ঘুণপোকা,পর্ব_৬,৭
মিম
পর্ব_৬
সোফা ছেড়ে উঠে টেবিলের একপাশে থাকা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢাললো সৈকত৷ চেয়ার টেনে বসে থেমে থেমে পানি খাচ্ছে সে। সৈকতের দিকে তাকিয়ে আছে ইমরান। নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে সে এই মানুষটার মাঝে। সৈকত রুপন্তির সঙ্গে যেমন আচরণ করতো সেও তো একই আচরণ অনন্যার সঙ্গে করে৷ রুপন্তি আর অনন্যার ক্যারেক্টারে খুব মিল।সৈকত আর তার নিজের মাঝে তো পার্থক্য নেই। তাহলে আজ কেন রুপন্তির প্রতি সৈকতের এতখানি অবহেলার গল্পগুলো শুনে রুপন্তির জন্য কষ্ট হচ্ছে? সৈকতকে কেন দোষী মনে হচ্ছে? আপন দোষগুলো কেউ নিজ চোখে দেখতে পায় না বলে?
পানি খাওয়া শেষে সৈকত উঠে এলো চেয়ার ছেড়ে। সোফায় আবারও গা এলিয়ে বসলো। মাথার চুলগুলো এলোমেলো করতে করতে বললো,
– পরদিন শুক্রবার ছিলো। ঘুম থেকে উঠলাম দেরী করে। নাস্তার জন্য ডাইনিংরুমে যেতেই ফুফুর সাথে দেখা৷ টেবিলে বসে উনি চা খাচ্ছিলো। উনাকে দেখে কোনোমতে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে দায়ভার শেষ করলাম। রুপন্তি এসে নাস্তা দিলো। রুটি মুখে দিতে যাবো ঠিক এমন সময় উনি বলে বসলো,
– তুমি যে একটা সভ্য পরিবারের ছেলে তা কি তুমি জানো?
উনার প্রশ্ন শুনে চমকে গেলাম। খুঁজতে লাগলাম আবার কি করলাম আমি? কোন ইস্যু নিয়ে আমাকে এই সকালবেলা ধোলাই করা হবে? উনি ধমকে আমাকে বললেন,
– রাত বিরাতে বউয়ের সাথে চেঁচামেচি করে তুমি আশপাশের লোকজনরে কি প্রমান করতে চাও? তুমি অশিক্ষিত জংলী পরিবারের ছেলে? পরিবার থেকে কোনো শিক্ষা পাও নাই?
উনার কথা শুনে আমার মনে পড়লো আগের রাতের কথা৷ আমি চুপ করে রইলাম। আমার তখন কিছু বলার ছিলো না। কি বলতাম আমি? এক হিসেবে দোষ তো আমারই ছিলো৷ এতরাতে চিৎকার চেঁচামেচি করা আসলেই অসভ্যতা৷ মনে মনে খুব রাগ হচ্ছিলাম রুপুর উপর। ওর কারনে আমি দিনদিন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যাচ্ছিলাম। কখন কোথায় কি করা উচিত সব কিছু ভুলে ম্যানারলেস হয়ে যাচ্ছিলাম।
– এখানে ভাবীর দোষ দিচ্ছেন কেন?
– তখন সবকিছুতেই ওকে আমার দোষী মনে হতো। কারণ ও নবনীর মত পারফেক্ট না।
– নবনীকে আপনার কেন পারফেক্ট মনে হতো? উনিও তো পারফেক্ট ছিলো না।
– হ্যাঁ ও পারফেক্ট ছিলো না৷ কিন্তু ও আমার মত ছিলো। তাই ওকে আমার কাছে পারফেক্ট মনে হতো।
– আপনার ফুফু আর কিছু বলেনি আপনাকে?
– বলার বাকি রেখেছে নাকি! নবনীর পায়ের যোগ্য রুপু না এটা ফুফু শুনেছিলো৷ দাঁতে দাঁত চেপে আমাকে বললো, রুপন্তিরে তুমি ঐ মেয়েটার পায়ের যোগ্যও মনে করো না! সাহস কত তোমার এই কথা আবার রুপন্তিরে মুখের উপর শুনাও! এত মিষ্টি বউ পাওয়ার পরও তোমার সুখ নাই! কি চাও তুমি? জিন্স পড়া চাকরি করা বউ দরকার তোমার? তোমার নবনীর চাকরি করা ছাড়া আর কি যোগ্যতা আছে? অহংকারী মেয়ে একটা! ঘরের কাজ জানে না, মানুষের সাথে মিশতে জানে না, মেহমান আদর আপ্যায়ন করতে জানে না। শ্বশুর শ্বাশুড়ি আপন করতে জানে না৷ তোমার ঐ বউ তো হাসতেও জানে না। হাসতে গেলেও তার কষ্ট! তোমার ঐ বউর সাথে রুপন্তিরে কেমনে মিলাও তুমি? অন্ধ হইছো? তোমার মায়ের কাছেও আমি শুনছি তুমি রুপন্তির সাথে খারাপ ব্যবহার করো সবসময়৷ কেন করো? কি করছে সে? জিন্স পড়া বউ দরকার তোমার? আজকেই রুপন্তিরে মার্কেটে নিয়ে জিন্স কিনে দিবো। চাকরি করা বউ লাগবে? রুপন্তি মূর্খ না। শিক্ষিত মেয়ে। মাস্টার্সটা শেষ করুক। তোমার ফুফাকে দিয়ে আমি ওর চাকরি ব্যবস্থা করাবো৷ তারপর দেখি তুমি কেমনে নবনীর পায়ের সাথে ওরে তুলনা করো।
ফুফু কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে শেষ করলো। আমিও চুপচাপ শুনলাম। কথা শেষে উনি চায়ের কাপে চুমুক দিতেই আমি বললাম,
– এক নিঃশ্বাসে তো এতগুলো কথা বলে দিলেন। এত আবেগপ্রবণ হওয়াও ভালো না৷ কিছু তো বাস্তবতার সাথে মিল রেখে কথা বলেন। এই যে বললেন রুপন্তি চাকরি করবে, এটা কিভাবে সম্ভব? কে ওকে এপোয়েন্ট করবে? এক জায়গায় স্থির থাকতে পারে ও? কথা বলেই তো সময় পার করবে, কাজ করবে কখন? হাসতে হাসতে লোকজনের গায়ের উপর পড়ে যায়। যাকে পায় তার সাথেই গল্প শুরু করে দেয়। অদ্ভুত সব প্রশ্ন করে বেড়ায়। এমন আজব ক্যারেক্টারকে কে এপোয়েন্ট করবে আমাকে একটু বলেন। মিনিমাম সেল্ফ রেসপেক্ট আছে ওর? কোনো পারসোনালিটি নাই এই মেয়ের। এসব ক্যারেক্টারের মেয়েদের ক্যারিয়ার নামে কিছু থাকে না ফুফু। এদের জন্য ঘর সংসারই উপযুক্ত। রুপন্তি তো সেটাও ঠিকঠাক করতে পারে না। রান্নাবান্না তো কিছুই জানে না। এখানে আসার পর রান্না করতে গিয়েছে পাঁচদিন। দুইদিন হাত পুড়েছে, একদিন হাত কেটেছে, একদিন পুরো পাতিলসহ তরকারী ফেলে দিয়েছে আরেকদিন তো রান্নাঘরেই আগুন ধরানোর ব্যবস্থা করেছিলো। আর টেস্টের কথা নাইবা বলি। মা দেখিয়ে দেয়া সত্ত্বেও গড়মিল করে ফেলে। তো ওকে আমি গতরাতে ঐসব কথা শুনিয়ে কি খুব অন্যায় করেছি?
