#গোধূলির_রাঙা_আলোয়,পর্ব-১৩
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
কথায় বলে গণনার দিন খুব তাড়াতাড়ি কেটে যায়। দেখতে দেখতে কখন এক মাস কেটে গেলো কেউ বুঝতেই পারলো না। উৎসার অসুস্থতা কমার পরিবর্তে দিনদিন বেড়ে চলেছে। এবার তামান্নাও সন্দেহ করতে শুরু করেছে। তবু ধরে বেঁধেও উৎসাকে হসপিটালে নেওয়ায় যায়নি। চেষ্টা করতে করতে তামান্নাও একসময় হাল ছেড়ে দিয়েছে। একটাই আশা এখন উৎসা নিজের ইচ্ছেতে হসপিটালে যাবে। বাড়িতে মেহমানে গিজগিজ করছে দেখে উৎসার অস্বস্তি বাড়ছে, আর কষ্টের কথা নাই বা বললাম। এই এক মাসে অবশ্য একটা পরিবর্তন দেখা গেছে। সেদিনের পর শুদ্ধকে আর বেলকনিতে দেখা যায়নি৷ তবে উৎসা প্রতিদিনই বেলকনিতে গিয়ে দাড়িয়েছে। গতকাল শুদ্ধর হলুদের অনুষ্ঠান হওয়ার কথা থাকলেও শুদ্ধ ওসব করতে রাজি হয়নি। তবে বিয়েটা ঠিকই করছে, তাচ্ছিল্যের সুরে হাসলো উৎসা। অনেক দেখে ফেলেছে আর পারছে না। ভেবেছিলো শুদ্ধর বিয়ে নিজের চোখের সামনে দেখবে। তবে মন আর শরীর কোনোটাই সায় দিচ্ছে না। তামান্না নিচে আছে সেই সুযোগে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলো উৎসা। দূর্বল শরীরে লাগেজ গুছিয়ে হাঁপিয়ে উঠলো। দুপুর পেড়িয়ে যেতে শুরু করেছে সবাই ব্যস্ত বরযাত্রী বের হওয়া নিয়ে। বেডে বসে একটা চিরকুট লিখলো উৎসা।
গোধূলির রাঙা আলোয় প্রথম দেখেছিলাম আপনাকে। অষ্টাদশীর মনের প্রথম মুগ্ধতা, ভালোলাগা। এটাই হয়তো আমার জীবনের চরম ভুল ছিলো। সময়ের সাথে ভুলে গিয়েছিলাম চাইলেই সবাই সবকিছু পায় না ডাক্তার সাহেব। আপনার উপর আমার কোনো অভিযোগ নেই, কারণ দোষটা আমার বেশি ছিলো। নতুন জীবনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা, ভালো থাকবেন ডাক্তার সাহেব। আপনার নতুন জীবনে আমার ছায়া আর পড়বে না।
চিরকুটটা রুল করে মুড়িয়ে নিলো উৎসা। শুদ্ধর দেওয়া রেশমি চুড়ির সাথে শুদ্ধর বেলকনিতে সুতো দিয়ে বেঁধে দিলো। নীল রঙা চুড়ি গুলোর দিকে একবার তাকালো উৎসা। গতবছরের বসন্ত উৎসবে শুদ্ধ চুড়িগুলো কিনে দিয়েছিলো তাকে৷ শুধু তাকে দিলে সবাই অন্যকিছু ভাববে দেখে তামান্না আর মিশুকেও কিনে দিয়েছিলো। আলতো হাতে চুড়ি গুলো ছুঁয়ে দিতেই রিনঝিন শব্দ করে উঠলো। চুড়ির আওয়াজে হলেও শুদ্ধর চোখে ঠিক পড়বে চিরকুটটা। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে রুমে ফিরে এলো উৎসা, তখনই রুমে এলো তামান্না।
উৎসা অবাক হয়ে বললো, কী রে তুই যাসনি বর যাত্রীর সাথে ?
