গল্প: ম্যানহোলের_অতলে পর্ব-৭

0
959

গল্প: ম্যানহোলের_অতলে
পর্ব-৭
লিখা : #এম_আর_রাশেদ এবং #মল্লিকা_জাহান

সুলতানা কাদের আর রহিমাকে নিয়ে ফ্লোর থেকে ঘর বাড়ি সব কিছু ধোয়া মোছার ব্যবস্থা করছে। তার হাতে তসবি৷ আলখেল্লার মতো হিজাব নিয়ে তিনি পিয়াশের রুমের দিকে যাচ্ছেন। সুপ্তি অনেকটা চিৎকার করে বাঁধা দিলো,

—- এই রুম পরিষ্কারের দরকার নেই মা! তার উপর এই ভরা সন্ধায় কেউ ঘর বাড়ি পরিষ্কার করে না! কে বলবে, বিকেলে এই বাড়ির ছোট মেয়েকে কবর দেওয়া হয়েছে। কোনো দরকার নেই। নিজের রুম পরিষ্কার করো যাও।

—- তোর থেকে অনুমতি নিচ্ছি না আমি। মৃত্যু দুনিয়ার বড় নিয়ম। আজ পিয়াশ মরেছে কাল আমি মরবো। তাই বলে ভোটকা আঁশটে গন্ধ নিয়ে নামাজ পড়বো? নামাজের মধ্যে একটা ফরজ, জায়গা পাক দরকার। যেখানে চার দিন ধরে ঘরের সামনে যাওয়া যাচ্ছে না।

—- এইখানে ক্লু আছে।

—- এইসব ক্লু দিয়ে কি পিয়াশকে ফিরে পাবো? আমার এই দুনিয়ার থেকেই মন উঠে গেছে। কঠিন হয়ে গেছে হৃদয়৷ তুই মরলেও কান্না করবো না৷

—- তুমি পাগলের মতো কথা কেন বলছো?

—- আমি না তোর বাপে পাগল! দেখ, গিয়ে পিয়াশের আত্তার মাগফিরাত কামনা করে দুটো ফকির খাওয়াতে পারে, হাসপাতালে শুয়ে আছে। মিনি হার্ট অ্যাটাক হয়েছে তার৷ কোনো মানে হয় এতোটা সিন ক্রিয়েট করার।

বলতে বলতে কেঁদে দিলেন। সুপ্তির আজকাল কারো কান্না সহ্য হয় না। অন্যঘরে চলে গেলো। পিয়াশের রুমে কাদেরকে দিয়ে তালা টা ভাঙ্গালো। কাদেরের বয়স তের বা চৌদ্দ, পিয়াশের বয়সী। শ্যামলা ছেলে, বলেন বিল্ডিং এর নতুন দাড়োয়ানের ছেলে। বড্ড কাজের, সুলতানার বেশ ভালো লাগে ছেলেটাকে। ঝুল ছাড়লো, রুমের ফ্লোর ব্লিসিং পাউডার দিয়ে মোছালো। বিছানার তোশক এ রক্তের গন্ধ। কাদের পানি ভিজিয়ে কয়েকবার হালকা মুছলো। সুলতানার কাছে গন্ধের পরিবর্তন হলো না, কাদের তোশক উঠিয়ে রেখে দিলো, কাল সকালে ছাদে শুকাবে। সুলতানা ভেবেছে তাও যদি গন্ধ না শুকায়, তোশকটাই ফেলে দেবে। কাদের পিয়াশের খেলনা গুলো, কাপড় কাচার পাউডার এর গোলানো পানিতে চুবিয়ে তারপর ন্যাকড়া দিয়ে মুছছে। ফ্লোর মোছার থেকে খেলনা গুলোর প্রতি আগ্রহ বেশি কাদেরের।

—- তোর খেলনা ভালো লাগে? ( সুলতানার প্রশ্ন)

—- জ্বী না চাচী!

—- লাগলে নিতে পারিস! আমাদের আর কে খেলবে!

—- সত্য চাচী!

