গ্যাসবেলুন #পর্ব_১০,১১ শেষ

0
1402

#গ্যাসবেলুন
#পর্ব_১০,১১ শেষ
লেখাঃ Nobonita Ferdows
১০

“ব্লাউজের পিঠ এতদুর পর্যন্ত খোলা কেনো? আসার থেকে তো দিনরাত এলোচুলে লাফায় বেড়াইতে দেখলাম, আজকে আবার খোঁপা? রাস্তার লোকদের ধবধব সাদা পিঠ দেখানোর শখ হইছে?” দাঁতমুখ খিঁচিয়ে হড়বড় করে বললো অরূপ।
.
অরণী এমন কিছুর জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলোনা। হতণম্ব হয়ে অরূপের দিকে তাকিয়ে আছে সে, কথা বলার শক্তিটা পর্যন্ত নেই তার। চোখের কোণায় পানি এসে গিয়েছে তার।
.
অরূপ অরণীর চুলের কাটা টা অরণীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে রিকশা ডাকলো। রিকশায় উঠে বসে অরণীর দিকে তাকিয়ে বললো, “উঠে পড়ুন!”
.
অরণী স্বাভাবিক গলায় বললো, “আমি যাবোনা কোথাও!”
.
অরূপ চোখ কটমট করে তাকিয়ে বললো, “কি বললেন?”
.
“আমি আপনার সাথে কোথাও যাবোনা!”
.
“কথা বাড়াবেন না। নাহলে আপনাকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে রিকশায় বসাবো!”
.
অরণী কঠিন মুখে রোবটের মতো উঠে বসলো রিকশায়।
.
“মামা, মগবাজার যাবো!”
.
অরণী বুঝতে পারলোনা বাইক থাকতে অরূপ তাকে নিয়ে রিকশায় কেনো উঠলো। মগবাজারে কেনো যাচ্ছে তারা? সে কি প্রশ্ন করবে? অবশ্য করলেও ব্যাঙ্গাত্মক কোনো উত্তরই পাবে!
.
“মগবাজার কেনো যাচ্ছি আমরা?”
.
“বিয়ে করতে!”
.
অরণী তাজ্জব হয়ে বললো, “জি?”
.
“আপনার এত কৌতুহল কেনো? সঙ্গে যাচ্ছেন, এখন চুপচাপ বসে থাকুন!”
.
অরণীর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। কিন্তু সে কিছুই বলতে পাচ্ছেনা৷ এই ছেলেটার ওপর রাগ দেখানোর অধিকার কি তার আছে?
.
“আপনার বাবাকে যদি এখন আমি ফোন করে বলি যে আমি আপনাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি, উনি কি করবেন?”
.
অরণী ভ্রু কুঁচকে বললো, “আপনার মাথা কি পুরোপুরি খারাপ?”
.
“না। এখনো হয়নি। তবে, হবে মনে হচ্ছে!”
.
অরণী বিরক্তমুখে বাইরের দিকে তাকালো। বাইরে ফোটা ফোটা বৃষ্টি পড়ছে৷ শ্রাবণ মাসে ঝুমঝুমান্তি বৃষ্টি হয়না, টিপটিপ বৃষ্টি হয়!
.
“আচ্ছা অরণী, তুমি কখনো ঝুম বৃষ্টিতে রাস্তার পাশে টঙ্গে দাঁড়িয়ে গরম গরম সিঙ্গারা আর চা খেয়েছো?”
.
“না!”
.
“আজ খাবে?”
.
“সিঙ্গারা আর চা নাহয় খাওয়া যাবে! কিন্তু ঝুমবৃষ্টিতে না, এমন টিপটিপ বৃষ্টিতে খেতে হবে!”
.
“ঝুমবৃষ্টি হবে। আর ঘন্টা দুয়েক এর মাঝেই তুমুল বৃষ্টি নামবে, কুত্তা-বিড়াল বৃষ্টি নামবে।”
.
“কি বৃষ্টি নামবে?” চোখ কুঁচকে অরণী প্রশ্ন করলো।
.
