গোধূলী_শেষে_তুমি_আমি,০৪,০৫

0
210

#গোধূলী_শেষে_তুমি_আমি,০৪,০৫
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৪

সোনালী রোদ গায়ে পরতেই চোখ খুলে তাকালো রজনী। ঝাপসা চোখে চারিপাশটা দেখার জন্য বারবার চোখটা মেলতে রইলো। চোখের ঝাপসা ভাবটা কেটে যেতেই রজনী বুঝতে পারলো এটা তাঁর ঘর। কিন্তু তাঁর যতোটা মনে আছে সে ছাদে ছিলো। তাহলে ঘরে কীভাবে এলো? গায়ের কাঁথাটা সরিয়ে উঠে বসতেই মাথাটা ঝিম মেরে উঠলো। মাথায় হাত দিয়ে কিছুটা সময় চুপ করে বসে রইলো। কিছুটা ভালো লাগতেই উঠে দাঁড়ালো সে। ওয়াশরুমে ঢুকে চোখেমুখে পানি ছিটালো। চোখের ঝাপসা ভাবটা কেটে গেলো পুরোপুরি। হঠাৎ রজনী খেয়াল করলো তাঁর হাত ব্যান্ডেজ করা। সে খুব অবাক হলো! হাত কে ব্যন্ডেজ করেছে ভেবে। তারপর সে খেয়াল করলো,তাঁর ঘাড়ের ক্ষতটাও পরিষ্কার করা। তাহলে কি কোন ভাবে আন্টি আমার এই অবস্থা দেখে ফেলেছে। হায় আল্লাহ এবার উপায়। যদি জানতে চায় এগুলো কিভাবে হয়েছে? কি উত্তর দেবে সে? কোন উত্তর তো তাঁর কাছে নেই। কোন রকমে হাতমুখ ধুয়ে সে ঘরে এলো। হাতমুখ মুছে ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রইংরুমে আসলো রজনী। রান্না ঘরে উঁকি দিতেই লিমা বেগমের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো। তিনি এগিয়ে এলেন। রজনীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন।

_ এখন জ্বর নেই আলহামদুলিল্লাহ। রাতে তো ভয় পেয়েছি। ভাগ্যিস বাড়িতে পল্লব ছিলো। না হলে কি যে হতো আল্লাহ জানে। তুমি ড্রাইনিংয়ে বসো,আমি তোমার জন্য নাস্তা নিয়ে আসছি।

_ আচ্ছা আন্টি।

আমি ড্রাইনিং টেবিলে বসতেই পল্লবের সাথেও চোখাচোখি হলো। সে মুখে খাবার দিচ্ছে আর ফোন টিপছে। আমি দেখেও না দেখার ভান করে বসে রইলাম। একটি কাঁটা চামচ নিয়ে ঘাটাঘাটি করছি। রাতে ছাদ থেকে পল্লব হয়তো আমায় ঘরে এনেছে। আর এই ব্যান্ডেজ-গুলোও সে করেছে আমি বেস বুঝলাম। কিন্তু আঘাত দিয়ে মলম লাগানো মানুষ গুলো সব থেকে বেশি ভয়ংকর হয়। কারণ তাঁরা সব থেকে বেশি খারাপ। তাঁরা জুতা পেটা করে,গরুদান করতে আসে। যেন তাঁদের করা অন্যায় গুলো মানুষ সহজেই ভুলে যায়। কিন্তু আমি রজনী সেটা কখনোই ভুলতে পারি না। আমাকে যাঁরা ভালোবাসে,তাঁদের থেকে আমাকে যাঁরা আঘাত করে তাঁদের বেশি মনে রাখি। কারণ এটাই আমি। মানুষটা আমার বাবা-মা তুলে কথা বলেছে! আমার সব থেকে দুর্বলতায় আঘাত করেছে। তাঁকে আমি কখনোই ক্ষমা করতে পারবো না।

