গল্পঃবর্ষণ_মুখর_দিন,পর্ব_০৯,১০

0
755

গল্পঃবর্ষণ_মুখর_দিন,পর্ব_০৯,১০
লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
পর্ব_০৯

নিয়াজের খুব অভিমান হলো জারার উপর।মেয়েটা একটাবার খোঁজ নিলোনা আমি কেমন আছি?হসপিটালে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত ওর দায়িত্ব শেষ?একবার অন্তত ফোন করতে পারতো।যতবার নিজেকে বুঝানোর চেষ্টা করছে অভিমান গুলো যেন মাথাচাড়া দিয়ে পাহাড়সম হচ্ছে।হুট করে মনে পড়লো জারার কাছে আমার নাম্বার আছেতো?সেদিনতো কল দিলাম এই মেয়ে মনে হয়না আমাকে চিনতে পেরেছে।

নিয়াজ নিজেই জারার নাম্বারে ডায়াল করে।ওমা বারবার বিজি শোনাচ্ছে।নিয়াজের মেজাজটাই বিগড়ে গেলো।এই মেয়ে এতক্ষণ ধরে কার সাথে কথা বলছে?
যতবার কল দিচ্ছে ততবারই বিজি দেখাচ্ছে।আচ্ছা নাম্বারটা কোনোভাবে ব্লক করে রাখেনিতো?নিয়াজ অন্য নাম্বার থেকে কল করতেই রিং হয়।নিয়াজ বুঝতে পারে জারা নাম্বারটা ব্লক করে রেখেছে।

জারা এতক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিয়াজের কথাই ভাবছিলো।কার কাছ থেকে মানুষটার খোঁজ নিবে?জ্বর কি খুব বেশি?বেশি না হলে নিশ্চয়ই অফিসে আসতো।খালার কাছ থেকে নিয়াজের বাড়ির ফোন নাম্বার নিতেও লজ্জা লাগছে।ব্যাপারটা কেমন দেখায়?জারার ভাবনার সুতো ছিঁড়ে ফোনের তীব্র আওয়াজে।স্ক্রিনে চোখ রেখে জারা ভ্রু কুচকায়।এটা কার নাম্বার?সেদিনও একটা অপরিচিত লোকের নাম্বার ব্লক করেছে।জারা ভাবতে ভাবতেই কল কেটে গেলো।দ্বিতীয় বার কল আসতেই জারা রিসিভ করে সালাম দেয়।
ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতে দেখে নিয়াজ চাপা স্বরে ধমক দিয়ে বলে,ফোন তুলছোনা কেনো?
জারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো।চোখ ছোট করে ঠোঁট খানিক বেঁকিয়ে বলল,কে ভাই আপনি?
নিয়াজ তেতে উঠে বলল,হোয়াট ভাই?
জারা কপালে ভাঁজ ফেলার চেষ্টা করে বলল,তো কি চাচা-জেঠা বলতাম?চোখ দুটো হালকা বড় করে বলল,নো নো নো আপনাকে আফা কিংবা খালা বলা উচিত ছিলো আমার রাইট?
নিয়াজ দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল,স্টপ!আমি না তোমার ভাই না চাচা-জেঠা আর না আফা-খালা।আমি নিয়াজ।
হ্যাঁ তো আমি কি কর….বলতে গিয়ে থেমে যায় জারা।কিছুক্ষণ চুপ থেকে মিনমিন করে বলল,সরি!এই নাম্বারটা কার?

নিয়াজ বিরক্তি সূচক শব্দ করে বলল,তোমাকে নিয়াজ কল দিয়েছে তাহলে নাম্বারটা ও নিশ্চয়ই নিয়াজের।
জারা জিবে কামড় দিয়ে আমতা আমতা করে বলল,কেমন আছেন?
নিয়াজ একটু অভিমান করেই বলল,সেটা কি তোমার জানার দরকার আছে?
জারা চুপ করে রইলো কিছুই বলল না।
নিয়াজ রাগ দেখিয়ে বলল,মানলাম তোমার কাছে নাম্বার নেই বাসায়তো আসতে পারতে।
জারা চোখ বড় বড় করে বলল,বিয়ের আগেই শশুর বাড়ী?