“কুকুর-বিড়াল বৃষ্টি; rain cats & dogs! মানে মুষলধারার বৃষ্টি।”
.
অরণী হেসে ফেললো। সে হঠাত হাসি থামিয়ে খেয়াল করলো অরূপ এতক্ষণ ধরে তাকে তুমি করে সম্বোধন করছে। অথচ তার একমুহূর্তের জন্যেও মনে হয়নি, তাদের মধ্যে সম্পর্কটা এতটাও কাছের হয়ে ওঠেনি!
.
“মামা, সামনে বায়ে সাইড করেন!”
.
রিকশা থামলো মগবাজার কাজি অফিসের সামনে। অরূপ ভাড়া মিটিয়ে অরণীর হাত ধরে বললো, “চলো!”
.
“এখানে কেনো?”
.
“বললাম না, বিয়ে করতে!”
.
“আপনি কি আমার সাথে ঠাট্টা করছেন?”
.
“তুমি যা মনে করো!”
.
অরূপ কাজি অফিসে ঢুকতে ধরে থমকে দাঁড়ালো!
.
“আচ্ছা শুনো, এক কাজ করো, তোমার বাবাকে একটা ফোন করো!”
.
“বাবাকে? কেনো?”
.
“আরে, ওনাকে জানাতে হবেনা, যে আজ আমাদের বিয়ে?”
.
অরণী কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, “আপনি কি বলছেন না বলছেন, আমি কিচ্ছু বুঝতে পারতিছিনা! আপনি আমার সাথে এমন মজা কেনো করছেন, বলুন তো? আর কত কাঁদাবেন আমাকে?”
.
“এমনে এখানে দাঁড়ায় কান্দিয়ো না দয়া করে! লোকজন তো আমাকে কিডন্যাপার মনে করে পিটাবে ধরে!”
.
অরণী ছলছল চোখে অরূপের দিকে তাকিয়ে আছে।
“আচ্ছা থাক, তোমাকে বলতে হবেনা। বিয়ের পর দুজনে একসাথে গিয়ে বলে আসবো! তারচেয়ে বরং রেহেনা বেগমকে একটা ফোন করে জানিয়ে দেই যে আমরা বিয়ে করছি। ভদ্রমহিলার অনেকদিনের চেপে রাখা কষ্ট তাতে যদি একটু কমে!”
.
অরণী বিস্মিত হয়ে বললো, “রেহেনা বেগম কে?”
.
“ছি ছি ছি অরণী! তুমি তোমার শাশুড়ী মায়ের নাম মুখে নিয়ে ফেললে! এতো বউমা জাতির কলঙ্ক!”
.
অরূপ পকেট থেকে ফোনটা বের করে তার মায়ের নম্বর ডায়াল করলো৷ একবার রিং হতেই তিনি ফোন ধরলেন!
“হ্যালো, আম্মা! শুনো, আমি আজরাতে বাসায় ফিরবোনা। কালসকালে বরণডালা সাজিয়ে রাখিয়ো। তোমার জন্য চাকরানী নিয়েই বাসায় ঢুকবো! তোমাকে আর একা একা সংসারের হাল টানতে হবেনা!”
.
রেহেনা বেগম ফোনের অপরপাশ থেকে কি বললেন, অরণী শুনতে পেলোনা! অরূপ আর কিছু বললোনা, খট করে ফোনের লাইন কেটে দিয়ে আবার অরণীর হাত ধরে কাজি অফিসের ভিতরে ঢুকলো।
.
.
অরণীর সাথে অরূপের বিয়েটা হয়ে গেলো হঠাত করেই, আকস্মিকভাবে কিংবা পরিকল্পনামাফিকভাবেই। বিয়ের সাক্ষী হিসেবে দুজনের একজন হলো সাদিক, অরণীর স্কুলফ্রেন্ড! অরূপ অরণীকে না জানিয়েই আজ সকালেই সাদিকের সাথে যোগাযোগ করে; সে নিজেই অরণীর পক্ষের সাক্ষী হতে রাজি হয়! আরেকজন সাক্ষী হলো সিন আপা, অরূপের চাচাতো বোন। তিনি গতকালই ঢাকায় এসেছেন। তার শ্বশুড়ের একটা বিশাল ভিটা আছে ঢাকায়, আপাতত সে সেখানেই উঠেছিলো। কিন্তু সকাল সকাল ছোটভাইয়ের ফোনের জরুরী তলব পেয়ে অরণী-অরূপের বিয়ের সাক্ষী হতে চলে এসেছেন!
