গোধূলির_রাঙা_আলোয়,পর্ব-০৪,০৫

0
828

#গোধূলির_রাঙা_আলোয়,পর্ব-০৪,০৫
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-০৪

বাড়িটা খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। শুদ্ধ আর মুগ্ধর একমাত্র আদরের বোন মাইশা সাদিক মিশুর জন্মদিন বলে কথা। মিশু আজ ১৬ বছরে পা দিলো। বোনটা দু-ভাইয়ের খুব আদরের, তাই বেশ বড় করেই পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। সবাই অপেক্ষা করছে আজকের মধ্যমণির জন্য কিন্তু তার দেখা নেই এখনো।

আনোয়ারা বেগম তিয়াসাকে বললেন, বৌমা দেখো তো মেয়েটা এখনো উপরে কী করছে। সব গেস্ট এসে পরেছে তো। সবাই ওর কথা জানতে চাইছে।

তিয়াসা মুচকি হেঁসে বললো, তামান্না আর উৎসা ওর সাথেই আছে, চলে আসবে এখনই।

তিয়াসা আর আনোয়ারা বেগমের কথোপকথনের মধ্যেই মিশু সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলো একটা সাদা প্রিন্সেস গ্রাউন পরে। তার পেছনেই তামান্না আর উৎসা। তিনজনকেই অসম্ভব সুন্দর লাগছে। এদিকে শুদ্ধ আর মুগ্ধ গেস্টদের সাথে কথা বলছে। মুগ্ধর অফিসের অনেকেই এসেছে পার্টিতে, তারা তিয়াসার দিকে বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে আর কানাঘুঁষা করছে। সামান্য এমপ্লয়ি হিসাবে ঢোকে বসের বউ হয়ে গেছে। তিয়াসার কানে সবই যাচ্ছে কিন্তু মুখ বুজে সব সহ্য করছে৷ আর তো কিছুটা সময় তারপরই এসবের অবসান ঘটবে। উৎসা নিচ পর্যন্ত মিশুর সাথে এলেও নিচে এসে অন্যদিকে চলে গেলো। যতই হোক সে তো আর তাদের ফ্যামিলি মেম্বার নয় তাই কেক কাটার ওখানে না যাওয়াটাই বেটার। পার্পেল একটা গ্রাউন পরেছে উৎসা, ফর্সা গায়ে তা ফোটে উঠেছে। উৎসা আহামরি সুন্দরী না হলেও মন্দ নয় দেখতে। তামান্না উৎসাকে দেখে ইশারায় কাছে যেতে বললেও উৎসা যায় না। চুপচাপ এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকে। পরিবারের সবাই মিশুর সাথে দাঁড়ায় কেক কাটার সময়। তিয়াসা আর মুগ্ধ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে।

তিয়াসা মুগ্ধর কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, আজ জন্মদিন মিশুর তবে সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে আপনার জন্য।

মুগ্ধ প্রশ্নবোধক চাহনি দিলে তিয়াসা মুচকি হাঁসলো, যে হাসিতে ছিলো একরাশ বিষন্নতা আর রহস্য। কেক কাটা হলে মিশু একে একে সবাইকে খাইয়ে দেয়। এতক্ষণে শুদ্ধর মনে পরে উৎসার কথা। মেয়েটাকে আশেপাশে না দেখে খুঁজতে গিয়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। মিশুকে উৎসার কাছে পাঠায় কেক খাইয়ে দিতে। মেয়েটা কেমন চঞ্চল হয়েও গম্ভীর। খোলা বইয়ের মতো হলেও রহস্যে মোড়ানো। মেয়েটা তার থেকে বয়সে অনেক ছোট তবু তার মনে জন্ম দিয়েছে তাকে জানার কৌতূহল।

৪.
সবার খাওয়া দাওয়া হয়ে পার্টি শেষের দিকে কিন্তু মুগ্ধ তিয়াসাকে কোথাও দেখছে না। ভেতরটা কেমন খচখচ করছে তিয়াসার তখনকার বলা কথাটার মানে জানার জন্য। হঠাৎ তিয়াসার আওয়াজে পা থেমে গেলো মুগ্ধর। সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে সেই আওয়াজ।

