খুন সিরিজ তৃতীয় সিকুয়েন্স,একাদশ পর্ব

0
194

খুন সিরিজ তৃতীয় সিকুয়েন্স,একাদশ পর্ব
গল্প:- মাস্টার অব মাইন্ড গেম
লেখা:- যাবেদ খান আবু বকর

ছাব্বিশ.
সাইমুন দুটো ঢোক গিলল একসাথে। তার দিকে ডিআইজির তাকানো দেখেই অনুধাবন করতে পেরেছিল, তিনি এখন তাকে এই প্রশ্নটাই করবেন! নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে প্রথম বলতে লাগল,
‘ আজকে একটা সাসপেক্টকে ক্রাইম সিন থেকে গ্রেফতার করি আমরা। ‘
ডান হাত উঁচু করে থামালেন ডিআইজি। তিনি একটু নিজের ভাবনায় ডুবে গেলেন। খাওয়াদাওয়া করে সবে বিছানায় শুতে যাবেন। এমন সময় কল আসে তার ফোনে। ফোন হাতে নিয়ে দেখে, ফারহান কল করেছে। বিলম্ব না করে কলটা রিসিভ করে। ওপাশ থেকে ভেসে আসে, ‘ আসসালামুয়ালাইকুম আব্বু। ‘ সালামের প্রত্যুত্তরে আইজি মারুফ হোসেন ‘ ওয়ালাইকুমুসসালাম ‘ বললেন। অফিস টাইমে ফারহান তাকে কল করে স্যার এবং অফিস টাইমের বাহিরে আব্বু বলেই সম্মোধন করেন। ওপাশ থেকে ফারহান বলতে আরম্ভ করেন,
‘ আব্বু, এমপির খুনের কেসে একটা সাসপেক্টকে তার ছেলের বউয়ের খুনের ক্রাইম সিনে পেয়েছি। আমরা ওকে এরেস্ট করতে যাচ্ছি। রাতে জিজ্ঞাসাবাদ করে কাল সকালে আপনাকে পুরো ডিটেইলস দিচ্ছি। ‘
ডিআইজি মারুফ হোসেন কেবল বললেন, ‘ ঠিক আছে। ‘ এরপর কলটা কেটে যায়। অতীত থেকে ফিরে আসেন বাস্তবে। পুনরায় ডান হাতের আঙুলগুলো একটু নাড়িয়ে সাইমুনকে পুনরায় বলার আদেশ করলেন। আদেশ মান্য করে সে পুনরায় বিবৃতি দিতে শুরু করল,
‘ যখন জিজ্ঞাসাবাদ করছিলাম, তখনই সাসপেক্টটি স্যারের বন্দুক হোলস্টার থেকে নিয়ে স্যারকে গান পয়েন্টে নিয়ে নেয়। এমনকি গুলিও করে। তখন বাধ্য হয়ে গুলি ছুড়তে বাধ্য হই। কিন্তু এমন সময়ই তার ফোন থেকে কল আসে। সম্ভবত তার বাসা থেকে কেউ কল করেছিল। কল পেয়েই স্যার সেখানে হন্য হয়ে ছুটে যায়। আমিও তার পেছন পেছন যাই। তবে তার আগে দুইটা ইউনিটকে আমাদের পেছনে আসতে বলি। ‘ ঢোক গিলতে একটু বিরতি নেয়। ফের বলতে আরম্ভ করে ঢোক গিলেই।
‘ স্যারের পেছন পেছন যেতেই দেখি, স্যার তার বাসার দিকে গেছেন। উনি গাড়ি থেকে নেমেই কেমন যেন দৌড়ে ভেতরে ঢুকেছিল। আমিও গাড়ি থামিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখি, আমাদের থানার দুজন অফিসার, রনি এবং দিলিপের মরদেহ পড়ে আছে। তাদের পাশ দিয়ে ভেসে যাচ্ছিল রক্তের ফোয়ারা। স্যার ততক্ষণে বাড়ির ভেতরে চলে গেছিল। আমিও তার পিছুপিছু গিয়ে দেখি। ‘ চোখ দুটো কিছু সময়ের জন্য সম্মিলিত করে নেয়। পরপর দুটো ঢোক গিলে। চোখ দুটো মেলে উপস্থিত সবার দিকে ঘাড় ফেরায়। সবার নজরের কেন্দ্রবিন্দু তার দিকে আটকে আছে। পাশ থেকে ডিআইজি তার কাঁধে হাত রাখলেন। নীরবে আশ্বাস দিলেন তাকে। সাইমুন একটু থেমে ফের বলতে আরম্ভ করল,
