গল্প : একটি লাল গোলাপের হাসি পর্ব-২

0
4062

গল্প : একটি লাল গোলাপের হাসি
পর্ব-২
লেখক : Riyad Ahmod Bhuiya

কিছুক্ষণ পর আবার কল দিলাম তায়েফের মায়ের নম্বরে। রিসিভ করলোনা কেউ। আবার কল দিলাম। এবার রিসিভ করলো। রিসিভ করতেই আমি বলতে লাগলাম,
-শুনুন, আমি ঐসময় আপনাদের বাসায় আপনার সাথে মজা করে ঐসব বলেছিলাম। আমি ভাবতেও পারিনি যে, আপনি আমার কথাগুলো এতটা সিরিয়াসলি নিবেন। তায়েফকে পাম্পের সামনে একটি ট্রাক ধাক্কা দিয়েছে। ও এখন হাসপাতালে আছে। আমিও সেখানেই যাচ্ছি। আমি কোন মজা করছিনা আপনার সাথে।

কথাগুলো বলে শেষ করতে না করতেই একটি চিৎকার শুনতে পেলাম আমি। তায়েফের মায়ের গলাই এটি। বুঝতে পারলাম, এবার ফোনটা তানহা নয় ওর মা রিসিভ করেছিলো।

এ যেন মহাসাগরের কোন ঝড়ের মধ্যে পড়ে গেলাম আমি। ভাবছি, না জানি এখন তায়েফের কন্ডিশন কেমন! এমন সময় টিটু কল দিলো। রিসিভ করলাম আমি।

ওপাশ থেকে টিটু,
-কোথায় তুই?

আমি,
-এইতো বাজারের কাছাকাছিই। তুই কোথায়?

টিটু,
-ঐ ট্রাক ড্রাইভারের সামনে।

আমি অবাক হয়ে বললাম,
-ট্রাক ড্রাইভারের সামনে মানে?

টিটু,
-ড্রাইভার বললে ভুল হবে। এ আসলে ড্রাইভারই নয় হেল্পার ও। আমাদের বাড়ির সামনের মোড়ে এসে একটি রিকশাকে ধাক্কা দিয়েছিল। মহিলা ছিলো রিকশায়। পড়ে গিয়ে নাকি আঘাতও পেয়েছে। এজন্য পাবলিক ওকে উত্তমমাধ্যম দিয়ে বৈদ্যুতিক খুঁটির সাথে বেঁধে রেখেছে। কি করব এখন তাহলে?

আমি যা বুঝার বুঝতে পেরে গেছি। এবার ওকে বললাম,
-তুই বাইক নিয়ে তাড়াতাড়ি বাজারে চলে আয়। বাকিসব আমি দেখে নিবনে।

ও এবার ফোনটা রেখে দিলো। এবার জামিলকে কল দিলাম। মনে আমার শঙ্কা! বড় ধরণের কিছু হয়ে যায়নি তো তায়েফের। নাহ, জামিল কিছুতেই ফোন রিসিভ করছেনা। হয়তোবা ও খুব ব্যস্ত। এমন সময় একটা কল আসলো। নম্বরটা অপরিচিত। রিসিভ করলাম আমি।

ওপাশ থেকে,
-আপনি কোথায় আছেন?

কণ্ঠটা তানহার। ও আবার বলে উঠলো,
-আরে কথা বলছেননা কেন? আমার ভাইটা ঠিক আছে তো?

আমি কি বলব বুঝতে পারছিলামনা। ও কাঁদছিলো ওপাশে। এবার আমি বললাম,
-হ্যা ঠিক আছে। কিছু হয়নি তায়েফের। ও সুস্থ আছে। আপনারা কোথায়?

এবার তানহা বললো,
-সত্যি বলছেন আপনি? আমার ভাইটির আসলেই কিছু হয়নি তো?

ও কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো জিজ্ঞেস করছিলো আমায়। আমি নিজের বিবেকের কাছে আটকে গেলাম এবার। নিজেকেই নিজে বললাম, ‘আর কত মিথ্যা বলবি রিয়াদ?’

এবার ঝটপট পকেট থেকে বাটন ফোনটা বের করে আমার রবি নম্বর থেকে জামিলকে কল দিলাম আবার। ও ফোন রিসিভ করতেই তানহার ফোনটা কেটে দিলাম আমি। না হয় কি কথা বলি না বলি সব শুনতে পেয়ে যাবে ও। জামিলকে বললাম,
-কোথায় তোরা?

