ঘুণপোকা,পর্ব_১০
মিম
– সেদিন রাতে আমি বাসায় ফিরলাম রাত বারোটায়। মনে আমার ভীষণ সুখ! এতরাতে কেন ফিরলাম এসব নিয়ে এক হাজার প্রশ্ন করার মত কেউ নেই কিংবা আমার গলা জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থেকে কেউ বলার নেই, “তোমার এখন ফ্রেশ হওয়া বারণ। সারাদিন পর তোমাকে পেয়েছি, একটু ভালো তো বাসতে দাও। ”
ফ্রেশ হয়েই শুয়ে পড়লাম। আগের রাতে ঘুম হয়নি৷ পরের রাতটাও না ঘুমিয়ে কাটানো যাবে না৷ শুয়ে পড়লাম ঠিকই, কিন্তু ঘুম আসলো না৷ সারারাত এপাশ ওপাশ করে কাটিয়ে দিলাম। সেদিন রাতেও ধরে নিলাম আনন্দে ঘুম আসছে না আমার৷ অনেকগুলো মাস পর একটু প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি সেই আনন্দে আমার ঘুম উধাও হয়ে গিয়েছে। সারারাত না ঘুমিয়ে পরদিন অফিসে গেলাম। পরদিনও আমি একই কাজ করতে থাকলাম। কিছুক্ষন পরপর ফোন চেক। সারাদিন অফিস শেষে বাসায় ফিরলাম। আবারও ফ্রেশ হয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঘুমের কোনো খোঁজ নেই৷ আনন্দে আটখানা হয়ে আমার ঘুম আসছে না এই যুক্তিতে সেদিন রাতে আমি আর সন্তুষ্ট হতে পারছিলাম না। প্রথম রাতে রুপু চলে যাওয়ায় আমি যতটা এক্সাইটেড ছিলাম তৃতীয় রাতে অতটাও ছিলাম না৷ তাহলে কেন আমার ঘুম আসবে না? কারণ খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। কিন্তু পাচ্ছিলাম না৷ যত খুঁজি তত অস্থির হয়ে যাই। মনে হচ্ছিল কিছু একটা নেই৷ মনের কোনো একটা জায়গা অদ্ভুত শূন্যতায় ভুগছে। সেই শূন্যতা কিসের তা আমি সারারাতেও আবিষ্কার করতে পারিনি৷ টানা তিনরাত না ঘুমিয়ে চোখেমুখে আমার বিশাল ক্লান্তির ছাপ পড়ে গেলো। অফিসে যাওয়ার সাথে সাথেই হাসিব ভাইয়া ডাকলো নতুন প্রজেক্টের ব্যাপারে কথা বলার জন্য। উনার রুমে যেতেই আমাকে বললো,
– চেহারার হাল কি হয়েছে তোর!
– তিনরাত ধরে ঘুমাই না।
– রুপন্তির সাথে ঝগড়া করে থাকতে পারিস না তো ঝগড়া করার প্রয়োজন কি?
– রুপন্তির সাথে ঝগড়া হয়েছে কে বললো?
– বলতে হবে নাকি! সবই বুঝি৷ ঝগড়া বেশিদিন ঝুলিয়ে রাখতে নেই। জলদি জলদি মিটিয়ে ফেললেই ভালো। আজ সারাদিন অফিসে থাকার দরকার নেই৷ দুপুরের মধ্যে কাজ শেষ করে বাসায় যা৷ রুপন্তির সাথে যা কিছুই হয়েছে মিটিয়ে ফেল।
সেদিন আমি দুপুরের আগেই ফিরে এলাম।
– ভাবীকে ফিরিয়ে আনার জন্য?
– না। মাথা ঘুরাচ্ছিলো। তাই চলে এসেছি।
– উনি আপনাকে এরপর আর কল করেনি?
