গোধূলী_শেষে_তুমি_আমি,০৮,০৯

0
157

#গোধূলী_শেষে_তুমি_আমি,০৮,০৯
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৮

বিয়ের প্রথম রাতেই আমি এক প্রকার ধর্ষন হই। যাকে বলে কিনা হালাল ধর্ষন। সেদিন আমি বুঝতে পারি অভিমানে নেওয়া সিদ্ধান্ত আমার কতোটা ভুল ছিলো। মঈনুলকে আমি দেখিনি,ওর বিষয়ে কোন খোঁজ নেইনি। আর সেই ফলাফল আমাকে দিতে হলো বিয়ের পর থেকে । আমার হাত থেকে ফোন নিয়ে নিলো মঈনুল। বাবা-র বাড়ির সাথে আমার সব রকমের যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো। অবশ্য কার সাথে যোগাযোগ করবো,আমার আপন বলতে তো কেউ নেই। মঈনুল একজন খারাপ লোকছিলো। যে কিনা যতপ্রকার নেশাদ্রব্য ছিলো সব বিক্রি করতো।অবশ্য এটা আমি জানতাম না। বিয়ের তিনমাস পর জেনেছি। এই তিনমাস আমার জীবনটা পুরো নরক করে দিয়েছে লোকটা। সারাদিন মানুষিক যন্ত্রণা, আর রাতে শারীরিক। আমি যেন একটা যন্ত্রে পরিনত হলাম। মঈনুল আমায় প্রচুর মারধোর করতো। কখনো লাঠি দিয়ে, কখনো হাত। কখনো তো সিগারেটের আগুন আমার পিঠে চেপে ধরতো। আর সব সময় আমায় হুমকি দিতো! যদি আমি এসব কাউকে বলি,ও আমার সাথে সাথে আমার পরিবারকেও মেরে ফেলবে। বিষয়টা আমি অন্য কাউকে না জানালেও ওর পরিবারকে জানাই। কিন্তু তাঁরা উল্টে মঈনুল বাসায় আসতেই নালিশ করে দেয়। আর যাঁর জন্য মঈনুল আমায় প্রচুর মারধোর করে। টানা তিনদিন ও আমায় খেতে দেয়নি। এতটা নরপশু আমার স্বামী, ভাবলেও আমার ঘৃণা হতো। মাঝে মাঝেই মনে হতো মরে যাই। কিন্তু ওই যে আত্মাহত্যা মহাপাপ। এই জন্য কখনোই সাহস হয়নি। বহুবার চেষ্টা করেছি,কিন্তু আমি বরাবরই ব্যর্থ হয়েছি। একদিন বাবা সকল রাগ,অভিমান দূরে সরিয়ে আমার সাথে দেখা করতে আসেন। আমাকে বুকে জড়িয়ে সে কি কান্না। আমি সেদিন আবারও বুঝলাম! রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও সত্যিই তিনি আমার বাবা। বাবা আমার চেহারা দেখেই বুঝে নিলেন,আমি ভালো নেই। কিন্তু তিনি মঈনুলের পরিবারের সামনে জিজ্ঞেস করতে পারছিলেন না। তাই কৌশলে তিনি আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেন। কিন্তু মুখের উপর মঈনুল না করে দেয়। এতে বাবা আরো সন্দেহ করে। কারণ আমাদের বাবা-মেয়ের মাঝে এতোদিন মান-অভিমান চলছিলো। অন্য কেউ হলে আমাকে তখনই পাঠিয়ে দিতো। তাই বাবা গোপনে নিজের ফোনটা আমায় দিয়ে গেলেন। গভীর রাতে বাবা ফোন করলেন তাঁর নাম্বারে! যেটা আমাকে তিনি দিয়ে গেছেন। আমি গোপনে সবটা বলে দেই। বাবা শুনে কি উত্তর দিবেন যেন ভেবে পেলেন না। তিনি বারবার নিজেকে দায়ী করলেন। তিনি ভাবলেন, আমি ছোট তাই ভুল করে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাঁর উচিত ছিলো আমাকে শাসন করা। আমি বাবাকে বোঝালাম, তাঁর দোষ নেই। সব দোষ আমার। আমি জেদ না করলে