গোধূলী_শেষে_তুমি_আমি,১২,১৩

0
180

#গোধূলী_শেষে_তুমি_আমি,১২,১৩
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ১২

“ওহে শ্যামবতী মেয়ে
তোমার ডাগর ডাগর আঁখিখানায়।
আমার নামে আজ থেকে কাজল দিও।”

হঠাৎ রজনী পল্লবের বুক থেকে হাতটা সরিয়ে নিলো। কড়া সুরে বললো।

_ কি বলছেন আপনি? মাথা ঠিক আছে।

_ একদম ঠিক আছে,কিন্তু তুমি এভাবে দূরে সরে থাকলে হয়তো মাথা ঠিক থাকবে না।

_ কি সব আবোল তাবোল বকছেন। আপনি একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি,তাই এমন কিছু করবেন না,যাতে পরে আফসোস করতে হয়।

_ তোমার কি তাই মনে হয় রজনী।

_ দেখুন আবেগে ভেসে এখন সব কিছু রঙিন লাগছে। আবেগ ফুরিয়ে যখন বাস্তবতা সামনে আসবে,তখন সব ভালোবাসা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যাবে।

_ আমার আবেগের বয়সটা আমি অনেক আগেই পার করে এসেছি।

_ ভুল বলছেন পল্লব আপনি। প্রতিটা মানুষ প্রথমে আবেগে ভাসে,তারপর বাস্তবতা শেখে। তাতে তাঁর বয়স সতেরো হোক বা সাতাশ। হ্যা হয়তো সতেরো বছরের কিশোরদের মতো সাতাশ বছরের যুবক পাগলামো করে না! কিন্তু তাঁরা শুরুতে আবেগেই গা ভাসিয়ে স্বপ্ন দেখে।

_ আমার বয়স না সাতারো,না সাতাশ! আমার রানিং বয়স ঊনত্রিশ। তাই তুমি আমার সম্পর্কে যা ভাবছো,সব ভুল ভাবছো রজনী । একটু আগেও যে দ্বিধা ছিলো! তা তোমার এই মুহূর্তের কথায় কেটে গেছে। আমি সত্যি তোমায় ভালোবাসি,সেটা আমি অনুভব করতে পারছি।

_ ভুল আপনি! হুট করে কখনো ভালোবাসা হয় না! যা হয় তা হলো প্রেম। আর প্রেম মানেই ক্ষনিকের মোহ।

_ তুমি কিন্তু আমার ভালোবাসাকে অপমান করছো রজনী।

_ যদি মনে হয় অপমান করছি, তো হ্যা করছি। কারণ আপনাদের মতো ছেলেরা আমাদের মতো মেয়েকে ব্যবহার করতে পারে, ভালোবাসতে পারে না। বেশি হলে তাঁদের বিছানার সঙ্গী করতে পারে,এর থেকে বেশি কিছু না।

_ রজনী।

চিৎকার করো উঠলো পল্লব। কিন্তু সেই চিৎকারে কোন ভাবান্তর নেই রজনীর মাঝে। সে আগের মতোই কঠিন চোখে চেয়ে রইলো। কারণ এখন যদি একটু ভয় তাঁর চোখে পল্লব দেখতে পায় তাহলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। এটা ঠিক পল্লবের প্রতি রজনীরও একটা দুর্বলতা রয়েছে। কিন্তু সেটা খুব গোপনে হৃদয়ে লুকানো। কোন মেয়ের সাধ্য আছে এমন ছেলের প্রতি দূর্বল না হওয়ার। যে না বলতেই সব কষ্ট বুঝে যায়,যত্ন করে সকল ক্ষত সারিয়ে তোলার চেষ্টা চালায়। কিন্তু অতীত! অতীত কখনোই রজনীর পিছু ছাড়বে না। তাই সে পল্লবের সুন্দর জীবনটা তাঁর কালো অতীত দিয়ে ঢেকে দিতে পারে না। তাই জন্ম নেওয়া সুপ্ত অনুভূতি বুকের মাঝেই দাফন করা হয়েছে। নিজেকে আরো কঠিন করে আঙুল উঁচু করে হিসহিসিয়ে রজনী বললো–

