গল্পঃডাবর,পর্বঃপ্রথম
লেখাঃসিহাব হোসেন
“কংগ্রাচুলেশনস,আপনি মা হতে চলেছেন”
ডাক্তারের মুখে কথাটি শোনার সাথে সাথে ইরার চোখ মুখ খুশিতে উজ্জল হয়ে উঠলো।ইরার স্বামী ইরফান খুশি ইরাকে সেখানেই জড়িয়ে ধরলো।ইরা তখন বেশ লজ্জা পেলো।দুইজন ডাক্তারের চেম্বার থেকে বাইরে বের আসতে ইরফান বলল
->শোনো জানপাখি আজ থেকে তুমি আর কোন কাজ করতে পারবে না বুঝেছো?
->উম,আমি কাজ না করলে কে কাজ করবে শুনি?
->আরে তোমার বর আছে কি জন্য।
->বাব্বাহ বউয়ের জন্য এত দরদ।বাচ্চাটা হয়ে গেলেই তো আর দরদ থাকবে না।
ইরফান ইরার দুই গাল আলতো করে টেনে বলল
->আমার দশটা না পাঁচটা না একটাই আমার বউ আমি তাকে ছাড়া আর কাকে দরদ দেখাবো শুনি।
->আর কাউকে দেখানোর ইচ্ছা করে মেরে তক্তা বানিয়ে দিবো।
->আচ্ছা বাবু চলো এখন বেশ রাত হয়েছে।
ইরফান ইরাকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো।নির্জন রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে,ইরফান গাড়ি চালাচ্ছে আর ইরা পিছনের সিটে চোখ বন্ধ করে বসে আছে।ইরফান গাড়ি নিয়ে একটা ব্রিজের ওপর এসেছে এমন সময় সে কিছু বুঝে উঠার আগে কোথায় থেকে এক সাদা পোশাক পরিহিত লোক হাতে কিছু একটা নিয়ে দৌড়ে এসে গাড়ির সামনের গ্লাসে আঘাত করলো।শব্দ পেয়ে ইরা চোখ খুললো।ইরফান গাড়ি ব্রেক করতে গাড়ি গিয়ে রাস্তার পাশে খুটির সাথে ধাক্কা খেলো।ইরফান বেশ আঘাত পেলো।ইরাও সামনে সিটের বাড়ি খেলো কিন্তু কোনমতো নিজেকে সামলে নিলো।আর একটু হলে গাড়িসহ দুইজনই গভীর খাদে পড়ে যেতো।
ইরফান তাড়াতাড়ি করে নিজের সিট বেল্ট খুলে গাড়ি থেকে নেমে ইরাকে বলল
->তুমি ঠিক আছো তো?কোন আঘাত লাগেনি তো?
->আমি ঠিক আছি।তুমি ঠিক আছো তো?
->হ্যাঁ ঠিক আছি।
ইরফান ইরা কে নিয়ে গাড়ি থেকে নামলো।আকস্মিক এমন ঘটনায় দুইজনেই অবাক।ইরফান সেই লোকটিকে খুঁজতে লাগলো।ইরা তখন বলল
->হঠাৎ কি করে এমন হলো?
->আমি গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলাম এমন সময় কোথা থেকে একটা লোক দৌড়ে এসে গাড়ির গ্লাসে আঘাত করলো।এখন সেই লোকটিকে দেখছি না।
ইরা নিজেও এদিক ওদিক দেখতে লাগলো কিন্তু কোথাও কোন লোককে দেখতে পেলো না।
এমন সময় পাশ দিয়ে একটি গাড়ি যাচ্ছিলো।ইরফান আর ইরা কে দেখে গাড়ি চালানো লোকটি একটু দুরে গিয়ে গাড়ি থামালো।তারপর গাড়ি থেকে একটু মাথা বের করে ইরফানকে উদ্দেশ্য করে বলল
->ভাই কোন কি সমস্যা হয়েছে নাকি?
->হুমম ভাই।আমার গাড়ির নিচে মনে হচ্ছে কেউ একজন চাপা পড়েছে।
লোকটি এটা শোনার পর মুখটা মলিন করে বললেন
->ভাই কেউ আপনার গাড়ির নিচে চাপা পড়েনি।এটা ছিলো একটা বিপদ সংকেত।
->আপনার কথাটা ঠিক বুঝলাম না?