‘ ভেতরে ঢুকে দেখি, মেঝে রক্তে লাল হয়ে গেছে। ভাবি মেঝেতে পড়ে আছে। স্যার ভাবির মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে রেখেছিলেন। ‘ থেমে যায় সে। আর বিবৃতি দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। তার কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নেন মারুফ হোসেন। নিজের দুই উড়ুর উপর কনুই ঠেকিয়ে ভাবনায় পড়ে যান। কী থেকে কী হচ্ছে ভেবে পাচ্ছেন না! এমপির পরিবার সম্পূর্ণ নিঃশেষ করে দিয়েছে। এখন আবার তার পরিবার বা তার মেয়ের সংসারের উপর কে নজর দিলো! নানা ভাবনায় বিভোর হয়ে আছেন। কিন্তু ফুরসত পাচ্ছে না ফোন কলের কারণে। একের পর এক বেজেই চলেছে তার ফোন। কিন্তু ধরার মতো মন মানসিকতায় নেই। বাহির থেকে এখনও মিডিয়ার লোকেদের শোরগোল শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, পারলে তারা গেট ভেঙেই ভেতরে প্রবেশ করবে। এত উশৃঙ্খল মিডিয়ার লোক কী করে হলো তা তার মাথায় আসছে না। এমন সময় গেট খোলার শব্দ শোনা গেল। অবাক হলো উপস্থিত সবাই! কে খুলল গেট? মিডিয়ার লোকেদের ভিড়কে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়ার কারণ কী? এমন একটা জঘন্য কাজ করল কে? ডিআইজি মারুফ হোসেন রাগে চোখ দুটো রক্তিম লাল করে উঠে দাঁড়ালেন। পা বাড়ালেন হাসপাতালের মূল ফটকে। তার পেছন পেছন উপস্থিত বাকি পুলিশ সদস্যগণও উঠে হাঁটতে শুরু করল। এমন সময় গেট পুনরায় বন্ধ করার শব্দ ভেসে আসে। কিছুদূর অগ্রসর হতেই সবার নজর কাড়ে হাসপাতালের মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ হওয়া এক যুবকের। হাতে সিম্পল ওয়াচ। চোখে একটা সানগ্লাস। গায়ে জড়িয়ে আছে কালো রঙের একটি ফুল হাতা শার্ট। কনুই অবধি ফোল্ড করা আছে হাতা। সাথে নিচে পরা আছে কালো রঙের প্যান্ট। পায়ে বুট জুতা। কানে ব্লুটুথ এবং মাথার চুলগুলো বাম দিক থেকে সিঁথি করা। সামনের এবং বাম দিকের চুলগুলো ফোলা। শার্ট চিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে বডি মাসেলগুলো। দ্রুত পায়ে হেঁটে এগিয়ে এলেন তিনি তাদের দিকে। সবার দৃষ্টি এখন যুবকের উপর। কেউ চিনতে না পারলেও ডিআইজি মারুফ হোসেন বেশ ভালো করেই চিনতে পেরেছেন, কে সে! যুবকটি এসে সরাসরি হাত বাড়িয়ে দিলেন তার দিকে। প্রবেশদ্বারের কাছে আসতেই অনুভব হলো, চারদিকের অন্ধকারের পরিমাণ কমতে চলেছে। ফরসা হয়ে আসছে সম্পূর্ণ পৃথিবী। ঘড়ির দিকে তাকালেন একবার ডিআইজি। আজানারের সময় হয়ে এসেছে। যুবকটি হাত বাড়িয়ে দিতেই হাতে হাত মিলিয়ে হ্যান্ডশেক করলেন তিনি। ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইলেন, সে এখানে কীভাবে! প্রত্যুত্তর করার আগেই একটা ল্যান্ড লাইন নাম্বার থেকে কল এলো তার ফোনে। ইশারায় যুবকটি তাকে ফোনটি তুলতে বললেন। ডিআইজি দেরি না করে কলটা রিসিভ করে কানে তুলে নেন। কিছু বলতে যাবেন তিনি তার আগেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে, ‘ ডিডোর প্রফেসর নিয়াক বলছি। ওখানের কী হালচাল? ‘
এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেন ডিআইজি। পরমুহূর্তে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে জবাব দিলেন,
‘ এখানে অনেক কিছুই ঘটে গেছে। আপাতত পরিস্থিতি স্বাভাবিকই আছে। তবে জানা নেই, কতক্ষণ অবধি থাকবে। ‘
ওপাশ থেকে প্রফেসরের ভারী কণ্ঠে ভেসে আসে, ‘ চিন্তার কোনো কারণ নেই। আইজি বেনজির আহমেদ কিছুক্ষণ আগে আমাকে কল করেছিল। ফারহানের চলিত কেসের ব্যাপারে বলেছে। এখনকার কন্ডিশন সম্পর্কেও জানিয়েছে। সকল বিষয় মাথায় রেখেই কেস সমাধানের জন্য ডিডোর সবচেয়ে বেস্ট অ্যাজেন্ট ‘ যাবেদ ‘কে পাঠিয়েছি আমি। ‘
নীরবে প্রফেসরের কথাগুলো শ্রবণ করলেন ডিআইজি। চোখ তুলে একবার তাকালেন সদ্য ভেতরে আসা যাবেদের দিকে। পালটা উত্তর দেওয়ার শ্রাগ করলেন তিনি।
‘ ঠিক আছে প্রফেসর। যাবেদ অলরেডি এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে। ‘

লাইনটা কেটে যায় তৎক্ষণাৎ। হ্যান্ডশেক ছেড়ে দেন তিনি। এতক্ষণ যাবত দুজনেই দুজনের হাত আঁকড়ে ছিলেন। উপস্থিত বাকি পুলিশ সদস্যগণ চোখগুলো কৌতূহলী করে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। স্বয়ং ডিসিও তাকিয়ে আছেন তাদের দিকে। মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে তাদের দুজনের কথাবার্তা! তারা ভেবে পাচ্ছে না, আগত যুবকটি কে? ডিআইজি মুখ থেকে যাবেদ নামটি উচ্চারণ করেছে। তবে কে এই যাবেদ? কী কারণে আসা তার এখানে? মুখ খুললেন ডিআইজি। উগড়ে দিলেন নিজের ভেতরের কথা। উপস্থিত সবার কৌতূহল মেটাতে ব্যস্ত তিনি।
‘ ডিডো সংস্থার প্রফেস কল করেছিলেন। এতদিন যার নাম তোমরা চর্চা করে এসেছ, আজ সেই নামের মানুষটা তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দ্যা মোস্ট ইন্ট্যালিজেন্ট এন্ড বেস্ট অ্যাজেন্ট ফর ডিডো। যাবেদ খান। ‘
সবাই অবাক না হয়ে পারে না। তাদের সামনে সেই বিখ্যাত ব্যক্তিটি দাঁড়িয়ে আছে? পুলিশ কিংবা র‍্যাব, উভয় টিমের মাঝে যাবেদ নামটাকে ইন্সপিরেশন মানা। লোকটা ছবি অবধি কোথাও নেই। কেউ চিনে না তাকে। কেবল কাজ এবং নাম চিনে। এখন অবধি লাইফে কোনো কেস পেন্ডিং থাকেনি। উপস্থিত সবাই স্যালুট জানায়। সেদিকে পাত্তা দেন না আগত লোকটি। ডিআইজির সাথে আলাপ করতে করতে হাসপাতালের ভেতর দিকে পা বাড়ান। হাঁটতে হাঁটতে দ্বিতীয়বারের মতো মুখ খুললেন তিনি।