_ ভুলে যাবেন না আমি আপনাদের বাড়ির আশ্রিতা। আর আমার অতীত কী? আমাকে নিয়ে মানুষ ফুর্তি করার কথা ভাবতে পারে! ভালোবাসতে বা সংসার করার কথা ভাবে না। ওসব গল্পে সিনেমায় হয়,বাস্তব জীবনে নয়।

_ রজনীইই

আর নিজেকে সামলাতে পারলো না পল্লব। নিজের শক্ত হাতের চড় বসিয়ে দিলো রজনীর নরম গালে। হঠাৎ এমন কান্ড হতে পারে তা হয়তো রজনী কল্পনাতেও ভাবেনি। তাই তো নিজেকে সামলে উঠতে পারেনি, পল্লবের পুরুষালী শক্ত হাতের থাপ্পড়ের কাছে! হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পরে গেলো সে। ঠোঁটের কোণা ফেটে ছুটতে রইলো লাল টুকটুকে রক্ত। শ্যামলা গালে বসে গেলো পাঁচ আঙুলের দাগ। প্রতিটা দাগ স্পষ্ট জানান দিলো কতোটা কষ্ট পেয়ে চড় বসিয়ে দিলো পল্লব। কিছু আঘাত রাগ থেকে আসে আর কিছু আঘাত কষ্ট থেকে। তুমি সেটা কীভাবে নেবে সেটা তোমার একান্ত বেপার।
তাঁর ভালোবাসাকে এভাবে রজনী অপমান করলো। গ্রহণ না করতো ফিরিয়ে দিতো! কিন্তু অপমান করলো কেন? সে তো একবারও জোর করেনি। সে তখন কেন ওসব বললো তাও জানে না। কিন্তু সে যদি জানতো রজনী তাঁকে এতোটা নিচুস্তরে দেখে,তাহলে কখনোই নিজের অনুভূতি গুলো প্রকাশ্যে আনতো না। কিভাবে বললো কথাটা রজনী! সে তাঁকে বিছানার সঙ্গী বানাতে পারে মাত্র আর কিছু না। তাঁর ভালোবাসা কি সত্যি এতোটা ঘৃর্ণিত। যা দেখলেই মানুষ বুঝতে পারে সঠিক না ভুল। তাহলে কি সে নিজের অনুভূতি প্রকাশ সঠিক ভাবে করতে পারেনি,নাকি রজনী বুঝতে পারেনি। রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে রজনীকে টেনে তুললো পল্লব। হাত টেনে ঘরের মাঝে টেনে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। দরজার ধারাম আওয়াজে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো রজনীর। ধুকধুক করা বুকটা নিজের গতিবিধি বারিয়ে দিলো কয়েকগুণ। রজনীর শুধু মনে হলো একটাই কথা। মানুষের রাগের মাথায় নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে! তাহলে কি পল্লবও হারিয়ে ফেলেছে। রজনীকে বেশি ভাবার সময় দিলো না পল্লব। ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিলো। ভয়ে রজনী গুটিয়ে নিলো নিজেকে। রজনীর দুই হাত নিজের হাতের মাঝে আবদ্ধ করে রজনীর দিকে ঝুকে পড়লো পল্লব। রজনীর চোখে চোখ রাখলো। পল্লবের প্রতিটা নিশ্বাস আছরে পরছে রজনীর মুখে। প্রতিটা নিশ্বাস যেন রজনীর ভয়কে বারিয়ে দিচ্ছে কয়েকগুণ। হাতের বাঁধনটা আরো শক্ত করলো পল্লব। রজনীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে।

_ আমি চাইলে তোমার কপাল ছুঁয়ে দিতে পারি পুরুষালি চাহিদা নিয়ে।

কথা শেষ করেই একটা চুমু দিলো রজনীর কপালে। আবার মুখ তুলে কানে কানে বললো —

_ আমি চাইলে তোমার গাল ছুঁয়ে দিতে পারি নিরর্দ্বিধায়।

এবারও একি কাজ করলো পল্লব, রজনীর গালে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে। আবারও বলে উঠলো।

