গল্প: ম্যানহোলের_অতলে পর্ব-৪

0
834

গল্প: ম্যানহোলের_অতলে
পর্ব-৪

লিখা : #এম_আর_রাশেদ এবং #মল্লিকা_জাহান

সহসা আয়ানের এমন কথায় শত শত মানুষের ভীর করা বাড়িটি মুহুর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেলো। বাড়ির কেউ মানতে নারাজ এমন ভিন্নার্থক কথায়। আবার কেউ লাশ কাটাকুটি নিয়ে অস্থির। আজিম সাহেব যেহেতু এসব বিষয়ে অবগত তাই বাড়ির সবাইকে বুঝিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সব দায়িত্ব আয়ানের উপর সমর্পন করেন। লাশ অ্যাম্বুলেন্সে ফেরত পাঠানো হলো পোস্টমর্টেমের উদ্দেশ্যে,

আয়ান বাইকের চাবি দেওয়ার সময় আবার বিপত্তি ঘটলো। সুপ্তি রক্তিম চোখে সামনে দাঁড়ালো। উচ্চকণ্ঠে বললো,

— কি হিসেবে আপনি পোর্স্টমোর্টেম করাবেন? আর এই দায়িত্ব বা অধিকার আপনার নেই। আমার বোন অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে পৃথিবীতে থেকে চলে গেছে। পরে আছে শুধু পচনশীল নিথর দেহটুকু। এটার উপরেও এখন অত্যাচার চালাতে চান?

— দেখুন আমি এখানে অধিকারের কোনো বিষয় নিয়ে আসিনি। আমি এসেছি সত্যটা উপলব্ধি করাতে আর এটা অধিকারের সূচকে লিপিবদ্ধ নয় বরং এটা আমার কর্তব্য।
আপনারা মর্মাহত, আর এটাই স্বাভাবিক কিন্তু তারপরেও আমাকে এটা করতে হবে।

— আপনারা তো এখন রীতিমতো একটা নিথর লাশকে নিয়েও টালবাহানা শুরু করেছেন। (রূঢ় কন্ঠে সুপ্তির উত্তর)

— ভুলে যাচ্ছেন আমি একজন আইনের কর্মকর্তা, সত্যি সামনে আসুক সবার কাম্য। কর্তব্যের বাইরে আমার দায়বদ্ধতা নেই।

— কিসের সত্যি? রুমে কেউ এসে খুন করবে, আমরা জানবো না? আর পিয়াশ চিল্লাবেও না। কোন যুক্তিতে বলছেন খুন৷ আপনাদের না ভালো মতো চেনা, টাকা-পয়সার জন্যে করছেন তাই না! মেয়েটাকে কবরেও শান্তি দেবেন না।

কথা গুলো বলার মাঝখানে আয়ান পকেট থেকে একটা কলম বের করে সুপ্তির হাত ধরে আচমকা হাতের কব্জিতে দাগ দিলো। কলমের কালির নিচেও সাথে সাথেই ফুটে উঠলো দাগ। সুপ্তি অন্য হাত দিয়ে হাত টা ধরলো। আয়ানের চোখের দিকে হাজারটা রাগ নিয়ে তাকিয়ে আছে। আয়ান নিজের হাত থেকে কলমটা সুপ্তির হাতে দিলো। তারপর বললো,

— নিজে দাগ দাও হাতে, আমার দাগের নিচে!

সুপ্তি অভিমানী চোখে তাকিয়ে রইলো। যেন সে মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঝাপসা চোখের জলগুলো বলছে, ” আপনার কোনো অধিকার নেই, আমার সাথে এ আচরণ করার!”

আয়ান রাগ নিয়ে বললো,

— শুনতে পান নি, নিজে হাতে দাগ দিন। যদি জানতাম বাসায় এসে মর্মাহত বাড়িতে ফিজিক্স শেখাতে হবে। তাহলে লাশ পর্যবেক্ষণ করার পর ময়নাতদন্তের আগে আনতেই দিতাম না। দুঃখিত একটু কড়া ভাবে কথা বলার জন্য।

সুপ্তি প্রচন্ড রাগ নিয়ে হাতে দাগ কাটলো। পরক্ষণে আয়ানের সামনে হাতটা বাড়িয়ে দেখিয়ে বললো,

— শান্তি? ইচ্ছে পূর্ণ হয়েছে আপনার। এবার তো আমার বোনের লাশটাকে কাটা ছেড়া থেকে মুক্তি দিন।