_ মনে মনে আমায় গালাগাল দেওয়া শেষ হলে নাস্তাটা খেয়ে এই ঔষধটা খেয়ে নিবেন।

হঠাৎ পল্লবের কথায় আমি বিষম খেলাম। মুখে কিছু নেই তবুও কেমন অসহ্য যন্ত্রণা হতে রইলো বুকে। কথায় আছে শুকনো জায়গায় আছার খাওয়া। আমার অবস্থা ঠিক সেটাই। আমার এমন অবস্থা দেখে আন্টি রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এলেন। কিন্তু পল্লব খুব স্বাভাবিক ভাবে বসে রইলো ঠিক আগের মতোই। যেন কিছু হয়নি। আন্টি আমাকে পানি এগিয়ে দিলেন। মাথায় ফুঁ দিলেন,পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন। আমি শান্ত হতেই তিনি পাশে বসলেন।

_ এখন ঠিক আছো।

_ জ্বি আন্টি

_ আচ্ছা ঠিক আছে,খাবারটা খেয়ে না-ও। তারপর পল্লবের দেওয়া ঔষধটা খেয়ে রেস্ট করো। রাতে তোমার জ্বর নামাতে তোমায় পানির সাথে গুলিয়ে ঔষধ দিয়েছি। তোমার তো কোন সেন্স ছিলো না। আল্লাহ তোমার হাতের এতো খারাপ অবস্থা আর তুমি আমাদের বললে না কেন?

_ আন্টি আমায় নিয়ে ব্যস্ত হবেন না,আমি ঠিক আছি। এসব ব্যথা আমার কাছে কিছু না। ছোট থেকে এসবের সাথে আমি অভস্ত্য। অবশ্য এবারের আঘাতটা একটু বেশি, কিন্তু কোন বেপার না ঠিক হয়ে যাবে।

_ ওহে মেয়ে,তুমি তো বলছো ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু রাতে তোমার ওই অবস্থা দেখে আমাদের মা-ছেলের কি অবস্থা হয়েছে তা তো তুমি জানো না।

_ খুবই দুঃখিত আন্টি,আমার জন্য রাতে শুধু শুধু আপনাদের কষ্ট হলো।

_ কি বলছো রজনী,তুমি আমাদের দায়িত্বে এখন। তোমার ভালো খারাপ দেখা কর্তব্য আমাদের।

_ তবুও আন্টি,ওতো রাতে আপনাদের কষ্ট দেওয়াটা ভালো দেখায় না।

_ মা তুমি উনাকে বলে দাও,এখন এতো বড় বড় কথা যেন তিনি না বলে। দুপুরে যদি হাতের ক্ষতটা আমাদের দেখাতো! তাহলে রাতে ওমন কিছু হতো না। তিনি যেচেই আমাদের ব্যতিব্যস্ত করে দিয়েছেন।

_ একদম বাজে কথা বলবেন না। কে বলেছিলো ভূতের মতো ছাদে যেতে আপনায়। আপনি না গেলে আমি ওভাবে চলে আসতাম না,তারাহুরো করে।

_ আমি ভূতের মতো ছাদে গিয়েছি,আর আপনি যে পেত্নীদের মতো একা একা ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলেন তার বেলায়।

_ ছিলাম তো আপনার কী?

_ আমার কী মানে? ওকে বেস! আমাদের ছাদে আমি গেছি,তাতে আপনার কি?

_ ওতো রাতে আপনার ছাদে কি কাজ।

_ আপনার কি কাজ ছিলো আগে সেটা বলুন?

_ আমি, আমি রাতের আকাশ দেখছিলাম। আপনি কি করছিলেন।

_ আমি পেত্নী দেখছিলাম। কি সুন্দর সে গুড়িগুড়ি পায়ে আমাদের ছাদের রেলিঙে পিঠ ঠেকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো। আর কোন মানুষের ঘাড় মটকানো যায় এটা ভাবছিলো। সেটাই উপভোগ করছিলাম।

_ আপনি

_ আমি কিছু না

এই কথা বলেই পল্লব খাবারের টেবিল ছেড়ে উঠে গেলো। আর বোকার মতো রজনী বসে রইলো। ছেলেটা কীভাবে মেয়েদের মতো ঝগড়া করলো তাঁর সাথে। শহরের ছেলেরা এতো ঝগড়া করতে জানে,সেটা রজনী জানতো না। রজনী ভাবনার মাঝে লিমা বেগম প্রশ্ন করলেন।

