গল্প:- খুন সিরিজ দ্বিতীয় সিকুয়েন্স,ষষ্ঠ পর্ব
লেখনীতে:- যাবেদ খাঁন আবু বকর
চেয়ার বন্ধি লোক দুটোর কথা শুনে উপস্থিত হওয়া লোক দুজনের মাঝে একজন মুচকি হাসছে অপরজন উচ্চস্বরে হাসছে । তৎক্ষণাৎ চেয়ার বন্ধি দুজনের উদ্দেশ্য করে উচ্চস্বরে হাসা লোকটি বলে উঠল,
-‘ তোমাদের কোনো ধারণা আছে কার সামনে কী বলছো?”
এই বলে লোকটি কোমড়ে গুজে রাখা বন্ধুকটি হাতে তুলে নিল। পা দুটো ভাজ করে নিচু হয়ে বসে তাদের মুখোমুখি হতেই চেয়ার বন্ধি লোক দুটোর মুখ থেকে বেরিয়ে গেল ” এজেন্ট যাবেদ”।
তৎক্ষণাৎ তাদের উদ্দেশ্য করে বলতে লাগল যাবেদ,
-‘ হ্যাঁ, কেমন চমক দিলাম? শুনে রাখো, তোমাদের বুদ্ধি ডালপালায় যদি চড়ে, তবে আমার বুদ্ধি পাতায় পাতায় চলে। খুব তো জোর দিয়ে বলছিলে। এবার বলো কাদের তুলে এনেছি! কী বলবে? ইলুমিনাতির সদস্যদের মধ্যে দুজনকে তুলে এনেছি!’ একদমে কথাগুলো বলে শেষ করল যাবেদ।
চেয়ার বন্ধি দুজন যাবেদের কথা শুনে যেন থমকে গেছে। ইতোমধ্যেই তাদের চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেছে। কখনো ভাবতেই পারেনি তারা, যাবেদ তাদের পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। পুনরায় তাদের উদ্দেশ্য করে হাসতে হাসতে বলল যাবেদ,
-‘ তোদের কি একটুও মনে হয়নি ট্রাকিং ডিভাইস কেন অফ হলো? আবার তা কী করেই বা অন হলো?”
যাবেদের মুখে এ প্রশ্ন শুনে উপস্থিত এজেন্ট ফারহানের মনে তৎক্ষণাৎ প্রশ্নের জোয়ার ভাটা বয়ে যায়। সেই জোয়ার ভাটার টানে প্রশ্ন উথাল-পাতাল করে মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ে একগাদা প্রশ্নের ঝুলি,
-‘ ওরা কারা? আর এরা যদি ইলুমিনাতির সদস্য হয়! তবে ধরলেন কী করে? আর সেই দোকানেই বা কেন গিয়েছিলেন?”
এজেন্ট ফারহানের প্রশ্ন শুনে কিঞ্চিৎ হেসে দিল যাবেদ। এ হাসি দেখে তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ফারহান। কিন্তু তার এরকম তীক্ষ্ণ এবং রুক্ষ দৃষ্টির চাহনি দেখে তৎক্ষণাৎ হাসি থামিয়ে বলতে আরম্ভ করল,
-‘ সরি! তোমাকে তো কিছুই বলা হলো না। অবশ্য তুমি এই লাইনে নতুন। যদি এখন তোমাকে ট্রেনিং না দেওয়া হয়, তবে শিখবে কী করে? তোমার মনে আছে আমি গাড়িতে উঠে কী কী করেছিলাম?’
কিছুটা অবাক হয়ে প্রশ্নের জবাব দিল ফারহান,
-‘ তেমন কিছুই তো বলেননি। শুধু গাড়িতে উঠে হাতে ট্রাকিং ডিভাইসটা নিয়েছিলান। আর কাউকে মনেহয় কল করেছিলেন। ”
একটি মুচকি হাসি দিয়ে বলল যাবেদ,
-‘ দ্যাটস গুড মাই ব্রাদার। এবার চলো একটু পেছন দিক থেকে ঘুরে আসা যাক!’
