#গোধূলী_শেষে_তুমি_আমি,০২,০৩
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ২
আপনি,আপনি এখানে কি করছেন? দরজার সামনে অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখে রজনী যেন আকাশ থেকে পরার মতো অবাক হলো। সাথে অবাক হলো পল্লবও। দু’জনার অবস্থা বেহাল। একজন ভয়ে সিটিয়ে আছে! অন্যজন রাগে ফেটে পড়ছে। তাইতো ভয়ে রজনী কথাটা বলে উঠেছে। আর রজনীকে অবাক করে দিয়ে পল্লব চিৎকার করে বললো।
_ আমি কী করছি মানে কি? যদি এই একি প্রশ্নটা আমি আপনায় করি! কি উত্তর দেবেন আপনি?
_ দেখুন এটা আমার বাড়ি নয়! তাই এখানে কোন সিনক্রিয়েট আপনি করবেন না।
_ ওও তাহলে কি এটা আপনার ওই পুলিশ অফিসার শ্বশুর বাড়ি।
_ আপনাকে কেন বলবো? আটশো টাকার জন্য আপনি আমার পিছু নিয়েছেন।
_ আমার কোন আক্ষেপ নেই সেই টাকার।
_ তাহলে এখানে এসেছেন কেন?
_ আপনি এখানে কেন সেটা বলুন।
_ বলবো না,একে তো ঠিক মতো চিকিৎসা করতে পারেন না! আর এখন আমাকে জিজ্ঞেস করছেন এখানে কেন? এটা আমার শ্বশুর বাড়ি। আমার স্বামী ঘরে আছে,ডেকে দিবো। আপনি কে এই বাড়ির।
রজনীর কথায় কমে যাওয়া রাগটা আবারও তরতর করে বেরে গেলো। নিজের রাগ সামলাতে না পেরে রজনীর ডান হাতটা চেপে ধরলো সে। হিসহিসিয়ে বললো–
_ বেয়াদপ মেয়ে,আমার বাড়িতে এসে! আমাকেই বলছে আমি কে? কোথাকার কোন অশিক্ষিত মেয়ে এসে আমাকে বলে কিনা আমি ডাক্তারি জানি না। কোন গরু আমায় ডাক্তার ঘোষণা করেছে। এসব গাইয়া মেয়েকে এই বাড়িতে কে ঢুকতে দিয়েছে। আগে এই অশিক্ষিত মেয়ের ব্যবস্থা করে নেই,তারপর তাঁদের।
_ আপনি আমার হাত ছাড়ুন।
_ যদি না ছাড়ি কি করবেন।
আরো শক্ত করে ধরে।
_ দেখুন আপনার যা বলার আছে,সেটা আমার হাতটা ছেড়ে বলুন।
_ কেন আপনার হাত কি সোনায় বাধানো নাকি?
_ সোনা হোক বা রূপা,কিন্তু আপনি আমার হাতটা আগে ছাড়ুন।
_ ছেড়ে দিলেই তো পালিয়ে যাবেন,আপনাদের মতো মেয়েদের আমার জানা আছে। বাবা-মা কোন শিক্ষা দিতে পারেনি! তাই এই বেগতিক পথে হাঁটছেন।
_ চুপপ,একদম বাজে কথা বলবেন না আমার বাবা-মায়ের নামে। আমি অন্যায় করেছি আমায় বলুন! কিন্তু আমার বাবা-মাকে কিছু বলবেন না। তাঁর আগে আমার হাতটা আপনি ছাড়ুন।
_ অশিক্ষিত বাবা-মায়ের বিগড়ে যাওয়া মেয়ে আপনি। আপনাকে আপনার বাবা-মা মানুষ করতে পারেননি। আমার তো মনে হয় আপনার বাবা মাও একজন ধান্ধাবাজ। কিভাবে টাকা অন্যের থেকে ধান্ধা করে নিতে হয়,তাঁদের থেকেই শিখেছেন।