_ তোমার হাতের এই ক্ষতটা কিভাবে হয়েছে রজনী। প্লিজ এটা বলবে না তুমি বলবে না।

মায়ের প্রশ্ন শুনে পল্লবের পা আপনা-আপনি থেমে গেলো। এদিকে লিমা বেগমের কথায় রজনী মুচকি হাসলো। হাতের রুটির অংশটুকু মুখে পুরে বললো।

_ সে অনেক কথা আন্টি,শুনলে বিরক্ত হবেন। এতোটুকু বলতে পারি। জীবনটা যতোটা উপর থেকে গোছালো হয়,আসলে জীবন অতোটা গোছালো নয়। উপরটা পরিপাটি হলেও ভেতরটা বড্ড বেশি অগোছালো। মায়ের মৃত্যুর সাথে সাথেই আমার জীবনটা অগোছালো হয়ে আছে। আর কখনো এই জীবনটা পরিপাটি হবার নয়। কারণ এরপর থেকে যাঁরাই জীবনে আসবে! তাঁরাই আমাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে আসবে। একটু নিজেকে গুছিয়ে নিতেই তাঁরা এলোমেলো করে সব ভাসিয়ে দিবে জোয়ার ভাঁটার নদীতে। কারণ এই কঠিন পৃথিবীতে ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট মানুষ আছে! কিন্তু ভেঙে যাওয়া মানুষটাকে গড়তে একজনও নেই। কোথাও কেউ নেই।

কথাগুলো শেষ করে পল্লবের দেওয়া ঔষধ গুলো নিয়ে রজনী উঠে গেলো। নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো সে। কিন্তু স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো পল্লব। এই অল্প কিছু কথার মাঝে কতটা ভয়ানক অতীত লুকিয়ে আছে রজনীর তা পল্লব কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারলো। কিন্তু পল্লব জানে না, তাঁর আন্দাজের বাহিরেও কিছু ভয়ানক অতীত থাকে! আসলে সেটাই রজনীর জীবন।

—————–

পরন্ত বিকেল। পশ্চিমের কোলে ঢলে পরা সূর্যখানার লাল আভা ফুটে উঠেছে। জানালার এক কোণে দাঁড়িয়ে দূর থেকে দূরে তাকিয়ে আছে রজনী। আজকাল তাঁর আকাশ কেন যে এতো ভালো লাগে সে জানে না। শুধু জানে আকাশের মতোই রজনীর জীবনটা শূন্য। আকাশের যতো কাছে যাবে,ততোই সব ধোঁয়াশা! ঠিক তেমনি রজনীর জীবনের যতোটা গভীরে যাবে ততোটাই ধোঁয়াশা। মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করে জীবনের সাথে কথা বলতে। কিন্তু জীবন কথা বলতে পারে না। এই তিনটি অক্ষরের একটি শব্দের অর্থ বুঝতেই মৃত্যু কাছে চলে আসে। কেউ কেউ সেই অর্থ বুঝতে পারে,কেউ পারে না। রজনী কিছুটা পেরেছে। এই জীবনের আসল মানে হয়তো! তুমি রবকে যতো ভালোবাসবে,রব ঠিক তোমায় ততোটাই ভালোবাসবে। কারণ পুরো জীবনটাই তো রবের দান। হঠাৎ রজনীর একটা গানের লাইন মনে পড়ে গেলো।