দিদার রোহানকে নিয়ে তার গ্রামে ফিরে এসেছে।তানিশাকে সব কিছুই জানিয়ে দিয়েছে দিদার।রোহানের পরিবারের সবাই জানে রোহান এক্সিডেন্ট করে হাত ভেঙেছে।রোহানের ভাবি মেয়েটা এই ভালো তো এই খারাপ।মানে যখন যেমন ইচ্ছা হবে তানিশার সাথে তেমন ব্যবহার করে।এখন তানিশাও ছাড় দেয়না ফাঁকে ফাঁকে খোঁচা মেরে কথা বলে ফেলে রোহানের ভাবির সাথে।
তানিশা রোহানের সব রকম খেয়াল রাখছে।কিন্তু প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো কথা বলছেনা।রোহান দিন দিন তানিশাকে দেখে অবাক হয়।মেয়েটা কিভাবে এত অবহেলা টর্চার সহ্য করে আবার রোহানের সেবা করছে।

দেখতে দেখতে নিয়াজ আর জারার বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো।আর মাত্র দুদিন অপেক্ষা।তারপরই নিয়াজের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে জারাকে নববধূ হিসেবে নিজের ঘরে তুলবে।জারার খালা,খালু,তাসিন,তুহিন,জারা সবাই মিলে বাস কাউন্টারে বসে আছে।বাস আসলেই সবাই জারার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিবে।জারার আরো আগেই গ্রামে যাওয়ার কথা ছিলো।কিন্তু নিয়াজ ছুটি দেয়নি।জারা যত তাড়াতাড়ি চলে যাবে নিয়াজের প্রেয়সীকে দেখার আকাঙ্খা আরো তীব্র হবে।
বাসে যে যার সিটে বসে পড়েছে।তুহিন জারার সাথেই বসেছে।তাসিন অন্য একটা ছেলের সাথে বসেছে।জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ঢাকা শহরটাকে পরোখ করে চলেছে জারা।আজ এই শহর ছেড়ে যাচ্ছে দুদিন পর পার্মানেন্টলি এই শহরে চলে আসবে।তখন বাবার বাড়ীর জন্য অতিথি হয়ে যাবে।

নিয়াজের পুরো বাড়ি এখন থেকেই লাইটিং করা হচ্ছে।বাড়ির কানায় কানায় ফুলের সমারোহ।অফিসের সব স্টাফকে ও ছুটি দিয়ে দিয়েছে।নিয়াজের বাবা সব কিছুর তদারকি করছেন।একমাত্র ছেলের বিয়েতে উনি কোনো কমতি রাখতে চান না।
এদিকে গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির আঙ্গিনায় পা রাখতেই সবাই এসে জারাকে ঘিরে ধরেছে।কোনোরকম সবাইকে পাশ কাটিয়ে জারা মাকে এসে ঝাপটে ধরে।জারার মা ও মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আদর করে দেন।পুরো বাড়ির চেহারাটাই পালটে গেছে।জারা ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই কেউ ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে।জারা পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে কায়াকে দেখে নিজেও কায়াকে জড়িয়ে ধরলো।
কায়া মিষ্টি হেসে বলল,কেমন আছিস আপু?
জারা চোখ দুটো কিঞ্চিৎ ছোট করে বলল,তোর বিয়ের খবর শুনে আপাতত ভালো আছি।
কায়া কোমরে হাত দিয়ে বলল,বারে তোমার বুঝি বিয়ে না খালি আমার একার বিয়ে?
কায়ার কথায় জারা ফিক করে হেসে দেয়।সাথে কায়া ও হেসে দেয়।

