গল্পঃ প্রতিশোধ
পর্বঃ ২১
লেখাঃ #Mst_Liza
আজ শুক্রবার।মিরার ছুটির দিন।শীতের সকালে লেপের মধ্যে মুখ গুজে এখনও শুয়ে আছে মিরা।আর ভাবছে, সেই ২০ বছর আগের দিনটার কথা।যেদিনটা সবকিছু ঠিক হয়ে গিয়েছিল।না ছিল কোনও মান-অভিমান।আর না ছিল কোনও ভুল বুঝাবুঝি।ছিল শুধু একে অপরের প্রতি ভালোবাসা।রাইসূল দেশে ফেরার পর মা আর রাইসূলকে সোহাগ বলে দিয়েছিল মির্জা প্যালেসেই থাকতে হবে।এতে সোহাগও তার বোনকে মিস করবে না আর মিরাও তার মা, ভাইকে মিস করবে না।তারপর হাসি, আনন্দ আর যত্নে ভরপুর একটা পরিবারে ভালোই চলছিল তাদের দিন।এতো আনন্দের মাঝে কোথা থেকে যে কি হয়ে গেল! হয়তো সুখ বেশি দিন থাকে না তাই এমনটা হয়েছে।
অতীত,
সেদিন মিরা প্রেগনেন্সির রিপোর্টটা নিয়ে হসপিটাল থেকে বের হয়েছিল।হসপিটালের সামনেই হাসানের সাথে দেখা।হাসান মিরাকে একা পেয়ে জোড় করে তুলে নিয়ে যেতে চাই মিরা কোনমতে হাসানের কবল থেকে পালিয়ে আসে।আর পালানোর সময় রিপোর্টটা সেখানেই পরে যায়।মিরা ফিরে এসে সোহাগকে আর হাসানের কথা বলে নি সোহাগ চিন্তা করবে বলে।দু’দিন পর সোহাগের জন্মদিন। তাই মিরা ঠিক করে নেয় সোহাগকে সারপ্রাইজ পার্টি দেবে। সাথে এটাও বলবে আমি আপনার সন্তানের মা হতে চলেছি সোহাগ মির্জা।কিন্তু পার্টির দিন হাসান এসে সব কিছু লন্ড ভন্ড করে দেয়।হাসান নিজেকে দাবী করে মিরার সন্তানের বাবা হিসেবে।মিরা অনেকবার সোহাগকে বোঝায় কিন্তু সোহাগ বোঝে না।সোহাগের শুধু একটাই কথা তোমার প্রেগনেন্সির কথা আমায় আগে কেন যানাও নি।আর হাসানের কাছেই বা তোমার রিপোর্টটা গেল কিভাবে? নিজের স্ত্রী আর সন্তানকে অস্বীকার করে ওই বাইরের হাসানের কথার গুরুত্ব বেশি দিয়েছিল সেদিন সোহাগ।সকলের সামনে মিরাকে করেছিল অপমান, দিয়েছিল অপবাদ।মিরা অনেক মিনতি করেছে কিন্তু সোহাগ শোনে নি।রেগে গেলে যে মানুষটার মাথার ঠিক থাকে না।তাই বলে সোজা বাড়ি থেকেই মিরাকে বের করে দেবে? মিরা তো সোহাগের পায়ে পর্যন্ত পরেছিল, বলেছিল আপনি ছাড়া আমি একদম নিস্ব।প্লিজ আমাকে একটু থাকতে দিন।আমি আপনার বাড়িতে কোনো এক কোণে পরে থাকব।দিন শেষে শুধু আপনাকে দেখব তবুও এভাবে তারিয়ে দেবেন না।সোহাগ মিরার কোনো কথাই শুনি নি।মিরাকে তারিয়ে দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দেয়।দরজার ওপাশ থেকে হাসান এসে মিরার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যায়।মিরা হাসানের থেকে হাতটা ছাড়িয়ে ছুটতে থাকে।