.
অরণী এখনো বিশ্বাস করতে পারছেনা, তার বিয়েটা এভাবে হয়ে গেলো! সে এখনো বাবাকে কিছু জানাতে পারেনি! বাবা জানতে পারলে কি করবেন, সে ভাবতে পারছেনা!
.
সিন আপু রেজিষ্ট্রেশনের কাজের পরপরই চলে গেলেন। অরূপ অরণীকে নিয়ে কাজি অফিস থেকে বের হলো। অরণী এতক্ষণ ধরে কবুল ছাড়া আর কোনো কথাই বলতে পারেনি। সে কবুলও বলেছে পুরোপুরি ঘোরের মধ্যে।
.
অরণীরা কাজি অফিস থেকে বেরোনোর পরপরই মুষলধারার বৃষ্টি শুরু হলো। অরূপের ভাষায় কুকুর-বিড়াল বৃষ্টি নেমে এলো। অরূপ অরণীর হাত এখনো ধরে আছে। একমুহূর্তের জন্যেও সে অরণীর হাতটা ছেড়ে দেয়নি!
.
“চা খাবেন?”
.
“আপনি তখন থেকে আপনি থেকে তুমি হয়ে আবার আপনিতে ফিরে যাচ্ছেন! মানুষকে কনফিউশানে ফেলা কি আপনার জন্মগত অভ্যাস?”
.
“সামনে একটা হোটেল আছে। হেব্বি সিঙ্গাড়া বানায়৷ সিঙ্গারা সাইজে তেমন বড় না, কিন্তু খেতে অমৃত! একবার খেলে আর কোনোদিন ভুলতে পারবিনা!”
.
অরণী চমকে গিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকালো অরূপের দিকে।
.
“নিজের বউকে আমি যা ইচ্ছে ডাকবো, তুই বলার কে?”
.
অরণী হেসে ফেললো। অরূপের মুখে তুই তোকারি শুনতে তার খারাপ লাগছেনা!
.
অরূপ অরণীর হাত ধরে বৃষ্টিতে নেমে গেলো। দুজনে হেঁটে এসে হোটেলের সামনে দাঁড়ালো। এতটুকু পথ হেঁটে আসতে গিয়ে, অরণী অরূপ দুজনেই ভিজে একাকার হয়েছে। অরূপের কালো পাঞ্জাবি ভিজে লেপ্টে আছে গায়ের সাথে। অরণী এতক্ষণে খেয়াল করলো, অরূপ তার সাথে মিলিয়ে কালো পাঞ্জাবি পড়েছে! আশ্চর্য! সে আগে খেয়াল করেনি কেনো!
.
অরণী জীবনে প্রথমবারের মতো এভাবে বৃষ্টিতে ভিজে রাস্তার পাশে রাত নয়টায় দাঁড়িয়ে সিঙ্গারা আর চা খেলো। আজকের দিনটা এমন হবে কে জানতো! অরণী মন্ত্রমুগ্ধের মতো অরূপের দিকে তাকিয়ে আছে। অরূপও তার দিকে তাকিয়ে আছে! কারো চোখের পলক পড়ছেনা! কার চোখের পলক আগে পড়বে?
.
অরণী হেরে গেলো। তার চোখে পানি এসে গিয়েছে। চোখে পানি নিয়ে পলকহীন তাকিয়ে থাকা যায়না!
.
“আচ্ছা, বিয়েতো হয়ে গেলো! বাসর কোথায় করা যায় বলোতো?”
.
অরণী চোখ বড়বড় করে তাকালো অরূপের দিকে!
“এভাবে বিয়ে করার কি দরকার ছিলো, অরূপ? আমাদের পরিবার তো অমত দিতোনা আমাদের বিয়েতে!”