এমন কিছুই হতো না। বাবা নিজেকে স্থীর করলেন এবং আমায় বললেন। মঈনুল যেহেতু নেশাদ্রব্য বিক্রি করে! তাহলে নিশ্চয়ই ঘরে কিছু রাখে। যদি পুলিশের হাতেনাতে ধরিয়ে দিতে পারি সেই জিনিসগুলো,তাহলে শাস্তিও দেওয়া হবে,আমি মুক্তিও পাবো। তারপর থেকে আমি সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। আল্লাহর রহমতে সুযোগটা পেয়েও গেলাম। বাবা পুলিশ নিয়ে এলো,এবং ওকে ধরিয়ে দিলো। আমাকে আর বাবাকে ও হুমকি দিয়ে যায়,ও খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে। বাবা মঈনুলের পরিবারকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমাকে নিয়ে চলে আসে। আমি চলে আসার পরই বাবা আমার সৎমাকে বলে দিলো! সে যদি আমার সাথে কোন বারাবাড়ি করে তাহলে পুলিশকে জানাবে,সেও এসবের সাথে জড়িত। মা ভয় পেলেন এবং চুপ হয়ে রইলেন। কিছু দিনের মাঝেই আমাদের ডির্ভোসের জন্য বাবা এপ্লাই করলেন। অবশ্য সফলও হলেন। কারণ একজন অপরাধীর সাথে আমার মতো মেয়ে কিছুতেই থাকতে পারবে না। তাই কোর্ট থেকে আমার তরফেই রায় হলো। বাবা আবারও আমায় পড়ালেখা করার জন্য বললেন। আমি রাজি হলাম। যেহেতু আমার বিয়ের সম্পর্কে তেমন কেউ জানতো না,তাই কেউ আমায় ডির্ভোসী বলে খোটাও দিতে পারেনি। বাবা সব সময় বলতো একটা কাজ আমি ভালোই করেছি,কাউকে বিয়ের বিষয়ে না জানিয়ে। অবশ্য কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে,বাবার শিখিয়ে দেওয়া উত্তর আমাকে আর মা’কে দিতে হতো। এতোদিন কোথায় ছিলাম? উত্তর ছিলো অসুস্থতার জন্য ডাক্তার দেখাতে শহরে ছিলাম। মা’কেও এই উত্তর দিতে হতো। তাই সবাই বিশ্বাস করে নিয়েছিলো। যেহেতু মঈনুলকে আমি মন থেকে বিয়ে করিনি,বা ওর সাথে আমার বিয়ের পর তেমন ভালো কোন সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। তাই ওর চলে যাওয়ায় আমার জীবনে কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। কিন্তু হঠাৎ একটা ঝড় এসে আবারও সব কিছু ধোঁয়াশা করে দিলো। যেহেতু আমাদের বাড়ি গ্রামে,তাই আমাদের কলপাড়টা ঘর থেকে একটু দূরে। তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য ওজু করতে যাই কলপাড়ে। সেদিন বাহিরে চাঁদের আলোয় আলোকিত ছিলো। ওজু শেষ হতেই অনুভব করি,আমার পাশে কারো উপস্থিত। আমি ভয় পেয়ে যাই। ভালো করে তাকাতেই দেখলাম মঈনুল, দাঁত বের করে হাসছে। কি বিচ্ছিরি ওর ওই হাসি। আজও মনে পড়লে আমার শরীরে কাঁটা দেয়। চিৎকার করার আগেই ও আমার মুখ বেঁধে দেয়। আমাকে একপ্রকার টেনেহিঁচড়ে ও নিয়ে যায় ওর সাথে। কিন্তু সেদিন মহান রাব্বুল আলামিন আমার উপর দয়া করেছিলেন। কারণ আমি সেদিন বাহিরে একা ছিলাম না,নিলিও ছিলো। ও টয়লেট গিয়েছিলো,আর আমি কলপাড়ে। পুরো ঘটনা ওর সামনেই ঘটেছিলো। ও তখন ভয়ে চিৎকার