হলুদের সব আয়োজন জাঁকজমকভাবে করা হয়েছে।কায়া আর জারার জন্য আলাদা আলাদা হলুদ শাড়ী শশুর বাড়ী থেকে এসেছে।কিন্তু মুহিত হাসান চাইছেন উনাদের মেয়ে বাবার বাড়ি থেকে দেওয়া শাড়ীটাই হলুদে পড়ুক।পার্লার থেকে মেয়ে এসে জারা আর কায়াকে সাজিয়ে দিয়ে গেলো।বিয়েতে জারার দুটো বান্ধবী এসেছে।তানিশা জারার স্কুল লাইফের বান্ধবী ছিলো।জারা ঢাকায় চলে যাওয়ার পরেও ওদের মধ্যে মাঝেমাঝে যোগাযোগ হতো।তুহিনকে মিমি ক্রমাগত কল,মেসেজ দিয়ে জ্বালিয়ে মারছে।তুহিন মনে মনে মিমিকে শ’খানেক গালি দিলো সাথে নিজেকেও গালি দিলো কেনো এই মেয়ের সাথে প্রেম করতে গেলো।

রাহি বিয়ের দিন রাজের সাথেই আসবে একেবারে বরযাত্রী হয়ে।
জারা আর কায়াকে সাজিয়ে একটা রুমে বসিয়ে দিয়ে গেলো।দুজনে কথা বলছে।
নিয়াজ হলুদের জন্য একেবারে তৈরি হয়ে হোয়াটস অ্যাপে জারাকে ভিডিও কল দিলো।কথার মাঝেই জারার ফোন বেজে উঠতেই কায়া ফোন হাতে নিয়ে দেখলো স্ক্রিনে স্যার লিখা।কায়া ভ্রু কুচকে বলল,এই স্যারটা আবার কেরে?
জারা ছো মেরে কায়ার হাত থেকে ফোন নিয়ে বলল,কেউ না।
কায়া ভ্রু নাচিয়ে বলল,কেউ না?নাকি আমার জিজু কোনটা?
জারা চোখ পাকিয়ে বলল,তুই থামবি?
ওদের কথার মাঝেই কল কেটে গেলো।দ্বিতীয় বার কল আসতেই কায়া ছো মেরে ফোন নিয়ে রিসিভ করে।
কল রিসিভ হতেই নিয়াজ হাসি মুখে স্ক্রিনে তাকাতেই সব হাসি গায়েব হয়ে গিয়ে কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালো।
কায়া হাত নাড়িয়ে বলল,হাই জিজু।বউকে দেখতে কল দিয়েছেন?কিন্তু এখনতো দেখা যাবে না।

জারা হাত বাড়িয়ে ফোনটা নেওয়ার চেষ্টা করছে কায়া বারবার হাত সরিয়ে নিচ্ছে।
নিয়াজ হাসি মুখে বলল,শালিকা নিজের বরের সাথে গিয়ে প্রেম করো আর বোনকে ও তার বরের সাথে প্রেম করতে দাও।
নিয়াজের কথা শুনে জারা লজ্জা পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো।কায়া মুখ বেঁকিয়ে বলল,জিজু যে এতটা বউ পাগল তা তো জানতাম না।
নিয়াজ দাঁত কেলিয়ে বলল,বরের কাজ বউয়ের প্রেমে পাগল হওয়া।কায়া ক্যামেরা ঘুরিয়ে জারার দিকে ধরলো।নিয়াজকে বলল,এই নিন বউকে দেখে নিন কিন্তু কথা বলা যাবে না।নিয়াজ ফোনের স্ক্রিনে জারাকে দেখতে দেখতে বলল,আমার বউকে ফোনটা দিয়ে এই ঘর থেকে বিদায় হও।
কায়া ভেংচি কেটে বলল,দেবো না ফোন আপনার বউকে হুহ।জারা খাটের উপর ধপ করে বসে পড়েছে।কায়া মেয়েটা চিকনি কিন্তু শক্তি বেশি।এর সাথে যুদ্ধ করে জারার পক্ষে মোবাইল নেওয়া সম্ভব না।
পাঁচ-ছয় জন মেয়ে এসে জারা আর কায়াকে ছাদে স্টেজে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছে।কায়া নিয়াজকে বায় জানিয়ে ফোন রেখে জারার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো।হলুদের অনুষ্ঠান খুব সুন্দরভাবেই কেটেছে।কায়া সবার সাথে তাল মিলিয়ে নেচেছে।জারাকে অনেক জোরাজোরি করেও কেউ নাচাতে পারলোনা।জারা স্টেজে বসে সবার আনন্দ দেখে চলেছে।

