গল্প:#গল্পের_অন্তরালের_অপূর্ণতা,(#পর্ব-৪)
লেখা:#নাজিফা_তাবাসসুম
জুনিয়র পুলিশ অফিসার সুজন রামিশা মার্ডার কেসের দায়িত্বে আছে। তাই সে ইন্সপেক্টর আহসানুল হকের সাথে কেস নিয়ে কথা বলার জন্য এসেছে।
– স্যার আমি তো এই কেসটা হ্যান্ডেল করছি,কিন্তু এই কেস এর মূল আসামি পূর্ণতাকে রহমানকে ছাড়া তো আমি কাউকেই সন্দেহের তালিকায় ফেলতে পারছি না।
– দেখ সুজন… আমি তো বুঝতে পারছি না তুমি প্রধান আসামি পূর্ণতা থাকে সন্দেহের তালিকায় ফেলেছো কেন? সেই তো খুনি সে বিষয় তো সম্পূর্ণভাবেই পরিষ্কার।
-কিন্তু স্যার ,তিনি এখনো পুরোপুরি জবানবন্দি দিচ্ছেন না, তিনি শুধু এক কথা বলে যাচ্ছেন গত পাঁচদিন ধরে যে তিনি নির্দোষ । তিনি নাকি জানেন না রামিশা কে খুন করেছে…।
– হাসালে সুজন!!এত সাধারন চিন্তা ভাবনা নিয়ে পুলিশে চাকরি করবে কিভাবে?তুমি আসামির কথা বিশ্বাস করবে নাকি কেস নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে সেটা তোমার উপরেই নির্ভর করছে। তবে এ ধরনের বোকার মত কথা আমার কাছে এসে বলবে না।
– দুঃখিত স্যার এ ধরনের ভুল আর হবে না তবে আমি কেসটা সলভ করার সম্পূর্ণ চেষ্টা করছি।
– সুজন তোমাকে যত দ্রুত সম্ভব এই কেস সলভ করতে হবে। মিস রামিশার বাবা-মা মেয়ের অকাল মৃত্যুতে খুব কষ্ট পেয়েছে; তারা চাপ দিচ্ছে। কেসটা যত তাড়াতাড়ি সলভ হবে ততই ভালো।
সুজন ইন্সপেক্টর আহসানুল হকের রুম থেকে বের হওয়ার সময় বাইরে এসে লক্ষ করল, আজও রামিশার বাবা-মা থানায় এসেছে তার মেয়ের মার্ডার কেসের অগ্রগতি সম্পর্কে জানার জন্য… সুজনের হঠাৎ করে খুব খারাপ লাগলো… রামিশার বাবা মা জন্য তাদের মেয়ের জন্য কত কষ্ট পাচ্ছেন, এসব ভাবতেই সুজনের মনে হলো এই কেসটা যেভাবে হোক দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে এবং পূর্ণতাকে তার সঠিক সাজা দিতেই হবে।
পূর্ণতা গত পাঁচ দিন ধরে পুলিশি হেফাজতে আছে তাকে একটি সেলে রাখা হয়েছে। গত পাঁচ দিনে অতিরিক্ত চিন্তায়, কষ্টে , দুঃখে পূর্ণতার চেহারা ভেঙে গিয়েছে। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। সে এত বাজে ভাবে কেন ফেঁসে গেল তাও আবার তারই বান্ধবীর খুনের দায়ে… পূর্ণতার বাবা গত চার দিন আগে পঞ্চগড় থেকে ঢাকা শহরে এসেছে পূর্ণতার অ্যারেস্ট হওয়ার খবর শুনে ; তার বাবা হন্য হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাকে মুক্ত করার জন্য । কিন্তু পরিস্থিতি তার অনুকূলে নেই। তার দরিদ্র কৃষক বাবার পক্ষে তাকে জামিন নিয়ে বের করে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
প্রত্যেকটা প্রমাণ পূর্ণতার বিরুদ্ধে পাওয়া গিয়েছে। পূর্ণতা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে সে এতো সহজে মুক্তি পাবে না।
রামিশাকে চাকু দিয়ে কুপিয়ে খুন করা হয়েছে এবং সেই চাকুতে পূর্ণতার ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গিয়েছে। রামিশা পাঁচ দিন ধরে নিখোঁজ ছিল, সেটা তার বিল্ডিংয়ের সবাই পুলিশকে জানিয়েছে এবং পূর্ণতার আচরণে অনেক অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেছে সে সম্পর্কও বিস্তারিত হয়তো জানিয়েছে। তবে সে বারবার পুলিশ কে বলেছে রামিশা একটি গেমে জড়িত ছিল যে গেমের নাম “Save Me”। কিন্তু পুলিশ তার কথায় কান দেয়নি…. কারণ তার কথা যথাযথ কোন ভিত্তি নেই। এ সংক্রান্ত কোন তথ্য পুলিশ খুঁজে পায়নি। পূর্ণতা কি করবে কিছু বুঝতে পারছেনা তবে সে যে এত সহজে এখান থেকে বের হতে পারবে না সেটা ভালোমতোই বুঝতে পেরেছে।
