গজপ্রিয়া-6,7
Chhamina Begam
6
গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে । সম্রাট আড়চোখে বারবার তাকাচ্ছে রানীর দিকে । কিন্তু রানি চোখ মুখ শক্ত করে স্টিয়ারিং ধরে আছে । ইচ্ছে থাকলেও আর টু শব্দটি করল না সম্রাট । এই মেয়ের অল্পতেই রেগে যাওয়ার ধাত আছে । ভরসা নেই । রেগে গেলে সত্যি সত্যি লাথি মেরে ফেলে দিতে পারে ।
মেয়ে এতদিন পর আসছে শুনে সেই সকাল থেকে জাহানারার বিশ্রাম নেওয়ার জোর নেই । যদিও জানে রানি বেশিক্ষণ থাকবে না । তবুও এই অল্প সময়ের মধ্যেই দুধপিঠা , তেলের পিঠা , পাটিসাপটা, পোলাও আর কষা মাংস রান্না করে ফেলেছে । তবে রানির জন্য সাদা ভাত রান্না করেছেন । কারণ ও পোলাও পছন্দ করে না । পোলাও টা জাহানারা রান্না করেছে সম্রাটের জন্য । খুব ভালোবাসে ছেলেটা পোলাও খেতে । ছোট বেলায় যখনি বেড়াতে আসত প্রতিবার খালামনির কাছে আবদার করতে পোলাও এর ।
বাণী ছোট হলেও সকাল থেকেই মায়ের সাথে হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করছে । আর বিলকিস, তার তো কথাই নেই । হাতে তেল, হলুদ লাগাতে তার ঘোর আপত্তি । বিয়ে বাড়ি যাবে জন্য সকাল থেকে চুলে হেনা , মুখে কি সব ফেসপ্যাক লাগিয়ে বসে আছে । জাহানারা বার কয়েক বলেছেন ওনাকে সাহায্য করতে । এটা সেটা অজুহাত দেখিয়ে প্রত্যেকবার বেরিয়ে গেছে সে।
রান্নাবান্না সারতে সারতেই আড়াই টা বেজে গেলে জাহানারা ঝটপট গোসল সেরে জোহরের নামাজ আদায় করে নিলেন । বিলকিস ঘন্টা খানেক আগে বলেছে রুমার ছেলে সম্রাট ও নাকি আসছে । অধীর আগ্ৰহে অপেক্ষা করছেন তিনি ছেলেমেয়ে দুজনকে দেখার জন্য । নিজের নাড়িছেড়া ধনের সাথে সাথে রুমার এই মেজ ছেলেটাকে দেখার ইচ্ছে প্রবল ভাবে মাথা চারা দিচ্ছে । সদা হাসিখুশি এই ছেলেটিকে তিনি নিজের ছেলের মতোই স্নেহ করেন । অপেক্ষার প্রহর সবসময় দীর্ঘ মনে হয় । জাহানারা অস্থির হয়ে ঘরের লাগোয়া বারান্দা থেকে বার বার রাস্তার দিকে উকি দিচ্ছেন । দেখা যায় কি না ?