করতে পারেনি। কিন্তু আমাকে মঈনুল ধরে নিয়ে যাওয়া সাথে সাথেই ও বাবাকে ডেকে তোলে। বাবা তৎক্ষনাৎ পুলিশের কাছে যায়। যেহেতু ও একজন জামিন পাওয়া আসামি ছিলো,তাই ওর অপরাধের কথা শুনে পুলিশ সাথে সাথেই রিয়াকশন করে। আমাকে একটা অন্ধকার রুমে বন্দী করে রাখে। যে অন্ধকারে নিজের অস্তিত্বও আমি বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ দরজার খোলার আওয়াজে আমার মনের ভয়টা দ্বিগুন বেড়ে যায়। আমি ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করি। কে, কে আপনি? আসলে আমি নিজেকে বোঝাতে চাইছিলাম,যেন এটা মঈনুল না হয়। কিন্তু আমায় ভুল প্রমাণ করে মঈনুল শরীর কাঁপিয়ে হেঁসে উঠলো। যে হাসি অতিভয়ংকর ছিলো। আমাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে! ও হঠাৎ আমার ঘাড়ে কামড় দেয়। আমি আল্লাহ বলে চিৎকার করে উঠি। ওই ব্যথা এতটাই ভয়াবহ ছিলো,যা আমি কখনোই কাউকে বিশ্লেষণ দিতে পারবো না। আমি তো মনেই করে নিয়েছি,আমি হয়তো আর দিনের আলো দেখতে পারবো না। আমি কামড়ের ব্যথা সইতে না পেরে চিৎকার করে কাঁদতে রইলাম। আমার ওই কান্না যতো গাড়ো হলো,মঈনুলের হাসি ততোই ভয়ংকর হলো। আমাকে কষ্ট দিয়ে ও যেন সুখ অনুভব করছিলো। আমার হাতের বাঁধন ও খুলে দিয়ে বললো। আমি তোকে কোপাবো,আর তুই কষ্টে ছটপট করবি। তোর সেই কষ্ট দেখে আমি শান্তি পাবো। আমি বুঝলাম মঈনুল স্বাভাবিক মানুষ না। ও হয়তো মানুষীক রোগী হবে। ও প্রথম কোপটা যখন আমার দিকে ছুরলো,আমি তখন বুঝে নিলাম। আমার আর সূর্য দেখা হবে না। আমার আর হয়তো বাবাকে বাবা বলে ডাকা হবে না। আমার হয়তো সময় হয়ে গেছে,আমার বাবা-মায়ের কাছে যাওয়ার । কিন্তু ওই যে রাখে আল্লাহ মারে কে। ওর দেওয়া ধারালো দায়ের কোপ আমার বুকে নয় হাতে এসে লেগেছে। আমি ব্যথার চিৎকার করে উঠলাম। হাত চেপে আমি মাটিতে বসে পড়লাম। গলগল করে রক্ত ঝড়তে শুরু করলো! চারিদিকের অন্ধকার আরো অন্ধকার হয়ে এলো আমার চোখে। তখনই আমার বাবাসহ পুলিশদের নজরে পড়লো। তখন বুঝলাম তাঁরা আমাকে আশেপাশেই হয়তো খুঁজছিলো। কিন্তু পায়নি,এখন আমার চিৎকার শুনে ছুটে এসেছে। সবার হাতের টর্চের আলোয় আমি চোখ তুলে তাকাতে পারছিলাম না। বাবা আমাকে তাঁর বুকে তুলে নিলো। আর মঈনুলকে পুলিশ ধরে নিলো। মঈনুল যাওয়া আগে একটা কথা বললো। তোর ওই ঘাড়ের ক্ষতটা শুকানোর আগেই আমি ফিরে আসবো। আর কিছু আমি শুনতে পাইনি। জ্ঞান হারিয়ে বাবার বুকে পড়ে রই। জ্ঞান ফিরতেই দেখি,বাবা,নিলি দাঁড়িয়ে আছে আমার কাছে। নিলির পাশে একটা ব্যাগ। আমি বাবাকে কিছু জিজ্ঞেস করবো! তাঁর আগেই বাবা বলে– তুমি আর এখানে থাকবে না। একটা ঠিকানা দিচ্ছি সেখানে চলে যাবে। আর এসবের কিছু কাউকে বলার দরকার নেই। যা বলার আমি বলে দিয়েছি! তাই তোমার চিন্তা নেই। আমি বাবাকে বললাম– আর কতদিন। বাবা বললো– যতোদিন না এটার সমাধান হয়।