না জানি কোন অপরাধে,দিলা এমন জীবন।
আমারে পোড়াইতে তোমার এতো আয়োজন।

সে জানে গান মিথ্যা। গানের প্রতিটা শব্দ মিথ্যা। তবুও কখনো কখনো মানুষ সেই গান গেয়ে নিজের কষ্ট একটু কমাতে চায়। কিন্তু কষ্ট কখনো কমে না, বেড়ে যায়। যদি কখনো কষ্ট কম অনুভব করতে চাও,তাহলে সূরা বাকারাহ’র আয়াত গুলো মনোযোগ দিয়ে শুনো। আস্তে আস্তে দেখবে তোমায় কষ্ট কম অনুভব হবে। কারণ এই সূরার প্রতিটা আয়াতে লুকিয়ে আছে সস্থি। চোখের কোণে জমা হওয়া জলটুকু মুছে নিলো রজনী। ঠিক তখনই মনে হলো কেউ তাঁর ঘাড় স্পর্শ করেছে। লাফিয়ে সরে দাঁড়ালো রজনী।গায়ের ওড়নাটা ভালো করে পেঁচিয়ে সামনে তাকাতেই পল্লবকে দেখলো সে। গলায় কঠিন ভাব এনে বললো।

_ এটা কেমন অসভ্যতা বলবেন একটু। আপনি আমার ঘরে কি করছেন?

_ আপনার ঘাড়ের এই ক্ষতটা আপনার হাতের থেকেও ভয়ানক সেটা কী আপনি জানেন?

_ না জানি না। যেনে লাভ নেই।

_ আছে,একজন ডাক্তার হিসেবে আপনাকে সেটা আমি জানাতেই পারি।

_ না পারেন না। আপনি না চোখ বিশেষজ্ঞ, তাহলে কবে থেকে এসব নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করলেন।

_ কাল রাত থেকে। শুধু গবেষণা করতে শুরু করিনি! খুব গভীর ভাবে ক্ষতটা সারানোর চেষ্টাও চালু করেছি।

_ ফাজলামো রাখেন,আর এখনি বেরিয়ে যান আমার ঘর থেকে।

_ আপনার এই ঘাড়ের ক্ষতটার জন্য টিটেনাস ইনজেকশন দিয়েছেন। এটা দেওয়া খুব জরুরি। কারণ মানুষের দাঁতে, কুকুরের থেকেও বেশি বিষ থাকে।

_ তাতে আপনার কি? আপনি এখনি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যান।

_ এতো বেরিয়ে যান, বেরিয়ে যান করছেন কেন? আমি কি থাকতে এসেছি নাকি।

_ তাহলে এসেছেন কেন?

_ এটা দিতে।
ইনজেকশন দেখিয়ে কথাটা বললো পল্লব।

_ একদম এই বাজে জিনিস আমাকে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না।

_ এটা বাজে না,এটা আপনার ক্ষত সারানোর ঔষধ। আর এটা দিলে আপনার ওই ক্ষতটা বেশি ক্ষতি আপনার করতে পারবে না।

_ আমার ভালো আপনায় কেউ দেখতে বলেনি,এখনি বেরিয়ে যান।

_ কি সেই তখন থেকে এক গান গেয়ে যাচ্ছেন। নতুন টতুন কিছু গান শুনি।

এই কথা ব’লেই পল্লব জোর করে রজনীর হাত ধরে চেয়ারে বসালো। আর এদিকে আমাদের রজনী রানী রাগে ফাটতে শুরু করলো বেলুনের মতো।

_ আপনার মতো এতো অসভ্য অভদ্র ছেলে আমি জীবনেও দেখিনি।

_ না দেখলে এখন দেখে নিন। বলা যায় না সুযোগটা যখন তখন চলে যেতে পারে। এই অফারটা চলবে আপনার ক্ষতগুলো না সারানো অবধি। তাই ঝটপট অফারটা লুফে নিন।

_ অসভ্য

_ সাথে আরো কিছু যোগ করতে পারেন আমি কিছু মনে করবো না। কিন্তু প্লিজ মাইনাস করবেন না,তাহলে সেটা রসালো হবে না। কিন্তু যতোই যোগ করুন না কেন! মুখে করবেন, হাতে-পায়ে না। কারণ হাত-পা যদি ছুড়াছুড়ি করেন! এখন দুটো ইনজেকশন এনেছি,বাজার থেকে আরো দু’টো আনবো। আমি কিন্তু ডাক্তার! এমন উড়নচণ্ডী প্রেসেন্ট নিজের আয়াত্তে কিভাবে আনতে হয় আমি ভালো করেই জানি।

