ঘুণপোকা,পর্ব_১৫
বাবা মা আমাকে ধরে বিছানায় শোয়ালো। মা আমার হাত পা মালিশ করে দিচ্ছিলো। বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো, বারবার বলছিলো হসপিটাল কেন যাবি না? বাসায় থেকে বিপদ কেন ঘটাতে চাচ্ছিস?
অনেকটা সময় পর বাবাকে বললাম, রুপন্তি আমার কল রিসিভ করছে না৷ তুমি তার খুব প্রিয়। তুমি কল করে আসতে বললে ও না করবে না৷ রুপন্তিকে বলো না এখানে এসে কয়েকদিন থেকে যেতে!
এতটা সময় বাবা মা আমাকে নিয়ে ভীষণ দুঃশ্চিন্তায় ছিলেন। মা কাঁদছিলো। দুজনের চোখে মুখে পেরেশানী স্পষ্ট৷ আমার আবদার শোনা মাত্রই উনাদের চেহারা থেকে সমস্ত দুঃশ্চিতার ছাপ উধাও। মা আর কাঁদছেনা, হাত পা মালিশ করে দিচ্ছে না৷ বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে না। দুজনই আমার দিকে খুব বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে রইলো। উনাদের দেখে মনে হচ্ছিলো সেই মুহূর্তে উনারা আমার অসুস্থতা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহে ভুগছেন।
– ভাবীকে বাসায় আনার জন্য আপনি নাটক করছেন এমন কিছু সন্দেহ করছিলো?
– হ্যাঁ। মা বেশ রাগ করেই আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
– রুপু কেন এখানে এসে থাকবে?
আমি কোনো উত্তর দেইনি। আমার উত্তর না পেয়ে বাবা একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো। আমার ইচ্ছে হচ্ছিলো অনেক অনেক কথা বলতে। রুপুকে ঘিরে আমার শত শত অনুভূতি জমা হয়েছে৷ আমি অনুতপ্ত হচ্ছি সকাল-বিকেল। প্রতিমুহূর্তে ঐ মেয়েটার প্রেমে ডুবে মরছি৷ ঐ মেয়েটাকে হারানোর ভয়ে বারবার নিঃশ্বাস হারাচ্ছি। আমি ভীষণ অসুস্থ। মরণব্যাধি পেয়েছে আমাকে। আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইলে রুপুকে এনে দাও। আর নয়তো তোমাদের ছেলে অতি শীঘ্রই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করবে।
আমি একটা কথাও বাবাকে বলতে পারিনি। সমস্ত কথা আমার গলা পর্যন্ত এসে আটকে গেলো। সেদিন ঐ মুহূর্তে আমি বোবা মানুষের কষ্ট খুব অনুভব করতে পেরেছি। তারা কতশত কথা বলতে চায় অথচ বলতে পারে না৷ আমারও অনেক কিছু বলার ছিলো অথচ আমি বলতে পারিনি।
– কখনোই মনের কথাগুলো প্রকাশ করতে পারেন না?
– একদমই না। এই ব্যাপারে আমি ভীষণ আনাড়ি। তবে আমি বলতে পারিনি অন্য কারণে। কারো প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা মানেই নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করা। আমি আমার দুর্বলতা কারো কাছেই প্রকাশ করতে চাইনি। আমার মা বাবার কাছেও না।
– আমার কেন যেনো মনে হয় আংকেল আন্টিকে এসব কথা বলেও কোনো লাভ হতো না।
– কিভাবে বুঝলে?
– মনে হচ্ছে আরকি! ভাবী ডিভোর্স দিতে চাচ্ছে, আংকেল আন্টি পুরোদমে সাপোর্ট দিচ্ছে ভাবীকে। বুঝাই যাচ্ছে উনারা ভাবীর পক্ষেই কথা বলবে। তাছাড়া সন্তান হিসেবে যতটুকু জায়গা উনাদের মনে আপনার থাকার কথা ছিলো সেইটুকু জায়গা কিন্তু ভাবী নিজের দখলে নিয়ে নিলো। ছেলের চেয়ে ছেলের বউকেই উনারা কয়েকগুন বেশি ভালোবাসে।
– ঠিকই ধারণা করেছো। বাবা মা রুপুর পক্ষেই ছিলো। রুপু যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাবা মা সবসময় সেটাই মেনে নিয়েছে৷ আমি কি চাচ্ছি সেসবের কোনো মূল্যই মা বাবার কাছে নেই।
– আংকেল কি কল করেছিলো ভাবীকে?
– তোমার কি মনে হয়?
