#গোধূলির_রাঙা_আলোয়,পর্বঃ ০১
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
ট্রেনের জানলায় মাথা নুইয়ে চোখের পানি ফেলছে উৎসা। এক বুক স্বপ্ন নিয়ে যে শহরে পা রেখেছিলো, সেই শহর থেকে এক বুক কষ্ট নিয়ে ফিরে যাচ্ছে। তার ভালোবাসার মানুষটা সারাজীবনের জন্য অন্য কারো ভাগ্যে লেখা হয়ে যাবে আজ। অষ্টাদশীর মনে যে মানুষটার জন্য প্রথম ভালোবাসার ফুল ফুটেছিল, সেই ফুল আজ কেবল কাঁটার আঘাত হয়েই রয়ে গেলো। স্বপ্নগুলোর সাথে ভালোবাসাটাও এই শহরে ফেলে যাচ্ছে সে। শব্দহীন কান্নায় কোলাহলে পূর্ণ স্টেশনটাও স্তব্ধ মনে হচ্ছে উৎসার কাছে। আশপাশের এতো কোলাহল, এতো মানুষের ব্যস্ততা একটুও যেনো নাড়া দিচ্ছে না তাকে। ট্রেনের জানলা দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। ক্ষণে ক্ষণে চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে নোনাজল। চোখদুটো বন্ধ করে নিতেই খুব বেশি জ্বালা করে উঠলো। ধীরে ধীরে ট্রেন চলতে শুরু করলো, একসময় কোলাহলে পূর্ন স্টেশন পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেলো। পাশ থেকে তামান্না উৎসার কাঁধে হাত রাখতেই জলে টইটম্বুর আঁখি নিয়ে ফিরে তাকালো তামান্নার দিকে। উৎসাকে দেখে তামান্নার চোখেও পানি চলে এলো। উৎসার চোখের পানি মুছে দিয়ে মাথা নাড়িয়ে ইশারায় কাঁদতে নিষেধ করলো। কিন্তু উৎসা করলো ঠিক তার উল্টো। তামান্নার বুকে আছড়ে পড়ে গলা ছেড়ে কাঁদতে লাগলো। চিৎকার করে কাঁদছে মেয়েটা, যে কান্না প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর বুকে ধারালো ফলার মতো আঘাত করছে। তামান্না বাঁধা দিলো না মেয়েটাকে, কাঁদলে বুকের ভেতরটা যদি হালকা হয়। কতগুলো দিন ধরে বুকের ভেতর কান্নাগুলো আঁটকে রেখেছিলো। তামান্না দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাইরের দিকে তাকালো। গোধূলির রাঙা আলোয় প্রকৃতি হয়ে উঠেছে অপরূপা। এমনই এক গোধূলির রাঙা আলোয় এই শহরে উৎসাকে নিয়ে পা রেখেছিলো তামান্না। উৎসার চোখে ছিল স্বপ্ন ছোঁয়ার তীব্র উৎকন্ঠা। চোখ বন্ধ করলে মনে হয়, এই তো সেদিনের কথা কিন্তু মাঝে কেটে গেছে দু’টো বছর। উৎসা কাঁদতে কাঁদতে একসময় চুপ হয়ে গেলো। ট্রেনটা ছুটে চলেছে ঢাকা শহরের সীমানা পেরিয়ে। উৎসা ডুব দিলো আজ থেকে দুইবছর আগের সোনালী সেই গোধূলিতে।
১.
এই তাম্বু উঠ, এসে গেছি তো, কুম্ভকর্ণ একটা।
উৎসার ধাক্কাধাক্কিতে বিরক্ত হয়ে পিটপিট করে তাকালো তামান্না। পড়ন্ত বিকেলে সূর্যের তেজ বিহীন আলোয় মুখ কুঁচকে গেলো তার।
ঘুমঘুম গলায় বিরক্ত হয়ে বললো, কী রে পর্দা সরিয়ে দিলি কেনো ?
উৎসা দ্বিগুণ বিরক্ত হয়ে বললো, আর কত ঘুমাবি তুই ? আমরা চলো এলেছি, ট্রেন থেমেছে সেই কখন।
তামান্না উঠে বসে চোখ কচলাতে কচলাতে বললো, কোথায় চলে এসেছি ?
