গজপ্রিয়া-9

0
426

গজপ্রিয়া-9
Chhamina Begam

– ” গুড মর্ণিং গজরানি..” নেট অন করতেই সম্রাটের মেসেজটা দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে যায় রানির । এই ছেলেটা এত খারাপ কেন ? এমনিতেই এর অত‍্যাচারে কোথাও শান্তিতে বসার জো নেই । তার ওপর এখন নতুন এক ঝামেলা শুরু করেছে । উপরি পাওনা হিসেবে যোগ হয়েছে এই সব উল্টো পাল্টা ম‍্যাসেজ ।
-“তুই আমাকে এভাবে জ্বালাস কেন বল তো ? আমার নাম টাকে আর কতবার বিকৃত করবি তুই ? আগেপিছে লেজ না জুড়লে শান্তি হয় না , না ! আর এটা কেমন শব্দ , ‘গজরানি ‘? এরকম কোনো শব্দ কি বাংলা ডিকশনারিতে আদেও আছে? ”
-” আদর করে ডাকছি তো ? রাগ করছিস কেন ? ”
-” আহা, আসছে আমার গুরুজন রে । আদর করে ডাকছি !” ভেঙচি কাটল রানি। তারপর আবার লিখল,
–” শোন সম্রাট , তুই যদি আর একবার আমার নাম টাকে এভাবে বিকৃত করিস না তাহলে দেখবি আমি কি করি । হয় শুধু রানি বলে ডাকবি নাহলে কোনো কিছুই সম্বোধন করতে হবে না …”
-” জানিস , তোর মুখে ‘শোনঅ সম্রাট ‘কথাটা শুনে আমার পেটে না প্রজাপতি উড়তে শুরু করেছে । আহা…। শোন না ,এবার থেকে আমাকে ‘তুমি’ করে ডাকবি বুঝলি । ‘তুই ‘ করে ডাকলে একদম ভালো লাগে না । আমরা তো এখন আর কাজিন নেই , তাই না । কয়েকদিন পর বিয়েও করব । আমাদের বাচ্চা কাচ্চা হবে । তখন যদি তুই আমাকে এভাবে তুই তোকারি করিস তাহলে আমার বাচ্চারা আমাকে একদম রেসপক্ট করবে না । কি ভয়ংকর ব‍্যাপার ! এত রিস্ক নেওয়া যাবে না । আজ থেকেই শুরু কর বুঝলি । একবার ডাক তো তুমি করে । শুনি আমি ..”

মেসেজটা পড়ে রানি যেন দম ফেলতেই ভুলে গেল । আল্লাহ, এত বেশরম, বেহায়া ,লুচুটাইপ ছেলে হয় নাকি ? রুমা খালামনি কত্তো ভালো । তার ছেলে কি না এরকম ! নিশ্চয়ই হাসপাতালে বদলাবদলি হয়ে গেছে । নাহলে ওয়াহিদ ,তনুজা আপা তো কত ভালো । আর এই ছেলে একনম্বরের বদ হলো কেন ?
রানি উত্তর দিলো না । নেট অফ করে বিছানা থেকে নামল । আটটা বেজে গেছে তবুও কেউ ডাকেনি ? আর এত আওয়াজ চারিদিকে তার মধ্যেও ও মরার মতো করে ঘুমালো কিভাবে ? একেবারে গোসল করে ফেলল রানি । দর্জির কাছে যেতে হবে আবার , ব্লাউজ গুলো আনতে । তাই তৈরি হয়েই বেরিয়ে এল ঘর থেকে ।