নিজের অতীত শেষ করে লম্বা একটা শ্বাস নিলো রজনী। আর পল্লব, সে এখনো নিজের ঘোরে আছে। সে হয়তো এমন কিছু কখনোই ভাবেনি। পল্লব ভেবেছিলো,মঈনুল হয়তো পাড়ার কোন বখাটে ছেলে হবে। যে রজনীকে বিরক্ত করতো। কিন্তু সে যে রজনীর প্রাক্তন স্বামী হতে পারে! তা যে কল্পনার বাহিরে ছিলো। ততোক্ষণে পল্লব নিজের হাত গুটিয়ে নিয়েছে। আর সেদিকে তাকিয়ে রজনী হাসলো। মানুষ এমনই হয়তো? সত্যিটা জানার পর দয়া দেখাতেও চায় না। অবশ্য ভালোই হয়েছে! জীবনে দয়া কম নেওয়া হলো না! এবার না-হয় সেটাও হারিয়ে যাক।

চলবে,,,

#গোধূলী_শেষে_তুমি_আমি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৯

বাসের পাশাপাশি সিটে বসে আছে দু’জন। কারো মুখেই কোন কথা নেই। আকাশে নেমেছে আঁধার। জানালা থেকে আসা হাওয়া চোখেমুখে আঁচড়ে পড়ছে রজনীর। সে পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে বাহিরের দিকে। কি চলছে তাঁর মনে তা সে জানে না। একসময় রজনী মাথা এলিয়ে দিলো। রজনী চোখ বুজতেই সেদিকে পল্লব এক ঝলক তাকালো। সেও একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো। তারপর নিজেও মাথা এলিয়ে দিলো সিটে। চোখ বুঁজে বললো।

_ নিজের প্রতি এতোটা ঘৃণা কেন রজনী আপনার? যে একটা সত্যি ঢাকতে এতোগুলা মিথ্যা বললেন।

পল্লবের কথায় রজনী বুঁজে রাখা চোখ খুলে তাকালো পল্লবের মুখো-পানে। আলোআঁধারির মাঝে স্পষ্ট নয় পল্লবের মুখখানা। তবুও যতটা রজনী বুঝলো পল্লব তাঁকে ধরে ফেলেছে। সাজানো মিথ্যা গুলো যে এভাবে ধরা পড়ে যাবে! তা রজনী বুঝতে পারেনি। কিন্তু পল্লব সত্যিটা বুঝলো কি করে! তাহলে কি মঈনুল সত্যিটা বলে দিয়েছে। আর ভাবতে পারলো না রজনী। কারণ হঠাৎ পল্লব রজনীর হাতটা আঁকড়ে ধরলো। ধুক করে উঠলো বুক। রজনীকে অবাক করে দিয়ে পল্লব নিজের বুকের মাঝে হাতটা রাখলো। এবার যেন নিশ্বাস বন্ধ হবার যোগাড়। রজনী মোচড়া-মুচড়ি করতেই পল্লব আরো একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেললো। আর সেটা হলো রজনীর অধরখানা ছুঁয়ে দিলো! রজনী কেঁপে উঠলো। ভয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলে, পারলো না পল্লবের শক্ত বাঁধনের জন্য । আরো একটু টেনে নিজের হাতের বাঁধনের আঁটকে নিলো পল্লব। এখন তাঁদের মাঝের দুরত্ব বলে কিছু নেই। রজনীকে আরো অবাক করে দিয়ে পল্লব বললো।