_ আমি চাইলে তোমার ওই কেটে যাওয়া ঠোঁট ছুঁয়ে দিতে পারি কামনার বসে।

কথা শেষ হতেই তা কাজে সম্পূর্ণ করলো পল্লব। আবারও বললো সে।

_ আমি চাইলে তোমার গলার মাঝে মুখ ডুবাতে পারি নিজের পরুষত্ব জাগিয়ে তুলতে।

প্রতিবারের মতোই এবারও রজনীর গলায় ডুবিয়ে দিলো নিজের মুখখানা। আর রজনী তখন বরফের মতো জমে উঠলো। সে যেন একটা পাথরের মুর্তি হয়ে পড়ে রইলো। গলা থেকে মুখ তুলে পল্লব বললো–।

_ আমি চাইলে এমন অনেক কিছুই করতে পারি। রজনী আমি হিংস্র হায়নাদের মতো তোমার শরীরের প্রতিটা অংশ খুবলে খেতে পারি। কারণ আমি পুরুষ। আমি যতটা ভালো, ঠিক ততোটাই খারাপ। তাঁর জন্য আমাকে মিথ্যা বা ছলনার আশ্রয় নেওয়ার কোন দরকার নেই।এমন কি তোমাকে আমার ভালোবাসার ফাঁদে ফেলতেও হবে না। কারণটা নিশ্চয়ই তোমার অজনা নয়। আমি জানি আমি যা করলাম,তা ভুল নয় পাপ। কিন্তু তোমাকে সঠিকটা না বোঝালে তুমি কখনোই বুঝতে না,উল্টে আমায় ভুল বুঝতে! যেমনটা এখন বুঝছো। আমি আরো অনেক কিছু করলেও তোমার কোন ক্ষমতা নেই আমাকে কিছু বলার। কেউ যদি কিছু ফ্রী পায়,তাহলে কেউ নিশ্চয়ই টাকা খরচ করবে না। আমাদের দেশে আবার ফ্রী জিনিসগুলোর একটু বেশি চাহিদা। তাহলে আমি তো চাইলেই তোমাকে আমার বিছানার সঙ্গী করতে পারি,তাহলে ভালোবাসার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কি মানে? চাইলে আমিও মঈনুলের মতো হতে পারি। তোমাকে খুন করে গুম করতে মঈনুলের থেকেও আমার কম সময় লাগবে। কিন্তু মঈনুল মাঈনুলের জায়গায়, আমি আমার। রক্ষক আর ভক্ষক দু’জনেই কিন্তু পরুষ মানুষ হয়। তাই খারাপকে যদি ভালোর সাথে গুলিয়ে ফেলো,সেটা তোমার মনের সমস্যা ! তোমার কঠিন রোগ এটা।আমি তোমাকে ভালোবাসি,মনের গভীর থেকে অনুভব করি এসব মিথ্যা বলার তো কোন প্রয়োজন নেই। তাহলে বুঝে নিতে হবে আমি কেন এসব বললাম। মানেটা হলো আমি তোমায় সত্যি ভালোবাসি।

একদমে কথাগুলো শেষ করেই পল্লব উঠে দাঁড়ালো। এক পলক রজনীর দিকে চেয়ে হঠাৎ দেয়ালে সজোরে আঘাত করে বসলো। সর্বশক্তি দিয়ে নিজের হাতখানা ক্ষতবিক্ষত করলো। হাতের মাংস তৎক্ষনাৎ ফেটে গলগল করে রক্ত বের হতে রইলো। সেই দিকে কোন নজর না দিয়ে আবারও রজনীর দিকে তাকালো। রজনী তখন ভয়ে আরো নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। যেটা দেখে পল্লব আবারও দেয়ালে সজোরে আঘাত করলো। কিন্তু এবারের আঘাতটা যেন বহুগুণ! তাই তো দেয়ালে কেমন বিকট আওয়াজ হলো। ঘরের প্রতিটা জিনিস যেন কেঁপে উঠলো সেই আঘাতে, সাথে কেঁপে উঠলো রজনী। পল্লবের পাগলামী দেখে নিজেকে সামলে রজনী এগিয়ে আসতে নিলেই পল্লব অন্য হাত দিয়ে ইশারা করলো।

_ দয়া দেখানোর কোন দরকার নেই। আপনি ভুলে যাচ্ছেন আপনার একটু আগের বলা কথাগুলো। আপনি আমাদের বাড়ির আশ্রিতা! তাই মালিকের ছেলের প্রতি দয়া দেখানোর কোন প্রয়োজন নেই। থাকুন নিজের অতীত আর কালো অধ্যায় নিয়ে। আমি আর কখনোই আপনাকে ডিস্টার্ব করবো না। আমি ভুল জায়গায়, সাথে ভুল মানুষের কাছে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে ফেলেছি। তাই আমি দুঃখিত। আর কখনোই আসবো না।