.
“অতটাকা খরচ করে লোকজন খাইয়ে বিয়ে করার কি দরকার? একটা সামান্য ব্যাপারে এতটাকা পয়সা খরচ করার কোনো দরকার আছে?”
.
“বিয়ে মোটেও কোনো সামান্য ব্যাপার না!” অভিমানী স্বরে বললো অরণী!
.
“তোমার কি কম্যুনিটি সেন্টারে বিয়ে হলোনা বলে আফসোস হচ্ছে?”
.
“প্রত্যেকটা মেয়েরই বিয়ের দিন লাল বেনারসী পড়ে বউ সাজার স্বপ্ন থাকে, আপনি তো আমার সেই আশায় পুরো পানি ঢেলে দিলেন!”
.
“বিয়ের দিন পুতুল সেজে স্টেজে বসে থাকার চেয়ে রাতের ল্যাম্পপোস্টের আলোতে বৃষ্টিতে ভিজে গরম গরম সিঙ্গারা আর চা খাওয়ার অভিজ্ঞতা কি বেশি সুন্দর না?”
.
অরণী চুপ করে থাকলো! আসলেই তার জীবনের অসম্ভব সুন্দর কিছু মুহূর্তের মধ্যে এটা একটা!
.
অরূপ চা শেষ করে বললো, “চলো!”
.
“কোথায়?”
.
“আরে, রাত বেড়ে যাচ্ছে! এরপর তো বাসর মিস করে ফেলবো!”
.
“এমন ভাব করছেন যেনো বাড়িতে আপনার জন্য ফুল দিয়ে বিছানা সাজিয়ে রাখা আছে!” মুখে ভেংচি কেটে বললো অরণী!
.
“বাহ! তোমার তো খুব বুদ্ধি! কি সুন্দর বুঝে ফেলেছো!”
.
অরণী বোকার মতো তাকিয়ে বললো, “কি বুঝে ফেলেছি?”
.
“উফফ! বড্ড বেশি প্রশ্ন করে মেয়েটা! চলো তো!”
.
এই তুমুল বৃষ্টির মধ্যে রিকশা পাওয়া সমস্যা হয়ে গেলো! অরূপ অনেক খুঁজে একটা রিকশা পেলো! রিকশাওয়ালা জমিদারী ভাব নিয়ে রিকশার সিটে বসে বললো, “দেড়শ টেহা দেওন লাগবো!”
.
“কত টাকা?”
অরূপ চোখ কপালে তুলে বললো, “চল্লিশ টাকার ভাড়া দেড়শো টাকা চাচ্ছেন? রাস্তা চিনেন আপনি?”
.
রিকশাওয়ালা আগের চেয়ে বেশি ভাব নিয়ে বললো, “গেলে চলেন, না গেলে নাই!”
.
রিকশাওয়ালা প্যাডেলে চাপ দিতেই অরূপ চেঁচিয়ে উঠলো, “থামেন থামেন! ঝড় বাদলার দিনে রাস্তায় যানবাহন কম বলে ভালো সুযোগ পেয়ে গেলেন! অরণী উঠো!”
.
অরণী উঠে বসলো! অরূপ অরণীর গা ঘেষে উঠে বসলো! অরণী আচমকা কি মনে করে অরূপের কপালে হাত দিয়ে বললো, “একি! আপনার গা তো জ্বরে পুরে যাচ্ছে! জ্বর কখন এলো?”
.
“সকাল থেকেই একটু খারাপ লাগছিলো! ও কিছুনা! সেরে যাবে!”
.
“সেরে যাবে মানে? সকাল থেকে খারাপ লাগলে এভাবে বৃষ্টিতে ভিজলেন কেনো আপনি? ইসস… কতক্ষণ থেকে ভিজা পাঞ্জাবিটা গায়ে আছে! জ্বর কতটা বেড়েছে, আপনার ধারণা আছে?”
.
