ঘুণপোকা,পর্ব_১৮
-স্যরি বলেছিলেন?
– উহুম৷ আমি কিছু বলার আগেই রুপু তাড়া দিতে লাগলো, বিছানা ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে রেডি হওয়ার জন্য। ভাবলাম বাসায় গেস্ট চলে আসবে অহেতুক এই সময়ে এসব কথা উঠিয়ে লাভ নেই৷ কথা বলতে হবে সময় নিয়ে। রুপুকে আর বাসায় ফিরে যেতে দিবোনা৷ ওকে আমার কাছেই রেখে দিবো। রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমার পাশে বসিয়ে যা বলার বলবো। সারারাত সময় থাকবে। ডিস্টার্ব করার মত কেউ থাকবে না, কোনো কাজের অজুহাতে রুপু আমার রুম থেকেও বের হতে পারবে না। বিকেলে উনারা আসলো। চারদিন পরই আকদের তারিখ ঠিক করলো। পাত্র দেশের বাহিরে চলে যাবে এক সপ্তাহ পর। দেশে ফিরে আসার পর অনুষ্ঠান হবে। বিশাল এক অজুহাত পেয়ে গেলাম রুপুকে বাসায় আটকে রাখার। উনারা চলে যাওয়ার পর আমার মুখ ফুটে কিছু বলতে হয়নি। রুপু নিজেই বাসায় ফোন করে জানিয়ে দিলো তার কাপড়ের লাগেজ যেন এই বাসায় রাহাত এসে দিয়ে যায়। সাবিহার বিয়ে, এমন সময়ে সাবিহাকে রেখে আপাতত সে কোথাও যাবে না৷ অনেক কাজ আছে এই বাড়িতে। সাবিহার বিয়ের সমস্ত শপিং সে নিজে করতে চায়, সবটুকু আনন্দ সে উপভোগ করতে চায়। আমি তখন মনে মনে আনন্দে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছি।
– মনে মনে গড়াগড়ি খাওয়া যায়!
– অবশ্যই যায়। খুব আকাঙ্খিত কিছু তুমি বিনা পরিশ্রমে পেয়ে গেলে কিন্তু তুমি সেই খুশি সবার সামনে প্রকাশ করতে পারছো না তখন মনে মনেই খুশিতে লাফাতে হয়, নাচতে হয়, গড়াগড়ি খেতে হয়।
– কি জানি ভাই! আমি আপনার মত মনে কথা চেপে রাখতে জানি না৷ মনে যা আসে সব প্রকাশ করে ফেলি।
– তোমার মত সবকিছু প্রকাশ করতে পারলে হয়তো আমার সমস্যার সমাধানগুলো খুব সরলভাবে হয়ে যেত!
– বাসায় বিয়ের হাওয়া চলছে, এমন ব্যস্ত মুহূর্তে ভাবীর সঙ্গে কথা বলতে পেরেছেন?
– রুপুকে সেদিন এক মুহূর্তের জন্যও কাছে পাইনি। কি ভীষণ ব্যস্ততা রুপুর! সেদিন রুপুই যেন আমার ঘরের মুরুব্বি৷ বাবা মায়ের যে সিদ্ধান্তগুলো নেয়ার কথা ছিল সেই সমস্ত ভার বাবা মা রুপুর কাঁধে দিয়ে দিলো। রুপু সিদ্ধান্ত নিলো ঘরোয়াভাবে গায়ে হলুদের আয়োজন করা হবে আর আকদ হবে রেস্টুরেন্টে। কাকে গায়ে হলুদে আসতে বলা হবে, কোন রেস্টুরেন্টে বিয়ে হবে, বিয়েতে কে কে দাওয়াত হবে, সাবিহা কোথায় সাজবে, কোত্থেকে শপিং করা হবে বিয়ের মেন্যু কি হবে সবকিছু রুপু একাই সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলো আর মা বাবা রুপুর সমস্ত সিদ্ধান্তে চোখ বুজে সম্মতি দিয়ে যাচ্ছিলো। আর আমি! আমি সোফার এককোনায় বসে রুপুকে ভীষণ মনোযোগে দেখে যাচ্ছিলাম। কি হাসিখুশি! কত এক্সাইটেড ছিল ও সাবিহার বিয়ে নিয়ে! ওর নিজের বিয়ে ডিভোর্সের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে সে ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথা নেই, কোনো দুঃখ নেই। আমাদের সম্পর্কের এমন কঠিন এক সময় আমরা পার করছি সেই মুহূর্তের রুপুকে দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না! এমনকি সাবিহাকে দেখতে এসে সাবিহার শাশুড়ি আমার রুপুকেই বারবার দেখছিলো। কি হাসিমুখে কথা বলে যাচ্ছিলো, আপ্যায়ন করছিলো তাদের! উনি এই বিয়েতে একটু অখুশি ছিলেন৷ মেনে নিতে চাচ্ছিলেন না৷ ছেলের মুখে দিকে তাকিয়ে এই বিয়েতে মত দিয়েছেন৷ উনি বাসায় আসার পর অতটাও স্বাভাবিক ছিলেন না৷ উনার মন খারাপ সেটা দেখেই বুঝা যাচ্ছিলো। উনারা আসার দশ মিনিট পর রুপু উনাকে নিয়ে বাসা দেখানোর বাহানায় সাবিহার ঘরে নিয়ে বসালো৷ দুজনে একসাথে আলাদা বসে কফি খেলো, গল্প করলো প্রায় একঘন্টার কাছাকাছি৷ এই এক ঘন্টায় রুপু কি করলো আমি জানি না, ভদ্রমহিলা খুব হাসিখুশি মুখ করে সাবিহার পাশে এসে বসলো৷ সেদিন কথা ছিলো শুধু আংটি পরানোর। উনি নিজ থেকেই বিয়ের প্রসঙ্গ তুললো। সাবিহার শ্বশুরকে বললো, ছেলে যাওয়ার আগে বিয়েটাই করে যাক। কি বলো?
