খেলাঘর,পর্বঃ১৪,১৫
লেখকঃ শাওন
পর্বঃ১৪
মহিলাটিকে লাজের বাসায় আনা হলো।ফারাজ ওনার পাশে বসে হাতে হাত ধরে বসে আছে।লাজ একটা ট্রে তে করে গরম সুপ বানিয়ে আনলো। লাজ বলল,”বলি,যদি আপনাদের মা ছেলের ভালোবাসা শেষ হয়ে থাকে তাহলে এই গরম গরম সুপটা খেয়ে নিন তো দেখি!”
-“নাহ নাহ,আমি এখন কিছু খাবো না।কিছু খেতে ইচ্ছে করছেনা।”
-“সে কি, তোমার বউমা এত কস্ট করে সুপ বানিয়ে আনলো আর তুমি খাবে না বলছো!”
ফারাজ কথাটা বলেই লাজকে একটা চোখ টিপ মারে,লাজ বোঝতে পারে ফারাজ ওকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কথা বলছে। লাজ এখন কিছু না বলে চমচে করে সুপটা খাইয়ে দিচ্ছিল।তখন মহিলাটি বলল….
-“বউমা আমার বড্ড লক্ষী! এমন সোনার টুকরা বউমা আর কতজন পায়?”
-“হুম,আর এমন অদ্ভুত বিয়ে আর কতজনের হয়?”
লাজ ফারাজের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল, ফারাজ চোখ নিচু করে ফেলল।ফারাজের মা বলল,”যা হবার হয়ে গেছে,তোরা আবার নতুন করে জীবন শুরু কর। সব রাগ অভিমান ভুল বোঝাবুঝি শেষ করে আর পাঁচ স্বামী স্ত্রী’র মতো জীবন যাপন কর!”
-“চায়লেই কি সব সম্ভব হয়ে যায়?যদি তাই হতো তাহলে একটাবার আমাকে বলেন ফারাজ কেন সবটা না জেনে আমার সাথে এমন করলো? এর কোনো উত্তর কি আছে আপনার কাছে?”
ফারাজ লাজের দিকে তাকিয়ে বোঝতে পারলো লাজ ঠিক কতটা কষ্ট নিয়ে কথাটা বলছে।লাজের চোখে পানি ছলছল করছে।কিন্তু সে কিছু বলতে পারছে না।ফারাজের মা বলল….
-“এগুলোর কোনো আমার উত্তর আমার কাছে না থাকলেও আমি একজন মা হয়ে তোমাকে এটা বলবো সবকিছু ভুলে যাও, যা হয়েছে এগুলো ফারাজ তার বাবা-র কথাতে করেছে।”
-“ভবিষ্যতে করবে না,তার কোনো গ্যারিন্টি আপনি দিতে পারবেন?”
-“এখন আমি যা বলতে যাবো তাতে আমি গ্যারিন্টি দিতে পারি ফারাজ তার বাবার সঙ্গ আর কখনো দিবে না। তুমি জানতে চেয়েছিলে না কি আমার পরিচয়? আমাকে কেন ওনি বন্ধি করে রেখেছিল?কি শত্রুতা? তাহলে শুনো তুমি,আর তুইও শোন ফারাজ!”
ফারাজের মা একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলো…..