– রুপন্তিরে নিয়ে এত সমস্যা হলে আমার কাছে দিয়ে দাও। আমি ওরে নিয়ে যাই। থাকতে হবে না তোমার সাথে৷
– কথায় আর পারছেন না ফুফু তাই না?
– থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিবো। বেয়াদবির শেষ প্রান্তে চলে গেছো। আমাকে তোমার মা বাবা পাও নাই। কথায় পারি না মানে কি? বলবো কথা তোমারে? শুনলে তো আবার তেলে বেগুনে জ্বলবা। রুপন্তির সেল্ফ রেসপেক্ট নাই তাই তোমার পছন্দ না। তোমার তো অনেক সেল্ফ রেসপেক্ট। তোমার আগের বউয়ের তো পা থেকে মাথা পর্যন্ত সেল্ফ রেসপেক্ট ছিলো। সেল্ফ রেসপেক্টের ঠ্যালাঠেলিতে তো ডিভোর্সই হয়ে গেলো৷ এই মেয়ের সেল্ফ রেসপেক্ট নাই দেখে তোমার সংসারে পড়ে আছে। আর নয়তো তোমার আগের বউয়ের মত লাত্থি মেরে তোমারে রেখে চলে যাইতো৷ শুকরিয়া করো এমন বউ পাইছো। আর নয়তো ডিভোর্স আরো একবার হইতো। তোমার মত বেয়াদবের সাথে কে করবে সংসার? কোনো মেয়েরে তুমি জীবনে সুখ দিতে পারবা না৷
ফুফুর কথায় কতটুক ক্ষেপে গিয়েছিলাম তা বলে বুঝানো সম্ভব না৷ নবনী যেই দোষগুলো আমার ঘাড়ে চাপিয়ে আমাকে ডিভোর্স দিয়েছিলো একই দোষ ফুফুও দিলো। নাস্তা টেবিলে রেখেই চলে এলাম নিজের ঘরে৷ রুপন্তিকে আমার একটা ডাইনি মনে হচ্ছিল। মানুষ বশ করা ডাইনি৷ ফুফুকে কিভাবে সে একরাতে কন্ট্রোল করে ফেললো সেটাই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সবকিছু হচ্ছিল রুপন্তির জন্য। ইচ্ছে হচ্ছিলো নিজের চুল সব টেনে নিজেই ছিঁড়ে ফেলি৷
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সৈকত। সৈকতের দু’চোখের দিকে তাকিয়ে আছে ইমরান। চোখজোড়ায় যেন হঠাৎ করেই খুব ক্লান্তিরা ভর করেছে। অনুশোচনার ক্লান্তি….
সৈকত চোখজোড়া নিচে নামিয়ে ফেললো৷ ক্ষীণ হয়ে যাওয়া কন্ঠে বললো,
– আমি ঘরে যাওয়ার পরই রুপু চলে এলো। হাতে খাবারের প্লেটটা নিয়ে বসে পড়লো আমার পাশে। রুটি ছিঁড়ে আমার মুখের সামনে তুলে বললো,
এত্ত রাগ করো কেন? ফুফু মুরুব্বি মানুষ। কত কথাই বলবে। তাই বলে তুমিও এভাবে মেজাজ দেখাবে! ঠিক না সিকু। আবার নাস্তাটাও ফেলে চলে এলে৷ নাও, হা করো।
একে তো আমি রাগে ফুঁসছিলাম। তারউপর রুপু আমার সামনে এসে এসব বলে আগুনে আরো ঘি ঢেলে দিলো। ওকে আমি সেই কথাগুলো বললাম যেগুলো আমার বলা উচিত হয়নি।
– কি বলেছিলেন?
– নাদিমের ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলেছিলাম।
– নাদিম কে?
