গল্পঃবর্ষণ_মুখর_দিন,পর্ব_০৪

0
727

গল্পঃবর্ষণ_মুখর_দিন,পর্ব_০৪
লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

এবার অন্তত বিয়েটা করে আমাদেরকে নাতি-নাতনির মুখ দেখা।
খাবার চিবোতে চিবোতে নিয়াজ বলল,এখনো অনেক সময় পড়ে আছে।
নিয়াজের বাবা বেশ শক্ত কন্ঠেই বললেন,সময়টা আর কোথায় রইলো?বয়সতো আর কম হলোনা।ত্রিশ ছাপিয়ে যাচ্ছে।বুড়ো হয়ে যাচ্ছো।নিয়াজের মা মাংসের বাটি ধপ করে টেবিলের উপর রেখে থমথমে মুখে বললেন,আমরা মরলেই তোমার ছেলে বিয়ে করবে।
নিয়াজ খাওয়া থামিয়ে দিয়ে বলল,বিয়ে করলেই তোমরা খুশি?
নিয়াজের মা খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন,তুই বিয়ে করবি বাবা?
নিয়াজ গম্ভীর মুখে জবাব দিলো তোমাদের বউমা দরকার বিয়ে করে তোমাদের বউমা এনে দেবো।এর থেকে বেশি কিছু আমার কাছে আশা করো না।তারপরেও মরার কথা মুখে নিবে না।
মিসেস রেনু হেসে মনে মনে বললেন,আগে বিয়েটা করো বাবাজান।বাকিটা তোমাকে দিয়ে বউমাই করিয়ে নেবে।
খাবার শেষ করে নিয়াজ নিজের ঘরে যেতেই নিয়াজের বাবা ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,যাক অবশেষে ছেলে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে।

নিয়াজ ফোনের স্ক্রিনে একটা ছবির দিকে অপলক চেয়ে আছে।এই ছবির মেয়েটার মাঝেই নিয়াজ নিজের মন হারিয়ে বসে আছে।কোনো এক বৃষ্টিভেজা দিনে নিজের প্রেয়সীকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলো নিয়াজ।ফাঁকা রাস্তায় ছাতা বন্ধ করে ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফেরার দৃশ্য এখনও নিয়াজের চোখে ভাসছে।সেদিনের পর কতবার যে লুকিয়ে লুকিয়ে সেই রমনীকে দেখেছে নিয়াজ তার ইয়াত্তা নেই।দুদিন সেই রমনীকে না দেখতে পেয়ে নিয়াজের যেন পাগলপ্রায় অবস্থা।পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে।খবরটা শুনে নিয়াজের পুরো পৃথিবী থমকে গিয়েছিলো সেদিন।প্রথম যেদিন নিয়াজ তার প্রেয়সীকে দেখেছিলো সেদিনই লুকিয়ে তার একখানা ছবি নিজের ফোনের ক্যামেরায় বন্দি করে নেয়।সেই থেকে প্রতিরাতে এই ছবিটি দেখেই চোখের তৃষ্ণা মেটায়।মানুষটা তার না হোক কিন্তু তার জন্য বরাদ্দকৃত ভালোবাসাটাতো মিথ্যে নয়।ঘুম না আসা পর্যন্ত নিয়াজ ছবিটার দিকেই তাকিয়ে থাকবে।এটা নিত্যদিনকার রুটিন হয়ে গেছে।যেন ছবির এই মেয়েটিকে একদিন না দেখলে ঘোরতর অন্যায় হয়ে যাবে নিজের সাথে।
বাবা মায়ের পছন্দমতো বিয়ে করবে ঠিক কিন্তু মনের সবটা জুড়ে এই মেয়েটার বিচরণ থাকবে।মনের কোন জুড়ে এই মেয়েটার পদচারণা চলতে থাকে প্রতিনিয়ত।মেয়েটাকে যখন স্বশরীরে নিজের আশেপাশে দেখে তখন ইচ্ছে করে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখে বলতে ভালোবাসি!
কিন্তু একটাই সংশয় সেটা হলো মানুষটা এখন অন্যকারো।তাকে ছুঁয়ে দেওয়ার অধিকার নিয়াজের নেই।

রাতের খাবার শেষ করে জারা ফোনটা হাতে নিয়েছে।উদ্দেশ্য বাড়িতে ফোন করে কথা বলা।তখনই মায়ের নাম্বার থেকে কল আসায় জারা মুচকি হেসে রিসিভ করে সালাম দেয়।
জারার মা সালামের উত্তর দিয়ে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন কেমন আছিস মা?
আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।তোমরা সবাই কেমন আছো?
জবাবে জারার মা বললেন সবাই ভালো আছে।তারপর জারার মা বেশ উসখুস করতে লাগলেন।
জারা বলল,মা কিছু বলতে চাইছো তুমি।তাই এতটা ফর্মালিটি না করে কি বলতে চাও বলে ফেলো।
এবার জারার মা থেমে যাওয়া কন্ঠে বললেন,আসলে কায়ার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে।ছেলে আর কায়া দুজন দুজনকে নাকি আগে থেকেই পছন্দ করে।ছেলে তার বাড়িতে জানিয়েছে উনারা আমাদের বাড়িতে প্রস্তাব পাঠিয়েছে।বেশ ভালোঘর থেকেই প্রস্তাব এসেছে।এখন তোর চাচা চাইছে বিয়েটা দিয়ে দিতে।এরকম ভালোঘর পেলে কোন বাবাই বা বসে থাকবে।

