খেলাঘর,পর্বঃ১২,১৩

0
2383

খেলাঘর,পর্বঃ১২,১৩
লেখকঃ শাওন
পর্বঃ১২

লাজ চোখ খুলে যা দেখলো তা সে কল্পনাও করতে পারেনি। গুলিটা ফারাজের গায়ে লাগার আগেই ঐ মহিলাটি সামনে চলে আসে। মহিলাটি পরে যাওয়ার আগেই ফারাজ ওনাকে ধরে ফেলে, আর মুখটা দেখতেই বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠে। এটা সে কি দেখছে?এতদিন পর সে তার এত প্রিয় একটা মানুষ’কে দেখছে যাকে দেখা মাত্রই মুখ থেকে বেড়িয়ে আসলো,”মা!”
লাজ দৌড়ে গিয়ে মহিলাটির পাশে গিয়ে বসে যখন ফারাজের মুখে কথাটা শুনলো তখন সে একবার তার দিকে অবাক হয়ে তাকালো।ফারাজ পাগলের মতো করছে,”মা,তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? মা তুমি এটা কি করলে?কেন করলে তুমি এমন? আমার জন্য কেন তুমি নিজেকে কষ্ট দিলে মা!”
মহিলা টি ওনার রক্তাক্ত কাঁপা হাতে ফারাজের গালে হাত দেবার আগেই চোখ বন্ধ করে নিলো।লাজ তারাতাড়ি ওনার নাড়ি পরীক্ষা করে বলে,” তোমাকে আমি পরে দেখে নিবো আগে ওনাকে বাঁচাতে হবে।”
লাজ কথাটা বলে মহিলার শরীরে হাত দিতে নিলে ফারাজ হাত ধরে ফেলে।তারপর চোখ রাঙ্গিয়ে বলে,” তুমি হাত দিবে না আমার মায়ের গায়ে, আজকে তোমার জন্য আমার মায়ের এই অবস্থা।তুমি আমাকে কি দেখবে আমি তোমাকে দেখবো যদি আমার মায়ের কিছু হয় তো।”
ফারাজ মহিলাকে কোলে করে নিয়ে যেতে লাগলো। লাজ বোঝতে পারলো না ফারাজ ওনাকে মা মা কেন ডাকছেন?তাহলে কি সত্যি ওনি ফারাজের মা ছিলেন,তারমানে এজন্যই তিনি সকালবেলা ফারাজকে নিয়ে এত জোর দিয়ে কথা বলছিলেন।লাজও পিছু পিছু গেল, ফারাজ গাড়িতে তার মাকে শুয়ে গাড়ি স্টার্ট দিতে নিবে তখনই লাজ গাড়িতে উঠে বসে।ফারাজ কিছু বলতে নিবে তাঁর আগেই লাজ বলে,”এখন আমাদের ঝগড়া করার সময় নেই, দেরী হয়ে যাচ্ছে ওরে হয়তো আমাদের আর কিছু করার থাকবে না।”
ফারাজ বোঝতে পারলো লাজের কথায় যুক্তি আছে তাই সে কথা না বাড়িয়ে গাড়ি চালাতে লাগলো। হসপিটালে আসতেই ফারাজের মা কে অপারেশন থিয়েটারের ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়। ফারাজ বাহিরে বসে থেকে চোখের পানি ফেলছে, আর একা একাই বলে যাচ্ছে…
-“কোথায় ছিলে মা তুমি এতদিন? তুমি আমার এতকাছে থেকেও কেন ধরা দাওনি? তুমি কেন আজকে আমার জন্য এমন করতে গেলে? মা গোআমি তোমাকে এতদিন পর পেয়ে হারাতে পারবো না।আল্লাহ দয়া করে তুমি আমার মাকে সুস্থ করে দাও!”
লাজ ফারাজের কান্না দেখছিল,সে ফারাজের সামনপ গিয়ে বলল,
-“খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না! আমারও এমন লেগেছিল যখন আমি শুনেছিলাম আমার বাবা মা আর এই পৃথিবীতে নেই।”
-“তার মানে তুমি ইচ্ছে করেই মাকে গুলি করেছো?”
-“আমি তোমাদের মতো এতটাও খারাপ মানুষ না যে একটা মাকে গুলি করবো। এতটুকু মন আমার আছে,তোমার মতো না!”