_ এই মিস্টার মুখ সামলে কথা বলুন। অন্যায় আমি করেছি! তাই যা বলার আমাকে বলুন,সেটা আগেই বলেছি। কিন্তু আপনি তখন থেকে আমার বাবা-মাকে দোষ দিয়েই যাচ্ছেন। কতটুকু চিনেন আপনি আমার বাবা-মাকে। একটা অচেনা অজানা মেয়ের বাবা-মায়ের সমোন্ধে এসব বলতে আপনাকে কে শিখেয়েছে ? আমি চাইলেই এখানে আপনার বাবা-মাকে টেনে কথা বলতে পারি! বলতে পারি আপনার শিক্ষা ভালো না। কিন্তু আপনার মতো এতো নিচুমনের মানুষ আমি নই। এরপর থেকে কারো বিষয়ে না জেনে তাঁর বাবা-মা তুলে কথা বলবেন না৷ কারণ সবাই আমার মতো এতো নরম না-ও হতে পারে। দেখা যাবে ফাটিয়ে দু’টো চড় আপনার গালে দিয়ে দিলো৷ তবে সাবধান। আমি দ্বিতীয়বার এতো শান্ত না-ও থাকতে পারি।
কথা শেষ হতেই অনেক জোর খাটিয়ে রজনী নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। গটগট পায়ে সিড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো। আর এতোক্ষণ সবটা দেখছিলো লিমা বেগম। তিনি পল্লবের দিকে এগিয়ে এলেন।
_ কিরে তুই ওকে চিনিস
_ চিনি মানে! আজ এই মেয়েটার জন্য আমাকে কতগুলো প্রেসেন্টের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে তা তুমি জানো না মা?
_ কি হয়েছে,আর ও তোর রহিমা আন্টির মেয়ে। তোর মনে আছে রহিমার কথা।
_ এই মুহূর্তে ওই মেয়েটার করা অন্যায়ের কথা মনে আছে! আর কিছু না।
_ কি করেছে সেটা তো বল?
পল্লব তাঁর মা’কে সবটা খুলে বললেন। সব শুনে লিমা বেগম বললো।
_ কখনো না জেনে কাউকে দোষারোপ করা ঠিক না পল্লব। তুমি ওর বাবা-মা তুলে কথা বলে ঠিক করোনি। মেয়েটার মা মারা গেছে আজ অনেক বছর। বাবার ছায়া তলে মেয়েটা মানুষ হয়েছে। শত মায়ের যাতাকলে পড়ে মেয়েটা প্রায় মরেই যাচ্ছিলো! সেখানে মেয়েটার বাবা বহু কষ্টে মেয়েটাকে আমাদের এখানে পাঠিয়েছে। আর তুমি কিনা সেই বাবা-মা তুলে ওকে কথা শোনালে। পল্লব যে যতোই খারাপ, তাঁরা তাঁদের বাবা-মাকে ঠিক ততোটাই ভালোবাসে! যতোটা তুমি তোমার বাবা-মাকে ভালোবাসো। তাই কারো দুর্বলতায় আঘাত করতে নেই।
_ মা তুমি আমার অন্যায়টা দেখলে ওই মেয়েটার অন্যায় দেখলে না। মেয়েটার জন্য সবার কাছে কীভাবে আমি ছোট হলাম।
_ পল্লব পয়সার এপিঠ এবং ওপিঠ যেমন থাকে! তেমনি আমাদের দেখার মাঝে, শোনার মাঝেও কিছু সত্যি লুকিয়ে থাকে। যাইহোক এই মুহূর্তে আমি তোমায় এসব বলতে চাই না। যা-ও ফ্রেশ হও।
_ ওকে
পল্লব সামনে এগিয়ে গেলো। কিন্তু হঠাৎ করেই লিমা বেগম চিৎকার করে উঠলো।
_ পল্লব তোমার হাত কাটলো কিভাবে? আল্লাহ এতো রক্ত।
মায়ের কথায় পল্লব ঘাবড়ে গেলো। হাতটা সামনে আনতেই দেখলো হাতে রক্তে মাখামাখি। ভালো করে চেক করলো নিজের হাতের কোথায় কেটেছে। ততোক্ষণে লিমা বেগমও এগিয়ে এলেন। কিন্তু কোথাও কোন ক্ষত তাঁরা খুঁজে পেলেন না। কিন্তু হাত ভরা এতো রক্ত কোথা থেকে এলো। তখনই পল্লবের খেয়াল হলো! সে তো ওই মেয়েটার হাত ধরেছিলো! আর খুব শক্ত ভাবেই ধরেছিলো৷ যতোবার মেয়েটা হাত ছাড়তে বলেছে! ঠিক ততোবারই পল্লব হাতের জোর খাটিয়ে শক্ত করে চেপে ধরেছে। তারমানে মেয়েটা–
