান্না করতে লাগলেন বুকের মাঝে চেপে ধরে। রাহেলার কোনো নিঃশ্বাস তিনি পাচ্ছেন না। ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে শ্বাস দিতে শুরু করলেন। ইতোমধ্যে ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছে সাব-ইন্সপেক্টর সাইমুন। বুটের শব্দ শুনে সেদিকে একবার নজর করেন। এরপর আবার ব্যস্ত হয়ে পড়েন নিজের কাজে। তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে! কোনোকিছু ভেবে উঠতে পারছেন না। কী করা উচিত এই মুহূর্তে তাও বুঝে উঠতে পারছেন না। হাতের সাথে হাত লেগে আচমকা অনুভব করেন খুব নিম্নভাবে নার্ভ চলছে। প্রাণ ফিরে এলো তার দেহে। দুই হাতে পাজা কোলে তুলে নিলেন। কোনো কথা না বলে নিজের গেটের দিকে দৌড় চালালেন। গেট পার হয়ে নিজের গাড়িতে উঠে বসলেন রাহেলার দেহটাসহ। নিজের বুকের সাথে লেপটে রেখে স্টেয়ারিং ধরলেন তিনি। গাড়ি স্টার্ট করে সাইরেন বাজিয়ে দিলেন। তার নিজ গাড়িতে পুলিশের সাইরেন থাকা সত্ত্বেও কখনো ব্যবহার করেননি। চিন্তাও করেননি কখনো করতেও হবে। গাড়ির গতি মুহূর্তের মাঝে আশির অধিক হয়ে গেল। ছুটতে লাগলেন হসপিটালের উদ্দেশ্যে।