->কোন ব্যাপার না বুঝিয়ে বলছি।যখন কারো জীবনে কোন বিপদ আসতে চলে তখন এই ব্রিজ দিয়ে কেউ গেলে তার ওপর এমন আকস্মিক হামলা হয়।তাই এটা নিয়ে না ভেবে আপনার সামনে থাকা বিপদ নিয়ে ভাবুন।
ইরফান কথাটি শুনে বেশ অবাক হয়ে বলল
->এটা কি করে সম্ভব?
->এটাই সম্ভব।আপনাদের মতো এরকম যাদের সাথে হয়েছে তাদের সবার এই একই অবস্থা হয়েছে।
এই বলে লোকটি গাড়ি নিয়ে চলে গেলো।ইরা দুরে দাড়িয়ে থেকে লোকটির কথা শুনছিলো।ইরফান ইরার সামনে আসতেই সে বলল
->লোকটি যেটা বলছিলো এরকম সত্যি কি কোন বিপদ আসতে পারে আমাদের?
->না তো।
->তোমার ব্যবসা সবকিছু ঠিক মতো চলছে তো নাকি?
->হ্যাঁ এসব নিয়ে কোন বিপদ নেই।তুমি চিন্তা করো না এখন বাসায় চলো।
ইরা আর কথা বাড়ালো না।ইরফান ইরাকে নিয়ে বাসায় চলে আসলো।বাসায় এসেই ইরফান ওর মা রাহেলা বেগমকে ওদের নতুন অতিথির খবর জানালো তখন তিনি হেসে উঠেই মুখটা কেমন যেন মলিন হয়ে গেলো।তখন ইরা রাহেলা বেগমের কাছে এসে বলল
->মা আপনি কি আমাদের সন্তানের জন্য খুশি নন?
তখন রাহেলা বেগম হেসে উঠে বলল
->আমি খুব খুশি মা।কিন্তু,,,,,।
->কিন্তু কি?
->কিছু না মা তুমি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।আর ইরফান তুমি একটু পরে আমার রুমে এসো কেমন জরুরি কথা আছে।
এটা বলে রাহেলা বেগম নিজের ঘরে চলেন গেলেন।ইরার কেমন জানি ওর শাশুড়িকে ঠিক লাগছে না।এমনি দিনে যেকোন কথা ইরার সামনেই বলে কিন্তু আজ কি এমন কথা বলবে যেটা ওর সামনে বলা যাবে না।সে যাইহোক মা-ছেলের আলাদা কথা থাকতেই পারে কিন্তু তারপরেও ইরার মনে হচ্ছে উনি এই বাচ্চার জন্য খুশি নন।ইরফান ইরাকে চুপ করে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বলল
->কি ভাবছো?
->কিছু না তো।
ইরা ফ্রেশ হয়ে আসলো।তারপর তিনজনে একসাথে খাওয়া দাওয়া করলো।ইরফানের বাবা ছয় মাসের মতো হলো মারা গেছেন।এখন ওরা মাত্র তিনজনই এই বাড়িতে থাকেন।ইরফানের সাথে ইরার দুই বছর হলো বিয়ে হয়েছে।বিয়ের আগে আড়াই বছরের সম্পর্ক ছিলো ওদের।তারপর পারিবারিক ভাবে বিয়েটা হয়।ইরফানদের টাকা পয়সার কোন অভাব নেই।
খাওয়া শেষে ইরা শোবার জন্য বিছানা ঝাড়ছিলো আর ইরফান সোফায় বসে ফোন টিপছে।বিছানা ঝাড়া শেষে ইরা বালিশের সাথে হেলান দিয়ে আধ শোয়া ভাবে শুয়ে একটা বই হাতে নিয়ে পড়তে লাগলো।হঠাৎ সে বই পড়া বন্ধ করে ইরফানকে বলল
->আচ্ছা তোমার কি মনে হয় মা কি আমাদের সন্তান আসার খবরে বেজার।
ইরফান তখন ফোনের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে ইরার দিকে তাকিয়ে বলল
->আরে পাগলি বেজার হবে কেন?তার নাতি-নাতনি আসবে এটা তো অনেক আনন্দের খবর।
->হুমম তারপরেও ওই ব্রীজের ওপরের ঘটনা আর মায়ের মুখ মলিন দুটোই কেমন জানি ভাবাচ্ছে।
ইরফান সোফা থেকে উঠে ইরার পাশে এসে বসলো।তারপর এক হাত ইরার গালে রেখে বলল
->তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছো এমন কিছু হবেনা দেখো।আর এখন এমন দুশ্চিন্তা করার মা বাবু দুইজনের জন্য ক্ষতিকর।
এটা বলে আলতো করে ইরফান ইরার পেটে টোকা মারলো।ইরা মুচকি হাসলো।ইরফান ইরার গালের টোল পড়া অংশে দুটো চুমু দিয়ে ওকে শুয়ে দিলো।তারপর বলল
->তুমি শুয়ে থাকো আমি মায়ের সাথে দেখা করে আসি।
->আচ্ছা।
ইরফান ওর মায়ের রুমের সামনে এসে বলল
->মা আসবো?