– না। সেদিনও আমি বারবার মোবাইল চেক করছিলাম রুপু কল করলো কিনা। আগের দুইদিন চেক করছিলাম ভুলবশত৷ আর সেদিন চেক করছিলাম ইচ্ছে করেই। তিনদিন হয়ে গেছে রুপু আমার সাথে কথা বলছে না, ব্যাপারটা একটু অবিশ্বাস্য লাগছিলো৷ বিয়ের পর বাবার বাড়িতে এক রাতের বেশি সে কখনোই থাকেনি। খুবজোর দুই রাত, এরবেশি কখনোই না। বাবার বাসা থেকে ফিরে এসেই বলতো, ভালো লাগে না তোমাকে না দেখলে। রাতে ঘুমাতে অসুবিধা হয়। এজন্য চলে এসেছি।
সেইবার তিনদিন হয়ে গেলো অথচ ফিরে এলো না এই ব্যাপারটাও অবিশ্বাস্য লাগছিলো। রুপন্তি কেন কল করছেনা আর রুপন্তি কেন ফিরে আসছে না এই দুটো ব্যাপার নিয়েই চিন্তা করে কাটিয়ে দিলাম দিনের বাকি অংশটুকু। রাত বাড়ছিলো, সেই সাথে আমার অস্থিরতাও। নিজেকে নিজেই সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম রুপন্তির মত ছ্যাঁচড়া স্বভাব মানুষ কখনোই রাগ করে থাকতে পারে না৷ তিনদিন রাগ করে থাকাই এদের জন্য অনেক! এইতো কাল সকালেই ফিরে আসবে। তারপর কল করে নিজেই বলবে, সিকু আমি ফিরে এসেছি। স্বান্তনাতেও কাজ হচ্ছিলো না৷ অস্থিরতা লেগেই ছিলো। উপায়ন্তর না পেয়ে স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুম দিলাম। এরপর গুনে গুনে পুরো সতেরোদিন পার হলো। উঠতে বসতে প্রতিমুহূর্তে রুপুকে মনে পড়তো। আমি কাজে মন বসাতে পারতাম না৷ বারবার ফোনের স্ক্রিনে তাকাতাম৷ বাসায় ফিরে ভালো লাগতো না৷ মনে হত কেউ বুঝি মারা গেছে এই বাসায়। কারো গলার স্বর পাওয়া যেতো না৷ বাসার সবাই প্রচন্ড শোকে দিন কাটাচ্ছিলো। রুপুকে হারানোর শোক।মায়ের চোখমুখ প্রায়ই দেখতাম ফুলে আছে৷ বাবা বেশিরভাগ সময় নিজের ঘরে শুয়ে থাকতো৷ সাবিহা সহজে আমার সামনে আসতো না৷ বাসার সবাই আমার উপর রেগে আছে সেটা আমি তাদের দেখলেই বুঝতাম। বিল্ডিংয়ের লোকজন আমাকে দেখলেই শুরুর দিকে জিজ্ঞেস করতো রুপু কোথায়? কবে আসবে? আমি হাবিজাবি উত্তর দিতাম। কয়েকদিন যাওয়ার পর আমাকে কেউ আর জিজ্ঞেস করেনি ওর ব্যাপারে। হয়তো বুঝতে পেরেছিলো আমাদের মাঝে কোনো ঝামেলা চলছে। অফিসের কলিগরাও তিন চারদিন পর রুপুকে নিয়ে কথা বলা বন্ধ করে দিলো৷ আমাকে সিকু বলে ডাকা বন্ধ করে দিলো। সবাই সৈকত নামে ডাকতে শুরু করলো। বুঝলাম রুপু হয়তো ওদের কিছু বলেছে। কলিগদের দিকে, বাসার লোকজনের দিকে তাকিয়ে থাকতাম কেউ রুপন্তিকে নিয়ে কিছু বলে কিনা। কেউ আমাকে রুপন্তির ব্যাপারে কিছু বলতো না। অথচ আমি জানতাম রুপুর সাথে সবারই যোগাযোগ হয়৷ খেতে ভালো লাগতো না৷ রাতে একটানা ঘুম হতো না৷ বারবার ঘুম ভাঙতো। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে ভালো লাগতো না৷ মুভি দেখতে ভালো লাগতো না৷ ঘুরতে ভালো লাগতো না৷ অদ্ভুত বিষন্নতায় দিন কাটাতাম। মনে হতো আমার সবকিছু থমকে গেছে। জীবনের সব সুখ আনন্দ সব হারিয়ে গেছে। প্রতিদিন অপেক্ষা করেছি রুপন্তির একটা কলের। বাসায় যেয়ে দেখবো রুপু ফিরে এসেছে এই আশায় প্রতিরাতে বাসায় ফিরেছি। প্রতিদিন সকালে চোখ মেলে আমার পাশে থাকা রুপুর বালিশের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম ও আজই ফিরে আসবে। অনেক তো হলো। আর পারবে না রাগ করে থাকতে৷ আর রুপু প্রতিদিন আমাকে মিথ্যা প্রমাণ করতো।
– কল তো আপনিও করতে পারতেন?
