গল্প:#গল্পের_অন্তরালের_অপূর্ণতা,(#অন্তিম_পর্ব)
লেখা:#নাজিফা_তাবাসসুম
আহসানুল হক সুজনের তৈরি করা রিপোর্ট দেখে বেশ অবাক হলেন। এসব কি সুজন?? এগুলো কি তৈরি করে এনেছো তুমি?
– স্যার এই রিপোর্টে যা যা আছে সব গুলোই ঠিক তথ্য।
-মানে?
– স্যার মিস রামিশার মার্ডার কেসের যদি একটা মূল ছোট ব্যাখ্যা বা হাইপোথিসিস দাঁড় করাই তবে বিষয়টি এমন হয় যে, প্রধান আসামি পূর্ণতা একজন মানসিক রোগী তার ভিতরে দুই ধরনের অসুখ রয়েছে প্রথমটি হলো , মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার বা আইডেন্টিটি ডিজঅর্ডার এবং আরেকটি ডিমেনশিয়া। আমি তার ডাক্তারের কাছ থেকে জানতে পেরেছি এই রোগের বিস্তারিত।
স্যার আমি আপনাকে কাগজে ব্যাখ্যা করে দিয়েছি আপনারা পড়ে নিতে পারেন এবং সাথে সাথে তার ডিমেনশিয়া ও ছিল এ রোগটি মূলত সব কিছু ভুলে যাওয়ার রোগ। ডিমেনশিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে মিস পূর্ণতা যা যা করছে সব কিছুই ভুলে যাচ্ছে এবং আস্তে আস্তে এই রোগটি তীব্রতা পেতে পেতে একসময় সে নিজেকে ভুলে যেতে শুরু করবে। যার সর্বশেষ স্তর আমাদের কথা মতে বদ্ধ উন্মাদ ।
– তুমি বলতে চাচ্ছ আসামির পূর্ণতা নির্দোষ!! সে অসুস্থ অবস্থায় খুন করেছে?
– স্যার আমি তাকে নির্দোষ বলছি না; তবে সে খুন করেছে অসুস্থ অবস্থায় এটি বলছি।
– আসামী পূর্ণতার বাবাতো তাকে জামিন করাতে চাচ্ছে। তবে এখন তো আর তার হয়তোবা জামিন হবে
না।কেস এখন আদালতে উঠবে।
– জ্বি স্যার।
– তুমি আমাকে বলেছিলে তুমি একটা ফুটেজ পেয়েছিলেন তার বাসা থেকে সেটা কি তোমার কাছে এখন আছে?
-জ্বি স্যার ফুটেজটি আমার কাছেই আছে। আমি আপনাকে দেখানোর জন্যই এনেছি।
অফিসের সময় ফুটেজটি আহসানুল হকের সামনে অন করলেন। স্পষ্ট দেখতে পেলেন পূর্ণতা চার দিন ধরে রামিশাকে অমানবিক ভাবে নির্যাতন করছে। এবং সে নিজেই রান্নাঘর থেকে চাকু নিয়ে রামিশাকে খুন করছে।
খুন করার পর রামিশার দিকে পূর্ণতা তাকিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। এবং বিস্ময়কর ভাবে সে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে স্বাভাবিকভাবেই কাজ করতে লাগলো। পরক্ষণেই সে আবারও তার লাশের সামনে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।
আহসানুল হক এ ধরনের ফুটেজ দেখে বেশ অবাক হলেন এবং তার শরীর বেশ খারাপ হয়ে গেল। বাস্তবিক জীবনে তিনি কখনো খুন হওয়া কোনদিন দেখেননি। তার বমি আসতে লাগলো, তিনি সুজনের সামনে দিয়েই বাথরুমে দ্রুত চলে গেলেন।
বেশ কিছুক্ষণ পর তিনি বাথরুম থেকে এসে দেখলেন সুজন ল্যাপটপ বন্ধ করে তার টেবিলের সামনের চেয়ারে বসে আছে।
– স্যার আপনার কি এখনো বেশি খারাপ লাগছে? আমি যদি জানতাম আপনার শরীর খারাপ করবে। তবে আমি এই ফুটেজ আপনাকে দেখাতাম না।
– না সেরকম কিছু না। এ ধরনের দৃশ্য কোনদিন দেখিনি তো। এজন্য নিতে পারছিলাম না। তবে আমার এই পূর্ণতা নামের মেয়েটির উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে এই মেয়েটির কোন অসুখ বিসুখ কিছুই নেই। ইচ্ছা করে যতসব নাটক করছে।
– স্যার সে রকমটাই ভাবা স্বাভাবিক । আমিও প্রথমে সেটাই ভেবেছিলাম , তবে তার সাইকোলজিক্যাল অবস্থা রিসার্চ করে যেটা দেখলাম, সে আসলেই অসুস্থ।
– আচ্ছা তুমি কি তার বন্ধু কবীরের সাথে কথা বলেছিলে? এই বিষয়ে তার মন্তব্য কি?