– রুপু যার জন্য বাসা থেকে পালিয়েছিলো সে। ও আমার দিকে খাবার বাড়িয়ে দিতেই ওর হাত থেকে প্লেটটা নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম ফ্লোরে। প্লেট ভেঙে কয়েক টুকরা হয়ে গেলো। এরপর শুরু করলাম ওর প্রেমিককে নিয়ে টানাটানি। বললাম, গিয়েছিলো তো প্রেমিকের সাথে সংসার করতে। পরদিনই তো প্রেমিক ফেরত পাঠালো তোমাকে। উচিত কাজ করেছে। ঐ ছেলে তোমাকে ছাড়বে না তো কি করবে? তোমার মত জোকারের সাথে সংসার করবে? তুমি সংসার করার উপযুক্ত? দিনভর মানুষকে বিরক্ত করা ছাড়া আর কি করতে পারো? ঐ ছেলে তোমাকে ছেড়ে দিয়ে বিপদ থেকে বেঁচে গিয়েছে। বাঁচতে পারেনি তোমার বাবা, বাঁচতে পারছিনা আমি। তোমার বাবা তো তোমার দেয়া মেন্টাল স্ট্রেস সহ্য না করতে পেরে স্ট্রোক করে কতগুলো দিন অসুস্থ ছিলো৷ বেচারা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট করে কথা বলতে পারে না৷ আর আমি? আমার তো মন চায় দেয়ালে মাথা ঠুকতে থাকি। মাঝেমধ্যে তো মনে হয় মাথার রগ ছিঁড়ে আজই মারা যাবো। কি করে পারো রুপন্তি লোকজনকে এত যন্ত্রনা দিতে! মুক্তি চাই এসব থেকে! মুক্তি! প্লিজ আমাকে মুক্তি দাও। চলে যাও আমার জীবন থেকে। আমি আর তোমাকে সহ্য করতে পারছি না। আমার দ্বারা আর সম্ভব না।
প্রথম! সেদিনই প্রথম আমি রুপুর চোখে পানি দেখেছিলাম! রুপু কষ্ট পাচ্ছিলো, আমি দেখছিলাম। নিষ্পলক তাকিয়ে ছিলো মেয়েটা আমার দিকে৷ একটা টু শব্দও সে করেনি৷ নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছিলো শুধু। অদ্ভুত এক শীতল প্রশান্তি লাগছিলো আমার। ওর চোখের পানিকে আমার বিশাল বড় অর্জন মনে হচ্ছিলো। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে এই চোখের পানি আমি দেখেছি। রুপন্তি কষ্ট পায়। সে তার সাবেক প্রেমিকের জন্য কষ্ট পায়৷ আমি পেয়ে গেলাম আমার সেই বহু আকাঙ্খিত প্রশ্নের উত্তর। আমি খুব মনোযোগে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম৷ ওর কান্না দেখছিলাম আমি৷ সুখ পাচ্ছিলাম। ভীষণ সুখ! তবে সুখটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি৷ মা এসে রুপুর হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিল তার ঘরে। আর ফুফু চিৎকার করে বলছিলো, এই মেয়ের লাজ লজ্জা থাকলে তোর মত বদমাইশের ঘরে আর থাকবে না। গাট্টি বেঁধে আজকেই তোর সংসার ত্যাগ দিবে।
আমিও চিৎকার করে বলে দিলাম,
– খুবই ভালো হবে। গাট্টি বাঁধা হয়ে গেলে আমাকে খবর দিতে বলবেন। আমি রিকশা ভাড়া করে দিবো।
সেদিন আমার সুখ ছিলো আকাশ ছোঁয়া। এত ফুরফুরে মেজাজে আমি শেষ কবে সময় কাটিয়েছি আমার মনে নেই। ভাবলাম দিনটা আমি খুব সুন্দর করে কাটাবো। বাসায় আগুন ধরিয়ে আমি সেজেগুজে চলে গেলাম বাহিরে। কাছের এক বন্ধু্কে নিয়ে চলে গেলাম লং ড্রাইভে৷ সারাদিন বাহিরে কাটিয়েছি।
ফিরেছি রাত সাড়ে নয়টায়৷ দরজা খুললো আমার মা৷ দেখলাম নাক চোখ ফুলে আছে। কান্নাকাটি করে চোখ মুখ ফুলিয়েছে। ড্রইংরুম ফাঁকা। সাবিহার ঘরের দরজা আটকানো। বাবা নিজের ঘরে শুয়ে আছে। মা দরজা খুলে দিয়েই চলে গেলো নিজের ঘরে। আমি আমার বেডরুমে গেলাম। দেখি রুপু নেই৷ ভাবলাম হয়তো সাবিহার ঘরে৷ কিছুক্ষন পর আমার রুম থেকে বের হয়ে ডাইনিং রুমে গেলাম পানি খেতে। পুরো বাসা নীরব। ভূতুড়ে অবস্থা। বুঝলাম ফুফু নেই। থাকলে এতক্ষণে উড়ে চলে আসতো আমাকে কথা শোনাতে৷ আর রুপু বোধহয় শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি, তাই এখনো সাবিহার ঘরে বসে আছে। নয়তো চলে আসতো আমার সাথে ঘ্যানরঘ্যানর করতে৷ পানি গ্লাসে ঢালবো ঠিক তখন সাবিহা ঘরের দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো। মায়ের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বললো,
– ভাবী ঠিকমত পৌঁছে গেছে মা। ফুফু বাসা পর্যন্ত ওকে দিয়ে এসেছে।
আমি আমার নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না৷ রুপু চলে গেছে! আমি মুক্তি পেয়েছি! মনভরে নিঃশ্বাস নিয়েছিলাম আমি৷ মনে হচ্ছিল কত জনম পর এমন মনভরে আমি নিঃশ্বাস নিচ্ছি।
– আপনি এমন কেন করলেন? কি এমন করেছিলো উনি? যত যাই হোক, ঐ ছেলের প্রসঙ্গে কথা বলা উচিত হয়নি। তারমধ্যে উনার বাবার ব্যাপারটা নিয়েও এভাবে বললেন। একটা মানুষের কষ্ট দেখার জন্য এত মরিয়া হয়ে গেলেন আপনি যে নিজের লিমিটেশনই ভুলে গেলেন?
– হুম ভুলেই গেলাম। সেদিন রাতে আমার ঘরে কেউ খায়নি৷ কেউ আমার সঙ্গে কথাও বলেনি৷ ড্রইংরুমে বসে অনেকমাস পর আমি একটু শান্তিতে মুভি দেখেছি৷ কেউ ছিলো না বিরক্ত করার মত। এমনকি রাতে খুশিতে আমার ঘুমও হয়নি৷ মনের আনন্দে সিগারেট খেয়ে, গান শুনে, ছাদে ঘুরে রাত পার করে দিয়েছি।
– একটা মানুষ আপনার সংসার ছেড়ে চলে গেলো অথচ আপনি কষ্ট পেলেন না?
– কেন পাবো? আমি তো চাচ্ছিলাম ও চলে যাক। আমার চাওয়া পূরণ হয়েছে। কষ্ট পাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না।
– ভাবী বাসায় যেয়ে কল করেছিলো?
– না।
– উনি রাগ করে কথা না বলার মানুষ না৷ তারমানে সেইবার সত্যিই রাগ করেই ফেললো।
– উহুম। রুপু অতটাও রাগ করেনি। তবে কষ্ট পেয়েছিলো খুব! ততটুকু কষ্ট যতটা সে আমার কাছে আশা করেনি। পরদিন খুব ফুরফুরে মেজাজে অফিস গেলাম। অফিসে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমার পাশের ডেস্কের মেয়েটা আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
– রুপন্তি কি অসুস্থ? গতকাল থেকে একবারও চ্যাট করলো না। কল করলাম রিসিভও করলো না।
– কি উত্তর দিয়েছিলেন? ঝগড়া হয়েছে সেটা বলেছিলেন?