অ্যাটেনশন প্লিজ

হঠাৎ সব আলো নিভে গিয়ে বড় পর্দায় ভেসে উঠলো তিয়াসার মলিন মুখটা। সবাই বেশ কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে পর্দার দিকে। মুগ্ধ ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সেদিকে।

পর্দার তিয়াসা মুচকি হেঁসে বললো, আপনাদের সবার মূল্যবান কিছু সময় নষ্ট করবো। তার জন্য আগেই ক্ষমা পেয়ে নিচ্ছি। আজ আমি আপনাদের একটা গল্প শোনাবো, আমার জীবনের গল্প। আপনাদের জানাটা প্রয়োজন।

বাবা-মায়ের আদরের বড় মেয়ে আমি। মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছি। ছোট থেকে স্বপ্ন ছিলো বড় হয়ে বাবার পাশে দাঁড়াবো একটা ছেলের মতো। সেই জন্য মন দিয়ে পড়াশোনা করেছি। ছোটবেলা থেকে চার ভাইবোনের সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হতো বাবাকে। তাই এসএসসি পরীক্ষার পর থেকে টিউশনি করতাম যাতে বাবার একটু হেল্প হয়। এভাবেই অনার্স শেষ করলাম আর চাকরির খোঁজে বেড়িয়ে পড়লাম। চাকরি, সে তো সোনার হরিণের মতো, আমার থেকে কত যোগ্যতা সম্পন্ন মানুষ সার্টিফিকেট নিয়ে মানুষের দাঁড়ে দাঁড়ে ঘুরছে। উপায় না পেয়ে এক বান্ধবীর কাছে হেল্প চাইলাম। সে নিরাশ করলো না, তার বাবার বন্ধুর অফিসে একটা ছোটখাটো চাকরির জোগাড় করে দিলো। জীবনের তেইশ বসন্ত পেড়িয়ে আসা মেয়েটার মনে কখনো কোনো পুরুষের জন্য ভালোলাগা কিংবা ভালোবাসা তৈরি হয়নি। তবে সেই নিয়ম ভেঙে মেয়েটা ভালোবেসে ফেলে এক হাসিখুশি পুরুষকে। হাজার ক্লান্তিতে তার মুখের হাসিটা যেনো হারাতে দিতো না। অফিসের পিয়ন থেকে শুরু করে বড় বড় পদস্থ সকলে তার চোখে ছিলো সমান। মনকে বুঝালাম সে তোমার জন্য আকাশের চাঁদ আর তুমি বামুন। সে ছিলো সেই অফিসের বস আর আমি সামান্য এমপ্লয়ি। কিন্তু মন তো বেহায়া, দিন কাটতে লাগলো লুকোচুরি ভালোবাসার খেলায়। কিন্তু হঠাৎ কালো ছায়ায় মতো জীবনে এলো এক নেশাখোর ছেলে। তার হাত থেকে বাঁচতেই মানুষটার নাম নিয়েছিলাম। কিন্তু আমার একটা ভুলে এতকিছু হয়ে যাবে বুঝতেই পারিনি। কিছু বুঝে উঠার আগেই তার ঘরের বউ হয়ে গেলাম। এতক্ষণে হয়তো সবাই বুঝে গেছেন আমি কার কথা বলছি। আপনারা ঠিক বুঝেছেন আমি মিস্টার আরমান সাদিক মুগ্ধর কথা বলছি। যাকে সবার চোখে আমি একদিন নিচে নামিয়ে দিয়েছিলাম অনিচ্ছা সত্ত্বেও। আজ সকলের কাছে সত্যিটা প্রকাশ করে তার গায়ে লাগা কালি মুছে দিলাম। সে নির্দোষ, নিষ্পাপ যা হয়েছে সব আমার জন্য। মা আপনাকে জানাতে চাই, আপনার ছেলে কোনো অন্যায় করেনি। আপনি যার মৃত্যুর জন্য তাকে দায়ী মনে করেন তার কোনো অস্তিত্ব ছিলো না এই পৃথিবীতে। পারলে আমাকে মাফ করে দিবেন। এই কথাগুলো সামনে দাঁড়িয়ে বলার সাহস আমার ছিলো না তাই এভাবে বলতে হলো। আপনাদের জীবনে যেমন ভেসে আসা মেঘের মতো এসেছিলাম আবার সেভাবেই চলে গেলাম। পারলে আমাকে মাফ করে দিবেন।

ভিডিও শেষ হতেই সব লাইট জ্বলে উঠলো। মুগ্ধ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সবার মাঝে। সবার দৃষ্টি এখন তার দিকেই। কিছুটা সময় লাগলো মুগ্ধর নিজেকে সামলে নিতে।

নিজের মাঝে ফিরতেই চিৎকার করে ডেকে উঠলো, তিয়াসা ?