অবশেষে একটা গাড়ি এসে থামল বাড়ির সামনে । রানি রাস্তার পাশে গাড়িটা পার্ক করে নেমে এল । মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে দেখল কিছুক্ষণ বারান্দায় দাড়ানো নিজের আপনজনদের । প্রায় পাচঁ মাস পর দেখছে ওদের । খুশিতে চোখের কোণে মুক্তোর মতো জল চিককিক করে উঠল । পাশে দাড়িয়ে সম্রাট দেখল পড়ন্ত বিকেলের সোনালী আলোয় ওই শ্যামলা মেয়েটির মায়াময় মুখখানি । টলটলে চোখে একটা সুখময় হাসি দিয়ে আপনজনদের দেখতে ব্যস্ত সে । জাহানারা স্বস্থির হাসি হেসে কিছুক্ষণ দেখল রানি কে । তার বাকি তিন মেয়ে তার নিজের গায়ের রঙ পেলেও রানিটা একদম বাবার মতো হয়েছে ।মুখের আদলটাও বাবার মতো । সারাক্ষণ একটা মায়া মায়া ভাব লেগেই থাকে । ওকে দেখলেই জাহানারা মোশারফ হোসেনের মুখটা দেখতে পান । ভাবতে ভাবতেই জাহানারা বারান্দা থেকে নেমে গেল সামনে । বিলকিস ,বানীও দৌড়ে গেল সেদিকে ।
রানি গাড়ি থেকে নামতেই ‘ আপু ‘ বলে চিৎকার করে জাপটে ধরল বাণী , বিলকিস । টাল সামলাতে না পেরে পড়েই যাচ্ছিল রানি , ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল । কারণ এমন পাথুরে রাস্তায় পড়ে গেলে কোমড়ের আস্ত থাকবে না । তখনি পেছন থেকে একটা শক্ত হাত বেড়ি দিয়ে ধরল রানিকে । ধাতস্থ হতে সময় লাগল কিছুক্ষণ । পরক্ষণেই এই হাতের মালিক কে হতে পারে বুঝতে পেরেই ঝট করে সোজা হয়ে দাড়িয়ে সরে গেল ।
-“আম্মুউউউ ” মাকে আল্লাদি সুরে ডেকে জড়িয়ে ধরে রানি । জাহানারা একটা প্রসস্থ হাসি হেসে বলে ,
-“কেমন আছে আমার সোনা মনিটা ? ”
-” খুব ভালো আছি আম্মু ”
-” আম্মু, তুমি সবসময় আপুকে বেশি বেশি আদর কর কেন ? আমাকে তো কখনই সোনামনি বলে ডাকো না ? ” বাণীর অভিমানী সুরে উপস্থিত সকলেই মুচকি হাসে । রানি মায়ের কাছ থেকে সরে এসে কোমড়ে হাত দিয়ে ভ্রু কুচকে বলে ,
-“ওরে আমার হিংসুটি রে । আমাকে এত হিংসে হয় তোর ! আমি তো মাঝে মাঝে আসি মায়ের আদর খেতে । আর তোরা তো সারাবছর আমার ভাগের আদর খাস । তখন তো আমি কিছু বলি না । ”
-“তুই সারাবছর না আসলেই যখন আসিস তখন তো ড্রাবল ট্রিপল আদর পাস । ” বিলকিস ও সুর মেলায় ।
রানি চোখ বড় বড় করে তাকায় । বলে,
-“আরে আরে , তোরা তো দেখি জোট বেধে ঝগড়া করতে আসছিস । তোদের দুজনের সাথে আমি পারব কি করে ? “তারপর জাহানারার দিকে ফিরে বলে ,
-“শোন আম্মু , তুমি কিন্তু সবসময় আমার দলে থাকবে বুঝছো । ”
জাহানারা হাসি মুখে মাথা নাড়ায় । বাণী, বিলকিস অবাক হয়ে দেখে । সম্রাট এতক্ষণ কৌতুক চোখে দেখছে সব । জাহানারাকে বলল,
-“কেমন আছেন খালামনি?”
-” ভালো আছি বাবা । তুই কেমন আছিস ? তোর মা কেমন আছে ? ”
-” আমিও ভালো আছি । তবে আম্মুর শরীর টা একটু খারাপ । বাতের ব্যাথার জন্য বেশি চলাফেরা করতে পারছে না । ”
-” ওহ । এই বয়েসেই বাতের ব্যাথা ধরে গেল !” আফসোস করে বলল জাহানারা । তারপর বলল,
-“আচ্ছা ,চলো সবাই…. ভিতরে চলো । ”
মাগরিবের আজান দিয়েছে অনেকক্ষণ হল । মোশারফ সাহেব এসেছেন একটু আগে । হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে দেয়ে রানির সাথে বসে গল্প করছেন । দুজনেই খোশমেজাজে গল্প করছে , পড়াশোনার খবর , স্বাস্থ্যের খবর আরো কত কি ? এক সময় তিনি উঠে চলে গেলেন ঘরে খাবার পরে তাকে নিয়মিত ওষুধ খেতে হয় ।
-“ভাইয়া আর একটু মাংস দেই । ”
-” হুম ,দে । ”
বিলকিস মাংসের বাটি থেকে কয়েক পিস তুলে দেয় সম্রাটের বাটিতে । খেতে খেতেই সম্রাট বলল,
-” তা বিউটি কুইন , শুধু কি বাড়িতেই এমন টিপটপ হয়ে থাকিস নাকি মিস ইন্ডিয়া কন্টেস্টে নাম দিয়েছিস ? ”
সম্রাটের কথায় বিলকিস একটু সংকুচিত হয়ে যায় । লাজুক হেসে বলে,
-” ধুর । কি যে বলো না ভাইয়া ? মিস ইন্ডিয়া আর আমি? না না । আমি এতটাও সুন্দর নই যে মিস ইন্ডিয়া কন্টেস্টে নাম দেব …..”