থাই গ্লাসের দোকানটি থেকে বেরিয়েই ডান দিকে মোড় নিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করল যাবেদ। কিন্তু তার এরকম একঘেয়েমি কর্মকাণ্ড দেখে কিঞ্চিৎ পরিমাণ রেগে গেল ফারহান। তৎক্ষণাৎ ফারহানের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি একটি হাসি দিয়ে বলতে লাগল যাবেদ,
-‘ গাড়িটা তৈরি রাখো। আর আমার পিছুপিছু গাড়ি নিয়ে আসো।’
কেবল এতটুকু বলে দোকানের সামনে থেকে দ্রুত বেগে হাঁটতে লাগল । কিন্তু এদিকে তার বলা কথা কিছুই মাথায় ঢুকলো না ফারহানের। অবশ্য আগেও যে খুব একটা ঢুকতো এমনটাও নয়। তবুও ভদ্রতা বজায় রেখে মৃদুস্বরে নিজের সাথেই নিজে বলে উঠল, ” এর সাথে যদি আর দুই দিন থাকি। নির্ঘাত আমি পাগল হয়ে লোকের দুয়ারে-দুয়ারে পাগলামি করব।’
কয়েক সেকেন্ড পেরিয়ে যেতেই আচমকা মাথায় একটি চাপড় মেরে নিজের সাথেই নিজে বলতে আরম্ভ করল,
” ফারহান, এত দ্রুতই পাগল হয়ে গেছিস না-কি! নয়তো পাগলের প্রলাপ বকছিস কেন তুই? ধুর! আমি বোধহয় পাগলই হয়ে গেছি। নয়তো একা একা কেউ কথা বলে?”
কিছু সময় পেরিয়ে যেতেই নিজের মনকে নিজে বলে ওঠে,
-“উনি যেটা বলে গেছেন, সেটাই দ্রুত করি। এতেই ভালো।”
তৎক্ষণাৎ যাবেদের পিছুপিছু গাড়ি নিয়ে এগুতে লাগল সে। কিছুদূর হাঁটতেই বাম দিকে একটি মোর নজরে এলো যাবেদের। কিন্তু সেদিকে তেমনভাবে দৃষ্টি দিয়ে না তাকিয়ে তৎক্ষণাৎ ডান হাতে থাকা ঘড়িটা উঁচু করে ধরে দেখতে লাগল সে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঘড়ির কাটার দিকে তাকাতেই নজরে এলো, ঘড়ির সবচেয়ে ছোটো কাটাটা তিন-এর উপর থেকে কিছুটা দূরে স্থীর হয়ে পড়ে আছে। তারচেয়ে একটু বড় কাটাটা সাত পেরিয়ে আটের কাছাকাছি অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। তবে বিরতিহীন। কিন্তু ততটাও গতিশীল নয়। এক কথায় বলা যায়, “ধীরস্থির”। এবং মধ্যস্থানে থাকা কাটাটার উপরে থাকা সবচেয়ে বড় কাটাটা বিরতিহীন ভাবে চলমান। যেন বিরতিহীনভাবে ঘুরে চলেছে। এ সময়টাতে রাস্তাঘাটে লোকজনের সংখ্যাটাও নেই বললেই চলে। যদি থাকে তবে তা দু-একজন। ঘড়ির কাটা নিয়ে গবেষণা করতে করতে রাস্তার বাম দিকের মোড়ের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। আর তাকে অনুসরণ করে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে আসছে ফারহান।
কোনো দিকে না তাকিয়েই অবিলম্বেই বাম দিকে মোর ঘুরিয়ে নিল যাবেদ। রাস্তার পাশেই দুজন লোক মাত্র এসে থেমেছে। পকেট থেকে ফোন বের করে ডায়েল প্যাডে একটি নাম্বার তুলতে ব্যস্ত। কিন্তু তাকে দেখা মাত্রই চোখ দুটি বড় বড় তাকায়। কিন্তু কয়েক ন্যানো সেকেন্ডের মাঝেই তাদের মস্তিষ্কের নিউরনে থাকা সিনান্সগুলো সজাগ হয়ে গেল। দ্রুত ফোনটা পকেটে পুরে যাবেদের মুখে আঘাত জন্য হাত বাড়ায় দুজন। কিন্তু এখানে সে কিছুটা কৌশল অবলম্বন করে মাথাটা একটু নিচের দিকে ঝুকিয়ে নেয়। যার হেতু তাদের হাত দ্বারা আঘাতটা মাথার উপর দিয়েই চলে যায়। কিন্তু এই মোক্ষম সুযোগ হাত ছাড়া না করে তাদের দু’জনের পেটের কিছুটা নিম্ন