গল্প : একটি লাল গোলাপের হাসি
পর্ব-৩
লেখক – Riyad Ahmod Bhuiya
তানহার চোখ থেকে পানি পড়ছে দেখে পকেট থেকে রুমালটা বের করে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম,
-নিন এটা!
ইগ্নোর করতে পারে এমন একটা ভয় কাজ করছিলো আমার মনে। কিন্ত না তেমন কিছু করেনি ও। রুমালটা নিলো। আর নিচু স্বরে বললো,
-থ্যাংকস।
আমি আর ফরমালিটি দেখাতে গিয়ে বললামনা, ‘মাই প্লেজার।’ সবকিছুরই একটা সময় আর অসময় থাকে।
আমাকে ওর সাথে কথা বলতে দেখে টিটু আর জামিল বাইরে চলে গেল। উর্দূতে একটা কথা আছে, ‘আক্বলমন্দ ক্যা লিয়ে ঈশারা হি কাফি হায়।’ অর্থাৎ, বুদ্ধিমানের জন্য ঈশারাই যথেষ্ট। তবে, ওদেরকে আমার কোন ঈশারাও দিতে হয়নি। ওদের বের হয়ে যাওয়াতে আমি এবার ওর সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে শুরু করলাম। চেষ্টা করতে থাকলাম কোনভাবেও কিছুটা হলেও শান্তনা দেয়া যায় কিনা।
বললাম,
-দেখুন, আজকে তায়েফের এমন অবস্থার জন্য কেবল একজনই দায়ী আর সে হলাম আমি। আমি যদি এমন কিছু না করতাম তাহলে এসবের কিছুই হতোনা। আমাকে ক্ষমা করে দিন!
তানহা আমার কথাগুলো শুনে চুপ করে রইলো। কিছু বললো না ও। আমি আবার বললাম,
-আসলে, আজ যে কেন আমি আপনাদের বাসায় গেলাম সেটাই বুঝতে পারছিনা। আমার জন্যই এসব হয়েছে। ভাগ্যিস তায়েফের বড় ধরণের কিছু হয়নি। যদি হয়ে যেত তাহলে আমি আজীবনের জন্য ওর আর আপনাদের সবার কাছেই অপরাধী হয়ে যেতাম।
এবার তানহা আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-আপনি কি দয়া করে একটু চুপ করবেন! কেন অযথাই নিজেকে দোষারোপ করছেন? এটা আমার ভাইয়ের ভাগ্যে ছিলো তাই এমনটি ঘটেছে। ওর ভাগ্যে আজকের এক্সিডেন্টি যেভাবে লিখা ছিলো সেভাবেই হয়েছে। এতে আপনার কোন হাত নেই। আপনি নিজেকে দোষারোপ করবেননা!
আজব লাগলো ওর কথাগুলো। এটাও অবশ্য ঠিক। ভাগ্যে ছিল বলেই ঘটেছে। এবার আমি আর কিছু বলতে যাব এমন সময় আঙ্কেল আন্টি চলে এলেন। তাঁদের মুখে কিছুটা আনন্দের ছাপ লক্ষ্য করলাম আমি৷ যার অর্থ, ‘ছেলেকে তারা চাইলেই জ্ঞান ফেরার পর বাসায় নিয়ে যেতে পারবেন।’ হ্যা, যা ভেবেছিলাম তাই হয়েছে। আঙ্কেল বলতে লাগলেন,
-ডাক্তারের সাথে কথা বলে এলাম।
এটুকু বলতেই মাঝখানে উনাকে থামিয়ে দিয়ে তানহা বলে উঠলো,
-কি বলেছে ডাক্তার?