সবাই কানাঘুঁষার করছে তিয়াসাকে নিয়ে। এদিকে মুগ্ধর মতো বাড়ির বাকি সবার একই অবস্থা। স্তব্ধ হয়ে নিজের জায়গায় জমে আছে। কেবল শুদ্ধ আর উৎসা স্বাভাবিক। উৎসা কিছুটা অবাক তবে শুদ্ধ একদমই স্বাভাবিক। উৎসার কাছে একটু গোলমেলে লাগলেও এতটা কল্পনা করেনি সে। তবে শুদ্ধ যেনো এমন কিছুই হবে মনে করেছিলো। মুগ্ধ দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেলো তিয়াসাকে খুঁজতে।

রুমের সামনে এসেই চিৎকার করে বললো, তিয়াসা এটা কী ধরণের ফাজলামো ? এসবের মানে কী ?

রুমে গিয়ে চুপ হয়ে গেলো মুগ্ধ। কারণ পুরো রুম ফাঁকা পরে আছে। মুগ্ধ একবার সারা রুমে চোখ বুলিয়ে নিলো। তিয়াসা আসার আগে তার রুমটা যেমন ছিলো ঠিক তেমন করে সাজিয়ে রাখা। দেখে মনেই হচ্ছে না এখানে একটা মেয়েও থাকতো। তিয়াসা আসার পর, না চাইতেও রুমের অনেক পরিবর্তন মেনে নিতে হয়েছিলো মুগ্ধর। তবে আজ সব আগের মতো, রুমের কোথাও তিয়াসার ব্যবহৃত একটা জিনিসও চোখে পরলো না তার। হঠাৎ একরাশ শূন্যতা ভড় করলো মুগ্ধর বুকে। মেয়েটা কী সত্যি চলে গেছে ? মুগ্ধ ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো রুমে। ধপ করে বেডে বসে পড়লো। অজানা ভয়ে সারা শরীর কাঁপছে তার। বেডে বসতেই সাইড টেবিলে কাঁচের গ্লাসের নিচে চাপা দেওয়া একটা ভাজ করা কাগজ আর একটা খাম দেখতে পেলো। কাঁপা হাতে সেটা তুলে নিলো মুগ্ধ। আগে ভাজ করা কাগজটা খোলে দেখলো তিয়াসার লেখা চিঠি।

প্রিয় মুগ্ধ
প্রিয় সম্মোধন করার কারণ আমি আপনার প্রিয় না হলেও আপনি সবসময় আমার প্রিয় ছিলেন আর থাকবেন। থাক সেসব কথা, আজকের দিনের অপেক্ষায় তো ছিলেন তাই না ? চাইলে আরো আগেই চলে আসতে পারতাম কিন্তু আপনাকে সবার কাছে নির্দোষ প্রমাণ করতে আজকের দিনের অপেক্ষায় ছিলাম। আমি আপনাকে সবার সামনে দোষী করেছিলাম, আমিই নির্দোষ করে গেলাম। পারলে মাফ করে দিয়েন, এতদিন আপনাকে বিরক্ত করার জন্য। আপনাকে ডিভোর্স দিতে পারবো না আমি। আমার জীবনের প্রথম আর শেষ পুরুষ আপনি। আপনার জীবন থেকে নিজেকে মুছে দিলেও নিজের জীবন থেকে আপনাকে মুছে দিতে পারবো না। আপনি যাতে আবার বিয়ে করে নিজের জীবন গুছিয়ে নিতে পারেন তাই দ্বিতীয় বিয়ের জন্য প্রথম স্ত্রীর অনুমতির প্রমাণ খামে আছে। যদিও আমি আপনার কাছে আপনার স্ত্রী কোনো কালেই ছিলাম না, এটা ফর্মালিটি মাত্র। ভয় পাবেন না, আর কখনো আপনার জীবনে আমার আগমন হবে না। আমার বাবা-মায়ের কাছে ক্ষমা চাইতে পারলাম না। আমি আপনাকে সবার কাছে নির্দোষ প্রমাণ করেছি, আপনি পারলে শুধু আমার বাবা-মায়ের ভুলটা ভাঙিয়ে দিয়েন। আর একটা কথা আজ না বললে হয়তো আর কোনোদিন বলার সুযোগ হবে না। অনেকটা ভালোবাসি আপনাকে , ভালো থাকবেন।

