#গোধূলির_রাঙা_আলোয়,পর্ব-১২
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
গাড়ি থেকে নেমে উৎসার বেলকনির দিকে একবার তাকালো শুদ্ধ, কিন্তু উৎসা শুদ্ধর তাকানো দেখে একটু পিছিয়ে নিজেকে অন্ধকারে আড়াল করার চেষ্টা করলো। তবু শুদ্ধর চোখেই ঠিকই ধরা পড়লো, বাগানের আলো বেলকনিতে পড়ায়। শুদ্ধ ভেতরে চলে গেলো, ঘন্টা তিনেক পার হতেই তামান্না রুমে এলো। এসে উৎসাকে না দেখে চিন্তিত গলায় ডাকতে লাগলো।
উৎসা ?
আমি বেলকনিতে, তুই ঘুমিয়ে পড় আমি একটু পর ঘুমাবো।
তামান্না বেলকনিতে গিয়ে উৎসার পাশে দাঁড়িয়ে বললো, অসুস্থ শরীর নিয়ে তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো ? ঘুমিয়ে পড় গিয়ে।
উৎসা গম্ভীর গলায় বললো, আমি এখানে একটু একা থাকতে চাই তামান্না।
তামান্না কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। উৎসা তাকে কী বলে ডাকলো ভাবতে লাগলো, তামান্না ? উৎসা সবসময় তাকে তাম্বু বলে ডাকে তাই কত ঝগড়া করেছে তার সাথে। তবে আজ কেনো তার মুখে তামান্না ডাক শুনে বুক কেঁপে উঠলো তামান্নার।
তামান্না অবাক কণ্ঠে বললো, তামান্না ?
উৎসা আবারও গম্ভীর গলায় বললো, আমি একা থাকতে চাইছি তামান্না।
তামান্না আর কিছু না বলে রুমে চলে গেলো। উৎসার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো এক ফোটা রহস্য জল।
অনুষ্ঠান শেষে রুমে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো শুদ্ধ। বাহির থেকে এসে ফ্রেশ না হয়ে কখনো বেডে যায় না শুদ্ধ। তবে আজ নিয়ম ভেঙে ফেললো। বড্ড ক্লান্ত লাগছে শুদ্ধর, শারীরিক নয় মানসিক ক্লান্তি। শারীরিক ক্লান্তি তো ঘুমিয়ে দূর করা যায়। শুদ্ধ এই মানসিক ক্লান্তি দূর করবে কীভাবে ? এই মানসিক ক্লান্তি তার ঘুমও কেড়ে নিয়েছে। আজ বাধ্য হয়ে এনগেজমেন্ট করেছে শুদ্ধ। অনেক ভেবেও আর কোনো পথ খোলা পায়নি। এরিশার সাথেও তার তেমন পরিচয় নেই, যে হুট করে তাকে কিছু বলবে। এরিশাকে বলে যদি হিতে বিপরীত হয়ে যায়। দেখা গেলো এরিশা আনোয়ারা বেগমকে সব বলে দিলো। তখন ব্যাপারটা সহজ হওয়ার বদলে আরো জটিল হয়ে যাবে। শুদ্ধ চিন্তা করেছে এক মাস সময় আছে হাতে। এর মধ্যে এরিশাকে কোনোভাবে বুঝিয়ে বলতে হবে তাকে। এখন একমাত্র ভরসা এরিশা। একমাত্র সেই পারবে এই সমস্যার সমাধান করতে। এরিশা বিয়েটা ভেঙে দিলে আনোয়ারা বেগমের মনও রক্ষা হবে আবার বিয়েটাও ভাঙবে। তারপর নাহয় সময় বুঝে উৎসার কথা জানানো যাবে। যদিও আনোয়ারা বেগমের উৎসাকে মেনে নেওয়ার চান্স খুবই কম। কারণ আনোয়ারা বেগম কখনোই তার ছেলের জন্য একটা ভাঙা পরিবারের মেয়েকে মেনে নিবে না। তার মতে পরিবার ছাড়া বড় হওয়া ছেলেমেয়েরা পরিবারের অর্থ বুঝে না। এমন মেয়ের সাথে বিয়ে হলে তার ছেলেকে তার থেকে কেড়ে নিবে ঐ মেয়ে।
অনেকটা সময় পর শুদ্ধ দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে উঠে বসলো। কিছুটা সময় মাথা নিচু করে বেডে বসে থেকে ওয়াশরুমে গিয়ে লম্বা টাইম শাওয়ার নিয়ে বের হলো, ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো রাত দেড়টা বাজে। এতো সময় কখন পার হলো বুঝতেই পারেনি। ধূসর রঙের টাউজারের সাথে একটা কালো রঙের টিশার্ট গায়ে জড়িয়েছে শুদ্ধ। টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো।
কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে পাশের বেলকনিতে তাকালো উৎসা। শুদ্ধকে দেখে বুকের ভেতরটা জ্বলে উঠলো আবার। বাম হাতে টাওয়েল নিয়ে চুল মুছতে ব্যস্ত সে, বাগানের লাইটের আলোয় বাম হাতের অনামিকা আঙুলের ডায়মন্ডের রিংটা জ্বলজ্বল করছে। চোখ ভড়ে উঠলো উৎসার।
চোখে নোনাজল নিয়ে ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটিয়ে তুললো, কংগ্রাচুলেশন ডাক্তার সাহেব।
চমকে উঠলো শুদ্ধ, দ্রুত পাশ ফিরে তাকালো। উৎসাকে দেখে স্বাভাবিকের থেকেও অবাক হলো। এতো রাত পর্যন্ত উৎসা এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে কল্পনাও করেনি সে।
চকিত গলায় বললো, এতো রাতে তুমি এখনো বেলকনিতে কী করছো ?
উৎসা সামনে তাকিয়ে বললো, কেনো জানি মনে হচ্ছিল আপনি আসবেন বেলকনিতে। আপনাকে কংগ্রাচুলেশন না জানিয়ে শান্তি পাচ্ছিলাম না। আমার ধারণা সত্যি করে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর আপনি আমার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে বেলকনিতে চলেই এলেন।
শুদ্ধ কিছু না বলে চুপ করে গেলো। তার কী বলা উচিত সে বুঝতে পারছে না। মেয়েটা এতো সময় ধরে তার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। হাতের টাওয়েল বেলকনিতে টাঙানো দড়িতে রাখলো। কিছুটা সময় নিরবতায় কেটে গেলো।
উৎসা আবার বললো, দুঃখীত আপনার এতো গুরুত্বপূর্ণ একটা দিনে আমি যেতে পারলাম না। দেখুন না এই অসুস্থতা আসার আর সময় পেলো না।
শুদ্ধ ভাবতে লাগলো উৎসা নিচে না গিয়ে ভালো করেছে। সে কখনোই উৎসার উপস্থিতিতে অন্য একটা মেয়ের হাতে আংটি পড়াতে পারতো না। তখন বিষয়টা সামলানোর আগেই আরো বিগড়ে যেতো। হঠাৎ শুদ্ধর খেয়াল হলো উৎসা কী বললো, অসুস্থতা ?
অস্থির গলায় বললো, কী হয়েছে তোমার ?
শুদ্ধর অস্থির গলা শুনে তার দিকে তাকালো উৎসা আর তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, আমার অসুস্থতা নিয়ে আপনার এতো অস্থিরতা মানায় না।
শুদ্ধ দাঁতে দাঁত চেপে বললো, হেয়ালি না করে কী হয়েছে সেটা বলো।
উৎসা মুচকি হেসে বললো, আমার কই মাছের জান ডাক্তার সাহেব। জন্মের পূর্বেই আমার আগমনের বার্তা পেয়ে আমার মা আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু মারতে পারেনি। আমার জন্য তাকে আরো পাঁচটা বছর আমার বাবার সংসার করতে হয়েছে, আমার প্রতি সেই ক্ষোভ এখনো আছে আমার মায়ের। তাই এতো সহজে আমার কিছু হবে না। সামান্য একটু জ্বর, ঠান্ডা হয়েছে। তবে এই পৃথিবীতে তো কারো প্রিয় হতে পারলাম না, যদি আল্লাহ তাআলা দয়া করে তার প্রিয় করতে চায় তাহলে আলহামদুলিল্লাহ আমি কবুল করলাম।
শুদ্ধ রেগে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, আজেবাজে কথা বলবে না উৎসা।
আবার তাচ্ছিল্যের সুরে হাসলো উৎসা আর বললো, কেনো কারো প্রিয় হয়েছিলাম বুঝি কখনো ?
