গজপ্রিয়া~18(অন্তিম পর্ব-প্রথম অংশ)

0
802

গজপ্রিয়া~18(অন্তিম পর্ব-প্রথম অংশ)
Chhamina_Begam

রেলস্টেশনের ওয়েটিং রুমের চেয়ারে বসে আছে রানি । ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে দেখছে একে একে বেরিয়ে যাওয়া ট্রেনগুলোকে । যাত্রীদের মধ্যে কেউ বা অপেক্ষা করছে পরবর্তী ট্রেনের জন্য ,কেউ বা ঘরে ফিরছে , কেউ বা ভীড় ঠেলে ছুটতে ছুটতে ট্রেন ধরতে চাইছে । হকারদের আনাগানা , ভিখিরি বাচ্চাদের ছোটাছুটি , অ্যানাউন্সমেন্টে এক মহিলা কিছুক্ষণ পর পর যান্ত্রিকতার সঙ্গে ট্রেনের গতিবিধি – সময়সীমা সম্বন্ধে যাত্রীদের অবহিত করার চেষ্টা করেছেন। সবাই নিজের নিজের ছন্দে ব‍্যস্ত । শুধু রানির নিজেকে উদ্বাস্তু বলে মনে হচ্ছে । যার জীবনের প্রতিটি সুর কেটে গেছে , ছন্দপতন ঘটেছে স্বাভাবিক গতিতে । চিন্তা ভাবনা গুলো থমকে আছে যেন । এতদিন নিজেকে যথেষ্ট চালাক মনে করতো রানি । কিন্তু কাল বিকেলের পর থেকে নিজেকে গবেট ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছে না । ‘ অনুভূতি ‘ নামক বস্তুটির পাল্লায় পড়ে এমন একটা দুঃসাহসিক কাজ করে ফেলতে পারে এ যেন আলাদিনের ঔ আশ্চর্য প্রদীপটি খুঁজে পাওয়ার মতো । অথচ মানবদেহের যে অঙ্গটির দোহাই দিয়ে মানুষের এত কারসাজি , এত লুকোচুরি সেই হৃৎপিণ্ড নামক যন্ত্রটির কাজ শুধু মাত্র রক্ত সঞ্চালন বই তো কিছু নয় । অথচ এর প্রভাবেই রানির সাজানো জীবনের ভিত নড়বড়ে হয়ে গেল । হিসেব গুলোই গড়মিল ধরতে পেরে যখন আবার প্রথম থেকে কষতে শুরু করল তখন বুঝলো পুরো অঙ্কটাই ভুল কষেছিল সে ।

একদিন আগে …

কয়েকদিনের বিরতিতে রানিদের বাড়িতে আবার সাজসাজ রব উঠেছে । ছোট করে অনুষ্ঠান করবে ভেবেও অনেক লোককে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে । সকাল থেকেই রানির একটা প্রবাদ মনে পড়ছিল ‘অতি আদরে স্বভাব নষ্ট ‘। কিন্তু ওর ক্ষেত্রে একটু পরিবর্তন হয়েছে । আর তা হলো ‘ অতি আদরে অনুভূতির অপমৃত্যু’ । যখন থেকে বিয়ে ঠিক হয়েছে তখন থেকে মামা , মামানি , লাবিব ভাইয়া সবাই বেশি বাড়াবাড়ি রকমের আদর করছে । যদিও এতে অভ‍্যস্ত রানি কিন্তু এবার এই আদরের কারণটা যে ওর বিয়ে এই কথা টা মনে হতেই অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে । জোর করে হাসতে গিয়ে চোয়ালের সাথে সাথে মনেও ব‍্যাথা হচ্ছে । কিন্তু এই ব‍্যাথার কারণটা ওর অজানা । বাইরে কারো আওয়াজ শুনলেই কান খাড়া করে শুনছে কিন্তু প্রত‍্যেকবার নিরাশ হতে হচ্ছিল রানিকে ।নিজের এই অসঙ্গত আচরণে নিজেই বেশ বিরক্ত সে। বারবার ধমক লাগাচ্ছে নিজেকে তবুও দুচোখ বেহায়ার মতো কাউকে খুজছে । না পেয়ে বিমর্ষ হচ্ছে তবুও অপেক্ষা করছে । কিন্তু কে সেই ব‍্যক্তি ? কাকে দেখার জন্য সে এতটা উতলা ? অনেক খুঁজেও মনের আয়নার তার স্পষ্ট কোনো অবয়ব ফুটে উঠলো না । শুধু হালকা এক ঝাপসা অবয়ব ধীরে ধীরে মুছে যেতে লাগল ।

