গজপ্রিয়া -১
Chhamina Begam
এটা বসন্ত কাল । ইতিমধ্যে শীত তার পাতকড়ি গুটিয়ে বিদায় নিয়েছে। মাথার ওপরে সূর্যটা সোনালী রোদ ফেলে ধরনীকে আলোকিত করে রেখেছে । শুষ্কতা কাটিয়ে প্রকৃতি নবরূপে সেজে উঠছে । যেন এক পূর্ণ যৌবনা নর-নারী । চারিদিকে অসংখ্য নাম না জানা ফুলের সমাহার ,ছোটবড়ো সব গাছে সবুজের মেলা বসেছে । প্রকৃতির এই উত্থাল রূপে বরাবরই মুগ্ধ হয় রানি । জানালার কাঁচ গলে মিঠে রোদ ওর কপাল, গাল ,ঠোট স্পর্শ করে যাচ্ছে । রানি জানালায় মাথাটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে সেই শুভ্র স্পর্শ অনুভব করার চেষ্টা করছে । ঠোঁটের কোণে একটা মিষ্টি হাসি ফুটে উঠেছে । যদিও পাখির কলতান শোনার উপায় নেই কারণ ট্রেন দ্রুত গতিতে ছুটছে গন্তব্যের দিকে । সন্ধ্যার নাগাদ রানী পৌছে যাবে নিউ আলিপুর দুয়ার স্টেশনে । ওখানে মামা নাহলে মামাতো ভাইয়েরা কেউ আসবে রানীকে নিতে ।
প্রকৃতিপ্রেমী রানি একজন সাহিত্য প্রেমীও বটে । তাই তো উচ্চমাধ্যমিকের পরপরই উচ্চশিক্ষার জন্য ছুটে ছিল শান্তিনিকেতনে কবিগুরুর আখড়ায় । বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করছে ও। সবে মাত্র মাস্টার্সের দ্বিতীয় বর্ষের থার্ড সেমিস্টারের পরীক্ষা শেষ হয়েছে । ইচ্ছে ছিল আর কয়েকদিন থেকে তারপর বাড়ি ফিরবে । বাড়ি বলতে নানুবাড়ি । রানিরা চার বোন , ও দ্বিতীয় । ওর ছোট বোন বিলকিস আর ও পিঠোপিঠি হওয়ায় ওর জায়গা নানু বাড়িতে হয়েছে । কারণ সেই সময় ওর মা জাহানারা খুব অসুস্থ থাকায় তারপক্ষে দুই মেয়েকে সামলানো সহজ ছিল না । তাই রানীর নানুমা ওকে নিজের কাছে নিয়ে যায়। যাইহোক, রানীর আর শান্তিনিকেতন বসে থাকা সম্ভব হল না । কারণ মামাতো বোন কাম বান্ধবী মোস্তাফিনার হঠাৎ করেই বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে । জরুরী ভিত্তিতে তলব পড়েছে রানীর । মোস্তাফিনার বিয়ে পরশু দিন । হাতে মাত্র একদিন আছে। যদিও মামা এক সপ্তাহ আগেই ওকে আসতে বলেছে ।রানী পদাতিক ট্রেনেই চলে আসতে চেয়েছিল । মামা ফোন করে বারণ করি দিল । বলল, আট-নয় ঘন্টার রাস্তা । একা একটা মেয়ে পদাতিক ট্রেনে আসা টা ঠিক হবে না । পথে যদি কোনো বিপদ হয় ? তাই ট্রেনের রিজার্ভেসন টিকিট পেতে একটু ঝক্কি পোহাতে হয়েছে রানীকে । শেষমেশ আজ বাড়ির পথে ।