_ এই যে আপনার অনিচ্ছায় আপনায় ছুঁয়ে দিলাম! তাহলে কী আপনি অপবিত্র হয়ে গেছেন। উঁহু হননি। কেউ হয় না। এই যে দেখছেন ব্যস্ত শহর! এই ব্যস্ত শহরের আনাচে-কানাচে এমন ঘটনা অহর-অহর ঘটে। এই যে আমরা যেমন পাশাপাশি বসে আছি,তেমনি আরো অনেকেই বসে। কেউ হয়তো প্রেমিক-প্রেমিকা,কেউ আপনার আমার মতো অল্প জানাশোনা, কেউ হয়তোবা পুরোপুরি অচেনা। আমার মতো হাজার পুরুষ আপনার মতো মেয়েদের সাথে ভিড়ভাট্টার মাঝে সুযোগ খোঁজে। কেউ বা এই পাশাপাশি সিটে থেকে নিজের হাতকে কাজে লাগায়। কোন কোন পুরুষ,প্রেমের মিথ্যা নাটক করে,নগ্ন ছবি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে। সব কিন্তু আমরাই করি। আবার আরো একটা কথা আছে। একজন আর্দশ বাবা কিন্তু একজন পুরুষ,একজন কেয়ারিং স্বামী বা প্রেমিক তাঁরাও পুরুষ। আপনার খুব ভালো একজন শিক্ষক,তিনিও পুরুষ। একজন ভালো তো অন্যজন খারাপ। আমি আমার হাত সরিয়ে নিয়েছি শুধুমাত্র আপনার মিথ্যা শুনে! ঘৃণা করে না। আমি সকালেই আপনার বাবা-র সাথে কথা বলেছি! তিনি আমায় সবটা বলেছেন। কিভাবে আপনি মঈনুলকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন, কীভাবে সে আপনায় কিডনাপ করেছে, সবটা। এমন কী আপনাকে কতদিন আঁটকে রেখেছে সেটাও আমায় আপনার বাবা বলেছে। তাহলে শুধু শুধু মিথ্যা বলার কি দরকার ছিলো। ভেবেছিলেন,আমরাও যদি আপনায় ধর্ষিতা বলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেই? কেন আপনি তো ধর্ষণ হননি,তাহলে এতো ভয় কেন? আর সব থেকে বড় বিষয়, হলেও কি? আপনি নিশ্চয়ই যেচে ধর্ষণ হননি। তাহলে? এই মিথ্যা বলে নিজেকে কতোদিন আড়াল করবেন আপনি? একমাস,দুইমাস, একবছর,বেশি হলে দুই বছর। একদিন না একদিন তো এসবের মুখোমুখি আপনায় হতেই হবে! তখন কী হবে? তাই পিছন থেকে নয়,সামনে থেকে লড়াই করুন। আপনি না অনেক সাহসী, তাহলে এমন ভীতু হয়ে লুকিয়ে আছেন কেন? এবার নিজের আসল রূপে ফিরে আসুন।

কথা শেষ করেই পল্লব আমার হাত ছেড়ে দিলো। কারণ আমরা পৌঁছে গেছি। পল্লব একটা রিক্সা নিলো। আবারও পাশাপাশি আমরা বসলাম। কিছু সময় পর বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। আমি সোজা নিজের ঘরে চলে গেলাম। দরজা আঁটকে বিছানায় নিজের শরীরটা বিছিয়ে দিলাম। তখন পল্লবকে বলা কথাগুলো বাবা-র সাজানো ছিলো। কিন্তু আমি কখনোই ভাবতে পারিনি এমন কিছু হবে। এই সব মিথ্যার মাঝে একটা সত্যি হলো,সত্যিই আমার বাবা-র মেয়ে আমি নই। মঈনুল আমার ক্লাসমেট। আমরা একসাথেই লেখাপড়া করেছি। এমন কি এক পাড়ায় আমাদের বাড়ি। ওর সাথে আমার ভালো কোন সম্পর্ক না থাকলেও টুকটাক মাঝেমধ্যে কথা হতো। আমি নিজের লেখাপড়া ছাড়া তেমন কারো সাথে কথা বলিনি। প্রয়োজন শেষ হতেই কলেজ থেকে বাড়িতে চলে আসি। একদিন বাড়িতে ফেরার পথে মঈনুলকে আমি নেশাগ্রস্ত অবস্থায় মারামারি করতে দেখি। মঈনুল নেশার ঘোরে ওর এক বন্ধুকে ছুড়ি মেরে বসে। আমি ভয়ে তখনই চিৎকার করে উঠি। কোন রকমে বাড়িতে ফিরে বাবাকে সবটা বলে দেই। বাবা শুনে আমায় কলেজে যেতে কিছুদিন বারন করে। আমিও বাবা-র বারন শুনে কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দেই। এক সপ্তাহ পর কলেজে গেলে