-“আমি মাহেরা তাকদিয়ার, মাহিম তাকদিয়ারের একমাত্র কন্যা সন্তান। যার নামে ছিলো পুরো তাকদিয়ার প্রোপার্টি। তা ছিলো আমাদের সবার অজনা।ফারাজের বাবা আমাকে ভালোবাসার নাটক করে বিয়ে করেছিল শুধু মাত্র এই প্রোপার্টি পাওয়ার আশায়। খুব ভালোই যাচ্ছিল আমাদের সংসার। হঠাৎ করে ফারাজের নানা মারা যাবার পর যখন ফারাজের বাবা নিজের নামে প্রোপার্টি করে নিতে চায় তখন জানতে পারে আমার নামে আগে থেকেই সবকিছু লিখে দিয়ে গেছে বাবা। তখন থেকেই ওনি চেয়েছিল আমার থেকে সবকিছু ছিনিয়ে নিতে কিন্তু সেটা আমি বোঝতে পারিনি। বোঝতে পেরেছিলাম সেদিন যেদিন ওনি ফারাজকে পৃথিবীতে আনতে নিষেধ করছিল। যেখানে সব বাবা খুশি হয় সেখানে তিনি আমার প্রতি রেগে গিয়েছিলেন। বার বার নষ্ট করে ফেলার কথা বলছিল এ নিয়ে প্রচুর ঝগড়া হয় আমাদের মাঝে একসময় ওনি মুখ ফসকে বলেই ফেলেন আমাকে বিয়ে করার কারণ। ওনার মুখ থেকে ঐকথা গুলো শুনে আমি খুব কেঁদে ছিলাম। নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম হঠাৎ করে ফারাজের কথা মনে এসেই শেষ করিনি। যে বাচ্চা টা এখনো পৃথিবীর আলো দেখেনি তাকে কিভাবে আমি মেরে ফেলি? ফারাজের চিন্তা করেই আমি কিছু করিনি, বেশকিছু দিন ওনার সাথে আমার কোনে কথা হয়নি৷ একদিন হঠাৎ করে ফোন আসে ওনি নাকি এক্সিডেন্ট করেছেন, যতই হোক ভালোবাসতাম তাকে ছুটে গিয়েছিলাম তার কাছে। অনেক কান্না কাটি করেছিল সেদিন আমার হাতে ধরে। ২য় বার বিশ্বাস করেছি তাকে আর সেটাই আমার ভুল হয়। কোন এক কাজের কথা বলে আমার থেকে প্রোপার্টির ২০% লিখে নেয়।কিন্তু আমি আজও জানি না ঐটা কিসের কাজের জন্য ছিলো? সত্যি কি কোনো কাজের ছিলো নাকি মিথ্যা কোনো চাল। ফারাজ হওয়ার বছর দুয়েক পর একদিন আমি ওনার রুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম,ওনি কারো সাথে ফোনে কথা বলছিলেন…..
-“আরে,তুমি এত রাগ করছো কেন? আর কয়েকটা দিন তো মাত্র তারপরেই এই সমস্ত সম্পত্তি আমার হয়ে যাবে। আর তুমি আমার! কোনো টেনশন করো না ফারাজকে সম্পত্তি লিখে দেওয়ার আগেই আমি সব নিয়ে নিবো আর তাছাড়া ফারাজ এখনো ছোট ওকে কিভাবে লিখে দিবে?”
এতটুকু শুনেই আমি বোঝতে পেরেছিলাম আমি আবারো ধোঁকার শিকার হয়েছি।সেদিনই আমি ফারাজকে নিয়ে চুপি চুপি ঐ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরেছিলাম। আমার বিশ্বস্ত উকিলের কাছে গিয়েছিলাম আর ওনাকে সবটা খুলে বলি।ওনি সবটা শুনে বলেন…..
-“এখন তাহলে আপনি কি করবেন?”
-“সেটাই করবো যেটা করলে ওর মনের আশা কখনোই পূরন হবে না। আমার কাছে এখনো প্রোপার্টি আছে ৮০%, এখান থেকে আমি ৬০%ফারাজের নামে লিখে দিবো আর বাকি ২০% আমার নামেই থাকবে।”
-“কিন্তু ফারাজের এত অল্প বয়সে কি করে?”
-“১৮ বছর না হওয়া পর্যন্ত ওর সম্পত্তি কেউ নিতে পারবে না আর দিতেও পারবে না। এই ১৮ বছরে হয়তো সে তার বাবা-র আসল রুপ বোঝতে পারবে। আর যদি এই ১৮ বছরের আগেই ফারাজের কিছু হয়ে যায় তাহলে ওর ভাগের সমস্ত সম্পত্তি সরকারের কাছে চলে যাবে। আর আমার ভাগের টাও তেমনি হবে।আরেকটা কথা সম্পত্তি নেবার বা দেবার সময় কোনো টিপ সই চলবে এটাও উল্লেখ করে দিবেন।
-“আচ্ছা, আপনি এখানে সাইন করে যান। আমি আজকে বিকালের মাঝেই পেপার আপনার কাছে পাঠিয়ে দিবো।”
-“আপনার পাঠাতে হবে না, আমিই সময় মতো আসবো।”
উকিলের কাছ থেকে বের হতেই কতগুলো লোক আমাকে ধরে ফেলল। চোখে মুখে কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেলল। ফারাজকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল। যখন চোখ খুলে তাকালাম তখন নিজেকে একটা বন্ধ রুমে হাত পা বাঁধা অবস্থায় আবিষ্কার করলাম। সামনে এসে দাঁড়ালো ফারাজের বাবা মুখে সেই ভয়ংকর হাসি। আমার চেয়ারে জোরে ধাবা দিয়ে বলে,”নিজেকে খুব চালাক মনে করো তুমি? কি ভেবেছিলে আমি কিছু জানতে পারবে না আর তুমি তলে তলে গোল দিয়ে যাবে? আরে তোমার সাথে সবসময় আমার চারটা চোখ লাগিয়ে রাখতাম, তুমি খুব চালাক তা আমার জানাই ছিলো। কিন্তু তুমি আজকের কাজটা মোটেও ঠিক করোনি।”
-“আর তোমার কাজটা? তুমি এত নিচ আমার জানা ছিলো না,শুধু মাত্র সম্পত্তির জন্য তুমি আমাকে বিয়ে করেছিলে ভালোবাসার নাটক করেছিলে?”