– না৷ বলেছিলাম কাজিনের বিয়ে এটেন্ড করতে বাবার বাড়ি গিয়েছে। ব্যস্ত আছে।
ঠিক এই প্রশ্নটা অফিসের কয়েকজন আমাকে জিজ্ঞেস করলো। সবাইকে একই উত্তর দিলাম। সবাই আমার কথা মেনে নিলো। আমি অফিস পৌঁছানোর একঘন্টা পরই হাসিব ভাইয়া তার কেবিনে আমাকে ডাকলো। আমি উনার কেবিনে পা রাখতে না রাখতেই আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
– রুপন্তি চ্যাট গ্রুপ থেকে লিভ নিলো কেন? তুই কিছু বলেছিস ওকে?
– আপনি কি বললেন?
– আমি প্রথমেই কিছু বলিনি৷ আমি আগে জানতে চাচ্ছিলাম রুপন্তি ঝগড়ার ব্যাপারে হাসিব ভাইয়াকে কিছু বলেছে কি না? যদি ও কিছু না বলে থাকে তাহলে আমি কেন আগ বাড়িয়ে বলতে যাবো?
– তারপর?
– জিজ্ঞেস করলাম রুপু উনাকে কি বলেছে। বললো, ও নাকি ম্যাসেজের রিপ্লাই দিচ্ছে না৷ তাই আমাকে জিজ্ঞেস করেছে। পরে আমি বললাম, এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। আমি রুপুকে কিছু বলিনি। ভাইয়ার মুখ দেখে বুঝতে পারছিলাম ভাইয়া আমার কথা বিশ্বাস করেনি। উনি অবিশ্বাসটুকু উনার মন পর্যন্তই আটকে রাখলো। আমাকে আর কিছুই জিজ্ঞেস করলো না। ভাইয়ার রুম থেকে বের হতেই অফিসের সবাই আমার ডেস্কে এসে একই প্রশ্ন করা শুরু করলো। সবাইকে আমি উত্তর দিলাম, এ ব্যাপারে আমি জানি না৷ কেউই আমার কথা বিশ্বাস করলো না৷ কেউ কেউ আমার সাথে কিছুক্ষণ তর্ক করলো আর কেউ কেউ আমার উত্তর শুনে চুপচাপ চলে গেলো৷
– হয়তো ওরা বুঝতে পারছিলো আপনার জন্যই উনি চ্যাট গ্রুপ লিভ নিয়েছে।
– হ্যাঁ, এটা ওরা সবাই বুঝতে পেরেছিলো।
– ভাবী আপনাকে আর কল করেনি?
– না। যেই মানুষটার ফোনকলে আমি বিরক্ত হয়ে যেতাম সেই মানুষটা সেদিন আমাকে একটা কলও করেনি৷ আর আমি কি করেছিলাম জানো?
– কি?
– মনের অজান্তেই বারবার পকেট থেকে মোবাইল বের করে চেক করছিলাম রুপু আমাকে কল করলো কি না?
– ভাবীর কল আসবে এটা যেন অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো তাই না?
– হ্যাঁ। পাশের ডেস্কে তখন তামান্না বসতো। পুরো অফিসে আমার সবচেয়ে ক্লোজ ছিলো এই মেয়েটা। সারাদিন ও আমাকে অবজার্ভ করলো। রাতে যখন অফিস থেকে বের হবো ঠিক সে সময় ও আমাকে বললো,
– আজ সারাদিন রুপন্তির ফোনের অপেক্ষা করেছো অথচ একটা ফোনও আসলো না। খুব ঝগড়া করেছো মেয়েটার সাথে তাই না?
ওর কাছে আমি আর অস্বীকার করিনি৷ বললাম রুপু বাবার বাড়ি চলে গিয়েছে। তামান্না সেদিন রাতে আমাকে নিয়ে গেলো কফি শপে। কফি খাওয়ানোর বাহানায় অনেক কথা বলেছিলো রুপন্তিকে নিয়ে। সেদিন আমি ওর একটা কথাও পাত্তা দেইনি৷ এক কানে ঢুকিয়েছি আরেক কান দিয়ে বের করেছি।
– কি বলেছিলো?
– এত কথায় না যাই। শুধু ছোট্ট করে কয়েকটা কথা বলি। প্রচন্ড অবহেলায় ভালোবাসার মানুষগুলো একদিন হারিয়ে যায়। আমাদের চোখের সামনে মানুষগুলো থাকা সত্ত্বেও আমরা তাদের হারিয়ে ফেলি। তুমি চাইলেই তাকে সামনে বসিয়ে একনজর দেখতে পারো কিংবা একটুখানি ছুঁয়ে দিতে পারো৷ কিন্তু তুমি পারবে না। তোমাদের মাঝে অদৃশ্য এক দেয়াল তৈরী হয়ে যাবে। একদিন খুব ইচ্ছে হবে দেয়ালটা ভেঙে তাকে পরম মমতায় বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরতে অথবা নিজের সবটা উজাড় করে সেই মানুষটাকে ভালোবাসতে। তুমি শত চেষ্টায়ও দেয়াল ভাঙতে পারবে না৷ অবহেলা বাদ দাও সৈকত। রুপন্তি তোমাকে ভালোবাসে। ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা দিতে শেখো।
#পর্ব_৭
– সেদিন রাতে আমি বাসায় ফিরলাম রাত বারোটায়। মনে আমার ভীষণ সুখ! এতরাতে কেন ফিরলাম এসব নিয়ে এক হাজার প্রশ্ন করার মত কেউ নেই কিংবা আমার গলা জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থেকে কেউ বলার নেই, “তোমার এখন ফ্রেশ হওয়া বারণ। সারাদিন পর তোমাকে পেয়েছি, একটু ভালো তো বাসতে দাও। ”
ফ্রেশ হয়েই শুয়ে পড়লাম। আগের রাতে ঘুম হয়নি৷ পরের রাতটাও না ঘুমিয়ে কাটানো যাবে না৷ শুয়ে পড়লাম ঠিকই, কিন্তু ঘুম আসলো না৷ সারারাত এপাশ ওপাশ করে কাটিয়ে দিলাম। সেদিন রাতেও ধরে নিলাম আনন্দে ঘুম আসছে না আমার৷ অনেকগুলো মাস পর একটু প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি সেই আনন্দে আমার ঘুম উধাও হয়ে গিয়েছে। সারারাত না ঘুমিয়ে পরদিন অফিসে গেলাম। পরদিনও আমি একই কাজ করতে থাকলাম। কিছুক্ষন পরপর ফোন চেক। সারাদিন অফিস শেষে বাসায় ফিরলাম। আবারও ফ্রেশ হয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঘুমের কোনো খোঁজ নেই৷ আনন্দে আটখানা হয়ে আমার ঘুম আসছে না এই যুক্তিতে সেদিন রাতে আমি আর সন্তুষ্ট হতে পারছিলাম না। প্রথম রাতে রুপু চলে যাওয়ায় আমি যতটা এক্সাইটেড ছিলাম তৃতীয় রাতে অতটাও ছিলাম না৷ তাহলে কেন আমার ঘুম আসবে না? কারণ খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। কিন্তু পাচ্ছিলাম না৷ যত খুঁজি তত অস্থির হয়ে যাই। মনে হচ্ছিল কিছু একটা নেই৷ মনের কোনো একটা জায়গা অদ্ভুত শূন্যতায় ভুগছে। সেই শূন্যতা কিসের তা আমি সারারাতেও আবিষ্কার করতে পারিনি৷ টানা তিনরাত না ঘুমিয়ে চোখেমুখে আমার বিশাল ক্লান্তির ছাপ পড়ে গেলো। অফিসে যাওয়ার পর পরই সাথেই হাসিব ভাইয়া ডাকলো নতুন প্রজেক্টের ব্যাপারে কথা বলার জন্য। উনার রুমে যেতেই আমাকে বললো,
– চেহারার হাল কি হয়েছে তোর!