সেই সকালে ডিম সিদ্ধ দিয়ে ভাত খেয়ে বেরিয়েছে রানী । ইচ্ছে করলেই আর একটু সময় নিয়ে কিছু একটা তরকারি বানিয়ে খেতে পারত । কিন্তু ইচ্ছে হয়নি । বাড়ি পৌছালেই তো মামানির হাতের টেস্টি খাবার খেতে পাবে । কথাটা ভাবতেই ক্ষিদেয় পেটটা মোচড় দিয়ে ওঠে । আর কিছুক্ষণ পড়েই নামবে ও । হাতের ব্যাগ টা থেকে একটা কেকের প্যাকেট বের করে খাওয়া শুরু করে ।
স্টেশনে নেমে রানি এদিক ওদিক তাকিয়ে মামাতো দাদা লাবিবকে খোঁজে। আগেই মেসেজ করে জানিয়ে দিয়েছে ও স্টেশনে থাকবে। খুঁজে না পেয়ে ফোন বের করে কল করতে যাবে তখনই একটা পরিচত কন্ঠস্বর শুনে রানি মুচকি হেসে মাথা তুলে তাকায় । ওর থেকে একটা দূরে ভীড়ের মাঝে দাড়িয়ে হাসি মুখে লাবিব হাত নেড়ে ডাকছে রানিকে । ওকে দেখে রানীর মুখের হাসিটা আর একটু চওড়া হয় ।ঠোঁটের ফাকে গজ দাতঁটা ঝিলিক মারে। ওই হাসি দেখে লাবিবের মনে হয় সারা দিনের ক্লান্তি যেন একনিমেষেই দূর হয়ে গেল । দেখতে দেখতে কত্তো বড়ো হয়ে গেল এই ছোট্ট মায়াপরীটা । ওদের বাড়িতে সব থেকে ছোট্ট সদস্য হল রানি । তাই আদর ভালোবাসা সব যেন একটু বেশি বেশি করে সবাই। রানী হাতের ব্যাগটা নিয়ে দ্রুত চলে আসে লাবিবের সামনে ।
-“কেমন আছ ভাইয়া ?”
-“ভালো । তুই কেমন আছিস ?”
-” এতক্ষণ শুধু ভালো ছিলাম । এখন তোমাকে দেখে আরো বেশি ভালো আছি ।”
-“পাগলি একটা…. ..চল ” মৃদু হেসে লাবিব রানির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দেয় ।
-” চলো ..”
-“রানি, ব্যাগটা আমাকে দে ”
কথা বলতে বলতেই দুজনেই স্ট্যান্ডের কাছে চলে আসে । রানি সামনে তাকিয়ে থমকে দাড়ায় । চোখ বড় বড় করে দেখে সামনে বাইকে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটাকে । ভ্রু সামান্য কুচকে যায় রানির । অজান্তেই মুখ দিয়ে বিরক্তি সূচক আওয়াজ ‘সিট’ বেরিয়ে আসে । বিরবির করে বলে ,
-“এই বান্দরটাও আসছে !”
লাবিব রানির বলা কথাটা শুনতে পায় । বলে ,
-“ও আজকে দূপুরে এসেছে । চাচি ওকে রেস্ট করতে বলল । কিন্তু আমি এখানে তোকে নিতে আসছি শুনে ও আসতে চাইল আসার পথে আমাকে কম্পানি দিতে । একাই আসছিলাম এতটা রাস্তা । তাই নিয়ে আসলাম । ”
ছেলেটা এখনও ওর দিকে তাকিয়ে চব্বিশটা দাঁত বের করে হাসছে । রানি কাছে গিয়ে দাড়াতেই ওকে উদ্দেশ্য করে ছেলেটা বলে,
-“ওই হাতির বাচ্চা, কেমন আছিস ?”