সাইমুন ঘরে ঢুকে সিনিয়র অফিসার ফারহানের এরকম আচরণ দেখে টু শব্দ পর্যন্ত করার সাহস পায়নি। যখন ফারহান তার স্ত্রীকে কোলে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করলেন, তখন সে-ও দৌড়ে এসেছে তার পিছুপিছু। কিন্তু কিছু বলতে পারেনি সে। যখন তার সিনিয়র অফিসার গাড়িতে উঠে বসলেন, তখন একবার বলতে চেয়েছিল, ‘ স্যার, আপনি পাশের সিটে বসেন। আমি গাড়ি চালাচ্ছি। ‘ কিন্তু ভয়ে আর বলা হয়ে ওঠেনি। এক তো সে আগে থেকেই তাকে রাগিয়ে দিয়েছে। তার উপরে নিজ হাতে হত্যা করে এসেছে সাসপেক্টকে। এখন এই মুহূর্তে সে যদি কিছু বলত, তবে ভিন্ন ঘটনার জন্ম নিতে পারত। তাই চুপ থাকাটাই ভালো মনে হয়েছে তার কাছে। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে পাশ থেকে একজন পুলিশ অফিসারকে ডাকলেন।
‘ নাবিল, তোমরা সবাই বাড়িটাকে সার্চ করে ফেলো। রাবি স্যারকে কল করে বলো, ফারহান স্যারের বাসায় দ্রুত আসতে। কাল বিলম্ব করবে না কিন্তু। এখনই কল করো। ‘
গাড়িতে উঠতে উঠতে কথাগুলো বলল সে। এরপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে নিজেও ছুটল তার সিনিয়রের পেছনে। সে ভালো করেই অনুধাবন কর‍তে পেরেছে, তার সিনিয়র কোন হসপিটাল যাবে এই সময়। সেও গাড়ির গতি যতটা সম্ভব বাড়িয়ে তুলছে। এক হাত দিয়ে গাড়ির স্টেয়ারিং ধরে আরেক হাতে ফোন বের করে আনল পকেট থেকে। কল প্রদান করল ডিআইজি মারুফ হোসেনকে। সিনিয়রের সুবাদে নাম্বার নেওয়া হলেও কখনো কল করা হয়নি তার। একটু জড়তা লাগলেও এই মুহূর্তে জড়তা কাটিয়ে কথা বলতে হবে। ডিআইজিকে খবর দেওয়াটা অতিসত্বর জরুরি। প্রথম কলে ফোন রিসিভ হলো না। পুনরায় কল প্রদান করে। এবার দুটো রিং হতেই ওপাশ থেকে ভারী কণ্ঠে ভেসে আসে,
‘ এই রাতের সময় কে কল করে বলো তো!’
সেদিকে তোয়াক্কা না করে সাইমুন সরাসরি বলতে আরম্ভ করল, ‘ স্যার আমি ফারহান স্যারের সহকারী বলছিলাম। স্যারের বাসায় কিছুক্ষণ আগে হামলা হয়েছে। আমাদের দুজন পুলিশ অফিসারসহ বাড়ির গার্ড দুজনের মৃত দেহ পাওয়া গেছে। ভাবির শরীরও গুলি লেগেছে। রক্তাক্ত ছিল সারা শরীর। স্যার হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। ‘
তার কথা শুনে ডিআইজি যেন আকাশ থেকে পড়ল! পরমুহূর্তেই হতভম্ব হয়ে পড়লেন! একটাই মেয়ে তার। আর তার হাত তুলে দিয়েছেন ফারহানের হাতে। আর কিছু না শুনেই পালটা প্রশ্ন ছুড়লেন তিনি,
‘ কোন হাসপাতালে? ‘
কাল বিলম্ব না করে তৎক্ষণাৎ জবাব দিলো সাইমুন,
‘ দ্যা মর্ডান সিটি হসপিটাল। ‘
তার কথা সম্পূর্ণ শেষ হতেই কিছু না বলে কলটা সসংযোগ বিচ্ছিন করে দিলেন ডিআইজি। সেদিকে ধ্যান না দিয়ে ফোনটা পুনরায় পকেটে রেখে দুই হাতে স্টেয়ারিং ধরল। গাড়ির গতি দ্বিগুণ করে তুলল দুটো গিয়ার ফেলে। মিনিট দুয়ের মাঝে দ্যা মর্ডান সিটি হসপিটাল এসে উপস্থিত হলো সে। গাড়ি থেকে নামতেই চোখ পড়ল সিনিয়র অফিসারের রেঞ্জ রোভার ব্র্যান্ডের গাড়িটি। তার ধারণাই সঠিক হয়েছে। তার সিনিয়র অফিসার তার অনুধাবন করা হসপিটাল এসেছেন। ভেতরে প্রবেশ করল দ্রুত পা বাড়িয়ে। বুঝতে পারল, স্যারের স্ত্রীকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে নেওয়া হয়েছে। একজন নার্সের সঙ্গে কথা বলছেন তার সিনিয়র অফিসার। কিছু শেষের দিকে কথোপকথন কানে এলো তার।
‘ স্যার, ম্যামের প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। দ্রুত অন্তত দুই ব্যাগ রক্ত ম্যানেজ করতে হবে। ‘
নার্সের কথা শেষ না হতেই সিনিয়র অফিসারের কণ্ঠ ভেসে আসে তার কানে।
‘ আমার আর রাহেলার রক্তের গ্রুপ একই। আমি রক্ত দেবো। ‘
নার্সটি কেবল বলল, ‘ তাহলে আমার সাথে আসুন স্যার। ‘
এরমাঝে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাকিয়েছেন সিনিয়র অফিসার। সাইমুনকে দেখেছেন। কিন্তু কিছু না বলে নার্সের সঙ্গে চলতে শুরু করেছেন তিনি। সে-ও বুঝতে পারছে, এই মুহূর্তে তার সিনিয়রের উপর দিয়ে কী যাচ্ছে! যদিও সে এরকম পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কখনো যায়নি। কিন্তু তবুও অনুভব করতে পারছে।

ফারহান পা বাড়ালেন নার্সটির সঙ্গে। পেছন ফিরে তাকালেন একবার। সাইমুনকে দেখতে পেয়ে মনের ভেতর স্বল্প সস্তি হলেও এখনও মস্তিষ্ক ভীষণ চাপে রয়েছে। মাথাব্যথা করছে খুব। মনে হচ্ছে, মাথাটা বুঝি এখনই ছিঁড়ে পড়ে যাবে। অনুভব করলেন অস্বাভাবিক মানসিক চাপ। এর আগে কখনো পরিচিত হননি এরকম ভয়ানক অনুভূতির সঙ্গে। এখনও শরীর, বুক, হৃৎপিণ্ড কাঁপছে। তিনি নিজেও জানেন না, কীভাবে যে তিনি হসপিটাল এসে পৌঁছেছেন! একটা রুমে নিয়ে গেল নার্স তাকে। ইশারা করে বেডশিটে শুয়ে পড়তে বলল। তিনি বিলম্ব না করে লেটে গেলেন বিছানায়। নার্স তার ডান হাতের কনুইয়ের উপরিভাগে একটা ক্যানেলা লাগাল। হাতে একটি নরম বল ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ স্যার, এটা চাপতে থাকুন। ‘
সন্ধ্যা থেকে স্ট্রেস আর শেষ অবধি এই ভয়ানক ধাক্কার হোঁচট! নিজের দেহটা ছেড়ে দিলো বিছানাতেই। বুজে এলো চোখ দুটো। কেবল পাশে বসে থাকতে দেখেছিলেন সাইমুনকে। এরপর আর কিছু মনে নেই। হারিয়ে স্মৃতির পাতায় হয়েছেন বিভোর। এরকম একটা হোঁচট খুবই স্বাভাবিক বিষয় নয়। তার পরনের সাদা জামাটা রক্তে লাল হয়ে গেছে। কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই তার। এই মুহূর্তে দুনিয়ার কোনোকিছুরই খেয়াল নেই। তার দুনিয়ার বিশাল একটা অংশ জুড়ে যে রাহেলারই বসবাস! এখন তো তার সেই অংশটাই নড়বড়ে। তবে তার দুনিয়া ঠিক থাকবে কী করে?

