বাড়ির পেছনের বাগানটায় ঝোপের আড়ালে বোরখা পরে, ব্যাগ হাতে ঘাপটি মেরে বসে আছে জিনাত।বাড়ির মধ্যে থেকে চিৎকার, চেচামেচির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।ভয়ে থরথর করে কাপছে সে।বার বার নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছে সে,,কেনো ও ওর বাবার কথা আগে শুনলো না! এখন তো পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, ও চাইলেও আর সহজে পালাতে পারবে না।নিজের গালে নিজেরই এখন চড় মারতে মনে চাচ্ছে ওর।
হঠাৎ ভাবলো,,,নাহ,এভাবে বসে থাকালে কোনো সমাধান হবে না,,,আমাকে এখান থেকে বের হতেই হবে।নয়তো বাস ছেড়ে দিলে,,দিনের আলোয় আমি পালাতে পারবো না।আমি কিছুতেই আমার জীবনটা এভাবে নষ্ট হতে দেবো না।
এই ভেবে ও আস্তে উঠে দাড়ালো।পা টিপে টিপে নিঃশব্দে এগোতে লাগলো।বড়ো আম গাছটার পেছনে দাঁড়িয়ে উকি দিয়ে দেখলো,,বাড়ির গেটের দিকটা ফাঁকা আছে।নাহ,,আর দেরী করা যাবে না,এই সুযোগ! এইভেবে ও একটা দৌড় দিলো গেটের দিকে।
এক দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে বড়ো রাস্তায় এসে দাড়ালো জিনাত।প্রচন্ড হাপাতে লাগলো ও।হাত থাকা ঘড়িটার দিকে তাকালো সে।৯ টা বাজে।দশটায় যশোরের বাস ধরতে হবে তার।তাই তাড়াতাড়ি একটা সি এন জি ডেকে উঠে বসলো ও।
সি এন জি তে উঠে ব্যাগে থাকা ঠান্ডা পানির বোতলটা বের করে,ঢকঢক করে অনেকটা পানি খেয়ে চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো সে।এই অবস্থায় মাথা ঠান্ডা রাখাটা খুব জরুরী।
কিন্তু চোখ মেলেই চিৎকার করে উঠলো জিনাত,,, একি আপনাকে আমি বাস স্ট্যান্ডে যেতে বলেছি,,,আর আপনি অন্য রাস্তায় যাচ্ছেন কেনো?
— অন্য রাস্তা না,,,সঠিক রাস্তাতেই যাচ্ছি!! (একটা রাশভারি কন্ঠে বললো ড্রাইভার)
–মানে,কি বলছেন আপনি?গাড়ি থামান, থামান বলছি!!
গাড়িটা থেমে গেলো।ড্রাইভার ঘাড় ঘুরিয়ে জিনাতের দিকে তাকাতেই, জিনাতের চোখ কপালে উঠে গেলো!!
-আ,আ,,আপনি (ভয়ে ভয়ে বললো জিনাত)
–ক্যানো,,অন্যকারো আসার কথা ছিলো নাকি?তোর আর তোর বাপের এতো সাহস!!যে এই রায়ানকে তোরা বোকা বানাতে চাস,,যার ভয়ে এই শহর কাপে!।তোর বাপ তো আমার হবু শ্বশুর,, তাই তাকে কিছু করিনি,,কিন্তু তুই এর ফলভোগ করবি।যদি ভালো চাস,,চুপচাপ বসে থাক।
জিনাত কি করবে বুঝতে পারছে না,, বাঘের হাত থেকে বাচতে গিয়ে,, সরাসরি বাঘের গুহায় এসেই পরলো সে।
সাতপাঁচ না ভেবে জিনাত গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে দৌড় দিলো,,কিন্তু বেশিদূর যেতে পারলো না,এর মাঝেই রায়ান দৌড়ে এসে ওকে ধরে ফেললো। হিজাবের উপর দিয়েই ওর চুলের মুঠি চেপে ধরে হুংকার দিয়ে বললো,,,,এখনো এতো সাহস দেখাস তুই,,কি ভেবেছিস আমাকে ,, রাস্তার মোড়ের কোনো পাতি মাস্তান আমি, যে আমার থেকে পালানো এতোই সোজা হবে,,,এই শহরের বাপ আমি,,আমি না চাইলে এই শহর থেকে পালানোর ক্ষমতা কারোর নেই।
চল আমার সাথে,,,,,
রায়ান জিনাতের হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগলো,,
–প্লিজ ছাড়ুন আমাকে,,,যাবো না আমি,,ছাড়ুন,,,ছাড়ুন বলছি,, (কাদতে কাদতে হাত ঝাকাতে লাগলো জিনাত)
ওদের সামনে একটা জীপ এসে থামলো।জীপে রায়ানের কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গ ছিলো।রায়ান জোর করে জিনাতকে গাড়িতে উঠিয়ে বসালো।গাড়িতে উঠে জিনাত সমানে চিৎকার চেচামেচি আর হাত পা ছুড়তে লাগলো।তাই রায়ান,,দড়ি দিয়ে জিনাতের হাত পা বেধে, মুখে টেপ লাগিয়ে দিলো।
এবার আর জিনাতের কিছুই করার থাকলো না।বসে বসে শুধু চোখের পানি ফেলতে লাগলো।
গাড়ি চলতে শুরু করলো,,,,
– ভাই,কোনদিকে যাবো?(গাড়ি চালাতে থাকা ছেলেটা জিজ্ঞেস করলো)
-সোজা কাজি অফিস!(হাসিমুখে বললো রায়ান)
কাজি অফিসের কথা শুনেই জিনাতের চোখদুটো বড়বড় হয়ে গেলো। ও আকুতি ভরা দৃষ্টি নিয়ে রায়ানের দিকে তাকালো,,মাথা নাড়িয়ে না,না করতে লাগলো।ওর চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছিলো।
কিন্তু রায়ান এগুলো আমলে নিলো না।
-ভাই,,তোমার বিয়ে এভাবে হবে?কত্ত স্বপ্ন ছিলো আমাদের তোমার বিয়ে নিয়ে,,আমরা অনেক বড়ো করে অনুষ্ঠান করবো,নাচগান হবে,বিশাল ভোজ হবে,,,,এখন তো দেখি কিছুই হবে না(রায়ানের সবচেয়ে ক্লোজ চ্যালা ফারদিন)
–এহ,,তাইলে আর কেম্নে হবে,,গুন্ডামাস্তানের সাথে কি আর ভদ্রলোকে মেয়ে বিয়ে দিতে চায়,,গুন্ডামাস্তানরা জোর করেই বিয়ে করে,,আর জোর করে করা বিয়ের কোনো অনুষ্ঠান হয় না বুঝলি!!