আয়ান সুপ্তির হাতটার দাগ দেখিয়ে বললো,

— ঠান্ডা মাথায় দুটো দাগ লক্ষ্য করুন। প্রথম টা আমি আপনার হাতে দিয়েছি, আর পুরোটা অংশ ফুলে গিয়েছে। কলমের কালি সর্বাংশে সমানভাবে গাঢ়। আর দ্বিতীয় টা আপনার দেয়া। এটা লক্ষ্য করুন, শুরুতে অল্প গাঢ়, পরে হালকা দাগ। আর প্র‍থম অল্প অংশ ফুলে গেছে, বুঝতে পারছেন?
বোঝার সুবিধার্থে আরও স্পষ্ট করে বলছি, পিয়াশের গলা নিজে থেকে কাটা হলে অল্প অংশ গাঢ় হয়ে কাটার কথা, বাকিটা হালকা। কিন্তু পুরোটা থেমে থেমে কাটা এবং গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। নিজে নিজে কেউ পারেনা। এর নির্ভরযোগ্য প্রমাণাদি আত্মহত্যা নয় বরং ঠান্ডা মাথায় খুনের দিকে ইঙ্গিত করে। আপনার বোনের খুনের শাস্তি হোক, আপনি কি তাই চান না?

সুপ্তি অভিমানী চোখ থেকে রাগস্বরুপ জলগুলো গাল বেয়ে পড়লো। সুপ্তির নীরবতা দেখে আবারও বললো আয়ান,

— আমি আসি তবে? আর ভরসা রাখুন, ময়নাতদন্তের পর খুনির খুন করার প্রক্রিয়া ধরা পরবে! আর হ্যাঁ বাড়িটা কি এক্সিডেন্টের পর পরিষ্কার করেছিলেন?

— না।

— দরকারও নেই৷ এটলিস্ট পিয়াশের রুমটায় যেন কেউ না যায়। এটা একটু খেয়াল রাখবেন দয়া করে।

বলেই আয়ান বাইকে উঠলো। সুপ্তির অস্থিরতা বেড়েই যাচ্ছে৷ পাঁজর ছিড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে হৃদপিণ্ডটা। সমগ্র বাড়ি জুড়ে আবার হাহাকার নেমে এলো। মরে গিয়েও মানুষের শান্তি নেই। সুপ্তির ভাবনাতে অন্যকিছু বিরাজমান। চোখ বেয়ে তো অঝোরে অশ্রু ঝড়ে চলেছে। এতটুকু বোঝাই যাচ্ছে, মার্ডার হলে তাদের বাড়িতে কেউ একজনকে আসতে হবে! আপন কেউ? কিন্তু কে? তাওয়াফ নয় তো? হতেই পারে! আজকালের দু-দিনের প্রেমে কি ভরসা৷ বাড়িতে সবার ভূত দেখার মত আচরণ। আমির সাহেব বুকে হাত দিয়ে ফ্লোরে বসে আছে। বাকি আত্মীয় স্বজনে বাড়ি ভর্তি। সুপ্তি পিয়াশের রুমে তালা দেওয়ার জন্যে, ড্রয়ার থেকে তালা বের করে দিতে যাবে এমন সময় পিয়াশের বড় ফুপি রুমের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সুপ্তি অগ্নিবর্ণ হয়ে বললো,
— ফুপি তুমি এখানে কি করছো?

ভূত দেখার মত চমকে গেলো। সাথে সাথে নিজেকে সামলিয়ে বললো,

— আমি তো পিয়াশ…

বলেই কেঁদে ফেললো বড় ফুপি সাবনাজ বেগম। সুপ্তির গলা জড়িয়ে ধরলো। সুপ্তির চোখে যেন আর পানি আসছে না। যখন অনুধাবন হলো এটা আত্মহত্যা নয় বরং খুনের ইঙ্গিত। তখন কারো সাথে কান্নাকাটি করে দুঃখ ভাগ করতে মন চাইছে না৷ সবাইকে যেন সন্দেহ হচ্ছে। সবার চোখের জল মায়াকান্না বলে মনে হচ্ছে। এমনকি নিজের মায়েরও। তাদের বাড়িতে অন্য কেউ আসবে কি করে? সুলতানা বেগম নিজেও বলেছিলো, খুন করতে হাত কাঁপবে না৷ ফুপিকে পিয়াশের রুম থেকে বাইরে এনে তালা লাগিয়ে দিলো। আয়ানের নম্বর থাকলে ভালো হতো, যাদের সন্দেহ হচ্ছে সবার নাম বলা যেত। সুপ্তি আকাশে দিকে একমনে তাকিয়ে বলতে লাগলো; হে স্রষ্টা এই ছোট্ট মেয়েটির সামান্য ভুলের জন্য এতো বড় শাস্তিই কি প্রাপ্য ছিল?

পরের দিন আয়ান ল্যাবের কাছে আনাগোনা করছে প্রচুর। কিন্তু রির্পোট দু-দিনের আগে পাওয়া মুশকিল। আয়ানের তদারকিতে এটা ক্লিয়ার পিয়াশের খুন হয়েছে। সেটা একজন করুক বা দুই-তিন জন। আয়ান আমির সাহেবের বাড়িতে গেলো। সুলতানা কাল থেকে জায়নামাজে বসে আছে৷ পানি ছাড়া কিছুই খায় নি। তসবি হাতে নিয়ে বিরবির করছে। চোখ মুখ ফোলা। তিনি গেট খুলে দিলো,

— তুমি যেন কে?