-” হুম । দেওয়ারও দরকার নেই । তার থেকে বরং পড়াশোনা কর মন দিয়ে । তোদের তো মনে হয় পরীক্ষা সামনে । ”
-” হুম ”
-“জানো তো খালামনি ,তোমার হাতের রান্না জাস্ট ফাটাফাটি হয়েছে বুঝলে । তুমি তোমার মেয়ে গুলোকেও তো শেখাতে পারতে । ”
বাড়ির ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে রানি আর বাণী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে তাদের আম্মু আর বোনকে । আম্মুর টা না হয় ঠিক আছে । বান্ধবীর ছেলে এসেছে উপরন্তু ভাতিজা হয় একটু বেশি আদর যত্ন করবে । এটা স্বাভাবিক । কিন্তু বিলকিস কি জন্য এত আদিক্ষ্যেতা দেখায় এই ছেলেকে রানি বুঝতে পারছে না । হয়তো কিশোরী বয়েসের ভালোলাগা হবে । কিন্তু এই ছেলে যা বদমাইশ । এর থেকে দুরে রাখতে হবে বিলকিসকে । নাহলে নিশ্চয়ই কোনো অঘটন ঘটিয়ে ছাড়বে । ”
-” আপু , বিলকিস আপু এমন ছ্যাচরামি করছে কেন বলত ?…… । ”
রানী যেন চমকে গেল কথাটা শুনে । আশ্চর্য , এইটুকু মেয়েও কিনা বিষয়টা লক্ষ্য করেছে। অবশ্য বাণী বরাবরই শান্ত অথচ বুদ্ধিমতী মেয়ে । সব বিষয়ে তার সর্বদা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থাকে । সেই তুলনায় বিলকিস একটু ছটপটে । সাজগোজ ছাড়া বাকি দুনিয়ার প্রতি ওর কোন বিশেষ কোনো আগ্ৰহ নেই । রাণীর হরিনের মতো টানা চোখ দুটি বিস্ময়ে যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে । বাণীর দিয়ে তাকিয়ে রাণি গভীর ভাবনায় পড়ে যায় । একজন ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া ছাত্রী কিভাবে এসব চিন্তা ভাবনা করতে পারে ? অবশ্য হতেই পারে । আজকাল অনেক কিছুই হচ্ছে ।
সম্রাটরা যখন বাড়ি ফিরল তখন রাত প্রায় নটা বাজে । বাণী আর বিলকিস কে আনতে গেলেও শেষমেশ জাহানারাও এসেছেন সাথে । মোশারফ সাহেব নিজে স্ত্রীকে যেতে বললে জাহানারা কিছুক্ষণ গাইগুই করছিল । তবে বাপের বাড়ি যাওয়ার আনন্দে সেই গাইগুই কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাটা পড়ল । সবকিছু গোছগাছ করে রাণিদের সাথে বেরিয়ে পড়লেন তিনিও ।
To be continue..।
#গজপ্রিয়া-7
#Chhamina Begam
রানিরা যখন নানুবাড়ি পৌছালো তখন ঘড়ির কাটা আটটা ছুইছুই ।দুর থেকেই বিয়েবাড়ির কোলাহলের আওয়াজ ভেসে আসছে । সোডিয়াম আলোর রোশনাইয়ে পুরোবাড়ি আলোকিত হয়ে উঠেছে। ছোটো ছোটো বাচ্চারা সেই আলোতে রাস্তায় হইহল্লা করছে। একটা খুশির আমেজ ছড়িয়ে আছে ছোট বড়ো সবার মধ্যে । গাড়ি থেকে নেমেই বাণি, বিলকিস দৌড়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে গেছে ।
রানি আর ওর মা উঠোনে পা দিতেই রানির মেজ খালা সাহানাজ হাসি মুখে এগিয়ে এল বোনের দিকে ।
-” কেমন আছিস ছোট ?”
-“ভালো আছি আপা । তুমি কেমন আছ ?”
-“এই তো আছি ভালোই । রানি, তুই কেমন আছিস মা ?”