_ এই না না।

_ হুম, এই তো গুডগার্ল।

তারপর পল্লব ইনজেকশন পুস করলো। বাক্স থেকে বায়োডিন বের করে সেটা তুলোয় মাখিয়ে রজনীর ক্ষত পরিষ্কার করতে শুরু করলো। হঠাৎ পল্লবের এমন কান্ডে রজনী উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো।

_ কি করছেন,আপনি আমার ঘাড়ে হাত দিচ্ছেন কেন।

_ আমাকে এখন একজন পুরুষ না ভেবে, একজন ডাক্তার ভাবুন। এই আমি শুনেছি আপনাদের চিন্তাধারা না অনেক প্রখর,মানে মেয়েদের। আপনারা মেয়েরা নাকি বুঝতে পারেন! কে আপনাকে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে। তো আমার এই ছোঁয়ায় কি আপনি নোংরামি খুঁজে পাচ্ছেন। জোর করে রজনীর হাতটা ধরে আবার বসিয়ে দিয়ে কথাটা বললো পল্লব।

_ দেখুন

_ হুম দেখছি তো, খুব গভীর ভাবে দেখছি আপনার ক্ষত গুলো। হাতের ক্ষত না শুকানো অব্ধি এমন ভাবেই থাকবে। কিন্তু আপনার এই ঘাড়ের ক্ষতটা রোজ ড্রেসিং করতে হবে। না হলে ইনফেকশন হবে। তাতে আপনিই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

_ হই তাতে আপনার কি? তখন থেকে একটার পর একটা কাজ করে যাচ্ছেন আমার অনুমতি ছাড়া। আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যান এখনি

হাতের নষ্ট তুলোটা ফেলে দিয়ে, নতুন তুলো দিয়ে আরো একটু পরিষ্কার করে দিলো পল্লব । সব কিছু হাতে নিয়ে রজনীর কানে কানে বললো।

_ বাড়িটা আমার, ঘরগুলো আমার,এখানে যে মানুষ গুলো থাকে তাঁরাও আমার। এখন আপনি যদি নিজেকে পর ভাবেন! তাহলে চিন্তা নেই আপন করার কৌশলও আমার জানা আছে।

চলবে,,,,

#গোধূলী_শেষে_তুমি_আমি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৫

পল্লবের কথায় রজনী বোকার মতো বসে রইলো। মানুষটা যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছে। কি খারাপ ধূর ভালো লাগে না। ওদিকে পল্লব কিছুটা দূর গিয়ে আবারও রজনীর কাছে ফিরে এলো। রজনী অন্যমনষ্ক ছিলো তাই পল্লবের ফিরে আসা খেয়াল করেনি। পল্লব রজনীর চোখের পাতাটা টেনে ধরলো। এবার ভয়ে রজনী চেয়ার থেকেই পড়ে গেলো। এটা দেখে পল্লব হাসতে হাসতে শেষ। আর রজনী ওমাগো বলে বিলাপ করছে।

_ এই আপনার কি ছোঁয়াচে রোগ আছে নাকি! ছুঁয়ে দিলেই এভাবে ভয় পান।

_ আপনার মতো বাজেলোক আমি একটাও দেখিনি পৃথিবীতে। কথায় কথায় মেয়েদের ছোঁয়া কি আপনার অভ্যস নাকি।

_ আপনি নিজে থেকে যদি সব বলতেন, তাহলে আমাকে এতোবার আপনাকে ছুঁয়ে দিতে হতো না।

_ আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি আমাকে নিয়ে আপনার এই ভাবনা ভাবনি বন্ধ করুন। আপনাদের মতো এই বড়লোক মানুষ শুধু আমাদের মতো মেয়েকে দয়া দেখায়! যে দয়া আমার চাই না।

_ রজনী আপনি ভুল ভাবছেন।

_ আমি ভুল ভাবছি না,আপনি এই মুহূর্তে আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাবেন।

_ যাবো,তাঁর আগে বলুন তো আপনার চোখে কি হয়েছে? সেদিন তো চোখের সমস্যার জন্য আমার চেম্বারে গিয়েছিলেন।