উৎসা বিরক্ত হয়ে তামান্নার মাথায় থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। ঘুম থেকে উঠে কিছু সময়ের জন্য সব ভুলে যায় তামান্না, সেটা নতুন কিছু নয়।
উৎসা নিজের জিনিসপত্র গুছাতে গুছাতে বললো, ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে আছি আমরা এখন। তোর কোন ভাইয়া না আসার কথা ছিলো, আমাদের নিতে ?
কিছু সময় চিন্তা করার পর তামান্নার সব মনে পড়ে গেলো আস্তে আস্তে ।
চিন্তিত গলায় বললো, ও গড দেরি হয়ে গেছে মনে হয়।
উৎসা বিরক্ত চাহনিতে তামান্নার দিকে তাকিয়ে বললো, আরো ঘুমা কুম্ভকর্ণের মতো ?
তামান্না ভীত গলায় বললো, শুদ্ধ ভাইয়া খুব পাংচুয়াল মানুষ। সময়ের প্রতি অবহেলা তার একদমই পছন্দ নয়। ঠিক সময়ে স্টেশনে অপেক্ষা করবে বলেছিলো। আমরা সময়মত না গেলে এখানেই ফেলে চলে যাওয়ার আগে একবারও ভাববে না।
তামান্নার ভাইয়ার কথা শুনে উৎসার কপালে ভাজ পড়লো বিরক্তির। তবে মুখে কিছু প্রকাশ করলো না। তামান্না উঠে তাড়াতাড়ি নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে লাগলো। উৎসার গুছানো হয়ে গেছে তাই বসে তামান্নার তাড়াহুড়ো দেখতে লাগলো।
তামান্নার হয়ে যেতে উৎসাকে তাড়া দিয়ে বললো, তাড়াতাড়ি চল।
লাগেজ হাতে নিয়ে তামান্নার সাথে ট্রেন থেকে নামার জন্য পা বাড়ানোর আগে দরজায় দাঁড়িয়ে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো উৎসা। বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে নিচে পা রেখে নতুন জীবনের সূচনা করলো। তামান্না ট্রেন থেকে নেমে দ্রুত ফোন বের করে হাতে নিলো শুদ্ধকে কল দেওয়ার জন্য। অন করতেই স্কিনে ভেসে উঠলো শুদ্ধের নাম্বার থেকে ১০ টা মিসকল। ফোন সাইলেন্ট থাকায় বুঝতেই পারেনি। তামান্না ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে নিলো। উৎসা কপাল কুঁচকে তামান্নাকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। এতো সুন্দর মুহূর্ত উপভোগ করতে পারছে না এই মেয়ের এমন অস্থিরতা দেখে।
স্টেশনের একপাশে দাঁড়িয়ে চরম বিরক্ত নিয়ে হাতের ঘড়িটার দিকে তাকালো শুদ্ধ তারপর আবার আশেপাশে তাকালো। তামান্নার নাম্বারে আবার ডায়াল করতেই এক ভদ্র মহিলা সুস্পষ্ট গলা ভেসে এলো।
“আপনি যে নাম্বারে কল করেছেন তা এমুহূর্তে ব্যস্ত আছে। কিছুক্ষণ পর আবার কল করুন, ধন্যবাদ।”
“The number you are calling is busy now. Please call after sometime, Thank you.”
এতক্ষণ তো তাও কল গেছে এখন তো তাও যাচ্ছে না, ব্যস্ত বলছে বারবার। বিরক্তি চোখে মুখে ফোটে উঠেছে শুদ্ধর। আধঘন্টা যাবত এই স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে সে, চট্টগ্রাম থেকে ট্রেন এসেছে আরো মিনিট পনেরো আগে, এখনো মেয়েটার দেখা নেই। এদিকে কেউ বুঝতে পারছে না যে দু’জনে একসাথে কল করছে তাই ব্যস্ত বলছে। শুদ্ধ বিরক্ত হয়ে ফোন পকেটে রাখার আগেই কেঁপে উঠলো ফোনটা।
তামান্নার নাম্বার দেখে রিসিভ করে বিরক্ত গলায় বললো, কোথায় তুই ?