আমি আমার বোনের চোখে সেই মুহূর্তে পানি দেখতে পাচ্ছিলাম। ওর চোখের সীমানা বেয়ে পানি চলে আসে আসে অবস্থা। ছলছল চোখে তাকিয়ে ছিল রুপুর দিকে। সাবিহার শাশুড়ি চলে যাওয়ার সময় আমাকে কি বলেছিলো জানো?
– কি?
– এত লক্ষ্মী বউ কোথায় পেলে বাবা? কি সুন্দর হাসে! মুহূর্তেই খুব আপন করে নিতে জানে। জানো, আমার দেখা সেরা অকর্মা মেয়েটাকে সেদিন আর অকর্মা মনে হচ্ছিলো না৷ ঐ একঘন্টায় রুপু কি এমন করলো সেটা নিয়ে আমি ভেবে কূল কিনারা করতে পারছিলাম না৷ বাজেটের মধ্যে কি দারুন সব প্ল্যানিং করে যাচ্ছিলো সাবিহার বিয়ের! আমার মা বাবাও হয়তো এত দ্রুত এমন দারুন প্ল্যানিং করতে পারতো না৷ সেদিন কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিলো আমি রুপুকে চিনিই না৷ আসলে চেনার চেষ্টা কখনো করিইনি৷ রুপুর ফ্যামিলি মেম্বাররাও না। চিনতে পেরেছিলো আমার ফ্যামিলি মেম্বাররা৷ তাই হয়তো এতবেশী ভালোবাসতো মেয়েটাকে!
– আপনি চিনতে একটু দেরী করে ফেললেন।
– একটু না, অনেক বেশি। যোগ্যতার চেয়ে বেশি মূল্যবান কিছু পেলে যা হয়, আমার বেলায় তাই হয়েছে৷
– তারপর? একটু কথাও কি হয়নি?
– হয়েছে। সেটা রাতে। সবাইকে বিয়ের দাওয়াত দেয়া, বিয়ে নিয়ে আলোচনা করতে করতে রাত দেড়টা বেজে গেল। আমি আমার ঘরে রুপুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। দেড়টার পর যার যার ঘরে সবাই চলে গেল। ড্রইংরুমের লাইট অফ করার পরপরই মনে মনে সব কথা গুছাতে শুরু করলাম রুপুকে কি কি বলবো। ভেবেছিলাম রুপু এখনি চলে আসবে, অথচ দশ মিনিট পেরিয়ে গেল রুপু আমার ঘরে আসলো না৷ আমিই ঘর থেকে বের হলাম রুপু কোথায় খোঁজার জন্য। ড্রইংরুমে যেতেই সাবিহার ঘর থেকে রুপুর গলার আওয়াজ ভেসে আসছিলো। সাবিহার ঘরে গিয়ে দেখি রুপু ওর বিছানায় লেপ গায়ে দিয়ে খুব হেসে হেসে গল্প করে যাচ্ছে। হাবভাবে বুঝলাম রুপু এই ঘরেই ঘুমোবে। সেই সন্ধ্যা থেকে অপেক্ষা করছি একটু কথা বলার জন্য অথচ রুপুর সময়ই হচ্ছে না আমাকে একটু সময় দেয়ার! এখন আবার এই ঘরে ঘুমোবে! একটু সুযোগ কি আমি পাবো না! এবার আমার সঙ্গে অন্যায় করা হচ্ছে। ভীষণ রেগে গিয়েছিলাম। ধমক দিয়ে রুপুকে বললাম, সেই সন্ধ্যা থেকে হেসেই যাচ্ছো, হেসেই যাচ্ছো! মুখ ব্যথা করেনা তোমার? আমাদের ডিভোর্স মাথার উপর ঝুলছে এমন মুহূর্তে এত হাসি কোথাও পাও রুপন্তি? কই আমার তো হাসি পায় না!
– ভাবী চলে গেলো যেদিন, সেদিন তো আপনিও খুব চিল মুডে ছিলেন। লং ড্রাইভেও গিয়েছিলেন। এখন ভাবী হাসছে সেটাতে তো আপনার আপত্তি থাকা উচিত না। ভাবীর প্রতি এত স্বৈরাচারী চিন্তাভাবনা কেন আপনার?
– শুধু রুপু না, সবার সঙ্গেই এমন ছিলাম। সেই ছোটবেলা থেকেই আমি স্বৈরাচারী গোছের লোক।
– তাই নাকি! আমি তো দেখিনি কখনো এমন!
– তুমি যেই মুহূর্তে কাউকে ভালোবাসবে তখন থেকে একটু একটু করে তোমার পুরোনো কিছু অভ্যাস বদলে যাবে। আমারও বদলে গিয়েছে অথবা বলতে পারো রুপু বদলে দিয়েছে।
চলবে
#মিম