ছুটতে ছুটতে মিরা চলে আসে সোনাডাঙ্গার বাস স্যান্ডে। চারিদিকে হাসানের লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।মিরা সবার চোখ এড়িয়ে খুলনা টু ঢাকার বাসটিতে উঠে পরে।বাস চলতে শুরু করে আর মিরার মধ্যে এক নির্বাক যন্ত্রণা ও ভয় কাজ করে।এমন সময়ে মিরার পাশের সিটে বসে থাকা যাত্রী নিরু আপা মিরার সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা শুনে ঢাকায় পৌঁছে মিরাকে তার আশ্রমে নিয়ে যায়।সেই আশ্রমে মিরা বৃদ্ধ মানুষদের সেবা করে কাটিয়ে দেয় জীবনের ১৯টা বছর।
মিরার মেয়ে মায়া। যার কাছে মিরা তার সন্তানের বাবার পরিচয়টা গোপন রেখেছে।মিরা চাই নি মায়া যানুক তার বাবা কে! টেলিভিশনে যতবারই সোহাগের সাক্ষাৎ দেখাতো মিরা এক ধ্যানে সবকিছু ছেড়ে টেলিভিশনের সামনে পরে থাকত।শুধু সোহাগের মুখটা দেখবে বলে।মায়া কিছু জিজ্ঞাসা করলে মিরা বলতো সে সোহাগের অনেক বড় ফ্যান।মায়াও যখন কোনও পত্রিকায় সোহাগের কোনো ফটো ছাপা হতো সেই ফটো কেটে এনে মিরাকে গিফট করত।মিরার তখন ঠোঁটের কোণে এক চিলতি হাসি ফুটে উঠত।যা দেখে মায়ারও ভালো লাগত।কিন্তু মায়াকে কখনও মিরা বুঝতেই দিত না সোহাগ আসলে তার বাবা!
হঠাৎ একদিন আবির তার বাবা-মাকে সাথে করে মায়ার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে।মায়াও রাজি হয়।বিয়ের দিনখন সব ঠিক ঠাক।মিরাও মেয়ে বিয়ে দেবে বলে খুব ধুমধাম করে আয়োজন করে।জীবনের সব পুঁজি খরচ করে ফেলে মেয়ের বিয়ের জন্য।বিয়ে পরানোর সময় যখন মেয়ের বাবার নাম জিজ্ঞাসা করা হয় তখন মিরা চুপ থাকে।বলতে পারে না মায়ার বাবার নাম।উক্ত পরিস্থিতিতে সকলেই মিরাকে আবার অপবাদ দেয়।মায়াকেও সবাই বলে পিতৃপরিচয়হীন একটি মেয়ে।আবিরকে তার বাবা-মা নিয়ে যায় বিয়ের আসর ছেড়ে।তখন সবাই বলে মায়াকে কেউ বিয়ে করবে না।কেউ জড়াবে না মায়ার মতো মেয়ের সাথে সম্পর্কে।এমন সময়ে কোথা থেকে যেন সোহেব খান আর তার স্ত্রী মুফতি খান এসে মিরাকে বলে মায়াকে তারা পুত্রবধূ হিসেবে পেতে চাই।তারা নাকি মায়াকে অনেক আগে থেকেই চেনে।মায়া খুব ভালো মেয়ে যার সাথে তাদের ছেলে মাহির খুব ভালো থাকবে।মাহিরকে তারা ফোন করে বিয়ের আসরে আনে।মাহির বাবা-মায়ের সিদ্ধান্তে রাজি হয়ে বিয়ে করে নেয় মায়াকে।মিরা মাহিরকে বলেছিল, আমার মেয়েটাকে তুমি কখনও কস্ট দিও না বাবা।ও ছোটবেলা থেকে বাবাকে পাই নি ঠিকই কিন্তু আমি ওকে বাবা-মা কোনও কিছুর অভাব বুঝতে দিয় নি।ওর দুইটা পরিচয় এক।ওর বাবাও অামি আর মাও আমি দুই।ও তোমার স্ত্রী। ওর মধ্যে ছেলে মানুষিতে ভরপুর।কিন্তু ভেতরটা একদম পরিষ্কার।ওকে তুমি একটু শিখিয়ে পড়িয়ে নিও।
