গল্প : একটি লাল গোলাপের হাসি পর্ব-১

0
5287

আমি টম এন্ড জেরি দেখছি আর নুডুলস্ খাচ্ছি। এমন সময় কেউ চেচিয়ে বললো,

-মা, আমি যে টেবিলের উপর নুডুলস রেখেছিলাম সেটা কোথায় গেল?

তায়েফের মা উত্তর দিলো,
-আমি দেখিনি। হয়ত বিড়ালে খেয়ে ফেলেছে।

বন্ধু তায়েফের বাসায় এসেছি ওর সাথে দেখা করতে। ও ওয়াশরুমে গেছে। আমাকে বলে গেছে বসে বসে টিভি দেখতে। আমি পাশের রুমের টেবিলের উপরে নুডুলস রাখা দেখে সেটা নিয়ে এসে খেতে লাগলাম। কিছু খেতে খেতে টিভি দেখার মজাই আলাদা। আর সেটা যদি হয় ফেভারিট খাবারগুলোর কোন একটি তাহলে তো আর কোন কথাই নেই। মেয়েটি সম্ভবত তায়েফের বোন হবে। কে জানে, দেখা হয়নি কোনদিন। শুধু শুনেছিলাম, ওর বোন নাকি ময়মনসিংহে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। ব্যাস এটুকুই।

এমনিতে কারোর বাসা-বাড়িতে গেলে প্রথমেই সেখানকার রান্নাঘরে যাওয়াটা আমার জন্য অবশ্য কর্তব্য। গিয়েই সবকটা পাতিল দেখে নিই কোনটায় কি আছে। আর নিজের পছন্দের কিছু থাকলে তো আর কোন কোন কথাই নেই, খাওয়া শুরু করে দিই। অবশ্য, এগুলো নিজের রিলেটিভদের কারোর বাড়িতে গেলেই করে থাকি। তায়েফদের বাসায় এনিয়ে তিনবার আসলাম। ওর মায়ের সাথে মোটামুটি ভালোই বুঝাপড়া আছে আমার। আমাকেও অনেক আদর করেন উনি।

আবার শুনতে পেলাম,
-বিড়ালে নুডুলস খেলে কি চামচ আর বাটি সহ খেয়ে ফেলেছে নাকি? সেগুলো পাচ্ছিনা কেন?

বেশ রেগেমেগেই কথাটি বললো শুনলাম। ভাবলাম, রাগলে রাগুক, তাতে আমার কি? আমিই আর বিড়ালের চেয়ে কম কিসে! খেলে খেয়েছিই। এসে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে তখনেরটা তখন দেখা যাবে। এই ভেবে আবারো খেতে লাগলাম নুডুলস আর দেখতে লাগলাম টম এন্ড জেরি। একদিকে নিজের নুডুলস না পেয়ে রীতিমতো তুফান শুরু করে দিয়েছে তায়েফের বোন। আর অন্যদিকে আমি সেই নুডুলস খেয়ে টম আর জেরির একবার দুমড়েমুচড়ে গিয়েও আবার ঠিক হয়ে যাওয়া, একবার গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে লেপ্টে গিয়েও আবারো উঠে দৌড়তে শুরু করা এসব দেখে দেখে হা হা হি হি হো হো করে আসছি।

কিছুক্ষণ পর তায়েফ বেরিয়ে এসে দেখে আমি নুডুলস খাচ্ছি আর সেই নুডুলস খুঁজেই পেরেশান হয়ে যাচ্ছে ওর বোন। এবার আমাকে এসে তায়েফ বললো,

-কিরে রিয়াদ, তুই কি করলি এটা? নুডুলস কোত্থেকে আনলি?

বেশ সুস্বাদু হয়েছে নুডুলসটা। গদগদ করে খাচ্ছিলাম আমি। এবার একটু পানি পান করে তায়েফকে বললাম,
-ঐ পাশের রুমের টেবিলের উপর রাখা ছিলো। সেখান থেকেই আনলাম।

আমার কথা শুনে তায়েফ দাঁড়ানো থেকে সোফায় বসে পড়লো। বললো,
-তুই জানিস ঐটা কার রুম?

আমি,
-কেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাকি হিলারি ক্লিনটনের?