-” আম্মা , শুনলাম ছোট চাচির নাকি প্রেসার ফল করেছে । ”
মৌসুমীর চিন্তিত কন্ঠস্বরে চিন্তার সুতো ছিড়ে গেলে সচকিত হয়ে কান খাড়া করল রানি । শুনতে পেল মামানি বলছে ,

-” হ‍্যা, আমিও দেখে এলাম । কাল থেকেই নাকি রুমার শরীরটা ভালো না । সম্রাটের চিন্তায় চিন্তায় নিজে অসুস্থ হয়ে পড়েছে । ভাগ‍্য ভালো যে ভাইজান তখন বাড়িতে ছিল । তাড়াতাড়ি করে ডাক্তারকে ফোন করেছে । না হলে যে কি হতো ? ”
সম্রাটের নামটা শুনেই রানির মনে হল এতক্ষণ যে অস্থিরতা ওকে নীরবে ঘায়েল করে যাচ্ছিল মুহুর্তেই যেন তার অবসান ঘটল । মনে হল যেন এই মাত্র কেউ ওর অশান্ত মনের ওপর দিয়ে এক পশলা শীতল বাতাস বইয়ে দিল । কয়েকবার বিরবির করে উচ্চারণ করল নামটা । আবার কান খাড়া করল রানি । মামানি তখনো একা একাই বিরবির করে বলছিলেন ,
-‘ আর সম্রাট ,কি যে হয়েছে ছেলেটার ? কালকেই তো কত হাসি খুশি ছিল । আর আজকেই চোখ মুখ শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গেছে । কত করে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে ? বলল না । রুমা বলছে কাল রাত থেকেই নাকি না খেয়ে আছে । বিছানায় শুয়ে শুয়ে কি যে আকাশ পাতাল চিন্তা করছে সেই জানে ?’
-” আম্মা , আমি তাহলে একবার দেখে আসি চাচিকে । ”
-“যাবে ? যাও তাহলে ।পারলে একবার সম্রাটকে জিজ্ঞেস করো তো কি হয়েছে ওর ? ”
-“হুম ”
-” ভাবি , চলো আমিও যাই তোমার সাথে । ” মৌসুমীকে বেরিয়ে যেতে দেখে রানি নিজেও উঠে এল ।
-” তান্নু কোথায় ? ”
-” ও বাণির সাথে খেলছে ”

রানি আর মৌসুমী গিয়ে দেখল রুমা শুয়ে আছেন বিছানায় । ডান হাতটা দিয়ে চোখ ঢেকে রাখা । মৌসুমী কিছুক্ষণ থেকেই চলে এল । কারণ লাবিব ফোন করছে অনবরত । ও চলে যেতেই রুমা রানির হাত ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন । রানি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল । এই পরিস্থিতিতে পড়লে কি করতে হয় বুঝতে পারল না । শুধু দুহাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে রাখল রুমার হাত টা । রুমার একবার মনে হল রানিকে বলবে আর একবার এই বিয়েটা নিয়ে ভেবে দেখতে । কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে স্বার্থপর মনে হতে লাগল । নিজের ছেলের জন্য তিনি অন‍্যের মেয়ের স্বপ্ন ভাঙতে চাইছিলেন । রানি নিশ্চয়ই পছন্দ করে আশিককে । নাহলে তো সম্মতি দিত না । নিজের চিন্তা ভাবনার জন্য নিজেকে ধিক্কার জানালেন মনে মনে । কিন্তু তবুও তিনি মা তো । নিজেকে এমন ভাবনা থেকে বিরত রাখতে পারলেন না । তার অমন স্বাস্থ্যসচেতন ছেলেটা কাল রাত থেকে একটা দানাও মুখে দেয়নি । একজন মায়ের জন্য এই বিষয়টা যে কতটা কষ্টের সেটা শুধু ভুক্তভোগীরাই জানে । বললেন ,
-” রানি ?”
-” হ‍্যাঁ খালামনি , ….কিছু বলবে ?”
ইতস্তত করতে করতে রুমা বলেই ফেলল ,
-” রানি , তুই কি সত্যি আশিককে বিয়ে করতে চাস ? ”