-“আমি তোমার মা বাবা’কে খুন করিনি।”
-“খোদার দুহায় লাগে আর মিথ্যা বলো না,আজকে তোমার মিথ্যার জন্য তোমার মায়ের এই অবস্থা। বর কত মিথ্যা বলবে তুমি,ওহ সরি তোমরা?”
-“আমি সত্যি বলছি খুন আমি করিনি,খুন করেছে আমার বাবার লোকেরা!হ্যা,আমি আজকে সব সত্য জেনেই তোমাকে বলতে এসেছিলাম কিন্তু তুমি আমার কোনো কথায় শুনোনি।”
লাজ চমকে উঠলো সে ফারাজের সামনে গিয়ে বলে,”তোমার বাবা-র লোকেরা মানে?তুমি ছিলে না তাদের সাথে?”
-“নাহ,আমি সেখানে থাকা তো দূর এসব কিছু জানতামও না আর জানলে এসব কখনোই হতে দিতাম না।”
-“তাহলে আমাকে আয়েরা মিথ্যা কেন বলবে?”
-“আয়েরা মিথ্যা বলেনি!”
-“কি শুরু করছো তুমি? একবার বলছো তুমি ঐখানে ছিলে না আরেকবার বলছো আয়েরা মিথ্যা বলছে না।তাহলে কি হয়েছিল সেদিন?”
-“একটু শান্ত হয়ে বসো আমি তোমাকে সবটা খুলে বলছি।”
——-অতীতে——
ফারাজ লাজের সাথে রাগ দেখিয়ে কারখানা থেকে বেড়িয়ে আসলো। নিজের বাবা’র প্রতি আনা মিথ্যা অভিযোগের বদলা নিবে ভেবে সে ভিতরে যায়। ভিতরে এসে দেখে কতগুলো লোক মাস্ক পরে মুখ ঢেকে আছে, লাজের বাবা’কে কতগুলো ঘুষি মারা মুখে দাগ হয়ে আছে, মায়ের গালে থাপ্পড়ের দাগ আছে।ফারাজ এতে কিছুটা রেগে গেল, সে আর যায়হোক বয়স্ক ব্যক্তিদের গায়ে হাত তুলা পচ্ছন্দ করে না। সে একে একে সবকটাকে রাম ধুলায় দিতে লাগলো, এক পর্যায় যখন ফারাজের সাথে পারলো না তখন লাজের বাবা মা’কে গুলি করে দেয়।যাতে করে বলতে না পারে তারা কে ছিলো?আর কে পাঠিয়েছিল তার কারণ যদি ফারাজ তার বাবার এসব কর্মকান্ড জানতে পারে তাহলে ফারাজ সরে আসবে। পর পর দুটি গুলিতে ফ্লোরে লুটিয়ে পরে লাজের বাবা ও মা। ফারাজ হাতের পাশে থাকা ফুলদানি দিয়ে ঢিল মারে,সাথে সাথে লোকটির হাত থেকে গুলি পরে যায়। ফারাজ দৌড়ে গিয়ে গুলি ধরার আগে আগেই লোকগুলো জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়। ফারাজ জানলার পাশে গিয়ে দেখে লোকগুলোকে আর দেখা যাচ্ছে না।পিছনে ফিরতেই দেখে আয়েরা দাড়িয়ে আছে। আয়েরা লাজের বাবা মা’কে নিচে পরে থাকতে দেখে চিৎকার করে উঠে।ফারাজ গুলিটা নিজের পিছনে রেখে বলে,” আয়েরা প্লিজ যা হয়েছে,তুমি কাউকে কিছু বলবে না।”
-“মেরে ফেললেন আঙ্কেল আন্টিকে?”