-“মামানি , চা দাও না গো । ….আজ তুমি আমাকে ডাকনি কেন ? ” চেয়ারে বসতে বসতে বলল রানি ।
-“কাল কত রাত করে ঘুমিয়েছিস মনে আছে ..”টেবিলে রাখা নাস্তার প্লেট থেকে একটা নিমকি তুলে সদ‍্য কামড় বসিয়েছে রানি মনিরার কথা শুনে জোরে শোরে একটা বিষম খেল । চকিতে তাকাল মনিরার দিকে । মামানি জানল কি করে যে আমি অনেক রাত করে ঘুমিয়েছি ?
-” এই নে “..চায়ের সাথে সন্দেশও দিল মনিরা । বলল,
-“কাল একটা অবধি তোরা ছাদে নাচানাচি করলি । আজ তো এমনিতেও ভালো ঘুম হবে না । তাই ডাকিনি ”
গোপনে স্বস্থির নিশ্বাস ফেলল রানি । তারপর চুপচাপ চা খাওয়ায় মন দিল ।
-“তুই কি কোথাও যাবি নাকি ?” জিজ্ঞেস করল জাহানারা ।
-“হ‍্যাঁ আম্মু ,দর্জির কাজে যাব । ব্লাউজ গুলো আনতে হবে । ” বলেই হাতের সন্দেশটা মুখে দিতেই যাবে ছো করে মুখে পুরে নিল সম্রাট । জাহানারার পাশে বসে আরাম করে গিলল । রানি হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। চোখ গরম করে বলল,
-“এই যে এখানে এত গুলো সন্দেশ রাখা আছে এগুলো তোর নজর গেল না । আমার হাতের টাই খেতে হবে কেন তোর ? ”
-“আমাকে তো তোর থ‍্যাঙ্কস জানানো উচিত ..তোর উপকার করলাম আমি … ”
-“ওহ হো ,তাই না । মুখের খাবার কেড়ে নিলি তার থ‍্যাঙ্কস বলব তোকে !”
-“অবশ্যই বলবি । এমনিতেই তো তুই হাফ হাতি হয়ে আছিস । এত মিষ্টি খেলে মোটা হয়ে যাবি । তখন প্রবলেম হবে আমার ” শেষের কথাটা প্রায় ফিসফিস করে বলল সম্রাট । রাগে -লজ্জায় রানির গাল-কান লাল হয়ে গেল । এত বেহায়া এই ছেলে , গুরুজনদের সামনেও এভাবে বলছে কিভাবে ? রানি অভিযোগের সুরে বলল জাহানারাকে,
-“দেখেছ আম্মু ,তোমাকে হাতি বলছে..”
জাহানারাও এতক্ষণ হতভম্ব হয়ে দেখছিলেন ওদের । চোখ গরম করে তাকালেন সম্রাটের দিকে ।
-“আরে না না । মিথ্যে বলছে ও খালামনি । তোমাকে কেন হাতি বলব ? তুমি তো এখনো কত সুন্দর আছ । ”
-“তাহলে আমাকে হাফ হাতি বললি কেন ? ইনডাইরেক্টলি তো আম্মুকেই বললি না । ”
-” সাধে কি তোকে ইমম‍্যাচিয়র বলি আমি । গাধি একটা।..আচ্ছা খালামনি , তুমি বলো তো । এখন যদি আমি একটা ছোট বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করি হাতির দেখতে কেমন ? সে ফটাফট বলে দেবে হাতির ইয়া বড় দুইটা দাত আছে । সে গুলো আমরা বলি গজদন্ত । রাইট । ”
জাহানারা মাথা নাড়ালো । মনিরাও আগ্ৰহি হয়ে শুনছে সম্রাটের কথা । সম্রাট আবার বলল,
-“তাহলে দেখ , এই রানির ও একটা ওরকম দাঁত আছে । তার মানে কি ? যার অমন দুটো দাত থাকবে সে ফুল হাতি । ওর একটা আছে তার মানে ও হাফ হাতি ”
এই পর্যন্ত শুনে জাহানারা মনিরা দুজনেই হো হো করে হেসে উঠলেন । সম্রাট মুচকি হেসে আড়চোখে রানিকে দেখে সন্দেশ খাওয়ার মন দিল । রানি শুধু থমথমে মুখ করে ওর খাওয়া দেখতে লাগল । ইচ্ছে করছে সব গুলো চুল টেনে দেয় ওর । যেমন ভাবা তেমন কাজ । খপ করে বাঁ হাতে সম্রাটের চুল মুষ্টিবদ্ধ করল রানি । সম্রাট হতভম্ব হয়ে বলল,
-” এই রানি, কি করছিস ? ছাড় না । আরে , ব‍্যাথা লাগছে তো”
-“লাগছে না । লাগুক । লাগার জন‍্যই তো ধরেছি । আজ আমি তোর সব চুল টেনে ছিড়ব ”