ভাইয়া আসলে ফোন সাইলেন্ট,,,
তামান্নার কথা সম্পন্ন হওয়ার আগে শুদ্ধ বলে উঠলো, আমি কোনো এক্সকিউজ জানতে চায়নি তামান্না। বেশি কথা বলা আমার পছন্দ নয়। কোথায় আছিস সেটা জানতে চেয়েছি।
তামান্না শুকনো ঢোক গিলে নিজের লোকেশন বললো। শুদ্ধ সেখানেই দাঁড়াতে বলে কল কেটে ফোন পকেটে রাখলো। কপালে আঙ্গুল চালিয়ে রাগ নিয়ন্ত্রণ করলো যতটা সম্ভব। তামান্না ফোন রেখে আশেপাশে তাকালো ভীত দৃষ্টিতে। উৎসা তখনো তামান্নার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।
তামান্না উৎসাকে বললো, কী রে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন ?
উৎসা বিরক্ত হয়ে বললো, তোর কাহিনি দেখছি আমি। এমন ভয়ে ভয়ে কথা বলছিলি যেনো তোর ভাইয়া না বরং কোনো দেশের প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলছিস।
তুই ভাইয়াকে চিনিস না তো তাই এমন কথা বলছিস।
কেনো রে তোর ভাই কী বাঘ নাকি ভাল্লুক ?
বাঘ বা ভাল্লুক না, দ্যা গ্রেটেস্ট ডাঃ আরফান সাদিক শুদ্ধ।
উৎসা ভেংচি কেটে বললো, ঢং দেখে বাঁচি না। এমনভাবে নাম বলছিস যেনো কোনো ফেমাস হলিউড হিরো।
তামান্না ভীত গলায় বললো, বাদ দে দোস্ত কখন কোনদিকে থেকে চলে আসে ঠিক নেই। এসে যদি শুনে আমরা তাকে আজেবাজে কথা বলছি, তাহলে পরের ট্রেনে আবার চট্টগ্রাম ফেরত যেতে হবে।
উৎসা ভেংচি কেটে বললো, এই উৎসা কাউকে ভয় পায় না,,,
উৎসা সামনে তাকিয়ে থমকে গেলো। মনে হলো একটা হার্টবিট মিস করে গেলো তার। এর আগে কোনো ছেলেকে দেখে উৎসার এমনটা হয়নি। ঘামার্ত আর বিরক্তি মাখা মুখ। সরু নাকে আঁটকে আছে চিকন ফ্রেমের চশমাটি, চশমার ভেতর মায়াবী দুটো চোখ, চিকন লালচে ঠোঁট জোড়া আর উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের চাপদাড়ি থাকা গোলগাল মুখটা যেনো এক মায়ার ভুবন। উচ্চতার সাথে স্বাস্থ্যটা একদম পার্ফেক্ট। নেভি ব্লু ফুলহাতা শার্ট বলিষ্ঠ দেহে একদম এঁটে আছে, হাতা দু’টো কনুই পর্যন্ত ফোল্ড করা আর হাতে কালো ঘড়িটা অদ্ভুত সুন্দর মানিয়েছে। এই গোধূলির রাঙা আলোয় কোনো পুরুষকে দেখে এই প্রথম মুগ্ধ হলো উৎসা।
তামান্না উৎসাকে ধাক্কা দিয়ে বললো, কী রে পুরাতন ক্যাসেটের মতো আঁটকে গেলি কেনো ?
উৎসা বিড়বিড় করে বললো, একেই কী লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইড বলে ?
তামান্না বিরক্ত হয়ে বললো, কী বিড়বিড় করছিস ?
উৎসা কিছু বলার আগেই ছেলেটা তামান্নার পিছনে অনেকটা দুরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বললো, তামান্না ?
তামান্না উৎসার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলো, কারো আওয়াজে চমকে পিছনে ফিরে তাকালো। শুদ্ধকে দেখে মুখে হাসি ফোটে উঠলো ঠোঁটের কোণে।
অস্থির গলায় বললো, কেমন আছো ভাইয়া ?
শুদ্ধ গম্ভীর গলায় বললো, আলহামদুলিল্লাহ। তুই কেমন আছিস ?