জামিল,
-হাসপাতালেই। আল্লাহর রহমতে হেলমেট পড়ে থাকায় বড় ধরণের কিছু হয়নি ওর। তবুও হাত পায়ের বেশকিছু জায়গায় আঘাত পেয়েছে। মাস তিনেক সময় লাগবে পুরোপুরি সেরে উঠতে।

জামিলের কথাগুলো শুনে কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেলাম আমি। বললাম,
-আচ্ছা, তুই থাক তাহলে। আমি আর টিটু আসছি কিছুক্ষণের মধ্যেই।

কথাগুলো বলে ফোনটা কেটে এবার তানহার নম্বরে কল দিলাম। রিসিভ করলো ও।

আমি,
-কোথায় আপনি?

তানহা,
-রাস্তায়, আপনি ?

আমি,
-বাজারে আছি। আমি এখনই রওয়ানা দিব।

তানহা আর কিছু না বলেই ফোনটা কেটে দিলো এবার। বুঝতে পারলাম ও আমার প্রতি ভীষণ রেগে আছে। অপেক্ষা করতে লাগলাম টিটুর জন্য। কিছুক্ষণ পর টিটু আসলে ওকে নিয়ে রওয়ানা হলাম হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।

বন্ধু তায়েফ আমার ঘুমিয়ে আছে। ওর হাত-পায়ে ব্যান্ডেজ। পাশেই বসে আছে জামিল। আমাদের দেখে ও যেন কোত্থেকে প্রাণ ফিরে পেলো!

ও বলে উঠলো,
-এসেছিস তোরা!

এই বলে ও উঠে দাঁড়ালো। আমি এগিয়ে গিয়ে ওকে বসিয়ে দিয়ে বললাম,
-এবার বল তো ঠিক কি হয়েছিল তখন আর তুই কি করছিলি সেখানে!

ও বলতে লাগলো,
-আমি তখন পাম্পের এখানেই ছিলাম। হঠাৎ করেই একটা বিকট আওয়াজ হয় এবং আশেপাশের লোকদেরকে ঐ ট্রাকটির দিকে দৌড়ে যেতে দেখি। আমিও যাই। গিয়ে দেখি বাইক সহ তায়েফ রাস্তার পাশে পড়ে আছে। পরে আর কি করব, উপস্থিত কয়েকজন লোকের সহায়তায় ওকে হাসপাতালে নিয়ে এলাম। তোদের এত দেরি হলো কেন?

সবকথা বলে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলো জামিল। আমি এবার সবকিছু বললাম ওকে। আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছি এমন সময় তানহা, আন্টি আর আঙ্কেল আসলো। তায়েফের বাবা এখানে চাকরী করেন বিধায় উনারা বাসা নিয়ে থাকেন। স্থায়ী বাসিন্দা নন। এসেই তায়েফের অবস্থা দেখে সবাই কান্নাকাটি শুরু করে দিলো। আমি এবার জামিল আর টিটুকে নিয়ে কেবিনের বাইরে চলে এলাম। একজন নার্সকে পাঠালাম ভেতরে। আর নার্সকে বলে দিলাম, যেন এমনভাবে বলেন যাতে তারা ঘাবড়ে না যান। যেন অভয় দেন। এমন সময় কল আসলো একটি। ফোন হাতে নিয়ে দেখি মা ফোন করেছেন।

-রিয়াদ কোথায় তুই?
মা জিজ্ঞেস করলেন।

আমি,
-হাসপাতালে এসেছিলাম। তায়েফের এক্সিডেন্ট হয়েছে।

মা অবাক হয়ে গেলেন কথাটি শুনে। তায়েফ, জামিল, টিটু, নাইম, রামিন, আনোয়ার, মাহফুজসহ আমার প্রায় সব বন্ধুদেরই আমাদের বাড়িতে যাতায়াত আছে। বলা নেই কওয়া নেই ওরা যার যখন মন চায় চলে যায় আমাদের বাড়িতে। মা সবাইকে অনেক আদর করেন। বিষয়টা এমন যে, সবাই যেন তাঁরই সন্তান! এত ভালোবাসেন বলেই হয়ত সবাই যায়। এবার আমাকে ধমকের স্বরে মা বললেন,

-তায়েফের এক্সিডেন্ট হয়েছে আর সেটা তুই এখন আমাকে বলছিস! ওর অবস্থা কেমন এখন? বড় ধরণের কিছু হয়নি তো?