রানি বিষ দৃষ্টি নিয়ে কটমট করে তাকায় ।
-“বলবি না তো । ঠিক আছে । এমন কটমট করে তাকিয়ে আছিস কেন ? হুহ। আমি জানি আমি সুন্দর দেখতে । তাই বলে তুই এভাবে নজর দিবি ? “বাইকে হেলান দিয়েই একগাল হেসে বলে ছেলেটা ।
এমনিতেই সারাদিনের জার্ণিতে কাহিল হয়ে আছে রানি। তার ওপর এই বিশ্রী মন্তব্য শুনে চোখ ছলছল করে ওঠে । কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে ,
-“ভাইয়া, তুমি এই বান্দরটাকে কেন নিয়ে আসছ ? দেখছ কিভাবে বলছে আমাকে। ওকে চুপ থাকতে বল তুমি । ”
-“ইস, হাতির বাচ্চাটা কান্দে কেন আবার “..ছেলেটা বাঁকা হেসে আবার বলে ওঠে।
-“আহঃ, সম্রাট, হচ্ছে টা কি বলতো ? আসতে না আসতেই তোরা শুরু হয়ে গেলি টম অ্যান্ড জেরির মতো। …. ঝগড়া পরে করিস । এখন চল ,বাইক ঘোরা । বাড়িতে সবাই আমাদের পথ চেয়ে আছে ”
সম্রাট ‘হুম’বলে বাইক ঘুরিয়ে চালকের আসনে বসে । লাবিব উঠতে যাবে তখনি সম্রাট ওকে থামিয়ে বাইক থেকে নেমে আসে । লাবিব বলে,
-“কিরে ,নেমে আসলি কেন ?”
-“ভাইয়া তুমিই চালাও ”
-“আসার সময় না বললি এখন তুই চালাবি ?”
-“হুম বলেছি ঠিকি । কিন্তু ভাইয়া , এখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে । তুমি তো জানোই আমি বাড়ি আসলেই শুধু বাইক চালাই। তাও অনেক দিন পর পর । আর আসার পথেই তো দেখলাম কেমন যানজট লেগে থাকা রাস্তায় ?আমি রিস্ক নিতে চাইনা । তাই তুমিই বরং চালাও । ”
– “ওহ আচ্ছা , সর তাহলে ।”
লাবিব সম্রাটকে মাঝে আর রানিকে সম্রাটের পিছনে বসিয়ে বাড়ির পথে এগিয়ে চলে । পথে যেতে যেতে রানী সম্রাটের একটা কথার ও জবাব দেয় না । শুধু লাবিব কিছু জিজ্ঞেস করলে চিৎকার করে উত্তর দিতে হচ্ছে । কারণ ওদের বাইকটা বাতাসের দেয়াল ভেদ করে সামনে এগিয়ে যাওয়ায় লাবিবের কথা গুলো রানি শুনতে পেলেও রানীর বলা কথা গুলো লাবিবের কান অবধি পৌছাচ্ছে না । বরং ওর বলা কথাগুলো বাতাসের সাথে পেছনে ছুটে যাচ্ছে । বাধ্য হয়ে কথা বন্ধ করতে হয় লাবিবকে । কিন্তু সম্রাট তার কথার গাড়ি বন্ধ করতে রাজি নয় । সে এটা সেটা জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছে রানিকে । রানি ইচ্ছে হলে উত্তর দিচ্ছে না হলে চুপ করে আছে । এমনিতেই বাড়ি ফেরার খুশিটা একটু ম্লান হয়ে গেছে সম্রাটকে দেখে । এই মহা ফাজিল ছেলেটা যে এবার কি কি ভাবে ওকে জ্বালাবে সেই চিন্তায় রানি অস্থির হয়ে পড়ছে। বদমাশটাকে লাথি মেরে নামিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।
-” ওই পেতনি ,কথা বলিস না কেন ?”