মঈনুল আমার পথ আঁটকে দাঁড়ায়। আমি জানতে চাইলে বলে! ওর বন্ধু যাকে ও ছুরি মেরেছে, ও নাকি ওর নামে কেস করেছে,আর সাক্ষী হিসেবে আমায় ডাকবে! আমি যেন না যাই। আমি কিছু না বলে ওকে পাশ কাটিয়ে চলে যাই। দুদিন পর হঠাৎ একজন দারোগা আমাদের বাড়িতে আসে জিজ্ঞেসা বাদ করতে। আমি যা দেখেছি সেটাই বলে দেই। এতে মঈনুল আর ওর পরিবার ক্ষিপ্ত হয় আমার উপর। অনেক ভাবে আমাদের হুমকি দেয়। কিন্তু এখানে আমাদের কি করার ছিলো। সত্যি যেটা আমি সেটাই বলেছি এরথেকে বেশি তো কিছু বলিনি। ওকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়,পরে জানতে পারি ও মেয়ে পাচার কারি দলের সাথে যুক্ত। অনেক মেয়েকে নাকি ও পাচার করেছে। পুরো পাড়ায় ওদের মানসম্মান নিয়ে টানাটানি। লজ্জায় ওর বাবা আত্মাহত্যা করে। এর পুরো রাগটাই পরে আমার উপর। বাবা-র মৃত্যু খবর শোনামাত্রই আমার উপর আরো রেগে যায় মঈনুল। ওর বাবা-র দাফনের সময় ওকে নিয়ে আসা হয়। আমার বাবাও সরিক হয় মঈনুলের বাবা-র জানাজায়। মঈনুলকে নিয়ে যাওয়ার সময় মঈনুল বাবাকে বলে! আমাদের সম্মান যেভাবে মাটিতে গড়াগড়ি খেয়েছে,ঠিক সেভাবেই আপনার সম্মান আমি মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়াবো। বাবা এই বিষয়ে আমায় কিছু জানায়নি। ভেবেছে আমি ভয় পাবো। মঈনুল জেলে যাওয়ার পর কিছুদিন মানুষের মুখেমুখে ছিলো তাঁদের আলোচনা। সময়ের সাথে সাথে তা মিলিয়ে গেলো। একদিন সন্ধ্যায় আমি ঘরে পড়ছিলাম। বাবা মায়ের চিৎকার চেচামেচির আওয়াজে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। বাবা-র ঘরের সামনে এসেই আমি থমকে গেলাম! কারণ সেদিন আমি জানতে পারলাম যাকে আমি বাবা বলে জানি,তিনি আমার বাবা নন। এতোদিন জানতাম মা আমার মা নয়, আজ জানলাম বাবা টাও আমার না। এতো কষ্ট আমি মেনে নিতে পারিনি। নিরবে সেখান থেকে সরে এসেছিলাম। ঘরে এসে সেদিন ডুকরে কেঁদেছিলাম। আমার মতো এতো অসহায় হয়তো পৃথিবীতে কেউ নেই। সেদিন মনে হয়েছে মায়ের মৃত্যুর সময় কেন আমার মৃত্যুও হলো না। রাতে বাবা খেতে ডাকতে এলেন! আমার চোখমুখ ফোলা দেখে তিনি বুঝে নিলেন সবটা। তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন। তুই আমায় মেয়ে! এটাই চির সত্যি। কারো কোন কথায় তুই মাথা ঘামাবি না। মানুষ অনেক কথাই বলবে! সবার সব কথা কানে তুলতে নেই। আমি কিছু বললাম না,সবটা নিরবে শুনে গেলাম। বাবা চলে যেতেই আবারও কান্নায় ভেঙে পড়লাম। এই পৃথিবীতে আমার বলতে কেউ নেই! এটাই যেন আমি মানতে পারছিলাম না। কাঁদতে কাঁদতে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। গভীর রাতে ঘুমটা ছুটে গেলো। অসহ্য চোখের ব্যথায় চোখটা মেলতে পারছিলাম না। চোখে-মুখে পানি দিতে কলপাড়ে যা-ই। মুখে একটু পানি ছিটাতেই,কেউ আমাকে পিছন থেকে