_ মা ওই মেয়েটার হাত হয়তো কেটে গেছে কোন ভাবে । ওই মেয়ের রক্ত এটা।
_ কি বলছো তুমি? রজনীর হাত কেটে গেছে। কিন্তু কীভাবে? আমি তো দেখলাম না। আর কেটেছে কখন তা-ও তো আমি জানি না।
_ মা আমার হাতের রক্ত দেখে বোঝা যাচ্ছে অনেকটা কেটে গেছে। কারণ অল্প কাটায় এতো রক্ত বের হওয়ার কথা নয়।
_ আমারও তাই মনে হচ্ছে।
_ মেয়েটা আমাদের বাড়িতে কবে এসেছে।
_ পরশুদিন সকালে। খুব ক্লান্ত ছিলো। সারাদিন শুইয়ে ছিলো। কাল পুরোটা সময় আমার পাশেই ছিলো। আজ সকালে হয়তো তোর চেম্বারে গেছে, সেখান থেকে বাড়ি। যদি এরমধ্যে কিছু হয়ে থাকে! আমার চোখে তো পড়বেই।
_ মা এসব বাদ দাও! আগে চলো মেয়েটার হাত ব্যান্ডেজ করতে হবে।
_ হ্যা হ্যা চল।
ওরা দু’জনেই রজনীর ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। রজনীর ঘরের সামনে আসতেই বুঝতে পারলো দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। লিমা বেগম রজনীকে ডাক দিলেন।
_ রজনী ঘরে কি করছো বাইরে এসো। রজনী তুমি কি কোন ভাবেই আহত হয়েছো? তোমার হাত কি অনেকটা কেটেছে? আর কখন কেটেছে?
লিমা বেগম এতো ডাকার পরে-ও কোন আওয়াজ এলো না ভেতর থেকে। তাঁরা একটু ভয় পেলো। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেনি তো? কিন্তু তাঁদের অবাক করে দিয়ে রজনী বলে উঠলো —
_ আন্টি আমি ঠিক আছি। ওয়াশরুমে ছিলাম তাই আপনার ডাকের সাড়া দিতে পারিনি মাফ করবেন। আর আমি ঠিক আছি।
_ তবুও রজনী একটু বাহিরে এসো।
_ আন্টি মাফ করবেন আমায়,আমি একটু ব্যস্ত আছি। এই মুহূর্তে আমি বের হতে পারবো না। আর আমি সত্যি ঠিক আছি। আমি যদি অসুস্থ ফীল করতাম, তাহলে কি এতো স্পষ্ট স্বরে কথা বলতে পারতাম। তাই টেনশন করবেন না,আমি সত্যি ঠিক আছি।
রজনী দরজা খুললো না। সেটা দেখে তাঁরা যে যাঁর রুমে চলে গেলো। পল্লব নিজের ঘরে গিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো হাত পরিষ্কার করার জন্য। হাত পরিষ্কার করার সময় তাঁর একটা কথাই মনে হলো।
মেয়েটার ধৈর্য শক্তি এতোটা প্রখর! এটা ভাবতেই পল্লব অবাক হলো। কতটা শক্ত করে ধরায় তাঁর হাত ফুরে রক্ত ঝড়েছে,অথচ কতটা স্বাভাবিক সে। বারবার শুধু বললো হাতটা ছেড়ে দিতে। একটু উঁহু শব্দ করলো না। মেয়েটা কি কোন পাথর নাকি। এমন মেয়েও কি আজকাল পাওয়া যায় নাকি। আজকাল নেকা মেয়েদের আনাগোনা বেশি! আর এই মেয়েটা পুরোপুরি আলাদা। কি দিয়ে তৈরি এই মেয়ে আল্লাহ যানেন?