আঙ্কেল এবার ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
-তায়েফের জ্ঞান ফিরলেই ওকে বাসায় নিয়ে যেতে পারবো আমরা। অসুবিধে নেই।
নিজ বাবার মুখে এমন কথা শুনে তানহা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। ওর মুখে কান্নামাখা হাসি দেখে ওকে তখন কি যে ভালো লাগছিলো তা বলে বুঝাতে পারবোনা আমি।
কিছুক্ষণ পরই সব বন্ধুরা দলবেঁধে চলে আসলো তায়েফকে দেখতে। সবাই এটাসেটা নিয়ে এসেছে। কেউ কেউ ওকে দেখেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছে! এ যেন পৃথিবীর অন্যতম একটি সম্পর্ক যার নাম বন্ধুত্ব তারই মহিমা এটি। রক্তের সম্পর্ক নয় তবুও যেন পরষ্পরের দুঃখ বেদনায় রক্ত শীতল হয়ে যায়।
রাত বারোটার দিকে তায়েফের জ্ঞান ফিরলো। ততক্ষণ ওকে দেখতে আসা আমাদের সার্কেলের একজন বন্ধুও বাসা/বাড়িতে যায়নি। অথচ, তায়েফের বেশ কিছু রিলেটিভ এসে দেখে ফিরে গেছে। সবার একটা কথাই ছিল, বন্ধুর মুখ থেকে কথা শুনেই তবে যাব। আল্লাহ্ আমাদের নিরাশ করেননি। প্রাণের বন্ধুকে ফিরিয়ে দিলেন আমাদের মাঝে। ও সবার চোখে চোখ রাখলো। কথা বললো। আমি সামনে যেতেই বলে উঠলো,
-কিরে দোস্ত, নুডুলস খাবিনা?
আমিও আর নিজেকে সামলাতে পারলামনা। ওর পাশে বসে ওকে জড়িয়ে ধরলাম।
এরপর বন্ধু তায়েফের পুরোপুরি সেরে উঠতে প্রায় আড়াইমাস লেগে যায়। এরমধ্যে আমার চাকরী হয়। চলে যাই সিলেটে। তানহার ফোন নম্বর আমার কাছে থাকলেও নিজে থেকে ওকে কোনদিন কল বা মেসেজ দিইনি। ফেসবুকেও এড আছে। এখানেও কোনদিন মেসেজ দেয়া হয়নি। তবে খুব ভালোবেসে ফেলেছিলাম ওকে। একতরফা ভালোবাসাও বলা যেতে পারে। এভাবেই দিন কাটতে লাগলো।
অবশেষে পাঁচ মাসের মাথায় একদিন রাত এগারোটার দিকে ওর ফোন আসলো। ইচ্ছে করেই রিসিভ করলামনা। আবার কল দিলো। এবারো রিসিভ করলামনা। আবার দিলো। তিন বারের সময় রিসিভ করলাম। প্রিয় মানুষের নিরুদ্দেশ হয়ে থাকলে তাঁর প্রতি অনেক অভিমান জন্মায়। আমারো জন্মেছিলো। তবে ওর কি দোষ, আমি তো আর ওকে নিজের মনের কথা বলিনি।
রিসিভ করতেই সেই সুরেলা কণ্ঠে ও বলে উঠলো,
-কেমন আছেন মিস্টার নুডুলস্?
আমি কথা বলবো কি, হাসতে হাসতেই পেট ব্যথা শুরু হয়ে গেল। আমি হাসছি শুনে সেও হাসলো কতক্ষণ। এবার আমি বললাম,
-হুম, মিস্টার নুডুলস্ ভালোই আছে। তা, রাধুনী কেমন আছে জানতে পারি?
আমার কথা শুনে ও বলে উঠলো,
-রাধুনীর দেখেছেন টা কি হুম! আপনাকে তো কদিন পর থেকে আমি নিয়মিত রাঁধব।
ওর কথার কিছুই বুঝতে পারলামনা। আমি বললাম,
-কিন্তু কিভাবে?
তানহা,
-বাড়িতে কবে আসছেন?
আমি,
-আগামী মাসের দশ তারিখে। কেন?
তানহা,
-আন্টি কি কিছু বলেননি আপনাকে?
আমি,
-কই, না তো। কেন, কোন সমস্যা হয়েছে কি?
তানহা,
-তেমন কিছুনা। একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষকে তারা মেরে ফেলতে চলেছে অথচ আপনাকে যে কিছুই জানায়নি সেটা শুনেই তো অবাক আমি।
আমি,
-আপনি কি বলছেন কিছুই বুঝতে পারছিনা আমি।
তানহা,
-আজব তো! এরকম বোকা মানুষের সাথে আমি কি করে সংসার করব সেটাই তো এখন আমার বুঝে আসছেনা।
আমি,
-জ্বী! কি বললেন এটা?