তামান্না বললো, তোকে অসুস্থ অবস্থায় একা বাসায় রেখে আমি কোথাও যাচ্ছি না।
বাড়িতে যেসব মেহমান এসেছে সবাই বরযাত্রীর সাথে যাওয়ার জন্যই এসেছে। তাই কাজের লোকগুলো আর দু’একজন বাড়ির লোক ছাড়া বাকি সবাই যাবে। তাদের ম্যানেজ করে বের হওয়া উৎসার জন্য কঠিন ছিলো না। কিন্তু তামান্নাকে কীভাবে ফাঁকি দিবে ? এদিকে ঠিক সময়ে না গেলে ট্রেন মিস হয়ে যাবে। উৎসা কিছু বলার আগেই তামান্না উৎসার লাগেজ খেয়াল করলো।
অবাক গলায় বললো, এসব কী ?
উৎসা বেশ সহজ গলায় বললো, আমি চট্রগ্রাম ফিরে যাচ্ছি। বিকেল ৪ঃ৩০ মিনিটের ট্রেন, রাত ১০টার মধ্যে পৌঁছে যাবো ইনশাআল্লাহ।
কিছুটা সময় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো তামান্না।
কাঁপা গলায় বললো, আমি তোর এতটাই পর হয়ে গেছি ?একবার আমাকে বলাও গেলো না ?
তামান্না ভেজা চোখে তাকালো উৎসার দিকে। সে দৃষ্টি অনুতপ্ত করলো উৎসাকে।
উৎসা অসহায় গলায় বললো, আমি চাইনি আমার জন্য তোর আনন্দ নষ্ট হোক। তুই তোর ভাইয়ার এতো আনন্দের দিনটা মিস করিস। ভেবেছিলাম ট্রেনে উঠে তোকে জানিয়ে দিবো।
তামান্না চোখের পানি মুছে নিজের লাগেজ নিয়ে জামাকাপড় গোছাতে গোছাতে শক্ত গলায় বললো, শুদ্ধ ভাইয়া আমার খালাতো ভাই হলেও তার থেকে তুই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে।
উৎসা অবাক হয়ে বললো, তুই কী করছিস এসব ?
তামান্না বললো, এই শহরে এসেছি তোর সাথে, থাকার হলেও তোর সাথে থাকব আর চলে যাওয়ার হলেও তোর সাথেই যাবো। উৎসা তুই হয়তো কোনোদিনই বুঝতে পারবি না তুই আমার কাছে ঠিক কী।
উৎসা তামান্নাকে জড়িয়ে ধরে বললো, সরি।
তামান্না লাগেজ আঁটকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো, এবার চল দেরি করলে ট্রেন মিস হবে।
সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হওয়ায় কেউ ওদের নিয়ে মাথা ঘামালো না। আনোয়ারা বেগম নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ছেলের বিয়ে দিবে, সেও চলে গেছে। তাই আর কেউ থাকেনি ওদের কিছু জিজ্ঞেস করার।
তামান্না দারোয়ানকে বললো, কাকা আমাদের কেউ খুঁজলে বলবেন উৎসার মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেছে তাই আমরা চট্রগ্রাম চলে গেছি।
উৎসা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তামান্নার দিকে। দারোয়ানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়লো দু’জনে। এবার উৎসার বুক ফেটে কান্না আসছে আর কখনো আসা হবে না এই শহরে। দেখা হবে না প্রিয় মুখটা, পূরণ হবে না স্বপ্নটা, মধ্যরাত পর্যন্ত কারো সাথে কফি খাওয়া হবে না। বাঁধ ভাঙা পানির মতো চোখের পানি টপটপ করে পড়তে লাগলো উৎসার।
অতীত থেকে বেড়িয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো তামান্না। ততক্ষণে গোধূলির আলো মিলিয়ে গিয়ে প্রকৃতি ডুবে গেছে ঘন কালো অন্ধকারে। ট্রেন চলতে চলতে অনেকটা পথ পেছনে ফেলে এসেছে তারা। মেয়েটা এতদিনের আঁটকে রাখা কান্না সবটা যেনো উজাড় করে দিয়েছে আজ। কাঁদতে কাঁদতে একসময় নিস্তেজ হয়ে গেছে উৎসা। তামান্না ভাবলো হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে, কত রাত মেয়েটা না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে তার হয়তো হিসাব নেই। তামান্না উৎসাকে সীটে শুইয়ে দিলো ভালো করে।
১৭.