‘ সবাইকেই দেখলাম, কিন্তু ফারহানকে যে কোথাও দেখলাম না! ও কোথায়? ‘
প্রত্যুত্তরে ডিআইজি মুখ খুললেন।
‘ ব্ল্যাড ডোনেশন রুমে। ঘুমিয়ে পড়েছে। ‘ এহেন বার্তা শুনে একটু হতভম্ব হলেন যাবেদ। সাধারণত ফারহানকে যতটুকু চেনেন তিনি, সে এমন ধরণের মানুষ নয়। কিন্তু আজ এই ক্রান্তিলগ্নে এসে ঘুমোচ্ছে! কথা পছন্দ না হওয়ায় পালটা প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
‘ ফারহান তো এমন ধরনের ছেলে না! আজ এই সময়ে ও ঘুমোচ্ছে? ব্যাপার কী? ঘুমের ঔষধ বা ড্রাগস দেওয়া হয়েছে নাকি ওকে? ‘
তার প্রশ্ন শুনে উপস্থিত সকলে বুঝতে পারল, কেন তাকে এতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়। সাধারণ কেউ হলে হয়তো সর্বোচ্চ জিজ্ঞেস করত, কোন রুমে আছে কিংবা আর কোনো প্রশ্ন নাও করতে পারত। কিন্তু তিনি তারচেয়েও কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে অনুমান অনুসারেই প্রশ্ন করে বসলেন, ঘুমের ঔষধ বস ড্রাগস দেওয়া হয়েছে কি না! তার প্রশ্নের জবাবে মুখ খুললেন সাইমুন। অবশ্য ইশারায় তাকে বলার জন্য আদেশ করেছেন ডিআইজি। সাইমুন তার পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলতে আরম্ভ করলেন,
‘ স্যারের শরীরে ক্যানোলার ঢুকানোর সাথে ঘুমের ঔষধ ডায়াজিপামও ইঞ্জেক্ট করা হয়েছে তার শরীরে। ‘ কথাটা শোনা মাত্রই ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকালেন যাবেদ। প্রশ্ন ছুড়লেন,
‘ ঘুমের ইঞ্জেকশন কেন? তাও ব্ল্যাড ডোনেশন টাইমে? ‘
‘ কারণ তাকে ঘুম না পাড়ালে কাজ করতে পারছিল না। ‘
ভ্রু কুঁচকে তাকান সাইমুনের দিকে। কিঞ্চিৎ রাগী স্বর নিয়ে চাপ প্রয়োগ করলেন তিনি।
‘ ভণিতা না করে সরাসরি বলো, কী হয়েছে এখানে? ‘
সাইমুন এবার শুরু থেকে সম্পূর্ণ ঘটনা তাকে বিবৃতি দিলো। একজন ভালো শ্রোতার মতো সম্পূর্ণ কথা পুঙ্খভাবে শুনলেন। সব শোনার পর অনুধাবন করতে পারলেন, বিশাল বড়ো কিছু হয়েছে এখানে। নয়তো এরকমটা হবার বিন্দুমাত্র প্রশ্নই আসে না। কিন্তু এখন সেদিক নিয়ে ভাবার সময় নেই। আপাতত প্রয়োজন হলো ফারহানের স্ত্রীর সুস্থতা। তার আগে ফারহানকে দেখে আসা প্রয়োজন তার। সেই সর্বশেষ দেখা হয়েছিল ডিডোর হেড কোয়ার্টারে। পুনরায় যে মোলাকাত হবে এটাও ভাবেননি তিনি। সাইমুনকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘ ফারহান কোন রুমে আছে? ‘ প্রত্যুত্তরে সে তাকে জানায়, ‘ আপনি চলুন আমার সাথে। আমি আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছি। ‘