রাতে শাড়ী পাল্টে মেকাপ তুলে একটা সুতি জামা পড়ে জারা শুয়ে পড়েছে।কায়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওর হবু বরের সাথে কথা বলছে।ক্লান্ত চোখ দুটো বুজে আসতেই জারার ফোন বেজে ওঠে।ফোনটা সুইচ অফ করে জারা ঘুমিয়ে পড়েছে।বাইরে সোরগোল শুনে জারার ঘুম ভাঙে।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চোখ কপালে উঠে গেছে।সকাল দশটা বাজে আর ও কিনা এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিলো।পাশে তাকিয়ে দেখলো কায়া ও পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।কায়াকে ডেকে দিয়ে জারা ওয়াশরুমে চলে যায়।

বিয়ের কনে রূপে লাল লেহেঙ্গাতে নিজেকে মুড়িয়ে নিয়েছে জারা।পার্লারের মেয়েরা বাকি সাজ কমপ্লিট করে দিয়েছে।নিজেকে আয়নায় দেখে জারা নিজেকেই যেনো চিনতে পারছেনা।এখন মনে হচ্ছে আয়নায় একটা চোখ ধাধানো সুন্দরী দাঁড়িয়ে আছে।এই সুন্দরীর সাথে জারার কোনো মিল নেই।
বরযাত্রী অনেক আগেই এসে পড়েছে।নিয়ম মতে জারা আর নিয়াজের বিয়েটা আগে সম্পন্ন হলো এরপর কায়ার বিয়ে সম্পন্ন হলো।
বিদায় বেলায় সবার চোখে পানি।একসাথে বাড়ির দুই মেয়েকে বিদায় দিতে হচ্ছে।জারা বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে চলেছে।মুহিত হাসানের চোখে ও পানি।মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।জারার মা ও জারাকে ধরে কেঁদে দিলেন।তুহিন জারাকে ধরে চোখের পানি ছেড়ে দিলো।কত দুষ্টুমি করেছে দুজনে।এখন সব শেষ করে জারা পরের ঘরে যাচ্ছে।

কাঁদতে কাঁদতে জারার লেহেঙ্গার ওড়না দিয়ে তুহিন নাক মুছতে গেলেই নিয়াজ তুহিনের হাতের মুঠোয় টিস্যু পুড়ে দিয়ে বলে সালাবাবু টিস্যু দিয়ে নাক মুছো আমার বউয়ের ওড়না দিয়ে নয়।কাঁদার মাঝেই তুহিন ফিক করে হেসে দিলো।কায়া আর জারাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে সবাই দাঁড়িয়ে আছে।তাসিন দূরে দাঁড়িয়ে চোখ মুছতেছে।রাহি পেছন থেকে সেভেন আপের বোতল দিয়ে তাসিনের মাথায় বাড়ি মারলো।তাসিন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।রাহি ভ্রু নাচিয়ে বলল,জারার বিয়ে তাই ও কাঁদতেছে।তোমার কি বিয়ে লাগছে যে তুমিও মেয়েদের মতো কাঁদতেছো।
রাহির কথা শুনে তাসিন ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিলো।রাহি হেসে কুটিকুটি।এই মানুষটা নাকি ওর বর হবে।

