ঘুণপোকাপর্ব_৪,৫
মিম
পর্ব_৪
ডানহাতের লোমগুলো একমনে খুঁটিয়ে যাচ্ছে সৈকত। নিজের দোষগুলো একে একে স্মরণ হচ্ছে। প্রতিদিনই মনে পড়ে নিজের প্রতিটা দোষ। অনুশোচনা তীব্র আকার ধারণ করতে থাকে, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ চলতে থাকে৷ কেউ জানে না সেই অনুশোচনার তীব্রতা, কেউ দেখে না সেই অদৃশ্য রক্তক্ষরণ। কাউকে দেখাতেও চায় না সে। যার জন্য এত হাহাকার সেই মানুষটাই তো দেখে না, অন্য কারো আর দেখে কাজ কি! তবে আজ পাশে বসে থাকা ছেলেটাকে খুব জানাতে ইচ্ছে হচ্ছে সেই গল্পগুলো। গল্পটা তার জানা খুব দরকার, নয়তো অনুশোচনার আগুনে যে তাকেও কোনো একসময় নিঃশব্দে পুঁড়ে মরতে হবে প্রতিবেলা!
– ভাইয়া?
– হুম?
– হঠাৎ থেমে গেলেন যে!
– তোমার প্রশ্নের যুক্তিসঙ্গত উত্তর আমার জানা নেই৷ যা কিছু করেছি পুরোটাই ছিলো অন্যায়। কোনো মানুষ হুবহু আমার মত হবে কিংবা আমি যা চাই ঠিক তেমনই হবে এটা আশা করা বোকামি। কখনোই সে হুবহু আমার মত কিংবা আমার মনমত হবে না। বিয়ের সাত আটদিন পর থেকেই ওর প্রতি আমার বিরক্তি শুরু হলো। খুব সাধারণ ব্যাপার যেটা বিরক্ত হওয়ার মত না, সেখানেও বিরক্ত হতাম। আমি হেলদি খাবার পছন্দ করতাম আর রুপুর পছন্দ ছিলো পৃথিবীর যত আনহেলদি খাবার আছে সেসব। যতধরণের ভাজাপোড়া, ঝাল এই পৃথিবীতে আছে সেগুলো ও রাক্ষসের মত খেতো৷ বিশেষ করে স্ট্রিট ফুড। কখনো বাহিরে ওকে নিয়ে বের হলে যতক্ষণ রাস্তায় থাকতাম ততক্ষণ এই ভর্তা, সেই আচার, আর নয়তো সিঙারা, ফুচকা এগুলো চলতেই থাকতো৷ আমি চাইতাম ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে বসে ওকে লাঞ্চ কিংবা ডিনার করাতে। আর ও কি করতো! রিকশা জোর করে টি এস সির ওদিকে নিয়ে যেতো। সেখানে যতধরণের স্ট্রীট ফুড পাওয়া যায় সব খেতো। একটা ফুড ভ্যান ছিলো ওদিকে। ঐ ছেলের ভ্যানের পাশে বসে ওর দোকানের পাস্তা আর বার্গার রুপু খাবেই। এরপর দৌঁড় দিতো ফুচকার দোকানে৷ ফেরার পথে টি এস সি তে অবশ্যই এক কাপ চা খেয়ে ফিরতো৷ আর বাসায় ফেরার সময় রিকশায় বসে যতধরণের ফেরিওয়ালা আছে সবার কাছ থেকে কিছু না কিছু হাবিজাবি খাবার কিনতোই৷ টুকটুক করে সারাপথ সেগুলো খেতো আর আমার সাথে একাই বকবক করতে থাকতো৷ বিয়ের পর ওকে নিয়ে বের হয়েছিলাম চারদিন। ওর এসব হাবিজাবি খাওয়ার বদঅভ্যাস আমি মেনে নিতে পারিনি। তাই আর ওকে নিয়ে বের হইনি।
– অন্যসব মেয়েরা ফাইভ স্টার হোটেলে যেতে চায় আর উনি রাস্তার খাবারেই স্যাটিসফাইড ছিলো। আপনার তো খুশি হওয়া উচিত ভাবী অল্পতেই সন্তুষ্ট হওয়া মানুষ।
– হ্যাঁ হওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু আমার খুশি লাগতো না। আমি হলিউড আর আর্ট ফিল্ম দেখতে পছন্দ করি। কিন্তু রুপু পছন্দ করতো সাউথ ইন্ডিয়ান উড়াধুরা মুভি। আমার সাথে যে আর্ট ফিল্ম দেখতো না তা না। দেখতো, তবে কোনো ইন্টারেস্ট আমি ওর মাঝে দেখতে পেতাম না৷ আমি বুঝতে পারতাম ও নিজের সাথে জোর খাটিয়ে আমার পাশে বসে মুভি হজম করছে। কখনো কখনো ও মুভি দেখতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়তো। এমন একটা অবস্থায় কি আর তুমি মুভি দেখতে পারবে? কখনোই না। এরপর থেকে আমি একাই বসে মুভি দেখতাম। ও আমার পাশে বসতে চাইলে বন্ধ করে দিতাম। আমি চাইতাম ওর সাথে লং ট্যুরে যেতে। কিন্তু যেতাম না। কারন রুপু একটা ইরিটেটিং ক্যারেক্টার। বেড়াতে গিয়ে আমাকে ছাড়া কথা বলার মত কাউকে পাবে না। কথা বলে বলে আমার মাথা খেয়ে ফেলবে৷ বিয়ের ঠিক ১৮-২০ দিন পর থেকেই নবনীকে আমি খুব মিস করতে লাগলাম। ওর সাথে আমার কাটানো সময়গুলো খুব মনে পড়তে লাগলো। কত সুন্দর বন্ডিং ছিলো আমাদের! একসাথে বসে মুভি দেখা, দূর দূরান্তে বেড়াতে যাওয়া আরো কত কি! ঘুরে ফিরে বারবার নবনীকে মনে পড়তো।
– উনাকে বিরক্ত লাগার পিছনে আপনি যে কারণগুলো দেখাচ্ছেন সেগুলো কি আদৌ বিরক্ত হওয়ার মত কারণ ছিলো?