রানি যেন একটা ধাক্কা খেল প্রশ্নটা শুনে । ওর কান যেন এই প্রশ্ন টা শোনার জন‍্যই অধীর আগ্ৰহে অপেক্ষা করছিল । বিচলিত বোধ করল রানি । নিজেকেই প্রশ্ন করল সে । সত্যি কি আমি আশিক ভাইয়াকে বিয়ে করতে চাই ? যদি হ‍্যাঁ, তাহলে আমি খুশি হতে পারছি না কেন ? কিসের কষ্ট আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে? কেন এত অস্বস্থি হচ্ছে ? রুমা দেখল রানির হাতটা হালকা কাপছে । চোখের দৃষ্টি অস্থির । কিছু একটা ভেবে দুবিধায় পড়েছে । রুমা বুঝল রানি সীমান্তহীনতায় ভুগছে। আরো কিছুক্ষণ থেকে রানি উঠে চলে গেল । রুমা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওর চলে যাওয়ার দিকে । বিরবির করে বলল, আমাকে ক্ষমা করিস রানি । নিজের ছেলের জন্য আমাকে একটু স্বার্থপর হতেই হলো । আমি জানি আমার এই প্রশ্নটা তোকে শান্তিতে থাকতে দেবে না । কিন্তু আমি নিরুপায় । আমার ছেলেকে চিনি আমি । সে তোকে কতটা চায় দেরিতে হলেও আমি তা বুঝতে পেরেছি । ছোটবেলা থেকেই ও যা চেয়েছে তা এনে দেবার যথাসাধ্য চেষ্টা আমি করেছি । কিন্তু এবার ও তোকে চেয়েছে । আমি চাইলেও তোকে এনে দিতে পারব না । কারণ তুই কোনো বস্তু নোস । তুই রক্তমাংসের একটা মানুষ । তোর মন আছে । অন‍্যের অনুভূতি বোঝার মতো ক্ষমতা তোর আছে । তাই আমি শুধু চেষ্টা করতে পারি। যদি তোর হৃদয়ে আমার ছেলের জন্য কিছু থেকে থাকে তাহলে তোকে তা অনুভব করতে হবে । আর যদি না থাকে তা হলে সেটা ওর ভাগ্য । আমি চাই না ভাইজানের এই রকম হটকারি সিদ্ধান্তের জন্য ভবিষ্যতে তোরা কেউ কষ্ট পাস । একটু পর সম্রাটের চিৎকার শুনতে পেলেন তিনি । কিন্তু রুমা উঠল না । চোখ বুজে ডাট হয়ে শুয়ে রইলে বিছানায় ।

সম্রাটের ঘরের দরজার সামনে দাড়িয়ে ভেতরে ঢুকবে কি ঢুকবে না ভেবে ইতস্তত করতে লাগল রানি। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেও সম্রাটকে দেখার অদম‍্য ইচ্ছেটাকে দমন করতে পারল না । দরজা ভেজানো ছিল । নব ধরে হালকা ঠেলতেই খুলে গেল । রানি দেখল পুরো ঘর অগোছালো হয়ে পড়ে আছে । তার মাঝেই সম্রাট চিৎ হয়ে শুয়ে আছে বিছানায় । ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে দেখছে সিলিংয়ে ঘুরতে থাকা ফ‍্যানটাকে । দরজা খোলার শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার রানিকে দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নিল । রানি নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে মেঝেতে পড়ে থাকা টি-শার্টটা তুলে হ‍্যাঙারে ঝুলিয়ে রাখল । এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে দুটো সিগারেটের প‍্যাকেট আর আধ খাওয়া কতকগুলো সিগারেটের অংশ । সেগুলো পেরিয়ে রানি মেঝেতে পড়ে থাকা কলম ,পেনসিল গুলো তুলে কলমদানিতে রাখতে রাখতে বলল,
-” কি হয়েছে তোর? কেন করছিস এসব ? ”
সম্রাট জবাব দিল না । পাল্টা প্রশ্ন করল ,
-“কেন এসেছিস এখানে ? ”
-” তোর চিন্তায় খালামনি অসুস্থ হয়ে পড়ছে । সেদিকে খেয়াল আছে তোর ? ”
রানির কথায় তড়িৎ গতিতে শোয়া থেকে উঠে বসল সম্রাট । রানির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল ,
-” আমাকে ছাড়া বাকি সবার কথা খেয়াল থাকে তোর তাই না ? সবার জন্য চিন্তা হয়? এখন তো আশিক ভাইয়ার জ‍ন‍্যেও ভাবছিস হয়তো ? শুধু আমিই তোর গোনায় ছিলাম না কখনো ? ”