– তবুও ভাই,,ভাললাগে না!!
-আচ্ছা যা,, তোদের ভাবি টাকা দিয়ে দিবো নে,,তোরা নিজেদের মতো ফূর্তি করিস।
এই কথা শোনার সাথে সাথে জীপে থাকা সবগুলো ছেলে একসাথে হইহই করে উঠলো।
গাড়ি এসে কাজি অফিসের সামনে থামলো।রায়ান জিনাতকে হাত পা খুলে দিয়ে টানতে টানতে কাজি অফিসের ভিতরে নিয়ে গেলো।
বিয়ের যাবতীয় কাগজ পত্র আগেই রেডি করে রাখতে বলা হয়েছিলো।তাই ওরা আসার সাথে সাথেই কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন।
–আমি এই বিয়ে করবোনা,,কিছুতেই না,,এভাবে জোর করে কি বিয়ে হয় নাকি?কাজি সাহেব প্লিজ এসব বন্ধ করুন।আমি রাজি না এই বিয়েতে,,আমার পরিবারের কেউ রাজি না।(কাদতে কাদতে বলছে জিনাত)
এবার রায়ানের মেজাজ চড়ে গেলো।ও একহাত দিয়ে জিনাতের দু গাল চেপে ধরে বললো,,,অনেক বকবক করেছি তুই,,আর না,!!আর একটা বাজে কথা বললে,,তোর বাপ মাকে আর জিন্দা দেখতে পাবি না,,বুঝলি,,
-মানে,,কি করেছেন আপনি তাদের সাথে?
-তেমন কিছুই করিনি,, শুধু বেধে রেখেছি,,তুই এমন তেরিবেরি করলে অনেক কিছুই করতে হবে।আর দ্যাখ,,চাইলেও তোরা কিছু করতে পারবি না,,আর পালাতেও পারবি না।তাই যা হচ্ছে চুপচাপ মেনে নে।আমাকে বেশি রাগাস না,,,আমার রাগ কিন্তু বড্ড ভয়ানক!!
জিনাত মাথা নিচু করে চুপচাপ চোখের পানি ফেলছে।এই মুহূর্তে নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে তার।এমন একটা দাগী আসামিকে বিয়ে করার চাইতে মরে যাওয়াটাও ভালো মনে হচ্ছে।কিন্তু ওর বাবা মায়ের জন্য,,, রায়ানের কথা মানা ছাড়া জিনাতের আর কোনো উপায় নেই।
কাজী বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন। কবুল বলার সময়, জিনাতের বুকটা যেনো ফেটে যাচ্ছিলো।চোখের সামনে নিজের স্বপ্নে দেখা ভবিষ্যৎ টা ভেসে উঠলো।কতো স্বপ্ন ছিলো ওর,,ভালোভাবে পড়াশোনা করে প্রশাসনিক পর্যায়ে কাজ করার।ওর বাবার খুব আশা মেয়েকে প্রশাসনিক পর্যায়ে দেখার।কারন তার কোনো ছেলে নেই।জিনাত হবার পরে, ওর মা,চিরদিনের মতো মা হবার ক্ষমতা হারায়।অনেকেই তাকে বলেছিলো,,আবার বিয়ে করার জন্য, কারণ মেয়ে দিয়ে ভবিষ্যৎ হয় না।কিন্তু জিনাতের বাবা বলেছিলো,,আমার মেয়ে একদিন এমন পর্যায়ে যাবে যে, তোমাদের ধারণা ভুল প্রমাণ করবে। তাই জিনাত বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে সেই ভাবেই নিজেকে তৈরী করছিলো ।ছোটো বেলা থেকেই খুব মেধাবী ছাত্রী জিনাত।বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে অনার্স এর প্রথম বর্ষে পড়ছে ও।কিন্তু এক ঝটকায় সব শেষ হয়ে গেলো।ওর পড়াশোনা, ওর স্বপ্ন, ওর ভবিষ্যৎ সব যেন অন্ধকারে তলিয়ে গেল।
রায়ান জিনাতের হাত ধরে টান দিতেই জিনাতের ভাবনার ছেদ পরলো।
-চলো,, আমাদের যেতে হবে(রায়ান)
জিনাত আর কিছুই বললো না,,চুপচাপ রায়ানের সাথে গিয়ে গাড়িতে উঠলো।
চলবে?
গল্পঃ স্ত্রী
পর্বঃ১
লেখিকা ঃতাওহীদা