আমি জানি মা এখন কতটা চিন্তিত আর আবেগাপ্লুত হয়ে গেছেন। তাঁকে এবার সামলে নিয়ে বললাম,
-ও এখন ঠিক আছে। ডাক্তার বলেছে কিছুদিন বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। তুমি টেনশন করোনা।

মা আমার নাছোড়বান্দা। তিনি এবার জেদ ধরে বসলেন তাকে যেন গিয়ে নিয়ে আসি। অবশেষে কোন উপায়ন্তর না দেখে বললাম,
-আচ্ছা ঠিক আছে। এখন তায়েফের মা-বাবা ভেতরে আছেন। আগে উনাদের সাথে কথা বলে দেখি তারা কি করেন। পরে তোমাকে নিয়ে আসব। এখন রাখছি।

ফোনটা কেটে দিয়ে ডাটা অন করে মেসেঞ্জার গ্রুপে ঢুকলাম। আমাদের গ্রুপের নাম ‘ফ্রেন্ডস্ ফরএভার।’ এতে মেম্বার ত্রিশজন। আমাদের বন্ধুত্ব কলেজ লাইফ থেকেই। তবে এর মাঝে একজন আমার বাল্যবন্ধুও আছে। ওর নাম রাহাত। বলতে গেলে দুজনই ন্যাংটা কালের বন্ধু। বন্ধুত্ব নিয়ে অনেক মানুষকেই আমি সমালোচনা করতে দেখেছি। তাদের কারোর মতে, একসময়ের কলিজার টুকরো বন্ধুও নাকি কোন একসময়ে দুশমন হয়ে যায়। সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়। শুরু হয় পরষ্পরায় নানান বিশৃঙ্খলার। আমি জানিনা, পৃথিবীর এমন কোন সম্পর্ক আছে কিনা যাতে কোন প্রকার মনোমালিন্যতা হয়না। রাগ-অভিমান হয়না। তবে হ্যাঁ, হোক পুরুষ কিবা নারী, একজন মানুষের জীবনে প্রকৃত বন্ধুর উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। যদি বলি, বন্ধুহীন জীবন লবণহীন তরকারীর মতো! আমার মনে হয়না যে এতে কেউ দ্বিমত পোষণ করবেন। তবে, সেই বন্ধুত্বটা যেন হয় সকল স্বার্থের উর্ধে এবং খাঁটি বন্ধুত্ব। কেননা, ভালো বন্ধু ঝুটলে যেমন জীবনে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে তদ্রূপ, স্বার্থপর, বাজে বা বিপথগামী কারোর সঙ্গ ধরলেও তাতে জীবনে নেতিবাচক প্রভাব এতটাই প্রকটভাবে পড়ে যে, জীবনকে একেবারে ধ্বংসের চূড়ান্ত সীমায় নিয়ে যায়।

গ্রুপের মেসেজগুলো দেখে বুঝতে পারলাম সবাই প্ল্যান করছে কিভাবে একত্রিত হয়ে হাসপাতালে আসা যায়। ওরা খবর পেয়ে এমনিই ছুটে আসতো। তবে আমরা এখানে আছি জেনে সেরকম তাড়াহুড়ো করছেনা আর। এবার নার্স বেরিয়ে আসলো কেবিন থেকে। যেতে যেতে বললো,
-আপনাদেরকে ভেতরে যেতে বলেছেন। যান!

আমরা গেলাম ভেতরে। তায়েফের বাবার সাথে আমার এর আগে একদিনই কথা হয়েছিল সরাসরি। সেটাও আবার প্রায় সাত-আট মাস আগে। এরপরও তিনি আমাকে দেখে চিনতে পেরে যান এবং আমাদের বন্ধুদের মধ্যে থাকা একে অপরের প্রতি এমন টান আর ভালোবাসা দেখে প্রশংসায় প্রায় কেঁদেই ফেলেন! তায়েফ ঘুমিয়ে আছে। ওকে সম্ভবত পেইন কিলার আর ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে রেখেছে। তেমন ব্লাড না যাওয়ায় ব্লাডের আর প্রয়োজন হয়নি। আর লাগলেও কোন অসুবিধা ছিলোনা। আমাদের ত্রিশজনেরই ব্লাডগ্রুপ, এড্রেস আর কনটাক্ট নম্বর সহ একটা লিস্ট তৈরি করেছিলাম। এতে করে কারোর নিজেদের রিলেটিভ বা রিলেটিভের রিলেটিভ অথবা স্থানীয় সাধারণ মানুষ যাদের ইমার্জেন্সি ব্লাডের প্রয়োজন হলে তাদেরকে আমাদের ত্রিশজনের এই সার্কেল থেকে ব্লাড দিতাম। অবশ্য, সেসময় যদি ডোনার থাকতো এবং তার রক্ত দেয়ার সময় হতো তাহলে।