সম্রাটের লাল হয়ে যাওয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল রানির । তবুও চোখ সরালো না সে । রানি দেখতে পেল সম্রাটের রাতজাগা চোখ দুটিতে ডার্ক সার্কেলের আড়ালে এক বিষন্নতার গল্প , এক মন ভাঙার গল্পের প্রেক্ষাপট । সেই চোখ দুটো একরাশ আকুতি নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে । হঠাৎ করেই কোথা থেকে যেন দলা পাকানো কষ্টরা এসে ভীড় করতে লাগল রানির হৃদয় অন্তপুরে । মনের আয়নার ঝাপসা অবয়বটা ধীরে ধীরে প্রকট হয়ে উঠছিল । রানি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল । এটা কিভাবে সম্ভব ? এই অবাধ্য, জেদি, রগচটা ছেলেটার জন্য ওর কষ্ট হচ্ছে কেন ? যেই সাহস আর মানসিক স্পৃহাকে সঙ্গে করে সে এখানে এসেছিল তা মুহুর্তেই কর্পূরের ন্যায় উবে গেল । তবুও কোনোরকমে উচ্চারণ করল কয়েকটি শব্দ,
-” এসব পাগলামির মানে কি সম্রাট ?”
সম্রাট অগ্নি দৃষ্টি মেলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল রানির দিকে । তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই রানিকে টেনে নিয়ে গিয়ে চেপে ধরল দেয়ালের সাথে । হতচকিয়ে গেল রানি । বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সম্রাটের দিকে ,
-” আহঃ সম্রাট , কি করছিস ?ছাড় আমাকে ? ”
রানি কসরত করেও যখন সম্রাটকে সরাতে পারল না উল্টে বাহু বন্ধনী আরো শক্ত হল , তখন তীব্র ঝাঝের সঙ্গে বলে উঠল,
-” সম্রাট , এসব কি ধরনের বেয়াদবি ? লাগছে আমার । ছাড় আমাকে ”
সম্রাট ছাড়ল না । রানির দিকে কড়া দৃষ্টি মেলে বলল,
-” আমার অনুভূতি তোর পাগলামি মনে হয় রানি? ”

সম্রাটের মুখে নিজের নামটা উচ্চারিত হতে শুনল রানি । আজ এই প্রথমবারের মতো ওর মনে হল এই ডাকে সে পাহাড়ি খরস্রোতা নদীর মতো ছুটে আসতে পারে । কি মেশানো ছিল ওই ডাকটায় ? মায়া , মমতা , আদর নাকি ভালোবাসা ? নাকি সবকিছুই ? এ কেমন অদ্ভুত সমীকরণ সম্পর্কের ? সম্রাটের কড়া চোখের দৃষ্টি আস্তে আস্তে বদলে যেতে দেখল রানি । মন কেমন করা অন্তর্ভেদি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রানিকে বলল,
-” আমি কাছে এলে কি কোনো অনুভূতি জাগে না তোর ? ”