জারা বলল,সবাই যেহেতু রাজি তাহলে বিয়েটা দিয়ে দিলেই পারো।জারার মা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বললেন,কিন্তু ঘরে বিবাহ উপযুক্ত বড় চাচাতো বোন রেখে কিভাবে ছোটবোন কে বিয়ে দেবো?
জারা ভ্রু কুচকে বলল,তা তোমরা কি করতে চাইছো বলোতো?
জারার মা বললেন তোর বাবা আবারো তোর জন্য ছেলে দেখছে।ভালো সমন্ধ পেলেই দুবোনের বিয়ে একসাথে দিয়ে দেবে।
জারা চমকে উঠে বলে কি বলছো এগুলো?কিছুদিন আগেই একটা বিয়ে ভেঙেছে।আমি এখন চাকরি নিয়েছি।অন্তত অনার্স পরীক্ষার আগে আমি এসব তোমাদের কাছে আশা করিনি।

জারার মা অনুনয়ের স্বরে বললেন,তুই রাগ করিস না।তোর বাবাতো এমনই মানুষ।তবে উনি বলে দিয়েছেন তোর পড়ালেখায় অমত পোষণ করে এমন পরিবারে তোর বিয়ে দেবেনা।এখন তোর চাচা চাইছে কায়ার বিয়েটা দিয়ে দিতে।যদি তোকে রেখে কায়াকে বিয়ে দিতে যাই তাহলে গ্রামের মানুষ কানাকানি শুরু করবে।তোর বাবা গ্রামের একজন গন্যমান্য ব্যক্তি।
জারা মায়ের কথা শুনে থম মেরে বসে আছে।মায়ের কথার উত্তরে কি বলা উচিত ওর জানা নেই।তবে বাবার কথার উপর কথা বলার সাধ্য জারার নেই।ছোটবেলা থেকেই একমনে বাবার সবকথা শুনে এসেছে।মুহিত হাসান ও কখনো মেয়ের কোনো ইচ্ছা অপূর্ণ রাখেন নি।কোনো জিনিসের জন্য মুখ ফুঁটে বলার দেরি মেয়ের সামনে সেই জিনিসটা এনে হাজির করতে দেরি হয়না।
জারার ভাবনার মাঝেই ওর মা আবার বলে উঠে,বিয়েটা ১৫ দিনের মধ্যেই সেরে ফেলতে চায় ছেলেপক্ষ।জারার এখন কথা বলতে ভালো লাগছেনা তাই মাকে বলল,তোমার সাথে পরে কথা বলবো আমার এখন ঘুম পাচ্ছে।
ফোনটা টেবিলের উপর রেখে জারা রান্নাঘরে গেলো চা বানাতে।কড়া করে এক কাপ চা বানিয়ে বারান্দায় একটা টুল টেনে বসলো।পাশের বারান্দা থেকে ফিসফিসানির আওয়াজ শুনে জারা তাড়াতাড়ি চা শেষ করে রুমে চলে আসে।গিয়েছিলো চা নিয়ে একটু একা একা বারান্দা বিলাস করবে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তাসিন সারারাত ধরে আজ বারান্দায় নিজের প্রেম চালিয়ে যাবে।গার্লফ্রেন্ডের পড়ার চক্করে প্রতিদিন ঠিক করে কথা বলতে পারেনা বেচারা।সপ্তাহে একদিন রাতের অর্ধেক সময় ধরে দুজনে কথা বলে।আর তাসিনের কথা বলার ঐতিহাসিক জায়গাটা হলো বারান্দা।

তাসিন তার গার্লফ্রেন্ড রাহিকে বলছে,আচ্ছা জারার চাকরির খবরটা তোমাকে কে দিলো?
রাহি বলল,আসলে ভাইয়া এসে জারার কথা বললো ও চাকরি করবে কি না?ওর বন্ধুর অফিসে নতুন লোক নিয়োগ দিচ্ছে।ভাইয়া বারবার জারার কথা বলায় আমি তোমাকে বলেছিলাম জারার জন্য চাকরি পেয়েছি।
তাসিন ভাবুক হয়ে বলল,তোমার ভাই হঠাৎ জারার চাকরির জন্য উঠেপড়ে লেগেছে কেনো?
রাহি বিরক্ত হয়ে বলল,উফ!সেটা তুমি ভাইয়াকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো না।এখন কথা বলার সময় পাচ্ছো ঠিক করে কথা বলছো না।পরে পুরো সপ্তাহ ঘ্যানঘ্যান করবা আমি তোমাকে সময় দিই না।
তাসিন বলল,আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে জারার কথা বাদ দিলাম।