– অবশ্যই না। তখনই তো বললাম খুবই অযৌক্তিক কিছু কারণ ছিলো ওকে ভালো না লাগার পিছনে। আরো আছে এমন ঘটনা। শুনবে?
– শোনার জন্যই তো অফিসে রয়ে গেলাম।
– ওর মাইগ্রেন প্রবলেম ছিলো৷ মাসে দুই একবার মাইগ্রেন পেইন খুব বেড়ে যেতো৷ রুপু সহ্য করতে পারতো না৷ এত কথা বলা মেয়েটা মাথায় বালিশ চাপা দিয়ে একদম চুপ করে শুয়ে থাকতো তখন। একটা কথাও বলতো না৷ রুপু চুপচাপ শুয়ে আছে তারমানে শরীরের অবস্থা বেশিই খারাপ। ওর যখনই পেইন হতো তখন ধূসর রঙের কি একটা তেল লাগাতো মাথায়। ভয়াবহ স্মেল ছিলো তেলটার৷ সেই তেল লাগানোর পর পুরো বাসা বিশ্রি গন্ধে ডুবে যেতো। বিয়ের পর প্রথম ওর মাইগ্রেন এ্যাটাক হয় ২২ দিন পর। অফিস থেকে বাসায় ফিরে পা রাখা মাত্রই সেই স্মেল এসে নাকে ধাক্কা খেলো৷ মা কে জিজ্ঞেস করতেই জানালো রুপুর কথা। ঘরে যেয়ে দেখি লাইট অফ করে মাথায় বালিশ চাপা দিয়ে শুয়ে আছে৷ পুরো ঘরে যা স্মেল ছিলো তারচেয়ে দ্বিগুণ স্মেল আমার রুমে। মনে হচ্ছিল আমার মাথার ভিতর কেউ বুঝি খোঁচাচ্ছে। কোনোমতে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বাথরুমে গেলাম গোসল করতে৷ ফিরে এসে দেখি ঘরের লাইট জ্বালানো। রুপু বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছে। চোখজোড়া ফুলে লাল হয়ে আছে। তেলে ডুবানো চুলগুলো দুহাতে টেনে ধরে রেখেছে। বিধ্বস্ত এক অবস্থা! আমাকে দেখা মাত্রই বললো,
– সিকু আমার চুলগুলো একটু টেনে দিবে প্লিজ৷ আমি আর সহ্য করতে পারছিনা।
আমি কি করেছিলাম জানো?
– কি?
– নাক মুখ কুঁচকে ওকে বলেছিলাম কারো সেবা যত্ন করে আমি অভ্যস্ত না। কারো চুল টানা, হাত পা টিপে দেয়া এগুলো আমার কাছে বিশাল বিরক্তিকর কাজ মনে হয়। তারউপর কিসব লাগিয়েছো মাথায়! বিদঘুটে গন্ধ। তোমার মাথায় হাত দেয়া সম্ভব না। আশা করি আমার ব্যাপারটা বুঝতে পারছো? তোমার খুব খারাপ লাগলে আমি সাবিহাকে ডেকে দিতে পারি। ডাকবো?
ও আর কোনো উত্তরই দিলো না। আবার বালিশটা মাথার উপর দিয়ে শুয়ে রইলো। তখন ওর কান্না পাচ্ছিলো কি না আমি জানি না৷ পাচ্ছিলো হয়তো! তাই বোধ হয় ওভাবে চুপচাপ মুখ লুকিয়ে আবারও শুয়ে পড়েছিলো চোখের পানি আড়াল করতে।
– মানুষটা কষ্ট পাচ্ছিলো, আর আপনি ওভাবে কথা শোনালেন! ব্যাপারটা খুব বেশি রুড হয়ে গেলো না?
– ব্যাপারটা আরো বেশি রুড হয়েছিলো সেদিন৷ আমি ওকে আমার ঘরে ঘুমাতে দেইনি। সাবিহার ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম ওর তেলের গন্ধে আমার ঘুম হবে না। রাতটা সাবিহার সাথে কাটালে ভালো হয়৷ ও চুপচাপ বিছানা ছেড়ে চলে গিয়েছিল সাবিহার ঘরে৷
– উনাকে ঘর থেকেই বের করে দিলেন! কি এমন তেল লাগিয়েছিলো উনি?
– তেলটার স্মেল বাজে ছিলো। তবে এতটাও না যে ওকে আমার ঘর থেকে পাঠিয়ে দিবো।
– তাহলে বের কেন করলেন?
– রুপুকে আমার ভালো লাগছিলো না। আমি শুধু সুযোগ খুঁজতাম ওর কাছ থেকে দূরে থাকার।
– উনাকে বিয়ে কেন করলেন?
– বাবার কথা বিশ্বাস করে। বিশাল ধাক্কা খেয়েছিলাম আমি। ধাক্কার তাল সামলে উঠতে পারছিলাম না। বাবার প্রতি খুব রাগ হয়েছিলো আমার৷ রাগে উনার সাথে কথা বলা কমিয়ে দিলাম। খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতাম না৷
– ভাবী সেদিনের পর আপনার সাথে রাগ করেনি?