সম্রাটের জড়ানো কথাগুলোয় রানির নিজের ভেতর ভাঙন টের পেল রানি । যে সম্রাট কি না নিজের পছন্দের জিনিস আদায় করতে কখনো আপোষ করে না । সেই সম্রাটের কন্ঠস্বর এমন করুণ !না । এভাবে মানায় না তাকে । সে উদ্ধত , তেজি রূপেই গ্রহণীয় । নিজের মুখের ওপর সম্রাটের নিশ্বাস পড়তেই গতকালের মতোই জমে গেল রানি । ও দেখল ওদের মাঝে শুধু কয়েক ইঞ্চির দুরত্ব মাত্র । ঘোর লাগানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সম্রাটের চোখের দিকে । সম্রাট এতটা কাছে দাড়িয়ে আছে যে রানি স্পষ্ট ওর হৎস্পন্দনের শব্দ শুনতে পাচ্ছে । সম্রাটের চোখের গভীরতায় ডুব দিতে গিয়ে রানি নিজের অজান্তেই ডান হাতটা দিয়ে আলতো করে স্পর্শ করল সম্রাটের বক্ষস্থলে , ঠিক হৃদয়ের ওপরে । শঙ্কিত হয়ে আবার তাকায় সম্রাটের চোখের দিকে । এত স্পিডে চলছে কেন ওর হৎস্পন্দন ?

-” সম্রাট ছাড় আমাকে । ভুলে যাস না কাল আমার আকঁদ । প্লিজ ছাড় ….”

রানির করূণ কন্ঠস্বর শুনে থমকে যায় সম্রাট । মুহুর্তেই মনে পড়ে রানি নিজেই সম্মতি দিয়েছে এই বিয়েতে । তখনি এক ঝটকায় সরে আসে রানির পাশ থেকে । নির্দিষ্ট দূরত্বে দাড়িয়ে গমগমে কন্ঠস্বরে বলল,
-” গেট লস্ড ..”
-“সম্রাট.. ” রানি করুণ দৃষ্টিতে তাকাল সম্রাটের দিকে ।
রানিকে তখনও দাড়িয়ে থাকতে দেখে এবারে চিৎকার করে উঠল সম্রাট,
-” কথা কানে যায় না তোর ? কি বলেছি আমি ? যেতে বলেছি না ? চলে যা না এখান থেকে ।আমি তোর মুখ দেখতে চাই না । প্লিজ গোওও । ..কি হল দাড়িয়ে আছিস যে? আমাকে না জ্বালালে তোর শান্তি হয় না , না । ঠিক আছে , কাল তোর আকঁদ তো । আমি নিজে দাড়িয়ে থেকে তোর বিয়ে দেব । তাহলে শান্তি পাবি তো । এখন প্লিজ চলে যা । আর আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দে , প্লিইইজ । ”
কয়েক পা পিছিয়ে গেল রানি । ঝাপসা চোখে তাকিয়ে দেখল ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া ছেলেটাকে । এই মুখ ফিরিয়ে নেওয়াটাই যেন দগদগে ঘা সৃষ্টি করল রানির হৃদয়ে ।

বাঁ হাতে লুকিয়ে চোখের জল টুকু মুছে ফিরে দেখল রানি তখনো ঠায় দাড়িয়ে আছে । টলটলে চোখ দুটো দিয়ে যখন তখন বৃষ্টি নামবে । বলল,
-” দরজা খোলা আছে রানি । প্লিজ চলে যা । আর আমার বিহেভিয়রে নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছিস তুই । তার জন্য সরি । এই বেয়াদব ছেলেটা আর কোনো বেয়াদবি করার আগে তোকে অনুরোধ করছে প্লিজ চলে যা এখান থেকে ”

রানি বেরিয়ে যেতেই হাতের কাছে গিটারটা পেয়ে জোড়ে আছাড় মারল সম্রাট । মরমর শব্দে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল গিটারটা । কয়েক মুহূর্ত বাদে আবার কাচ ভাঙার শব্দ পেল রানি । চমকে পিছন ফিরে তাকালেও ফিরে গিয়ে দেখার মতো মনের জোর পেল না । এলোমেলো পা ফেলে একগুচ্ছ প্রশ্ন মনের মাঝে জমিয়ে তখনকার মতো ফিরে এলো সে ।

