গজপ্রিয়া~14
Chhamina_Begam
অনেকক্ষণ হলো নতুন বৌ নিয়ে বরযাত্রীরা ফিরে গেছে । কিন্তু রানিদের পুরোবাড়িটা নিঝুম পুরীর মতো নিস্তব্ধ হয়ে আছে । মুসুর বাবা ভাইয়েরা কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকার পর নিজেদের সামলে সবকিছু গোছগাছ করতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। কিন্তু মহিলাদের কান্নার রেশ থামল না । তাদের বিরামহীন কান্নার শব্দে ছোট্ট তান্নুর ঘুম ভেঙে গেলে সেও আম্মু, দাদিদের দেখাদেখি কান্না জুড়ে দিল। কান্না থামিয়ে মৌসুমী ব্যস্ত হয়ে পড়ল মেয়ে চুপ করাতে ।
নিজের ঘরে ফিরে রানি শাড়ি বদলে শুয়ে পড়ল । কিন্তু অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করেও ঘুম এল না কিছুতেই । বিছানার অন্য পাশে মুসুর জায়গাটায় বাণী হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমুচ্ছে । সেদিকে অপলকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সে। তারপর নেমে এল বিছানা থেকে । রুমের উত্তরমুখী জানালাটা খুলে দিতেই হুরমুড়িয়ে একপশলা ঠাণ্ডা বাতাস শীতল চাদর পড়িয়ে দিল রানিকে । পূর্ণিমা মনে হয় , ঝলমলে জোছনায় চারপাশের অন্ধকার সরে গিয়ে রাতের পরিবেশকে মায়াবী করে তুলেছে । রানি জানালার মোটা কার্ণিশে বসে তাকিয়ে রইল পূর্ণ চন্দ্রের দিকে । অতি সংবেদনশীল মানুষেরা ঝট করে কোনো ঘটনাকে মেনে নিতে পারে না । আকাশের দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে তাই নীরবে অশ্রু বিষর্জন করতে লাগল সে । আগের দিন রাতেও অনেক রাত অবধি গল্প করে কাটিয়েছে মুসু আর ও মিলে । আর আজ মনে হচ্ছে পুরো ঘরটা যেন ওকে একলা পেয়ে গিলে ফেলতে চাইছে । এলোমেলো ভাবনায় বাকিরাত টুকু নির্ঘুম কাটল রানির । ফলস্বরূপ পরদিন সকালে প্রচণ্ড মাথাব্যথার সাথে শরীর কাপিয়ে জ্বর এল রানির ।
শান্তিনিকেতনের হোস্টেলে থাকাকালীন বাড়ির প্রতিটি মানুষকে ভীষণ মিস করত রানি । ফোনে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বললেও যেন আশ মিটত না । কখনো ঠান্ডা লেগে সামান্য সর্দি-কাশি বা জ্বর এলেও ভালোবাসার দুটো পরশ বোলানোর মতো কেউ নেই সেখানে। হ্যাঁ, বান্ধবীরা আছে । তারা যথেষ্ট খেয়াল রাখে । কিন্তু সবাই নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য এতদূর পাড়ি দিয়ে পড়তে যায় সেখানে । একটু আধটু হলে আলাদা কথা , তবে সারা দিনভর কারো পিছনে সময় নষ্ট করার মতো যথেষ্ট সময় কারো কাছেই থাকে না । কিন্তু বাড়িতে এসে জ্বরের বাহানায় আম্মু আর মামানির মিষ্টি অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে রানি ।সেই সকালে বাণীর চিৎকারের মাধ্যমে শুরু হয়েছে অত্যাচার । এই সন্ধ্যা অবধি ক্ষণে ক্ষণে সেই অত্যাচারের রুপ বদলাচ্ছে । কত ইচ্ছে ছিল সবার সাথে সেও যাবে বৌভাত খেতে ! কিন্তু মামানি স্পষ্ট বারণ করে দিয়েছেন আজ কোথাও যাওয়া হচ্ছে না রানির । জ্বর দুপুরবেলাতেই নেমে গেলেও এখনো অবধি কি সব বিস্বাদ সুপ গিলতে হচ্ছে রানিকে ! অসহায় মুখ করে সহ্য করতে হচ্ছে সবার আদরমাখা অত্যাচার গুলো ।
কিছুক্ষণ আগেই মামানি ওষুধ খাইয়ে দিয়ে চলে গেছেন । বিছানায় এপাশ ওপাশ করে ঘুমানোর চেষ্টা করল রানি । ঘুম তো এলোই না উপরন্তু মনটা খারাপ হয়ে আছে । প্রায় ঘন্টা খানেক আগে অল্প কয়েকজন বাদে বাড়ির সবাই বৌভাতের অনুষ্ঠানে চলে গেছে । । ওখানে সবাই নিশ্চয়ই খুব আনন্দ করছে আর সে কিনা এখানে মশাদের সাথে গল্প করে কাটাচ্ছে ! মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল রানির । হঠাৎ রিংটোনের শব্দে চট করে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল সম্রাট ভিডিও কল করেছে । তৎক্ষণাৎ রিসিভ করল রানি ।