-“আয়েরা, সময় হলে সবটা জানতে পারবে কিন্তু প্লিজ এখন ওনাদের হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো ওদের এখনো দম আছে। আমি ততক্ষণে লাজকে নিয়ে আসছি,আর হ্যা কাউকে কিছু বলবে না।”
—–বর্তমানে—–
লাজ সবটা শোনার পর ফারাজের দিকে তাকালো, সে কি বলবে খুঁজে পাচ্ছিল না। ফারাজ বলে,”ওহ আরেকটা কথা, তুমি হয়তো এটা জানতে চাচ্ছো আমি কি করে জানলাম ওরা আমার বাপের লোক ছিলো? তাহলে শোনো, তোমাকে আমি বলেছিলাম না আংটি টা আমার কেমন চিনা চিনা লাগছে,আজকে সকালেই আমার মনে হলো আমি আংটি টা কোথায় দেখেছিলাম। তোমাকে যেদিন প্রথম গুন্ডাদের হাত থেকে বাঁচায় ঐদিন এই আংটিটা দেখেছিলাম আমার বাপের খাস লোক রানা’র হাতে। আজ সকালেই গিয়েছিলাম তার বাসায় কিন্তু খুঁজে পায়নি। অনেক খুঁজাখুজির পর পেলাম তাকে তার গ্রামের বাড়িতে। প্রথমে সোজা ভাবে কিছু বলতে চাচ্ছিল না কিন্তু যখন দু চার ঘা পরলো তখন পটপট করে সব বলে দিলো।”
-“তো এখন বিশ্বাস হলো তো?তোমার বাবা ঠিক কতটা ভালো মানুষ?ওনি কি করতে পারেন আর কি করতে পারেন না?”
লাজের কথার কোনো উত্তর ফারাজের কাছে নেই। সে নির্বাক, সে এতদিন যে বাবাকে নিয়ে গর্ব করে এসেছিল সেই বাবার মুখোশ আজকে খুলে গেছে। সে লজ্জায় লাজের দিকে তাকাতে পারছে না, যেই বাবা-র জন্য সে এত এত কাজ করেছে সেই বাবা এতটা খারাপ সে কল্পনাও করতে পারেনি। লাজ তার সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,” তারমানে সত্যি তুমি এসব কিছু জানতে না।”
-“আমি তোমাকে আর কতবার বলবো আমি এসব সম্পর্কে কিছু জানতাম না,তাও তুমি আমার কোনো কথা বিশ্বাস করছো না বার বার একই কথা বলে যাচ্ছো?”
-“তুমিও তো আমার কথা বিশ্বাস করছিলে না,আজ বিশ্বাস হলো তো তোমার বাবা কতটা ভালো? সেদিন কারখানার কথাটাও সত্য ছিলো, ওনি আমাকে সহ আরো কতগুলো মেয়েকে পাচার করতে চেয়েছিলেন। আর এই মহিলা তোমার মা হয়?”
-“হুম!”
-“তোমার বাবাই ঐ মহিলাকে তোমাদের কারখানায় বন্ধি করে রেখেছিল, চেয়ারের সাথে বেঁধে রেখেছিল।”
-“মিথ্যা কথা,ওনি নিজের ইচ্ছেই আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল!”
-“কে বলেছে?তোমার বাবা!এখনো তুমি তোমার বাবার কথায় বিশ্বাস করছো? ঐদিন তোমাদের কারখানায় একটা মেয়ে এসেছিল এত্ত বড় ঘোমটা দিয়ে?একটা কাজের জন্য পায়ে ধরে কান্নাকাটি করছিল?”
ফারাজ একটু চিন্তা করতেই মনে পরলো ঐদিনের মেয়ের কথা। সে তারাহুরো করে বলল…..
-“হ্যা,এসেছিল।তুমি কি করে জানলে?”
-“আমি জানলম কারণ আমিই ছিলাম ঐ মেয়ে!”
ফারাজ অবাক চোখে লাজের দিকে তাকালে লাজ বলে…..
-“হুম,তুমি তো আমার কথায় বিশ্বাস করছিলে না তাই প্রমান যোগাড় করতে এই ছদ্মবেশ নিয়েছিলাম। কারখানা পুরো টা দেখছিলাম কোথাও কিছু পায় কিনা, তখনই এই তালা লাগানো রুমটা চোখে পরলো,যে রুমটা থেকে কয়েকদিন আগে আমি কান্নার আওয়াজ আসতে শুনেছিলাম।”
লাজ ধীরে ধীরে ফারাজ সবকিছু খুলে বলল, রুমে কিভাবে ঢুকলো? কি কি দেখলো? কিভাবে ঐ রুম থেকে বের হলো? একের পর এক সবকিছু বলল। সবটা শুনার পর ফারাজ জিজ্ঞেস করলো….
-“এই কয়েকদিন মা তোমার কাছে ছিলো?তোমাদের বাসায়?”