_ আমার কিছু হয়নি।

_ আমি তো আপনার চোখটা দেখলাম, মনে হয় আপনার চোখে কেউ হয়তো আঘাত করেছে।

_ আপনায় বলেছে তাই না।একধাপ বেশি বোঝা কি আপনার রোগ নাকি। আমি চোখে কুঞ্চির গুঁতো খেয়েছি। তারপর চোখের কোণে রক্তজমাট বেঁধেছিলো! ঔষধ খাওয়ার পর ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু এখন চোখ থেকে পানি পড়ছে। তাই—

_ হয়েছে আর বলতে হবে না,আমি বুঝে গেছি।

তারপর হাসতে হাসতে পল্লব ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আর রজনী বোকা হয়ে তাকিয়ে রইলো। সে এতোক্ষণ কীভাবে সবটা বলে দিলো সেটা ভেবে অবাক হলো। উনি কি আমায় তাঁর বসে নিয়ে নিয়েছে নাকি। আল্লাহ এই ছেলে এমন কেন?

—————–

পৃথিবীতে দিনের আলো ফুরিয়ে রাতের আঁধারে ঢেকে গেছে। পাখিরা যে যাঁর নীড়ে ফিরে গেছে। এবার পল্লবও নিজের চেম্বারে ফিরে যাবে। লিমা বেগম সবাইকে চা-নাস্তা দিয়েছে,সাথে নিজেও বসে আছে। সোফায় বসে মা-ছেলে নিজেদের বিষয়ে কথা বলছে। আর রজনী নিজের মতো করে ভাবনায় বিভোর হয়ে আছে। হঠাৎ ফোনের রিংটোনে সবার ধ্যান ভেঙে গেলো। সবাই সেদিকে তাকিয়ে পরলো। রজনী নিজের ফোনটা হাত তুলে নিলো। কারণ তাঁর ফোনটাই বাজছে। রিসিভ করে সে একটু দূরে সরে গেলো।

_ হ্যা নিলি বল,কেমন আছিস।

_ আমি ভালো আছি,তোর কি খবর বল?

_ এই তো ভালোই, বাবা-র কি খবর বল তো?

_ কাকু ভালো আছে,আমার সাথেই আছে।

_ তোদের বাড়িতে আব্বু এই অসময়ে। কিছু কি হয়েছে?

_ কাকু কিছু বলবে তোকে। বাড়িতে বসে বলতে পারবে না,তাই এখানে এসেছে ।

_ আচ্ছা দে

_ কাকু এই নাও,রজনী কথা বলবে।

_ রজনী

_ হ্যা বাবা বলো,কেমন আছো।

_ আলহামদুলিল্লাহ, তুই কেমন আছিস।

_ আমি ভালো আছি বাবা। তোমার শরীর কেমন এখন,পায়ের ব্যথা কমেছে।

_ হ্যা এখন ভালোই আছি। তোকে একটা কথা বলার ছিলো?

_ বলো বাবা,আমি শুনছি।

_ মঈনুল জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গেছে। কে বা কারা ওকে ছাড়িয়ে নিয়েছে জানতে চেয়েছি,কিন্তু ওরা আমায় থানায় ঢুকতে দেয়নি। তাঁর আগেই আমায় হুমকি দিয়েছে। বলেছে তোকে খুঁজে না পেলে আমাকে বন্দী করবে।

_ কি বলছো বাবা

কথাটা রজনী চিৎকার করে বললো। সাথে ওর হাত-পা হঠাৎ করেই কাঁপতে শুরু করলো। রজনীর চিৎকারে পল্লব এবং তাঁর মায়ের কথায় ব্যাঘাত ঘটলো। তাঁরা রজনীর দিকে তাকাতেই রজনীর বেহাল অবস্থা দেখতে পেলো। দেখতে পেলে রজনীর অস্থিরতা। রজনীর পুরো শরীর খারাপ ভাবে কাঁপছে।