কল রিসিভ হতেই স্ক্রিনের ওপর রানির মুখটা ভেসে উঠতেই মৃদু হাসল সম্রাট । দেখল রানির লম্বা চুল গুলো আলুথালু হয়ে ছড়িয়ে আছে ঘাড়ময় । একদিনেই চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে । বড়মা জাহিদের বাড়ি যেতে বারণ করায় মুখ চুন করে বসে ছিল এক কোণে । অনুষ্ঠানে এসে থেকেই রানির শুকনো মুখটা বারবার ভেসে উঠছিল চোখের পর্দায় । তাই কল করে বসল । কমপক্ষে এই বাহানায় যদি মন ভাল হয় । বলল,
-” কিরে পেতনি , ঘুমিয়ে পড়েছিলি নাকি ? ”
সম্রাটের পিছনে বৌভাতের লোকেদের দেখে রানির মনখারাপ ইতিমধ্যে উবে গেছে । তাই আর ঝগড়া করতে ইচ্ছে করল না রানির । বলল,
-” আপু কোথায় রে ? ”
রানির উচ্ছ্বাস দেখে ভালো লাগল সম্রাটের । বলল ,
-“ওয়েট, নিয়ে যাচ্ছি । ”
সম্রাট মোস্তাফিনার কাজে গিয়ে ডাকল ,
-“আপু? ”
মুসু প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে ভ্রু নাচিয়ে তাকাল । সম্রাট হেসে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দিল নিজের ফোনটা
-“নাও কথা বলো …রানি আছে লাইনে “..
মুহুর্তেই হাসি ফুটল মুসুর মুখে । রানি আসেনি শুনে মুখ ভার করে ছিল । তারপর জ্বরের কথা শুনে উশখুশ করছিল ফোন করতে । কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিল না ।বলল,
-” এখন কেমন আছিস রানি ? শরীর কেমন ? ওষুধ খেয়েছিস ? ”
-” উফফ , ধীরে বলো আপু । আমি একদম ঠিক আছি । মামানি একটু আগেই ওষুধ খাইয়ে দিয়ে গেছে । ”
মুসু স্বস্থির নিশ্বাস ফেলল । পাশে জাহিদ ছিল । সেও কুশলাদি জিজ্ঞেস করল । রানি বলল,
-” আপু, তোকে খুব সুন্দর লাগছে আজ ..”
-“শুধু তোমার আপুকেই সুন্দর লাগছে ? আর আমাকে ? ” রসিকতা করল জাহিদ । হাসল রানি বলল,
-” না না । তোমাদের দুজনকেই ভালো দেখাচ্ছে একসঙ্গে । তবে আপুকে একটু বেশি সুন্দর লাগছে..”
-“ওহ, তাই বুঝি “.. মন খারাপ করার ভান করল জাহিদ ।
-“হ্যাঁ , একদম । দেখতে হবে না আপু টা কার ? রানির আপু বলে কথা । যেনতেন লাগবে…. তার চান্সই নেই ”
রানির কথায় হেসে উঠল সবাই । এরপর অতিথিরা আসলে তাদের সাথে ভাব জমাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল জাহিদ-মুসু । সম্রাট ঘুরে ঘুরে পুরো বাড়ি দেখাল রানিকে । একসময় রানির সাড়াশব্দ না পেয়ে সম্রাট দেখল পুরো স্ক্রিনে ঘরের সিলিং দেখা যাচ্ছে । সম্রাট দুবার ডাকল রানিকে । কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না । হাসল সম্রাট । ভাবল , রানি নিশ্চয়ই ফোন অন রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছে ।
ইতিমধ্যে দুটোদিন পেড়িয়ে গেছে ।আত্মীয় স্বজনরা সবাই বিদায় নিয়েছে ।শুধু রয়ে গেছে বাণী । কিছুদিন আগেই ও নতুন ক্লাসে ভর্তি হয়েছে । তাই পড়ার চাপ কম ।