পল্লব গটগট পায়ে দরজা খুলে চলে গেলো। আর সেখানেই মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়লো রজনী। কি করলো সে। দূরে সরাতে গিয়ে যে মানুষটাকে সে আঘাত দিয়ে ফেলেছে। রজনীর থেকে একটু দূরেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পল্লবের হাতের তাজা রক্ত।এগিয়ে গিয়ে রক্ত ছুঁয়ে দিতেই শরীর শিউরে উঠলো। রক্তমাখা হাতের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো রজনী। কি হলো তাঁর সাথে। মানুষটা এমন পাগলামি কেন করলো? কেন বুঝতে চাইছে না বাস্তবতা বড্ড কঠিন। বাস্তবতা মুখে বলাটা যতো সহজ, করতে পারা ঠিক ততোটাই কঠিন।

চলবে,,

#গোধূলী_শেষে_তুমি_আমি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ১৩

খাবার টেবিলের চারকোণে বসে আছে চারজন। কারো মুখেই কোন কথা নেই। কেউ থম মেরে আছে,তো কেউ গম্ভীর, কেউবা চুপচাপ! আর এদের মাঝে নিজেকে অসহায় লাগছে লিমা বেগমের। রজনীকে আজ ঘর থেকে জোর করে ডেকে এনেছে লিমা বেগম। তাই তাঁকে বাধ্য হয়ে আজ সবার সাথে রাতের খাবার খেতে বসতে হয়েছে। অবশ্য আরো একটা কারণ আছে,সেটা আমরা পরে জানবো। রজনী মুখে এক লোকমা ভাত দিয়ে আনমনে কি যেন ভাবছে। ভাতের প্লেটে তাঁর হাত থাকলেও, মন তাঁর অন্য কোথাও। সে একইভাবে ভাত শুধু নেরে যাচ্ছে। সেদিকে একবার ভ্রুকুচকে তাকালো আমজাদ আলী। তাঁর এই মেয়েটাকে একদম পছন্দ না। কেমন করে বেহায়ার মতো খাচ্ছে। কোন দ্বিধা নেই নিজের মাঝে। এতোদিন ঢং করে আড়ালে ছিলো, আজ সময় সুযোগ বুঝে ঠিক তাঁদের সাথে খেতে বসেছে। এসব মেয়েদের সে ভালো করেই জানে। এদের মতিগতি খুব খারাপ। রজনীর দিক থেকে চোখ সরিয়ে তিনি পল্লবের দিকে তাকালেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললো।

_ তোমার হাতে কি হয়েছে

হঠাৎ আমজাদ আলীর কথায় মুখের সামনে নেওয়া এক লোকমা ভাত আবারও প্লেট পরে গেলো রজনীর। সে ভয়ে ভয়ে পল্লবের দিকে তাকালো। কিন্তু পল্লবের কোন ভাবান্তর নেই। সে একমনে বাহাতে চামচ ধরে খাবার মুখে দিচ্ছে। বিরক্ত নিয়ে আমজাদ আলী আবারও প্রশ্ন করলো।

_ কি বললাম তোমার কানে যায়নি।

এবার চোখ তুলে তাকালো পল্লব। চামচটা প্লেটে রেখে বাবা-র চোখে চোখ রাখলো।

_ আমার ভালো খারাপের খবর কবে থেকে নিতে শুরু করলেন আপনি?

_ পল্লব

চিৎকার করে উঠলেন আমজাদ আলী। সেই চিৎকার লাফিয়ে উঠলো রজনী সাথে লিমা বেগম। কিন্তু পল্লব স্বাভাবিক। এদের এমন আচরণ দেখে লিমা বেগম অভ্যস্ত। তবুও তিনি ভয় পায়। আর সেখানে তো রজনী চুনোপুঁটি। রজনী কোন মতে চোখ তুলে তাকালো আমজাদ আলীর দিকে। তাকাতেই বুঝতে পারলো আমজাদ আলীর রাগ যেন ঝড়ে পড়ছে সর্বস্র দিয়ে। সে আবারও চোখ নিচু করলো। কখন জানি ঝড়টা তাঁর দিকে মোড় নেয়। কারণ হাতটা তো তাঁর জন্য এমন করেছে পল্লব। রজনী ভাবনা বাদ দিয়ে কথা শোনায় মনোযোগ দিলো। তখন আবারও আমজাদ আলী বললো–