পঁচিশ.
সাইমুন রুমে ঢুকে তাদের পেছন পেছন। সিনিয়রকে বিছানায় শুয়ে চোখ বুজে নিতে দেখে একটু ভয় পেল সে। এরপরই অনুভব করতে পারল, তার সিনিয়রের উপর দিয়ে কী পরিমাণ চাপ যাচ্ছে। জাগানোর কথা মস্তিষ্কেও আনল না। ভাবনায় মগ্ন হলো পাশে বসেই, কী হলো কী থেকে? এরকমটা কর কে? কেন করল? সব যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে তার মাথায়। এটাও সে ভেবে পাচ্ছে না, কেন সেলের মাঝে অজ্ঞাত খুনিটির উপর বন্দুকের গুলি চালাল! সে মোটেও ভাবতে পারেনি, এমন একটা কাণ্ড ঘটে যাবে সেই সময়ে। একই সময়ে একটা নয়, দু দুটো ঘটনার জন্ম হয়েছে। সন্দেহের রেশ পাচ্ছে সে! কিন্তু কীসের সন্দেহ কিংবা কার উপরে সন্দেহ তা ভেবে পাচ্ছে না। এমন কি কার উপর সন্দেহের তীরটা ছোঁড়া উচিত তাও ভেবে পাচ্ছে না! যখন সে ভাবনায় বিভোর, সেই সময়ে তার সিনিয়রের দেহ থেকে দুই ব্যাগ রক্ত নিয়ে নার্স কক্ষ থেকে চলেও গেছে! তার হুঁশও নেই! ভাবনার ঘোরে ভাটা পড়ে একাধিক গাড়ির শব্দে। মস্তিষ্ক সচল হতেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তাকায় সিনিয়রের দিকে। ভেবেছিল, নার্সটা এখনও সেখানে আছে। রক্ত হাত থেকে নির্গত হয়ে ব্যাগ ভরতি হচ্ছে। কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে হতভম্ব! এমন কিছুই নেই। নেই তার সিনিয়রের হাতে লাগানো ক্যানোলা। আর না আছে নার্স মেয়েটি। সে ভেবে নেয়, নার্সটি হয়তো রক্তের ব্যাগ নিয়ে অপারেশন থিয়েটারে চলে গেছে। বাহিরে এত গাড়ির শব্দ শুনে কক্ষ থেকে বের হয়। দৃষ্টি গিয়ে পড়ে হসপিটালের করিডোরে। একসাথে অন্তত পঁচিশ জনের একটা পুলিশ বাহিনী ভেতর দিকে এগিয়ে আসছে! প্রথম দেখায় বুঝতে পারেনি সে কারা আসছে! একটু ভালো করে নজর করতেই মস্তিষ্ক সংকেত প্রেরণ করে, সবার প্রথম সারির মধ্যখানে আছেন ডিআইজি মারুফ হোসেন। তার ডান পাশে আছেন ডিসি মোহাম্মদ নাজিম। তিনি ডিআইজিকে কী যেন বলছেন, কিন্তু ডিআইজি তার কথার প্রেক্ষিতে কোনো জবাব বা ইশারাও করছেন না। তারা এগিয়ে আসে অপারেশন থিয়েটারের সামনে। তাদের দিকে সাইমুনও এগিয়ে যায়। প্রথমে স্যালুট দিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় ডিআইজির উদ্দেশ্যে।
‘ স্যার আসসালামুয়ালাইকুম। আমি সাব-ইন্সপেক্টর সাইমুন। আমিই আপনাকে কল করেছিলাম। ‘
প্রত্যুত্তরে ডিআইজি মারুফ হোসেন হাত মিলিয়ে বললেন,
‘ ওয়ালাইকুমুসসালাম। ‘
আরও কিছু বলতে নিলেন, এমতাবস্থায় অপারেশন থিয়েটারের ভেতর থেকে একজন ডাক্তার বের হয়ে তাগদা স্বরে বলতে লাগল,
‘ আপনারা এখনও রক্তের কোনো বন্দবস্ত করতে পারননি? রোগীর এরকম অবস্থায় রক্ত দিতে আর কিছুক্ষণ দেরি করলে বাঁচিয়ে রাখা সক্ষম হবে না! ‘
এহেন কথায় সকলে বাকহারা হয়ে পড়ে! সাইমুন যেন আকাশ থেকে পড়ল। দ্রুত পেছন দিকে ঘুরে ডাক্তারের উদ্দেশ্যে বলতে লাগল,
‘ দুই ব্যাগ রক্ত না দেওয়া হলো মাত্র? আর দুই ব্যাগের কথা না আস্তেধীরে ম্যানেজ করতে বললেন? ‘
অবাক স্বরে ডাক্তারটি বলতে লাগল, ‘ আমরা কখন বললাম! আর দুই ব্যাগ রক্ত কাকে দিয়েছেন!’
তার এমন মন্তব্য শুনে সাইমুন যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না! মনে সন্দেহ জাগে, দুই ব্যাগ রক্ত নার্সটি তবে লুকিয়ে ফেলেনি তো? নাকি সে এই রক্ত নিয়ে অপারেশন থিয়েটারে যায়নিই? দ্রুত প্রশ্নের জবাব দিয়ে বলল সাইমুন,
‘ কেন? আপনাদের পেছনে যেই নার্সটি ছিল! সে-ই তো রক্ত নিলো দুই ব্যাগ! ‘
ডাক্তার যেন এবার চমকে গেল তার কথা শুনে। বলতে লাগল,
‘ কী বলছেন! তবে নার্স রুবি রক্তের ব্যাগ নিয়ে গেল কোথায়? ‘