সকালে জারা ঘুম থেকে উঠে নামায পড়ে তিনকাপ চা বানিয়ে এককাপ খালুকে দিয়ে আরেককাপ খালার ঘরে দিয়ে আসলো।এককাপ নিজের জন্য রাখলো।জারার খালু সকালে মসজিদ থেকে এসেই সোফায় বসে থাকেন চায়ের জন্য।নাস্তা খাওয়ার আগ অব্দি কয়েক কাপ চা উনার খাওয়া হয়ে যায়।এত চা খায় বলে রাজিয়া বেগম কথা শুনাতে ছাড়েন না।তাই জারাকে দেখলে চুপিচুপি জারার কাছে চা চায়।চা টা শেষ করে হাতের কাপটা ধুয়ে সকালের নাস্তা বানানোতে হাত লাগায় জারা।মাঝেমাঝেই জারা সকালের নাস্তা অনেকসময় দুপুরের রান্নাটাও করে ফেলে।রাজিয়া বেগম না করলেও জারা শুনেনা।
নাস্তা বানানো শেষ করে যারা গোসল করে নেয়।চুলার গরমে একেবারে ঘেমে গেছে।
সবার নাস্তা খাওয়া প্রায় অর্ধেক শেষ জারা এসে নিজের প্লেটে একটা পরোটা আর ভাজি নিয়ে খাওয়া শুরু করলো।তাসিন আজ এখনো নিচে আসেনি।কচ্ছপের মতো ধীরে ধীরে আজকে নিচে নামবে।যেদিন রাতে কথা বলে তারপরের দিন ঘুমের কারণে উঠতে কষ্ট হয়।তখন আস্তে আস্তে ঢুলতে ঢুলতে নিচে নামবে।অফিসে গিয়েও বসের কাছে ঝাড়ি খাবে।

ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরে জারা কিছুক্ষণ শুয়েছিলো।কখন যে চোখটা লেগে গেছে বুঝতেই পারেনি।ঘুম ভাঙে রাজিয়া বেগমের ডাকে।ফোন হাতড়ে সময় দেখে ১ঃ২০ মিনিট বাজে।তড়িঘড়ি করে ফ্রেশ হয়ে নামাযটা পড়েই অফিসের জন্য বেরিয়ে পড়ে।দুপুরের খাবার খেতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে।বাসার সামনে থেকে একটা রিকশা নিয়ে অফিসে চলে আসে।অলরেডি পাঁচ মিনিট লেইট।তাড়াহুড়ো করে অফিসে ঢুকতেই কিছুর সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে যেতে নেয়।চোখমুখ খিঁচে সামনে যা পায় সেটাই আঁকড়ে ধরে পড়া থেকে বাঁচার জন্য।অকস্মাৎ সামনের ব্যক্তির শার্ট চেপে ধরায় সে টাল সামলাতে না পেরে জারার কোমর শক্ত করে ধরে দাঁড়ায়।কোমরে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ মেলে তাকায় জারা।নিয়াজকে সামনে দেখে ওর শার্ট ছেড়ে দিয়ে সিটকে দূরে সরে যায়।অস্বস্তিতে মাথা নিচু করে নেয় জারা

নিয়াজ কপট রাগ দেখিয়ে বলল,দেখে হাটতে পারেন না।এমনিতে ও পাঁচমিনিট লেইট করে এসেছেন।
জারা মাথা নিচু করে বলল,সরি স্যার!
সবাই কাজ ফেলে রেখে সার্কাস দেখছে।নিয়াজ সবাইকে একটা ধমক দিয়ে নিজের কেবিনে চলে যেতেই এশা এসে জারাকে চেপে ধরে বলল,এতগুলো দিন এখানে আছি নিয়াজ স্যারের পাশে ঘেষতে পারলাম না।আর তুমি কিনা আসতে না আসতেই একেবারে বুকের কাছে চলে গেলে।এই তোমার ট্রিকসটা আমাকেও একটু শিখিয়ে দিও।
জারা বিরক্ত হয়ে বলে,ট্রিকস মানে?আপনি দেখলেন আমি পড়ে যাচ্ছিলাম।
এশা বলল,হ্যা সেটাইতো বলছি।এরকম পড়ে যাওয়ার ট্রিকস আমাদের শিখালেও পারো।
জারা আর কথা না বাড়িয়ে নিজের কেবিনে এসে বসে কাজে মন দেয়।
আজকে আর নিয়াজের কাজে মন বসবেনা।নিজের কেবিনের সাথে সংযুক্ত বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।জারার স্পর্শ পেয়ে কেমন যেন মনটা বিষিয়ে উঠেছে।কি হতো যদি জারার বিয়েটা না হতো?

চলবে…….।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here