অরূপ ঘোরগ্রস্ত মানুষের মতো হাসলো। তারপর হঠাত অরণীর কাঁধে মাথা দিয়ে অরণীর কোমড় জড়িয়ে বিড়বিড় করে বললো, “অরণী…. অরু…. ভালোবাসি!”
.
অরণী চিন্তায় পড়ে গেলো! অরূপের জ্বর ক্রমশ বেড়েই চলেছে! আর কতক্ষণ যে লাগবে বাড়ি ফিরতে!
.
.
চলবে……

#গ্যাসবেলুন
#সর্বশেষ_ও_১১শ_পর্ব
লেখাঃ Nobonita Ferdows
.
অরূপ অরণীর কাঁধে ওপর মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে ছিলো. অরণী বৃষ্টির ঝাপটা থেকে অরূপকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে; বৃথা চেষ্টা। দুজনেই ভিজে একাকার হয়ে গেছে।
.
অরূপ চোখখুলে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো, “মামা, বায়ে নিবেন!”
.
রিকশাওয়ালা বিরক্তমুখে পিছনে ফিরে বললো, “যাবেন কই আপনেরা?”
.
“আগামসি লেন যাবো!”
.
রিকশাওয়ালা মহাবিরক্ত হয়ে রিকশা আচমকা থামিয়ে বললো, “আপনে ঠিক করলেন এক জায়গা, এখন কইতাছেন আগামাসি লেন যাইবেন! আমি যাবোনা আপনাদের লইয়া! আপনে ভাড়া দিয়া নাইমা পড়েন!”
.
অরূপ অরণীর কাধ থেকে মাথা তুলে বললো, “আরে মামা, ঝামেলা কইরেন না! আপনে যত চান, তত ভাড়াই দিবো৷ চলেন!”
.
রিকশাওয়ালার ইচ্ছাভাড়ার প্রস্তাব শুনে কিছুটা মন গললো। রিকশায় প্যাডেল চালিয়ে বামে মোড় নিলো!
.
অরণী হকচকিয়ে গিয়ে বললো, “আমরা কোথায় যাচ্ছি, অরূপ? আমাদের বাড়ি তো এদিকে না! আগামসি লেনে কেনো যাচ্ছি আমরা?”
.
“বলছিনা, বেশি বকবক করবা না! চুপচাপ বসে থাকো! আজকে আমি যা চাইবো তাই হবে! তুমি আমাকে আটকাবা না!”
.
“অরূপ, তোমার জ্বর আসছে! এসময় ঘোরাঘুরি করার কি দরকার?”
.
“উফফ… বড্ড জ্বালাও তুমি। আমার বৃষ্টিতে ভিজলে অমন একটু জ্বর আসেই৷ এক-দেড় ঘন্টার মধ্যেই জ্বর নেমে যাবে!”
.
“এবার কিন্তু বেশি বেশি হচ্ছে, অরূপ! আমরা এক্ষুণি বাসায় যাবো, তুমি কোনো কথা বলবা না! মা….”
.
অরণী রিকশাওয়ালাকে রিকশা ঘুরায় নিতে বলতে চাচ্ছিলো। কিন্তু বলতে পারলোনা! অরূপ তার মুখ চেপে ধরেছে; বামহাতে মুখ চেপে ধরে ঘোরগ্রস্ত চোখে অরণীর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে! এই চোখে এর আগে কখনো সে এভাবে তাকিয়ে থাকতে পারেনি, চোখে চোখ রাখার সাহস হয়ে ওঠেনি; কিংবা এইচোখের বিশালতায় ডুবে মরার ভয়ে তাকাতে পারেনি!
.
