গল্পঃ আমি আসবই,পর্ব ১

0
3402

গল্পঃ আমি আসবই,পর্ব ১
লেখিকাঃ Saaiba Chowdhury

আমার কি দোষ ছিলো আম্মু!! আমাকে যে মেরে ফেললে? অর্পিতার কানের কাছে বাচ্চাদের কন্ঠে কে যেন ফিসফিস করে কথাটা বলে গেলো।
সাথেই সাথেই ঘুম ভেংগে গেলো ওর। তলপেট প্রচন্ড ব্যাথা হয়ে আছে।
বেশ অনেকগুলো পেইন কিলার খেয়েছিলো অর্পি। কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি।একটু আগের ঘটনাটি কি সত্য! নাকি কোনো ভ্রম হয়েছে তার!
অর্পি দেখতে পায় তার শরীর থেকে দরদর করে ঘাম ছুটছে। অজানা ভয়ে থরথর করে কাঁপছে পুরো শরীর।
তড়িঘড়ি করে বিছানার পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে হাসিবকে কল দেয় সে। দুয়েকবার রিং হতেই ওপাশ থেকে কল রিসিভ করে হাসিব বলে ,
-কল দিয়েছো ভালোই হয়েছে অর্পি৷ জানো আজ অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখেছি আমি।
আমি স্বপ্নে দেখেছি, ছোট্ট একটা বাচ্চা আমার কানের কাছে এসে বলছে, “আমাকে কেন মেরে ফেললে আব্বু! আমি কি দোষ করেছি?”
কথাটি এখনো আমার কানে ভাসছে। মনে হচ্ছে এটা কোনো স্বপ্ন নয় এটা বাস্তব।
হাসিবের কথা শুনে অর্পিতা বিস্ময়কর কন্ঠ নিয়ে বলে,
-এটা কিভাবে সম্ভব! একই স্বপ্নটা আমিও দেখেছি হাসিব। স্বপ্নটা দেখে তোমাকে কল করেছি সবকিছু বলার জন্য কিন্তু তুমিও সেম স্বপ্ন কিভাবে দেখলে!
অর্পিতার কন্ঠ শুনে হাসিব বুঝতে পারে সে খুব ভয় পেয়েছে। প্রসঙ্গ ঘুরাতে অর্পিতাকে বলে,
-আচ্ছা বাদ দাও। এমন অনেক সময়ই ঘটে থাকে। এটা একটা কাকতালীয় ঘটনা ছাড়া কিছুই নয়। এখন বলো তোমার শরীর কেমন আছে?
হাসিবের কথার প্রতি উত্তরে অর্পিতা বলে,
-এবরশনের পর থেকে পেটে প্রচুর ব্যাথা করছে।
ধীরে ধীরে ব্যাথাটা বেড়েই চলেছে। সকালে অনেকগুলো পেইন কিলার খেয়েছি তবুও কমার কোনো নাম নেই। এমন কেন হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছি না।
-চিন্তা করো না। একটু কষ্ট করে সহ্য করো,ডাক্তার যে ঔষধগুলো দিয়েছে সেগুলো নিয়মিত খাও দেখবে খুব শীঘ্রই সব ঠিক হয়ে যাবে।