-“শোন সম্রাট ,তুই না আমার সাথে একদম কথা বলবি না। তোকে জাস্ট সহ্য হচ্ছে না আমার । এখন দয়া করে মুখ বন্ধ কর । নাহলে কিন্তু ধাক্কা মেরে ফেলে দেব রাস্তায় । ”
বলার সাথে সাথেই বাইকের সামনের চাকা রাস্তার একটা ছোট গর্তে পড়তেই একটা বড়বড় ঝাকি খায় সবাই । এতক্ষণ রানী বাইকের পেছনের হুডটা ধরে থাকলেও ঝাকি খাওয়ার সাথে সাথে ডান হাতে সম্রাটের কাধ খামচে ধরে । সম্রাট আড় চোখে তাকায় রানীর হাতের দিকে । ঘাড়টা টনটন করছে ব্যাথায় । তবুও মুখে একটা মুচকি হাসি ফুটে উঠেছে। রানি একটু এগিয়ে এসেছে সম্রাটের দিকে । এই জন্যই সম্রাট লাবিবের পাশে বসতে দেয়নি রানিকে । যদিও জানে লাবিব খুব ভালোবাসে বোনকে । তবুও নিজের বোন তো নয় । আর রানিকে অন্য কোনো ছেলের পাশে দেখলেই সেই বয়সন্ধিকাল থেকেই বুকের মধ্যে কি যেন একটা খচখচ করে । নিজের ভেতরে একটা অসহনীয় ব্যাথা টের পায় সম্রাট ।
লাবিব উচ্চ স্বরে বলে ওঠে,
-“রানি ,ভালো করে ধরে থাকিস কিন্তু । রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ।জায়গায় জায়গায় বড় বড় গর্ত হয়েছে অনেক। ”
-“হুম, তাই তো দেখছি। তুমিও সাবধানে চালাও ভাইয়া।
রানির নানু বাড়ি গ্ৰামে । ওরা যে পাড়াতে থাকে তারা সবাই ওর নানুর নিজের গুষ্টির লোক, মানে চাচাতো, জ্যাঠাতো ভাই সবাই । তার সাথে নিজের একভাই তো আছেই । ওই ভাই মানে , রানির মায়ের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে সম্রাট। সম্রাটের মা আবার জাহানারার বাল্যসখি রুমা। তাই রানি তাকে মামি না ডেকে খালামনি ডাকে ।
পৌছেই বাড়ির ছবি দেখে রানি একটু অবাক হয়। পুরো বাড়িটা প্যান্ডেল দিয়ে সাজানো হয়েছে । তবে রাস্তায় এখনো গেট লাগানো হয়নি । বাড়ির সামনের পুকুর টায় মাটি ভরে গতবছর লাবিব একতলা ঘর তুলেছিল । তার ছাদে সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। বিয়ে তো পরশু তাতেই এত লোক এসেছে। না জানি বিয়েতে আরো কত লোক আসবে । সন্ধ্যা হওয়ার জন্য বালভের সাথে সাথে মরিচ বাতি গুলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। এসব দেখে নিভে যাওয়া মনটাও নিমেষে চাঙা হয়ে ওঠে রানির । ওকে দেখেই ছোট ভাইবোনরা সবাই দৌড়ে আসে। আত্মীয় স্বজন যারা এসেছিল সবাই কুশলাদি জিজ্ঞেস করে। মামা রানিকে রেস্ট নিতে বলে কি একটা কাজে বেরিয়ে যায় । সবাইকে পেরিয়ে রানি ওর মামানির (মনিরা) সামনে গিয়ে দাড়ায় । ছলছল চোখে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে মনিরা।
“মামানি “বলে কাছে যেতেই মনিরা জড়িয়ে ধরে রানিকে । তারপর কপালে চুমু একে মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে বলে ,
-” বাচ্চাটা আমার কত্তো শুকিয়ে গেছে । খাস না নাকি ঠিক মতো ? ”
-“আম্মু, এই আমিও আছি পাশে । আমি তো দিন দিন বাতাসে ঢুলছি। আমাকে কি তোমার চোখে পড়ে না গো । সব আদর শুধুই রানির জন্য । হুহ। ” ন্যাকা ন্যাকা স্বরে বলে মোস্তাফিনা ।
-“ইস, ননদিনী দুদিন পর তো চলেই যাচ্ছ। তবুও হিংসা করছ কেন ওকে ?হুহ। তোমাকে তো আমরা সবাই তিনবেলা আদর করে খাওয়াচ্ছি । আর ওখানে ও তো হোস্টেলের ওই ডালভাত খেয়েই কাটিয়ে দিল এত বছর । “…মনিরার পাশ থেকে লাবিবের বৌ মৌসুমী মৃদু হেসে বলে। কোলে লাবিবের দেড় বছরের মেয়ে তান্নু ঘুম জড়ানো চোখে চেয়ে দেখছে সবাইকে ।রানি বাচ্চাটার গালে একটা চুমু একে দেয় ।
-“হুম একদম , মুসু তোর পেটে এত হিংসে ভরা কেন রে । আমার বোনটাকে একদম দেখতে পারিস না তুই। ” লাবিব রানির পাশে দাড়িয়ে মোস্তাফিনাকে উদ্দেশ্য করে বলে । সবার কান্ড দেখে রানি মুখ টিপে হাসে । আসে পাশে দাড়ানো অনেকেই দাড়িয়ে দাড়িয়ে মজা নেয় দৃশ্যটার । মোস্তাফিনা রাগে লাল হয়ে যায় । ওর আবার রেগে গেলে চোখে জল চলে আসে । হলো তাই, টলটল চোখে লাবিবের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” তোমরা সবাই এমন কেন ? হ্যাঁ । আমি কি একটু মজা করতে পারি না। আর রানি আমার বোন । ওকে আমি হিংসে করব কেন ? দুদিন পর তো চলেই যাব ।তখন দেখব কার সাথে এমন কর তোমরা ?এই রানি, চল তো এখান থেকে । তোর সাথে অনেক কথা আছে আমার ”
মোস্তাফিনা রানির হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় ঘরের দিকে ।
-” গল্প পরে করিস তোরা । রানি , তুই আগে গোসল করে নে । আমি খাবার রেডি করছি। ”
-“ওকে মামানি”
-“আরে ব্যাগটা তো নিয়ে যা ”
লাবিবের কথা শোনার হওয়ার আগেই মোস্তাফিনা রানিকে নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে ।
-“ভাইয়া, আমি দিয়ে আসি । দাও।”..সম্রাট লাবিবের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে রানিদের পিছু পিছু যায়। বাকিরা সবাই সবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ।
দরজার বাইরে দাড়িয়ে দুবার ঠকঠক শব্দ করে সম্রাট ,
-“আপু ,আসব ?”
-“কে, সম্রাট ….হ্যাঁ, আয় ”
মোস্তাফিনার অনুমতি পেয়ে সম্রাট ঘরে প্রবেশ করে ।
-“আপু , রানির ব্যাগটা দিতে এসেছি। ”
-“ওহ, রাখ এখানে। ”
সম্রাট ব্যাগটা বিছানার ওপর রেখে চলে আসার জন্য পা বাড়াতেই মোস্তাফিনা থামিয়ে দেয় ,
-” চলে যাচ্ছিস নাকি ? বস না এখানে । কত দিন থেকে কথা হয় না তোর সাথে । ”
সম্রাট একবার রানির দিকে তাকায় । রানি বাঁকা চোখে ওকেই দেখছে। সম্রাট বিছানায় বসতে বসতে বলে,
-“হ্যাঁ আপু । আসলে ব্যস্ত থাকি তো । আর ইন্সটিটিউট থেকে এসে আর বসে থাকতে ইচ্ছে করে না । তখন শুধু ঘুমাতে মন চায় ”
মোস্তাফিনা হাসে ।
-“তোর কোর্স শেষ হবে কবে ?”
-” আর দেড় বছর লাগবে ”
-“ওহ আচ্ছা ।..”