-“এসব বাংলা আলাপ বাদ দিয়ে বলো,উকিলের কাছে কি বলে এসেছো?”
-“তোমার মনের আশা বান্চার করে এসেছি।”
-“তুই ভালোই ভালোই বলবি নাকি আমি অন্যকিছু ট্রাই করবো।”
চুলের মুঠি ধরে কথাটা বলল।
-“যা করার করো কিন্তু ফারাজের কিছু করলে কিন্তু তোমার সব আশা শেষ হয়ে যাবে।”
-“মানে?”
-“মানে টা না হয় নিজেও জেনে নিও!”
-“মানে তো আমি বের করবোই,তার পর তোর কি হাল করবো তা শুধু দেখবি!”
ওনি বের হয়ে গেলেন,তারপর হয়তো কোনো ভাবে আমার বলা আসা কথাগুলো জেনে গেলেন। আমাকে এভাবেই বেঁধে রেখেছিলেন আর ফারাজ পরম যত্নে নিজের কাছে আগলে রেখেছিলেন। ঐটা ওর ভালোবাসা না বরং সম্পত্তি পাওয়ার লোভ।”
ফারাজের মা কথাগুলো শেষ করেই নিজের চোখের পানিটা মুছে নিলেন।ফারাজ তার মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। লাজ ফারাজের মার কাঁধে হাত রেখে বলে,”ভালোবাসা! এই জিনিসটাই মানুষকে সহজে বোকা বানাতে পারে!”
লাজের কথাটুকু ফারাজের বুকে গিয়ে লাগলো। লাজ নিজের ছলছল চোখের পানি গড়িয়ে পরার আগেই মুছে নিলো। তারপর বলল,” এসব কান্না কাটি করার দিন শেষ। এখন বদলা নেবার সময় হয়ে গেছে। আমার বাবা মা’র হত্যার বদলা! ফারাজকে তার মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত করার বদলা! মায়ের সাথে হওয়া অবিচারের বদলা! কতগুলো মেয়ের জীবন নিয়ে খেলার বদলা আরো না জানা কতগুলো কুকর্মের বিচার!”
লাজ কথাগুলো বলে সামনে হাত ধরলে ফারাজের মা তার হাতের উপর হাত রাখে। লাজ আর ফারাজের মা দুজনই ফারাজের দিকে তাকালে সেও নিজের হাত ওদের সাথে এক করে। ফারাজ বলে,” যে বাবাকে এত সম্মান করতাম তাকেই শেষ করার জন্য হাত মিলাচ্ছি!”
মাহেরা তাকদিয়ার বলে,” অন্যায় এর শাস্তি পেতেই হয়। আর যদি নাম দেওয়া হয় তাহলে সেও সেই অন্যায়ের ভাগিদার হয়ে যায়।কথায় আছে অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে দুজনেই সমান পাপী!”
ফারাজ আর কোনো কথা বলল না। সবার মাঝে কিছুক্ষণ নিরবতা থাকার পর লাজ বলল……
-“মিশন নাম্বার ওয়ান হলো আমাদের আগে তাকদিয়ার ম্যানসনে উঠতে হবে। তারপর যা করার ঐখানে থেকেই করতে হবে।”
ফারাজ বলল,”তোমার কি মনে হয় তুমি ঐখান থেকে কিছু করতে পারবে? ঐখানে প্রতিটা লোক তোমার বিরুদ্ধে!”