হাঁটতে লাগল সাইমুন। অনুসরণ করে হাঁটছেন অ্যাজেন্ট যাবেদ। হাঁটার মাঝেও বিগত কেসগুলো নিয়ে ভাবছেন তিনি। গতকাল একটা কেস শেষ করে সবে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন বাসায়। এমন সময় তাকে প্রফেসর নিয়াক কল করেছেন। ঘুমের ঘোরেই কল রিসিভ করেছেন তিনি। প্রফেসর নিয়াক তাকে তাগদা দিয়ে বলছিলেন,
‘ যাবেদ, ডেভিড কেসে তোমার সঙ্গী ছিল যে ফারহান। মনে আছে তোমার? ‘
কিঞ্চিৎ বিরক্তি বোধ করেছিলেন তিনি সেই সময়ে। বিরক্তি নিয়েই প্রশ্ন করেছিলেন,
‘ হ্যাঁ চিনি। কিন্তু এটা তো কাল সকালেও বলতে পারতেন। এই রাত-বিরেতে ঘুমের বারোটা বাজিয়ে বলাটা কি খুব বেশি দরকার ছিল? ‘
তার এই প্রশ্নের জবাব দেননি প্রফেসর। বরং সুন্দর করে এড়িয়ে গিয়ে তিনি তার মূল টপিকে আসলেন।
‘ ফারহান একটা কেস সামলাচ্ছিল, কিন্তু কেসের সিলসিলায় অনেক কিছুই ঘটে গেছে। ওর বাসায়ও হামলা হয়েছে। ‘ যাবেদ চুপচাপ শুনছিলেন। ঘুম তার এতক্ষণে চলে গেছে। কিন্তু তার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে প্রফেসর ফের প্রশ্ন করলেন,
‘ যাবেদ, তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ? ‘ প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, ‘ জি স্যার। শুনতে পাচ্ছি। আপনি বলতে থাকুন। ‘
‘ ঠিক আছে। ফারহানের স্ত্রীকে যেই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, তোমার বাসা থেকে তা খুব বেশি দূরে নয়। তুমি এখনই গাড়ি রওনা হও। আর এখন থেকে এই সম্পূর্ণ কেসটা হ্যান্ডেল করবে তুমি। আমি সব কিছুর ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। ‘
মেজাজ বিগড়ে গেল তার। কিছুটা রাগ চটা স্বরে বলতে চাচ্ছিলেন, সবেই তো গতকাল একটা কেস শেষ করে বাসায় ফিরেছি। আজ আবার! আমার তো একটু বিশ্রাম প্রয়োজন হয়। তা নয় কি? কিন্তু এগুলো তিনি বলতে পারেননি। তিনি যখনই বলার জন্য কণ্ঠস্বর ছেড়েছেন, তখনই ওপাশ থেকে প্রফেসরের কণ্ঠে ভেসে এসেছে, ‘ আমি আশা রাখছি, অ্যাজেন্ট যাবেদ আমাকে হতাশ করবে না। ‘ আর কিছু বলা হয়নি তার। আর কিছু বলারও থাকে না। মাঝেমাঝে রাগও হয় প্রফেসরের এমন হুটহাট সিদ্ধান্তের কারণে। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি বুঝতে পারেন, প্রফেসর তার ভালো জন্যই করছেন। এমনকি তার মাঝে কাবিলিয়ত আছে দেখেই তাকে প্রফেসর তাকে আটকে যাওয়া কিংবা ক্রিটিক্যাল কেসগুলো তার কাছে হস্তান্তর করেন।