-“রানি, কি করছিস? ছাড় ওকে … ” ধমকালেন জাহানারা ।
-“না আম্মু । একে ছাড়ব না আমি । ও আমাকে কেন বলবে ওভাবে ?”
-“রানি ছাড় , লাগছে তো ওর “.. মনিরার কথায় মুষ্টি হালকা হল রানির । সেই সুযোগে সম্রাট চম্পট ।
-“ওই দাড়া বলছি ” শাসালো রানি ।ধাওয়া করল সম্রাটকে । দৌড়তে গিয়ে উঠোনে সম্রাটের ধাক্কা লাগল আশিকের সাথে ।
-” আরে আরে, দৌড়াচ্ছিস কেন তুই ?”
হালকা হাসল সম্রাট । বলল,
-“এমনি ..”
রান্নাঘরের দরজায় রানিকে থমকে দাড়াতে দেখে মৃদু হাসল আশিক । রানিও হাসল তবে লজ্জা পেয়ে । লুঙ্গি পড়া আশিককে দেখে ওর ভীষণ হাসি পাচ্ছে ।
-“রানি , একটা হেল্প করো তো । আমি গোসল করব । কিন্তু তোয়ালে পাচ্ছি না । ”
-” ওহ , দাড়ান । আমি বের করে দিচ্ছি । ”
বলেই রানি চলে গেল । আশিক ওকে অনুসরণ করল । খানিক বাদেই একটা নতুন তোয়ালে এনে দিল রানি । আশিক ওকে একবার আপাত মস্তক পরখ করে বলল ,
-“তুমি কি কোথাও যাবে ?”
-“হ‍্যাঁ । আমি একটু বাজারে যাব । ”
-“ওহ তোমার যদি দেরি নাহয় তাহলে একটু অপেক্ষা করতে পারবে । আমি চাচাদের ওখানে যাব । তোমাকে না হয় যাওয়ার পথে নামিয়ে দেব । ”
-“আচ্ছা । ” বলেই মৃদু হাসল রানি ।
-“ঠিক আছে । তাহলে কুড়ি মিনিট অপেক্ষা করো , আমি রেডি হয়ে নেই । ” বলেই মিষ্টি হেসে আশিক চলে গেল ।
উঠোনে দাড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আশিক আর রানিকে দেখল সম্রাট । এই স‍্যারকে এখন একদম সহ‍্য হয় না সম্রাটের । নেহাত স‍্যার বলে কিছু বলতে পারে না । তাই বলে যা খুশি তাই করবে নাকি ? বিয়ে খেতে এসেছে । চুপচাপ বিয়ে খেয়ে চলে যাবে । তা না করে লাইন মারার চেষ্টা করছে । তাও আমার সম্পদের ওপর ..। উঠোনের একপাশে বসে মৌনি মেহেন্দি লাগিয়ে দিচ্ছে ছোট বাচ্চাদের । পাশে মোস্তাফিনা , মিলি বসে আছে । সম্রাট সে দিকে এগিয়ে গেল ।

-” রানি , এদিকে আয় । আমার মেহেদী কখন লাগিয়ে দিবি ?”
-” আপু , আমি দর্জির কাছে যাব তো । মৌনি দিচ্ছে তো । ওকে বল না ..”
-” তুইই দিয়ে দে । মৌনি ব‍্যস্ত আছে । আর ব্লাউজ গুলো নিয়ে টেনশন করতে হবে না । সম্রাটকে বলেছি । ও গিয়ে নিয়ে আসবে । তুই আয়, বস এখানে ..”
অগত্যা রানিকে বসতেই হল । একবার বক্র দৃষ্টিতে তাকাল সম্রাটের দিকে । তারপর মেহেন্দি পড়াতে মন দিল । সম্রাট মনে মনে খুশি হল । যাক প্ল্যান টা তো কাজ করেছে । কিছুক্ষণের মধ্যে আশিক তৈরি হয়ে বেরিয়ে এল ।এসে রানিকে ডাকল । কিন্তু রানি উত্তর দেওয়ার আগে সম্রাট উত্তর দিল,
-“ভাইয়া , রানি যাবে না । ওর এখানে একটু কাজ আছে তো । আর দর্জির কাছে আমিই যাব । আপনি কি কোথাও যাচ্ছেন ?”