-“হুম, তোমার বাবা-র ভয়ে আমি ওনাকে একা ছাড়তে পারিনি। কখন কি করে বসে ওনার সাথে তাই ছাড়িনি।”
-“তুমি আমাকে আরে কেন বলো নি এসব?”
-“বললেই কি আমাকে বিশ্বাস করতে তুমি? আর তাছাড়া আমিও তোমাকে বিশ্বাস করতে পারিনি, ভেবেছিলাম তুমিও হয়তো তোমার বাবার সাথে জড়িত আছো।”
-“লাজ!তুমি কি করে ভাবলে আমি আমার মা’কে এভাবে বেঁধে রাখবো?”
-“আমি কি করে জানতাম ওনি তোমার মা?”
-“কেন ঐদিন ডায়েরিতে ছবি দেখোনি?”
-“ডায়েরীতে আমি ছবি দেখেনি মাত্র লেখাগুলো দেখেছিলাম।আর তাছাড়া…..”
আর কিছু বলার আগেই অপারেশন থিয়েটার থেকে নার্স বেড়িয়ে আসলো। ফারাজ আর লাজ দৌড়ে ওনার কাছে গেল।ফারাজ অস্বস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো,”মা কেমন আছে?”
নার্স বলল,”অবস্থা খুবই জটিল, খুব তারাতাড়ি ২ ব্যাগ o- রক্ত লাগবে,আপনারা তারাতাড়ি রক্ত বের করেন।নয়তো আমাদের কিছু করার থাকবে না।”
ফারাজ বলল,”এত তারাতাড়ি o- রক্ত আমি কোথায় পাবো?”
লাজ বলল,”চিন্তা করো না,আমার রক্তের গ্রুপ o-, নার্স আমি রক্ত দিবো আমাকে নিয়ে চলেন।”
-“চলুন আমার সাথে।”
লাজ ফারাজের হাতটা একবার ধরে ইশারা করলো কোনো চিন্তা না করতে। লাজ নার্সের পিছু পিছু চলে গেল।ফারাজ লাজকে যতক্ষণ দেখা গিয়েছে ততক্ষণ দেখলো।চোখের অগোচর হয়ে গেলে থপ করে বসে পরে।মাথায় হাজারো চিন্তা যেমন হচ্ছে তেমনি হাজারটা প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে। তার বাবা এমন কেন করলো? কেন তার মা কে এভাবে আটকে রেখেছিল? এসব কিছু কেন লুকিয়ে গেল? কালো ব্যবসা কবে থেকে শুরু করেছে এসব হাজারো প্রশ্নের মাঝেও মায়ের টেনশন যেন যাচ্ছেই না। যাবে কি করে? এতদিন মাকে দেখতে পেলতাও এমন একটা অবস্থায়!

চলবে

খেলাঘর
লেখকঃ শাওন
পর্বঃ ১৩

লাজ রক্ত দিয়ে আসলো, মাথাটা একটু একটু করে ঝিমাচ্ছে। ফারাজ হাতটা ধরে বসিয়ে দিলো, তারপর জিজ্ঞেস করলো,”তুমি কিছু খাবে?আমি এনে দিবো?”
-“নাহ,আমি কিছু খাবো না।আমি ঠিক আছি।ফারাজ, আমি গুলিটা ইচ্ছে করে করিনি।আমি তোমাকে গুলি করতে চেয়েছিলাম কিন্তু বোঝতে পারিনি ওনি কোথা থেকে চলে আসলেন।”
লাজ বলেই কান্না করে দিলো, ফারাজ লাজকে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,”ইটস ওকে,আমি বোঝতে পারছি তুমি এসব ইচ্ছে করে করোনি, তুমি আমাকে ভুল বোঝেই এসব করেছো।এখন দোয়া করো মা’র যেন কিছু না হয়।”
ঘন্টা খানেক হয়ে গেল কিন্তু এখনো কোনো খোঁজ খবর পাওয়া গেলনা।অপারেশন থিয়েটারের ভিতরে কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই বোঝতে পারছে না তারা।লাজ আর ফারাজ একজন আরেকজনকে শক্ত দেখালেও দুজনের মনেই অজানা এক ভয় কাজ করছে।ওটির লাইট অফ হলো, ডাক্তার বেড়িয়ে আসলেন।ফারাজ দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন….