তায়েফ,
-এটা আমার বোন তানহার রুম। ও মাসের পর মাস হোস্টেলে থাকলেও আমরা কেউই ওর রুমে থাকতে যাইনা। এমনকি কোন মেহমান এলেও এতে থাকতে দিইনা। এটি তালা দেয়া থাকে। মাঝেমাঝে পরিষ্কার করার জন্য খোলা হয়। অথচ তুই কিনা ওর রুমে ঢুকে ওরই রান্না করা নুডুলস বিনা পারমিশনে নিয়ে এসে খেয়ে ফেলছিস!

আমি বললাম,
-এতে হয়েছে টা কি আমাকে একটু বলবি! কই, ডাকতো তোর বোনকে! আমিই বলব যে, আমিই তার রুম থেকে নুডুলস এনে খেয়ে ফেলেছি।

কথাগুলো বেশ জোড়েই বললাম আমি। এতেই কাজ হয়ে গেছে। তানহা চলে আসলো। আমি টের পেয়েছি ও রুমে এসেছে তবুও আরো এক চামচ নুডুলস মুখে নিলাম। এমন সময় তানহা বলে উঠলো,

-এক্সকিউজ মি! আপনি কাকে বলে এটা আমার রুম থেকে নিয়ে এসেছেন?

আমি এবার ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
-নুডুলসটা যা হয়েছে না কোন জবাব নেই। জীবনে ফুটপাতের দোকান থেকে শুরু করে কত ফাইভ স্টার হোটেলে অন্যের টাকায় খেয়েছি এমন সুস্বাদু খাবার আমি এর আগে কখনোই খাইনি জানেন। এমন খাবার খেয়ে কয়েক হাজার গালি অনায়াসেই হজম করে নেয়া যাবে। এবার বলুন কি যেন বলছিলেন!

আমার মুখে এসব কথা শুনে তায়েফ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। এবার তানহা বললো,
-সত্যি বলছেন আপনি? নুডুলসটা ভালো লেগেছে আপনার?

আমি এবার মুচকি হেসে বললাম,
-ভালো হয়েছে কি বলেন, অনেক ভালো হয়েছে। আরেকটু হবে?

তানহা বললো,
-কি যে বলেননা! আসলে, আমি খুব অল্পই রান্না করেছিলাম৷ ডিম ছিলোনা তো বেশি, তাই।

আমাকে কথাগুলো বলে কিছুক্ষণ আগেই ঘন্টায় চারশো কিলোমিটার বেগে ধেঁয়ে আসতে থাকা প্রলয়ঙ্কারী ঝড়টি দুর্বল হয়ে নরম গলায় তায়েফকে বললো,
-সোনা ভাই আমার, বাবার বাইকটা নিয়ে তাড়াতাড়ি বাজার থেকে গিয়ে এক হালি ডিম নিয়ে আয় তো যা!

তায়েফ ওর বোনের কথা শুনে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে বললো,
-আমার কাছে টাকা নেই।

এবার তানহা বললো,
-তুই বাইক বের কর আমি টাকা দিচ্ছি।

তায়েফ চলে গেল। কয়েক মুহুর্তের ব্যবধানে পরিবেশটা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ায় তায়েফের মা কিচেন থেকে বেরিয়ে আসলেন। এসে আমাকে দেখে বললেন,
-আরে রিয়াদ যে! কখন এসেছ বাবা?

আমি,
-এই তো আন্টি কিছুক্ষণ হলো। ভালো আছেন আপনি?

আন্টি,
-হ্যা বাবা ভালো। তোমার বাবা-মা কেমন আছেন?

আমি,
-জ্বী আন্টি, আল্লাহর রহমতে ভালোই আছেন।

এবার আন্টি আমার সামনে থাকা নুডুলসের বাটি দেখে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন। তানহাকে বললেন,
-কিরে, তোর নুডুলস পেলি খুঁজে?