হাসিবের কথায় সম্মতি জানিয়ে অর্পিতা ফোন রেখে দেয়। কিন্তু কোনোভাবেই নিজেকে শান্ত করতে পারে না সে। ভেতরে ভেতরে এক প্রকার অস্থিরতা কাজ করতে থাকে। তার কানে শুধু একটা কথাই বাজছে, “আমার কি দোষ ছিলো আম্মু? আমাকে যে মেরে ফেললে!”
পেটে ব্যাথা নিয়েই ধীরে ধীরে উঠে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায় অর্পিতা। খুব অপরাধবোধ হচ্ছে তার।
নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে,
-এবরশন করে কি আমি ভুল করলাম?
কিন্তু এমন সময়ে বাচ্চা নেওয়া মানে নিজের উঠতি ক্যারিয়ার শেষ করা। বিয়ে হয়েছে মাত্র কয়েকমাস এর মাঝে বাচ্চা নেওয়া অসম্ভব।
না না আমি যেটা করেছি একদম ঠিক করেছি।
নিজের ক্যারিয়ারের সাথে কোন কম্প্রোমাইজ আমি করতে রাজি না।
কথাগুলো বলে আবারও বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে।
বিয়ে হলেও হাসিব ও অর্পিতা দু’জনকে দুই জায়গায় থাকতে হয়।
হাসিব নিজের জবের জন্য ভিন্ন শহরে থাকে, আর অর্পিতা পড়ালেখার জন্য ভার্সিটির পাশেই একটা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকে । হাসিব মাঝে মাঝেই সেখানে আসা যাওয়া করে।
নিজেদের অর্থ সম্পত্তির কোনো অভাব না থাকলেও অর্পিতার চিন্তাভাবনা , যেভাবেই হোক নিজের একটা পরিচয় গড়তে হবে।
তাই সংসার নিয়ে আপাতত দু’জনের কেউ ই ভাবছে না। কিন্তু অসচেতনতায় অর্পিতা বিয়ের ছয়মাসের মাথায় বুঝতে পারে সে প্রেগন্যান্ট।
হাসিব ও অর্পিতা দু’জন মিলেই সিদ্ধান্ত নেয়, এবরশন করানোর। নিজের লক্ষ্যের মাঝে কোনো বাঁধাই সে চায় তারা।
অতঃপর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অর্পিতা এবরশন করে ফেলে।
কিন্তু সমস্যা হয় এবরশন করার পরদিন থেকেই।
পেটে অসহ্য রকমের ব্যাথা শুরু হয় অর্পিতার,যেটা হওয়ার একদমই কথা ছিলো না।
ডাক্তারের দেওয়া ঔষধ ও খায় নিয়মানুযায়ী তবুও ব্যাথা কমছে না।
আজও অন্যান্য দিনের মতো পেইন কিলার খেয়ে ঘুমিয়েছিলো সে কিন্তু ঘুমের মাঝে এমন অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে বেশ ঘাবড়ে যায়।
এভাবে কেটে যায় বেশ কিছুদিন। ব্যাথাটা ধীরে ধীরে কমে গেলেও, ঘুমের মাঝে সেই বাচ্চার কন্ঠ শুনতে পায় প্রায় সময়ই। প্রথম প্রথম ভয় পেলেও ধীরে ধীরে এ বিষয়টিও সে মানিয়ে নেয়।
কিন্তু আজকাল অর্পিতার ভিতরে অনেক ধরনের পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে।
খাবারের প্রতি অনীহা,জোর করে কিছু খেলে বমি হয়ে যাওয়া এবং নিজের শরীরের বিশেষ কিছু অঙ্গ ভারী হয়ে আসা সবকিছুই ভিন্ন কিছু ইঙ্গীত করছে।
কয়েকদিন ধরে পেটের ভিতরে নতুন কোন অস্তিত্বও অনুভব করতে পারছে অর্পিতা।
সে দেরি না করে সবকিছু হাসিবকে খুলে বলে। তারা সিদ্ধান্ত নেয় পুনরায় ডাক্তারের কাছে যাবে এবং এ বিষয়ে আলোচনা করবে।
.
.
.
ডাক্তার মনিরার চেম্বারে অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে অর্পিতা ও হাসিব।
মিসেস মনিরাকে সবকিছু খুলে বলার পরে তিনি একটু অবাক হয়ে জানান, এমন হওয়ার কোনো কারণই নেই। তবুও মুল কারণ জানার জন্য তিনি আরও একবার টেস্ট করবেন সবকিছু।
সবরকম টেস্টের সেম্পল দিয়ে রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে অর্পিতা ও হাসিব।
ঘন্টাখানেক পরে ডাঃ মনিরা রিপোর্ট হাতে ফিরে আসে। বিন্দু বিন্দু ঘামে ভেজা কপালে দুঃশ্চিতার ছাপ।
রিপোর্ট টেবিলের উপর রেখে চেয়ারে বসে তিনি বললেন,
-আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত মেম।
আসলে আমার ক্যারিয়ারে এমন ভুল কখনো আমার দ্বারা হয়নি। আপনাদের কথাটি কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না।
ডাঃ মনিরার কথা শুনে অর্পিতা এবং হাসিব একে অপরের দিকে তাকায়।
-কি হয়েছে সবকিছু খুলে বলুন আমাদের।
হাসিবের প্রশ্নের উত্তরে ডাঃ মনিরা বলেন,
-মেম এর এবরশন সাকসেস হয়নি। স্টিল সি ইজ প্রেগন্যান্ট।
কিন্তু বিশ্বাস করুন এমন হওয়ার কথা না। আমি খুব সতর্কতার সহিত কাজ সম্পন্ন করেছিলাম।

ডাঃ মনিরার কথা শুনে অর্পিতা প্রচন্ড রেগে গেলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ডাঃ মনিরাকে বললো,
-আপনি কি মজা করছেন ডাক্তার।
আপনি জানেন আপনার এই ভুল আমার জন্য কতোটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে?
কেমন ডাক্তার হয়েছেন আপনি, একটা এবরশন ঠিকমতো করতে পারেন না!
আমি আপনার নামে মামলা করবো।
আমি আমার ক্যারিয়ারের সাথে কোনো কম্প্রোমাইজ করতে রাজি নই।

এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে অর্পিতা টেবিলে রাখা সাইড ব্যাগটি নিয়ে হনহনিয়ে বের হয়ে গেলো।
রাগান্বিত দৃষ্টিতে ডাঃ মনিরার দিকে তাকিয়ে হাসিবও অর্পিতার পিছু পিছু বের হয়ে যায়।
দু’জনে বের হয়ে যাওয়ার পর গভীর দুঃশ্চিতার অতলে হারিয়ে যায় ডাঃ মনিরা।
.
.
.
ঘড়িতে রাত ১১ টা বাজে।
রুমের সবকটা লাইট অফ করে চোখ বন্ধ করে চেয়ারে বসে আছেন ডাঃ মনিরা।
অর্পিতাকে একবার কল করা দরকার বলে তার মনে হচ্ছে, কিন্তু অর্পিতা যেভাবে রেগে আছে এমতাবস্থায় কল দেওয়াও সমীচীন মনে করছেন না তিনি।
তবে এখনও সুযোগ আছে এবরশন করানোর৷
বেশি দেরি করে ফেললে এটা অর্পিতার জন্য লাইফ রিস্ক হয়ে যেতে পারে, এটা তাকে অবশ্যই জানানো দরকার।
তার রাগের জন্য নিজের দায়িত্বকে তো আর এড়িয়ে যাওয়া যায় না!
ভাবামাত্রই দেরি না পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে অর্পিতার নাম্বারে কল দেন তিনি
ওপাশ থেকে অর্পিতা কল রিসিভ করলে বিনয়ী সুরে ডাঃ মনিরা তাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলেন।
প্রথম প্রথম একটু রাগ করলেও, অবশেষে অর্পিতা ডাঃ মনিরার কথায় রাজি হয়ে যায়।
ডাক্তার মনিরা অর্পিতাকে জানিয়ে দেয়,
আগামিকাল সকাল ১০ টায় হাসপাতালে যাওয়ার জন্য। আবারো এবরশন করানো হবে অর্পিতাকে।
অর্পিতাও সম্মতি জানিয়ে ফোন রেখে দেয়।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ফোন রেখে বিছানায় চলে যান ডাঃ মনিরা।
.
.
.
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে অর্পিতা ফ্রেশ হয়ে হসপিটালের জন্য রেডি হয়। সকাল থেকে কতোবার কল দিয়েছে হাসিবকে
কিন্তু ফোন রিসিভ করার নামগন্ধও নেই।
নিশ্চয়ই আজ অফ ডে পেয়ে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।
মনে মনে হাসিবকে অনেক বকে দেয় অর্পিতা।
হঠাৎ ফোনে রিংটোন বেজে ওঠে তার। ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে হাসিব কল করেছে। অর্পিতা ঠিক করে নেয়, ফোন ধরেই ইচ্ছেমতো কথা শুনিয়ে দেবে হাসিবকে।
ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে হাসিবের উত্তেজিত ভেসে আসে,
-হ্যালো অর্পি, খবরটা কি শুনেছো?
ফোন করেই হাসিবের এমন প্রশ্ন শুনে বেশ অবাক হয়ে অর্পিতা বলে,
-কোন খবরের কথা বলছো!
অর্পিতার প্রশ্নের উত্তরের হাসিব বলে,
-আজ আমাদের যেই ডাক্তারের কাছে এবরশনের জন্য যাওয়ার কথা ছিলো, ডাঃ মনিরা!
উনি কাল রাতে সুইসাইড করেছেন।
নিজ বাসার ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় তার মৃতদেহ পাওয়া গেছে। সকালে কাজের লোক শত ডাকাডাকির পরেও কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়।
পুলিশ দরজা ভেঙে তার মৃতদেহ উদ্ধার করে।

হাসিবের থেকে এমন কথার শোনার জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলো না অর্পিতা।
সকাল সকাল এমন অনাকাঙ্ক্ষিত খবর পেয়ে অর্পিতার বুকটা ধুক করে কেঁপে ওঠে।
এরমধ্যে হঠাৎ তার কানে ভেসে আসে খিলখিল করে একটা বাচ্চার মিষ্টি হাসির শব্দ।
আশেপাশে তাকিয়ে সে কাউকে দেখতে পায় না।
দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বিছানার উপর বসে পড়ে।
অর্পিতা বুঝতে পারে না হাসির শব্দটা কি বাস্তব নাকি তার মস্তিষ্কের কোনো ভ্রম

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here