->হ্যাঁ বাবা ভিতরে এসো।
ইরফান রুমে গিয়ে দেখলো ওর মাকে কেমন যেন বিষন্ন দেখা যাচ্ছে।ইরফান ওর মায়ের কাছে বসে বলল
->মা তোমাকে কেমন যেন চিন্তিত দেখাচ্ছে এই খবর শোনার পর থেকে কারনটা কি?
->সেজন্য তোমাকে ডেকেছি।কিন্তু কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না আমি।
->না মা বলো কোনো সমস্যা নেই।
->আমি আর তোর বাবা একজনের কাছে ঋণী?
->কার কাছে মা?আর কত টাকা ঋণ?
->এটা কোনো টাকার ঋন নয় বাবা,এটা অন্য কিছু দিয়ে শোধ করতে হবে।
->সেটা কি পরিষ্কার করে বলো তো আম্মু?
->ঠিক আছে তাহলে শোন।আজ আমাদের যে এত সম্পদ এসব কিছুই আগে আমাদের ছিলো না।তোর বাবা আর দাদারা ছিলো কৃষক।আর অত্যন্ত গরীব।অন্যের জমিতে চাষ করে যা পেতো তাই দিয়ে সংসার চলতো।তবে তোর বাবাকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন ছিলো তাই তো তিনি ধার দেনা করে তোর বাবাকে পড়াশোনা শেখায়।তোর দাদা মনে করতো তোর বাবা চাকরি পেয়ে এসব ঋন শোধ করে দিবে।কিন্তু দুর ভাগ্য তোর বাবা শহরে এসে চাকরি খুজেও কোথাও চাকরি পেলো না।এদিকে তোর বাবার আমার সাথে ছোট বেলা থেকে সম্পর্ক ছিলো।তার কোন কাজ না থাকায় না পারছিলো আমায় বিয়ে করতে না পারছিলো তোর দাদার করা ঋণ শোধ করতে।তাই তোর বাবা শহরে এসে নিজেই আবার চাষাবাদ শুরু করে।হাস মুরগির খামার দেয়।সেই সাথে আমাকেও বিয়ে করে।অভাবের সংসারে সুখেই ছিলাম আমরা কিন্তু দেনাদার দিনকে দিন চাপ দিয়ে চলছিলো আমাদের।তোর দাদা অনেক আটকে রেখেছে কিন্তু একসময় সবাই ধৈর্যহারা হয়ে যায়।তোর দাদা এসব টেনশনে হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়।এরপর সব দেনা তোর বাবার ঘাড়ে এসে পড়ে।তোর বাবা মানুষের জমিতে চাষ করে যা পেতো তা দিয়ে দেনা দিতো।এর মধ্যে তুই আমার গর্ভে এলি।তখন যেন তোর বাবার চিন্তা আরো বেড়ে গেলো।কিন্তু সেবার আমাদের অনেক ফসল হয়েছিলো কিন্তু হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড়ে এক রাতে সব নষ্ট হয়ে গেলো।আমাদের জীবনে নিমিষে ঘোর অন্ধকার নেমে এলো।তোর বাবা এখন কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলো রাতে বেলা আমায় নিয়ে গ্রাম ছেড়ে পালাবে।শহরে গিয়ে আয়রোজকার করে তারপর একদিন গ্রামে এসে সব দেনা পরিশোধ করবে।কিন্তু সেটা কি আদৌও সহজ হবে।শহরে তো কাজ পাওয়া খুব কঠিন তখনকার সময়।কিন্তু এছাড়া আর উপায়ও নেই।আমিও তাতে রাজি হলাম।যেদিন আমার চলে যাবো তার আগের দিন স্বপ্নে দেখি আমাদের কোণার ঘরের একপাশে গোল হয়ে মাটি ফেটে গেছে।