– কেন করবো? ঝগড়া হয়েছে আমাদের মাঝে। আমি কেন আগ বাড়িয়ে ঝগড়া মিটাবো? সেল্ফ রেসপেক্ট আছে না আমার!
– আপনি এটাকে সেল্ফ রেসপেক্ট ভাবছেন?
– হুম, এমনটাই ভাবতাম।
– আপনি কষ্ট পাচ্ছিলেন উনার জন্য অথচ একটা কল করলেন না৷ সামান্য একটা কলই তো ছিলো।
– তখন তো ঐ সামান্য কলটাকে আমার সামান্য মনে হতো না৷
– আপনি উনার জন্য কষ্ট পাচ্ছিলেন৷ তারমানে আপনি উনাকে ভালোবাসতেন?
মুখ বাকিয়ে হাসলো সৈকত। মাথার চুলগুলো আঙুল দিয়ে উল্টিয়ে দিয়ে বললো,
– গন্ডগোল তো সেখানেই বেঁধেছিলো ইমরান৷ রুপন্তি নামের সেই টর্নেডোকে আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম৷ কখন বাসলাম, কিভাবে বাসলাম টেরই পেলাম না৷ ও চলে যাওয়ার পরও আমি বুঝতে পারিনি ঐ টর্নেডোকে আমি ভালোবাসি। শুধু বুঝতাম রুপন্তিকে আমার ভীষণ মনে পড়ে। কিন্তু ভালোবাসা তখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি৷ বুঝেছি সতেরোদিন পর যেদিন রুপু আমাদের বাসায় এলো ওর ডায়েরী নিয়ে যাওয়ার জন্য৷ সেইরাতে ছোটখাটো একটা ঝড় বয়ে গিয়েছিলো আমার উপর।
– কিসের ডায়েরী?
– রুপুর ডায়েরি যেখানে ওর বহু গোপন তথ্য লেখা আছে। বিয়ের পর রুপু আমাদের দুজনের একটা ছবি বাঁধাই করে এনে ড্রইংরুমের দেয়ালে এঁটে দিয়েছিলো৷ সতেরোদিন পর অফিস থেকে বাসায় ফিরে দেখি ছবিটা দেয়ালে নেই। সেটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ছবি কে সরালো? মা বললো, রুপু সরিয়েছে।
– রুপন্তি এসেছে! কোথায় ও?
– চলে গিয়েছে।
রুপু এসেছে শুনে যতটা খুশি হয়েছিলাম, তারচেয়ে বেশি মন খারাপ হলো ও চলে গিয়েছে শুনে। খানিক বাদেই দেয়াল থেকে ছবি সরানোর কথা মনে পড়তেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। মাকে জিজ্ঞেস করলাম,
– ও কেন এসেছিলো? দেয়াল থেকে ছবি সরানোর জন্য?
– না। ওর কি একটা ডায়েরি নাকি আছে৷ সেটা খুঁজতে এসেছিলো। অনেকক্ষণ খুঁজলো। কোথাও নেই। তুই দেখেছিস নাকি ডায়েরিটা?
– ও ডায়েরি খুঁজতে এসেছে ভালো কথা। দেয়াল থেকে ছবি কেন সরালো? ছবি সরিয়ে সে কি প্রমাণ করতে চায়?
– এখানে তোর রাগারাগির কি আছে? ওর ছবি, ওর ইচ্ছে হয়েছে এখান থেকে সরাবে তাই সরিয়ে দিয়েছে।
– এটা ওর একার ছবি না৷ আমারও ছবি আছে৷
– হ্যাঁ আছে। তো?
– তো আবার কি? ও ছবি কেন সরালো?