একটু থমকালো আশিক । ক্ষণিকের জন্য তাকাল রানির দিকে । রানিও দেখল ওকে । রানির সলজ্জ্ব চাহনিতে একটু আনমনা হয়ে গেল আশিক। ছোট বাচ্চার হাত থেকে খেলনা কেড়ে নিলে যেমন হাহাকার করে ওঠে বাচ্চাটা আশিকের ভেতরটা ঠিক ওই রকম করে উঠল । একটু হাসার চেষ্টা করল আশিক । সফলও হলো । সম্রাটের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“হ‍্যাঁ , চাচা ডেকে পাঠিয়েছেন । কাল তো আমায় ফিরতে হবে । তাই ভাবলাম আজ দেখা করে আসি । ..আচ্ছা আমি আসি তাহলে … ”

আশিক বেরিয়ে গেল । রানি আবার মেহেন্দি পড়াতে মনোযোগ দিল । শুধু মোস্তাফিনা আর সম্রাট আশিকের যাওয়ার পথে চেয়ে রইল । দুজনেই বুঝল আশিকের চোখের ভাষা । কারণ সাত বছর আগের রানির সমস্ত ক্রিয়াকলাপের প্রত‍্যক্ষদর্শী ছিল ওরা দুজন ।

সম্রাটের বলা কথা গুলো আশিকের একদম ভালো লাগে নি । একটু আগেও মনটা বেশ ফুরফুরে ছিল । ভেবেছিল আজ অনেকটা সময় ও আর রানি একসঙ্গে থাকতে পারবে । পুরোনো অনুভূতি গুলো একটু হলেও মজবুত হবে । ছয়-সাত বছর আগে রানি যখন ওকে অপলকে তাকিয়ে দেখত । ও বুঝত সব । রানির চপলতা ওকে খুব টানত । কিন্তু কখনো রানিকে বুঝতে দেয়নি । ভেবেছিল সঠিক সময় আসুক তখন বলবে । ততদিনে রানি পড়াশোনা শেষ করুক । কিন্তু আসলেই কি সঠিক সময় বলতে কিছু হয় ? আজ একটা কথা খুব মনে পড়ছে “চোখের আড়াল হলে মনের আড়াল হতে কতক্ষণ “। এতদিন এই কথায় বিন্দুমাত্র বিশ্বাস ছিল না । ভালোবাসা জিনিস টা কি এতই সস্তা যে চোখের সামনে না থাকলে মন থেকেও মুছে যাবে ? কখনই জুতসই জবাব টা খুজে পায় না আশিক । কথাটা সবসময় মনের মধ্যে ঘুরপাক খায় । সারাক্ষণ জ্বালিয়ে মারে ওকে । রানি হয়তো আগের কথা মনে হলে ছেলেমানুষী আবেগ ভেবে লজ্জা বোধ করে । কিন্তু ও তো সত্যি সত্যি ভালোবাসে রানিকে । এই সাত বছরে ওর জীবনে অনেকেই এসেছে গেছে । কাউকেই মনে ধরেনি । এখন সেই মনেই অমাবস্যার অন্ধকার ঘনিয়েছে । বারবার চোখের পাতায় ভেসে উঠছে কাল রাতের নাচের দৃশ্য , সম্রাট-রানির যুগলবন্ধি , ওদের একে অপরের দিকে তাকিয়ে থমকে যাওয়া । দুজনকেই একসঙ্গে বড়ো হতে দেখেছে আশিক । টিউশনে দুজনে সবসময় একে অপরকে কিভাবে টেক্কা দেওয়া যায় সেই চিন্তায় বুদ হয়ে থাকত । বিন্দুমাত্র সদ্বাব ছিল না । মাঝে মাঝে ওদের দুজনের মধ্যে মধ‍্যস্থতা করতে হত আশিককে । আর আজ দুজনে একে অপরকে …… হর্ণের আওয়াজে সম্বিৎ ফেরে আশিকের । একটা ট্রাক মুখোমুখি এগিয়ে আসছে । দ্রুত নিজের গাড়িটাকে পাশ কাটিয়ে নেয় । নিজের এলোমেলো ভাবনার জন্য আজ নির্ঘাত এক্সিডেন্ট করত । অল্পতেই বেচে গেছে আজ ।

To be continue…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here