– তিনরাত ধরে ঘুমাই না।
– রুপন্তির সাথে ঝগড়া করে থাকতে পারিস না তো ঝগড়া করার প্রয়োজন কি?
– রুপন্তির সাথে ঝগড়া হয়েছে কে বললো?
– বলতে হবে নাকি! সবই বুঝি৷ ঝগড়া বেশিদিন ঝুলিয়ে রাখতে নেই। জলদি জলদি মিটিয়ে ফেললেই ভালো। আজ সারাদিন অফিসে থাকার দরকার নেই৷ দুপুরের মধ্যে কাজ শেষ করে বাসায় যা৷ রুপন্তির সাথে যা কিছুই হয়েছে মিটিয়ে ফেল।
সেদিন আমি দুপুরের আগেই ফিরে এলাম।
– ভাবীকে ফিরিয়ে আনার জন্য?
– না, মাথা ঘুরাচ্ছিলো। তাই চলে এসেছি।
– উনি আপনাকে এরপর আর কল করেনি?
– না। সেদিনও আমি বারবার মোবাইল চেক করছিলাম রুপু কল করলো কিনা। আগের দুইদিন চেক করছিলাম ভুলবশত৷ আর সেদিন চেক করছিলাম ইচ্ছে করেই। তিনদিন হয়ে গেছে রুপু আমার সাথে কথা বলছে না, ব্যাপারটা একটু অবিশ্বাস্য লাগছিলো৷ বিয়ের পর বাবার বাড়িতে এক রাতের বেশি সে কখনোই থাকেনি। খুবজোর দুই রাত, এরবেশি কখনোই না। বাবার বাসা থেকে ফিরে এসেই বলতো, ভালো লাগে না তোমাকে না দেখলে। রাতে ঘুমাতে অসুবিধা হয়। এজন্য চলে এসেছি।
সেইবার তিনদিন হয়ে গেলো অথচ ফিরে এলো না এই ব্যাপারটাও অবিশ্বাস্য লাগছিলো। রুপন্তি কেন কল করছেনা আর রুপন্তি কেন ফিরে আসছে না এই দুটো ব্যাপার নিয়েই চিন্তা করে কাটিয়ে দিলাম দিনের বাকি অংশটুকু। রাত বাড়ছিলো, সেই সাথে আমার অস্থিরতাও। নিজেকে নিজেই সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম রুপন্তির মত ছ্যাঁচড়া স্বভাব মানুষ কখনোই রাগ করে থাকতে পারে না৷ তিনদিন রাগ করে থাকাই তার জন্য অনেক! এইতো কাল সকালেই ফিরে আসবে। তারপর কল করে নিজেই বলবে, সিকু আমি ফিরে এসেছি। স্বান্তনাতেও কাজ হচ্ছিলো না৷ অস্থিরতা লেগেই ছিলো। উপায়ন্তর না পেয়ে স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুম দিলাম। এরপর গুনে গুনে পুরো সতেরোদিন পার হলো। উঠতে বসতে প্রতিমুহূর্তে রুপুকে মনে পড়তো। আমি কাজে মন বসাতে পারতাম না৷ বারবার ফোনের স্ক্রিনে তাকাতাম৷ বাসায় ফিরে ভালো লাগতো না৷ মনে হত কেউ বুঝি মারা গেছে এই বাসায়। কারো গলার স্বর পাওয়া যেতো না৷ বাসার সবাই প্রচন্ড শোকে দিন কাটাচ্ছিলো। রুপুকে হারানোর শোক।মায়ের চোখমুখ প্রায়ই দেখতাম ফুলে আছে৷ বাবা বেশিরভাগ সময় নিজের ঘরে শুয়ে থাকতো৷ সাবিহা সহজে আমার সামনে আসতো না৷ বাসার সবাই আমার উপর রেগে আছে সেটা আমি তাদের দেখলেই বুঝতাম। বিল্ডিংয়ের লোকজন আমাকে দেখলেই শুরুর দিকে জিজ্ঞেস করতো রুপু কোথায়? কবে আসবে? আমি হাবিজাবি উত্তর দিতাম। কয়েকদিন যাওয়ার পর আমাকে কেউ আর জিজ্ঞেস করেনি ওর ব্যাপারে। হয়তো বুঝতে পেরেছিলো আমাদের মাঝে কোনো ঝামেলা চলছে। অফিসের কলিগরাও তিন চারদিন পর রুপুকে নিয়ে কথা বলা বন্ধ করে দিলো৷ আমাকে সিকু বলে ডাকা বন্ধ করে দিলো। সবাই সৈকত নামে ডাকতে শুরু করলো। বুঝলাম রুপু হয়তো ওদের কিছু বলেছে। কলিগদের দিকে, বাসার লোকজনের দিকে তাকিয়ে থাকতাম কেউ রুপন্তিকে নিয়ে কিছু বলে কিনা। কেউ আমাকে রুপন্তির ব্যাপারে কিছু বলতো না। অথচ আমি জানতাম রুপুর সাথে সবারই যোগাযোগ হয়৷ খেতে ভালো লাগতো না৷ রাতে একটানা ঘুম হতো না৷ বারবার ঘুম ভাঙতো। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে ভালো লাগতো না৷ মুভি দেখতে ভালো লাগতো না৷ ঘুরতে ভালো লাগতো না৷ অদ্ভুত বিষন্নতায় দিন কাটাতাম। মনে হতো আমার সবকিছু থমকে গেছে। জীবনের সব সুখ আনন্দ সব হারিয়ে গেছে। প্রতিদিন অপেক্ষা করেছি রুপন্তির একটা কলের। বাসায় যেয়ে দেখবো রুপু ফিরে এসেছে এই আশায় প্রতিরাতে বাসায় ফিরেছি। প্রতিদিন সকালে চোখ মেলে আমার পাশে থাকা রুপুর বালিশের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম ও আজই ফিরে আসবে। অনেক তো হলো। আর পারবে না রাগ করে থাকতে৷ আর রুপু প্রতিদিন আমাকে মিথ্যা প্রমাণ করতো।
– কল তো আপনিও করতে পারতেন?