– তুই দেয়ালে ছবি রেখে কি প্রমাণ করতে চাস? আর কয়দিন বাদে ডিভোর্স হয়ে যাবে৷ এমন অবস্থায় দেয়ালে ছবি বাঁধিয়ে রাখা আদিখ্যেতা ছাড়া আর কিছু না।
– কে দিচ্ছে ডিভোর্স? রুপু? কখনোই না৷ ও রাগ করে বাপের বাড়ি পর্যন্তই থাকতে পারবে৷ এরচেয়ে বেশি কিছু ওকে দিয়ে সম্ভব না। যাক কয়দিন, নিজেই ফিরে আসবে বাবার বাড়ি থেকে৷
মা আমার সাথে খুব স্বাভাবিক কন্ঠে কথা বলছিলো। হঠাৎ করে মায়ের কি হলো আমি জানি না। আমি শেষ কথাটা বলতেই মা আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালো৷ বহুবছর পর মায়ের এমন রাঙা চোখ দেখেছিলাম। যেদিন থেকে বাবা মা আবিষ্কার করলো আমি বেয়াদব হয়ে গিয়েছি সেদিন থেকে বাবা মা আমাকে বকা দেয়া কিংবা রাগ করে কথা বলা ছেড়ে দিয়েছে। সবসময় আমি একতরফা রাগারাগি করতাম। বাবা মা শুধু চুপচাপ আমাকে সহ্য করতো। সেদিন মা রুপন্তির জন্য আমার সাথে রেগে গেলো৷ দাঁত কিটমিটিয়ে বললো,
– রুপু খুব সস্তা না রে সৈকত? তোর হাজার লাত্থি গুতা খেয়েও আবার এই সংসারে আসবে! রুপুকে এত সস্তা ভাবিস কেন? কি করেছে ও? তোর সমস্ত অন্যায় চুপচাপ সহ্য করেছে তাই রুপু সস্তা? তোর এত এত অবহেলা পেয়েও তোর পিছনে সারাক্ষণ ঘুরঘুর করেছে একটু মন পাওয়ার জন্য তাই রুপু সস্তা? নাকি ও কাজে পটু না তাই ও সস্তা হয়ে গিয়েছে? রুপু এত সস্তা না রে সৈকত। আমার কাছে ওর অনেক দাম। কেন জানিস? ও আমার মেয়েটাকে নিজের বোনের মত আগলে রেখেছে। আমাকে আর তোর বাবাকে নিজের বাবা মায়ের মত আপন করে নিয়েছে। যা কিছু আমাদের তোর কাছে পাওনা ছিলো সেসব পাওনা রুপু দ্বিগুণ করে মিটিয়েছে। আমি আর তোর বাবা মারা যাওয়ার পর সাবিহাকে আগলে রাখার মত আর কেউ থাকবে না। আমার মেয়েটাকে রুপু আগলে রেখেছিলো। আমরা দুজন নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম দুনিয়াতে আমরা না থাকলেও আমাদের মেয়েকে দেখার মানুষ আছে। তোর আশা আমরা করি না৷ আমরা বেঁচে থাকতেই আমার মেয়ের দিকে নজর দেয়ার সময় তোর হয় না আর আমরা মারা গেলে তো সাবিহা বেঁচে আছে না মারা গেছে সেই খোঁজও নিবি না৷ স্বর্গে ছিলাম আমি এই সাড়ে সাতমাস৷ আমার ঘরে সুখের জোয়ার নিয়ে এসেছিলো এই মেয়ে। আমার ঘরের হাসি আনন্দ সব শেষ। সংসারে আবার অন্ধকার চলে আসলো। আমার সাবিহা আবার একা হয়ে গেলো। কেউ থাকবে না আমার মেয়ের খোঁজ নেয়ার মত। তুই সব শেষ করে দিলি৷
আসবে না রুপু৷ চিরতরে চলে গিয়েছে৷
বলে গিয়েছে লিগ্যাল নোটিশ পাঠাবে কাল পরশুর মধ্যেই৷ ভালোই হবে। তোর মত বেয়াদবের সাথে এমন পরীর মত মেয়ে মানায় না৷ ওর জন্য মন থেকে দোয়া করি মেয়েটার সামনের জীবন যেন খুব খুব সুন্দর হয়। রাজপুত্রের মত ছেলে আসুক ওর জীবনে৷ ওর সমস্ত অপ্রাপ্তিগুলো পূর্ণ করুক। আজনম মাথায় করে রাখুক।
মা কাঁদছিলো আর টানা কথাগুলো বলে যাচ্ছিলো৷ মায়ের সব কথা আমি মাথা নিচু করে শুনে যাচ্ছিলাম। খুব খারাপ লাগছিলো কথাগুলো শুনে। কিন্তু মেজাজ বিগড়ে গেলো শেষের কথাগুলোয়৷ রুপুর আবার বিয়ে হোক এমন দোয়া করার মানে কি? আমি মায়ের সাথে চেঁচিয়ে উঠলাম,
– আমি তো খারাপ। দুনিয়ার মাটিতে ফুলের মত মনের পুরুষের তো অভাব নেই। যাও, একটা পুরুষরুপি ফুল ধরে এনে রুপন্তিকে বিয়ে দিয়ে দাও৷
(চলবে)