-“তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো,ঐ বাড়িতে থেকেই আমি তোমার মাকে উদ্ধার করেছিলাম আর তার সাথে অনেককিছু জানতেও পেরেছিলাম।তুমি তো জানোই আমি তোমাদের বাড়িতে ঢুকার আগে একটা সাধারাণ ডিটি করে এসেছিলাম সেটার ভয়ে তোমার বাবা আমাকে কিছু করার সাহস করতে পারবে না। তাছাড়া এখন তুমিও আমাদের পাশে আছো আশা রাখছি কিছু করতে পারবে না।”
লাজের কথাতে ফারাজ বোঝতে পারলো লাজ ওকে বিশ্বাস করেই কথাটা বলেছে ফারাজ একটা মুচকি হাসি দিলো।
চলবে
খেলাঘর
লেখকঃ শাওন
পর্বঃ১৫
ফারাজ তার মা আর লাজকে নিয়ে তাকদিয়ার ম্যানসনের ঢুকার আগেই চিৎকার করে উঠলেন ফারিদ তাকদিয়ার।
-“দাঁড়াও!কোথায় ঢুকছো তোমরা?কার পারমিশন নিয়ে ঢুকছো?”
ফারাজ বলল,”আমাদের বাড়িতে আমরা ঢুকবো তাতে কারো পারমিশনের প্রয়োজন কেন হবে?”
-“কিহ বললে তুমি? তোমাদের বাড়ি, হা হা হা। তোমার বাড়ি ছিলো কিন্তু আজ থেকে প্রায় এক মাস আগে এই বাড়িটা আমার হয়ে গেছে।”
ফারিদ তাকদিয়ার কথা শুনে চমকে উঠে সবাই। লাজ ফারাজের দিকে তাকালে ফারাজ তার বাবার দিকে তাকায়। ফারিদ তাকদিয়ার বলে….
-“কি?অবাক হচ্ছিস? কি করে আমার হলো? তাহলে শোন কিছুদিন আগে আমি তোর থেকে নতুন কারখানার কাগজ করার জন্য সাইন নিচ্ছিলাম না তখনই তোর প্রোপার্টির সাইনও করিয়ে ফেলি। ভেবেছিলাম তোকে বাড়ি থেকে বের করে দিবো কিন্তু তুই আমার হয়ে ভালোই কাজ করছিলি। মাঝপথে চলে আসলো এই লাজ।”
ফারিদ তাকদিয়ার লাজের দিকে চোখ রাঙ্গিয়ে কথাটা বলল। ফারাজ তার বাবা’র কলার চেপে বলল,” আমি তোমাকে ছাড়বো না, আমি তোমাকে শেষ করে দিবো।”
ফারিদ তাকদিয়ার এক ধাক্কা দিয়ে সোফায় ফেলে দিয়ে বলে….
-“আগে নিজের মাথার ছাদ খোঁজ তারপর না হয় আমাকে ধরবি!”
-“ফারিদ তাকদিয়ার তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো আমি এখনো বেঁচে আছি, আর আমার ২০% ও এখনো বাকি আছে।তাই এই বাড়িতে আমারও ভাগ আছে।”
মেহারা তাকদিয়ার ফারিদ তাকদিয়ারের সামনে গিয়ে কথাটা বলে।লাজ ওনার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে….
-“এই ২০% নিয়েই এই বাড়িতে থাকবো, আর আপনার প্রতিটা কুকর্মের পর্দা ফাঁস করবো। কাল যখন মা সবার সামনে এসে নিজের মুখ খুলবে তখন নিজের মুখ কোথায় লুকাবেন আপনি? কি জবাব দিবেন আপনি সবাইকে?”
লাজের কথা গুলো শোনে ভয় পাওয়ার বদলে উল্টো হেঁসে উড়িয়ে দেয় ফারিদ তাকদিয়ার তারপর বলে,” তোমার কি মনে হয় লোক ওর কথা বিশ্বাস করে নিবে, তাও আবার কোনো প্রমান ছাড়া।”
মাহেরা তাকদিয়ার বলে-“প্রমান আমি নিজেই!”