——————
টেবিলের উপর রাখা ফোনটা ভাইব্রেট করতেই রজনীর চোখ খুললো। অনেক চেষ্টা করে হাতের রক্ত পড়া থামিয়েছে। এখন সেখানে প্রচুর যন্ত্রণা করছে। তখন হয়তো আন্টির ছেলের হাতে কোনভাবে রক্ত লেগে গেছে। না হলে তাঁরা বুঝলো কীভাবে তাঁর হাতের ক্ষতের কথা। সে যথেষ্ট সাবধানে নিজের হাত আড়াল করেছে। তাঁর ফুলহাতা কামিজ গুলো তাঁকে সাহায্য করেছে ক্ষতগুলো আড়াল করতে। সে কখনোই নিজের আঘাত গুলো কাউকে দেখাতে চায় না। কারণ সবাই দয়া দেখায়। আর রজনী কারো দয়া চায় না। একমাত্র আল্লাহর দয়া হলেই হবে। সে চেয়ার থেকে উঠে টেবিলে রাখা ফোনটা হাতে তুললো। ফোনটা রিসিভ করে কথা বলতে রইলো।
_ বল নিলি
_ কি খবর তোর
_ ভালো
_ রাতের সেই স্বপ্ন গুলো তোকে এখনো জ্বালায়।
_ ওটা স্বপ্ন না নিলি! বাস্তব। আমার সাথে ঘটা বাস্তব ঘটনা।
_ ভুলে যা
_ চাইলেই সব ভোলা যায় না।
_ আর কতদিন মনে রাখবি।
_ যতোদিন বেঁচে আছি। কারণ কেঁড়ে নেওয়া মানুষ গুলোকে কখনোই ভোলার নয়। আর নরপিশাচ তো আমার সবটা–
_ বাদ দে
_ হুম, বাদ দেবো বলেই এতদূর পালিয়ে আসা। বাবা-র কি খবর?
_ ভালো,পায়ের তেমন সমস্যা হয়নি! চিন্তা করিস না।
_ আচ্ছা রাখছি।
_ রজনী
_ বল
_ রাতে জেগে থাকিস এখনো।
_ তুই হয়তো আমার নামের অর্থ ভুলে গেছিস। রজনী অর্থ রাত। আমি নিজেই যদি রাত হই তাহলে আমার চোখে ঘুম আসাটা অস্বাভাবিক বেপার। সেখানে ঘুম না আসাটাই স্বাভাবিক।
_ সেটা কি ওই ঘটনার পর থেকে?
_ যেটাই হোক,আমি ঠিক আছি। রাখছি। আর কিছু বলতে দিলো না নিলিকে রজনী। তাঁর হাতটা যে ব্যথায় টনটন করছে। আজ না জানি কতটা কষ্ট পেতে হয় এই ব্যথার জন্য তাঁকে।
চলবে,,,,
#গোধূলী_শেষে_তুমি_আমি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৩
চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেই অন্ধকারে একটি মেয়েকে মুখ বেঁধে রাখা হয়েছে। মেয়েটা অনবরত কেঁদে চলেছে। হঠাৎ একটি অবয় সামনে আসতেই মেয়েটা ভয়ে ভয়ে বললো।
_ কে,কে আপনি
অবয়টা হা হা করে হেঁসে উঠলো। সেই হাসির ঝংকারে আশেপাশে থাকা পাখিগুলো ভয়ে উড়ে গেলো। পাখিদের উড়ে যাওয়ার শব্দ শোনা গেলো,শোনা গেলো তাঁদের ডানা ঝাঁপটানো। মেয়েটা ভয়ে সিঁটিয়ে গেলো। তাঁর মুখ থেকে কোন আওয়াজ এলো না। হঠাৎ অবয়টা এগিয়ে এসেই মেয়েটার ঘাড়ে কামড়ে দিলো। মেয়েটা ব্যথায় আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠলো আল্লাহ বলে।