চক্ষুকোটরের আকর্ষণে কিংবা মনোজগতের অজানা উন্মাদনায় অরূপ অরণীর ভেজা কোমর চেপে ধরলো! তারপর টেনে নিয়ে একদম কাছে নিয়ে আসলো! অরূপ অনেক আগেই অরণীর মুখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে দিয়েছে। তবুও অরণী কোনো কথা বলতে পারলোনা! অরূপের এহেন চাহনী তার বাকশক্তিতে নিজের কব্জার বাইরে নিয়ে ফেলেছে! অরণী অরূপের শরীরের ভিতরে ডুবে গেলো! অরণী চোখবন্ধ করে মাথানিচু করে ফেলেছে! অরূপ একহাতে অরণীর থুতনি ধরে মুখ তুলে ধরলো! সেখানে কি প্রবল তৃষ্ণায় থরথর করে কাঁপছে তার ঠোঁট। অরূপ তার একজোড়া ওষ্ঠ তৃষ্ণার্ত একজোড়া ওষ্ঠে ডুবিয়ে দিলো। ঝড়ো হাওয়ায় মাতম লেগেছে! বৃষ্টির ফোঁটাগুলো মাতাল হয়ে গিয়েছে! সেই প্রবল বৃষ্টির মাতাল রাতে দুই মাতাল হৃদয় নতুন কোনো গল্পের আহ্বানে যেনো দুজনে দুজনার পরিপূর্ণতার অংশ হলো!
.
.
অরণীরা এসে দাঁড়ালো একতলা কাঠের বাড়িটা সামনে! বাড়ির বিরাট লোহার গেট পেড়িয়ে সোজা রাস্তা গিয়ে বাড়ির সদর দরজায় ঠেকেছে! বাড়িটা জানালাগুলো বেশ বড় বড়! বাড়ির সামনে খুব যত্ন করে নানা ফুলের গাছ লাগানো হয়েছে! অরণী কড়া বেলিফুলের গন্ধ পাচ্ছে! পিছনদিকে আম, কাঠাল, লিচুর গাছ দিয়ে ভরা! বাড়ির সামনে টানা বারান্দার উপরে হলুদ রঙ্গের তিনটে বাতি জ্বলছে! তবে বাড়ির নামটা অদ্ভুত; “রাধাচূড়া”
বাড়িটায় কোনো রাধাচূড়ার গাছ নেই! অথচ বাড়ির নাম রাধাচূড়া দিয়ে রেখেছে!
.
“অরূপ এটা কার বাসা?”
.
“সিন আপার শ্বশুরের ভিটা! আপা সন্ধ্যাতেই দুলাভাইকে নিয়ে বাসায় চলে গেছেন! বাসাটা ফাঁকা এখন! শুধু একজন কেয়ারটেকার আছেন.. আপা আমাদের বাসরের ব্যবস্থা এখানেই করেছেন!”
.
“এসবের কি দরকার ছিলো? আমরা বাড়িতে গেলেই পারতাম! আন্টি-আঙ্কেল, ফুপু, সবাই টেনশন করতিছে হয়তো!”
.
“আঙ্কেল আন্টি কারা?”
.
“কারা মানে? তোমার বাবা মা!”
.
“আমার বাবা-মা তোমার কে হয়? মা-বাবা বলার অভ্যাস করো! আর এখানে বাসর না করলে পালিয়ে বিয়ে করার মজাটাই তো হতোনা! বাড়িতে গেলে সবাই মেনেই নিবে! তখন আর ইন্টারেস্টিং কিছু হতোনা! আর বাসার কারো টেনশন করারও তো কোনো কারণ নেই! এতক্ষণে সবাই জেনো গেছে, আমাদের বিয়ের কথা! মা ফোনও করেছিলো, আমি ধরিনি!”
.
অরণী চোখ কপালে তুলে বললো, “কি বলো? কিভাবে?”
.
“তোমার কি মনে হয়, আপা বাসায় গিয়ে সবকথা পেটের মধ্যে চেপে বসে আছে?”
.
অরণী চিন্তিত মুখে অরূপের দিকে তাকালো!
.
“এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে, নাকি ভেতরে যাবে?”
.