– উহুম। আমার রুপু রাগ করার মত মানুষ না৷ সহজে সে রাগ করে না। অসহনীয় কষ্টও হাসিমুখে চেপে যাওয়ার ক্ষমতা রুপুর আছে।
সৈকতের দিকে খুব মনোযোগে তাকিয়ে আছে ইমরান। মানুষটাকে বুঝার চেষ্টা করছে সে। লোকটাকে নির্দয় আর অসভ্য মনে হচ্ছে। অথচ অফিসে জয়েন করার পর থেকে এই মানুষটাকে কখনোই মনে হয়নি সে নির্দয় কিংবা সে অসভ্য। তাহলে এটা কি তার বদলে যাওয়া রূপ? আগে কি সত্যিই সে তার বলা গল্পের মত রুড ছিলো? আর রুপন্তি? সে কোথায়? এই মানুষটার সঙ্গে এখনো আছে নাকি চলে গেছে?
একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন মনের মাঝে ছুটোছুটি করছে ইমরানের। খুব অস্থির করে তুলছে তাকে প্রশ্নগুলো। সমস্ত প্রশ্ন আর অস্থিরতাটুকু নীরবে মনের এককোনে রেখে সৈকতের দিকে তাকিয়ে আছে সে। প্রশ্নের উত্তরগুলো নাহয় গল্পের মাঝ থেকেই খুঁজে নিবে সে।
– ও যখনই সিক থাকতো আমি ওর ধারে কাছেও যেতাম না। নিজের মত থাকতাম। একবার হলো কি, রুপুর শুরু হলো মাথাব্যাথা৷ বরাবরের মত সেই অদ্ভুত বিশ্রি তেলটা ওর মাথায় লাগানো হলো। সাবিহাকে পাঠিয়ে দিলাম আমার ঘরে। আর আমি চলে গেলাম সাবিহার ঘরে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই জানতে পারলাম ও সারারাত ঘুমাতে পারেনি মাথাব্যাথায়। সকালে আমি যখন অফিসে আসার জন্য রেডি হচ্ছিলাম তখন ও একহাত বাড়িয়ে আমার হাত ধরলো। বললো,
– প্লিজ বাসায় থাকো। আমি বোধ হয় আজকেই মারা যাবো। মারা যাওয়ার সময় তুমি আমার সামনে থাকবা৷ তোমাকে থাকতেই হবে৷
ওর দু’চোখ বেয়ে পানি পড়ছিলো৷ বিশ্বাস করো ওর চোখের পানি দেখে আমার মায়া তো লাগলোই না উল্টো মেজাজ গরম হচ্ছিলো। সামান্য মাথাব্যাথাকে ইস্যু করে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করার মানে কি! বিরক্তিতে আমার চেহারা কুঁচকে এলো। আমি কিছুই বলিনি রুপুকে। জাস্ট ওর দিকে চেহারা কুঁচকে তাকিয়ে ছিলাম। ও বুঝতে পেরেছিলো আমি বিরক্ত হচ্ছি। ও কাঁপা কন্ঠে আমাকে বলেছিলো,
– আমাকে একটু ভালোবাসলে কি হয় সিকু? ভালোবাসো না কেন আমাকে? আমি কি তোমাকে খুব বিরক্ত করি?
– ঠিকই তো বলেছে। আপনি উনাকে একদমই ভালোবাসতেন না৷ কি এমন করেছে উনি? এত বিরক্তি কেন আপনার?
– কারন ও নবনী না৷ আমার প্রয়োজন ছিলো নবনীর মত একজন মানুষ। সেইসাথে চুপচাপ শান্তশিষ্ট একটা মেয়ে যে চুপচাপ সব মেনে নিবে। আমি নবনীকে যা দেখাতে চেয়েছিলাম সেটা আর কখনোই সম্ভব না সেটা আমি বিয়ের এক সপ্তাহের মধ্যে টের পেয়েছিলাম। এবং তার সাথে আমার সংসার করা সম্ভব না সেটাও ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলাম।
– এক সপ্তাহেই সংসার ভাঙার কথা মনে হলো আপনার!
– হুম। নবনীর সাথে কাটানো স্মৃতিগুলো খুব ডিস্টার্ব করছিলো৷ বারবার রুপুর মাঝে আমি নবনীকে খুঁজেছি। একবারও পাইনি। একটা কিংবা দুটো অমিল থাকলে হয়তো সংসার করা যেতো৷ যার সাথে আমার পুরোটাই অমিল তার সাথে সংসার কি করে সম্ভব?
– আপনি আপনার প্রেজেন্ট ওয়াইফের মাঝে যদি এক্স ওয়াইফকে খুঁজবেন তাহলে তাকে ডিভোর্স কেন দিলেন?
– নবনী যা চাচ্ছিলো তা আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব ছিলো না৷ দুর্ভাগ্যবশত রুপুও আমার কাছে একই জিনিস এক্সপেক্ট করতো৷ শুধু এক্সপেক্টই না, ও জোর করে ওর আবদারগুলো আদায় করে নিতো৷ পারতো না শুধু আমার ভালোবাসাটুকু আদায় করতে৷ প্রায়ই বলতাম চলে যাও। ডিভোর্স দিতে চাই তোমাকে। বিয়ের চারমাস পর থেকে খুব বেশিই বলতাম। ও বুঝতে পারতো আমি কথার কথা বলছি না। যা বলছি সত্যিই বলছি। তবুও ও রাগ করতো না৷ মুখ টিপে হাসতো। কখনো আমার গলা দুহাতে জড়িয়ে হাসতো আর বলতো, ভালো তো বাসো না একটুও। সারাদিন তো শুধু বকাই দাও আমাকে।তোমার নবনী বেস্ট আর আমার লাজ-লজ্জা নেই, সেল্ফ রেসপেক্ট নেই বলতেই থাকো। আবার ডিভোর্সও দিতে বলো। আমি কিন্তু ভীষণ রাগ করি। ইচ্ছে হয় চলে যাই৷ কিন্তু আমি যাই না। ব্যাগ গুছাতে যাবো ঠিক তখনই মনে হয় আমি চলে গেলে সিকু তো একদম একা হয়ে যাবে। কাকে বকা দিবে? আমি চলে গেলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট তোমারই হবে সেটা আমি জানি। এজন্য আমি যাই না। আর নয়তো কবে চলে যেতাম!
