গল্পঃ দেনাপাওনা
পর্বঃ ৫ম&শেষ পর্ব
লেখাঃ- Md. Nazmul Huda
অন্যদিকে আমার ভাইয়ার কাছে জানতে পারলাম,রাহুলের ছোট ভাইয়ের সাথেই নিলাকে আবার বিয়ে দিবে রাহুলের বাবা।
আদালত আমার ফাঁসির রায় দেওয়ার ঠিক দুইদিন পরে পুলিশ তদন্ত করে জানতে পারলো রাহুলের খুন নিলার বাবা লোক দিয়ে করিয়েছে।
তথ্যসূত্রে জানা গেছে রাহুলের বাবা নিলার বাবার কাছে তার পাওনা টাকার জন্য প্রচুর পরিমানে চাপ দিতেছে।আর তাছাড়া রাহুলের সব অপকর্মের কথা নিলার বাবা জানতে পেরেছে।
নিলাকে এবং নিলার বাবাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।রাহুলকে যেহেতু নিলার বাবা খুন করেছে তাই নিলাকে পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে।নিলার বাবা গ্রেফতার হওয়ার পরে পুলিশ আমাকে ছেড়ে দিয়েছে।আর নিলা যখন আটকে ছিলো তখন আমি নিলার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।কিন্তু নিলা আমার সাথে কোনো কথাই বললো না।আমিও কিছু না বলে সেখান থেকে চলে গিয়েছিলাম।
কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে আমি নিলার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।নিলার বাসায় ছিলো তখন নিলার মা।তার কাছ থেকে জানতে পারলাম নিলাকে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনে আটকে রাখছে। এবং তারা চাইছে রাহুলের ছোট ভাইয়ের সাথেই নিলাকে বিয়ে দিবে।রাহুলের ছোট ভাই দেশের বাহিরে একটা কোম্পানিতে জব করতেছে।সে দেশে আসলেই তার সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে।
আমার বড় ভাই আমাকে তাদের সাথে করে নিয়ে গেলো।তারা আমাকে বিয়ে দিবে তার জন্য উঠে পরে লেগেছে।কিন্তু এই মুহুর্তে বিয়ে করা সম্ভব না।
সব কিছু ভুলে গিয়ে নিলাকে কাছে পেতে চাই।আসলে নিলার তো কোনো দোষ ছিলো না।শুধু শুধু নিলাকে কষ্ট দিয়েছি।
রিলেশন করার আগে শুনেছি,ভালোবাসা নাকি খুব বেদনার।ভালোবাসা থাকলে নাকি অনেক বাধা বিপত্তি আসে।আসলেই,ভালোবাসা নামক জিনিস টা এখন আমায় কুড়েকুড়ে খাচ্ছে।
আমি সাত পাচ না ভেবে বলেই দিলাম ভাইয়া ভাবীকে,আমার আর নিলার সাথে যা ঘটেছে সব কিছু ভুলে গিয়ে আবার নতুন করে শুরু করতে চাই।
হাস্যকরের মত কথা ভেবে ভাইয়া হেসে দিয়ে বললো…
-তুই কি ভুলে গেছিস নিলার গর্ভে অনাগত সন্তান বেড়ে চলেছে।
-ভাইয়া ওর সন্তান না হয় আমার পরিচয়েই বড় হবে!
-নিলয় পাগলের মত কথা বলিস না।এটা কখনো সম্ভব না!