_ আজকাল কি একটু বেশি ব্যয়াদপ হয়ে যাচ্ছো দেখছি। বাবা-র মুখেমুখে কথা বলা। তা ছাড়াও দেখলাম বাড়িতে আজকাল তুমি বেশি থাকছো! বেপারটা কি অন্য কিছু।

বাবা-র ইঙ্গিত কি সেটা ভালোই বুঝলো পল্লব। তাই কথাটা ঘুরাতে সে বললো।

_ আপনিই বলেছিলেন,আপনি যখন বাড়িতে থাকবেন! তখন হাজার কাজ থাকলেও যেন আমি বাড়িতে থাকি। আজ যখন আপনি অন্য কিছু ইঙ্গিত করছেন,তাহলে ঠিক আছে আমি কাল চলে যাবে।

নিজের খোঁচা মারা কথায় বেশি সুবিধা করতে পারলেন না। তাই আমজাদ আলী বুঝলেন হয়তো আন্দাজে মারা ঢিলটা ভুল। তাই তাঁর গলা পরিষ্কার করে তিনি বললেন।

_ ঠিক আছে ঠিক আছে। কোথাও যেতে হবে না। পরশু আমাদের বিবাহবার্ষিকী। অনুষ্ঠানটা না হয় শেষ করে যাও।

_ দেখা যাক কি করি।

এই কথা বলেই পল্লব উঠে দাঁড়ালো। পল্লবকে উঠতে দেখে লিমা বেগম বললো।

_ কিরে কিছুই তো খেলি না। একে তো বাহাত দিয়ে খাচ্ছিলি,এখন আবার উঠে যাচ্ছিস। ভালোমতো তো খাওয়া হলো না।

_ যা খেয়েছি তাতেই হবে।

তারপর পল্লব চলে গেলো নিজের ঘরে। আর লিমা বেগম স্বামীর সাথে তর্ক করতে রইলেন। কেন তিনি বারবার ছেলেটাকে রাগায়। কি জন্য সব সময় এতো শাসনে রাখে ছেলেটাকে। ছেলে বড় হয়েছে কেন সে ভুলে যাচ্ছে। তাদের এসব কথার মাঝে নিজেকে খুব অসহায় লাগছে রজনীর। তাই সে কোনরকম বিভ্রান্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

_ আআন্টি আমি ঘরে যাচ্ছি।

কথাটা বলতে দেরি পথ অতিক্রম করতে দেরি নেই। আর রজনীর কান্ড দেখে আমজাদ আলী রেগে গেলেন।

_ একটুও ভদ্রতা নেই মেয়েটার মাঝে। খাওয়া শেষ আর উঠে গেলো।

স্বামীর এমন কথায় প্রতিবাদ করে উঠলো লিমা বেগম ।

_ আমরা এখানে কথা বলছি,বাচ্চা মেয়েটা কি করবে এখানে। আমাদের কথার মাঝে থাকলে আরো অভদ্র দেখাতো। তাই তো চলে গেছে। ও না গেলে তুমি আরো ওকে কথা শুনাতে। এই জন্যই মেয়েটা চলে গেছে।

_ এখনো মানুষ চিনলে না লিমা তুমি।

_ এতো চিনে লাভ কি আমার? সেই তো তোমার মতো মানুষের সামনে খারাপ আচরণ করতে হবে। যেটা আমি কোনদিনও পারবো না। থাকো আমি গেলাম।