– উনার আত্মসম্মান নিয়ে খুব খোঁচাতেন তাই না?
– সুযোগ পেলেই এটা নিয়ে কথা শোনাতাম। কারণে অকারণে শোনাতাম। বিয়ের ২৭ দিন পর ও সাবিহাকে নিয়ে এসেছিলো আমার অফিসে। অফিসের ফ্লোরে পা রাখতেই আমাদের হাসিব ভাইয়ার সাথে ওর দেখা। ও বাহিরে দাঁড়িয়ে আমাকে কল করছিলো। আমি রিসিভ করিনি৷ আমি জানতাম না ও লিফটের ওখানে দাঁড়িয়ে আছে৷ ভাইয়া নিজ থেকে এগিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলো কাকে খুঁজছেন?
ও বললো, সিকুকে খুঁজি। সরি, সৈকতকে খুঁজি৷
ব্যস, হাসিব ভাইয়া অতটুকু শুনেই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা। সেদিন থেকে হাসিব ভাইয়া আমাকে সিকু বলেই ডাকতো৷ ভাইয়ার দেখাদেখি অফিসের সবাই ঐ নামেই ডাকা শুরু করলো। অফিসে রুপু সেদিন আড়াইঘন্টার মত ছিলো। আড়াইঘন্টার মধ্যে একঘন্টা হাসিব ভাইয়া নিজের রুমে রুপুকে বসিয়ে গল্প করেছে৷ রুপুর কথা শুনে খুব হেসেছিলো উনি সেই একঘন্টা। আর বাকি দেড়ঘন্টা অফিসের বাকি স্টাফদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিয়েছে রুপু। অদ্ভুত সব কথা বলে আড়াইঘন্টায় আমার অফিসের বস, কলিগ সবাইকে হাসিয়ে রুপু হয়ে গেলো আমার অফিসের সেলিব্রিটি আর অফিসের সবাই হয়ে গেলো রুপুর ফ্যান। হাসিব ভাইয়া তো রুপুকে অফিসের নিচ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসেছিলো। ও চলে যাওয়ার পর হাসিব ভাইয়া আমাকে বলেছিলো,
– চমৎকার একটা মেয়েকে বিয়ে করেছিস৷ কথা বললেই মন ভালো হয়ে যায়।
অফিসের সবাই রুপুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকতো৷ কেন থাকতো আমি জানি না। আমি খুব বিরক্ত হতাম ওদের প্রশংসা শুনে। না পারতাম কিছু বলতে না পারতাম সহ্য করতে৷ তারউপর অফিসে যেয়ে সিকু ডাকটা শুনলে মনে হতো আমার কান পঁচে যাচ্ছে। তবুও শুনতে হতো। বাধ্য হয়ে শুনতে হতো৷ আমার অফিসের কলিগদের সাথে রুপুর দারুন সম্পর্ক তৈরী হলো৷ ওর সাথে কমবেশি সবাই ফেসবুকে যোগাযোগ করতো৷ ও মাঝেমধ্যে অফিসে চলে আসতো। দিনদিন ওদের এই সুন্দর হতে থাকা সম্পর্কটা আমার কাছে বিষ মনে হতে লাগলো৷ সীমা ছাড়িয়ে গেলো ঠিক দুইমাস পর। আমাদের অফিস কলিগদের একটা মেসেঞ্জার গ্রুপ ছিলো। সেখানে আমরা সবাই টুকটাক কথা বলতাম, হাসি তামশা করতাম। সেই গ্রুপে রুপুকে এড করা হলো৷ সেদিন রুপুর সাথে খুব চেঁচামেচি করলাম। বললাম,
– তুমি এমন কেন? ওরা আমার কলিগ৷ ওদের সাথে তোমার এত কথা বলতে হবে কেন? এত সস্তা কেন তুমি? যখন তখন যেখানে সেখানে হাজির হয়ে ফালতু বকবক শুরু করো। ওরা তোমাকে অফিসে ডাকে আর তুমিও চলে যাও জোকার সেজে ওদের বিনোদন দিতে৷ নিজের সম্মানের দিকে একটু তো তাকাও!
ও বললো,
– এখানে সম্মানের প্রশ্ন আসছে কেন? কারো সাথে আমার সম্পর্ক যদি ভালো হয় সেখানে সম্মান নিয়ে টানাটানির কি আছে? সবকিছুতেই এত সম্মান-সম্মান করো কেন? তুমি যেটাকে আত্মসম্মান ভাবো সেটা কখনোই আত্মসম্মান না। সেটা তোমার ইগো।
– হ্যাঁ। ঠিকই তো বলেছে। অফিসের কেউ কি কখনো আপনাকে বলেছে ভাবীকে উনারা জোকার ভাবে?
– উহুম। অফিসের সবাই ওকে খুব পছন্দ করে।
– তাহলে এসব বললেন কেন?
– তখন যা মাথায় এসেছে তাই বলেছি।
– একটা কথা বলুন তো? আমি অফিসে এসেছি ছয়মাস হলো। কখনো তো দেখিনি কেউ আপনাকে সিকু বলে ডাকছে কিংবা ভাবীকে নিয়ে কেউ কোনো কথা বলেছে।
– ওরা কেউ কখনো অফিসে বসে রুপন্তিকে নিয়ে কোনো গল্পই করবে না। আমাকে ঐ নামে ডাকবেও না।
– কেন?