রোজ খাওয়াদাওয়ার পর সিগারেটে টান দেওয়া অনেক দিনের বদ অভ‍্যাস ফাহিমের । আজও তাই বেরিয়ে ছিল । দুটো টান দেওয়ার পরেই ডাক্তার কাকুকে বেরিয়ে যেতে দেখল সম্রাটদের বাড়ি থেকে । অবাক হল সে । একটু আগেই বাড়ি ফিরেছে সে । সম্রাটদের বাড়ির কাহিনী তার অজানা । তাই এক পা দু পা করে এগিয়ে গেল । গিয়ে দেখল রুমা চাচি একা একা বকবক করতে করতেই সম্রাটের ঘরের দিকে যাচ্ছে । হাতে একটা জলের বোতল আর কিছু খাবার । ফাহিম জিজ্ঞেস করল ,
-“কি হয়েছে চাচি ? আপনি কাকে বকছেন ?”
ফাহিমকে দেখে রুমা মলিন হাসি হাসল । বলল,
-” কাকে আবার !আমার সুপুত্র একজন আছে না । তাকেই । মহারাজ যত সব উৎপটাং কাজকর্ম করে নিজেকে জখম করে বসে আছেন । আর আমি তো আছিই তাদের সেবা যত্ন করতে । এমনিতেই বাতের ব‍্যাথায় নড়তে চড়তে পারি না । তার ওপর এদের যত জ্বালা ..”
আক্ষেপ করতে করতে রুমা সম্রাটের ঘরে গেল । ফাহিম অনুসরণ করল ওনাকে । দেখল হাতে আঘাত পেয়ে বসে আছে । ডাক্তার ব‍্যান্ডেজ বেধে দিয়ে গেছেন । রুমা সম্রাটকে ওষুধ খাইয়ে বেরিয়ে গেলে ফাহিম চেয়ার টেনে বসে সম্রাটের সামনে ।
-” কি ভাবে হল এসব ?”

সম্রাট জবাব দিল না ‌ শুধু কয়েক পলক নিস্পৃহ দৃষ্টি মেলে ফাহিমকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিল অন্য দিকে । ফাহিম কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে বলল,
-“নিজেকে কষ্ট দিয়ে কি লাভ সম্রাট ? তার থেকে ওকে ভালো করে বললেই তো পারিস । আর তুই যদি না পারিস তাহলে আমি বলি । এখনো সময় আছে সম্রাট । বুঝিয়ে বললে নিশ্চয়ই বুঝবে ও । ”
-” সুপারিশ করার দরকার নেই ভাইয়া । রানি বোকা নয় । যথেষ্ট ম‍্যাচিয়র সে । ও যদি নিজে বুঝতে না চায় তাহলে আর বলে কি হবে ? ”
-“সুপারিশ কেন বলছিস ? ও হয়তো সত্যি বুঝতে পারেনি । সবাই সব কিছু বুঝতে পারে না সম্রাট । সবাই নিজের অনুভূতি নিয়ে সচেতন থাকে না । রানিও তাদের মধ্যে একজন …… ”
ফাহিমকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে সম্রাট বলল,
-“থাক না ভাইয়া এসব । আমার ভালো লাগছে না আর । ভাইয়া , আমরা কাল কথা বলি কেমন? ”

সম্রাটের অভিমানী কন্ঠস্বর শুনে ওকে আর ঘাটাল না ফাহিম । বলল,
-” আচ্ছা , ঠিক আছে । তুই রেস্ট নে । আমি গেলাম …”

সেই মুহূর্তে রানি সম্রাটদের ওখান থেকে চলে এলেও কোথাও শান্তিতে দু-দন্ড বসতে পারল না । এক অসহনীয় পীড়া ওর মনপ্রাণ আচ্ছন্ন করে রাখল সারারাত ব‍্যাপি । ঘুমের সাথে তো আড়ি হয়েই গেছে ইতিমধ্যে । পরদিন লাল চোখের সাথে ডার্ক সার্কেল এবং নিষ্প্রভ মুখখানা দেখে রে রে করে উঠল বিলকিস । প্রায় জোর জবরদস্তি করে টেনে নিয়ে গেল পার্লারে । মামাকে বলে গেল দুপুর হতে হতেই ফিরে আসবে ওরা । কিন্তু দুপুর গড়িয়ে যখন বিকেল হল তবুও ফিরে এল না তখন লাবিব ফোন করল রানিকে ‌ । বারবার ফোন করার পরও রানির নম্বর সুইচ অফ শোনাচ্ছে ।