_ এবার আমি কোথায় লুকাবো বাবা। ও আমায় ধরে ফেলবে। ও আমায় এবার মেরেই ফেলবে। আমি কি করবো এবার। আমাকে ও মেরেই ফেলবে। আমি আর তোমাকে দেখতে পাবো না! আমায় না পেলে তোমায়ও ওরা মেরে ফেলবে। পরের মেয়ের জন্য আজ তোমাকেও বিপদে পরতে হচ্ছে। আমাকে তুমি সেদিন কেন মেরে ফেললে না। আমার জন্য ওরা তোমার নিলির ক্ষতি করবে। আমি কি করবো! আল্লাহ আমি এবার কি করবো,ওরা নিশ্চয়ই জেনে গেছে আমি এখানে। ওরা আমার ঠিকা—

আর কিছু বলতে পারলো না রজনী, সেন্স হারিয়ে ফেললো। ততোক্ষণে রজনীর অবস্থা দেখে পল্লব এবং লিমা বেগম এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু তাঁরা কিছু বোঝার আগেই রজনী ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লো। লিমা বেগম দৌড়ে গিয়ে রজনী নিজের হাতের উপরে নিলেন। আর পল্লব দৌড়ে গিয়ে ফোনটা তুলে নিলো। ফোনে এখনো রজনীর বাবা রজনী,রজনী বলে চিৎকার করছে। পল্লব ফোনটা কনে তুললো।

_ হ্যালো আঙ্কেল, হ্যালো, হ্যালো

_ কাকু বাহিরে মঈনুলের লোক দেখতে পেলাম, ফোনটা কেটে দিন।

টুথটুথ করে ফোনটা কেটে গেলো। উপরের ওই কথাটাই শুনতে পেলো পল্লব। মঈনুল, কে এই লোক যাঁর জন্য—

_ পল্লব একগ্লাস পানি নিয়ে আয়।

পল্লব দৌড়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে এলো। রজনীর চোখেমুখে ছিটিয়ে দিতেই, রজনী চোখ খুললো। চোখ খুলতেই হঠাৎ লিমা বেগমকে আঁকড়ে ধরলো আর বলতে রইলো।

_ আন্টি ওরা আমায় তুলে নিয়ে যাবে। আমাকে লুকিয়ে ফেলুন। ওরা আমায় মেরে ফেলবে। এবার আমি আর বাঁচতে পারবো না। ওই মঈনুল আমাকে মেরে ফেলবে আন্টি। আমাকে না পেলে ওরা বাবা-র ক্ষতি করে দিবে। আমাকে মেরে ফেলবে। ওই মঈনুল আমার সব—

কথা শেষ হলো না,আবারও সেন্স হারিয়ে লিমা বেগমের বুকে মিশে রইলো রজনী । লিমা বেগম আর পল্লব যেন কিছুই বুঝতে পারলো না। কি এমন হয়েছে যে রজনী এতো ভয় পেয়েছে। মা-ছেলে যেন দিশেহারা হয়ে বসে রইলো। হঠাৎ লিমা বেগম চিৎকার করে উঠলো–

_ পল্লব, রজনীর শরীর অসম্ভব গরম হয়ে আসছে।

_ কি বলছো মা,কই দেখি।

পল্লব রজনীর কপালে হাত দিতেই বুঝতে পারলো,অস্বাভাবিক ভাবে রজনীর শরীর গরম হতে শুরু করেছে। অতিরিক্ত ভয় থেকে রজনীর এমন অবস্থা হয়েছে তা পল্লব ভালোই বুঝতে পারলো। সে তাঁর মা’কে বললো।

_ মা উনাকে এখনি ঘরে নিয়ে যেতে হবে। আর আমার মনে হচ্ছে উনার এই অস্বাভাবিক জ্বরের জন্য যখন তখন খিঁচুনি উঠবে। এই ঠান্ডা ফ্লোরে থাকলে বেশি ভয়।

_ ধর ওকে,ঘরে নিয়ে চল। আল্লাহ মা মরা মেয়েটার সাথে কেন এমন হচ্ছে।

পল্লব আর লিমা বেগম ধরাধরি করে রজনীকে ঘরে নিয়ে এলেন। রজনীকে শুয়ে দেওয়ার কিছু সময় পর,সত্যি সত্যি রজনীর খিঁচুনি উঠলো। কম্বল কাঁথা দিয়ে রজনীকে চেপে ধরলো লিমা বেগম। অনেকটা সময় যেতে রজনী স্বাভাবিক হলো। কিন্তু রজনীর জ্বর নামার কোন নাম নিলো না। ঘড়ি তখন রাত নয়টার ঘরে ঠেকেছে। লিমা বেগম খুব ভয় পেলেন।