– জ্বি স্যার, কথা বলেছিলাম। সে এই বিষয়ে কিছুই জানে না।তবে সে রামিশার মৃত্যুতে অনেক কষ্ট পেয়েছে। তাদের মধ্যে কিছু একটা সম্পর্ক ছিল সবার গোপনে; সেটা বুঝতে পারলাম তার সাথে কথা বলতে গিয়ে।
– তাহলে বলতে চাচ্ছ তার এই কেসের সাথে কোন সম্পৃক্ততা নেই?
– না সে কেসের সাথে কোন প্রকার যুক্ত নেই।
অফিসার সুজন ইন্সপেক্টর আহসানুল হকের কাছে সব রিপোর্টে এবং ফুটেজ দিয়ে বেরিয়ে আসলো। এখন তার উদ্দেশ্য পূর্ণতার সাথে কথা বলা। সে শেষবারের মতো দেখতে চায় পূর্ণতার বক্তব্য কী!!
পূর্ণতা হাজতের এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে ছিল তার আশেপাশে অনেক হাজতীরা তাকে নিয়ে অনেক মজা করছে।
সুজন পূর্ণতাকে আলাদাভাবে কথা বলার জন্য আলাদা করে ডেকে নিল।
পূর্ণতা তার সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে। সে মৃদু স্বরে বললো, ‘আমি নির্দোষ’।
– আপনি নির্দোষ নন.. আপনি নিজে আপনার বান্ধবীকে খুন করেছেন এবং নৃশংসভাবেই খুন করেছেন বলা যায়।
পূর্ণতা মাথা তুলে তার দিকে তাকালো। সে বলল, এসব কি বলছেন?
অফিসের সময় পূর্ণতার সামনে তার খুন করার ফুটেজটি চালু করল।
পূর্ণতা তার ফুটেজটির দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যেন কি হচ্ছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না । সে একবার সুজনের দিকে তাকাচ্ছে আর একবার ফুটেজটির দিকে।
– আমি…
-হ্যাঁ আপনি তাকে খুন করেছেন। কারণ আপনি কবীরকে পছন্দ করতেন কিন্তু যখন দেখলেন আপনার বান্ধবী রামিশা এবং কবীরের মধ্যে আগে থেকেই একটি সম্পর্ক রয়েছে , তখন আপনি বিষয়টি মেনে নিতে পারলেন না। তাছাড়া আপনি প্রচন্ড আত্ম অহংকারী এবং জেদী একজন। যার কারণে আপনার এই অসুখগুলোর যথাযথ চিকিৎসা করা হলোও আপনি সুস্থ হতে পারছেন না। কারণ আপনি নিজের ভেতর যে ধরে রেখেছেন আপনি সুস্থ। আপনার এই বিশ্বাস আপনাকে আরো অসুস্থ করে তুলছে।
– আপনি মানে… কিভাবে জানলেন?
-আপনার ডাক্তার শায়লা সাথে আমি কথা বলেছিলাম আপনার ব্যাপারে। তিনি সবকিছুই জানিয়েছে আপনার ব্যাপারে। একটা কথা না বললেই নয় ,আপনি যতটাই খুবই সাধারণ থাকার অভিনয় করেন না;কেন আপনি কিন্তু মানুষটা ততটা ভালো নন।
পূর্ণতা কোন উত্তর দিল না সে মাথা নিচু করে চুপ করে বসে থাকল। মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল, আমার কি ফাঁসি হবে?
– না আপনার আগেই মত ফাঁসি হবে না । কারণ আপনি মানসিকভাবে অসুস্থ। আপনাকে মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে রেখে আপনাকে সুস্থ করা হবে তারপর হয়তো আপনার ফাঁসি হবে।
পূর্ণতা এবার আর কোন প্রশ্ন করল না সে চোখ তুলে সুজনের দিকে তাকালো। তা চেহারায় গভীর বেদনার ছাপ।
প্রায় পাঁচ বছর পার হয়ে গিয়েছে,
পূর্ণতা এখন মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে রয়েছে। তবে সব পাগলদের মধ্যে পূর্ণতা সবার চাইতে আলাদা। সে এখন সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করছে। কিন্তু মাঝেমধ্যে সে তিন ধরনের মানুষের মত আচরণ করে কখনো সে নিজের মত আচরণ করে, কখনো রামিশার মত, কখনো একজন পুরুষের মতো। সে যেই অন্যায়টা করেছে তার জন্য সে অনুতপ্ত। কিন্তু, সে এক সময়ে ভুলে যায় সে কি অন্যায় করেছে। তাই সে মুক্তি চায় আজো…।
কিন্তু পূর্ণতার জীবনের গল্পটি থেমে গিয়েছিল সেখানেই… পূর্ণতার গল্পের অন্তরালের অপূর্ণতাকে কখনোই পূর্ণতা গল্পের অন্তরাল থেকে বাস্তবে নিয়ে আসতে পারবে না। পূর্ণতার গল্পটি হয়তোবা অপূর্ণই থেকে যাবে। গল্পের অন্তরালের অপূর্ণতাকে কখনোই পূর্ণতা দেওয়া যাবে না….
এভাবেই হয়তো অনেক গল্পের সমাপ্তি ঘটে।
(সমাপ্ত)