মুখ চেপে ধরলো। কিছু বোঝার আগেই আমার হাত-পা বেঁধে দিলো। টানা পনেরো দিন আমায় আঁটকে রেখেছিলো মঈনুল। প্রতিটাদিন ও আমায় মানুষিক যন্ত্রণা দিয়েছে। আমি বলতাম আমায় মেরে ফেল। কিন্তু ও হেঁসে বলতো,তোকে এভাবে মারলে তুই তো সহজ মৃত্যু পাবি। কিন্তু তোকে আমি ধীরে ধীরে মারবো। তুই ভেতর বাহির সব দিক থেকে মরবি। সম্মান হারাবি,তারপর নিজে থেকেই মৃত্যুকে বরন করবি। সত্যি সত্যি ও যেটা বলেছিলো,সেটাই করেছে। আমার সম্মান মাটিতে গড়াগড়ি খাইয়ে ও আমায় ছেড়েছে। আমার শরীরে ইচ্ছে করে এমন কিছু দাগ লাগিয়ে দিলো! যা দেখলে সবাই ভাববে আমাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। আর আমাদের দেশে ধর্ষকের থেকে ধর্ষিতার বেঁচে থাকা দায়। আমি ধর্ষিতা না হয়েও আমার গায়ে লাগিয়ে দেওয়া হলো ধর্ষণের কালি। সকাল-বিকাল আমাকে কেউ নাম ধরে ডাকতো না ডাকতো! শুনেছিস,ওই যে রবির মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে। আজ থেকে ও
ধর্ষিতার খাতায় নাম লেখালো। আমার এতো সুন্দর নামের অর্থ সেদিন আমি বুঝলাম। রজনী অর্থ রাত। তাহলে আজ থেকে আমাকে রাতের আঁধারে লুকিয়ে থাকতে হবে। রজনী এখন থেকে রাতের আঁধারে লুকাবে। আমি ভীতু ছিলাম না কখনোই, কিন্তু সমাজের ধারালো কথা আমায় ভীতু তৈরি করলো। আস্তে আস্তে আমি নিজের সাথে যুদ্ধ করতে রইলাম। কিন্তু হেরে গেলাম। সব ছেড়ে আমি আত্মহত্যা বেছে নিলাম! কিন্তু সেখানেও আমি ব্যর্থ হলাম। বাবা আমাকে বুঝিয়ে আজ এতদূর পাঠিয়ে দিলো। এতদূর এসে লাভ কি হলো! সেই তো সত্যর মুখোমুখি আবারও আমাকে দাঁড়াতে হলো। হয়তো এখন পল্লব আমাকে শান্ত করতে এগুলো বলছে। কিন্তু ঠিক মনে মনে সেও ভাবছে,একজন পুরুষ নিশ্চয়ই পনেরো দিন আমায় শুধু শুধু বেঁধে রাখেনি। কারণ একজন পুরুষ আর একজন মেয়ে আগুন_মোম। পাশাপাশি থাকলে গলতেই হবে। আর পুরুষ জাত হায়নাদের মতো। মেয়ে দেখলেই হামলে পড়ে। সেখানে মঈনুল কিছুই করেনি এটা কতটা সত্যি। এতোকিছু করার পরেও মঈনুলের শান্তি হয়নি! এখন আমায় খুন করবে। তাঁর কারণ বাবা ওর মা’কে হুমকি দিয়েছে। বাবা ভীতু,কিন্তু মেয়ের অসহায়ত্ব দূর করতে তিনিও হয়তো সাহসী হয়ে উঠেছে। এবার হয়তো মঈনুল আমায় ধরলে আর ছেড়ে দিবে না। মৃত্যুটা হয়তো ওর হাতেই। আমি জানি না,লিমা আন্টিরা আমার কি হয়৷ শুধু জানি বাবা-র পরিচিত । তাহলে কি লিমা আন্টি সেই, যাঁর জন্য মা নিজের অনেক জমি বিক্রি করে তাঁকে টাকা দিয়েছিলো। আমি জানি না,এবার আমি পল্লবের মুখোমুখি কিভাবে হবো। সত্যিটা তাঁর সামনে ছিলো, আর আমি মিথ্যা বলে গেলাম একের পর এক।
এটাই আমার আসল এবং লুকিয়ে রাখা অতীত। বাকিগুলো নিজের এই অতীত লুকাতেই মিথ্যা বলা। কেমন হবে আগামী সকাল আমার জন্য?

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here