ভাগে মুষ্টিবদ্ধ হাত দিয়ে আঘাত করে। তাদের দুজনের পেটের নিম্নভাগে আঘাত পড়তেই ব্যথায় আৎকে উঠে। অবিলম্বেই তারা দুজন পেটে হাত দিয়ে নিচ দিকে কিছুটা ঝুকে যায়। কিন্তু এই সুযোগটা হাত ছাড়া না করে দুজনের ঘাড়ের মধ্য বরাবর একটু কৌশল খাটিয়ে হাতের আঙুল চারটি সোজা করে কব্জির নিম্নভাগ দিয়ে আঘাত করে। যার নিমিত্ত তৎক্ষণাৎ দু’জনের মস্তিষ্কে সাময়িক সময়ের জন্য রক্ত সঞ্চারণ বন্ধ হয়ে যায়। যার হেতু অবিলম্বেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ফারহান যাবেদের পিছুপিছু গাড়ি নিয়ে সেখানে এসে উপস্থিত হয়। কিন্তু তার দিকে কিঞ্চিৎ ভাবনার দৃষ্টিতে না তকিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়া দেহ দুটি কাঁধে তুলে নেয়। ফারহানকে হাতের ইশারায় গাড়ির পেছনের দরজা খুলে দিতে বলে সে। গাড়ির পেছনের দরজা খুলে যাওয়া মাত্রই কাঁধে অজ্ঞান হওয়া লোক দুটোকে একজনের উপর আরেকজনকে ফেলে রাখে। কিছুটা রাগ চটা ভাব ফুটে উঠেছে তার মুখমণ্ডলে। কিন্তু তা পাত্তা না দিয়ে ফারহানের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে,
-‘ ওপাশের সিটে যাও। দ্রুত!’ শেষ কথাটা কিছুটা ধমকের সুরের মত শোনাল। কিন্তু সেদিকে ধ্যান না দিয়ে পাশের সিটে বসে পড়ল ফারহান। আর তার পাশের সিটে বসে গাড়ির স্টেয়ারিং হাত ধরে রেখেছে যাবেদ।
তবে যাবেদের কর্মকাণ্ডগুলো ফারহানকে কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে দিয়েছে। তবুও নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে, “কী হচ্ছে এসব? প্রথমে গ্লাসের দোকানের উদ্দেশ্য করে এলো। এরপর পরই কিছু সময় সিসি টিভি ফুটেজ দেখে। কিন্তু অবাক বিষয়, সেখানে তেমন কিছু না বলেই দোকান থেকে বেরিয়ে যায়। আর দোকান থেকে বের হয়েই অদ্ভুত আচরণ শুরু করে। কিন্তু অদ্ভুত আচরণ করেও বাম দিকের মোড়ে গিয়ে দু’জন লোককে ঘাড়ে আঘাত করে অজ্ঞান করে দেয়ে। এবং তাদেরকে গাড়ির পেছন দিকে কিছুটা দলা মুচড়ি করে রেখে দেয়। এরপরই গাড়ির ড্রাইভিং সিটে এসে গাড়ি চালাতে আরম্ভ করে। তবে কি সিসিটিভি ফুটেজে কিছু দেখেছে? কিন্তু আমি তো তেমন কিছুই খুঁজে পেলাম না।” একলা মনে কথাগুলো ভাবছিল সে। পুনরায় নিজেকে নিজেই বলে ওঠে, ” হে ফারহান, তোমাকে প্রফেসর নিয়াক স্যার খুনের রহস্য নয়, এই জলজ্যান্ত পাগলের সাথে থেকে পাগল হবার জন্য পাঠিয়েছে।” শেষের কথাগুলো নিজেকেই নিজে বলে মুখ টিপে মুচকি হাসতে থাকে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে ঈষৎ গম্ভীর সুরে বলতে লাগল যাবেদ,
-‘ প্রফেসর নিয়াক স্যার তোমাকে আমার সাথে পাগল হবার জন্য নয়, খুনের রহস্য উন্মোচন করার জন্যেই পাঠিয়েছে। তুমি খুব সাধারণ দৃষ্টিতে বিষয়গুলোতে চোখ বোলাচ্ছ। যার হেতু খুনের তেমন কোনো সূত্র খুঁজে পাওনি। একটু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সকল বিষয়গুলো মস্তিষ্কের নিউরনে থাকা সিনান্সগুলো একটু সজাগ করো। এবং মস্তিকেই কৃত্রিম একটি খুনের দৃশ্যপট সৃষ্টি করো। খুব সহজেই বুঝে যাবে আমি কী কী করতেছি!’