তামান্না হাসিটা বজায় রেখে বললো, আলহামদুলিল্লাহ।
উৎসা তখনো হা করে তাকিয়ে আছে শুদ্ধর দিকে। উৎসাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে শুদ্ধর কপাল কুঁচকে গেলো। তামান্না শুদ্ধের দৃষ্টি অনুসরণ করে উৎসার দিকে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটা বোকার মতো শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে আছে। তামান্না কনুই দিয়ে ধাক্কা মারলো উৎসাকে। উৎসা তামান্নার দিকে বিরক্তি নিয়ে একবার তাকিয়ে আবার শুদ্ধর দিকে তাকালে হুঁশ ফিরলো তার।
শুদ্ধকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকতে থেকে বোকা মার্কা হাসি দিয়ে বললো, আসসালামু আলাইকুম।
শুদ্ধ গম্ভীর গলায় সালামের উত্তর নিয়ে উৎসার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তামান্নার দিকে তাকিয়ে বললো, বাসায় চল। মা তোদের জন্য অপেক্ষা করছে।
শুদ্ধ আর কিছু না বলে সামনের দিকে যেতে লাগলো।
তামান্না উৎসার হাত ধরে বললো, চল।
উৎসা বিমোহিত গলায় বললো, এটা কে তাম্বু ?
তামান্না বিরক্ত গলায় বললো, কথা শুনে এখনো বুঝিসনি ? এটাই শুদ্ধ ভাইয়া।
দুজনে আর কথা না বাড়িয়ে শুদ্ধর পিছনে যেতে লাগলো। উৎসার দৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করছে শুদ্ধকে। পকেটে হাত গুঁজে সামনে তাকিয়ে কী সুন্দর হেঁটে চলেছে। আশপাশে কী হচ্ছে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ যেনো নেই তার। স্টেশনের বাইরে এসে তামান্নাকে দাঁড়াতে বলে কোথাও গেলো আর দু’মিনিটের মাথায় গাড়ি নিয়ে ফিরে এলো। তামান্না দেরি না করে লাগেজ গাড়ির পিছনে রেখে এসে ভেতরে বসে পড়লো।
উৎসাও এসে পেছনে বসতে গেলে শুদ্ধ গম্ভীর গলায় বললো, দুজনেই পিছনে বসলে লোকে আমাকে ড্রাইভার মনে করবে।
উৎসা কিছু বলার আগেই তামান্না বললো, তুই সামনে বস প্লিজ। আমার ঘুম এখানো কাটেনি, আমি ঘুমাবো।
উৎসা কিছু না বলে সামনের সিটে গিয়ে বসে সিট বেল্ট লাগিয়ে নিলো। গাড়ি চলতে শুরু করলে কিছুক্ষণের মধ্যেই তামান্না আবার ঘুমিয়ে পড়লো। শুদ্ধ চুপচাপ ড্রাইভ করছে আর উৎসা আড়চোখে শুদ্ধকে দেখছে আবার বাইরে তাকিয়ে ঢাকা শহর দেখছে। উৎসা এই প্রথম ঢাকা এসেছে এমনটা নয়। এর আগেও অনেকবার এসেছে ঢাকাতে যখন উৎসার ফুপু ঢাকাতে থাকতো। উৎসার ফুপু এখন পুরো ফ্যামিলি নিয়ে কানাডায় সেটেল্ড হয়ে গেছে৷ কিছুদিন আগে ভর্তির জন্য গুনে গুনে দুবছর পর ঢাকা এসেছিলো উৎসা আর আজ একেবারে চলে এলো। ধানমন্ডির ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস এর মিডিয়া স্টাডিজ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হয়েছে উৎসা আর তামান্না। ছোটবেলা থেকে সাংবাদিকদের প্রতি আলাদা আগ্রহ ছিলো উৎসার। তবে তামান্নাকে সে জোড় করেই নিজের সাথে ভর্তি করেছে। উৎসা পড়াশোনায় খুব বেশি ভালোও নয় আবার খারাপও না। টপ না করলেও ভালো নাম্বার নিয়ে পাশ করে সবসময়। তবে পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পায়নি উৎসা বা তামান্না কেউ। পড়াশোনায় তামান্না