চলবে…….।

#গল্পঃবর্ষণ_মুখর_দিন
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১০

একে একে সবগুলো গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে।বাকি রইলো দুটো গাড়ি।নিয়াজ আর জারাকে একটা গাড়িতে তুলে দিয়ে নিয়াজের বাবা এদিকের কিছু কাজ সেরে আরো কয়েকজন নিয়ে পরে আসবেন।
কান্না করতে করতে জারা চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে।ঘাড় আর মাথা টনটন করছে।কেমন মনে হচ্ছে যারা যেন গোল গোল হয়ে ঘুরছে।সিটে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঝে থাকে জারা।নিয়াজ জারাকেই দেখে যাচ্ছে।মনে মনে প্রশান্তি হচ্ছে কিছু মুহূর্ত আগ থেকে জারা তার অর্ধাঙ্গিনী হয়ে গিয়েছে।।।
অর্ধাঙ্গিনী শব্দটার মানে অনেক গভীর।জারার হাতটা ধরতে গেলেই নিয়াজের ফোন বেজে উঠে।বিরক্ত হয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখে বাবার ফোন।কল রিসিভ করতেই নিয়াজের বাবা জানালেন,তোর শশুর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে।নিয়াজ উত্তেজিত হয়ে বলল,কি বলছো বাবা।হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন কেনো?

নিয়াজের কথা কর্ণধারে পৌঁছাতেই জারা চোখ মেলে তাকায়।নিয়াজ বলল,আচ্ছা আমরা আসছি।ড্রাইভারকে গাড়ি ঘুরিয়ে জারার বাসার দিকে যেতে বলে নিয়াজ।জারা নিয়াজকে প্রশ্ন করে,কে অসুস্থ?আমার বাবা,মা ঠিক আছে তো?
নিয়াজ জারার হাত নিজের হাতে মুঠোয় নিয়ে বলল,সবাই ঠিক আছে।বাবা আমাকে একটা কাজে আবার তোমাদের বাসায় যেতে বলেছে।
জারার দৃষ্টি দেখে নিয়াজ বুঝতে পারলো তার মিথ্যে জারা বিশ্বাস করেনি।
নিয়াজের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে জারা ফুঁফিয়ে উঠে বলে,সত্যি করে বলুন,কার কি হয়েছে।আমি স্পষ্ট আপনাকে বলতে শুনেছি কেউ অসুস্থ।
নিয়াজ জারার পিঠের উপর হাত দিয়ে জারাকে আগলে ধরে বলল,তুমি উত্তেজিত হইওনা।আসলে তোমার বাবা একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
জারা ফুঁপিয়ে কান্না করে দিয়ে বলে,আমি জানতাম হয় বাবা নয়তো মা দুজনের একজনের কিছু হয়েছে।জারা কেঁদেই চলেছে।নিয়াজ কিছুতেই জারাকে শান্ত করতে পারছে না।প্রায় আধা ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে এখন আবার জারার বাসায় ফিরতে হচ্ছে।

নিয়াজের বাবা জারার বাবার সাথে কথা বলে বেরিয়ে আসছিলেন।তাসিনের বাবা মাথায় হাত রেখে এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে খুঁজে চলেছেন।উদ্দেশ্য তাসিনের মাকে না দেখলে জারার মাকে বলবেন এক কাপ চা দিতে।হঠাৎ গ্লাস ভাঙার আওয়াজ হতেই উনি পাশ ফিরে তাকান।নিয়াজের বাবাও পেছন ফিরে তাকান।জারার বাবা বুকে হাত চেপে সোফায় হেলে পড়ে আছেন।পানির গ্লাস নিতে গিয়ে গ্লাসটাও নিচে পড়ে ভেঙে গেছে। তাসিনের আর নিয়াজের বাবা এসে জারার বাবাকে ধরেলেন।তাসিনের বাবা সবাইকে ডাকলে বাড়ির সবাই ড্রইংরুমে চলে আসেন।মুহিত হাসানকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