-“তোমার কথা সবাই জানে তুমি আমাকে ছেড়ে অন্য কারো সাথে চলে গিয়েছিলে? আজ এতদিন পর কেন আসলে কি করতে আসলে এগুলোর উত্তর কি দিবে? আর তাছাড়া সামনে নির্বাচন এখন আমার বিরুদ্ধে এসব উল্টো পাল্টা নিউজ স্বাভাবিক বলেই পাবলিক মেনে নিবে।তোমরা কিছু করতে পারবে না।”
-“আর যদি বলি এবারের নির্বাচনের আগেই আপনার পর্দা আমি খুলে ফেলবো তখন আপনি কি করবেন?”
লাজের কথা শুনে ফারিদ তাকদিয়ার ওর দিকে তাকিয়ে বলে,”আগে খুলে তো দেখাও!”
-“তাহলে চ্যালেন্জ নিলাম এবারের নির্বাচনের আগেই আপনার পর্দা ফাঁস হবে আর আপনি এমপি হতে পারবেন না!”
-“হাহাহা, শকুনের দোয়াতে গরু মরে না। যেখানে আমার কোনো প্রতিদ্বন্ধী নেই সেখানে আমাকে এমপি হওয়া থেকে আটকায় কে?”
-“শকুনের দোয়াতে গরু মরে কিনা জানি না কিন্তু এবার আপনি এমপি হতে পারবেন না!”
-“সময়েই সবটা বলবে!”
ফারিদ তাকদিয়ার লাজকে কথাটা বলে উপরে চলে যায়। লাজ মাহেরা তাকদিয়ার কে একটা রুমে রেখে নিজেদের রুমে আসে। এসে দেখে ফারাজ সোফায় বসে আছে,মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে কিছু একটা ভাবছে।
লাজ জিজ্ঞেস করলো,”কি ভাবছো?”
লাজের প্রশ্নে ফারাজ ওর দিকে তাকালো আর বলল,” আমি তোমার সাথে খুব বড় অন্যায় করে ফেলিছি!আমি সবটা না জেনেই তোমার সাথে এমন করেছি প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও!”
-“আমি এসব ভুলে গিয়েছি তুমিও সবকিছু ভুলে যাও,এতে তোমারই ভালো হবে।”
-“তারমানে আমরা সংসার করবো?”
ফারাজের প্রশ্নটা খুবই চঞ্চলতার সাথে করেছিল।লাজ ওর দিকে মলিন ভাবে তাকিয়ে বলে,” ভুলে গিয়েছি বলেই এটা নও যে আমরা স্বাভাবিক হয়ে যাবো। একটা জিনিস কি জানো, ভালোবাসা এমন একটা জিনিস যা একবার কারো প্রতি থেকে উঠে গেলে শত চেষ্টা করলেও আর আগের মতো করে করা যায় না। আর যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে সংসার কি করে হবে?”
-“আর যদি ঐ মানুষটা তার ভুল বোঝতে পেরে একটা ভালো মানুষ হয়ে যায় তাহলে? যদি সে সবসময় পাশে থাকে তার কেয়ার করে ভালো মন্দের দায়িত্ব নেয় তাহলে?”
-“ঐটা তখন যদি হয় তাহলে অন্য ব্যাপার এভাবে তো বলা যায় না!”
লাজ উঠে চলে যেতে নিলেই ফারাজ প্রশ্ন করে…
-“তাহলে এখন আমরা কোন সম্পর্কে থাকবো?”
লাজ পিছন ফিরে বলে,”যে সম্পর্ক নিয়ে এসেছিলাম এই বাড়িতে, বদলা আর প্রতিশোধের সম্পর্ক। যদিও এখন তোমার থেকে কোনো কিছু নেবার নেই কিন্তু তোমার বাবার থেকে আছে। ওনার প্রতিটা কাজের বদলা আর শাস্তি দেওয়ার।”
-“সেখানে আমিও তোমার পাশে আছি,যদি মরতে হয় তাহলে মরবো করিম এখন তোমার পাশ থেকে সরবো না!”
-“যে কথাটা বললে না,ঐটা বলা যতটা সহজ হয়েছে করে দেখানো টা তারচেয়েও বেশী কঠিন হবে।”
-“ওয়েট!”