মেহমানদের জন্য মিষ্টির প‍্যাকেট নিতে এসেছে লাবিব । ফোনের রিংটোন শুনে কার্টনটা ফাহিমের হাতে দিয়ে কল রিসিভ করল । ওপাশ থেকে বিলকিসের আদ্র কন্ঠস্বর ভেসে আসল ,
-” ভাইয়া, আপুকে পাওয়া যাচ্ছে না । ”
-“পাওয়া যাচ্ছে না মানে কি ? কোথায় এখন ও? ”
-” জানি না ভাইয়া । আমরা পার্লারে এসেছিলাম । আপু আমাদের বলল ওর কি যেন একটা দরকার কাছে । বলেই বেরিয়ে গেছে । আর ফেরেনি । আমি আর বানি সেই তখন থেকে খুজছি । কিন্তু পাচ্ছি না । আপুর ফোন ও সুইচ অফ বলছে । ”
বিলকিসের কথায় মাথা ঘুরে উঠল লাবিবের । টাল সামলাতে না পেরে পরেই যাচ্ছিল ফাহিম তাড়াতাড়ি ধরে ফেলল ।

সন্ধ্যা গড়িয়ে এখন রাত্রি তার অন্ধকারের সাম্রাজ্য বিস্তার করার প্রানপন চেষ্টা করছে । কিন্তু স্টেশনের সোডিয়াম আলোর বন‍্যা সেই চেষ্টায় একপশলা জল ঢেলে দিয়েছে । এতক্ষণ নিশ্চয়ই খোজাখুজি শুরু হয়ে গেছে !আচ্ছা , মামা কি রেগে আছে ওর ওপর ? আর মামানি , আম্মু ওরা কি কান্না করবে ? না খুঁজে পেয়ে নিশ্চয়ই কেদেকেটে একাকার হবে ?বিয়ের আনন্দের পরিবর্তে কান্নার রোল উঠছে হয় তো সারাবাড়িতে। কিন্তু তবুও ফিরে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না রানি । আর না সামনে এগিয়ে যাওয়ার অদম্য স্পৃহা জাগছে মনে । তখন কি ভেবে , কেন এভাবে ছুটে এসেছিল ঠিক মনে পড়ছে না । শুধু একটা কথাই বারবার মনে হচ্ছিল এখান থেকে পালাতে হবে । সম্পর্ক গুলোকে বোঝা মনে হচ্ছিল । যা না চাইতেও জোর করে চেপে বসতে চাইছে ওর ওপর । তাই তো ওভাবে পড়িমরি করে ছুটে এসেছিল । যেন এখান থেকে পালিয়ে গেলেই সব কিছুর সমাধান হবে । কিন্তু মামাকে কষ্ট দিয়ে , তার সম্মান নষ্ট করে নিজের শান্তির ঠিকানায় লুকোতে মন সায় দেয়নি । এমন অদ্ভুত দোলাচলে কখনও নিজেকেও পড়তে হবে এ তো ভাবনার অতিত ছিল । তবুও এমনটা হলো । নিয়তি টেনে নিয়ে গেল তার অতল গহ্বরে । এ যেন হওয়ার ছিল । না হলে যে ছেলেটিকে দু চোখে সহ‍্য করতে পারত না সে আজ কিনা তারই জন্য নিজের প্রিয়জনদের চোখের জলের কারণ হলো ।ছোটবেলায় হলে সম্রাটের এই গর্হিত কাজের জন্য ওকে কয়েক ঘা লাগিয়ে দিত । হ‍্যাঁ, সম্রাট যা করেছে , তা অত্যন্ত গর্হিত একটি কাজ । ওর উচিত হয়নি সারাক্ষণ রানিকে বিরক্ত করা , ওর উচিত হয়নি যখন রানি রেগে থাকত তখন হাসানোর চেষ্টা করা । ওর উচিত হয়নি রানিকে সারাক্ষণ প্রোটেক্ট করার চেষ্টা করা , ওর উচিত হয়নি ওভাবে কাছে আসা , ওভাবে চুমু দেওয়া, ওকে বকে দেওয়া , রানিকে গজরানি বলা। কিচ্ছু উচিত হয়নি । সব ভুল ছিল । আর এই ভুল গুলো মনের অজান্তেই কখন ওর অনুভূতি, ওর ইচ্ছে-অনিচ্ছে , ওর ভালোলাগা , ওর মন , ওর সমস্ত ইন্দ্রিয়ের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেছে বুঝতে পারেনি রানি । সত্যি বুঝতে পারেনি । আর যখন বুঝল তখন ওর সাথে আর একজনের নাম জুড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে ।