মিরা মাহিরকে আরও বলে বাবা আমার মেয়েটাকে আমি একজন আদর্শ ডাক্তার হিসেবে দেখতে চেয়েছিলাম।কিন্তু দেখও আমার সেই স্বপ্নটা আজ পূরণ হলো না ঠিকই তবে এমন একজনের হাতে ওকে তুলে দিচ্ছে যে খুলনার অনেক বড় একটা হসপিটালের ডাক্তার।
মাহির তখন মিরাকে থামিয়ে বলে আপনার মেয়ে যদি চায় তাহলে সেও একদিন ডাক্তার হবে।আমি নিজে ওকে সেইদিকটাই সাপোর্ট করবে।
মাহিরের কথায় মিরা অনেকটা খুশি হয়।মাহির মায়াকে বিয়ে করে খুলনায় নিয়ে আসে।মায়া চলে যাবার পর মিরা একদম একা হয়ে যায়।মায়ার বিয়ের দিন মিরা মায়ার বাবার নাম না বলায় আশপাশের মানুষও অনেক কথা বলা শুরু করে।মিরা পারে না এতো অপমান সহ্য করতে।তাই সেখান থেকেও চলে আসে বরিশাল।এখানে এক পুরোনো বান্ধবী রুমার সাহায্যে নিয়ে একটা স্কুলে জব পায়।ছোট ছোট বাচ্চাদের স্কুলে থাকলে সারাদিন শাসন করে, আদর করে কাটিয়ে দেয়। আর রাতের সময়টুকু মাঝে মাঝে মায়ার সাথে ফোনে কথা হয় না হলে টেলিভিশন দেখে কেটে যায়।
বর্তমান
।
মাহির গাড়ি নিয়ে স্নিগ্ধার বাড়ির সামনে এসে জোড়ে জোড়ে হর্ণ বাজাতে থাকে।স্নিগ্ধা এসে গাড়ীতে উঠলেই মাহির গাড়ি স্ট্যাড দেয়।
স্নিগ্ধাঃ গুড মনিং জান
মাহিরঃ,,,,,
স্নিগ্ধাঃ গুড মনিং বলেছি তোমাকে আমি?
ন্যাকা ন্যাকা ভাবে বলে।
মাহিরঃ,,,,,
মাহিরের কোনও প্রতিউত্তর না পেয়ে স্নিগ্ধা এবার রেগে যায়।
স্নিগ্ধাঃ কথা কানে যাচ্ছে না তোমার?
মাহিরঃ,,,,,,
স্নিগ্ধা মাহিরের শার্টের কলার ধরে নিজের সামনে টেনে আনে,
স্নিগ্ধাঃ ওই নষ্টা মেয়েটার জন্য তুমি আমার উপর এখনও রেগে আছো?
মাহির কিছু না বলেই গাড়িটা থামিয়ে দেয়।
মাহিরঃ গাড়ি থেকে নামো!
স্নিগ্ধাঃ মানে?
মাহিরঃ মানে বুঝছো না?
মাহির গাড়ি থেকে নেমে ঘুরে এসে স্নিগ্ধার পাশ থেকে গাড়ির দরজাটা খুলে,
মাহিরঃ নামো
স্নিগ্ধাঃ নাহ
মাহির স্নিগ্ধার হাত ধরে টেনে গাড়ির থেকে নামিয়ে দেয়।তারপর ঘুরে এসে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়িতে স্ট্যার্ড দিয়ে স্নিগ্ধাকে রেখে চলে যায়।
স্নিগ্ধা হা হয়ে আছে।এতো বড় অপমান?
স্নিগ্ধঃ মাহিরের সাহস হয় কিভাবে আমার সাথে এমনটা করার? ওই মেয়েটার জন্য? এর শোধ আমি নিয়ে ছাড়বো।
চলবে…..