ইতি
আপনার না মানা বউ
তিয়াসা

মুগ্ধর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তীব্র ব্যাথা হচ্ছে বুকের পা পাশে। মিশুর জন্মদিনের পার্টি নিয়ে এতটা ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো তিয়াসার এসব চিন্তা ভাবনার আঁচ করতে পারেনি একটুও। তিয়াসার চিঠি পড়ে এটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, সে তার বাবা-মায়ের কাছে যায়নি। মুগ্ধ এবার খামটা খুলে তিয়াসার সাইন পরা দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতিপত্র পেলো। মুহূর্তে সেটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিলো।

এদিকে পরিস্থিতি বুঝতে পেরে শুদ্ধ গেস্টদের কোনোরকম সামলে নিলো। সবাই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে করতে বের হয় গেলো ধীরে ধীরে। আনোয়ারা বেগম তখনো নিজের বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সোফায় বসে আছে থম মেরে। তামান্না আর মিশুর অবস্থাও একই রকম। উৎসার রিয়াকশন বুঝার উপায় নেই। আগামীকাল তামান্না আর উৎসার হোস্টেলে উঠে যাওয়ার কথা ছিলো। কয়েকদিনে তিয়াসার সাথে উৎসারও বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিলো। বড় বোনের মতো উৎসাকে আদর করতো। আগামীকাল চলে যাবে বলে একটা ঘড়িও গিফট করেছে উৎসাকে। উৎসা বুঝতেই পারেনি সে যাওয়ার আগে তিয়াসাই এ বাড়ি থেকে চলে যাবে।

শুদ্ধ উৎসার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো, মাকে আর মিশুকে একটু সামলাতে পারবে ?

উৎসা অবাক চোখে তাকালো শুদ্ধের দিকে। শুদ্ধের কণ্ঠে ছিলো অসহায়ত্ব। সে কোনদিক সামলাবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। মুগ্ধর কাছে যাওয়া প্রয়োজন আর মায়ের কাছেও কারো থাকা জরুরি। মিশু আর তামান্না নিজেরাই হতবুদ্ধি হয়ে বসে আছে।

উৎসা ছোট করে বললো, হুম।

শুদ্ধ ধন্যবাদ বলে মুগ্ধর রুমের দিকে ছুঁটে গেলো। শুদ্ধর অজানা কারণে প্রচন্ড অশান্তি লাগছে। হয়তো জমজ হওয়ার জন্য মুগ্ধর বিষন্নতা কিছুটা আঁচ করতে পারছে। শুদ্ধ মুগ্ধর রুমে গিয়ে দেখে চিঠি হাতে ফ্লোরে বসে আছে মুগ্ধ আর চারপাশে পরে আছে ছোট ছোট কাগজের টুকরো।

শুদ্ধ এগিয়ে গিয়ে মুগ্ধর সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো আর কাঁধে হাত রেখে বললো, মুগ্ধ।

আমি এমন কিছু কল্পনাও করিনি ভাই।

মুগ্ধর কথা শুনে শুদ্ধ দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, আমি আগেই তোকে সাবধান করেছিলাম।

কোথায় খুঁজবো ওকে আমি এখন ?

শুদ্ধ এবার ফ্লোরে বসে পড়লো মুগ্ধর পাশে আর বললো, এতোটা যখন ভালোবাসিস তাহলে এতো অবহেলা কেনো করতে গিয়েছিলি।

রাগ ছিলো ওর উপর ৷ আমাকে দেখে সম্মানে যারা মাথা নিচু করতো, তারাই আমাকে দেখে কানাঘুঁষা শুরু করে ওর জন্য, তাই রাগ ছিলো।