-“ভালো আছি খালামা । তুমি কখন এসেছ ? আর মিলি আপা আর মৌনি, সাহিন ভাইয়ারা কোথায় ? ”
-” এই তো আমরা বিকেলে আসছি । মৌনি তো এখানেই ছিল । ওই তো বিলকিসের সাথে আছে । আর মিলি মুস্তাফিনার সাথে গল্প করছে । সাহিন, ও এখানেই আছে হয়তো কোথাও । আসার পর থেকেই দেখছি না ওকে । হয়তো তামিমের সাথে বেরিয়েছে । ”
-” আপা, দুলাভাই আসেনি ?” জিজ্ঞেস করল জাহানারা ।
-“নারে , ও তো কাজ পাগল মানুষ । কাল আসবে হয়তো বিকেল নাগাদ । ” বলল সাহানাজ ।
-“আরে ছোট ফুপি, এখানেই দাড়িয়ে থাকবে নাকি । ভেতরে চলো , আম্মা ডাকছে ?”…কাছে এসে দাড়াল মৌসুমী ।
-“বৌমা, ভালো আছ তো ? তোমার মেয়ে কোথায় ?”
-” ভালো আছি ফুপি । তান্নু মুসুর সাথে আছে । চলো তোমরা । এসো । ”
–” হ্যাঁ যাই । আপা চলো । ”
-” আম্মু , তোমরা যাও । আমি রুমে গেলাম । ”
-“আরে রানি ?” ডাকল মৌসুমী ।
-“হ্যাঁ ভাবি । বলো ..”
-“শোন , জামা কাপড় পাল্টে তাড়াতাড়ি আসিস তো আমার কাছে । আমি রান্নাঘরে আছি ”
-“আচ্ছা ”
ঘরে গিয়ে রানি দেখল তান্নু মোস্তাফিনার কোলে খেলছে আর মিলি মোস্তাফিনার সাথে গল্প করছে । দরজা খৈলার শব্দ হতেই দুজনেই তাকায় রানির দিকে ।
-“হ্যালো লেডি , কেমন আছেন আপনি ?” হাসি মুখে রানি এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে মিলিকে ।
-“হেই মাই কুইন , আ’ম ফাইন । তুই কেমন আছিস ?”
-” খুব ভালো … আচ্ছা আপু , তোমরা কথা বলো আমি চেঞ্জ করি । ভাবি এখুনি যেতে বলল আমাকে । ”
-“আচ্ছা যা ”
–
-” এখন সময় হল দুই বোনের আসার । মেয়েটা শুধু একার আমার ? বিয়ে লাগছে একমাত্র ভাসতির । আর তার ফুপিদের পাত্তা নেই । আত্মীয়ের মতো ঢুলে ঢুলে আসছ !” সাহানাজ , জাহানারা যেতেই কপট ঝাড়ি দেয় মনিরা ।
-“আরে ভাবি , বললেই কি আসা যায় বলো তো । পুরো সংসারের কাজ গুছিয়ে তারপর বেরতে পারছি । মহাসেনার আব্বু তো ছুটিও পায়নি । তাও আমাদের তিন মা মেয়েকে পাঠিয়ে দিল । ” বলল জাহানারা ।
-“আমার কথা তো জানোই ভাবি । সাহিনের আব্বু যা কাজ পাগল লোক । কত করে বলার পর সাহিন সব কাজ ওর বাবাকে বুঝিয়ে দিয়ে তারপর আমাদের নিয়ে এল । ”
মনিরা দুজনের কথা শুনে হেসে ফেলল । বলল,
–” হয়েছে । এত এত কথা বলতে হবে না । আমি জানি তো । এমনিতেই মজা করলাম একটু । বসো । আমি চা বানাই । ”
-“ভাবি , আম্মার শরীর এখন কেমন ?” প্রশ্ন করল জাহানারা ।
-” আগের মতোই । কোনো উন্নতি নেই । তাই তো মুসুর বিয়েটা এত তাড়াতাড়ি দিতে হচ্ছে । নাত জামাই দেখতে চায় আম্মা । ”
-“ওহ…. । ভাবি ,তুমি চা বানাও । আমি ততক্ষণে আম্মার সাথে দেখা করে আসি । ”
-“হুম যাও ”
-” ভাবি, কেন ডাকলে বলো ?”