—- সত্য বৈ কি? পিয়াশের পুতুল গুলো দেখলে আরো কষ্ট হয়৷ যা ভালো লাগে নিয়ে যা। ভুলে যেতে চাই আমার দুটো কন্যা ছিলো।

কাদের সাথে সাথেই সুলতানাকে সালাম করলো। মনে মনে পিয়াশকেও ধন্যবাদ দিলো। প্রায় দু-একটা বাদে সবকয়টা খেলনা নিলো, সাথে টেবিল ল্যাম্প, পুরোনো খাতা। গল্পের বই, কলম- বইপত্র, রঙ পেন্সিল এর সেট। প্রায় রুমের অর্ধেক জিনিস সুলতানা ফেলে দিলো বা কাওকে দান করে দিলো। পিয়াশের ছবি গুলোও নিচে নামানো হলো, আলমারিতে জামাগুলোও মহিলাকে দিলো। পুরো রুম চকচক করছে। সুলতানার চোখে পানি আবারো এলো। সুপ্তি ঠিক পেছনে দাঁড়ানোর মায়ের। অতি রাগে ফুঁসছে সে। রাগী, অভিমানে, চোখ রক্তিম তার। ক্ষিপ্ত ভাবে বললো,

—- তুমি রুম ফাঁকা করেছো কেন?

—- গরীব মানুষকে দান করলাম, রেখে কি হবে? ওরা পরে দোয়া করবে।

—- তোমায় দেখে মনে হচ্ছে, যেন পিয়াশের মৃত্যুতে তুমি খুব আনন্দিত, কোন হিসেবে ওর স্মৃতি বিলিয়ে দিলে।

—- কোন হিসেবে বলতে? স্মৃতির দোহাই দিয়ে বছরের পর বছর বদ্ধ ঘরে জিনিসপত্র ধুলি জমবে, আমরা এতে পিয়াশকে ধরে রাখবো? আরে ওরা পায় না কাপড়-চোপড়, যখন ওরা পড়া জামা – কাপড় পড়ে আমার সামনে আসবে, আমার মনে হবে আরেকটা পিয়াশ। আমি তো সবার মধ্যে পিয়াশকে খুঁজছি।

—- তোমার কথাগুলো যেন বিষের মতো লাগছে। তুমি আসলে কি চাও বলবে মা? পিয়াশে ছবি কই দেয়ালে?

—- ছবি হারাম! তাই নিচে নামানো।

মায়ের কথায় তীব্রতর হলো সুপ্তির চোখের জল আর অভিমান। নিজের রুমে গিয়ে সামনে পানির জগ আর গ্লাস ছিলো, সেগুলো ফেলে দিলো। ঝং করে একটা শব্দ করতে থাকলো, তারপর আবার চারপাশ নীরব। মুখ গুছে কান্না করছে সুপ্তী। এই মাকে যে চেনে না সে, আচ্ছা মা কোনোভাবে মৃত্যুর সাথে জড়িত নয় তো? হতেই পারে ভুলবশত কিছু! বা এই মায়ের মাথা খারাপ হয়েছে। না হলে খুনীকে সাহায্য করতো কেন? খুনীর ক্লু ধুয়ে মুছে ফেললো কেন? সুপ্তির ড্রয়ার থেকে দশটা ঘুমের ট্যাবলেট খেলো। অনেক রাত ঘুমায় না সে৷ যার দরুণ, আজ যা তা ভাবছে। তাই ঘুমানো উচিত। বান্ধবী নিশি একজন সাইকোলজির স্টুডেন্ট। একদিন ওদের ক্লাসে গিয়েছিলো। স্যার ভাষণ দিচ্ছিলো,

” একটা প্যারাসিটামল কাজ করে ত্রিশ মিনিটে, কিন্তু দেখা যায়, মাত্র ১০ মিনিট বা পাঁচ মিনিটে আমাদের শরীর ঘামতে শুরু হয়, কেন?”

পুরো ক্লাস থমথমে, সত্যিই তো কেন? সুপ্তী সেদিন মুগ্ধতা নিয়ে ক্লাস করেছিলো। স্যারের ব্যাখ্যা, জম-জমাট ক্লাস, ক্লাসে ফ্যান নষ্ট ছিলো কিন্তু তাও তার এতটুকুও অস্বস্তি হয় নি৷ তারপর স্যার আবার শুরু করলো,
” এর কারণ কি? কেউ বলতে পারবে? হ্যাঁ, মনের জোর, মনে একটা জোর কাজ করে আমি সুস্থ হয়ে যাবো! ”

সুপ্তির ঘুম আসছে৷ অথচ, মাত্র পাঁচ মিনিট হয়েছে৷ দেওয়ালের ঘড়ি টিক টিক ঘুরছে। অন্ধকার চারপাশ,” কেউ আছে? আমায় বলবে পিয়াশ কোথায়, অন্ধাকারে মিলিয়ে গেছে, আমিও কি যাবো? বাবাও কি যাবে? বাবা কি সুস্থ আছে? কেউ বলবে? ”