নিয়াজের বাবা নিয়াজকে আবারো ফোন করে বলে দিয়েছেন উনারা হাসপাতালে আছে।নিয়াজ জারাকে নিয়ে হাসপাতালে চলে এসেছে।ভারী লেহেঙ্গা নিয়ে হাঁটতে জারার কষ্ট হচ্ছে তবুও বাবাকে দেখার জন্য একহাতে লেহেঙ্গা ধরে যত দ্রুত সম্ভব হেটে চলেছে।নিয়াজে রিসিপশন পেশেন্টের নাম বলে কোথায় আছে জেনে নিয়েছে।জারার হাত একহাতে মুঠো করে ধরে জারার বাবাকে যে কেবিনে রাখা হয়েছে সেদিকে গেলো।হাসপাতালে বাড়ির বড়রা কজন এসেছে।তাসিন আর তুহিনও বাসায় তখন বাসায় ছিলোনা।তারাও এখন হাসপাতালে চলে এসেছে।মহিলা কাউকে আনা হয়নি।জারা দৌঁড়ে গিয়ে ওর চাচাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলে,বাবা কোথায় আমি বাবাকে দেখবো।জারার চাচা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,কাঁদিস না মা।ভাইজান ঠিক হয়ে যাবে আল্লাহকে ডাক।নিয়াজ এসে জারাকে বুকের সাথে আগলে নিলো।জারাও নিয়াজের পিঠ খামছে ধরে কেঁদে যাচ্ছে।ডাক্তার পরীক্ষা করে বেরিয়ে আসতেই সবাই সেদিকে এগিয়ে গেলো।ডাক্তার বললেন,উনারতো আগে থেকেই হার্টের সমস্যা আছে।নিশ্চয়ই কিছু নিয়ে চিন্তা করেছেন যার কারণে বুকে ব্যথাটা দেখা দিয়েছে।চিন্তা করবেন না উনি এখন ঠিক আছেন।কিছুক্ষণ পর গিয়ে দেখা করে আসতে পারবেন।

মুহিত হাসান উপরের দিকে তাকিয়ে সিটে শুয়ে আছেন।মেয়েটাকে পরের হাতে তুলেতো দিয়েছেন।মেয়েটা সুখী হবে কিনা এসব নানা চিন্তা করে বুকে চিনচিনে ব্যথা হতেই পানির গ্লাসটা নিতে চাইলেন।হাত ফসকে গ্লাস পড়ে গিয়ে উনি সোফায় হেলে পড়েন।বুকের ব্যথাটা হঠাৎ করেই তীব্র হয়ে উঠলো।
সবাই মিলে মুহিত হাসানের সাথে দেখা করে বেরুলেন।জারা বাবার বুকে মাথা দিয়েই ফুঁফিয়ে কেঁদে যাচ্ছে।মুহিত হাসান মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,এত কাঁদতে হয়না মা।বাবা এখন ঠিক আছি।তবুও জারা কাঁদছে।নিয়াজ জারাকে টেনে বলল,তুমি যে বাবার বুকে মাথা রেখেছো বাবার যে বুকে ব্যথা বাবার কষ্ট হচ্ছে তো।জারা চট করে মাথা সরিয়ে নিয়াজের দিকে তাকালো।মুহিত হাসান মুচকি হেসে বললেন,আমার মোটেও কষ্ট হচ্ছেনা।জারা চোখ গরম করে বলল,তুমি সব সময় এমন করো।তোমার কষ্ট হচ্ছে তার পরেও বলছো তুমি ঠিক আছো।জারার বাবা নিঃশব্দে হাসলেন।সন্তান যখন বুকে মাথা রাখে তখন কষ্টকে কষ্ট বলে মনে হয়না।

রাত একটায় জারা নিয়াজ নিয়াজের বাবা রওনা দিলেন ঢাকার উদ্দেশ্যে।নিয়াজের বাবা সামনেই ড্রাইভারের সাথে বসেছেন।নিয়াজ জারাকে নিয়ে পেছনে বসেছেন।নিয়াজের বাবার সাথে যে ক’জন যাওয়ার বাকি ছিলো উনাদেরকে আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।জারার চোখ দুটো নিভু নিভু হয়ে আসছে।মনে হচ্ছে কত বছর ধরে ঘুমায়না।সিটে মাথা এলিয়ে দিলো।তলিয়ে গেলো ঘুমের রাজ্যে।নিয়াজের বাবাও সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুঝে আছেন।বয়স্ক মানুষ আজকে উনার উপর অনেক ধকল গেছে।ড্রাইভার আর নিয়াজ জেগে আছে।জারার ঘুমানোর অনেকক্ষণ পর নিয়াজ আস্তে করে জারার মাথাটা ওর ঘাড়ে রেখে একহাতে জড়িয়ে রাখে।জারার খবর নেই সে ঘুমিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে আছে।