বরযাত্রীর সব গাড়ি কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছে গেলেও বরের গাড়ি পৌঁছাল না অনেক সময় অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরও। আনোয়ারা বেগমকে চিন্তিত দেখালো খুব। ছেলেটা জেদ ধরে নিজের গাড়ি নিজেই ড্রাইভ করে বের হয়েছে বাড়ি থেকে, সবার হাজার বাঁধা উপেক্ষা করে সাথেও কাউকে নেয়নি। তখন থেকে আনোয়ারা বেগম আতংকে আছেন। সময় বাড়ার সাথে সাথে বিয়ের অনুষ্ঠানের কোলাহল বাড়তে লাগল। কনে সাজে বসে থাকা এরিশা ভাবতে লাগলো এনগেজমেন্টের কিছুদিন পরের কথা। জরুরি তলবে শুদ্ধ তাকে একটা কফিশপে ডেকে পাঠিয়েছিলো। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে অনেকটা নিরব সময় পার করে দুজনে।
শুদ্ধ হঠাৎ বললো, তুমি আমার ছোট তাই তুমি করেই বলছি। তোমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্য এখানে ডেকেছি।
এরিশা বললো, কী কথা ?
শুদ্ধ বললো, বিয়েটা আমি করতে পারবো না।
এরিশা চকিত গলায় বললো, মানে ?
শুদ্ধর সোজাসাপ্টা উত্তর, আমি একজনকে ভালোবাসি। তোমার স্বামী তোমাকে ভালো না বেসে সারাজীবন অন্য একজনকে ভালোবাসবে সেটা তুমি মেনে নিতে পারবে কিনা আমি জানি না। তবে আমি পারবো না উৎসার জায়গায় অন্যকাউকে সহ্য করতে। আমি বিয়েটা ভাঙতে পারছি না মায়ের জন্য তাই তোমার কাছে হেল্প চাইছি।
এরিশা মৃদু হাসলো তবে কিছু বললো না আর তা দেখে শুদ্ধ কঠিন গলায় বললো, তুমি সাহায্য করলে ভালো নাহলে আমাকে অন্য উপায় খুঁজতে হবে। বিয়েটা আমি কিছুতেই করতে পারবো না।
এরিশা হাসিটা বজায় রেখে বললো, আমি আপনাকে কী সাহায্য করবো বলুন, আমি নিজেও আপনার মতো একই পরিস্থিতির স্বীকার।
শুদ্ধ অবাক হয়ে বললো, মানে ?
এরিশা মাথা নিচু করে বললো, এরিক আমার ব্যাচমেট। দু’বছরের সম্পর্ক আমাদের। বাংলাদেশে আসার উদ্দেশ্য আমাকে জানানো হয়নি। এখানে এসে সব জানার পর কী করবো বুঝতেই পারছি না, সব এতো তাড়াতাড়ি হচ্ছে। আমার বাবা হার্টের পেশেন্ট, এবার আমার অবস্থাটা বুঝুন।
শুদ্ধ এবার যেনো চোখে অন্ধকার দেখলো। যার কাছে সাহায্য চাইছে সে নিজেই ওর থেকেও খারাপ পরিস্থিতিতে পরে আছে।
শুদ্ধ কিছুটা সময় নিরব থেকে এরিকের নাম্বার নিয়ে চলে যায়। তারপর আর এরিশার সাথে কথা হয়নি শুদ্ধর। এদিকে এরিশা বিদেশে পড়াশোনা করলেও পরিবারের চাপে থেকেছে সবসময়, এমনিতেই সহজসরল স্বভাবের। এতদিন কান্না করা ছাড়া কিছুই হয়নি তার দ্বারা। এই যে এখনো একটু পর পর চোখ মুছে যাচ্ছে।
চিন্তা ভাবনার মাঝেই আনোয়ারা বেগমের ফোন বেজে উঠলো শুদ্ধ নাম্বার দেখে তাড়াতাড়ি রিসিভ করলো, কোথায় তুমি শুদ্ধ ?