তানহা হাসতে হাসতে বললো,
-আর বলোনা মা, তোমার ছেলের কাণ্ড এসব। আমার ঐ নুডুলস এনে সে তার বন্ধুর আপ্যায়ন করে ফেলেছে।

তানহা হয়ত ঐসময় আমার বলা সবগুলো কথা স্পষ্ট শুনেনি। আর যদি শুনেও থাকে তাহলে এখন আমি নিজেই যে এনে খেয়ে ফেলেছি সেটা ওর মায়ের থেকে আড়াল করতে চাইছে। তবে আসলে ঠিক কোনটা সেটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়।

আমাকে আর তানহাকে বসিয়ে রেখে আন্টি চলে গেলেন। ও আমার পাশের সোফাতেই বসে আছে। আমি আগ বাড়িয়ে কোন কথা বলছিনা ওর সাথে। তবে খুব কাছাকাছি বসায় টের পাচ্ছিলাম যে, টম এন্ড জেরি দেখে হাসাহাসি করা আমার এমন ছেলেমানুষী দেখে ও মুচকি মুচকি হাসছিলো।

হঠাৎ ও জিজ্ঞেস করলো,
-আচ্ছা, আপনি কি করেন?

আমি টিভির দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই বললাম,
-টম এন্ড জেরি দেখি।

ও বিরক্তির স্বরে বললো,
-আরে ধ্যাৎ, এটা নয়। জিজ্ঞেস করছি, পড়াশোনা করছেন নাকি অন্যকিছু?

আমি,
-করিনা কিছু। বাপের হোটেলে আছি।

তানহা বললো,
-ওহ আচ্ছা, সেটাই তো। হাতির মতো বড় হয়েও যদি টম এন্ড জেরি দেখেন তাহলে আর কি করতে পারবেন বলুন! আপনাদের কাজই হলো সারাদিন বন্ধুদের সাথে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ানো, ফোন চালানো, ফেসবুকে মেয়েদের মেসেজ পাঠানো, আর দুহাতে বাবার টাকা উড়ানো। এসবই তো করতে পারেন!

আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে নিষ্পাপ ছেলের মতো বললাম,
-ফেসবুক কি জিনিস আবার? এটি খায় নাকি পরিধান করে? আর আমি তো মোবাইল ফোনই ইউজ করিনা। আর কি বললেন যেন? ওহ বন্ধুদের সাথে ঘুরাঘুরি করা! আমি তো সন্ধার পর রীতিমতো বাসা থেকে বেরোই হইনা। আর বাবার টাকা খরচ করার কথা বলছেন, লাস্ট কবে আমার বাবা আমাকে টাকা দিয়েছিলেন সেটা তো মনেই করতে পারছিনা। অযথাই আমাকে কি না কি ভেবে একেবারে ধুয়ে দিলেন!

আমার কথাগুলো শুনে তানহা একেবারে ‘থ’ বনে গেল। ও এবার বললো,
-ওহ, আই এম সো স্যরি। প্লিজ আপনি কিছু মনে করবেননা! এই একবিংশ শতাব্দীতে আপনার মতো এত ইনোসেন্ট ছেলেও আছে সেটা আসলে ভাবাও যায়না। সত্যি, আমি আসলেই দুঃখিত। আর হ্যাঁ, আপনি বসে বসে টম এন্ড জেরি দেখুন। তায়েফ আসলে আমি নুডুলস রান্না করব। আপনি সেটা খেয়ে তারপর যাবেন। ঠিক আছে!

আমি এবার ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
-এরপর যাব মানে? থাকতে বলবেননা আমাকে?

তানহা লজ্জা পেয়ে গেল এবার। বললো,
-সিউর! তা বলবোনা কেন। অবশ্যই থাকবেন। আজ থাকুন! তায়েফ তো আছেই। ওর সাথে থাকবেন। কাল যাবেন।

এবার আমি বললাম,
-আরে নাহ। আমি যে রুম থেকে নুডুলস এনে খেয়েছি সেই রুমেই থাকবো। আর সেটাও আগামী তিন-চারদিন। আমার বাবা-মা বাসায় নেই। ওরা আসলে তারপর চলে যাব।

আমার সব অদ্ভুত এটিটিউট আর বিহেভিয়ার দেখে ও রীতিমতো অবাক হয়ে গেল। এবার ও বললো,
-আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি বসুন আমি আসছি।

এই বলে চলো গেল ও। ওর চলে যাওয়ার সাথে সাথেই আমার ফোনে একটা কল আসলো। ব্রাইবেশন মোডে ছিল ফোনটা। এবার ফোনটা পকেট থেকে বের করে দেখি জামিল কল দিয়েছে। রিসিভ করলাম আমি।

ওপাশ থেকে জামিল,
-দোস্ত কোথায় তুই?