-” ওহ রানি , শোন এই প্লেটটা আমাদের ঘরে নিয়ে যা তো । তোর ভাইয়ার কোন এক বন্ধু এসেছে বলল। আমি একটু এদিকে ব্যস্ত আছি । তুই দিয়ে আয় না নাস্তার প্লেট টা । ”
-” ঠিক আছে। দাও । ”
-“ভাইয়া, দরজাটা খোলো । ভাবি নাস্তা পাঠিয়েছে”
-“ভেজানো আছে । চলে আয় “.. ঘরের ভিতর থেকে লাবিবের আওয়াজ ভেসে আসে।
ঘরে ঢুকেই রানী যেন চারশো চল্লিশ ভোল্টের ঝটকা খেল । এ কাকে দেখছে সামনে ? আশিক ভাইয়া । ওহ আল্লাহ ,কেমন দেখা যাচ্ছে আমাকে ? চুল গুলো ঠিক আছে তো ? মুখ ধুয়ে ক্রিম ও তো লাগাইনি আজ ! নিজের পোশাকের দিকে তাকিয়ে আর একবার আফসোস হয় রানির । ইস , আজকের দিনেই এই নেতানো কুর্তি টা পড়তে হলো । ইস্ত্রিটা একদম নষ্ট হয়ে গেছে । সামনে যেটা পেয়েছে সেটা পড়ে চলে এসেছে রানী । অত খেয়াল ছিল না । ফুরফুরে মনটা এক নিমিষেই জন্য কালো মেঘে ঢেকে গেল । আরষ্ঠ হয়ে কিছুক্ষণ থম মেরে দাড়িয়ে রইল ।
-” রাণী ,দাড়িয়ে আছিস কেন ? আয় ভেতরে …” লাবিবের কথায় সচেতন হয় । গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায় ঘরের ভিতরে । সোফায় বসে গল্প করছে লাবিব আর আশিক । তাদের সামনে টি টেবিলের ওপর নাস্তার প্লেট রাখে রানি । একটা প্লেট তুলে আশিকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
-” ভাইয়া নাস্তা নিন । ”
আশিক মিষ্টি করে হেসে নাস্তার প্লেট হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করে ,
-“কেমন আছ রানি ?
-“ভালো আছি ভাইয়া । আপনি কেমন আছেন ? ”
-“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি । ”
বলেই আশিক তার বিখ্যাত মুচকি হাসিটা হাসে । ওই হাসি দেখে রানী থমকে যায় । ফিরে যায় সাত বছর আগে অতীতের সেই দিনগুলোতে । তখন ইলেভেনে পড়তো রানী। ইংলিশ পড়ার জন্য আশিকের কাছে টিউশন নিত । আশিক তখন পঁচিশের টগবগে যুবক । শ্যাম বর্ণের প্রায় ছয় ফুট উচ্চতার মাঝারি স্বাস্থ্যের আশিক তখন সদ্য মাস্টার্স কমপ্লিট করে পি.এইচ.ডির প্রিপারেশন নিচ্ছিল । ঘন চুল গুলো সবসময় ব্যাকব্রাশ করা থাকত । চওড়া কপাল ,উন্নত নাক , চাপদাড়ি যুক্ত মুখখানিতে সবসময় মুচকি হাসি লেগেই থাকত । বলতে গেলে সেই সময়ের ওদের পুরো ব্যাচের মেয়েদের ক্রাশ ছিল আশিক । রানিদের পাড়ার প্রায় সব মেয়েই আশিক বলতে একবাক্যে চিনত । রানি নিজেও আশিককে ইমপ্রেস করার জন্য কম চেষ্টা করেনি । রোজকার পড়া কমপ্লিট করে যেত । আশিককে ইমপ্রেস করার চক্করে ইংলিশ পরীক্ষায় সেবার 94 পেয়েছিল রানি । আর প্রতিবার রানি টিউশনে ক্লাস টেস্ট গুলোতে ভালো করলেই আশিক মিষ্টি করে হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিত । আর তাতেই একসপ্তাহ পর্যন্ত চুল ধুতে চাইত না রানি । চুলে জট লেগে ময়লা হয়ে কি যে বিশ্রী হয়ে যেত । ছোট থেকে মোস্তাফিনা আর ও একি রুমে ঘুমায় । মোস্তাফিনা কত বকাবকি করেছে ওকে । কিন্তু তবুও রানি চুল ধুবে না । একপ্রকার জোর জবরদস্তি করেই মোস্তাফিনা তখন চুল ধুয়ে দিত রানির । ইস , এখন এসব মনে পড়লেই ভীষণ লজ্জা পায় রানি । একই টিউশনে পড়ার সুবাদে সম্রাট কিছু কিছু জানত । এ নিয়ে কম জ্বালাতন করেনি রানিকে । দুজনেই কোনোকিছু দিয়ে ঝগড়া লাগলেই সম্রাট আশিকের কথা বলে ক্ষেপাত রানিকে । তার পর আশিক চাকরি পেয়ে চলে গেল এলাকা ছেড়ে । আর রানিও চলে গেল শান্তিনিকেতন । এত বছর পর আজ দেখা হল সামনাসামনি । স্বাভাবিক ভাবেই এতদিন পরে আশিককে দেখে রানি চমকে গিয়েছিল । ছোটবেলার কথা গুলো মনে পড়তেই কোথা থেকে যেন একঝাঁক লজ্জা এসে জড়ো হল মুখখানিতে ।
-” পড়াশোনা কেমন চলছে রানি ?”