যাবেদের কথা শুনে ঈষৎ থতমত খেয়ে বলল ফারহান,
-” প্রফেসর নিয়াক স্যার আপনার সাথে আমাকে পাগল হবার জন্য পাঠাবে কেন! তবে পাগল হবার জন্য না পাঠালেও অর্ধ পাগলের দারপ্রান্তে। আর আপনার মত যদি এরকম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে মস্তিষ্কের নিউরনে থাকা সিনান্সগুলো জাগ্রত করে কৃত্রিম একটি খুনের দৃশ্যপট তৈরি করলে, আমি নির্ঘাত পাগল হয়ে যাব।’ প্রথম কথাগুলো চমকিত স্বরে হলেও শেষে এসে প্রায় হতাশায় নিমজ্জিত কণ্ঠে কথাগুলো বলল সে।
একটি মুচকি হাসি দিয়ে বলল যাবেদ,
-‘ থাক তোমায় আর অতটা ভাবতেও হবে না, আর তোমাকে পাগলও হতে হবে না। তবে একসময় সব বুঝে যাবে। ‘
ফারহান মনে মনে নিজেই নিজে বলতে লাগল, ” এই লোক তো ভারী ভয়ংকর। যে সে কেউ কউ। আর যেরকমটা ভাবছিলাম তেমনটাতো মোটেও নয়। নয়তো আমার মনের কথা বুঝল কী করে!”
তৎক্ষনাৎ তার উদ্দেশ্য করে হাসিমাখা মুখ নিয়ে বলতে লাগল যাবেদ,
-” আমাকে ভয়ংকর ভাবার প্রয়োজন নেই। তবে বিচক্ষণতা সম্পন্ন লোক বলতে পারো। আমি শুধু তোমার মুখের ভাব দেখে মস্তিষ্কে একটু ভাবনা যুক্ত করে তোমায় বললাম।’
এরপর গাড়িতে নেমে এলো নিস্তব্ধতা। মিনিট কয়েক হাইওয়ে রোড দিয়ে গাড়ি চলতেই একটি ঘন জঙ্গলের কাছে এসে উপস্থিত হয়। কিছু সময় অপেক্ষা করে গাড়ি নিয়ে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলতে লাগল। এক পর্যায় ঘন জঙ্গলের কাছে এসে উপস্থিত হয়। চারদিক লতাপাতায় ছেয়ে আছে। তেমন কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। কিন্তু সেদিকে তোয়াক্কা না করে গাড়িতে থাকা সুইচ বোর্ডের মধ্য হতে একটি সুইচ চাপ প্রয়োগ করে যাবেদ। ফারহানকে অবাক করে দিয়ে লতা-পাতাগুলো দুদিকে চেপে যায়। এবং আরো ভেতরে যাবার জন্য একটি পিচঢালা রাস্তা তৈরি হয়ে গেল। এরকম দৃশ্য দেখে ফারহান অবাক হলেও যাবেদের মুখের ভাব আগের মতই আছে। তবে ব্যাপারটি নিয়ে বেশি ভাবছে না ফারহান। পুনরায় গাড়ির গতিপথ বৃদ্ধি করে দিয়ে ভেতর পথ প্রবেশ করল তারা। ভেতরে গাড়ির অবস্থান টের পেতেই আপনা-আপনিভাবে আগের মত হয়ে গেল জঙ্গলের দেয়াল। এবারও এই দৃশ্য দেখে অবাকতার শীর্ষে অবস্থান করেছে ফারহান। কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলল না। কিন্তু তার দিকে একবার তাকিয়েও কিছু বলল না যাবেদ। গাড়ি চালিয়ে কিছুদূর আগাতেই নজরে এলো একটি ছোট্টো কুটির। তবে বাহির দিক থেকে যতটাই সাধারণ মনে হয়, ভেতর থেকে ঠিক ততটাই ভয়ানক। বাহিরে গাছের ছাউনি দিয়ে বেড়া এবং চাল দিলেও ভেতর দিক থেকে প্রটেক্ট করার জন্য রয়েছে পলি-কার্বনেট গ্লাস। যা বুলেট প্রুফ এবং সাউণ্ড প্রুফ। কুটিরের কাছে এসে গাড়ি থায় যাবেদ। দ্রুত পায়ে গাড়ি থেকে নেমে পেছনে চলে যায়। পেছনের দরজা খুলে অজ্ঞান হয়ে থাকা লোক দুটোর দেহ কাঁধে তুলে নেয়। হাঁটতে থাকে কুটিরের দিকে। যেন তার উদ্দেশ্য কুটিরের ভেতর। গাড়ির ভেতর বসে না থাকে বেরিয়ে পড়ল ফারহান। দ্রুত তার পিছু নিয়ে কুটিরের ভেতরে প্রবেশ করল সে। রুমের মধ্যস্থানে কয়েকটি চেয়ার দেখা যাচ্ছে। এছাড়াও কুটিরের ভেতরের গন্ধটা ভয়ানক। কেমন