সিন আপা সবকিছু সাজিয়ে রেখে গিয়েছেন। একজন কেয়ারটেকারকে বলে গিয়েছেন, ভালোমতো যত্নআত্নি করতে! অরূপ-অরণীর জন্য নতুন পাঞ্জাবি-শাড়ি রেখে, দুজনার জন্য সাত-আটরকমের পদ রান্না করে টেবিলে ঢেকে রেখে গিয়েছেন! অরূপ ঘরে গিয়ে অফহোয়াইট রঙের পাতলা, সুতি পাঞ্জাবিটা আর তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলো। অরণী ঘরের দরজা লাগিয়ে, বাথরুমের ছিটকিনি বাইরে থেকে লাগিয়ে ঘরেই ভেজা শাড়ি বদলে সিন আপার রাখা শাড়িটা পড়ে নিলো। অরণীর শাড়ি পড়া হতে না হতেই বাথরুমের ভিতর থেকে ধমাধম ধাক্কা পড়তে থাকলো। অরণী দরজা খুলতে আর একসেকেন্ড দেরী করলে অরূপ বুঝি দরজা ভেঙ্গেই ঘরে ঢুকে পড়তো!
.
“আরে খুলছিলাম তো। অস্থির হওয়ার কি ছিলো?”
.
অরূপ বাথরুম থেকে হুড়মুড়ি করে বেড়িয়েই অরণীর কোমর চেপে টেনে ধরে তার চোখের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “আমারই বউ শাড়ি বদলাবে, তার জন্য আমারই ঘরে ঢোকা বারণ? সাহস তো কম না তোর!”
.
অরূপ হঠাত খেয়াল করে বললো, “এই ব্লাউজের গলা এতো বড় কেনো? বাইরে যাস পিঠখোলা রেখে, আর আমার সামনে সব ঢাকা? বাসরে এতসেজেগুজে কে থাকে? যা সব খুলে আয়!”
.
অরণী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে অরূপের দিকে! অরূপ হঠাত অরণীকে ছেড়ে দিয়ে হো হো করে হাসতে হাসতে বললো, “চমকালে তো তোমাকে ভালোই লাগে দেখতে! প্রথম দিন থেকে এই হতভম্ব দৃষ্টি দেখাতে দেখাতেই তো পটিয়ে ফেললা আমাকে!”
.
অরণী বাচ্চা মেয়েদের মতো মুখ গোমড়া করে বললো, “আর আপনিইতো হাসি দেখাতে দেখাতে ডুবায় ফেললেন আমাকে!”
.
“আমার হাসি আগে কখন দেখলা তুমি?”
.
“ওই যে অ্যালবামের ছবিগুলোতে শ্রেমা আপার সাথে….”
অরূপের মুখ চুপসে গেলো। অরণী সেটা খেয়াল করেই কথা বলতে বলতে থেমে গেলো!
.
“আমি কি মন খারাপ করিয়ে দিলাম তোমার?”
.
অরূপ গম্ভীর কন্ঠে বললো, “না! আপা, নিচে খাবার দিয়ে গিয়েছে! তুমি খেয়ে আসো!”
.
“তুমি খাবেনা?”
.
“না!”
.
অরূপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো! অরণী অরূপের পায়ের কাছে গিয়ে বসতে বসতে বললো, “আচ্ছা! ভুল হয়ে গিয়েছে! স্যরি!”
.
“অরণী, শ্রেমার কথা আমি আর কখনো শুনতে চাইনা! শ্রেমা বলে কারো কথা আমি আর মনে রাখতে চাইনা! মাধূর্য তোমার আর আমার সন্তান! মাধূর্য এটাই জানবে, আর তুমি আমিও এটাই জানবো!”
.
“তুমি চাইলেই ভুলতে পারবে?”
.
অরূপ চোখ বন্ধ করে চুপ করে থাকলো!
.
“অরূপ যা হয়েছে, সবকিছুকে স্বাভাবিকভাবে নাও, তাহলে দেখবা, আর খারাপ লাগছেনা! শ্রেমা আপা যেটা করেছে, সেটা অন্যায়! একসয় তো তিনি তোমাদের ভালো রেখেছিলে.. কিন্তু সে তোমার, মাধূর্যের জীবনে এখনোও থাকলে, তোমরা কেউ ভালো থাকতে পারতেনা! শ্রেমা আপার ভালোলাগাটা অন্য কোথাও ছিলো। তুমি ওনাকে ক্ষমা করে দাও! উনি যার সাথে আছে, তার সাথেই ভালো থাকুক!”