– দেখো ভাইয়া,নিলা আর আমার মাঝে এখন কোনো যোগাযোগ নাই,কিন্তু বিলিভ করো নিলার জন্য আমার তিল পরিমান ভালোবাসা কমে নি।আর আমার মনে হয় না নিলা আমাকে ভুলে গেছে বা আমার জন্য ওর কাছে তিল পরিমান অভিযোগ আছে।
আজ আমি যদি নিলার বাবার কথা শুনে এমন সিদ্ধান্ত না নিতাম তাহলে এই পরিস্থিতির স্বীকার আজ হতে হতো না।ভাইয়া এমন ঘটনা তো অহরহ ঘটে যাচ্ছে।তুমি দেখো অনেকেই বড় বড় সন্তান থাকা সত্বেও বিয়ে করে।আর আমরা পাচটা বছর ধরে একে অপরকে ভালো করেই চিনি জানি, প্লিজ ভাইয়া তুমি কিছু একটা করো।
আমার কথা শুনে ভাইয়া ভাবী চোখ কুচকে তাকালো।আমি তাদের সামনে থেকে চলে গেলাম।বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট জ্বালাতে জ্বালাতে মনে পরলো নিলার সবচেয়ে অপছন্দ ছিলো স্মোক করা।রিলেশন চলাকালীন আমি মাঝে মধ্যে স্মোক করতাম খুব সাবধানে।একদিন নিলার কাছ থেকে আর সামলাতে পারলাম না।একদিন হেটে হেটে বাসা থেকে কলেজে যাচ্ছিলাম।হঠাৎ করেই মুষলধারে গুবগুবে বৃষ্টি শুরু হলো।আমি তারাতারি রাস্তার পাশের একটা টং এর দোকানের মধ্যে ঢুকে পরলাম।টানা এক ঘন্টা ধরে বৃষ্টি পরতেছে।থামতেছেই না।হাল্কা হাল্কা ঠান্ডাও লাগতেছে।দোকানদারকে কড়া করে একটা লাল চা আর সাথে একটা সিগারেট দিতে বললাম।চা আর সিগারেট পান করতে করতে বৃষ্টির বেগ কিছুটা কমলো।অন্যদিকে নিলা আমাকে কয়েকবার ফোন দিয়েছে,বৃষ্টির শব্দের ফোনের রিংটোন কান পর্যন্ত আসে নি। ফোন হাতে নিয়ে যখন দেখলাম নিলা আমাকে কয়েবার ফোন দিয়েছে তখন আমি নিলাকে ফোন ব্যাক করলাম।ফোন দেওয়ার পরে জিজ্ঞেস করলো আমি কোথায় আছি।আমি যে টং য়ের দোকানে বসা ছিলাম সেই দোকানের নাম বললাম।আর তাছাড়া আমাদের কলেজটা ছিলো টং এর দোকানের পাশেই।
কিছুক্ষন পরেই নিলা ছাতা নিয়ে গুটিগুটি পায়ে হেটে আসছে।দোকানের কাছে আসার পরে নিলা আমাকে তার ছাতার নিচে যেতে বললো।আমি আর নিলা এক ছাতার নিচে হেটে যাচ্ছি।তখনও ফোঁটাফোঁটা বৃষ্টি পরতেছে।কলেজের মধ্যে এসে একটা ছাউনির নিচে এসে বসলাম।
ঠান্ডায় আমার দুইঠোট কাঁপতেছিলো।তা নিলার চোখে পরে গেলো।আশে পাশে তাকিয়ে নিলা আমার ঠোটে চুমু খেলো।অমনি সাথে সাথে একটা থাপ্পড়।
আসলে চকলেট বা চুইংগাম কিছুই মুখে দেই নি,আর তাছাড়া আরেকটি মজার বিষয় হলো সেইদিনই প্রথম লিপকিস দিয়েছে নিলা।সেই প্রথম দিনেই সিগারেটের গন্ধ নিলার নাক পর্যন্ত পৌঁছে গেলো।
নিলা আমাকে থাপ্পড় দিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে,আমিও বোকা মানুষের মত তাকিয়ে আছে।নিলার হাত ছুতে যাবো তখনই হাতটা ছিটকে হাটা দিলো।
টানা দুইদিন নিলা আমার সাথে কথা বলে নাই।সেই থেকে স্মোক করা ভুলে গেছিলাম।কিন্তু আজ আমি চেইন স্মোকার।
ভাবতে ভাবতে হাতের সিগারেট পুড়ে গেলো,প্যাকেট থেকে আরেকটি সিগারেট বের করে টানতে লাগলাম।
আচ্ছা নিলা আমার কাছে ফিরে আসবে তো?নিলাকে যে বড্ড ভালোবাসি।নিলাও কি আমাকে ভালোবাসে,নাকি বড্ড ঘৃনা করে আমাকে।নিলার হাতটা একটি বারের জন্য কি ছুঁতে দিবে আমায়?হাতটা ধরে হাটুগেড়ে যদি আবার ভালোবাসার আবদার করি আমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিবে নাতো?