সুপ্তি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলো, বিরবির করছে সে।

রাত প্রায় দুটো পাঁচ, ডিউটি অভার হয়েছে আয়ানের প্রায় ৪ ঘন্টা। হসপিটালে বসে আছে আয়ান, সাথে আজিম সাহেব। আজিম সাহেব এটা দিয়ে তিন প্যাকেট সিগারেট শেষ করলো। আয়ান দেখে যাচ্ছে, তার কঠিন মানুষকে ভেঙে যেতে দেখবে এটা ভাবে নি কখনো। আমির সাহেব এখন মোটামুটি সুস্থ। তাদের অসুস্থতায় কেসের যেন দিক ঘুরছে। আয়ানের ফোন ভাইব্রেট হলো, আয়ানের মা ফোন করেছে, আয়ান রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে চিন্তিত কন্ঠে,

—- তোর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই? কিসের জন্যে যে এই চাকরি করিস! নাই জীবনের ঠিক-ঠিকানা। কয়বার ফোন দিয়েছি, ফোন করে বলা যায়, ফিরতে দেরি হবে! কতক্ষণ খাবার নিয়ে বসে থাকে?

—- মা, আমি আসছি। দশ মিনিট দাও, আসলে এস. পি স্যারের ফ্যামিলি কেসে আছি। প্রচুর চাপ।

—- আমি কার কি হয়েছে শুনতে চাই না! ডিউটি পর্যন্ত থাক, এর বাইরে এত মাথা ব্যাথা কেন সব জিনিসে? তোর বোন প্রেগন্যান্ট, সে খবর আছে৷ আট মাস, যে কোন সময় খবর আসবে, হসপিটালে নেওয়া লাগবে। তুই ছাড়া আর কে আছে আমাদের? তোর মানুষের প্রতি সব দায়িত্ব তাই না? আর আমরা!!

——- আচ্ছা মা, আসছি। তুই তরকারী গরম দাও, আমি চুলো থেকে নামানোর আগে আসছি।

আয়ান ফোনটা ছেড়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। চোর, ডাকাতের পিছনে ছুটতে ছুটতে
নিজের পরিবারকেই সেকেন্ড অপশনে ফেলেছে। দীর্ঘশ্বাস নিলো, আজিম সাহেব আয়ানের দিকে তাকালো,

—- স্যার আমার বাড়ি থেকে ফোন আসছিলো!

—- কি অদ্ভুত, আমার বাড়ি থেকেও ফোন এলো,সুপ্তি নাকি কিছু খেয়েছে, গোঙ্গাচ্ছে।

—- আপনি এতোটা শান্তভাবে কিভাবে বলছেন! আমাদের হসপিটালাইজ করা উচিত।

—- সুলতানা আসছে.। আমি এই হসপিটালেই আসতে বলেছি, ডাক্তারকেও ফোন দিলাম।

—– স্যার! সবাই কি সুইসাইড করার জন্যে প্রতিযোগিতা করছে।

—- সুপ্তির কাজ আমার কাছে সাধারণই লাগছে। কিন্তু সুলতানা বড্ড শান্ত ছিলো ফোনে। যেন সে নিজেই বিষ খায়িয়েছে। লোক দেখাতে হসপিটালে আনছে।

—- স্যার আমি কি এগিয়ে যাবো?

—- দরকার নেই। ওয়েট করো! আমি ছক মেলাচ্ছি। সুলতানার তো পিয়াশকে মারার কারণ ছিলো, এখন সুপ্তিকে মারার কারণ কি? সত্য জেনে গিয়েছিলো? নাকি অন্য কিছু!!

আয়ান, আজিম সাহেবের শান্তরুপ দেখে বিস্মিত, সে এক ঘন্টা আগেও আড়ালে চোখের জল লুকিয়েছে।

প্রায় পনের মিনিটের মাথায় সুপ্তির এম্বুল্যান্স এলো। এডমিট করা হলো! আয়ান মেলাতে পারছে না। ডাক্তার নল দিয়ে ওয়াশ করছে। সুপ্তির অলরেডি রক্ত যাচ্ছে। আজিম সাহেব মাথা ঠান্ডা করে আবারও ভাবছে, প্রথম থেকে, এখন খালি প্রমাণ পাওয়া বাকি!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here