— আমার নাম আয়ান।

— পুলিশ?

— আমি একজন সাব-ইন্সপেক্টার!

— সে যাই হোক, সবাই পুলিশ। এসো, শুনেছি পুলিশ নাকি টিম নিয়ে আসে, তুমি একাই আসছো। সত্য বলো তো খুন হয়েছে এটা কি সত্য? নাকি আজিব তোমাকে টাকা পয়সা হাতিয়ে নিতে এইগুলো বলেছে।

আয়ান চাইলে অনেক বড় জবাব দিতে পারতো৷ কিছুই বললো না, আয়ান উলুবনে মুক্তো ছড়াতে পছন্দ করে না। আয়ান যে রেঞ্জে রয়েছে সেখানের এসপি আজিম সাহেবের টিম। আয়ান সাব-ইন্সপেক্টার৷ এই কেসের তদন্ত এর পারমিশন এখনো পায় নি। তাই ইউনিট আসছে না। কিন্তু ইউনিট নিয়ে আসতে চাইলে অনেক দেরি হবে। এটাই প্রথম কেস নয় পারমিশনের আগেই আয়ান কাজ করেছে। এর আগেও অনেক কেস সে একাই সলভ করেছে। তাই এস পি আজিম সাহেব মাত্র এক বছরের মাথায় আয়ানের প্রোমোশনের ব্যবস্থা করে। হত্যার চেয়ে বরং লাশের জন্য অপেক্ষা বেশি কষ্টের সেটা আয়ানের অজ্ঞাত নয়। সে নিজেও জানে প্রিয়জনের হারানোর ক্ষতের তীব্র যন্ত্রণা কতটা গভীর। তাই কিছু না বলেই দমে গেলো।
আয়ান রুমের তালা খুলে রুমটা ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। চারপাশ ভাতে ছড়ানো ছিটানো। চেয়ারে খুন হয়েছে পিয়াশ। ফ্লোরে চেয়ার টানার দাগ স্পষ্ট। আয়ান মনে মনে সেদিনের রাতের ঘটনা সাজিয়ে নিলো। কেউ এসেছিলো। পিয়াশ অজ্ঞান ছিলো, রক্তাক্ত দাগ গুলো দেখে মনে হচ্ছে, খুন করে চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছে। খুন ফ্লোরে হয় নি, তো কোথায়? খাটে? খাটে গিয়ে দেখলো রক্ত ভিজে জমে আছে। চাদরটা উঠালো, তোশকের একপাশে কাপড় দিয়ে ঢাকা। সরিয়ে দেখে চাদরে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। খুনি হয়তো কোনো ভাবে অজ্ঞান করে তারপর বিছানায় এবং সেখানে খুন করে তারপর চেয়ারে রাখে। কিন্তু চেয়ারেই রাখলো কেন? খুনের এই ছোট খাটো পরিশ্রম আয়ানের অদ্ভুত লাগে৷ সেই তো অনেক সূত্র ফেলে যায়।

সুপ্তি আর সুলতানা গেটের বাইরে এসে দাঁড়ালো। আয়ান বারান্দায় গেলো। দো-তালা বিল্ডিং, যে কেউ আসতে বা যেতে পারে! আবার রুমেরও কেউ খুন করতে পারে। আয়ান জিজ্ঞেস করলো,

— আচ্ছা ছুড়িটা কই?

সুপ্তি উত্তর দিলো,

— আসলে আমরা ভেবেছিলাম, এটা সুইসাইড, তো ছুড়িটা হসপিটালে নেওয়া হয়েছিলো না-কি কি হয়েছিলো মনে নেই।

— কাওকে সন্দেহ?

— তাওয়াফ।

— তাওয়াফ কে?

— তাওয়াফ হলো, পিয়াশের বয়ফ্রেন্ড। আসলে পিয়াশ আর তাওয়াফকে মা খুব আন্তরিক ভাবে আবিষ্কার করে। এর জন্য বাড়িতে অশান্তি। ইউ নো বাড়িতে যেমন হয়!

— কাল তাওয়াফ এসেছিলো?

— জানি না। কাল অনেক মানুষ এসেছিলো।

— তাওয়াফের বাড়ির ঠিকানা জানেন?

— না কিন্তু এই এলাকায় থাকে। এলাকার বখাটেদের মধ্যে একজন। আর আমাদের পারার ফুটবল ক্লাবে খোঁজ নিলেই জানবেন।

আয়ান আর কথা বাড়ালো না। কতগুলো ছবি তুলে নিলো ক্যামেরা দিয়ে। তারপর চলে গেলো।

তাওয়াফকে খোঁজা সত্যি কঠিন না। এলাকা খুব বেশি বড় নয়। কিন্তু এইসব কেসে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় ভয়ে পালিয়ে যায়। আয়ান এলাকার বড় দোকান থেকে তাওয়াফের কথা বলতেই বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দিলো।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here