_আল্লাহ বলেই চিৎকার করে শোয়া থেকে উঠে বসলো রজনী। ঘাড়ে হাত দিয়ে অনুভব করলো! সে স্বপ্ন দেখেছে এতোক্ষণ। তাঁর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা সে আবারও স্বপ্নে দেখেছে। আর কতদিন তাঁকে এই বাস্তবরূপী স্বপ্ন তাড়া করে বেরাবে। শরীর বেয়ে ঘাম ছুটছে। ভয়ে তাঁর গলা শুকিয়ে মরুভূমির মতো শুষ্ক হয়ে আছে। ঘুম তাঁর জীবন থেকে হারিয়ে গেছে! সে ভালোই বুঝতে পারলো। কোন মতে সে নিজেকে স্থীর করলো। উঠে গিয়ে এক গ্লাস পানি তাঁকে পান করতেই হবে। না হলে এই খড়া মরুভূমি গলা থেকে নামবার নয়। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে নিলেই! মাথাটা হঠাৎ চক্কর দিয়ে উঠলো। মাথা চক্কর দিতেই সে বুঝলো,তাঁর শরীরে ধুম জ্বর। ব্যথার জন্যই জ্বরটা এসেছে। এখন উপায়।নতুন বাড়ি, নতুন মানুষ! এদের সামনে অসুস্থ হওয়া মানেই একটা উটকো ঝামেলা তাঁদের কাঁধে দেওয়া। ফোনটা হাতরে টাইম দেখে নিলো। রাত তিনটে বাজে। একে তো তার চোখে ঘুম আসতেই সময় নিয়েছে রাত একটা,এখন বাজে তিনটা। সেটাও রইলো না। কিছুটা স্থীর করে আবারও উঠে দাঁড়ালো। বোতলের মুখটা খুলে ঢকঢক করে পানি পান করলো রজনী৷ এখন কিছুটা ভালো লাগছে। বোতলটা টেবিলের উপর রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো রজনী। ধীর পায়ে হাঁটতে রইলো ছাদের দিকে। ছাদের রেলিঙের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দূর আকাশে তাকিয়ে রইলো রজনী। আকাশের চাঁদটা সচ্ছ। চাঁদের পাশের সাদা শুভ্র মেঘগুলো সব থেকে বেশি সুন্দর । সেদিন রাতেও তো এমন সচ্ছ আকাশ ছিলো। চারিদিকে চাঁদের আলোয় আলোকিত ছিলো। কিন্তু সেই আলো কখন যে জীবনকে অন্ধকার নামিয়ে দিলো,তা রজনী জানে না। বুক চিরে বেরিয়ে এলো এক দীর্ঘশ্বাস। হঠাৎ রজনী অনুভব করলো তাঁর পাশে কারো উপস্থিতি। শরীরটা যেন হিম হয়ে গেলো। সেদিনও তো এমন ভাবেই কেউ পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো। তাহলে কি? রজনী ভয়ে দু-পা পিছিয়ে এলো।
রজনীকে পিছিয়ে যেতে দেখে পল্লব অবাক হলো। তাই সে বললো–
_ এতো রাতে ছাদে আসতে ভয় পেলেন না! আর আমার উপস্থিতি আপনাকে এতটা ভীত করে দিলো। বিষয়টা একটু কেমন জানি।
পল্লবের কথায় কোন হেলদোল নেই রজনীর। সে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালো পল্লবের থেকে। আর পল্লব মনে মনে হাসলো। আসলেই মেয়েটা একটু আলাদা। হঠাৎ পল্লবের মনে পড়লো রজনীর কাটা হাতের কথা। তাই সে কিছুটা এগিয়ে গেলো রজনীর কাছে।
_ আপনার হাতের কি খবর? আর আপনার হাতটা কাটলো কী করে?