– হয়তো রুপু নিষেধ করেছে।
– কেন?
– সেটা আমার শাস্তি।
– ভাবী কি এখনো আপনার সঙ্গে আছে? নাকি চলে গিয়েছে?
#পর্ব_৫
সৈকত মুচকি হাসলো। ইমরানের প্রশ্ন এড়িয়ে অন্য প্রসঙ্গ টেনে আনলো৷
মাসখানেক যাওয়ার পর নবনী নামক শূণ্যতা আমাকে আরো বেশি জেঁকে ধরলো। আমার বারবার মনে হতে লাগলো কেন আমি নবনীকে যেতে দিলাম? কেন আমি রুপন্তিকে বিয়ে করলাম? নবনী আমার জন্য পারফেক্ট ছিলো। নবনীর সবকিছু আমার সাথে মিলে যেতো। কত ভালো ছিলাম আমি! আর রুপন্তির সাথে আমার সম্পর্কটা একটা মিসম্যাচ। দুজনের মাঝে বিশাল পার্থক্য। এই পার্থক্য কখনোই মিটবে না। ওর প্রতিটা ব্যাপার আমার কাছে বিরক্তিকর মনে হতো৷ রুপুকে আমার কাছে বিশাল বড় আপদ ছাড়া আর কিছুই মনে হতো না। বিশেষ করে আমার ব্যক্তিস্বাধীনতায় কেউ নাক গলাচ্ছে এটা আমার সহ্য হচ্ছিলো না৷ ও ভালো কথা বললেও আমার বিরক্ত লাগতে শুরু করলো। আমি খুব বেশি ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে গিয়েছিলাম। কোনকিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলাম না৷ কাজে মন বসাতে পারছিলাম না। তখন মনে হলো রুপন্তিকে আর চুপচাপ মেনে নেয়া ঠিক হচ্ছে না। ওকে কড়া কথা না শোনালে আমি শান্ত হতে পারবো না। মনে রাগ পুষে আর কতক্ষণ শান্ত থাকা যায় বলো? সেদিন অনেক রাতে বাসায় ফিরলাম। বরাবরের মতই রুপন্তি বারবার কল করছিলো। আমি একটা কলও রিসিভ করিনি। যখন আমি বাসায় পা রাখি তখন বাজে রাত এগারোটা পঁয়তাল্লিশ। কলিংবেলে চাপ দেয়া মাত্রই রুপু দরজাটা খুলে দিলো। মনে হচ্ছিল যেন ও দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলো। আমাকে দেখতেই ভ্রু কুঁচকে অভিযোগ করা শুরু করলো,
– এতক্ষণ কোথায় ছিলে তুমি? কতবার কল করলাম একটাও রিসিভ করলে না!
ওর কোনো কথার উত্তর না দিয়েই জুতা খুলে ঘরে ঢুকলাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে রইলো উত্তরের আশায়। বাবা ডাইনিংরুমেই দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি উত্তর দিচ্ছি না দেখে বাবা বললো,
– মেয়েটা কখন থেকে অস্থির হয়ে আছে। ওর প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিস না কেন?
ব্যস, শুরু করে দিলাম চিৎকার। বললাম,
– কেন এই মেয়ের সব কথার উত্তর আমাকে দিতে হবে? ও কে? কেন ওকে আমার সবকিছুর কৈফিয়ত দিতে হবে?
বাবা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো৷ আমার চিৎকারে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো মা আর সাবিহা। ওরা দুজনও চুপ করে ছিলো আমার চিৎকারে৷ আমার এসব আচরনের সাথে বাসার সবাই পরিচিত ছিলো৷ অপরিচিত ছিলো রুপন্তি৷ খুব অবাক হয়েছিলো সেদিন। কেমন বোকা বোকা চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। খুব শান্ত কন্ঠে আমাকে বললো,
– তুমি বাবার সাথে এভাবে কথা বলছো কেন?
সেদিনই প্রথমবার রুপন্তির দিকে আমি চোখ রাঙিয়ে তাকিয়েছিলাম। দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিয়েছিলাম,
– তো আর কার সাথে করবো শুনি? উনার কথায় তোমাকে বিয়ে করেছি। ভেবেছিলাম বাবা তো আর ছেলের জন্য খারাপ কোন সম্বন্ধ নিয়ে আসবে না৷ তোমার মত একটা সার্কাসের জোকারকে আমার কাঁধে ঝুলিয়ে দেয়া হবে কখনোই কল্পনা করতে পারি নি। বিয়ের পর থেকে আমার ঘাড়ে চড়ে বসে আছো। নরকে পরিণত হয়েছে আমার জীবন। যা যা আমি সহ্য করতে পারি না সেসব আরো বেশি করে করতে থাকো। কেন করো? কি চাও? আমাকে অশান্তিতে রেখে মারতে চাও তুমি?
– আমি কি……
– থামো। একটা কথাও বলবে না। সারাদিন কথা বলতেই থাকো, বলতেই থাকো। কত কথা বলো! মুখ ব্যাথা করে না তোমার? পাশের মানুষটা বিরক্ত হচ্ছে কি না সে খেয়াল আছে তোমার? মাথাব্যাথা শুরু হয় আমার তোমার কথা শুনতে শুনতে। আর এতবার কল করার কি আছে শুনি! ভালো লাগে না ঘন্টায় ঘন্টায় এত কল। আমি কেন তোমার কল রিসিভ করি না এটা তুমি বুঝো না কেন? ইচ্ছে করে রিসিভ করি না আমি। এতটুকু বুঝার ক্ষমতা কি নেই? নাকি বুঝেও না বুঝার ভান ধরো?