তানহা,
-না মানে, আমি বলছিলাম কি যে, যার সাথে আপনার বিয়ে হবে সে কি করে আপনার মতো এমন বোকা মানুষের সাথে সংসার করবে সেটাই ভেবে পাচ্ছিনা।
আমি,
-ওহ সেই কথা! এটা তো আগে ভেবে দেখিনি। আচ্ছা, আপনার যদি আমার মতো কোন বোকা মানুষের সাথে বিয়ে হয় তখন আপনি কি করবেন?
তানহা,
-তাকে নিয়ে বাজারে যাব।
আমি,
-তারপর?
তানহা,
-বাজারে গিয়ে লাইব্রেরী থেকে তার জন্য বই কিনবো। ঐ যে থাকেনা, ‘অ’ তে অজগর। ‘আ’ তে আম। সেসব।
আমি,
-তারপর কি করবেন?
তানহা,
-ফাইজলামো বন্ধ করে বলুন তো আন্টি কি আসলেই আপনাকে কিছু বলেননি?
আমি,
-একটু অপেক্ষা করুন আমি মায়ের সাথে কথা বলে নিচ্ছি।
আমি সবকিছু আঁচ করতে পেরেও কথাটি সরাসরি ওর মুখ থেকে বের করতে চাইছিলাম। এবার আমাকে থামিয়ে দিয়ে ও বললো,
-থাক, উনাকে আর এত রাতে কল দিয়ে ডিস্টার্ব করতে হবেনা। আমিই বলছি সব।
আমি,
-হুম বলুন!
তানহা,
-সেদিন তায়েফের সাথে বাজার থেকে ফেরার পথে আপনাদের বাড়িতে উঠেছিলাম। তায়েফ শুধু দেখাতে চেয়েছিল যে, ওরা আপনাদের বাড়ি গেলে আপনার মা ওদেরকে কতটা আদর করেন। এতেই ঘটে বিপত্তি। আপনার মা যে এত সাংঘাতিক মানুষ সেটা ঐদিন দেখলাম। বাবারে বাবা!
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-কেন, কি করেছিলেন আমার মা?
তানহা,
-আমার সামনেই তায়েফকে সরাসরি বলে বসেন, ‘তায়েফ, তোমার বোনকে আমার ছেলের বউ বানাতে চাই। দিবে বাবা?’ সে কি কাণ্ড রে বাবা! আমার ভাইয়ের তো তখন লজ্জায় চোখমুখ একেবারে লাল হয়ে গিয়েছিলো।
আমি বললাম,
-তারপর কি হলো?
তানহা,
-পরে তায়েফ বললো, ‘সেটা না হয় আপনারা গুরুজনেরাই ঠিক করবেন।’ তখন ওকে আপনার মা আমার মাকে কল দিতে বলেন এবং মাকেও সরাসরি প্রস্তাব দিয়ে বসেন!
আমি,
-তারপর?
তানহা,
-এরপর আর কি। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদের দুজনকে আর বাঁচতে দিবেননা। আমি তো ভেবেছিলাম আপনি হয়ত সব জানেন এবং আপনিই হয়ত কল দিবেন। তা আর হলো কই!
আমি,
-উনাদের সিদ্ধান্তে কি আপনার কোন আপত্তি আছে?
তানহা,
-বুঝেননা?
আমি,
-এবার বুঝেছি।
এই বলে দুজনেই কিছুক্ষণ হেসে নিলাম। এবার তানহা বললো,
-আচ্ছা, আপনার ব্লাড গ্রুপ যেন কি?
আমি,
-বি পজেটিভ।
তানহা আমার ব্লাড গ্রুপের কথা শুনে নিরব হয়ে গেল। এবার আমি জিজ্ঞেস করলাম,
-কি হলো, একেবারে নিরব হয়ে গেলেন যে?
তানহা,
-একটা কথা বলব কিছু মনে করবেননা তো?
আমি,
-নাহ, বলুন!.
তানহা,
-স্বামী-স্ত্রীর রক্তের গ্রুপ এক হলে নাকি সন্তানের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়?