হাতে ধরা বোলপুরের টিকিটটা একবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল রানি । একটু আগেই বেরিয়ে গেছে ট্রেনটা স্টেশন ছেড়ে । রানি উঠে বসেছিল তাতে ।সিটে বসে মামা ,ভাইয়াদের করুন মুখটা বারবার ভেসে উঠছিল চোখের পাতায় । তাই ট্রেন ছাড়ার আগ মুহুর্তে আবার নেমে পড়েছে । রাত গভীর হচ্ছে । ফুটপাতের বাচ্চা গুলোও বার দুয়েক ওর কাছে এসেছিল । ব‍্যাগে কিছু চকলেট ছিল । সব বিলিয়ে দিয়েছে ওদের মধ্যে । যাত্রীরা অনেকেই ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে ওর দিকে । হয়তো ভাবছে প্রেমিকের অপেক্ষা করছে , অথবা প্রেমিক ধোকা দিয়ে পালিয়ে গেছে । হয়তো ফিরে যাওয়ার উপায় নেই । তাই বসে বসে কান্না করছে । একজন বৃদ্ধা মহিলা তো কথায় কথায় অনেক গুলো উপদেশ ও দিয়ে গেছেন । কথা গুলো মনে পড়তেই মলিন হাসি হাসল রানি । রাত কটা বাজে এখন ? ফোনটাও সাথে নেই । কোথায় পড়েছে কে জানে ? আচ্ছা সম্রাট কি আমাকে খুঁজছে । নিজের চিন্তার ধরণ দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল রানি । সম্রাট কেন খুজবে ? ও তো মুখ দেখতে চায় না রানির ।

বিকেল থেকে তন্ন তন্ন করেও খুজেও যখন রানির খোঁজ মিলল না তখন মৌসুমী বলল থানায় ডায়েরি করতে । ফাহিম জানাল চব্বিশ ঘন্টা না পেরলে থানায় ডায়েরি করা যায় না । সব আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে একে একে ফোন করে দেখল কেউ বলতে পারছে না রানির খবর । বিয়ে বাড়ি মুহুর্তেই শোকসভায় পরিনত হয়েছে । মনিরা, জাহানারার সাথে বিলকিস-বানিও ডুকরে ডুকরে কাঁদছে । একদিকে বিলকিস বারবার নিজেকে দোষারোপ করছে কারণ ওর জোরাজুরিতেই রানি পার্লারে যেতে রাজি হয়েছিল । আর অন‍্যদিকে মনিরা বেজায় ক্ষেপে আছেন স্বামীর ওপর । কারণ তার হটকারিতার জন‍্যই এমনটা হয়েছে বলে মনিরার ধারনা । লাবিবের বাবা খবরটা শোনার পর থেকেই পাথরের মূর্তিতে পরিনত হয়েছেন । কি জানি কি হয়েছে মেয়েটার সাথে ? আজকাল তো কত কিছুই হচ্ছে ! কেউ কিডন‍্যাপ করেনি তো আবার ? তিনি আর ভাবতে পারেন না । মাথা ঘুরছে তার । চোখে মুখে অন্ধকার দেখছেন । হাই ব্লাড প্রেশারের রোগী তিনি । শশুরকে টলতে দেখে মৌসুমী দৌড়ে আসে । ধরে বসিয়ে দেয় চেয়ারে ।

সবাই যখন হয়রান হয়ে আছে , কোনো কুলকিনারা পাচ্ছে না তখন বানি ছুটে যায় সম্রাটের কাছে । ওর বিশ্বাস হয়তো ভাইয়াই পারবে মেজপাকে খুঁজে বার করতে । সদ‍্য ওয়াহিদের মুখে রানির নিখোঁজ হওয়ার কথা শুনেছে সম্রাট । শোনার পর থেকেই কতক্ষণ ঝিম মেরে বসে ছিল ।নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না । বারবার জিজ্ঞেস করেও যখন ওয়াহিদের কাজে একি জবাব শুনল তখন দিশাহারা হয়ে পড়ল । কোনো রকমে গায়ে টিশার্ট গলিয়ে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে । মনে মনে রানিকে প্রশ্ন করল ,
– কোথায় তুই রানি ? তুই ঠিক আছিস তো ?”

To be continue…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here