আমি সেগুলো পরিষ্কার করার জন্য সরাতে দেখি,সেখানে অসংখ্য টাকার নোট সোনা,রুপা হিরা আমি তো সেটা দেখে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি।আমি একের পর এক টাকা গুলো নিয়ে আমার আঁচলে ভরছি।আর হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়।এটা স্বপ্ন ছিলো ভাবতেই নিমেষে মন খারাপ হয়ে গেলো।আমি উঠে বসতে যাবো আর তখনই মনে হলো আমার গায়ের ওপর থেকে কি যেন পড়লো।আমি ভয় পেলেও মনে সাহস করে হারিকেন জ্বালিয়ে যা দেখলাম তাতে একদম চমকে গেলাম।আমি স্বপ্নে যতগুলো টাকা তুলেছি সে সমস্ত টাকা মেঝেতে পড়ে আছে।আমি তখনই তোর বাবাকে ডাক দিলাম।তোর বাবাও এমনটা দেখে চমকে গেলেন।আমরা এই টাকা গুলো নিয়ে রেখে দিলাম।তারপর হারিকেন হাতে ওই ঘরে গিয়ে দেখলাম সত্যি সত্যি সেখানে অসংখ্য টাকা আর সোনা হিরা রয়েছে।আমরা দুইজনে এসবে লোভে পড়ে নিতে যাবো এমন সময় এক গায়েবি আওয়াজ এলো,কেউ একজন বলে উঠলো,এসব টাকা তোমরা পাবে,তবে এর জন্য তোমাদের কিছু দিতে হবে?আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম,কি দিতে হবে?তখন জবাব এলো,একটা পাঠার তাজা রক্ত দিতে হবে অর্থাৎ তোর রক্ত দিতে হবে?আমি সাথে সাথে টাকা গুলো ফেলে দিলাম।তখন আমি বললাম,দরকার নেই আমার টাকার?তখন জবাব এলো,টাকা গুলো না নিলে তোমরা মারা যাবে,কারন এটাই তোমাদের হাত পড়েছে,লোভী হাতে যে এটাকে স্পর্শ করে এই টাকা-সম্পদ তার পিছু ছাড়ে না।যদি তোমার সন্তানকে না দাও তবে তোমার সন্তানের প্রথম যে সন্তান আসবে তাকে তোমার দিতে হবে।
আর আমরা তখন লোভে পড়ে তাতেই রাজি হয়ে গেলাম।এরপর থেকে আমাদের কোনো অভাব হয়নি।আমরা শহরে চলে আসি।তারপর তোর জন্ম হয়।আমরা খুব সুখেই তো ছিলাম।আমাদের টাকা কখনো কমেনা।একটা কলস উঠে এসেছিলো সেখান থেকে যেটা টাকা পয়সা সোনা গোহনায় ভর্তি থাকে।ওখান থেকে যত টাকাই নিইনা কেন তৎক্ষনাৎ সেটা পূর্ন হয়ে যায়।আর আজ থেকে দুই মাস হলো আমি আবারো সেই গায়েবি আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি।সে বার বার তার ঋণের কথা স্মরন করিয়ে দিচ্ছে।
ইরফান হেসে উঠলো তারপর বিদ্রুপ করে বলল
->যদিও এটা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।তারপরেও মা কিভাবে এমনটা করতে পারলে?আমি যেমন তোমাদের কাছে প্রিয় ঠিক আমার সন্তান আমার কাছে প্রিয়।
->বাবা ওইরকম পরিস্থিতিতে পড়লে তুইও এমনটা করতি।নিরুপায় ছিলাম আমরা।
->সে যাইহোক মা আমি আমার সন্তানের কোন ক্ষতি হতে দিবো না।এতে যদি আমার সব সম্পত্তি শেষ করতে হয় আমি তাতেই রাজি।
এই বলে ইরফান চলে আসলো।
চলবে,,,,,,