এবার তো সবার কাছে সবটা পরিষ্কার হয়ে গেছে।

আমি ওর থেকে মুক্তি চাইনি কখনো।

মুগ্ধ হঠাৎ জড়িয়ে ধরলো শুদ্ধকে আর বাচ্চাদের মতো কাঁদতে লাগলো।

কান্নাভেজা গলায় বললো, ছোট ভাই হিসাবে কখনো কিছু চাইনি তোর কাছে। কয়েক মিনিটের বড় হলেও তুই আমার বড়। আজ তোর ছোট ভাই হিসাবে প্রথমবার কিছু চাইছি। প্লিজ ওকে ফিরিয়ে এনে দে। কথা দিচ্ছি একটুও কষ্ট দিবো না। ওকে ছাড়া দমবন্ধ হয়ে আসছে আমার।

মুগ্ধর এমন আকুতি শুদ্ধর হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। ভাইবোন দুটোকে প্রচন্ড ভালোবাসে শুদ্ধ, হয়তো নিজের অন্তর্মুখী স্বভাবের জন্য প্রকাশ করা হয়নি কখনো। কিন্তু তাদের জন্য নিজের জীবন দিতেও পিছপা হবে না।

শুদ্ধ মুগ্ধর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, তুই শান্ত হ একটু৷ পাতাল থেকে হলেও খোঁজে বের করবো তোর ভালোবাসা। এই প্রথম আমার ছোটভাই আমার থেকে কিছু চেয়েছে৷ সেটা আমি কীভাবে না দিয়ে পারি ?

চলবে,,,

#গোধূলির_রাঙা_আলোয়
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-০৫

তুই না থাকলে জানি না কোথায় যেতাম আমি।

এভাবে বলিস না তিয়াসা, তুই আমার একমাত্র বেস্টফেন্ড। তোর পাশে দাঁড়াতে পেরে নিজেরই ভালো লাগছে রে।

এখন একটা জবের ব্যবস্থা করতে হবে তাড়াতাড়ি।

তোর অভিজ্ঞতা আছে, পেয়ে যাবি প্রবলেম হবে না আর যতদিন না পাচ্ছিস আমি তো আছি।

তিয়াসা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালো তোরার দিকে। তোরা তিয়াসার বেস্টফেন্ড। সেদিন রাতে মুগ্ধর অপমান সহ্য করতে না পেরে তোরাকেই কল দিয়েছিলো তিয়াসা। একটা থাকার ব্যবস্থা করে দিতে বলেছিলো। তোরা মেয়েটা অনেকটা ছেলেদের স্বভাবের। নিজের ইচ্ছে মতো চলতে পছন্দ করে, বিভিন্ন জায়গায় ঘুরাঘুরি করা, আড্ডা দেওয়া, মারামারি করা এসবই পছন্দ তার। এজন্য তার মেয়ে বন্ধু নেই খুব একটা। তোরা তিয়াসাকে একদিন বাঁচিয়েছিল বখাটেদের থেকে। তারপর থেকেই তিয়াসার সাথে তোরার বন্ধুত্ব। পড়াশোনায় ফাঁকিবাজ হওয়ায় অনার্স শেষ করে উঠতে পারেনি এখনো। হোস্টেলে থাকা তার জন্য সম্ভব না তাই একটা ফ্ল্যাটে থাকে একাই। তিয়াসাকে নিয়ে সেখানেই যাচ্ছে।

তোরা হঠাৎ বললো, আমরা আগামীকাল সাজেক যাচ্ছি ট্যুরে, পাঁচদিনের ট্যুর।

তিয়াসা বললো, আমি কোথাও যাবো না রে।

তোর কাছে জানতে চাইনি যাবি কিনা। আমি তোর জন্য টাকা দিয়ে দিয়েছি এখন আর ফেরত নেওয়া যাবে না। আর আমি চলে গেলে একা থাকবি কী করে ? তাই কোনো কথা হবে না, তুইও যাচ্ছিস৷ তোর মনটাও একটু ভালো হবে। আমি দু’জনের জন্য মার্কেটও করে ফেলেছি।

তিয়াসা আর কিছু বললো না, চুপ করে তোরার কথা শুনলো। তোরা একবার যেহেতু বলেছে এখন আর হাজার বার না করলেও কাজ হবে না। একটু আগে তোরাই তাকে নিয়ে এসেছে মুগ্ধর বাড়ির সামনে থেকে। তিয়াসা নিজের জিনিসপত্র আগেই তোরার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলো। এখন তোরার বাইকের পেছনে বসে আছে তিয়াসা। মেয়েটা ভালো বাইক চালাতে পারে। মাঝে মাঝে শুধু বাইক নিয়েও ট্যুরে চলে যায়। তিয়াসা ভেবে পায় না একটা মেয়ের এতো সাহস হয় কী করে ? তিয়াসা হঠাৎ খেয়াল করলো তোরা বাসার রাস্তায় না গিয়ে অন্য রাস্তায় যাচ্ছে।

কী রে এদিকে কোথায় যাচ্ছিস ?