-“ডাক্তার, আমার মা ঠিক আছে তো?ওনার কিছু হয়নি তো?”
ডাক্তার সাহেব নিজের মাস্ক খুলছেন।লাজ জিজ্ঞেস করলো,”কি হলো চুপ হয়ে আছেন কেন? উত্তর দিচ্ছেন না কেন?বলুন কিছু!”
ডাক্তার সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালো,” রিল্যাক্স!চিন্তার কোনো কারণ নেই।অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে।”
লাজ চোখ বন্ধ করে বলল,”আল্লাহ’র কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া!”
ফারাজ জিজ্ঞেস করলো,” আমরা কি ওনার সাথে দেখা করতে পারি?”
-“এখন না,কিছুক্ষণ পর ওনাকে কেবিনে দেওয়া হবে তখন দেখা করতে পারবেন কিন্তু হ্যা বেশী শব্দ করবেন না।”
ডাক্তার এতটুকু বলে চলে গেলেন। লাজ ফারাজের কাঁধে হাত রাখলে ফারাজ ওর দিকে তাকায়।

কেবিনে নিয়ে গেলো ফারাজ আর লাজ দুজনেই ভিতরে আসে। ফারাজের মা’র মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো, এখনো জ্ঞান ফিরেনি।ফারাজ তার মায়ের পাশে গিয়ে বসে তার মায়ের হাত ধরে বলে…..
-“আই এম সরি মা, আমি তোমাকে অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাতে পারিনি।আমি পারিনি বাবা-র হাত থেকে তোমাকে রক্ষা করতে।প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও তুমি প্লিজ!”
ফারাজ তার পায়ের হাতে চুমু খেয়ে কান্না করতে করতে কথাগুলো বলল। লাজ ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,”এখন এসব বলার সময় নয় ফারাজ, আগে তোমার মা ঠিক হোক তারপর সবকিছু জেনে আমি কিছু একটা করবো।”
-“শুধু তুমি একাই নও, আমিও আছি তোমার সাথে। আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম তোমার বাবা মার খুনীকে আমি খুঁজে বের করে শাস্তি দেবো, আমাকে আমার কথা রাখতে দাও লাজ! এতদিন আমার বাবা আমাকে ব্যবহার করছে, ওরা শুধু আমার ভালো দিক দেখেছে এখন আমার খারাপ দিকটা দেখবে। তোমার সাথে হওয়া প্রতিটা অন্যায়,আমার মার সাথে হওয়া অন্যায়, তোমার বাবা মার খুন করার অপরাধ, সবকিছুর শাস্তি ওনাকে পেতেই হবে। তোমার সাথে এখন থেকে আমিও আছি, ওনার দিন শেষ এবার।”
ফারাজের কথাগুলো শুনে লাজ অবাক হয়ে তাকালে ফারাজ ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে….
-“আমি জানি তুমি আমাকে এখনো বিশ্বাস করতে পারছো না। কিন্তু আমি সত্যি বলছি আমি এসব জানতাম না,যদি জানতাম তাহলে তোমার সাথে কখনোই এই মিথ্যা ভালেবাসার নাটক করতাম না, তোমার মনের ফিলিংস নিয়ে কখনো খেলতাম না। আমি তো তোমাকে সত্যি….”
ফারাজ বাকি কথাগুলো বলতে গিয়েও বলল না। লাজ তার সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো,”কি?থেমে গেলে কেন?বলো!তুমি তো আমাকে সত্যি কি?”
-“কিছু না!”
ফারাজ রুম থেকে বেড়িয়ে গেল। সে সোজা তাকদিয়ার ম্যানসনের ড্রয়িং রুমে এসে ফারিদ তাকদিয়ারের নাম ধরে চিৎকার করে ডাকছে। ফারিদ তাকদিয়ার বের হয়ে এসে জিজ্ঞেস করে…
-“কি হয়েছে?এভাবে নাম ধরে ডাকছিস কেন?”
-“তুমি যা করেছো তার পর তোমাকে আমার বাবা ডাকতেও ঘৃণা করছে।”
-“কি করেছি আমি?”