– কেন করবো? ঝগড়া হয়েছে আমাদের মাঝে। আমি কেন আগ বাড়িয়ে ঝগড়া মিটাবো? সেল্ফ রেসপেক্ট আছে না আমার!
– আপনি এটাকে সেল্ফ রেসপেক্ট ভাবছেন?
– হুম, এমনটাই ভাবতাম।
– আপনি কষ্ট পাচ্ছিলেন উনার জন্য অথচ একটা কল করলেন না৷ সামান্য একটা কলই তো ছিলো।
– তখন তো ঐ সামান্য কলটাকে আমার সামান্য মনে হতো না৷
– আপনি উনার জন্য কষ্ট পাচ্ছিলেন তারমানে আপনি উনাকে ভালোবাসতেন?
মুখ বাকিয়ে হাসলো সৈকত। মাথার চুলগুলো আঙুল দিয়ে উল্টিয়ে বললো,
– গন্ডগোল তো সেখানেই বেঁধেছিলো ইমরান৷ রুপন্তি নামের সেই টর্নেডোকে আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম৷ কখন বাসলাম, কিভাবে বাসলাম টেরই পেলাম না৷ ও চলে যাওয়ার পরও আমি বুঝতে পারিনি ঐ টর্নেডোকে আমি ভালোবাসি। শুধু বুঝতাম রুপন্তিকে আমার ভীষণ মনে পড়ে। কিন্তু ভালোবাসা তখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি৷ বুঝেছি সতেরোদিন পর যেদিন রুপু আমাদের বাসায় এলো ওর ডায়েরী নিয়ে যাওয়ার জন্য৷ সেইরাতে ছোটখাটো একটা ঝড় বয়ে গিয়েছিলো আমার উপর।
– কিসের ডায়েরী?
– রুপুর ডায়েরি যেখানে ওর বহু গোপন তথ্য লেখা আছে। বিয়ের পর রুপু আমাদের দুজনের একটা ছবি বাঁধাই করে এনে ড্রইংরুমের দেয়ালে এঁটে দিয়েছিলো৷ সতেরোদিন পর অফিস থেকে বাসায় ফিরে দেখি ছবিটা দেয়ালে নেই। সেটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ছবি কে সরালো? মা বললো, রুপু সরিয়েছে।
– রুপন্তি এসেছে! কোথায় ও?
– চলে গিয়েছে।
রুপু এসেছে শুনে যতটা খুশি হয়েছিলাম, তারচেয়ে বেশি মন খারাপ হলো ও চলে গিয়েছে শুনে। খানিক বাদেই দেয়াল থেকে ছবি সরানোর কথা মনে পড়তেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। মাকে জিজ্ঞেস করলাম,
– ও কেন এসেছিলো? দেয়াল থেকে ছবি সরানোর জন্য?
– না। ওর কি একটা ডায়েরি নাকি আছে৷ সেটা খুঁজতে এসেছিলো। অনেকক্ষণ খুঁজলো। কোথাও নেই। তুই দেখেছিস নাকি ডায়েরিটা?
– ও ডায়েরি খুঁজতে এসেছে ভালো কথা। দেয়াল থেকে ছবি কেন সরালো? ছবি সরিয়ে সে কি প্রমাণ করতে চায়?
– এখানে তোর রাগারাগির কি আছে? ওর ছবি, ওর ইচ্ছে হয়েছে এখান থেকে সরাবে তাই সরিয়ে দিয়েছে।
– এটা ওর একার ছবি না৷ আমারও ছবি আছে৷
– হ্যাঁ আছে। তো?
– তো আবার কি? ও ছবি কেন সরালো?
– তুই দেয়ালে ছবি রেখে কি প্রমাণ করতে চাস? আর কয়দিন বাদে ডিভোর্স হয়ে যাবে৷ এমন অবস্থায় দেয়ালে ছবি বাঁধিয়ে রাখা আদিখ্যেতা ছাড়া আর কিছু না।
– কে দিচ্ছে ডিভোর্স? রুপু? কখনোই না৷ ও রাগ করে বাপের বাড়ি পর্যন্তই থাকতে পারবে৷ এরচেয়ে বেশি কিছু ওকে দিয়ে সম্ভব না। যাক কয়দিন, নিজেই ফিরে আসবে বাবার বাড়ি থেকে৷
মা আমার সাথে খুব স্বাভাবিক কন্ঠে কথা বলছিলো। হঠাৎ করে মায়ের কি হলো আমি জানি না। আমি শেষ কথাটা বলতেই মা আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালো৷ বহুবছর পর মায়ের এমন রাঙা চোখ দেখেছিলাম। যেদিন থেকে বাবা মা আবিষ্কার করলো আমি বেয়াদব হয়ে গিয়েছি সেদিন থেকে বাবা মা আমাকে বকা দেয়া কিংবা রাগ করে কথা বলা ছেড়ে দিয়েছে। সবসময় আমি একতরফা রাগারাগি করতাম। বাবা মা শুধু চুপচাপ আমাকে সহ্য করতো। সেদিন মা রুপন্তির জন্য আমার উপর রেগে গেলো৷ দাঁত কিটমিটিয়ে বললো,
– রুপু খুব সস্তা না রে সৈকত? তোর হাজার লাত্থি গুতা খেয়েও আবার এই সংসারে আসবে! রুপুকে এত সস্তা ভাবিস কেন? কি করেছে ও? তোর সমস্ত অন্যায় চুপচাপ সহ্য করেছে তাই রুপু সস্তা? তোর এত এত অবহেলা পেয়েও তোর পিছনে সারাক্ষণ ঘুরঘুর করেছে একটু মন পাওয়ার জন্য তাই রুপু সস্তা? নাকি ও কাজে পটু না তাই ও সস্তা হয়ে গিয়েছে? রুপু এত সস্তা না রে সৈকত। আমার কাছে ওর অনেক দাম। কেন জানিস? ও আমার মেয়েটাকে নিজের বোনের মত আগলে রেখেছে। আমাকে আর তোর বাবাকে নিজের বাবা মায়ের মত আপন করে নিয়েছে। যা কিছু আমাদের তোর কাছে পাওনা ছিলো সেসব পাওনা রুপু দ্বিগুণ করে মিটিয়েছে। আমি আর তোর বাবা মারা যাওয়ার পর সাবিহাকে আগলে রাখার মত আর কেউ থাকবে না। আমার মেয়েটাকে রুপু আগলে রেখেছিলো। আমরা দুজন নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম দুনিয়াতে আমরা না থাকলেও আমাদের মেয়েকে দেখার মানুষ আছে। তোর আশা আমরা করি না৷ আমরা বেঁচে থাকতেই আমার মেয়ের দিকে নজর দেয়ার সময় তোর হয় না আর আমরা মারা গেলে তো সাবিহা বেঁচে আছে না মারা গেছে সেই খোঁজও নিবি না৷ স্বর্গে ছিলাম আমি এই সাড়ে সাতমাস৷ আমার ঘরে সুখের জোয়ার নিয়ে এসেছিলো এই মেয়ে। আমার ঘরের হাসি আনন্দ সব শেষ। সংসারে আবার অন্ধকার চলে আসলো। আমার সাবিহা আবার একা হয়ে গেলো। কেউ থাকবে না আমার মেয়ের খোঁজ নেয়ার মত। তুই সব শেষ করে দিলি৷