_ পল্লব এখন উপায়,

_ মা উনি ভয়ে আছেন,এই ভয় ভেতর থেকে দূর না হওয়া অবধি এমনই হবে। কিন্তু কি এমন ঘটনা আছে যা উনাকে ভেতর থেকে এভাবে ভেঙে দিচ্ছে।

_ আমাদের ওর বাবা-র সাথে কথা বলতে হবে। আমার মনে হয় রজনী কিছু জানাবে না।

_ আমারও তাই মনে হয়।

—————

সময় রাত তিনটে। রজনীকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হ’য়েছে। রজনীর জ্বর নামার কোন নামই নিচ্ছিলো না। তাই পল্লব বাধ্য হয়ে তাঁর একজন ডাক্তার বন্ধুকে খবর দিয়ে এনেছিলো। সে এসে রজনীকে ঔষধ এবং ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে গেছে। এখন রজনীর জ্বর একটু কম। রজনীর পাশে লিমা বেগম শুয়ে আছে। আর বেলকনিতে বসে চিন্তায় মগ্ন পল্লব। তাঁর বন্ধু তাঁকে জানিয়েছে! অতিরিক্ত ভয় থেকেই রজনীর এই জ্বরটা এসেছে। আর এই ভয় ভেতর থেকে যদি না কাটে,তাহলে হয়তো এমন জ্বর সব সময় আসবেই। যদি ভয়ের আসল কারণটা পল্লব জানতো,তাহলে হয়তো রজনীর ভয়টা একটু হলেও কাটিয়ে দেওয়া যেত। পল্লবের আকাশ-কুসুম চিন্তায় ছেৎ পড়লো ফোনের আওয়াজে। পকেট থেকে নিজের ফোন বের করতেই বুঝতে পারলো তাঁর ফোন বাজছে না,অন্য কারো ফোন। বেলকনি থেকে তারাহুরো করে পল্লব ঘরে এলো! কারণ ফোনের আওয়াজে লিমা বেগম বা রজনীর ঘুম নষ্ট হতে পারে। পল্লব ঘরে এসে দেখলো,রজনীর ফোন বাজচ্ছে। সে তড়িঘড়ি করে ফোনটা হাতে তুলে নিলো। হাতে নিতে নিতেই ফোনটা কেটে গেলো। কেটে যাওয়ার কিছু সময় পর ফোনটা আবারও বেজে উঠলো। ফোনটা হাতে নিয়ে পল্লব বেলকনিতে চলে গেলো,যেন ওদের ঘুমের ব্যাঘাত না হয়। ফোনটা রিসিভ করবে কি করবে না ভাবতে রইলো। কারো পার্সোনাল জিনিসে হাত দেওয়া অনুচিত কাজ। কিন্তু কি যেন ভেবে পল্লব ফোনটা রিসিভ করে কানে তুললো । পল্লব হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো একজন পুরুষের কন্ঠ।

_ রজনী,জান আমার! তুমি নাকি আমার ভয়ে লুকিয়ে আছো। তুমি পাতালেও যদি লুকিয়ে থাকো,এই মঈনুল সেখান থেকে তোমায় খুঁজে বের করবে। তুমি আমাকে চেনো না। আচ্ছা জান,তোমার ঘাড়ের ক্ষতটা কি সেরে গেছে। তোমায় আমি বলেছি না,তোমার ক্ষত শুকানোর আগে আমি জেল থেকে বেরিয়ে যাবো। দেখলে জান আমি বেরিয়ে গেছি। এবার তোমাকে খুঁজে নিবো!যেমন তোমার বান্ধবীকে দু’টো থাপ্পড় দিয়ে তোমার নাম্বার জোগাড় করেছি। এবার তোমাকে খুঁজে পাবার পালা। ভালো থেকো। হা হা হা হা।

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here