রানিকে ঠায় দাড়িয়ে থাকতে দেখে মোস্তাফিনা ভ্রু উচিয়ে প্রশ্ন করে ,
-“কি রে তুই দাড়িয়ে আছিস কেন ? যা গোসল করে আয় । ততক্ষণে আমি গল্প করি ওর সাথে ”
রানি একবার কঠিন দৃষ্টিতে তাকায় সম্রাটের দিকে । তারপর আলনা থেকে তোয়ালে নিয়ে সম্রাটের একদম সামনে এসে দাড়ায় । দুজনের মাঝে মাত্র এক ফুটের দুরত্ব। ওর আচরণে সম্রাটসহ মোস্তাফিনাও কিছুটা ঘাবড়ে যায় । রানি সামনে দাড়িয়েই সম্রাটের দিকে কিছুটা হেলে বাঁ হাতটা বাড়িয়ে দেয় । সম্রাট ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় । চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখে রানিকে । থমথমে মুখে রানি তাকিয়ে আছে ওর দিকে । সময় যেন একটু থমকে যায় সম্রাটের জন্য । চোখ দুটো রানির মুখের আদলে ঘোরাফেরা করে । চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে মনের মাঝে একে ফেলে রানির মাঝারি ঘনত্বের ধনুকের মতো বাঁকা ভ্রু , কাটা কাটা নাক , কালচে খয়েরি রঙা চোখ, সরু অধরযুগলকে । বুকের ভেতর তখন দামামা বাজতে শুরু করেছে । পলকহীন চোখে সম্রাট চেয়ে আছে রানির চোখে। ততক্ষণে রানি সম্রাটের পাশে থাকা ব্যাগ থেকে নিজের একটা কুর্তি আর পাজামা বের ফেলেছে। চোখের দৃষ্টি এখনো সম্রাটের চোখে নিবন্ধ । চোখে চোখে যেন কত কথা হচ্ছে । কিন্তু আসলে তা নয় । সম্রাটের চোখে হতভম্ব ভাব আর রানির চোখে দুষ্টুমি খেলা করছে। কুর্তি, পাজামা নিয়ে রানি সোজা হয়ে দাড়ায়। তারপর গটগট করে হেটে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে । এতক্ষণের চেপে রাখা হাসিটা সশব্দ বেরিয়ে আসে । সম্রাটকে জব্দ করতে পেরে একটু হাত পা ছুড়ে কয়েকটা নাচের স্টেপ ও করে ফেলে । বাথরুম থেকে হাসির আওয়াজ পেতেই মোস্তাফিনা রানির দুষ্টুমি ধরতে পেরে সেও হা হা করে হেসে ওঠে । মোস্তাফিনার হাসির শব্দ শুনে সম্বিত ফেরে সম্রাটের । ডান হাতটা অজান্তেই বুকে উঠে হৃৎপিণ্ডের জায়গায় চেপে ধরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে । বিরবির করে বলে,
-“উফফ, আল্লাহ ।এই মেয়েটা কি আমাকে হার্ট অ্যাটাক দেবে নাকি । এত পাজি কেন মেয়ে টা ?উফফফ ”
-“তোরা পারিস ও বটে । এখনো তোদের কুত্তে-বিল্লির মতো ঝগড়া বন্ধ হয়নি । বড় হবি কবে তোরা । ছোটবেলায় তোদের দুটোকেই পাগলা কুকুরে কামড়েছে মনে হয় । যার জন্য এখনো তোদের পাগলামি যায় না । “..হাসতে হাসতে বলে মোস্তাফিনা ।
সম্রাট বুক থেকে হাত নামিয়ে আবার একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে ছেড়ে দেয় । সত্যি বলতে ও একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিল । ছোটবেলায় রানির সাথে এরকম বহু কান্ড করেছে ও । দুজনে সবসময় চেষ্টায় থাকত কে কাকে মাত দিতে পারে । কিন্তু অনেক দিন রানির সাথে সেভাবে কথা হয়না । এক কথায় ওকে এড়িয়ে চলে রানি । ফেসবুকে এখনো রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করেনি । হোয়াটস অ্যাপ থেকে ব্লক করে রেখেছে হয় তো । বলতে গেলে যোগাযোগের কোনো রাস্তাই রানি খোলা রাখেনি সম্রাটের জন্য । তাই তো সম্রাট সবসময় বাড়িতে ফোন করে ইনিয়ে বিনিয়ে রানির কথা জিজ্ঞেস করে । আর যখনই শোনে রানি বাড়ি এসেছে বা আসছে যেভাবেই হোক ছুটি মেনেজ করে সেও বাড়িতে চলে আসে । কিন্তু আজ রানির এমন আচরণের জন্য একদম তৈরি ছিল না সে । এমনটা আগে কক্ষনো করেনি রানি । তবে যাইহোক এর ফলাফল তো তোমাকে ভুগতেই হবে কন্যা। তুই নিজের জানিস না তোর এটুকু দুষ্টুমি এই হৃদয়ে কেমন কালবৈশাখী ঝড় তুলেছে । একে শান্ত করতে হলে তোকে চাইই চাই … মনে মনে ভেবে সম্রাট বাঁকা হাসি হাসে ।
To be continue..