সকালে পাখির কিচিরমিচির শব্দে নিয়াজ জেগে যায়।কখন যে চোখটা লেগে এসেছে বুঝতেই পারেনি।বাবা সামনে সোজা হয়ে বসে আছেন।জারার দিকে একপলক তাকালো নিয়াজ।নিয়াজের শেরওয়ানি মুঠো করে ধরে ঘুমিয়ে আছে জারা।ওরা ঢাকায় চলে এসেছে।আর কিছু পথ বাকি আছে নিয়াজের বাসা আসতে।
ড্রাইভার নিয়াজের বাসার সামনে গাড়ি থামাতেই নিয়াজের বাবা নেমে পড়লেন।নিয়াজ জারাকে মৃদুস্বরে ডাক দিলো।নিয়াজের বাবা একপলক পেছনে তাকিয়ে বললেন,অনেক ক্লান্ত মেয়েটা।ডেকো না তুমি নিয়ে এসো।বাবার কথায় নিয়াজ এদিক ওদিক তাকায়।ব্যাপারটা কেমন দেখায় বাবার সামনে বউকে কোলে নিয়ে হাঁটবে?

নিয়াজের বাবা বললেন,এত সংকোচের কিছুই নেই নিয়ে এসো।নিয়াজ বাবার কথা মতো জারাকে টেনে কোলে নিতে গেলেই জারা জেগে যায়।নিয়াজকে নিজের অনেক কাছে দেখে পিছিয়ে যায়।যার দরুন মাথায় হালকা বাড়ি খায়।নিয়াজ সরে গিয়ে বলে নেমে এসো বাসা এসে গেছে।জারা গাড়ি থেকে নেমে নিয়াজের পিছু পিছু হাঁটা ধরলো।মাথা তুলে একপাল বাড়িটার দিকে তাকালো।বাড়ির নকশা দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই বাড়ির মানুষ গুলো কতটা শৌখিন।দরজায় দাঁড়িয়ে মিসেস রেনু অপেক্ষা করছিলেন।নিয়াজের বাবা ঢাকার ভেতরে ঢুকেই বাসায় ফোন করে দিয়েছেন।সবে মাত্র সকাল ছয়টা বাঝে।সব আত্মীয় স্বজনরা এখন নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছে।মিসেস রেনু কি কি নিয়ম পালন করা লাগে সেগুলো শেষ করে নিয়াজকে বললেন জারাকে ঘরে নিয়ে যেতে।এমনিতেই সবার উপরে অনেক ধকল গেছে।নিয়াজ সোজা হেঁটে চলেছে।জারা কি করবে বুঝতে পারছেনা।নিয়াজের পিছু পিছু যাবে কিভাবে?কেমন অস্বস্তি হচ্ছে।মিসেস রেনু নিজের ঘরে চলে গেলেন।

নিয়াজ একবার পেছনে তাকিয়ে মাকে না দেখে জারার হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেলো।জারাকে সব চেঞ্জ করে নিতে বলেছে।নিয়াজ রুমেই চেঞ্জ করে খাটে শুতে গিয়ে দেখলো পুরো খাট ফুল দিয়ে সাজানো।নিয়াজ ফুল গুলোকে ঝেড়ে বিছানা পরিষ্কার করে শুয়ে পড়েছে।জারা মেকাপ তুলে আস্তে আস্তে লেহেঙ্গা পাল্টে একটা শাড়ি পড়ে নিয়েছে।রুমে এসে দেখলো নিয়াজ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।জারা হেঁটে হেঁটে বারান্দা খুঁজে বের করে ফেলেছে।বারান্দায় গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো।এখন ঘুমালে সহজে ঘুম ভাঙবেনা।সবাই কি ভাববে?বলবে নতুন বউ এত বেলা অব্দি ঘুমায়।তাছাড়া নিয়াজের পাশে ঘুমাতেও কেমন সংকোচ হচ্ছে।