ফারাজ লাজ কে দাঁড় করিয়ে সোফারা সামনে থাকা ফলের ঝুড়ি থেকে ছুড়ি নিয়ে আসে। তারপর একটান দিয়ে হাতের তালু কেটে ফেলে।টপটপ করে রক্ত পরতে লাগলো,লাজ ফারাজের হাত ধরে দেখে অনেকটাই কেটে গেছে। সে বলল,”তুমি কি পাগল হয়ে গেছো?কি করলে এটা?কেন করলে?ইশ কতটা কেটে গেছে,কিভাবে রক্ত বের হচ্ছে তুমি দেখছো?এসব কোন ধরনের পাগলামি বলো তো!”
-“হতে পারে এটা পাগলামি কিন্তু বিশ্বাস করো আমি এখন সত্যি তোমার পাশে থাকতে চায় আর থাকবো।”
-“তাই বলে তুমি এভাবে হাত কেটে বিশ্বাস করাবে? পাগল তুমি?”
-“হুম পাগল আর সেটা তো…”
ফারাজের বাকি কথাটুকু না বলে আটকে গেল।লাজ ওকে জিজ্ঞেস করলো,”কি হলো?থেমে গেলে কেন? কি বলতে চায়ছিলে?”
-“কিছু না,তুমি বলো তোমার চোখে পানি কেন?কান্না করছো?”
-“কই পানি?আমি কেন কান্না করবো?চোখে কি একটা গেল তাই জ্বালা করে পানি বের হচ্ছে!”
-“তুমি মিথ্যা কেন বলছো? তুমি যতই বলো আমাকে ভালোবাসো না আমি জানি তুমি আজও আমাকেই ভালোবাসো।”
-“বেশী জানো বলেই আজকে এই অবস্থা,চুপচাপ এখানে বসো আমি ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি।”
লাজ চোখের পানি মুছে ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে আসলো।খুব যত্ন করে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে,ফারাজ ওর দিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে আছে। কি মায়া আছে এই মুখটাই ফারাজ নিজেও জানে না। ব্যান্ডেজ করা শেষ হলে ফারাজ বলে….
-“একটা সুযোগ কি দেওয়া যায় না আমাকে?”
-“আবার কিসের সুযোগের কথা বলছো তুমি?”
-“তোমাকে ভালোবাসার!”
-“ফারাজ, ভালোবাসাটা এত সহজ না বললেই হয়ে যায় না আর আমি যেই আঘাতটা পেয়েছি তারপর কেন জানি ইচ্ছে করছে না!”
-“প্লিজ লাজ, আমি তোমাকে সত্যি ভালোবাসতাম, সেই প্রথমদিন তোমাকে দেখেই আমার ভালো লেগে যায়, ভার্সিটির প্রথমদিন আমি তোমার পিছু পিছু যাচ্ছিলাম তখন তোমার পারফিউমের গন্ধে আমার কেমন জানি নেশা ধরে যাচ্ছিল। নিজের অজানাতেই ভালোলাগতে শুরু করলো।কিন্তু যখন বাবা-র ভুল কথা মাথায় ঢুকলো আর বন্ধুদের উশকানিতে সবকিছু শেষ হয়ে যায়।”
-“তুমি ভালোলাগা পর্যন্ত ছিলো বলেই শেষ হয়ে যায় ভালোবাসলে শেষ হতো না।”
লাজ উঠতে নিলে ফারাজ ওর হাত দরে বলে…..
-“আমি তোমাকে সত্যি ভালোবাসতাম, তোমার সাথে ভালোবাসার নাটক করতে করতে কখন নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম নিজেও বোঝতে পারিনি। কিন্তু একদিকে বাবার অপমান আর অন্যদিকে বন্ধুদের উশকানি আমার মাথা পুরো শেষ করে দিয়েছিল। আমি বোঝতে পারছিলাম না কি করব? লাজ প্লিজ আমাকে আর একটা সুযোগ দাও ল, প্লিজ!”
-“সত্যি ভালোবাসো?”
-“কি প্রমান চাও বলো?”
-“সারাজীবন পাশে থাকতে হলে কিন্তু অনেক রাগ অভিমান ভাঙ্গতে হবে,অনেক ঝড় সহ্য করতে হবে!”
-“সবকিছুর জন্য প্রস্তুত!”