-“একদম নাটক করবে না তুমি আমার সাথে, আমি তোমার ব্যাপারে সব জেনে গেছি। তুমি এত এত নিচে কি করে নামতে পারো? তুমি নিজের সত্য চাপা দেওয়ার জন্য লাজের বাবা মাকে মেরে ফেললে? কি এমন সত্য জেনে গিয়েছিল ওরা যার ফলে তোমার ওদের মারতে হলো? আর তুমি আমাকে কেন উল্টা পাল্টা বুঝিয়েছিলে লাজের বিষয়ে? ঐদিন কলেজে যা হয়েছিল সব সত্যিই ছিলো তাহলে কেন তুমি আমাকে মিথ্যা কাহিনী বলেছিলে?”
ফারিদ তাকদিয়ার ফারাজের কথা শুনে একদম ভয়ে চুপসে গেছে।ওনি মনে মনে ভাবছেন,”ফারাজ এসব জানলো কি করে?তাহলে কি মাহেরা ওকে সবটা বলে দিয়েছে? না না, সেটা কি করে সম্ভব?মাহেরা কি করে এতদিন পর ফারাজ কে চিনবে? আর চিনলেও লাজের কথাগুলো কি করে জানবে? তারমানে কি লাজ ওকে সবকিছু বলেছে আর লাজই মাহেরা কে নিয়ে পালিয়েছে?”
ফারাজ বলল,”তুমি মনে মনে যা ভাবছো আমি জানি। আর যা ভাবছে সব ঠিকই ভাবছো? মার সাথে আমার দেখা হয়েছে আর লাজই মাকে তোমার হাত থেকে উদ্ধার করেছে।”
-“দেখ বাবা, তোকে ও ভুল বোঝাচ্ছে। আমাদের মাঝের সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইছে ও!”
-“চুপ বাবা, আর একট কথা বলবেও না।আমার তোমার সাথে কোনো কথা বলতেই ইচ্ছে করছে না কিন্তু হ্যা একটা কথা শুনে রাখো তুমি যা করেছো তার প্রতিটা অন্যায় কাজের শাস্তি পাবে। আর সেটা আমি দিবো,তোমাকে আমি আগেই বলেছিলাম, আমি তোমার পাশে ততক্ষণ আছি যতক্ষণ তুমি ভালো কাজে আছো কিন্তু এখন আর আমি তোমার সাথে নেই।তাই নিজের পথ নিজে দেখো,যায় হয়ে যাক না কেন আমি তোমাকে তোমার প্রতিটা অন্যায় কাজের শাস্তি দিতেই থাকবো।”
ফারাজ কথাগুলো বলে বাড়ি থেকে বের হবার সাথে সাথেই ফারিদ তাকদিয়ার রাগে হুংকার দিয়ে সোফার টেবিলে লাথি মারে। কাচগুলো টুকরো টুকরো হয়ে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,”লাজ!লাজ!লাজ! এই লাজের জন্য আমি প্রতিনিয়ত ফেইল হয়ে যাচ্ছি। এই লাজ আজকে আমার থেকে আমার ছেলেকে কেড়ে নিলো,এর মূল্য তো ওকে চুকাতেই হবে।পথের কাটা আমি খুব তারাতাড়ি সরিয়ে দিবো শুধুমাত্র সঠিক সময়ের অপেক্ষা।”
কথাটা শেষ করে নিজের চাদরটা শরীরে জড়িয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেন।

ফারাজ লাজের হাতের উপর শুয়ে আছে, আর লাজ ফারাজের গালের উপর নিজের গাল দিয়ে। হঠাৎ করে বাহিরের হৈচৈ এ লাজের ঘুম ভেঙে যায়। সে নিজেকে ফারাজের সাথে এভাবে দেখে চমকে যায়। কাল সারাত তাহলে তারা এভাবেই ছিলো, ভাবতে লাগলো লাজ। তারপর যখন কিছু মনে আসলো না তখন আর ততটা জোর খাটালো না। লাজ নিজের হাত টান দিতেই ফারাজ আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। লাজের চোখ আটকে যায় ফারাজের ঘুমন্ত মুখটাই,একটা মানুষকে ঘুমের মাঝেই নাকি সবচেয়ে বেশী সুন্দর লাগে। লাজ আজকে তা নিজের চোখে দেখছে।ইচ্ছে করেও চোখ সরাতে পারছে না হাত তো দূরের কথা। লাজ ফারাজের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। আর একা একা মুচকি হাসতে লাগলো।
ঘুমের মাঝে কারো স্পর্শ অনুভব করছিল ফারাজ, চোখ খুলে দেখে লাজ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। দুজন দুজনের দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে আছে। তখনই একটা নার্স আসলো আর দুজন দুদিকে সরে বসলো।নার্স এসে বলল…..