আশিকের ভারী স্বর শুনে রানি ভাবনার জাল ছিড়ে বাস্তবে ফেরে । বলে ,
-” ভালোই । …..আচ্ছা , তোমরা গল্প কর । আমি আসি তাহলে .. ” কোনো রকমে কথা গুলো বলেই রানি দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসে ঘর ছেড়ে । উঠোনে দাড়িয়ে একটা লম্বা নিশ্বাস নেয় । তখনি ঘাড়ের কাছে কারো গরম নিশ্বাসের সাথে পুরুষালি কন্ঠস্বর শুনে আর এক দফা চমকে ওঠে রানি ।
-” কি হয়েছে রে তোর ? এভাবে হাপানি রোগির মতো করে শ্বাস নিচ্ছিস কেন ?”
নিজেকে সামলে ঘাড় ঘুরিয়ে সম্রাটকে দেখে বেজায় ক্ষেপে যায় রানি । বলে,
-” আমাকে তোর হাপানি রোগি মনে হচ্ছে ? ”
-” হুম , সেরকমই লাগছে । এই দেখ ,এখনো তুই জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস ফেলছিস। ”
সম্রাটের কথায় রানি নিজের নিশ্বাসের গতি খেয়াল করে । সত্যি তো । এখনো বুকটা ধরপর করছে । এর কারণ কি ? ও হো । ছোট বেলায় কারো ওপর ক্রাশ খেয়ে এই বয়েসে তাকে সামনে দেখলে তো লজ্জা লাগবেই । আর হ্যাঁ , এই সাদা বান্দরকে এই কথাটা কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না যে আশিক ভাইয়ার সাথে এখন কথা হয়েছে আমার । নাহলে এর খোঁচায় জীবন থেকে শান্তি জিনিসটা পারমানেন্টলি উড়ে যাবে । নিজেকেই বুঝ দেয় রানি । তারপর চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা শ্বাস নেয় । সময় নিয়ে ছেরেও দেয় । তারপর লাবিবের ঘরের দিকে আঙ্গুল ইশারা করে বলে,
-“আসলে ওই খানে দরজার কাছে… একটা সাপ দেখলাম । তাই ভয় পেয়ে গেছি । ” চট করে কিছু খুঁজে না পেয়ে সাপের কথাই বলে রানি ।
-“সাপ ? কোথায় ? এখানে সাপ আসবে কেন ? যে কোলাহল চারিদিকে ….” লাবিবের ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাস্যের সুরে বলে সম্রাট ।
-“ছিল । এখন নেই । চলে গেছে । ঢোরা সাপ ছিল মনে হয় । ”
-” আচ্ছা যাক । শোন ডিনারের পর ছাদে পার্টি হবে । আপুকে নিয়ে আসবি । ”
-” পার্টি ?”
-“হুম আপুর জন্য ব্যাচেলর পার্টি । হ্যাঁ তবে কোনো মেনু নেই । শুকনা পার্টি হবে । ” বলে রানির মাথায় একটা চাটা মেরে বাকা হেসে চলে যায় সম্রাট । মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বিরক্তিকর দৃষ্টি নিয়ে তাকায় রানি সম্রাটের দিকে । বিরবির করে বলে ,
-“বান্দার , সাদা বক একটা । দু মিনিট ভালো করে কথা বললেই তিন মিনিটে নিজের আসল স্বভাব দেখিয়ে দেয় । ”
To be continue…