মনে হচ্ছিলো ও দৌড়াচ্ছে। ও হাঁপাচ্ছিলো। এবার আমি বললাম,
-আমি তায়েফের বাসায়। কি হয়েছে? তুই হাঁপাচ্ছিস কেন?

এবার ও হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
-পেট্রোল পাম্পের সামনে তায়েফকে পেঁছনের দিক থেকে আসা একটি ট্রাক ধাক্কা মেরে চলে গেছে। নেত্রকোণার রোডে যাচ্ছে ট্রাকটি। আর শোন, ট্রাকটিতে বালু ছিলো। আমি আর কজন মিলে তায়েফকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। কিছু একটা কর!

কথাগুলো বলে ও ফোনটা কেটে দিলো। কিংকর্তব্যবিমূর হয়ে গেলাম আমি। কি হলো এটা! পরক্ষণেই তানহা চলে আসলো। আমার হাতে স্মার্ট ফোন দেখে ও বলে উঠলো,

-আপনি না ফোন ব্যবহার করেননা! তাহলে এটি কার ফোন হুমম? বোকা পেয়েছেন আমাকে?

আরো কি না কি বলতে লাগলো ও। বলাই স্বাভাবিক। কিন্ত আমি এখন কি করব? তাড়াহুড়ো করে টিটুর নম্বরটা বের করে কল দিলাম ওকে। ও রিসিভ করতে করতে আমি বেরিয়ে এলাম তায়েফদের বাসা থেকে। টিটু ফোন রিসিভ করতেই বললাম,

-পাম্পের সামনে তায়েফকে বালু ভর্তি একটি ট্রাক ধাক্কা দিয়েছে একটু আগে। ও মোটরসাইকেল নিয়ে বাজারে গিয়েছিলো। ট্রাকটি নেত্রকোণার দিকে যাচ্ছে। পাম্পের পরে তো রাহাতের বাড়ির আগ পর্যন্ত ডানে-বামে ট্রাক যাবার মতো আর কোন রাস্তা নেই তাইনা রে?

ও বললো,
-হুম। কিন্তু তুই কোথায়?

আমি বললাম,
-আমি তায়েফদের বাসায় এসেছিলাম। বেরোচ্ছি এখন। তুই বাইকটি নিয়ে বাজারের দিকে আয়। আমি রাহাতকে কল দিচ্ছি। আর যদি পারিস তাহলে রামিনকে কল দিয়ে বল ওর মামাকে ফোন দিয়ে সব বলতে। ওর মামার বাড়ি নেত্রকোনার কাছেই। আর বলিস, ট্রাকটিতে বালু ছিলো।

ও বললো,
-আচ্ছা ঠিক আছে।

এই বলে ও ফোনটা রেখে দিলো। রাস্তায় কিছুদূর যেতেই একটি রিকশা পেয়ে গেলাম। তাতে উঠে বসলাৃ এবার। বাজারের দিকে যাচ্ছি আর ভাবছি, তায়েফের এক্সিডেন্ট হয়েছে অথচ সেটা ওর পরিবারকেই জানালামনা! খবরটি শুনে কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলাম আমি। তায়েফের মায়ের নম্বর আছে আমার কাছে। কল দিলাম উনার নম্বরে। রিসিভ করলো।

আমি,
-আন্টি, আমি রিয়াদ বলছিলাম।

ওপাশ থেকে,
-আপনি তো আজব মানুষ! আপনি না ফোন ইউজ করেননা বলেছিলেন। মিথ্যা কেন বলেছিলেন আমাকে?

আমি বললাম,
-এখন এসব কথা বলার সময় নয়। আঙ্কেলকে জানান তায়েফের এক্সিডেন্ট হয়েছে। আমার এক বন্ধু কজনকে নিয়ে ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। আমিও যাচ্ছি।

আমার কথাগুলো শুনে তানহা বললো,
-মিথ্যা বলার জন্য যদি কাউকে নোবেল দেয়া হতো তাহলে সেটা আপনিই পেতেন। কেন মজা করছেন আমার সাথে? এসব নিয়ে মিথ্যা বলতে লজ্জা করেনা আপনার?

আমি ওকে কি করে বুঝাবো কিছুই মাথায় আসছিলোনা আমার। রাগে ফোনটা কেটে দিলাম আমি।

——-চলবে——-

গল্প : একটি লাল গোলাপের হাসি
পর্ব-১
লেখক : Riyad Ahmod Bhuiya

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here