কেননা, একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষ প্রতি তিনমাস পরপর রক্ত দান করতে পারেন।

“স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান ড. সিরাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সের মধ্যে শারীরিকভাবে সুস্থ নারী ও পুরুষ রক্ত দিতে সক্ষম। এক্ষেত্রে পুরুষের ওজন থাকতে হবে অন্তত ৪৮ কেজি এবং নারীর অন্তত ৪৫ কেজি। এছাড়া রক্তদানের সময় রক্তদাতার তাপমাত্রা ৯৯.৫ ফারেনহাইটের নিচে এবং নাড়ির গতি ৭০ থেকে ৯০ এর মধ্যে এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকতে হবে। পুরুষদের ক্ষেত্রে রক্তের হিমোগ্লোবিন প্রতি ডেসিলিটারে ১৫ গ্রাম এবং নারীদের ক্ষেত্রে ১৪ গ্রাম হওয়া দরকার। রক্তদাতাকে অবশ্যই ভাইরাসজনিত রোগ, শ্বাসযন্ত্রের রোগ এবং চর্মরোগ মুক্ত থাকতে হবে। সাধারণত ৯০ দিন পর পর, অর্থাৎ তিন মাস পর পর রক্ত দেওয়া যাবে। Image copyrightGETTY IMAGES রক্ত দেয়ার সময় শরীর থেকে ২৫০-৩০০ মিলিগ্রাম আয়রন কমে যায়। ‘রক্ত দেয়ার সময় শরীর থেকে ২৫০-৩০০ মিলিগ্রাম আয়রন কমে যায়।’ সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের শরীরে ৪ থেকে ৬ লিটার পরিমাণ রক্ত থাকে। প্রতিবার ৪৫০ মিলিলিটার রক্ত দেয়া হয়। এ কারণে রক্ত দিলে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা একেবারেই নেই।” (তথ্য- বিবিসি বাংলা, ঢাকা। ১৪ জুন, ২০১৮)

এবার তানহার বাবা বললেন,
-নার্স বলেছে এখানে সপ্তাহ খানেক থাকলে ভালো হবে। এরপর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে বাসায় নিয়ে যেতে পারবো। তোমাদেরকে যে আসলে কি বলে ধন্যবাদ দিব আমি সে ভাষা খুঁজে পাচ্ছিনা। আই এম রিয়েলি প্রাউড অব মাই সন বিকজ, হি হ্যাজ সাচ গুড ফ্রেন্ডস ইন হিজ লাইফ!

কথাগুলো বলতে বলতে উনি তাঁর চোখের পানি মুছে নিলেন। এর আগে আমি কখনো কোন মানুষের চোখে আনন্দ অশ্রু বইতে দেখিনি। হয়ত এটাই সেই অশ্রু! এবার আমাদের সকলের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন,

-আমি তায়েফের মাকে নিয়ে ডাক্তারের সাথে আরেকটু কথা বলে আসি। তোমরা থাকো এখানে।

এই বলে উনারা দুজন চলে গেলেন। তানহা ওর ভাইয়ের শিয়রের পাশে বসে আছে। ভেজা চোখে অপলক তাকিয়ে আছে তায়েফের মুখের দিকে। হয়ত মনে মনে ভাবছে, ‘তুই তোর যে বোনটাকে এত ভয় পাস সে তোর শিয়রের পাশে বসে আছে। অপেক্ষা করছে সে, কখন তুই চোখ মেলে তাকাবি আর আমাকে বোন বলে ডাকবি। চোখ দুটো খুল ভাই আমার!’

এটা আমার ভাবনা ছিলো। তবে হ্যাঁ, আমার কেন যেন মনে হয়, করুণ হলেও পৃথিবীর সুন্দরতম মুহুর্তগুলোর মধ্যে এটিও একটি। একজন বোন সে তার কলিজার টুকরো ভাইয়ের জন্য যেকোন কারণে পথ চেয়ে আছে। অপেক্ষার প্রহর গুনছে। যাদের পোড়া কপাল, যাদের কোন বোন নেই, বোন না থাকার শূন্যতা যে কেবল তারাই টের পায়।

——-চলবে——-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here