লিমা বেগমও চলে গেলেন,অবশেষে তাঁর পিছুপিছু আমজাদ আলীও চললেন।

————-

সময় ঘড়িতে রাত একটা সাত। ঘরের মাঝে পায়চারি করছে রজনী। তাঁর কিছুতেই ঘুম আসছে না। পল্লব নিজের হাতে কোন ঔষধ তো দূর কোন ব্যান্ডিজও করেনি। হাত ফুলে টুইটুম্বুর। এভাবে অবহেলা করলে হাতে ইনফেকশন হতে পারে যখন তখন। নিজের জন্য অন্য কারো এতো বড় আঘাত হয়েছে এটা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না রজনী। সে কিছুক্ষণ আগে পল্লবের ঘরের সামনে থেকে ঘুরে এসেছে । পল্লবের ঘরের লাইট জ্বলছে দেখে একটু চুরি করে উঁকি মেরেছিলো! তখন দেখেছে,কীভাবে পল্লব হাতের ব্যথা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছে। চোখমুখ খিঁচে হাত ধরে বসে ছিলো। ভয়ে আর দ্বিধায় ঘরে ঢুকতে পারেনি। পল্লবের ব্যথাতুর নাকমুখ কোঁচকানো যেন রজনীকে একটুও শান্তি দিচ্ছে না। না আর না। এবার যদি তাঁকে আরো একটা থাপ্পড় খেতে হয়,সে খাবে। তবুও পল্লবের হাতে মেডিসিন লাগাতে হবে। রজনীর ক্ষতগুলো সারাতে মানুষটা কতকিছু করলো! আর তাঁর বেলায় কেন সে বসে থাকবে। তাও আবার তাঁর জন্যই যখন ক্ষতিটা হয়েছে পল্লবের। তাই একবুক সাহস নিয়ে পা বারালো পল্লবের ঘরের দিকে। পল্লবের মতো তো আর রজনী ডাক্তার না,তাই তাঁরা গ্রামে বসে যেভাবে আঘাত গুলো সারানোর জন্, যা প্রয়োগ করতো তাই করবে। হেক্সিসল। হ্যা হেক্সিসল লাগাবে পল্লবের হাতে। একদিনেই ব্যথা নিরাময় হবে ইনশাআল্লাহ। রজনীর ঘরের বাম দিকের দুটো রুম তারপর পল্লবের রুম। রজনীর পাশের রুমটা পল্লবের বোন পলির। তাঁর পাশের রুমটা কার জানা নেই। আর তাঁর পরের রুমটা পল্লবের। পুরো বাড়ি অন্ধকারে ঢেকে আছে। ড্রইংরুমে ডিম লাইটের আলোয় কিছুটা স্পষ্ট চারদিক। এক-পা দু-পা করে পল্লবের ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। একটু আগে সঞ্চয় করে আনা সাহস হঠাৎ করেই ফুস হয়ে গেছে। এবার, এবার কি করবে। হঠাৎ করেই বুকে ধুকপুক করতে শুরু করলো। এই হার্টবিট টাও মাঝে মাঝে নিজের সাথে বেঈমানী করে। তুই আমাকে সাহস দেওয়ার বদলে ভিতু করে দিস কেন? কোথায় তুই আমার শরীরের অংশ হয়ে আমায় সাহস দিবি! তা না করে আমাকে ভয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিস। তোকে তো পরে দেখে নিবো,আগে উনাকে দেখে নেই।

_ কথাগুলো সাজানো হলে এখান থেকে চলে যান, আমার অসুবিধা হচ্ছে।

পল্লবের এহেন কথায় রজনী ভরকে গেলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো কথাটা কোথা থেকে এলো। যখন বুঝলো কথাটা পল্লবের ঘর থেকে আর পল্লব বলেছে,তখন সে ভাবলো!
সে তো দরজার এপাশে আছে! তাহলে পল্লব বুঝলো কি করে সে এখানে? আর বিরক্ত করলো কি করে? সে তো এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো,কোন শব্দ তো করেনি। মনকে তাহলে একটু জোরে শাসন করা হয়ে গেছে কি?ইসস না হলে তো বুঝতে পারতো না সে এখানে আছে। মনকে আরেক দফা গালাগাল দিলো। কিন্তু পরে নিজেই বোকা হলো। সে তো মনে মনে কথা বলেছে তাহলে?