একটা রক্ত পঁচে যাওয়ার ভ্যাপসা গন্ধ। এছাড়াও চারদিকে থাই গ্লাস লাগিয়ে রাখার ফলে ভ্যাপসা গন্ধের পরিমাণটা বৃদ্ধি পেয়েছে। কাঁধ থেকে দুজনের দেহ দুটি চেয়ারের উপর রাখল। পাশে থাকা লম্বাটে টেবিলটি একটু টান দিতেই হাতের কাছে চলে এলো। টেবিলের উপরে নানান রকমের যন্ত্রপাতির দেখা মিলছে। যা মুহূর্তেই ভাবিয়ে তুলছে ফারহানকে। নিজ মনকে সে নিজেই প্রশ্নবিদ্ধ করল, ” কী করতে চাচ্ছেন উনি?” কিন্তু তার প্রশ্নটা তার মনেই রয়ে গেল। প্রকাশ পায়নি আর। টেবিলের উপর থেকে দুটি বড় রশি নিয়ে তাদের দুজনের হাত-পা শক্ত করে বেঁধে দিল। এতক্ষণ হাই পাওয়ার লাইটের আলো জ্বললেও যাবেদের দুটি হাত তালি দেওয়াতে তৎক্ষণাৎ লাইটের আলো কমে গিয়ে ২৫ ওয়াটের লাল লাইটের নিভু নিভু আলো জ্বলছে। হয়েছে। টেবিলের উপর থেকে এক হাতে জগ নিয়ে অপর হাতে পানি ঢালল। চেয়ার বন্ধি লোক দুটোর মুখ উদ্দেশ্য করে পানি ছুঁড়ে মারল। কিচ্ছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হতেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায় চেয়ারে বন্ধি লোক দুটো।
অতিত দেখা থেকে ফিরল দুজন। মস্তিষ্কে নিউরনের সিনান্সগুলো জাগ্রত করে কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল ফারহান,
-‘ সব বুঝলাম! কিন্তু এদের দুজনকে হাতের বাগে আনলেন কী করে?”
একটি রহস্যময় হাসি দিয়ে হাতের দিকে ইশারা করে বলল যাবেদ,
-‘ তোমার মনে আছে এটার কথা?’
অবাকতার চরম সীমায় অতিক্রম করে ব্যক্ত করল ফারহান।
-‘ আরে এটা তো সেই ট্রাকিং ডিভাইসটা।’
ঠোঁটের কোণে একটি মুচকি হাসি যোগ করে বলল যাবেদ,
-‘ হ্যাঁ এটা দিয়েই! হেতু ওদেরকেই ধরার জন্য ওদের টোপই ব্যবহার করেছি। এক কথায় বলতে, ওদের ছোঁড়া ঢিল,ওদেরকেই নিক্ষেপ করেছি।’
অবাকের সীমা তরণ করে পুনরায় প্রশ্ন করল ফারহান,
-‘ কিন্তু এটা কী করে সম্ভব হলো?’
ঠোঁটের কোণে একটি মুচকি হাসি ফুটিয়ে ব্যক্ত করতে আরম্ভ করল যাবেদ,
-‘ ট্রাকিং ডিভাইস চালু এবং বন্ধ করার দুইটাই সুইচ আছে। এর আগেও আমার সাথে এমনটা ঘটেছিল। তাই এ সমন্ধে একটু বেশিই ধারণা আছে। যার হেতু গাড়িতে উঠে তৎক্ষণাৎ ডিভাইসটি বন্ধ করে দিই। নকল ইলুমিনাতির সদস্যরা যখন দেখল তাদের ডিভাইস বন্ধ হয়ে গেছে, এক প্রকার অবাক হয়ে যায়। হন্ন হয়ে খুঁজতে লাগল বন্ধ হয়ে যাবার কারণ। কিন্তু তাদের কারো মাথায় আসেনি, যে এই ডিভাইসটা আমার হাতে পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে।
আর এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে নিলাম আমি। ডিভাইস অফ করে দিয়ে গ্লাসের দোকানের উদ্দেশ্য করে রওনা হলাম। দোকানের কাছাকাছি এসে পূর্বের মত আবারও ক্ষণিক সময়ের জন্য ডিভাইসটা অন করি। এখন পুনরায় অফ করে দিই। এরপর ভেতরে চলে যাই।’ এদিকে হন্ন হয়ে খুঁজতে খুঁজতে আমার পর্যন্ত পৌঁছাবার জন্য লোক পাঠায়। বাকিটা ওদেরকেই মালাই মেরে কাবাব দিয়ে দিলাম।’
পুনরায় অবাক হবার ভঙ্গি মুখে ফুটিয়ে প্রশ্ন করল,
-‘ হ্যাঁ এতটুকু বুঝলাম! কিন্তু এদের উপস্থিতি আপনি কীভাবে টের পেলেন? এরা যে বাম দিকের মোড়েই ছিল তা কী করে জানলেন?’