– আমার তো মনে হচ্ছে কল করেনি।
– সত্যিই করেনি। মা কঠিনভাবে আমাকে জানিয়ে দিলো, এসেছিলোই তো তোকে দেখতে। নিজে ডেকে এনে নিজেই বের করে দিলি। এখন আবার ঢঙ করছিস কেন? রুপু আর আসবে না। শরীর খারাপ হয়েছে ডক্টরের কাছে চল। রুপুর এখানে কোনো কাজ নেই। সাবিহার সাথে যার সম্পর্ক চলছে কাল বিকেলে তার বাড়ির লোকজন সাবিহাকে দেখতে আসবে। খুব সম্ভবত আগামীকালই বিয়ের তারিখ ঠিক করে যাবে। রুপু আগামীকাল বিকেলে আসছে। অহেতুক আজ আসতে বলার প্রয়োজন নেই।
মা কথাগুলো বলে বের হয়ে গেল আমার ঘর থেকে। বাবা আমার পাশেই বসে ছিলো৷ আমাকে দেখছিলো খুব মন দিয়ে। হয়তো আমার চোখের ভাষা বুঝার চেষ্টা করছিলো! বাবা আমাকে এভাবে দেখছে ব্যাপারটা আমাকে খুব অস্বস্তিতে ফেলে দিলো। বাবা আমার চোখ দেখে বুঝে ফেলবে আমি রুপুকে ভালোবাসি, ব্যাপারটা নিয়ে আমি ভয় পাচ্ছিলাম। আমি চাইনি কেউ বুঝুক আমি রুপুকে ভালোবাসি। চাইনি কারো হাসির খোড়াক হতে, কাউকে নিজের দুর্বলতা জানাতে। আমি মুখে বালিশ চাপা দিয়ে শুয়ে রইলাম। আমার কান্না পাচ্ছিলো। কিন্তু আমি কাঁদতে পারছিলাম না। আমি কাঁদতে পারি না। খুব কষ্টে ভিতরটা চুরমার হয়ে গেলেও পারি না। আমার মনে হচ্ছিলো আমি একটু কাঁদতে পারলেই আমার কষ্ট কমে যাবে। একটু কাঁদার জন্য খুব চেষ্টা করেছি, আমি পারিনি।
– ভাবীর চোখে একটু পানি দেখার জন্য কতকিছুই না করলেন! অথচ সেই মানুষটার জন্যই কি না কাঁদার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন!
মুখ বাকিয়ে হাসলো সৈকত। বললো,
– অন্যায় রুপুও করেছে। রুপুর উচিত ছিলো আরো আগেই রাগ করে চলে যাওয়া, আমার সাথে ঝগড়া করা। মেয়েটা সবসময় হাসিমুখে সব মেনে নিয়ে আমাকে এতখানি আস্কারা দিয়েছে। আমাকে লিমিট ক্রস করার পারমিশন দিয়েছে। যখন আমি লিমিট ক্রস করলাম তখন আমাকে ফেলে চলে গেল মেয়েটা! আগে আমাকে দুই একটা কড়া করে হুমকি-ধমকি দিলেও তো পারতো তাই না?
– হুমকি-ধমকি দিলে কি আপনি এমন আচরন করতেন না?
– এতটাও বাড়াবাড়ি করতাম না।
– ভাবীকে আর কল করেছিলেন?
– না।
– তাহলে? চিন্তা করতে করতেই রাত কাটিয়ে ফেললেন?
– উহুম। আধাঘন্টা পর কোনো একভাবে এই অসুস্থ শরীরেই বেরিয়ে পড়লাম রুপুর বাসার উদ্দেশ্যে। নাদিমকে আমার বিশাল পীড়া মনে হচ্ছিলো। সহ্য হচ্ছিলো না একদম! রুপুর সাথে এই ছেলের ব্যাপারে কথা বলে সবটুকু ক্লিয়ার না করা পর্যন্ত আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না৷ রুপু নাদিমকে নিয়ে কতটুকু সিরিয়াস সেটা জানা সেই মুহূর্তে খুবই জরুরি ছিলো।
– কাউকে বুঝতে দিবেন না আপনি ভাবীকে ভালোবাসেন। আর এই কাজ করলে কি ভাবি কিংবা উনার বাসার মানুষজন আপনার ভালোবাসা বুঝে ফেলতো না?