-“আপনারা চায়লে আজকেই ওনাকে বাসায় নিয়ে যেতে পারেন।তেমন কোনো সমস্যা নেই এখন!”
ফারাজ অবাক হয়ে বলল,” কি বলছেন কি আপনি? এখনো মা’র জ্ঞান ফিরেনি আর আপনি বলছেন কোনো সমস্যা নেই!”
লাজ একটু মুচকি হাসি দিয়ে বলে,” ওনার জ্ঞান ফিরেছে, কালরাতেই ওনি চোখ খুলে তাকিয়ে ছিলেন।ওনি এখন ঘুমাচ্ছেন।”
নার্স বলল,”ডাক্তার স্যার সবকিছু দেখেই যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। তারপরও যদি কোনো প্রবলেম হয় নিয়ে আসবেন।”
নার্স চলে গেলে।ফারাজ চোখ রাঙ্গিয়ে লাজের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। লাজ চোখে ইশারা করে জানতে চায় কি হয়েছে।ফারাজ বলে…..
-“মা’র জ্ঞান ফিরেছিল তুমি আমাকে ডাকোনি কেন?”
-“তুমি ঘুমাচ্ছিল, আর অনেক ক্লান্ত ছিলো বলে ডাকিনি। তোমার মাও ডাকতে নিষেধ করেছিল!”
-“আমার কাছে আমার মা সবথেকে বেশী দামী, আর তুমি আমার ঘুমের জন্য ডাকোনি?”
-“ব্যাপার টা তেমন না,তুমি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়েছিলে, আমি ডাকতে চায়লেও মা দেয়নি। তাছাড়া ওনি তেমন কিছু বলেনি পাঁচ মিনিটের মতো সজাগ ছিলো তারপর আবার ওনাকে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয়!কিছুক্ষণ পরেই ঘুম থেকে উঠে যাবে তখন না হয় কথা বলো!”
-“হুম!”
-“আচ্ছা,এখন যাও একটু মুখে পানি দিয়ে আসো, কেমন দেখা যাচ্ছে। মানুষের সামনে তোমাকে স্বামীর পরিচয় কিভাবে দিবো বলো তো, সেই কলেজের হট ড্যাশিং হ্যান্ডসাম হিরো এখন হিরো আলম হয়ে গেছে।”
-“বাহ,মনে হচ্ছে স্বামীর প্রতি ভালোবাসা উতলিয়ে পরছে,হুহ ডং!”
-“উতলিয়ে তো পরবেই যতই হোক স্বামী তো!”
-“ওহ আচ্ছা, তাহলে স্বামীকে তার অধিকার টুকু দিয়ে দাও!”
-“কোন অধিকার?”
লাজ বোঝতে পারছিল না কিসের অধিকার তাই জিজ্ঞেস করে, ফারাজ শয়তানি হাসি দিতে দিতে লাজের দিকে এগোতে লাগলো। লাজ এক পা এক পা করে পিছুতে লাগলো।দেয়ালের সাথে পিঠ আটকে গেল লাজের। সে সাইড দিয়ে চলে যাবে তার আগেই ফারাজ ঐদিকে হাত দিয়ে দেয়। লাজ শাড়ি পরা ছিল, পেটের একপাশ দেখা যাচ্ছিল। ফারাজ সে জায়গায় এক আঙ্গুলে খোঁচা দিতেই লাজ চোখ বন্ধ করে ফেলে। শাড়িতে খামচি দিয়ে ধরে।ফারাজ লাজের কানের কাছে গিয়ে বলে…
-“বউকে ইচ্ছে মতো করে পেটানোর!”
ফারাজের এমন কথা শুনে লাজ চমকে চোখ খুলে তাকায়। ফারাজ লাজের এমন রিয়েক্ট দেখে হো হো করে হেঁসে দেয়। লাজ বোঝতে পারছে না,সে হাসবে নাকি কাঁদবে। সে কি ভেবেছিল আর কি হলো? লজ্জায় একটু লাল হয়ে গেল সে, ফারাজ হাসতে হাসতে ওয়াশরুমের দিকে গেল।

চলবে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here