_ আঘাত দিয়ে,সেই আঘাতে মলম লাগানো মানুষ গুলোকে আমার একদম ভালো লাগে না ।
_ আমি কিন্তু ইচ্ছে করে আপনায় ব্যথা দেইনি।
_ ভাগ্যিস জানতেন না! জানলে তখন বাবা-মা তুলে কথা বলতেন না নিশ্চয়ই।
_ আপনি আমায় সত্যি ভুল বুঝছেন! পুরো বিষয়টা আমার অজান্তে হয়েছে। আপনার বিষয়ে মা আমায় জানিয়েছে। আগে থেকে জানলে হয়তো আমার দ্বারা কোন কষ্ট পেতে হতো না আপনায়। আপনার হাত কীভাবে কেটেছে ? আর কতোটা কেটেছে দেখি।
এই কথা বলেই পল্লব রজনীর হাত ধরতে যায়। কিন্তু রজনী দূর সরে দাঁড়ালো।
_ কথায় কথায় মেয়েদের হাত ধরা কেমন ভদ্রতা বলবেন আমায়। আমার ব্যথা আমাকে বুঝতে দিন। আর এই ভাবে আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করবেন না। আমার বিরোক্ত লাগে।
চোখেমুখে বিরোক্ত ফুটিয়ে রজনী হেঁটে চলে গেলো। কিন্তু কিছুটা পথ যেতেই তাঁর মাথা আবারও ঘুরে উঠলো। কিন্তু এবার আর নিজেকে সামলে নিতে পারলো না,তাঁর আগেই ছাদের শক্ত ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লো। রজনীকে পড়ে যেতে দেখে পল্লব ভয় পেলো। দৌড়ে গিয়ে রজনীকে তুললো। রজনীকে ধরতেই বুঝলো রজনীর শরীর পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। খুব অবাক হলো পল্লব। এতটা জ্বর নিয়ে কতটা স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছিলো মেয়েটা। তারমানে তখন ক্ষতটা আড়াল করতেই তাঁদের বলেছে,সে ঠিক আছে। আল্লাহ এই মেয়ে এমন কেন?
_ এই যে শুনতে পাচ্ছেন। এই যে।
_ ধূর্ত কি নাম তা-ও তো ভুলে গেছি , কি করবো এখন?
পল্লব রজনীকে কোলে তুলে নিলো। নিচে এসে রজনীর ঘরে গিয়ে রজনীকে শুয়ে দিয়ে দৌড়ে চলে গেলো তাঁর মা’কে ডাকতে। তাঁর মা আসতেই সে রজনীর মাথায় হাত রাখলো। হাত দিতেই সে তৎক্ষনাৎ হাত সরিয়ে নিলো। ছেলের উদ্দেশ্যে বললো।
_ পল্লব অনেক জ্বর তো মেয়েটার শরীরে।
_ হ্যা মা,আমিও প্রথম দেখে ভয় পেয়েছি।
_ কিন্তু এতো রাতে কি করবো?
_ মা মাথায় পানি দিতে হবে। এখন এটা ছাড়া আর কোন উপায় দেখছি না। আগে তাঁর জ্ঞান ফিরাতে হবে। না হলে কোন ঔষধও তো তাঁকে দিতে পারবো না।
_ আচ্ছা দাঁড়া আমি পানি নিয়ে আসছি।
লিমা বেগম চলে গেলেন পানি আনতে। পল্লব রজনীর কাছে এগিয়ে গেলো। শ্যামলা চেহারার এই মেয়ের চোখের নিচে জমেছে কালি। গালের ডানপাশে ছোট্ট একটা তিল যেন এই শ্যামলা চেহারার মেয়ের সৌন্দর্য আরো কয়েকগুণ বারিয়ে দিয়েছে। আরো একটু কাছে যেতেই পল্লব আঁতকে উঠল। কারণ রজনীর ঘাড়ে খুব গভীর এক ক্ষত দেখা যাচ্ছে। পল্লব কিছুটা গভীর ভাবে লক্ষ করতেই বুঝতে পারলো এটা কামড়ের দাগ। কিন্তু এভাবে কে মেয়েটাকে কামড় দিয়েছে। ক্ষতটা কেমন কালো হয়ে আছে। প্রতিটা দাঁতের দাগ স্পষ্ট। পল্লব কি ভেবে হঠাৎ রজনীর জামার হাতাটা একটু সরিয়ে দিলো। হাতার কাপড়টা সরাতেই পল্লব এবার ভয়ে ছিটকে দূরে সরে দাঁড়ালো। আল্লাহ এতোটা গভীর ক্ষত নিয়ে মেয়েটা বসে ছিলো। হাতের কাটা দাগটা কেমন ফাঁক হয়ে আছে। দু’টো সেলাই খুলেও গেছে। হয়তো দুপুরে পল্লবের শক্ত করে ধরায় এমন হয়েছে। আর এই মেয়েটা কোন মতেই সেটা কাউকে বুঝতে দিলো না। যে কেউ ক্ষতটা দেখলে বুঝবে,কেউ খুব গভীর ভাবে আঘাত দিয়েছে। কেউ নিজের সর্বচ্চ রাগ মিটাতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করেছে। আল্লাহ এই মেয়ের প্রতি কার এতো ক্ষোভ থাকতে পারে। পল্লব উঠে দাঁড়ালো। নিজের ঘরে যেতে নিলে লিমা বেগমের সাথে দেখা হলো।
_ কিরে তুই আবার কোথায় যাচ্ছিস। আমাকে সাহায্য কর।
_ মা দুই মিনিট অপেক্ষা করো আমি আসছি।
তারপর পল্লব ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। কিছু সময় পর হাতে করে একটা বাক্স নিয়ে এলো। লিমা বেগম বললো।
_ এটা দিয়ে কি হবে? রজনীর তো জ্বর এসেছে।
_ মা যাঁর জন্য শরীরে জ্বর এসেছে! সেটা ঠিক না করলে জ্বর কমবে না।
_ কিসের জন্য জ্বর এসেছে, আমি বুঝলাম না।
_ এদিকে আসো আমি দেখাচ্ছি।
তারপর পল্লব মায়ের হাত ধরে রজনীর সামনে এনে দাঁড় করালো। রজনীর হাত তুলে লিমা বেগমকে দেখাতেই তিনি ভয়ে দূরে সরে দাঁড়ালো।
_ মা’গো কি সাংঘাতিক। এতটা গভীর ভাবে কিভাবে কেটেছে।
_ মা আমার মনে হয়,আমাদের এখান থেকে উনার এই ক্ষত হয়নি! হয়েছে তাঁর বাড়িতেই। কিন্তু তিনি আমাদের দেখায়নি। আর দুপুরে আমার হাতের মোচড়ামুচড়িতে হাতের দু’টো সেলাই ছুটে গেছে। হয়তো এই জন্য এতো রক্ত ঝড়ছিলো। কিন্তু উনি তো তখন কিছু হয়নি বলে, আমাদের চলে যেতে বললেন। আমাদের ভুল, একটু জোর করলে হয়তো এখন এসব কিছু হতো না। ঘাড়ের ক্ষতটার কথা লুকিয়ে গেলো পল্লব।
_ সে যাইহোক, যা করার তাড়াতাড়ি কর। এই জন্যই হয়তো ভাইজান বলেছিলো। মেয়েটা তাঁর প্রচন্ড চাপা। নিজের কষ্ট কখনোই কাউকে বলে না। কিন্তু এতটা চাপা স্বভাবের আমি কল্পনাও করতে পারিনি।
_ মা এসব পরেও বলা যাবে। আমি হাতের সেলাই দু’টো দিয়ে দেই। তুমি মাথায় পানি দিয়ে দাও।
_ কিন্তু তোর কাছে কাটা জায়গা অবস করার ইনজেকশন আছে, যে তুই সেলাই করবি।
_ মা, যে মেয়েটা এতো ব্যথা নিয়ে চুপ ছিলো! আমার মনে হয় না, সে এই জ্ঞান হারানো অবস্থায় সেলাই করলে কোন রিয়াক্ট করবে।
_ তবুও
_ মা তুমি ভুলে যাচ্ছো তোমার ছেলে একজন ডাক্তার। হ্যা আমি হয়তো চোখ বিশেষজ্ঞ, কিন্তু ডাক্তার তো?
আর কোন কথা বললো না পল্লব। সে তাঁর কাজ শুরু করে দিলো। ক্ষতটা ভালো করে পরিষ্কার করলো। ছুটে যাওয়া সেলাইটা নতুন করে দিলো। তারমধ্যে রজনীর মাথায় লিমা বেগমের পানি ঢালা শেষ হলো। তিনি নোংরা পানিটা বাহিরে রেখে আসতে গেলেন। সেই ফাঁকে পল্লব,ঘাড়ের ক্ষতটা পরিষ্কার করে দিলো। পরিষ্কার করতেই পল্লবের মনে হলো। যতটা নিজেকে এই মেয়ে দেখিয়েছে! তাঁর থেকেও গভীর এই মেয়ে। সুস্থ হলে তাঁকে জানতেই হবে এই ক্ষতের আসল কারণ কী?
চলবে,,