মুহূর্তের মাঝে একটা হুলুস্থুলে কাণ্ড বেঁধে গেল। হাসপাতাল থেকে রক্তের ব্যাগ নিয়ে গায়েব নার্স! ডিআইজি আর ডিসির মাথায় কিছুই ঢুকছে না। ডাক্তারটি আবার বলে ওঠে,
‘ দ্রুত অন্তত দুই ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা করেন। নইলে রোগীকে বাঁচানো খুব ক্রিটিক্যাল হয়ে যাবে। ‘
ডাক্তারটি ভেতরে চলে যেতেই ডিআইজির দিকে তাকায় সাইমুন। তাকাতেই তিনি বলতে লাগলেন,
‘ রাহেলার সাথে আমার রক্তের গ্রুপ ম্যাচ করে না। ‘
পাশ থেকে ডিসি জিজ্ঞেস করেন, ‘ স্যার, ম্যামের রক্তের গ্রুপ কী? ‘
‘ এ পজিটিভ। ‘

সবচেয়ে অবাক ব্যাপারটা হলো, উপস্থিত সেখানের কারও রক্তই এ পজিটিভ নয়। দ্রুত আশেপাশের ব্ল্যাড ব্যাংকগুলোতে কল করা হলো। প্রত্যেকটা ব্ল্যাড ব্যাংক থেকে একটাই জবাব! ‘ স্যার, আমাদের কাছে এ পজিটিভ রক্ত নেই। ‘ পুনরায় একটা হুলুস্থুল লেগে গেল। এরকমটা হওয়া একেবারেই অসম্ভব! এ পজিটিভ আহামরি রেয়ার কোনো গ্রুপ নয়। কিন্তু এমন সিচুয়েশন ক্রিয়েট হওয়া তো অসম্ভব প্রায়! অপারেশন থিয়েটারে থাকা ডাক্তারদের পুনরায় ডাকল সাইমুন। এবার ভেতরে থাকা পাঁচজন ডাক্তারই বেরিয়ে এলো। সিনিয়র ডাক্তার বেরিয়ে ডিআইজিকে দেখেই এগিয়ে আসে তার কাছে। সালাম দিয়ে জানতে চায়, উনি এখানে কেন? প্রত্যুত্তরে বলেন তিনি, ‘ ওটি-তে যাকে নিয়েছ তোমরা, সে আমার মেয়ে। ‘ চমকে ওঠে সেই ডাক্তার। কাঁপা কণ্ঠে ব্যক্ত করে,
‘ আয়া..আপনার মেএয়ে? ‘ ঘাড় কাত করে বলল, ‘ ঠিক আছে স্যার। দেখছি আমরা। ‘