ঠোঁটের কোণে ধূর্ত প্রকৃতির একটি রহস্যময় হাসি দিয়ে প্রশ্ন করল,
-‘ সিসিটিভির ঘটনা মনে আছে?’
হতাশা ভুক্ত কণ্ঠে ব্যক্ত করল ফারহান,
-‘ হ্যাঁ! আপনি ফুটেজটা ফ্রিজ করতে বললেন। এরপর কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে সেখানে তাকিয়ে থেকে দোকান থেকে বের হয়ে এলেন। কী যে দেখলেন! সেটাই বুঝলাম না।’
দুই ঠোঁটের কোণে পূর্বের চেয়েও আরও বড় একটি রহস্যময় হাসির রেখা ফুটিয়ে ব্যক্ত করতে লাগল যাবেদ,
-‘ একজন লোক থাই কিনেছিল। হাতে ইলুমিনাতির সাইন ছিল। এবং এই ফুটেজটা যখন দেখছিলাম, এর পাশেই একটা মনিটরে নজর পরে। সেখানে দোকানের বাহিরের ফুটেজ লাইভ টেলিকাস্ট দেখাচ্ছিল মনিটরে। আর সেখানেই নজরে আসে এই দুজনের হাতে সেই ইলুমিনাতির বিখ্যাত জ্যা। দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে সময় লাগে না আমার। ফুটেজে দেখছিলাম তারা অইদিকেই যাচ্ছে। অতঃপর আর কী? বেরিয়ে এসে তাদের পিছু ধরলাম। এরপর ধামাল করে নিয়ে এলাম। ‘
হতাশায় আচ্ছন্ন কণ্ঠে বলল ফারহান।
-‘ এদিকে মূর্খের মত কী ভেবেছি আমি। ‘
টেবিলের উপরে থাকা যন্ত্রপাতিগুলো আলোর ঝলকানিতে চকচক করছে। তা দেখে ভয়ে পেয়ে বিচলিত হয়ে গেল লোক দুটো। কিন্তু যথাসম্ভব চেষ্টা করছে যেন মুখে ভয়ার্ত ভাব ফুটে না ওঠে। টেবিলের উপর প্লাস,সুং,ড্রিল মেশিন, দা,লবন। এছাড়াও রয়েছে নানান প্রকৃতির তৈজসপত্র। যা কেবল অত্যাচারের জন্য ব্যবহৃত করা সম্ভব। কাটিং প্লাসটি হাতে নিয়ে কয়েকবার শূণ্য চাপ দিয়ে দেখল যাবেদ। এ দেখে ভয়ে ঢোক গিলল দুজন। তৎক্ষণাৎ তাদের উদ্দেশ্য করে গম্ভীর কণ্ঠে বলতে আরম্ভ করল যাবেদ,
-‘ যা যা প্রশ্ন করব, যদি সঠিক উত্তর না দেস! তবে এমন হাল করব না, ভাবতেও পারবি না! ”
তখনের হুমকি দেওয়া লোকটির কাছে একটি চেয়ার টেনে বসল যাবেদ। ফারহান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেবল যাবেদের কর্মকাণ্ড দেখে যাচ্ছে। লোকটির ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুলটি কাটিং প্লাসটির মধ্য স্থানে রেখে কিছুটা চাপ দিয়ে ধরল। সামান্য পরিমাণ চাপ প্রয়োগ করে লোকটির উদ্দেশ্য করে প্রথম প্রশ্ন করল যাবেদ,
-‘ প্রথম প্রশ্ন, তোদের মুল হোতা কে?’