আমি রুপুকে এতগুলো কথা বললাম অথচ ও আমার একটা কথারও প্রতিউত্তর দিলো না৷ একফোঁটা চোখের পানিও ও ফেলেনি৷ শুধু চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো৷
– খুব সাধারণ কথা ছিলো। এখানে তো রেগে যাওয়ার মত কোন কথা ছিলো না৷
– হ্যাঁ, খুব সাধারণ কথাই ছিলো। কিন্তু ওর প্রতি আমার রাগ তো পুরানো ছিলো৷ ঐ একমাসের রাগ একদিনে ঝেড়েছি৷
– আপনার বাবা মা কিছুই বললো না?
– না৷ উনারা জানতো আমাকে তখন কিছু বললে আমি আরো বেশি রেগে যেতাম আর যা খুশি বলে দিতাম।
– সেদিনের পর ভাবী আপনার সাথে রাগ করে ছিলো কতদিন?
– কতদিন! কি যে বলো না! আমি ভেবেছিলাম সেদিনের পর রুপু আর উল্টাপাল্টা কিছু করবে না৷ আমাকে বিরক্ত করবে না৷ রাগ করে আমার সাথে এটলিস্ট সপ্তাহখানেক কথা বলবে না৷ আমি এই কয়টাদিন একটু শান্তিতে কাটাতে পারবো। আমার ধারণা আবারও ভুল হলো৷ কড়া কথা মুহূর্তেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার ক্ষমতা রুপুর আছে সেটা আমি সেদিনই জেনেছি। সেদিন শাওয়ার নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখি রুপু ওয়াশরুমের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে৷ আমার হাত থেকে তয়লাটা নিয়ে আরেক হাতে টেনে আমাকে বসালো খাটের উপর। তয়লা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বললো,
– এত রাগ করেছো আমার সাথে! এত বকা দিতে জানো তুমি! আমি কিন্তু কষ্ট পেয়েছি। এবারের মত মাফ করে দিলাম৷ আর কখনো এভাবে বকবে না আমাকে। আবার যদি বকা দাও তাহলে আমি কিন্তু রাগ করে চলে যাবো।
আমি আবারও বোকা বনে গেলাম। সামনে দাঁড়িয়ে সযত্নে আমার চুল মুছতে থাকা মেয়েটাকে আমি বেহায়া হিসেবে আবিষ্কার করলাম। কিভাবে সম্ভব! এত কথা শোনার পরও কিভাবে এই মেয়ে আমার সাথে আহ্লাদ করে কথা বলছে! ও আরও কি বলছিলো জানো?
– কি?
– সিকু তোমাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। একগ্লাস শরবত এনে দেই৷ খুব যত্ন করে বানাবো। আমার এত্তগুলো ভালোবাসাও মিশিয়ে দিবো। খাওয়ার সাথে সাথেই দেখবে এসব ক্লান্তি টান্তি সব উধাও৷
– কি অদ্ভুত! আপনার কথা শুনে উনি নিশ্চয়ই টের পেয়েছিলো আপনি কতটা বিরক্ত উনার প্রতি। সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী উনি৷ বিয়ের পরপরই কোনো মেয়ের সাথে তার হাজবেন্ড এত রুড বিহেভ করলে তো সেই মেয়ে হয় বাবার বাড়ি ফিরে যাবে আর নয়তো দশ বারোদিন কথাই বলবে না। অথচ উনি আপনার আচরণ কি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিলো! আপনাকে খুশি করার চেষ্টা করছে!
– ও এমনই। ওকে কেউ শ’খানেক কড়া কথা শোনালেও ওর কিছুই আসে যায় না৷ এক কানে ঢুকায় অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়। রুপুকে কেউ বকা দিলে তার সাথে রুপু কয়েক মিনিট পরই হেসে হেসে কথা বলা শুরু করে৷ ওকে দেখে বুঝার উপায় নেই একটু আগেই সামনের মানুষটার কাছে সে বকা খেয়েছে। আর আমি বকা দিলে কিছুক্ষণ চুপ থাকতো। তিন চারমিনিট পর আমার হাত জড়িয়ে ধরে বলতো,
– থাক, আমরা আমরাই তো। তুমি বকা দিয়েছো আবার তুমিই আদর করবে৷ বকা তো দিয়েছোই এখন রাগ ঝেড়ে ফেলো তো! কাছে আসো তোমাকে একটু আদর করে দেই।
এই বলেই গাল নয়তো ঠোঁটে চুমু দিতো।
– উনি আপনাকে খুব ভালোবাসতো তাই না?
– অনেক বেশি৷ আমি ওর ভালোবাসার যোগ্য ছিলাম না৷ এতখানি ভালোবাসার মত কিছুই আমি করিনি। কিন্তু আমাকে ঘৃনা করার মত অনেক কারণ ছিলো ওর কাছে। ওর সাথে প্রথম যেদিন আমি খারাপ ব্যবহার করলাম, সেদিনের পর থেকে ওর সাথে ভালো আচরন আমি খুব কমই করেছি। সেদিন রুপু এতগুলো কথা শোনা সত্ত্বেও আমার সাথে নরমাল বিহেভ করে আমাকে লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছিলো ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করার। পান থেকে চূন খসলেই ওকে আমি কথা শোনাতাম। দিন যাচ্ছিলো ওকে কড়া কথা শোনানোর মাত্রা আরো বাড়ছিলো৷
– কেন?
– মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার। রুপু কেন সবকিছু স্বাভাবিকভাবে নেয়, ও কেন কষ্ট পায় না এসব আমাকে খুব খোঁচাচ্ছিল। কি বললে ও কষ্ট পাবে, ও মেনে নিতে পারবে না এটা জানা আমার জন্য খুব জরুরি হয়ে গেলো। এজন্যই ওকে নিত্যদিন কিছু না কিছু শোনাতামই। ওকে কথা শুনিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না দেখে শুরু করলাম নবনীর সাথে তুলনা করে ওকে খোঁটা দেয়া। কথায় কথায় নবনীর সাথে ওকে তুলনা করতাম। আজেবাজে বকতাম। ও শুধু হাসতো আর বলতো,
– তোমার নবনী কখনোই আমার মত হতে পারবে না। দুনিয়াতে রুপু এক পিসই আছে।
– এত অপমান করতেন, তবুও উনি আপনাকে ভালোবাসতো!
– হুম বাসতো। অকারণেই রুপু আমাকে ভালোবাসতো। পৃথিবীতে কোনো মেয়ে তার হাজবেন্ডের মুখে এক্স ওয়াইফের প্রশংসা হাসিমুখে মেনে নিয়েছে এমন ঘটনা আমি কখনোই শুনিনি৷
– শুধু আপনি কেন? কেউই শুনেনি৷
– সত্যিই পৃথিবীতে রুপু একজনই আছে। ওর মত কেউ নেই।
– এই মানুষকে এত অবহেলা কি করে করলেন ভাইয়া? আপনি উনাকে কখনো স্বাভাবিক ভাবে মেনেই নেন নি। কেন?
– প্রথম থেকেই আমার মাথায় গেঁথে গিয়েছিল রুপু আমার মত না। ও অদ্ভুত এবং বিরক্তিকর একটা ক্যারেক্টার। ওকে এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।
– একটাবার কি উনাকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেয়ার চেষ্টা করতে পারতেন না?
– অবশ্যই পারতাম। কিন্তু করিনি। যাকে জীবন থেকে চিরতরে সরিয়ে দিতে চাচ্ছি তাকে কেন স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়ার চেষ্টা করবো?
জানো ইমরান, রুপু জাদু জানতো। মানুষ বশ করার জাদু৷ আমার ছোট ফুফু খুবই জাদরেল স্বভাবের মহিলা। বিয়ের সাতমাসের দিকের ঘটনা। একরাতে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসে জানতে পারলাম পরদিন ফুফু আসছে৷ মনে মনে কি যে খুশি হয়েছিলাম!
– আপনার ফুফুর সাথে সম্পর্ক খুব ভালো ছিলো ?
– মোটেই না। আমরা দুজন দুজনকে একদম সহ্য করতে পারতাম না৷ ফুফু কারো কোনো ভুল দেখলেই খোঁচা দিয়ে কথা বলতো, বকা দিতো। আমার ফ্যামিলির সাথে আমার অতটা আন্তরিক সম্পর্ক ছিলো না, বাবা মা কে তেমন প্রায়োরিটি দিতাম না এসব কারণে ফুফু আমাকে কথা শোনাতো৷ আমার অসহ্য লাগতো উনাকে। উনি আমাদের এখানে আসলে সহজে আমি বাসায় পা রাখতাম না। আর আমার বিয়ের পর তো নবনীকে যথাসম্ভব উনার কাছ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতাম। উনি নবনীকে সহ্যই করতে পারতো না। সবসময় বাবা মাকে বলতেই থাকতো,
– কি এক বউ যে সৈকত নিয়ে আসলো! এটা বউ নাকি ব্যাটা ছেলে বুঝি না তো কিছু।
– ব্যাটা ছেলে বলতো কেন?
– নবনী জিন্স পরতো। বাসার কাজ টাজ ছুঁয়েও দেখতো না৷ বাসার বাহিরে থাকতো বেশিরভাগ সময়। এসব কারণে ফুফু ওকে ছেলে ডাকতো। রুপু রান্না করতে পারতো না। রান্না করতে গেলে জিনিসপত্র নষ্ট করে ফেলতো। তারউপর বকবকানি স্বভাব, সারাঘর অকারণে ছুটোছুটি তো চলতোই। ফুফু এসব একদম সহ্য করতে পারবেনা এটা আমি নিশ্চিত ছিলাম৷ উনার মতে মেয়ে মানুষ হবে ঘরোয়া কাজে পটু, শান্ত আর স্নিগ্ধ। আমি রেডি হয়ে বসে ছিলাম ফুফু রুপুকে জম্পেশ ধোলাই দিচ্ছে সেটা দেখার জন্য। পরদিন আমার অফিস আসতে ইচ্ছা হচ্ছিলো না৷ কাজের প্রেশার ছিলো অনেক তাই আসলাম। মন পড়ে রইলো বাসায়৷ কতক্ষণে বাসায় যাবো সেই অপেক্ষায় অস্থির হয়ে গেলাম। অস্থিরতায় এক কাজ তিনবার ভুল করলাম৷ আমার আর জলদি বাসায় ফেরা হলো না৷ বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত একটা। বাসার সবাই ঘুম একমাত্র রুপু বাদে। ও জেগে বসে ছিলো আমার জন্য। সবসময়ের মত আমার মুখ দেখেই বললো আমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। লেবুর শরবত বানিয়ে দিবে কিনা৷ অন্যদিন হলে রাত একটায় আমি কখনোই শরবত খেতে রাজি হতাম না৷ কিন্তু সেদিন শরবত বানাতে বললাম। ছুটে চলে গেল রান্নাঘরে শরবত বানাতে। আমি ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি ও শরবতের গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাত থেকে গ্লাস নিয়ে খুব ধীরে ধীরে শরবত খাচ্ছিলাম আর অপেক্ষা করছিলাম ও আমাকে কখন ফুফুর কাছ থেকে ধোলাই খাওয়ার গল্প শোনাবে। একগ্লাস শরবত আমি পুরো বিশমিনিট সময় নিয়ে শেষ করলাম। এই বিশ মিনিটে রুপু রাজ্যের সব গল্প বলে ফেললো অথচ ফুফুকে নিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করলো না৷ ও কিছু বলছে না দেখে আমিই জিজ্ঞেস করলাম
– ফুফু এসেছে?