তাছাড়া তার পরিবার বলতে এখন ডিডো অবধিই সীমাবদ্ধ। না আছে স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে কিংবা পরিবারের কেউ। অতীতে ডুবে যেতে লাগলেন। কত স্মৃতিমধুরর ছিল তার জীবনের একটা সময়। ভালোবাসায় তার জীবন কানায় কানায় ভরতি ছিল। প্রথম ভালোবাসা এবং স্ত্রী অলিনকে নিয়ে তার প্রতিটা স্বপ্ন বাঁধাই করা ছিল। যেখানে অন্য কারও ছায়া কিংবা স্পর্শ পড়তে পারে না। মডেলটা ডি মিশনে অলিনকে চিরজীবনের জন্য হারান তিনি। এরপর কেসের সিলসিলায় বহু নারী তার জীবনে এসেছে, গিয়েছে। কিন্তু কারও প্রতি কোনোপ্রকার আকর্ষণ খুঁজে পাননি। ফলে এখনও কারও সাথে নতুন করে ঘর বাঁধতে পারননি তিনি। তাছাড়া তার একমাত্র ভাই তাবিব এখন আছে দেশের বাহিরে। লন্ডনে একটা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। সেখানেই বিয়ে করে লাইফ সেট করে নিয়েছে। দেশে এখন সে একাই আছে। বাসায় ফিরে একাকী জীবন তার। প্রফেসর অবশ্য তার এই দিকটা উপলব্ধি করেই যত দ্রুত সম্ভব পুনরায় নতুন কেস জোগাড় করে দেন। যাতে তার একাকী থেকে নিজের ব্যক্তিত্বই ভুলে যান। মানুষ একাকী বসবাস কর‍তে পারে না। কোনো মানুষের পক্ষেই তা সম্ভব না।

ঘোর ভাঙে সাইমুনের ডাকে। ‘ স্যার, চলে এসেছি। আপনি ভেতরে যান। আমি বাহিরেই আছি। ‘ একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলল সে। হাতের ইশারায় ভেতরে যাবার জন্য বলল। অ্যাজেন্ট যাবেদ সাত-পাঁচ না ভেবে খট খট বুটের শব্দ তুলে ভেতরে প্রবেশ করলেন। সম্পূর্ণ টাইলস করা একটি রুম। দুই পাশে দুটি টিউব লাইট। দুটোই জ্বালানো আছে। সাদা আলোয় সাদা টাইলসগুলো যেন আরও চকমক করছে। দরজার বাম পাশে পাতা হয়েছে বেড। বেডের পাশে ক্যানোলাসহ নানান ধরনের সরঞ্জামাদি রাখা আছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ফারহানের দিকে নজর করলেন তিনি। চেহারার গঠন বদলেছে ফারহানের। তিন বছর আগে শেষ যখন দেখেছিলেন, তখন তার চেহারায় আরও রোগাপটকা ছিল। মুখের চামড়াগুলো হাঁড়ের সাথে লেগে ছিল। দেহের স্বাস্থ্য আরও কম ছিল। এখন মুখ ভরা ভরা লাগছে। স্বাস্থ্য বেড়েছে। আগের ফারহান আর এখনকার ফারহানের মাঝে বিশাল একটা তফাত রয়েছে। আরও কিছুক্ষণ রুমের ভেতরে পর্যবেক্ষণ করে বেরিয়ে এলেন তিনি। চলে গেলেন অপারেশন থিয়েটারের সামনে। সাইমুন তার পিছু পিছু আসছে। সেদিকে ধ্যান দেননি। অপারেশন থিয়েটারের সামনে দীর্ঘ তিন ঘণ্টা বসে থাকার পর সকাল সাতটার সময় থিয়েটারের ভেতর থেকে একসাথে দুজন ডাক্তার বেরিয়ে এলো। তাদের দেখে ডিআইজি অনেকটা দৌড়ে ছুটে গিয়েছেন তাদের কাছে। তার পিছু পিছু অ্যাজেন্ট যাবেদসহ বাকিরাও গিয়েছে। ডাক্তার বেরিয়ে তাদের ছুটে আসতে দেখেই হাতের ইশারায় সবাইকে থামাল। প্রশ্ন করতে হাত দিয়ে প্রতিহত করে তারা দুজনে কম্বাইন করে বলতে লাগল,