– তখন এই কথাগুলো মাথায়ই আসেনি একদম। হঠাৎ মাথায় ভূত চাপলো রুপুর সাথে কথা বলবো, সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেলাম। ঘোরের মাঝে ছিলাম আমি। আধপাগল অবস্থা আমার। পুরো রাস্তা নাদিমকে নিয়েই জল্পনা-কল্পনা করতে করতে পার হয়েছে। আমার ঘোর কাটলো রুপুদের এলাকায় পৌঁছে। এলাকার মোড় পার হয়ে একটু সামনেই মুখোমুখি দুটো এ্যাপার্টমেন্ট আন্ডার কনস্ট্রাকশন। তুলনামূলক অন্ধকার ছিলো জায়গাটা৷ মানুষজনও নেই৷ ঐ পথ ধরে যাওয়ার সময় দেখলাম রুপু রিকশায় বসা৷ এক ছেলে রিকশার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। খুব নীচু স্বরে দুজনে কথা বলে যাচ্ছে। অন্ধকারেও আমি রুপুর কুঁচকে যাওয়া চেহারা কিছুটা বুঝতে পারছিলাম। পরিস্থিতি আমার কাছে ভালো ঠেকেনি। ভাড়া মিটিয়ে আমি রিকশা থেকে নেমে রুপুর কাছে যাবো ঐ মুহূর্তে কোত্থেকে রাহাত দৌঁড়ে এসে ছেলেটাকে এলোপাতাড়ি কিল ঘুষি যা পারে সব দেয়া শুরু করলো। আর অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ তো আছেই৷ রুপুকেও রাহাত বকে যাচ্ছে,
– যে যা খুশি করতে থাকে তুমি কিছু বলো না কেন? কিসের আত্মীয়তা? এমন চুতিয়া আত্মীয় দরকার নাই আমার। দুই গালে চড় লাগাইতে পারো না? তোমার ধারে কাছে আসার সাহস কেমনে করে? তোমার জীবন ধ্বংস করছে এখনও তুমি আত্মীয়তা নিয়া চিন্তা করো?
বুঝলাম ছেলেটা নাদিম। রুপু ততক্ষণে রিকশা ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাথা নিচু করে কাঁদছিলো ও। রুপুর নাক টানার শব্দ পাচ্ছিলাম। ওর পাশে গিয়ে হাত ধরে জিজ্ঞেস করলাম,
– কি হয়েছে? সমস্যা কি?
এবার রাহাত আমাকে বকা শুরু করলো।
– আপনাকেও!
– হ্যাঁ। নাদিমের চুলের মুঠি ধরে ওর মাথা ঘুরাচ্ছিলো আর আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত কিটমিট করে বললো,
– আরেক মা**** হাজির। তুই ফুপ্পির বিয়ে করা বর তাই তোরে মারি না৷ আর নয়তো এইটার মতন তোরেও ধইরা দিতাম। ফুপ্পির অর্ধেক জীবন নষ্ট করছে এই হারামজাদা আর বাকিটা নষ্ট করলি তুই। তোরে আর এই হারামজাদারে আমার কোপায়া টুকরা করতে মন চায়। তুই আবার হাত ধরছোস আমার ফুপ্পির! হাত ছাড় বা*****।
– গালিও দিলো!
– আমাকে কেউ গালি দিবে আর আমি সেটা চুপচাপ শুনবো এটা একটা অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু সেদিন এই কান্ডই ঘটলো৷ আমি রাহাতকে কিছুই বলিনি। চুপ করে শুনে গিয়েছি শুধু। কেন যেন একটা গালিও আমি গায়ে মাখিনি৷ বরং আমার ভীষণ খুশি খুশি লাগছিলো।
– গালি শুনে খুশি লাগছিলো!
– উহুম। নাদিমকে পেটানো হচ্ছে সেই খুশি। ভিতরে অদ্ভুত এক শান্তি টের পাচ্ছিলাম। এতক্ষণ ভুগতে থাকা মানসিক চাপ থেকে একটু হলেও মুক্তি পেয়েছিলাম।
– একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন! হুমকি শুনেও কি ভাবির হাত ধরে রেখেছিলেন?
শব্দ করে হেসে উঠলো দুজনই। টি টেবিলের উপর দুই পা তুলে দিতে দিতে সৈকত বললো,
– নাহ্ ছাড়িনি। ধরেই রেখেছিলাম। রাহাত এসে আমাদের দুজনের হাত ছাড়িয়েছিলো। সেইসঙ্গে বলে গেলো,
– ফুপ্পি তোরে এত ভালোবাসলো আর তুই একটু সম্মান দিলি না মানুষটাকে! তুই একটা আবেগহীন চামার৷ তোর মত চামারের বিয়ে করাই উচিত না।
(চলবে)
#মিম