– হ্যাঁ এসেছে তো। সাবিহার সাথে ঘুমাচ্ছে।
– কথা হয়েছে উনার সাথে?
– ও মা! হবে না! সারাদিনই তো কথা হয়েছে। খুব ভালো মানুষ।
– বকা টকা দিয়েছে?
– নাহ্। বকা দিবে কেন?
– রান্না বান্না তো জানো না। করো তো সারাক্ষণ তিড়িংবিড়িং৷ তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কি!
– নাহ্ আমাকে তো বকে নি।
– সত্যিই বকা দেয়নি?
– নাহ্। ভালোই তো কাটালাম সারাদিন। আমি আইসক্রিম পছন্দ করি তাই বিকেলে আমাকে দোকানে নিয়ে গিয়েছিলো। বললো, যেই ফ্লেভারের বক্স ভালো লাগে সেটা তুলে নিতে। রাতে আমি সাবিহা আর ফুফু বসে রজনী কান্তের মুভিও দেখেছি। কাল থেকে উনার কাছে আমার কুকিং ক্লাস শুরু হবে। উনি নিজেই বললো আমাকে রান্না শেখাবে এই দশদিন। দশদিনে দশটা রেসিপি শিখবো আমি৷
ওর কাছে এই ধরনের উত্তর আমি মোটেও আশা করিনি। সারাদিনের আশা আর স্বপ্ন মুহূর্তেই মাটি হয়ে গেলো। প্রচন্ড হতাশ হলাম আর ভাবতে লাগলাম, এটা কেমন অবিচার! রুপুর এক হাজার সমস্যা থাকা সত্ত্বেও ফুফু ওকে কেন ছাড় দিলো? আমি হলে তো এতক্ষণে ধুয়ে মুছে শেষ করে ফেলতো। লেবুর শরবতের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে আরো বেশি হতাশ লাগছিলো। অহেতুক এত রাতে এই শরবতটা আমাকে খেলাম। তাও বিশি মিনিট সময় নিয়ে! পুরো সময়টাই আমার বৃথা। একে তো মেজাজ খারাপ হচ্ছিল খুব। তারউপর আগুনে ঘি ঢালার মত একটা কথা বলে বসলো রুপন্তি।
– কি বলেছিলো?
– ও কেমন একটা শয়তানী ধাঁচের হাসি দিয়ে বললো ফুফু আমাকে বকেনি কিন্তু অন্য একজনকে বকেছে। জানো কাকে? আমার সতীন নবনীকে। কি বলেছে জানো? তুমি একটা অহংকারী আর অকর্মার ঢেঁকিকে বিয়ে করেছিলে। আর এখন তোমার বিয়ে হয়েছে মিষ্টি চড়ুই পাখির সাথে৷ এইযে তুমি আমাকে রান্না জানি না, আমি কোন কাজের না এসব বলে খোঁটা দাও আর নবনীর এত গুন কীর্তন করতে থাকে এগুলো কিন্তু ঠিক না। রান্না তোমার নবনীও জানতো না৷ সে আর আমি একইরকম। আমরা দুজনই অকর্মা। ফুফু আমাকে সব বলে দিয়েছে।
এগুলো বলেই ও হাসতে শুরু করলো। রাগে পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলছিলাম আমি। তখন কয়টা বাজে ঘড়িতে! খুব সম্ভবত দুইটা। অতরাতেই আমি খুব চেঁচামেচি করেছিলাম রুপুর সাথে।
– কি বলেছিলেন?
– অনেক কিছু। নবনীর সাথে ও নিজেকে তুলনা করছে এটা আমার সহ্যই হলো না। বললাম, নবনীর সাথে নিজেকে তুলনা করো! নবনীর পায়ের যোগ্যতা তোমার আছে! ও ঘরের কাজ পারে না কিন্তু নিজের ক্যারিয়ার তো সামলে যাচ্ছে। ও কত ট্যালেন্ট তুমি জানো? মাসে কত সেলারী পায় সে খবর জানো? মানুষকে বিরক্ত করা ছাড়া আর তো কিছুই করতে জানো না।
– হ্যাঁ করবোই। করতেই থাকবো৷ কি চাও? তোমাকে রেখে চলে যাই? তুমি যত বেশি রাগ করবে আমি ততবেশি তোমাকে জ্বালাবো৷ জীবন থাকবে যতক্ষণ জ্বালাতে থাকবো ততক্ষণ। এই যে তোমার গলায় ঝুলেছি, আমি আর তোমাকে ফেলে কোথাও যাচ্ছি না৷ তুমি চাইলেও আমাকে দূরে সরাতে পারবে না।
– একটা কথা বলি ভাইয়া?
– হুম?
– নবনী আপনার এক্স৷ হতে পারে ভাবীর সহ্যক্ষমতা বেশি। কিন্তু আপনার এক্স কে নিয়ে ভাবীকে এত কথা না শোনালেও পারতেন৷ হয়তো উনি হাসিমুখে কথাগুলো ইগনোর করতো কিন্তু কষ্ট কি উনি পেতো না? একটু হলেও পেতো।
– অবশ্যই রুপুর কষ্ট হতো৷ কিন্তু ও প্রকাশ করতো না৷ অদ্ভুত সহ্যক্ষমতা আছে ওর। রুপুর এই সহ্যক্ষমতার শেষ সীমা কোথায় সেটা খুঁজতে গিয়েই তো আমি আমার সীমা অতিক্রম করে ফেলেছিলাম।
(চলবে)