শুদ্ধ তাকিয়ে রইলো উৎসার দিকে। এই মুখটা তার চোখের আড়াল হবে সেটা ভাবতেও পারে না শুদ্ধ। প্রতিরাতে মুচকি হাসিমাখা মুখটা দেখে ঘুমাতে যাওয়া যে তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে এখন। এই মুখটা যে রাতে না দেখে, সে রাতে শুদ্ধ ঘুমাতে পারে না। বিশ্লেষণ করে এটাও বের করেছে সে। এই অশ্রুসিক্ত চোখে বড্ড বেমানান এই মুখটা, এই মুখে কেবল মুচকি হাসি মানায়।
উৎসা হঠাৎ করুন গলায় বললো, আপনি এমনটা কেনো করলেন ডাক্তার সাহেব ?
শুদ্ধ বুঝেও না বুঝার ভান করে বললো, কী করেছি ?
উৎসা এবার খানিকটা রাগ নিয়েই বললো, এতোটা অবুঝ তো নন আপনি। কয়েক কদম দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার ভালোবাসা দুই বছরেও বুঝতে পারবে না।
শুদ্ধ ভাবলেশহীন ভাবে বললো, আমি তো তোমাকে ভালোবাসতে বলিনি কখনো।
উৎসা দৃষ্টি সরিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, ভুলটা সত্যি আমারই। কিন্তু কী বলুন তো, জীবনের গত বাইশ বছরে কখনো কারো থেকে একটু কেয়ার, একটু শাসন, একটু সময় পাইনি। তাই আপনি ভালো মনে মানবতার খাতিরে আমার জন্য এগুলো করলেও, আমার লোভী মনটা সেসব ভালোবাসা মনে করে ফেলেছিলো। তাই তো আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছে। তবে চিন্তা করবেন না আমার হারানোর অভিজ্ঞতা আছে, হেরে যাওয়ার অভিজ্ঞতাও আছে। তবে দয়া করে আর কখনো মানবতা দেখাতে আসবেন না আমাকে।
শুদ্ধ এবার বুঝতে পারলো, না চাইতেও কতটা আঘাত করে ফেলেছে উৎসাকে। ভাঙা মনটা আবার ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। কিন্তু এরিশার সাথে কথা না বলে এই মুহূর্তে উৎসাকে কোনো আশাও দিতে পারছে না। আবার কথা দিয়ে রাখতে না পারলে আরো কষ্ট পাবে মেয়েটা। শুদ্ধ জানে না কী হবে। তবে যাই হোক শুদ্ধ আর কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারবে না। মুচকি হাসিমাখা মুখের ছবিটা হৃদয়ে আঁকা হয়েছে খুব সযত্নে, সেখানে আর কারো ছবি ঠাঁই পাবে না কোনোদিন।
উৎসা হঠাৎ অসহায় গলায় বললো, আচ্ছা আপনি কী কখনো আমাকে একটুও ভালোবাসেননি ? আপনার ঐ চোখ কী তবে মিথ্যা বলেছিলো আমাকে ? ডাক্তার সাহেব ভালোবাসা কী শুধু মুখে বললেই হয় ?
শুদ্ধ চোখ নামিয়ে বললো, তুমি অসুস্থ আর অনেক রাত হয়ে গেছে। এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে ঘুমিয়ে পড়ো গিয়ে।
শুদ্ধ রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে উৎসা পেছন থেকে বললো, পালিয়ে যাচ্ছেন ?
শুদ্ধ থমকে দাঁড়ালো তবে মুখে কিছু বললো না, পিছনে ফিরে তাকালোও না।
আপনাকে মুখ লুকিয়ে পালাতে হবে না ডাক্তার সাহেব। আমিই চলে যাবো আপনার চোখের আড়ালে। এমন কোথাও যেখান থেকে চাইলেও আপনি খোঁজে বের করতে পারবেন না। আরে ভুলে গেছিলাম আপনি খুঁজতে চাইবেনই বা কেনো ? আমিও না বোকার মতো কথা বলছি তখন থেকে।
শুদ্ধর বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। এভাবে কেনো বললো মেয়েটা ? তার যে ভয় হচ্ছে, হারানোর ভয়।
চলবে,,,,