আসবে না রুপু৷ চিরতরে চলে গিয়েছে৷
বলে গিয়েছে লিগ্যাল নোটিশ পাঠাবে কাল পরশুর মধ্যেই৷ ভালোই হবে। তোর মত বেয়াদবের সাথে এমন পরীর মত মেয়ে মানায় না৷ ওর জন্য মন থেকে দোয়া করি মেয়েটার সামনের জীবন যেন খুব খুব সুন্দর হয়। রাজপুত্রের মত ছেলে আসুক ওর জীবনে৷ ওর সমস্ত অপ্রাপ্তিগুলো পূর্ণ করুক। আজনম মাথায় করে রাখুক।
মা কাঁদছিলো আর টানা কথাগুলো বলে যাচ্ছিলো৷ মায়ের সব কথা আমি মাথা নিচু করে শুনে যাচ্ছিলাম। খুব খারাপ লাগছিলো কথাগুলো শুনে। কিন্তু মেজাজ বিগড়ে গেলো শেষের কথাগুলোয়৷ রুপুর আবার বিয়ে হোক এমন দোয়া করার মানে কি? আমি মায়ের সাথে চেঁচিয়ে উঠলাম,
– আমি তো খারাপ। দুনিয়ার মাটিতে ফুলের মত মনের পুরুষের তো অভাব নেই। যাও, একটা পুরুষরুপি ফুল ধরে এনে রুপন্তিকে বিয়ে দিয়ে দাও৷
– ডায়েরিটা কি সেদিন পেয়েছিলেন?
– হুম। মায়ের সাথে ঝগড়া করে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে রইলাম অনেকটা সময়৷ মনে হচ্ছিলো মাথা থেকে বুঝি গরম ধোঁয়া উড়ছে। হঠাৎ মনে পড়লো ডায়েরির কথা। কি এমন লেখা আছে ডায়েরিতে যে এটা খুঁজতে রুপন্তি বাসায় চলে এলো! তাড়াহুড়ো করে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলাম৷ ওয়্যারড্রব, আলমারী, ড্রেসিং টেবিল সব খুঁজলাম। কোথাও নেই৷ এরপর খুঁজতে লাগলাম ফার্ণিচারের চিপায়। খুব দরকারী কাগজগুলো এসব জায়গাগুলোতেই খুঁজে পাওয়া যায়। আমার ধারণা মিথ্যা হয়নি। ডায়েরিটা খুঁজে পেলাম ওয়্যারড্রবের পিছনের ছোট্ট ফাঁকা জায়গা থেকে। দরজা আটকে দ্রুত ডায়েরিটা নিয়ে বসে পড়লাম। রুপু প্রতিদিন ডায়েরি লিখতো না। শুধু মাত্র বিশেষ কিছু স্মৃতি, কিছু গোপন কথা যেগুলো কেউ জানে না সে কথাগুলোই লেখা। ডায়েরির প্রথম পাতা শুরু হয়েছে নাদিমকে নিয়ে। ওদের প্রেম কিভাবে হয়েছিলো সেসব আরকি। সেদিনই আমি জানতে পারি ওর প্রেমিকের নাম আর পরিচয়৷
– কিভাবে পরিচয় হয় দুজনের? একই এলাকার ছিলো? নাকি ক্লাসমেট?
– নাদিম ওর ছোট ফুফুর ছেলে। একই বাড়িতে থাকতো।
– ওহ, কাজিন!
– হ্যাঁ। একই বাড়ির বাসিন্দা। রুপু তখন ক্লাস এইটের স্টুডেন্ট আর নাদিম এইচ এস সি পরীক্ষার্থী। নাদিমের আরো আগে থেকেই রুপুকে পছন্দ ছিলো৷ সরাসরি কখনো বলেনি কিন্তু বিভিন্ন ভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেছে। রুপু তখন ছোট৷ অত ইশারা ইঙ্গিতের কথা বুঝতো না৷ ও ক্লাস এইটে ভর্তি হওয়ার পর নাদিম সরাসরি ওকে বললো। বুঝোই তো উঠতি বয়স, সবেমাত্র মনের কোণে আবেগ অনুভূতি জন্মাচ্ছে। ছেলেটা এসে ভালোবাসি বললো আর আমার ওয়াইফও খুশিতে বাকবাকুম করতে করতে রাজি হয়ে গেলো। কেউ জানতো না ওদের দুজনের ব্যাপারে। বাসার লোকজন বিশ্বাস করে রুপন্তির সাথে স্কুলে আসা যাওয়ার জন্য মাঝে মধ্যে নাদিমকে পাঠাতো। সেই সুযোগে রুপু স্কুল ফাঁকি দিয়ে চলে যেতো নাদিমের সাথে ঘুরতে৷ দেড় বছর দুজন খুব প্রেম করেছে। কত কিছু লিখা আছে ডায়েরিতে! কোথায় কোথায় ঘুরেছে, কবে প্রথম হাত ধরেছে, কবে প্রথম ফুল বিনিময় হয়েছে, নাদিমকে নিয়ে রুপুর অনুভূতিগুলো বিস্তারিত লিখা আছে ডায়েরিতে। আমি এত বিস্তারিত ঘটনা বলতে পারবো না৷ অন্য প্রসঙ্গে আসি৷
ভ্রু কুঁচকে সৈকতের দিকে ঝুঁকে বসলো ইমরান। অভিযোগের স্বরে বললো,
– কেন বলবেন না? ডায়েরির লাইনগুলো জানার জন্য আমি ভীষণ এক্সাইটেড। পুরো গল্পের সব আকর্ষণ আমার আটকে আছে ডায়েরির দিকে৷ অথচ আপনি বলছেন শোনাবেন না! পুরো রাত পড়ে আছে। সবটুকু শোনাতে হবে৷
– রুপু নাদিমকে নিয়ে কি ফিল করতো কিংবা ওদের প্রেমের গল্প কেমন ছিলো আমার সেসব নিয়ে আলোচনা করতে ভালো লাগে না৷ আমি সহজে গল্পের ঐ অংশটুকু মাথায় আনি না। শুধু এতটুকু বলি রুপন্তি ছেলেটাকে ভীষণ ভালোবাসতো৷ বিশ্বাসও করতো খুব৷
– আপনি ঐ অংশটুকু বলতে কেন চাচ্ছেন না?