নিয়াজ চোখ খুলে বারান্দায় এসে জারার হাত ধরে রুমে নিয়ে আসলো।খাটে শুইয়ে দিয়ে বলল,এখন ঘুমাও।কেউ কিছু মনে করবেনা।সবাই জানে আমরা অনেকরাত অব্দি হাসপাতালে ছিলাম।জারা মোচড় দিয়ে উঠতে গেলেই নিয়াজ পাশে শুয়ে জারাকে জড়িয়ে ধরে।জারার তো দম বন্ধ হয়ে আসছে।আল্লাহগো হাত গুলো মনে হয় একমণ ওজনের হবে।নড়তে পারছেনা বেচারি।জারার মোচড়ামুচড়িতে নিয়াজ জারার গলায় মুখ গুঁজে দিয়ে বলল,একদম নড়াচড়া করোনা।নিজেও ঘুমাও আমাকেও ঘুমাতে দাও।
জারার শরীরে কাঁপুনি ধরে গেছে।নিয়াজ ওর এত কাছে চলে এসেছে।চোখ মুখ খিঁচিয়ে জারা আল্লাহকে ডাকছে নিয়াজ যাতে সরে যায়।নিয়াজ অলরেডি ঘুমিয়ে পড়েছে।জারা ও নড়তে না পেরে নিয়াজের হাতের নিচে চাপা পড়েই ঘুমিয়ে গেছে।

জারা বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারে নি।মনে মনে একটা চিন্তা ছিলো সবাই কি ভাববে?ঘুম ভেঙে দেখতে পেলো নিয়াজ একহাত জারার উপর দিয়ে রেখেছে।জারা নিয়াজের হাত সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়।নিয়াজের পাশে তার ফোন ছিলো।স্ক্রিন অন করে সময় দেখতে গিয়ে ওয়ালপেপারে রিহার জন্ম দিনে শাড়ি পড়া জারার একটা ছবি দেখলো।মূলত ছবিটা জারার মুখ চেপে হাসি থামানোর সময়ই নিয়াজ তুলেছিলো।জারা ফোন রেখে দিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে একেবারে গোসল করে নিয়েছে।রুমে এসে চুল মুছে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো।বউ মানুষ হালকা লিপস্টিপ না দিলেও কেমন খালি খালি দেখা যায়।জারা ট্রলি থেকে সাজগোছের সব জিনিস রেখে লিপস্টিপ তুলি নিয়ে ঠোঁটে লাগিয়ে নিলো।

নিয়াজ পাশ ফিরে শুতে গিয়ে ওর মনে হলো ও কিছু একটা দেখেছে।চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে দেখলো জারা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে চিরুনি চালাচ্ছে।নিয়াজ অনেকক্ষন ধরে নেশাগ্রস্তের মতো তাকিয়ে থাকলো।মন বলছে উঠে গিয়ে জারার চুলে মুখ ডুবিয়ে দে।চোখ বলছে সালা চুপটি করে ঘুমা।অবশেষে সবকিছুর সাথে যুদ্ধ করে নিয়াজ চোখ বন্ধ করে নিলো।জারা মাথায় ঘোমটা টেনে নিচে চলে গেলো।আটটা বেজে গেছে।বড়রা উঠে পড়েছে সবাই।একজন মহিলা জারকে দেখে বললেন,ওমা বউমা তুমি এখন নিচে আসতে গেলে কেনো?তোমরাতো সকালেই এসেছো।ঠিক মতো ঘুমাতেও তো পারোনি।জারা মুচকি হেসে বলল,অনেক্ষণ তো ঘুমালাম।মিসেস রেনু রান্নাঘরে সবকিছুর তদারকি করছেন।সকালে কে কি খাবেন সেসবের দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন।জারার গলার স্বর শুনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে জারাকে কিছুক্ষণ বকাঝকা করলেন।এখন নিচে নেমে আসার কি দরকার ছিলো।জারা মিষ্টি হেসে মিসেস রেনুকে বললেন,আমার এখন আর ঘুম আসবেনা।তাই নিচে চলে এলাম।জারাকে সোফায় চুপটি করে বসে থাকতে বলে মিসেস রেনু আবারো ছুটলেন রান্নাঘরে।

চলবে…….।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here