উত্তরে লোকটি কিছুটা দাম্ভিকতা দেখিয়ে বলল,
-‘ জানি না।’
কথাটি বলা মাত্রই কাটিং প্লাসে সম্পূর্ণ চাপ প্রয়োগ করে ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুলটি সম্পূর্ণ কেটে ফেলল। গগন ধাঁধানো একটি চিৎকার দিয়ে উঠল লোকটি। বড় বড় শ্বাস নিতে আরম্ভ করল সে। আঙুলের কাটা অংশ থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল মেঝেতে। সেদিকে তোয়াক্কা না করে পাশের আঙুলটি কাটিং প্লাসের মধ্যে দিয়ে চেপে ধরল যাবেদ। পুনরায় একই প্রশ্ন করল যাবেদ। তবে এবার লোকটার উত্তরে কিছুটা বদল এসেছে। প্রবাদবাক্যই আছে, ” সোজা আঙুলে যদি ঘি না উঠে, তবে আঙুল বাঁকা করো। নিশ্চয়ই আঙুলে গি উঠবে।” লোকটার কথার ধরণ দেখে বুঝা যাচ্ছে, ব্যাটা এবার লাইনে এসেছে। বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে ক্ষীণ কণ্ঠে প্রশ্নের উত্তরে বলল,
-‘ তাকে চিনি না। কখনো সামনা-সামনি দেখা হয়নি। কেবল ফোনে আলাপ হয়েছে। ‘
লোকটির পকেটে হাতড়ে দ্রুত ফোন হাতে তুলে নেয় যাবেদ। একটা টাচস্ক্রীন ফোন। অনেক পুরোনো মডেলের ফোন। Symphony Model P6 ফোন। কিন্তু সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে পাওয়ার বাটনে চাপ প্রয়োগ করল যাবেদ। তৎক্ষণাৎ সাইড লক দেওয়া স্ক্রিন চলে এলো। দ্রুত স্ক্রিনে থাকা লকটি সাইডে নিতেই লক খুলে যায়। দ্রুত ফোনের ডায়েল প্যাডে গিয়ে চেক করতেই একটি অদ্ভুত নাম্বার নজরে এলো। এছাড়াও নাম্বারটি থেকে বহুবার কল এসেছে। এবং কথা হয়েছে। দ্রুত টেবিলের উপরে রাখা বন্দুকটি হাতে তুলে নেয় যাবেদ। লোকটির কপাল বরাবর বন্দুকের নল রাখে। আচমকাই ট্রিগার চাপ দিয়ে বসল যাবেদ। টং করে একটি ঝংকারের শব্দ তুলল বন্দুকের গুলি। রুমের ভেতরে নেমে এলো সম্পূর্ণ নিস্তব্ধতা। বন্দুকের নল দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। বারুদের পোড়া ধোঁয়াগুলো রুমের বায়ুর সাথে মিশে গেল কয়েক মুহূর্তের মাঝে। ভ্যাপসা গন্ধের সাথে মিলিত হয়েছে বারুদের পোড়া গন্ধ। রুমের ভেতরে একটা অস্বাভাবিক গন্ধের সৃষ্টি হয়েছে। এটা সুগন্ধ না দুর্গন্ধ তা বলাটা বড়ই কষ্টকর। লোকটি পাশে বন্ধি অপর লোকটি কিছু সময় চুপ থাকলেও রুমে বাংকার শব্দ তুলে একটি চিৎকার দিল। কিন্তু সেদিকে ধ্যান দিল না যাবেদ। বন্দুকটি পুনরায় পাশে একটু আগে চিৎকার করা লোকটার দিকে তাক করল। একটু আগে বন্দুক থেকে নির্গত হওয়া গুলিটা সোজা লোকটির কপালের মধ্যবর্তী স্থান আঘাত হেনেছে। কপাল ভেদ করে অপর পাসজ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষগুলো চিঁড়ে গুলিটি বের হয়েছে। কপাল এবং মাথার পেছন দিক থেকে চুয়িয়ে চুয়িয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। গাল বেয়ে বেয়ে রক্ত গড়িয়ে মেঝেতে পড়ছে। পাশে থাকা লোকটি যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। ট্রিগারে হাত রাখল যাবেদ। কিছুটা রাগ এবং কিছুটা গম্ভীর স্বর মিলিয়ে এক ভয়ানক কণ্ঠস্বরের সৃষ্টি হয়েছে। জীবিত লোকটির উদ্দেশ্য বলতে আরম্ভ করল, অতঃপর তার উদ্দেশ্য করে বলতে লাগল, ” তুইও আমার সঙ্গিনীর মৃত্যুর সাথে জড়িত। তোরও বেঁচে থাকার অধিকার নেই। ”