_ এখনো দাঁড়িয়ে কি করছেন? আমি কিন্তু আপনায় যেতে বলেছি এখান থেকে। লুকিয়ে লুকিয়ে পরপুরুষকে দেখা কি আপনার পেশা নাকি। খাবার টেবিলে খেয়াল করলাম,কেমন করে আমাকে দেখছেন। মনে হলো যেন আমাকে খেয়েই ফেলবেন।

রজনী এবার দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো।

_ আপনিও কি আমায় দেখছিলেন নাকি? না হলে বুঝলেন কি করে আমি আপনায় দেখছি। আর আমি আপনাকে বিরক্ত কোথায় করেছি। আমি তো চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম।

_ কি ভাবছিলেন।

_ ওই তো কীভাবে ঘরে ঢোকা যায়।

_ তাঁর মানে আপনি স্বীকার করছেন, আপনি ঘরে ঢোকার জন্য এতোক্ষণ বাহিরে অপেক্ষা করছিলেন।

_ হ্যা,না মানে না।

_ হা হা হা হা,এভাবে নিজেকে উপস্থাপন না করে চলে যান।

_ আআমি তো এখানে চিকিৎসা করতে এসেছি।

অনেক ভয়ে ভয়ে কথাটা বললো রজনী। রজনীর ভয় পাওয়া চেহারার দিকে পল্লব তাকালো। নিজেকে সামলে সে বললো।

_ আপনি কি ডাক্তার নাকি,যে চিকিৎসা করতে এসেছেন।

_ না, ডাক্তার ছাড়া কি চিকিৎসা করা যায় না৷ তাহলে আপনি তো চোখের ডাক্তার, আমার ঘা গুলোর চিকিৎসা কেন করলেন?

_ মানে

_ মানে কিছু না,এই যে দেখছেন হেক্সিসল এটা দিয়ে আপনার চিকিৎসা করবো।

_ উঁহু, এটা দিয়ে চিকিৎসা

_ হ্যা, বিশ্বাস করেন খুব ভালো হবে।

_ ভালো হবে,আপনি জানেন এগুলো ক্ষতে দিলে কতটা কষ্ট হয়।

_ আরে একটু পর ঠান্ডা হয়ে যাবে।

_ কিন্তু যতোটা সময় কষ্ট হবে ততোটা সময়ের দায় কে নিবে।

_ কেন আমি

_ আপনি কীভাবে?

_ পুরো সময়টা আমি চেষ্টা করবো আপনার হাতে বাতাস করার।

_ হায় আল্লাহ, কাকে মন দিয়ে বসলাম। কথাটা মনে মনে বললো পল্লব। কিন্তু রজনীকে বললো।

_ আপনার এই ভুলভাল চিকিৎসা দূরে রাখুন।

_ একদম না,দেখুন কি হয় এবার।
এই কথা ব’লেই পল্লবের হাত ধরে খাটের এক কোণে বসালো। পল্লব শুধু চেয়ে দেখলো রজনীর কান্ড। তুলো ছিঁড়ে তাতে কিছুটা হেক্সিসল মিলিয়ে পল্লবের পুরো হাতে মাখিয়ে দিলো! আরো একটু দিতে যেতেই পল্লব আহহ বলে চিৎকার করলো।

_ উফফ রজনী এটা আপনি কি করলেন আমার হাত জ্বলে যাচ্ছে। আল্লাহ।

এই কথা বলেই পুরোঘরে হাত নিয়ে হাঁটতে রইলো। আর হাতটা ঝাঁকাতে রইলো। আল্লাহ এতো জ্বলছে কেন ফু-ফু-ফু।

_ একদম ঠিক হয়ে যাবে। অনেক জ্বালা করছে।

_ না জ্বলবে কেন মজা লাগছে। আপনার কি মনে হয়,সিনেমার নায়িকারা নায়কের ক্ষত জায়গায় মলম লাগায় আর নায়ক ভেলকার মতো তাকিয়ে থাকে! আমি ওভাবে তাকিয়ে থাকবো,আর আমার ব্যথা অনুভব হবে না। ওরে ওরা নায়ক আর আমি মানুষ। ওদের ব্যথা নেই আমার আছে। আল্লাহ কি জ্বালানী দিয়ে জ্বালিয়ে দিলো আমায়।

_ ওভাবে বলছেন কেন? আমি তো

_ মাফ করেন,চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুন। আর না হলে আমার সামনে থেকে যান।

_ এদিকে দেখি আপনার হাতটা।

জোর করে পল্লবের হাতটা নিজের দিকে আনলো। মুখ দিয়ে ফুঁ দিতে রইলো। অনেকটা সময় পর হাতটা শীতল হয়ে গেলো। কিন্তু রজনী তখনো ফুঁ দিচ্ছে। আর পল্লব সেই শীতল পরশ অনুভব করছে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here