আমি,
-নাহ। শুনুন তাহলে। গাইনি কনসালটেন্ট বেদৌরা শারমিনের ভাষ্যমতে, “স্বামীর রক্তের গ্রুপ যদি পজেটিভ হয় তাহলে স্ত্রীর পজেটিভ হতে হবে। আর যদি স্বামীর রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ হয় তাহলে স্ত্রীর পজেটিভ বা নেগেটিভ যে কোনো একটি হলেই হবে। তবে স্বামীর গ্রুপ যদি পজেটিভ হয় তাহলে কোনোভাবেই স্ত্রীর রক্তের নেগেটিভ হওয়া চলবে না। এ ক্ষেত্রে স্ত্রীর গ্রুপ যদি নেগেটিভ হয় তাহলে তার স্বামীর রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ হলে অনেক সমস্যা এড়ানো যাবে।
স্বামীর রক্তের গ্রুপ স্ত্রীর রক্তের গ্রুপ সন্তানের অবস্থান
পজিটিভ(+) পজেটিভ(+) সুস্থ সন্তান
নেগেটিভ (-) নেগেটিভ (-) সুস্থ সন্তান
নেগেটিভ (-) পজেটিভ (+) সুস্থ সন্তান
পজিটিভ (+) নেগেটিভ (-) প্রথম সন্তান সুস্থ, দ্বিতীয় থেকে সমস্যা
স্বামীর রক্তের গ্রুপ পজেটিভ এবং স্ত্রীর নেগেটিভ হলে কী হতে পারে
স্বামী-স্ত্রীর রক্তের গ্রুপ মিলে গেলে কোনো সমস্যা হয় না। তবে স্ত্রী যদি নেগেটিভ হয় আর স্বামী যদি পজেটিভ হয় তাহলে ‘লিথান জিন’ বা ‘মারণ জিন’ নাকে একটি জিন তৈরি হয়, যা পরবর্তীতে জাইগোট তৈরিতে বাধা দেয় বা জাইগোট মেরে ফেলে। সেক্ষেত্রে মৃত বাচ্চার জন্ম হতে পারে। বাচ্চা হতে পারে জন্মান্ধ। এছাড়া যখন কোনো নেগেটিভ গ্রুপের মা পজেটিভ ফিটাস (ভ্রুণ) ধারণ করে তখন সাধারণত প্রথম বাচ্চার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু ডেলিভারির সময় পজেটিভ ভ্রুণের রক্ত, প্লাসেন্টারের (গর্ভফুল) বাধা ভেদ করে মায়ের শরীরে প্রবেশ করবে। মায়ের শরীরেও প্রসবের সময় যে রক্ত প্রবেশ করবে, তা প্রসবের কয়েক মাসের মধ্যেই মায়ের শরীরে আরএইচ এন্টিবডি তৈরি করবে।
nh9887যখন মা দ্বিতীয় সন্তান বহন করবেন, তখন যদি তার ভ্রূণের ব্লাডগ্রুপ আবার পজেটিভ হয়, তাহলে মায়ের শরীরে আগে যে এন্টিবডি তৈরি হয়েছিল সেটা প্লাসেন্টার বাধা ভেদ করে বাচ্চার শরীরে প্রবেশ করবে। আর যখন এটি ভ্রূণের শরীরে ঢুকবে তখন ভ্রূণের লোহিত রক্ত কনিকার সেল ভেঙে যাবে। এ সমস্যাকে চিকিৎসা বিদ্যায় বলা হয় আরএইচ ইনকমপ্যাটিবিলিট।
আগে কখনও অপারেশন না হয়ে থাকলে অনেক সমস্যা এড়ানো যাবে। শুধু সচেতন থাকতে হবে। স্বামীর ব্লাডগ্রুপ পজেটিভ হলে, বাচ্চা জন্মের পরপরই বাচ্চার ব্লাডগ্রুপ পরীক্ষা করতে হবে। যদি নেগেটিভ হয় মায়ের মতো, তবে কিছু করার দরকার হয় না। আর পজেটিভ হলে এন্টি ডি ইনজেকশন নিতে হবে ডেলিভারির ৭২ ঘণ্টার মধ্যে।” (তথ্যসূত্র-যুগান্তর অনলাইন পোর্টাল, ১৭ নভেম্বর, ২০১৭)
এতগুলো কথা শুনে তানহা বলে উঠলো,
-যতটা বোকা ভেবেছিলাম ততটা নন আপনি। সংসার তাহলে করা যাবে আপনার সাথে।
কথাগুলো বলে ও হাসতে লাগলো। আমি ওর হাসি শুনে শুধু ভাবছিলাম, মানুষ এত সুন্দর করে হাসে কিভাবে?
——চলবে——