তৎক্ষণাৎ ট্রিগারে চাপ প্রয়োগ করল যাবেদ। পুনরায় রুমে একটি ঝংকার দিয়ে শব্দ তুলে পুনরায় পিনপতন নীরবতা। রুমে নেমে এলো পুনরায় নিস্তব্ধতা।
যাবেদের এরকম কাণ্ডে হতভম্ব হয়ে গেছে ফারহান। তার সামনে মুহূর্তেই দুটি লোককে মেরে ফেলল। সুট আউট করে কাউকে মারা যেন যাবেদের হাতের ময়লা। চেয়ারে বাঁধা লোক দুটির মরা দেহগুলোর বাঁধন খুলতে লাগল যাবেদ। এ দেখে আরো হতভম্ব হয়ে যায় ফারহান। ” কী করতে চাচ্ছেন উনি? এই একটা প্রশ্ন কেবল তার মনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেছে। কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না। জোয়ার-ভাটার গতিপথ স্থির হয়ে গেছে। যার ফলে প্রশ্নগুলো মুখ থেকে উথলে বেরিয়ে আসছে না। বাঁধন মুক্ত করে দেহগুলো টেনেহিঁচড়ে রুম থেকে বের করল যাবেদ। ফারহান কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। যেন চোখের সামনে মনের ভ্রম দেখছে সে। কিন্তু এগুলোতো আর মনের ভ্রম নয়। রুম থেকে মৃত দেহগুলো দরজার কাছে এনে একটি শিস দিল যাবেদ। তৎক্ষণাৎ দৌড়াতে দৌড়াতে উপস্থিত হলো চারটে সাদা নেকড়ে। দেহের গড়ন বেশ মোটাসোটা। উচ্চতায়ও কম নয়। উচ্চতায় প্রায় তিন ফিট। মৃত দেহগুলো টেনে একটু কাছে এগিয়ে গেল যাবেদ। দ্রুত নেকড়েগুলো যেবেদের সামনে এসে কদমবুসি করতে লাগল। পায়ের সাথে মাথা লাগিয়ে ঘষতে আরম্ভ করল নেকড়ে চারটে। যেন বহুদিন পরে আজ মনিবের দেখা পেয়েছে। এত বড় বড় নেকড়ে দেখে ভয়ে জড়সড় হয়ে যায় ফারহান। মনে মনে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে সে, ” এ কোন মহা মুসিবতে এসে ফাঁসালাম আমি!” কিন্তু মুখ দিয়ে একটি আওয়াজও বের করতে পারছে না।
মৃত লোক দুটোর দেহগুলো নেকড়েদের দিকে ছুঁড়ে দিল যাবেদ। তৎক্ষণাৎ মুখে হিংস্র ভাব ফুটিয়ে হামলে পড়ল তারা। মাত্র সাত মিনিটেই যাবেদের সামনে পড়ে আছে কেবল তাদের পরিধান করা ছিঁড়া-ফাঁড়া কাপড়গুলো। এছাড়া সামান্য কিছু রক্ত। এছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। যাবেদের ঠোঁটের কোণে ভেসে উঠেছে এক আত্মতৃপ্তির প্রতিচ্ছবি। ফারহানকে ডাক দিয়ে ইশারায় তার পিছু হাঁটতে বলল। সে অবিলম্বেই তৎক্ষণাৎ দৌড়ে যাবেদের পাশে গিয়ে উপস্থিত হয়। এত তাড়াতাড়ি মরার ইচ্ছে মোটেও নেই তার। এখনো বিয়ের স্বাদ গ্রহণ করা বাকি আছে। তবুও ভয়ে ভয়ে যাবেদের উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন রাখল ফারহান,
-‘ আপাতত কোথায় যাচ্ছি আমরা?’
একটি মুচকি হাসি দিয়ে বলল যাবেদ,
-‘ নতুন উদ্যোমে যাত্রা দেওয়ার জন্য যাচ্ছি।’
তবে যাবেদের এই মুচকি হাসির পেছনে কতটা হিংস্রতা লুকিয়ে আছে, তা একটু আগেই স্ব চোখেই দেখে এসেছে ফারহান।
[ — চলবে — ]
*কী হতে যাচ্ছে?
*এত হিংস্রতার আড়ালেও এত সুন্দর স্বভাব?
*কোথায় যাওয়া হচ্ছে তাদের?