কিছুই বুঝে উঠতে পারল না উপস্থিত সবাই! তবে সবাই এতটুকু বুঝতে পারছে, বেশ বড়োসড়ো কোনোকিছু অবশ্য হয়েছে। এবং সামনে আরও হতে যাচ্ছে! ইতোমধ্যে মিডিয়ার লোক দিয়ে হাসপাতালের আশপাশে ভীড় জমে গেছে। বাহিরের মেন গেট বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে তারা। বেশ কিছু পুলিশ সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে। এই মুহূর্তে এদের মুখ লাগার কোনো ইচ্ছেই নেই ডিআইজি বা ডিসির। হঠাৎ ডিআইজির মনে পড়ল ফারহানের কথা। তৎক্ষণাৎ সাইমুনকে ইশারায় ডেকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ এই ছেলে, এদিকে আসো। ‘
সাইমুন তার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। ওয়েটিং চেয়ারে বসে ডিআইজি তাকে ডাক দিতেই সে দৌড়ে এগিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে,
‘ জি স্যার? ‘
কিছুটা কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করলেন ডিআইজি, ‘ ফারহান কোথায়? এতক্ষণ হয়ে গেল, ওর দেখা পাচ্ছি না কেন? ‘
সাইমুন প্রত্যুত্তরে একটু কেঁপে জবাব দিলো,
‘ স্যার, ফারহান স্যারের দেহে কেনোলা লাগানোর পরপরই উনি কেমন যেন ঘুমোচ্ছেন। ‘
‘ কেমন যেন ঘুমোচ্ছে মানে? ‘ বিলম্ব না করেই তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করেন ডিআইজি।
আমতা আমতা স্বরে জবাব দিলো সাইমুন,
‘ প্রথমে স্যারকে ঘুমিয়ে যেতে দেখে ভাবছিলাম, উনি প্রচুর প্রেশারে আছেন। তাই বোধ হয় ঘুমিয়ে গেছেন। কিন্তু এখন এতকিছুর মনে হচ্ছে, উনি ঘুমোয়নি, উনাকে জোর করে ঘুম পাড়ানো হয়েছে। ‘

চুপ করে গেলেন ডিআইজি মারুফ হোসেন। এই মুহূর্তে আর কিছু বলার মতো জো দেখছেন না তিনি। ভেবে পাচ্ছেন না, হচ্ছে কী এসব? রক্তসহ নার্স উধাও হয়ে যাওয়া! এরপর কোনো ব্ল্যাড ব্যাংকেই একটা সাধারণ গ্রুপের রক্ত খুঁজে না পাওয়া! তারপর গিয়ে ডাক্তারদের অস্বাভাবিক আচরণ! কিছু একটা ঘটেছে। এতগুলো ঘটনা কেমন যেন একটা সূত্রে গাঁথা মনে হচ্ছে। তখনই মনে প্রশ্ন জাগে, এরকমটা হলো কী করে? মাথা নিচ দিকে দিয়ে ভাবছিলেন। চোখে ঘুম ঘুম ভাবটা কেটে গেছে। তার পরনে কোনো স্যুট নেই। ঘুমিয়ে ছিলেন তিনি। এমন সময় কল আসে সাইমুনের। তার মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া হচ্ছে শুনে নিজেকে কোনোমতে বিছানা থেকে তুলে গায়ে একটা সাদা পাঞ্জাবি ঠেকিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েছেন। পাশে ঘুমানো স্ত্রী রাইমামকেও কিছু বলেননি এমনকি ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলেননি। বাসা থেকে বেরিয়ে নিচতলা থেকে ড্রাইভারকে ডেকে ঘুম থেকে তুলে রওনা দিয়েছেন হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে ডিসিকে কল করে আসতে বলেছেন।

মাথা তুলে বাম হাতটা সামনে এনে পাঞ্জাবির হাতাটা উপর দিকে টানলেন। বেরিয়ে এলো রোল এক্স ব্র‍্যান্ডের ঘড়ি। সময় দেখলেন তিনি। রাত সাড়ে তিনটা বাজে এখন। সাইমুনের দিকে ঘাড় ফেরালেন। বেচারা কাচুমাচু হয়ে তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। কখনো তার সামনে দেখিনি এই ছেলেটিকে। আর তাকেও সামনে থেকে দেখে ছেলেটাও বেশ ঘাবড়ে আছে তা বেশ বুঝতে পারছে।
‘ এরকমটা হলো কী করে? ‘

– চলবে –

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here