লাজ আর কিছু না বলে ফারাজকে জরিয়ে ধরলো। ফারাজও লাজকে জড়িয়ে ধরলো। লাজ এতদিন ফারাজের থেকে প্রতিশোধ নিতে চায়লেও তার ভালোবাসা একটুও কমেনি। সেই আগের মতো করেই ভালোবেসে গেছে। ফারাজ শুধরে যাওয়ায় লাজ আর তাকে দূরে সরিয়ে দিতে পারলো না। পুনরায় ফারাজের সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরী করলো।
লাজ ফারাজকে ছেরে সামনে দাঁড়ালে ফারাজ খেয়াল করলো তার চোখে হালকা পানি। আসলে লাজ একটু বেশীই ইমোশনাল তাই সে সহজেই কেঁদে দেয়। ফারাজ তার চোখের পানিগুলো মুছে দিয়ে বলে…..
-“এভাবে যদি কান্না করো তাহলে সামনে সবকিছু সামলাবে কি করে বলো।”
ফারাজের কথায় লাজ নিজের চোখ মুছে বলে,” কই কান্না করছি আমি তো কান্না করছি না।”
-“ওহ আচ্ছা, তাহলে সবকিছু যখন ঠিক হয়েই গেল তাহলে এখন অধিকার গুলোও ঠিক টাক মতো নিয়ে নেওয়া যাক দুজনের?”
ফারাজ শয়তানি হাসি দিয়ে লাজের দিকে তাকালো লাজ ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকায়।ফারাজ সামনে এগোতে লাগলে লাজ পিছুতে পিছুতে বলল,”কোন অধিকার?বউ পেটানোর!”
লাজের কথায় ফারাজ হেঁসে দিয়ে বলে,” আরে বউ কেন পেটাতে যাবো?”
-“তাহলে?”
-“বউকে আদর করার,ভালোবাসার!”
লাজের কোমড়ে ধরে টান মেরে নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলল ফারাজ। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে কথাটা বলল। লাজ ইতিমধ্যে কাঁপা শুরু করে দিয়েছে। ফারাজ নিজের গাল দিয়ে লাজের গালে ঘষতে লাগলো, হাত দিয়ে চুল গুলো এক সাইড করে পিঠে হাত নিতেই লাজ এক ধাক্কা দিয়ে তাকে সড়িয়ে দেয়। ফারাজ অবাক হয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করে জানতে চায়লো,”কি হয়েছে?” লাজ একটু স্বাভাবিক হয়ে বলল,” আমি এখনো এসবের জন্য প্রস্তুত নয়!এসবের কথা এখনো মাথায় আনিনি, আশা করি বোঝতে পারছো!”
-“ওহ, আচ্ছা সরি, আমার উচিত ছিলো তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে নেওয়া।সরি!”
-“হুম!”
-“আচ্ছা,তাহলে ফ্রেশ হয়ে আসো।আজ থেকে এক সাথে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবো। এতে তো কোনো সমস্যা নেই?”
-“তাতে সমস্যা নেই কিন্তু যদি কিছু…”
-“কিছু হবে না,প্রমিস!”
ফারাজ লাজকে তার কথা শেষ হওয়ার আগেই কথাটা বলল। লাজ ফারাজের দিকে তাকালে ফারাজ একটা কিউট স্মাইল দেয়, যা দেখে লাজের হার্টবিট বাড়তে শুরু করে। লাজ তারাতাড়ি সেখান থেকে চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় শুয়া মাত্রই ফারাজ ওকে খপ করে জরিয়ে ধরে।লাজ প্রথমে ভয় পেয়ে গেলেও পরে ফারাজকে দেখে শান্ত হয়। তখন তার কেমন যেন একটা ভালোলাগা অনুভব হয়। আজ প্রথম ফারাজ তাকে এভাবে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে, আর তারা দুজন এতটা কাছাকাছি। ফারাজ চোখ বন্ধ করে আছে আর লাজ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ফারাজ চোখ খুলে বলে,”এভাবে তাকিয়ে থাকলে তো অনেকিছু করতে মন চায়বে মাই ডেয়ার চাশনি!”
লাজ কথাটা শুনে লজ্জায় তারাতাড়ি চোখ বন্ধ করে ফেলে।ফারাজ মুচকি হাসি দিয়ে সেও চোখ বন্ধ করে ফেলে। আর চাশনি কথাটা লাজকে ফারাজ ভালোবেসে বলে, সেই প্রথম থেকেই এই নামে ডাকে ফারাজ।
চলবে