তোরা বললো, বাসায় রান্না করিনি কিছু আর তুইও কিছু খাওয়ার অফার করলি না। যতই হোক পার্টি ছিলো মুগ্ধ ভাইয়ের বাড়িতে। এখন দিকে একটা ভালো রেস্টুরেন্ট আছে, সেখানে যাবো ডিনার করতে।

তিয়াসা কিছু না বলে চুপ করে গেলো। মুগ্ধর কথা খুব মনে পরছে। হয়তো ঘন্টা খানিক হবে তাকে দেখেছিলো কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কতদিন হয়ে গেছে দেখে না। সারাজীবন না থেকে কীভাবে কাটাবে সেটা ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে।

তিয়াসা আনমনে বললো, একই শহরে থেকে পারবো তো নিজেকে তার থেকে দূরে রাখতে ?

নিজেকে করা এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই তিয়াসার।

তোরা আর তিয়াসা ডিনার করে বাসায় চলে গেলো। যদিও তিয়াসার গলা দিয়ে খাবার নামেনি। তোরা সেটা খেয়াল করেও বেশি কিছু বলেনি৷ বাসায় এসে তোরা তিয়াসাকে ওর রুম দেখিয়ে দিলো। ফ্ল্যাটে দুটো বেডরুমের সাথে এটাচ ওয়াশরুম, একটা ড্রয়িংরুম, একটা কিচেন আর একটা ছোট রুম আছে সেটা তোরা স্টোররুম হিসাবে ব্যবহার করে। তিয়াসা আগেও এখানে এসেছে তাই তাকে দেখানো রুমে চলে গেলো। জামাকাপড় নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢোকে গেলো আর শাওয়ার নিতে লাগলো। পানির সাথে চোখের নোনাজল মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। কান্নার কোনো শব্দ হচ্ছে না তবে চোখের ঝর্ণা বয়ে চলেছে অবিরাম।

কান্নাভেজা গলায় বললো, এবার আপনি খুশি তো মুগ্ধ ? একই শহরে থেকেও আজ আমি আপনার থেকে অনেক দূরে। আর কখনো আপনার সামনে যাবো না।

৫.
ভালোবাসা উপলব্ধি করার জন্য হলেও দুরত্ব প্রয়োজন। এই দেখো না, তুমি যখন আমার পাশে ছিলে বুঝতেই পারিনি এতোটা ভালোবাসি তোমাকে। আজ মাত্র দুদিন হলো তুমি আমার কাছে নেই কিন্তু মনে হচ্ছে যেনো কত যুগ পেরিয়ে গেছে তোমাকে দেখি না।

তিয়াসার ছবির দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছে মুগ্ধ। মেয়েটা কখনো জানতেই পারলো না অপর পাশের মানুষটাও তাকে এতোটা ভালোবাসে। সেই রাতে শুদ্ধ মুগ্ধকে নিয়ে শহরের প্রতিটা অলিগলি খুঁজেও তিয়াসার খোঁজ পায়নি৷ শহর থেকে বাইরে যাওয়ার বাস, ট্রেন, লঞ্চ এমনকি এয়ারপোর্টেও খোঁজ নিয়েছে। কোথাও পায়নি তাকে, মুগ্ধ ভেঙে পড়েছে একদম। আনোয়ারা বেগমের আদেশে মুগ্ধ তিয়াসাকে একটা ফোন কিনে দিয়েছিলো সেটাও রেখে গেছে, তাই ফোনেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে পারেনি। শুদ্ধ নিজের ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাল ছাড়েনি। মুগ্ধ যেমন হাসিখুশি তেমনি ইমোশনাল। একটুতেই অনেক ভেঙে পরে। শুদ্ধ সবদিক সামলানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। উৎসা শুদ্ধের এমন দ্বায়িত্বশীলতা দেখে বারবার তার প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। শুদ্ধর কথায় তামান্না আর উৎসা হোস্টেলে যায়নি। বাড়ির অবস্থা ভালো নয় তাই ওরাও থেকে গেছে।