কখন যে চোখের কোনে পানি চলে আসলো তা খেয়াল করতে পারলাম না।মনটা ছুটে চলছে নিলার কাছে।কেমন যেনো অস্থিরতার মাঝে কাটাচ্ছি।
নিলা এখন শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের কাছে আটকা হয়ে আছে।নিলারকে বিয়ে দেয়নি তো রাহুলের ছোট ভাইয়ের সাথে।আমি যাবো নিলার কাছে।যেভাবেই হোক নিলাকে আমি ওই বাসা থেকে বের করবো।
রাত তখন তখন দুইটা কোনো মতেই ঘুমাতে পারলাম না।নিলাকে আবার ফিরে পেতে চাই এই কথা ভাইয়া ভাবীকে বলার পরে তারাও আমার সাথে ঠিক মত কথা বলে নি।শুয়ে শুয়ে ভাবছি ভোর হলেই নিলার উদ্দেশ্যে রওনা হবো।
ফজরের আজানের শব্দ কানে ভেসে আসছে,ভাইয়া জেগে গেছেন।অজু করে নামাজ পরে নাস্তা করার জন্য টেবিলে বসলেন।আমি ফ্রেশ হয়ে ভাইয়ের পাশে এসে বসলাম।
-নিলয় কিছু বলবি?
-হ্যা ভাইয়া!আমি নিলার সাথে দেখা করতে যাবো।
– নিলয় তুই কেনো বুঝতেছিস না,এইটা কখনো সম্ভব না।
-ভাইয়া আমি কিছুই শুনতে চাই না,যা হবার আমার হবে,তোমার গাড়িটা আর আমাকে কিছু টাকা দাও।
-টাকা আর গাড়ি নিয়ে কি করবি?
-নিলাকে নিয়ে আসবো,আর আমার হাতে টাকা নাই তা তো তুমি জানো।
-দেখ নিলয় আমি তোর ভালোর জন্যই বলতেছি।
বুঝতে পারছি ভাইয়াকে বলে কিছুই লাভ নেই।কারন ভাইয়া কখনোই এটা মেনে নিতে পারবে না।ভাবীকে বললেই হবে।তাই ভাবিকে ভালো মতো বুঝাতে হবে।
পরে ভাবী ভাইয়াকে বুঝিয়ে কিছু টাকা এবং তার গাড়ির চাবিটা আমাকে এনে দিলো।
ভাইয়ার ড্রাইভারকে আমার সাথে যেতে বারন করলাম।আমি একাই গাড়ি নিয়ে রওনা দিলাম।
যেকোনো ভাবেই নিলাকে ওই বন্দী ঘর থেকে বের করাতে হবে।তাই ওই এলাকার কিছু পরিচিত বন্ধুদের ফোন দিয়ে জানিয়ে রাখলাম।ওরাও আমার সাথে যাবে নিলার কাছে।
নিলার বাবা মা যে বাড়িতে থাকতো আমি প্রথমে সেই বাড়িতে গেলাম,সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম,নিলার মা অনেক আগেই তার বাবার এলাকায় চলে গেছে।এবং তার মাথায়ও মেন্টালিটি সমস্যা দেখা দিয়েছে।তবে এখনো নিলা রাহুলদের বাসায় আছে।
আমি তড়িঘড়ি করে রাহুলদের বাসায় গেলাম।রাহুলের বাবার সাথেই প্রথম দেখা হলো।তিনি আমাকে দেখেই বললো……
-তুমি এখানে?
-নিলার কাছে এসেছি।ও কোথায়?
-রাহুলের পাশেই!
-মানে?
-আসো নিলার কাছে?
আমাকে বাড়ির দক্ষিন পাশে নিয়ে গেলো রাহুলের বাবা।নতুন দুইটা কবর দেখা যাচ্ছে।কাছাকাছি যেতেই আমার পা থেমে গেলো।কবরের ফলক পাথরে বড় অক্ষরে একটাতে লেখা নিলা,আরেকটাকে লেখা রাহুল।
চোখ বেয়ে শুধু পানি পরছে।বুকটা চিনচিনে ব্যথা শুরু হলো।দম আটকে আসতে শুরু করলো।রাহুলের বাবা আমার ঘাড়ের উপরে হাত রেখে বললো।
-একমাত্র দেনাপাওনার জন্যই কয়েকটি মানুষের জীবন শেষ হয়ে গেলো।সব কিছু আমার জন্যই হয়েছে,এর শাস্তি আমিও পাবো।
আমি কিছু না বলে শুধু উপরের দিকে তাকিয়ে বললাম,
-তোমাকে আমার কাছে পাওয়ার দেনাপাওনাটাও শোধ হলো না।তোমার আমার দেনাপাওনা শোধ করবো ওপারে এসে।
#সমাপ্ত