বিলকিস থাকতে চেয়েছিল কিন্তু সামনে ওর ফাইনাল পরীক্ষা । তবুও পড়াশোনায় ফাকিবাজ মেয়ে বাড়ি ফিরতে নারাজ । তাই একপ্রকার জোর করে ওকে সাথে নিয়ে গেছে জাহানারা । সকালে খাওয়া দাওয়ার পর বাড়ির পাশে আমতলায় আড্ডা বসিয়েছে রানি আর কাজীনরা মিলে । গল্পের মধ্যমনি হয়ে আছে মুসু আর জাহিদ । ওরা আর কয়েকদিন পর বাড়ি ফিরবে । এই কয়েকদিন আশপাশটা ঘোরাঘুরি করা বা আত্মীয়দের বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করেই কেটে যাচ্ছে ওদের । অতিরিক্ত জামাই আদরে হাসফাঁস অবস্থা হলেও না করার জোর নেই জাহিদের। তাই নিয়ে মৌসুমী রসিকতা করছে ওর সাথে । সাথে তাল দিচ্ছে সম্রাট । এই দুজনের রসিকতায় নাজেহাল অবস্থা জাহিদের । আর একটু দূরে বসে মুসু, ফাহিম আর রানি মিলে চুপচাপ মজা নিচ্ছে । তান্নু একটা বাশের কঞ্চি হাতে নিয়ে মুরগি ধাওয়া করছিল । খেলতে খেলতে একটু দূরে চলে যাওয়ায় রানি উঠে দাড়ায় ওকে নিয়ে আসতে । তান্নুর একটা বাজে অভ্যাস আছে । খোলা চুল দেখলেই হাতে নিয়ে পেচাতে শুরু করে । তাই রানি নিজের খোলা চুল গুলো হাত খোপা করতে করতে এগিয়ে গেল তান্নুর দিকে । তখনি মৌসুমীর দৃষ্টি পড়ে ওর পিঠের দাগ গুলোর ওপর । ভ্রু কুচকে তাকায় । রানি তান্নুকে নিয়ে ফিরে আসলে মৌসুমী হাত বাড়িয়ে মেয়েকে কোলে নিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করে ,
-“রানি, তোমার পিঠে কি হয়েছে ? এত মোটা দাগ পড়ল কিভাবে ? কবে লেগেছে ”
মৌসুমীর থেকে মাত্র দুহাত দুরেই বসেছিল সম্রাট । আস্তে করে কথাটা বললেও স্পষ্ট শুনতে পেল সে । চেয়ারে বসেই ঘাড় সামান্য হেলিয়ে দেখল রানিকে । তারপর আবার মন দিল ফাহিমের কথায় ।
রানি প্রায় ভুলেই গিয়েছিল পিঠের দাগটার কথা । প্রথম দিন গোসল করার সময় একটু জ্বললেও পরে আর কিছু মনে হয়নি । আর আচড় লাগা জায়গায় যে দাগ পড়ে যেতে পারে সেটা মাথাতেই আসেনি । কিন্তু এখন মৌসুমীর কথায় ঘাবড়ে গেল । আড়চোখে একবার সম্রাটকে দেখল । তৎক্ষণাৎ চোখাচোখি হয়ে গেল দুজনের । রানি কি বলবে ভেবে পেল না । তখনই চোখ পড়ল তান্নুর হাতের কঞ্চিটার দিকে । জোর করে হেসে বলল,
-” ওহ …ওটা । আর বোলো না । তুমি তো জানোই আমাদের ক্যাম্পাসে কেমন গাছপালায় ভর্তি ।ওখানেই লেগেছে । আমার ফ্রেন্ড পুজার কথা বলেছিলাম না । ওর সঙ্গে গল্প করতে করতে হেটে ফিরছিলাম হোস্টেলে । দুজনেই অন্যমনস্ক ছিলাম । মোড় ঘুরতেই সামনে টোটো চলে আসে আর পুজা আমাকে টেনে সরিয়ে আনতে গেলে ওর নখের আচড় লেগে ছিলে গেছে । পড়ে গিয়েছিলাম দুজনেই রাস্তার পাশে , ওর ও ডান হাতের কুনুইয়ে ছিলে গিয়েছিল অনেকটা জায়গা । ”
রানির সাফাই শুনেও মৌসুমী ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ । রানির বুকের ভেতরে ভয়ে দামামা বাজছে । রানি সন্দিগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখল মৌসুমী কে । ভাবি এমন করে তাকিয়ে আছে কেন ? তিনি কি আদেও কথাটা বিশ্বাস করেছেন ? মনে তো হচ্ছে , করেছে । না, করে নি । করলে এভাবে তাকাত না । তিনি আবার কোনো প্রশ্ন করবেন না তো ? করলে কি জবাব দেবে ভাবতেই গলা শুকিয়ে এল সম্রাটের । ও আরো একবার আড়চোখে দেখল সম্রাটকে । কেমন মিটিমিটি হাসছে দেখ বেয়াদব টা । হাড় বজ্জাত একটা । আমাকে বিপদে ফেলে হাসছিস তো । দাড়া ,তোর হাসি আমি বের করব এবার । একবার খালি মুক্তি পাই এই সিচুয়েশন থেকে। তারপর তোকে আমি দেখে নেব । মনে মনে আরো কিছুক্ষণ হয়তো গজ গজ করতো রানি , বিঘ্ন ঘটল তান্নুর কান্নায় । ওর খাওয়ার সময় হয়েছে । মৌসুমী ব্যস্ত হয়ে পড়ল মেয়েকে নিয়ে । এই প্রথম তান্নুর কান্না শুনে খুশি লাগল রানির । মনে মনে ধন্যবাদ জানাল তান্নুকে। বলল, থ্যাঙ্ক ইউ তান্নু সোনা । এই যে তোমার আন্নি প্রমিজ করছে তোমাকে অনেক গুলো চকলেট কিনে দেবে …..”
To be continue..