শুদ্ধ মায়ের কথা উপেক্ষা করে বললো, আমার জীবনের বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত তুমি নিয়েছো মা। সেসব নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই, তুমি সবসময় আমার ভালোই চেয়েছো। তবে এবার আমার ভালো করতে গিয়ে চারটা জীবন নষ্ট করে দিচ্ছিলে তুমি। সেটা আটকাতেই জীবনের প্রথম আর শেষবারের মতো তোমার অবাধ্য হলাম। পারলে মাফ করে দিও তোমার অপরাধী ছেলেকে। এরিশা যে ছেলেকে ভালোবাসে তাকে আমি গেইটে নামিয়ে দিয়ে এসেছি, আন্টিকে বলো ছেলেটাকে মেনে নিয়ে এরিশার সাথে বিয়েটা দিয়ে দিতে। বিয়ে মিটে গেলে বাড়ি ফিরে এসো। তোমার পুত্রবধূ বাড়িতেই এসেই পেয়ে যাবে।
আনোয়ারা বেগম স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কিছু বলার মতোও খোজে পেলেন না। মায়ের নজর এড়ানো এত সহজ নয়। আনোয়ারা বেগমের বুঝতে সময় লাগলো না শুদ্ধ পুত্রবধূ বলতে কাকে বুঝিয়েছে। এতদিন মিথ্যা সন্দেহ মনে করে গুরুত্ব দেয়নি। সন্দেহটা এভাবে সত্যি হয়ে যাবে ভাবেনি।
অনেক ঝামেলা করে অবশেষে এরিককে মেনে নিয়ে এরিশার সাথে বিয়ে দেওয়া হলো। এদিকে শুদ্ধ বাসায় গিয়ে সোজা উৎসার রুমে গেলো আর কষ্ট পেতে দিবে না মেয়েটা।
“আজন্মকাল কষ্ট যার সঙ্গী, সে কী পাবে এতো সহজে কষ্ট থেকে মুক্তি।”
শুদ্ধ রুমে উৎসাকে না পেয়ে ভাবলো বেলকনিতে আছে। বেলকনিতেও যখন পেল না তখন ভয় করতে লাগলো। ফিরে আসতে যাবে তখনই রেশমি চুড়ির আওয়াজ কানে এলো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকলো রেলিঙের দিকে। মোটা সুতো ছিঁড়ে কাগজ আর চুড়ি গুলো হাতে নিলো। কাঁপা হাতে কাগজটা খুলে পড়তে লাগলো।
স্টেশনে ট্রেন থামতেই তামান্নার ঘুম ভাঙলো। বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলো মনে নেই। উৎসাকে ডাকতে তার দিকে ফিরে ভয়ে আঁতকে উঠলো তামান্না। নাকমুখ রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে। কিছু সময়ের জন্য তামান্না হতবিহ্বল হয়ে বসে রইলো, তার কী করা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না।
কাঁপা হাতে উৎসার গালে থাপ্পড় দিয়ে ভেঙে ভেঙে বললো, উৎসা আমার ভয় করছে চোখ খোল প্লিজ।
তামান্না উৎসাকে সীটে সোজা করে বসিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে চোখে মুখে ছিটিয়ে দিলো তবু উৎসা চোখ খুলছে না। তামান্না নিজের ওড়না দিয়ে রক্তে মাখামাখি উৎসার মুখ মুছিয়ে দিলো। মুছে দিয়ে কাজ হলো না, তখনো নাক দিয়ে রক্ত আসছে। ভয় আর আতংকে কান্না করে দিলো তামান্না। ওরা একটা কেবিন বুক করেছে। সেখানে কেবল উৎসা আর তামান্না ছাড়া কেউ নেই। উপায় না পেয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো সাহায্যের আশায়।
একটু এগিয়ে যেতেই কারো সাথে ধাক্কা খেলো। মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, প্লিজ হেল্প মি, প্লিজ।
তামান্না হাতজোড় করে কান্না করে দিলো। সামনের ছেলেটা হতবুদ্ধি হয়ে গেলো হঠাৎ এমন পরিস্থিতিতে পরে।
নিজেকে সামলে বললো, কী হয়েছে ?
তামান্না কিছু না ভেবেই ছেলেটার হাত ধরে টেনে ওদের কেবিনে নিয়ে গেলো। উৎসাকে দেখে ছেলেটা আসল কাহিনি বুঝতে পারলো। ছেলেটা দ্রুত পকেট থেকে ফোন বের করে এম্বুলেন্সের জন্য কল দিলো।
চলবে,,,,,