শুদ্ধ নক না করেই মুগ্ধর রুমে ঢুকে পরলো মুগ্ধকে দেখে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, খাবি চল।

ক্ষিদে নেই।

মা বললো দুপুরেও কিছু খাসনি, অফিসেও যাচ্ছিস না দুদিন ধরে।

ভালো লাগছে না কিছু।

আমি তো বলেছি তিয়াসাকে খোঁজে দিবো, আমাকে একটু সময় দে।

দুদিন কেটে গেছে এখনো কিছুই জানতে পারিসনি তুই।

নিজের ইচ্ছেতে যে হারিয়ে যায় তাকে খোঁজ পাওয়া সহজ নয় মুগ্ধ। তবু আমি যখন কথা দিয়েছি সেই কথা আমি যেভাবেই হোক রাখবো।

মুগ্ধ কিছু না বলে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো শুদ্ধর দিকে। মুগ্ধ ঠিক যতটা ইমোশনাল শুদ্ধ ঠিক ততটাই শক্ত মনের মানুষ। সে একা হাতে পরিবারটা সামলে রেখেছে এই অবস্থায়। মিশু আর আনোয়ারা বেগম তিয়াসাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছিলো তাই তারাও ভেঙে পরেছে, আনোয়ারা বেগম একটু বেশি। ছেলেমেয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকে বৌমাকে পেয়ে তার একাকিত্ব দূর হয়েছিলো। বড্ড নির্ভরশীল হয়ে পরেছিলো মেয়েটার উপর। তার কখন কী চাই সেটা না বলতেই বুঝে যেত মেয়েটা।

আনোয়ারা বেগম গম্ভীর মুখে বসে আছে ডিনার টেবিলে শুদ্ধ এক প্রকার জোর করেই মুদ্ধকে সাথে নিয়ে এলো। কাজের লোকের রান্না খেতে পছন্দ করে না এ পরিবারের কেউ, তাই আজকের রান্না উৎসা করেছে। উৎসা আর তামান্না মিলে খাবার সাজিয়ে নিচ্ছিলো তখনই শুদ্ধ মুগ্ধকে নিয়ে টেবিলে এলো। উৎসা বেশ অবাক হলো কারণ দুপুরে সবাই অনেক চেষ্টা করেও মুগ্ধকে খাওয়াতে পারেনি। দুই ভাইয়ের ভালোবাসা দেখে আবারও মুগ্ধ হলো উৎসা। এমন একটা পরিবারের স্বপ্ন দেখতো সবসময় কিন্তু তার ভাগ্যে সেটা মেলেনি।

আনমনে খাবার মুখে দিয়ে হঠাৎ আনোয়ারা বেগম বলে উঠলো, বৌমা তুমি জানো না আমি বেশি মসলার খাবার খাই না।

সবাই কেবল খাওয়া শুরু করেছিলো আনোয়ারা বেগমের কথায় সবাই থম মেরে গেলো। এদিকে উৎসা অস্বস্তিতে পরে গেলো।

আমতা আমতা করে বললো, আসলে আন্টি আমি জানতাম না আপনার কী পছন্দ।

আনোয়ারা বেগমের হুঁশ ফিরলো এবার। টলমলে চোখে তাকালো উৎসার দিকে।

ভেজা গলায় বললো, মেয়েটা যদি চলেই যাবে তবে এতো বদঅভ্যেস কেনো বানিয়ে দিয়ে গেলো, এতো মায়ায় কেনো জড়িয়ে দিয়ে গেলো ?

মুগ্ধ মাথা নিচু করে বললো, সব আমার জন্য হয়েছে মা। সবকিছুর জন্য আমি দ্বায়ী। বুঝতে পারিনি এভাবে চলে যাবে।

আনোয়ারা বেগম তাকালেন ছেলের দিকে। দুদিনে কী হাল হয়েছে চেহারার।

তুই কী সত্যি ভালোবাসতি না তিয়াসাকে ?

বাসতাম।

আনোয়ারা বেগম এবার অবাক হয়ে বললো, তাহলে এসবের মানে কী ?

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here