‘ অপারেশন সাকসেসফুল বলা যায়। ডান পাশের বুকের উপরিভাগে গুলিটা আঘাত করেছে। তবে রক্তক্ষরণ হয়েছে প্রচুর। এত রক্তক্ষরণের পরেও যে জীবিত অবস্থায় হাসপাতালে এনে অ্যাডমিট করা গিয়েছে, এটাই অনেক। এখন সুস্থ আছে। রক্তও দেওয়া হয়েছে। ‘ শেষ কথাগুলো বলার সময় ডাক্তারগণ একটু অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছিল। ডিআইজি কিছু বলতে যাবেন, কিন্তু তার হাত ধরে ইশারায় কিছু বলার জন্য মানা করলেন যাবেদ। তিনি ভালো করেই বুঝতে পেরেছেন, ডিআইজি এই মুহূর্তে কী প্রশ্ন করবেন। কিন্তু এই প্রশ্ন করার সময় এখন না। সুস্থতার খবর পেয়ে উনি একটু স্বাভাবিক হলেন।

সবাই যখন থিয়েটারের পাশে বসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছিল, তার কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান ফেরে ফারহানের। সে নিজেই ব্ল্যাড ডোনেশন রুম থেকে বেরিয়ে থিয়েটারের দিকে ছুটে আসে। তিনি ছুটে এসেই দেখতে পান, পুলিশবাহিনীর বেশ বড়োসড়ো একটা দল থিয়েটারের কাছে বসে আছে। মস্তিষ্কের নিউরনে থাকা অণুগুলো দিকবিদিকশুন্য হয়ে ছুটতে শুরু করল। ভাবনা এলো তার মস্তিষ্কে। রাহেলার খারাপ কিছু হয়নি তো? সে ঠিক আছে তো? এখানে এত পুলিশের সমারোহ কেন? চারদিকে এত আলো কেন? ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই প্রথমে নজরে পড়ে তার শ্বশুর আব্বুকে। বসে আছেন তিনি। তবে তাকে এখন কিছুটা রিল্যাক্স মনে হচ্ছে। ডিআইজি তাকে আসতে দেখে দ্রুত টান দিয়ে তার পাশে বসালেন। ফারহানকে টান দিতেই তিনি বসে পড়েন তার শ্বশুরের পাশে। কিন্তু ঘাড় ফিরিয়ে চোখ পড়ে যায় তার সিনিয়রের উপর। নজর আটকে যায় সেদিকে। তিনি ভেবে পাচ্ছেন না, তিনি কি স্বপ্ন দেখছেন? নাকি এটা তার কল্পনা? ডিআইজি তার উদ্দেশ্য করে বলতে আরম্ভ করেন,
‘ ফারহান, এখন একটু সুস্থ আছে রাহেলা। বন্দুকের গুলি বুকের ডান পাশের উপর দিয়ে চলে গেছে। তবে এখনও জ্ঞান ফেরেনি বলে জানিয়েছে ডাক্তার। ‘
তিনি তার শ্বশুরের কথা শুনে মাথাটা ঠান্ডা করলেন। মনে স্বস্তি এলো তার। কিন্তু আচমকাই তার মনে আরও একটা প্রশ্ন আসে। তার মেয়ে কোথায়! তৎক্ষণাৎ সেখানে প্রশ্নটা করে বসেন,
‘ আমার মেয়ে রাইসা কোথায়! ‘ তার এরকম প্রশ্নে কেঁপে ওঠেন ডিআইজি। মুহূর্তের মাঝে একটা হুলুস্থুল কাণ্ড বেঁধে যায়। বেঁধে যাওয়াটাই স্বাভাবিক! বাচ্চা মেয়েটা তো তাদের সাথেই থাকার কথা! ফারহানের বাসায় থাকা পুলিশ অফিসারদেরকে আদেশ করা হলো, তন্নতন্ন করে খুঁজতে। আদেশ অমান্য করেনি তারা। তন্ন তন্ন করে খুঁজে কিছুই পায়নি। কোত্থাও নেই রাইসা।

– চলবে –

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here