জুনিয়র অফিসার সুজন পূর্ণতার বাসায় আবার গেল। যদি কোন জরুরী তথ্য পাওয়া যায়, সুজন পুরো বাসাটি ঘুরে দেখল। কিন্তু এখানে সেরকম কিছু না পেয়ে হতাশ হয়ে গেল। তবে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সে সোফার নিচে একটি ল্যাপটপ দেখতে পেল, সাথে ঘরের কোণে রাখা ময়লা ফেলার ঝুড়িতে কিছু দোমড়ানো মোচড়ানো কাগজ পাওয়া গেল, কাগজ গুলোর মোড়ক খুলে সে দেখতে পেল কাগজগুলো একজন ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন। ডাক্তারটি মানসিক রোগ স্পেশালিস্ট। নাম “শায়লা আক্তার”।
সুজন সেই মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিল, এই ডাক্তারের সাথে এখন দেখা করতে হবে। তার হয়তোবা এখান থেকেই তার অনেক কিছু সহজ হয়ে যাবে…
জুনিয়র অফিসার সুজন বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেল ডক্টর শায়লা চেম্বারে বসে আছে। ডক্টর শায়লার সাথে সুজন কেস নিয়ে অনেকক্ষণ কথা বলল এবং পূর্ণতার ব্যাপারটি তাকে বুঝিয়ে বলল।
সবকিছু শুনে ডাক্তার শায়লা বলল পূর্ণতা আমার পেশেন্ট ছিল। গত দুই বছর যাবত ওর বিভিন্ন রকম মানসিক সমস্যার কারণে সে আমার কাছে ট্রিটমেন্ট নিচ্ছিল।
অফিসার সুজন বলল, সেকি আসলে মানসিক ভাবে অসুস্থ ? নাকি সে নাটক করছে সেটাই বুঝতে পারছি না। আর যদি তার মানসিক সমস্যা থেকেই থাকে তবে তার কি ধরনের সমস্যা রয়েছে?
অফিসার সুজনের প্রশ্ন শুনে ডক্টর শায়লা গম্ভীর মুখে উত্তর দিল, আমার পেশেন্ট পূর্ণতা একটি বিরল রোগে আক্রান্ত রোগটির নাম “মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার” বা “আইডেনটিটি ডিজঅর্ডার”এবং তার সাথে সাথে পূর্ণতা ডিমেনশিয়াতেও আক্রান্ত।
ডক্টর শায়লার মুখে এই অচেনা রোগ গুলোর নাম শুনে সুজন হকচকিয়ে গেল। সে বলল, আসলে আমার এই ধরনের রোগ সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা নেই বললেই চলে। তাই যদি বিস্তারিত বলতেন তবে ভালো হতো।
– আচ্ছা, তাহলে আমি এক্সপ্লেইন করছি মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার বা আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডার এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ভেতরে দুই ধরনের সত্তা বিরাজমান থাকে অর্থাৎ এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিজেদের ভিতর দুই ধরনের পার্সোনালিটি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। যেমন পূর্ণতার ক্ষেত্রে যদি বলতে হয়, তাহলে বিষয়টা এমন যে পূর্ণতা দুই ধরনের সত্তাতাকে নিয়ে জীবন পার করছে।
একটি হচ্ছে তার নিজস্ব সত্তা এবং আরেকটি হচ্ছে তার কাল্পনিক সত্তা। তার কাল্পনিক সত্তাতে সে একজন পুরুষ। সে যখন পুরুষের পার্সোনালিটিতে থাকে তখন সে তার নিজের পার্সোনালিটিকে ভুলে যায় অর্থাৎ তার কিছুই মনে থাকেনা। তখন তার মনে হয় সেটাই তো জীবন।
আবার সে হঠাৎ করে যখন নিজের পার্সোনালিটি তো ফিরে আসে তখন নিজের সেই কথা পার্সোনালিটি সম্পর্কে তার কিছুই মনেই থাকে না। সেই সত্তাকে তার কাছে মনে হয় অন্য আরেকজন মানুষ, অর্থাৎ সে নিজেকে আরেকজন মানুষ হিসেবে সাথে কল্পনা করে।
অফিসের সুমন বিস্মিত হয়ে বললেন, এ ধরনের রোগ আছে পৃথিবীতে!!
-এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই সারা পৃথিবীর অল্প সংখ্যক মানুষের এ ধরনের রোগ হয় ; পূর্ণতা তাদের মধ্যেই একজন। এর সাথে সাথে পূর্ণতার ডিমেনশিয়া নামক ভুলে যাওয়া রোগ আছে। সে সহজে অনেক কিছু ভুলে যায়। অনেক কিছু মনে রাখতে পারে না। তাকে আমি সাজেস্ট করেছিলাম, সে যেন কিছু ভুলে যাওয়ার আগে অবশ্যই ডায়েরীতে সেটা নোট করে রাখে।
– হ্যাঁ সেটা অবশ্য ঠিক। আমরা রামিশার মার্ডার হওয়ার প্লেসের পাশে একটা ডায়েরী পেয়েছিলাম। সেখানে দেখলাম, পূর্নতা এবং তার এক বন্ধু কবীর রামিশার জন্য মিসিং ডায়েরি করতে থানায় গিয়েছিল। বিষয়টি দেখে বেশ অবাক হয়েছি।
কিন্তু থানায় সে আমাদের সাথে কো-অপারেশন করার সময় বারবারই বলছিল, সে নাকি কিডন্যাপ হয়েছিল। রামিশা ও তার বন্ধু কবীর নাকি তার মিসিং ডায়েরি করতে গেয়েছিল। এ বিষয়টি খুবই অদ্ভুত লেগেছে আমার কাছে।
ডক্টর শায়লা বললো, সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, রামিশার পার্সোনালিটিকে অনেক সময় পূর্ণতা তার নিজের পার্সোনালিটি হিসেবে ধরে। তবে সেটা খুব একটা বেশিদিন হয়নি ।খুবই সমসাময়িক ভাবে তার এই নতুন একটি পার্সোনালিটি এসেছে, সাথে সাথে তার ডিমেনশিয়া ও তীব্র হয়ে যাওয়ার কারণে সে যা যা করেছে সবকিছু সে ভুলে যাচ্ছে। এই সব কয়টি বিষয় তীব্রভাবে হয়েছে।
– সে আমাদের কাছে বারবার বলছিল, রামিশা নাকি একটি গেম খেলতো। মিস পূর্ণতার ধারণা সেই গেমের কোনো এক কারণে রামিশা কে খুন করা হয়েছে, এই বিষয়টি সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কি?
– এ বিষয়টি সম্পন্নই পূর্ণতার কাল্পনিক । এটা সে আমার কাছেও অনেকবার বলেছিল। কিন্তু এটি সম্পূর্ণই বানানো এবং তার কল্পনা ছাড়া আর কিছুই না। তাছাড়া সে সবুজ কালার দেখলেই একটু অস্বাভাবিক হয়ে যায়। ওর কালার ফোবিয়া আছে।
– ডক্টর শায়লা, একটা বিষয় কি জানেন? আমি তার ঘর থেকে পাওয়া ল্যাপটপ পেয়েছি। ল্যাপটপটি দেখেই স্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে , সেটি পূর্ণতার। কিন্তু সে অস্বীকার করছে। সেটি নাকি তার নয়। তার জবানবন্দিতে সেটি রামিশার ল্যাপটপ।
ল্যাপটপে সেভ করা একটি সিসিটিভি ফুটেজ দেখলাম। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে অনেক অবাক হলাম। সে তার পাশের ঘরে সিসিটিভি লাগিয়ে রেখেছে। সেই রুমে পূর্ণতা রামিশাকে চার দিন ধরে অমানবিক নির্যাতন করে মেরেছে। রামিশার ওপর পূর্ণতার কি কারণে এত ভয়াবহ রাগ সেটি বুঝতে পারলাম না।
আর একটি আরেকটি ফুটেজে দেখলাম, সে কারোর সাথে ফোনে কথা বলছিল। দু’রকম কণ্ঠস্বর করে!!এই বিষয় গুলোর ব্যাখা কি?
– পূর্ণতা ভালো ভেন্ট্রিকুয়েলিজম করতে পারত সেই জন্য হয়ত বা তাকে সে দুই রকম কণ্ঠস্বরে কথা বলতে দেখেছেন।
ডক্টর স্যারের চেম্বার থেকে অফিসারের সুমন বের হওয়ার উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়ালো।
– ডক্টর আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। অনেক সাহায্য করলেন।
– ইটস্ ওকে। এটা আমার দ্বায়িত্ব ছিল।
অফিসার সুজনের সামনে পূর্ণতাকে ঘিরে থাকা বিরাট বড় একটা রহস্য অনেকটাই সমাধান হয়ে গেল। এখন সামান্য একটা ছোট কাজ আছে। সেটা করার জন্য তার এখন পূর্ণতার সাথে কথা বলতে হবে। ইমিডিয়েটলি!!!
বিশেষ দ্রষ্টব্য: (পড়ে কেমন লাগলো অবশ্যই মন্তব্য করে জানাবেন। আশা করি আজকের পর্বে অনেক রহস্য সমাধান হয়েছে। যদি কোন ভুল ত্রুটি হয় তবে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।ধন্যবাদ।)