তো উৎসার থেকেও একধাপ নিচে। সারাবছর পরে পরে ঘুমাবে আর পরিক্ষার আগে পাগলের মতো পড়বে। তামান্না সবসময় বলে আমি বিয়ে করে ঘর সংসার সামলাবো ভাই, আমার এতো পড়াশোনার দরকার নাই। কিন্তু তামান্নার বাবা মায়ের স্বপ্ন মেয়ে প্রতিষ্ঠিত হোক। এদিকে উৎসার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন থাকলেও তাকে নিয়ে কোনো স্বপ্ন নেই তার বাবা-মায়ের। তাদের কথা মনে পড়তেই বুক চিঁড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এলো উৎসার। বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে তার যখন মাত্র দশ বছর বয়স। দু’জনেই আবার নতুন বিয়ে করে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। মাসে মাসে দু’জনেই মোটা অংকের হাতখরচ তাকে দিলেও কখনো ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করেনি মা তুই খেয়েছিস কিনা। ভালোবাসা জিনিসটা কী উৎসা কখনো অনুভব করতে পারেনি। শৈশবে ডুব দিলে চোখের সামনে ভাসে কেবল বাবা-মায়ের ঝগড়া আর চেঁচামিচি। উৎসার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে যেতেই তাড়াতাড়ি মুছে নিলো। পাশে তাকিয়ে দেখলো শুদ্ধ খেয়াল করেছে কিনা। না শুদ্ধ সামনে তাকিয়ে মন দিয়ে ড্রাইভ করছে আর তামান্না পেছনে ঘুমে ডুবে আছে। উৎসা সিটে মাথা এলিয়ে বাইরের দিকে তাকালো। উৎসা মাথা ঘুরিয়ে নিতেই শুদ্ধ আবার তাকালো উৎসার দিকে। ভাবতে লাগলো মেয়েটা কাঁদছিলো কেনো ? শুদ্ধ দেখেছে উৎসাকে নিজের চোখ মুছতে, তার দিকে তাকাবে বুঝতে পেরেই চোখ সরিয়ে নিয়েছিলো। শুদ্ধ সামনে তাকিয়ে আবার উৎসার দিকে তাকালো। মেয়েটাকে রহস্যময় লাগছে তার কাছে। উপরে হাসিখুশি মনে হলেও ভেতরটা তেমন মনে না। শুদ্ধ আর উৎসাকে নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে নিজের কাজে মন দিলো।
২.
তিয়াসা অশ্রুভেজা চোখে তাকিয়ে আছে ফোনের দিকে। আজ দুদিন হলো অফিসের কাজে কক্সবাজার গিয়েছে মুগ্ধ কিন্তু দু’দিনে একটি বারের জন্যেও ফোন রিসিভ করেনি তিয়াসার। এক-দুবার রিং হওয়ার পরই বন্ধ করে রেখেছে ফোন। মাস দুয়েক হলো বিয়ে হয়েছে দুজনের কিন্তু সম্পর্কটা প্রথম থেকেই স্বাভাবিক নয়। খুব বাজে একটা পরিস্থিতিতে পরে বিয়ে করতে হয়েছে মুগ্ধকে। যার সম্পূর্ণ দোষ তিয়াসার। তাই সে তিয়াসাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চলে। তিয়াসা দু’হাতে মুখ ঢেকে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। তিয়াসা জানে সে অন্যায় করেছে কিন্তু সে তো নিরুপায় ছিলো। নিজে বাঁচতে গিয়ে নির্দোষ একজন মানুষকে তার পরিবারের কাছেও অপরাধী বানিয়ে দিয়েছে।
তিয়াসা কাঁদতে কাঁদতেই বললো, আমি কী করতাম আপনি বলুন ? আমি তো নিরুপায় ছিলাম, এতবার আপনার পা ধরে মাফ চেয়েছি তাও আপনি মুখ ফিরিয়ে আসেন আমার থেকে। কী করলে মাফ করবেন আমায় ? শুধু আপনাকে ছেড়ে যেতে বলবেন না, আমি সেটা কখনো পারবো না।
তিয়াসার কান্নাভেজা কথাগুলো চারদেয়ালের ভেতরেই আটকা পরে রইলো। মুগ্ধের কাছে যে কখনো পৌঁছাতে পারবে না তারা।
চলবে,,,,