.
অরূপ বিছানায় উঠে বসতে বসতে থমথমে গলায় বললো, “তুমি আমার সাথে ভালো থাকবে, অরণী? হঠাত যদি কখনো মনে হয়, মাধূর্যের সাথে, আমার সাথে, অন্যকেউ একসময় জড়িয়ে ছিলো?”
.
“অতীতে কি ছিলো, তা নিয়ে আমার কোনো যায় আসেনা, অরূপ! তখন তো আমি ছিলাম না! কিন্তু এখন আমি আছি! আর আমার অস্তিত্ব হয়ে তুমি আছো, মাধূর্য আছে! মাধূর্য আমারই মেয়ে, আমারই অংশ, আমার মনের সবচেয়ে বড় একটা অংশ!”
.
.
.
অরণীরা বাড়ি ফিরার জন্য পরদিন সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়লো! অরূপ রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে হঠাত রিকশা থামিয়ে বারোটা গ্যাসবেলুন কিনলো! রিকশায় উঠে অরণীর হাতে দিয়ে বললো, “আমাদের বাড়িতে প্রথম আসার দিন তো একটা বেলুন হাতছাড়া করে ফেলেছিলা। আজ দেখি কয়টা সামলাতে পারো! তুমি যা ধিঙি মেয়ে, একটা সামলানো মানেই বিশাল ব্যাপার!”
.
অরণী ভেঙচি কেটে বেলুনগুলো হাতে নিয়ে হাসি হাসি মুখে উপরে বেলুনগুলোর দিকে তাকিয়ে বললো, “তোমার মতো অগোছালো একটা ছেলেকে সামলানোর দায়িত্ব নিয়ে ফেললাম, এরপরেও বলবা, গ্যাসবেলুনের সুতা সামলাতে পারবোনা আমি?”
.
“আচ্ছা, যদি বারোটাই সামলায় নিয়ে বাড়িতে ঢুকতে পারো, তাহলে মানবো, তুমি আমাকে সামলায় রাখতে পারবা!”
.
“বাজি ধরতিছো?” ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো অরণী!
.
“তেমনটাই মনে করো!”
.
.
অরণীরা যখন বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো, তখন বাড়ির প্রায় সবাই উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে! আতাহার সাহেবও এসেছেন! বোধহয় সবাই তাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলো! রিকশায় ওঠার পর অরূপ বাড়িতে ফোন করে জানিয়েছিলো যে তারা ফিরছে!
অরণী বাড়ির গেট পেরিয়ে ঢুকতেই মাধূর্য মা মা করে ছুটে এলো! এতগুলো বেলুন দেখে চোখ বড় বড় করো মাথা উচিয়ে তাকিয়ে আছে মাধূর্য। অরণী গ্যাসবেলুনের লম্বা সুতাগুলো মাধূর্যের হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে বললো, “শক্ত করে ধরো মা! নাহলে উড়ে যাবে!”
.
মাধূর্য বাধ্য মেয়ের মতো বেলুনগুলো ধরে নিয়ে “বুবু, বুবু, দেতো, তত বেউন” বলতে বলতে পিছনে ঘুরে রেহেনা বেগমের দিকে ছুটে যাচ্ছিলো! দুই হাতে বেলুনগুলো ঠিক করে ধরতে গিয়ে একটা বেলুন হাতছাড়া হয়ে ফুস করে উড়ে গেলো! মাধূর্য থেমে গিয়ে কাঁদোকাঁদো চেহারায় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো!
.
অরূপ হেসে ফেলে বললো, “দেখতে হবেনা, কার মেয়ে? শেষ পর্যন্ত হাতে এগারোটা বেলুনই থাকলো!”
.
অরূপের কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো! রেহেনা বেগম মুগ্ধচোখে ছেলে আর ছেলের বউমার হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকালেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে করে বললেন, “হে সৃষ্টিকর্তা, ওদের সুখী করো! এই সুখমিলন যেনো আজীবন স্থায়ী থাকে, তুমি দেখো!”
.
.
(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here