– বললাম তো আমার ভালো লাগে না৷
– কেন লাগে না?
– রুপন্তির প্রথম ভালোবাসা হচ্ছে নাদিম যাকে ও অন্ধের মত ভালোবেসেছে৷ আমি ছাড়া অন্য কেউ রুপন্তির ভালোবাসা পেয়েছে এটা আমার মেনে নিতে কষ্ট হয়। হতে পারে নাদিম রুপন্তির জীবনে একটা বাজে অধ্যায় যেটা অতীত হয়ে গেছে বহুবছর আগে৷ তবুও আমি মেনে নিতে পারি না।
মুখ টিপে হাসলো ইমরান। বললো,
– আচ্ছা বলতে হবে না৷ আপনি যতটুকু বলবেন অতটুকুই শুনবো।
– হাসি পাচ্ছে তাই না?
– উহুম।
– মেয়েটাকে ভালোবাসি তো। ওকে অন্য কারো পাশে রেখে ভাবতে পারি না৷ খুব হিংসে হয়।
– হুম, হুম। বুঝতে পেরেছি।
– রুপুর হুটহাট ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নেয়ার রোগ আছে। তেমনই এক ভয়ংকর সিদ্ধান্ত হলো নাদিমের সাথে পালানো। রুপু তখন ক্লাস নাইনে পড়ে। সামার ভ্যাকেশন চলছে। মামার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলো। সেখানে রাত জেগে কাজিনদের সঙ্গে মুভি দেখলো। মুভিতে নায়ক নায়িকা পালিয়ে বিয়ে করে। ব্যস, ঐ মুভি দেখে রুপুর মাথায় ভূত চাপলো সে পালিয়ে বিয়ে করবে এবং দুদিনের মধ্যেই করবে। সেদিন মুভি শেষ করে রাত তিনটায় নাদিমকে ফোন করে জানালো ও নাদিমের সাথে পালাবে। ওরা বিয়ে করবে, দূরে কোথাও চলে যাবে। সেখানে ছোট্ট সংসার হবে। ভালোবাসায় মাখামাখি থাকবে ওদের সংসার। দিনভর সময়ে অসময়ে চুমু আদান-প্রদান হবে৷ আরো কত কি যে হাবিজাবি লিখা ছিলো! জানো ইমরান, এই লাইনগুলো পড়ার পর আমার ইচ্ছে হয়েছিলো রুপুর কানের নিচে থাপ্পড় দিয়ে আসি৷ এইটুকু একটা মেয়ে এত পাকা পাকা কথা বলবে কেন? কিসের সংসার ওর? সংসারের বয়স হয়েছে তার?
– ভাবী কম বয়সে ঐসব কথা বলেছে সমস্যা সেটা না৷ আপনার থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে হয়েছে অন্য কারণে। ভাবী অন্য কাউকে ঘিরে স্বপ্ন দেখছে সেটা আপনার সহ্য হচ্ছিলো না।
– হয়তো!
– নাদিম রাজি হয়েছিলো পালানোর জন্য?
– হুম। ঐদিন রাতেই দুজনে প্ল্যান করে ফেললো দুদিন পরই পালাবে। পরদিন সকালে রুপু বাসায় ফিরে এলো। ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে সব রেডি৷ রুপু পরদিন বাসা থেকে পালাচ্ছে এই কথা জানতো শুধু মাত্র রাহাত। একদম প্রথম থেকে নাদিম আর রুপুর ব্যাপারটা রাহাত জানতো। এই প্রেমে রাহাতের যথেষ্ট অবদান আছে। বহুবার পিয়নের দায়িত্বও পালন করেছে ছেলেটা৷ পরদিন দুপুরে সবাই যখন ঘুমাচ্ছিলো তখন বাসা থেকে রুপু বেরিয়ে গেলো। রাতের ট্রেনে ওরা সিলেট যাবে। বাড়ির বাহিরে এলাকার মোড় থেকে দুজনে এক রিকশায় করে স্টেশন পৌঁছালো৷ নাদিম খুব বেশি নার্ভাস ছিলো সেদিন। আর রুপু তো রুপুই। সে তখন তার নতুন সংসারের স্বপ্নে বিভোর। সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে নাদিম বললো সে পানি কিনতে যাচ্ছে। এই কথা বলে সেই যে গেলো আর ফিরলো না৷ পুরো স্টেশন খুঁজেছে নাদিমকে। কোথাও খুঁজে পায়নি। রুপু নাদিমকে কল করতেই থাকলো, ওপাশ থেকে কেউ রিসিভ করলো না৷ একপর্যায়ে মোবাইলের সুইচটাই নাদিম অফ করে দিলো৷ ততক্ষণে ঘড়িতে রাত সাড়ে আটটা বেজে গিয়েছে৷ বাসা থেকে রাহাত বিকেলেই মেসেজ দিয়েছে রুপুকে খোঁজা হচ্ছে। স্টেশনে বসেই কাঁদছিলো রুপু। সেদিন বৃষ্টি নামের এক মেয়ে সিলেটের ঐ ট্রেনে যাওয়ার কথা ছিলো। মেয়েটা পড়াশোনার জন্য ঢাকায় থাকতো। ওর বাসা ছিলো সিলেটে। ওকে কাঁদতে দেখে ওর পাশে এসে বসলো। জিজ্ঞেস করলো কাঁদছে কেন? প্রথমে রুপু বলতে চায়নি৷ রাত ওদিকে বেড়েই চলছে৷ এমন মুহূর্তে বাসায় ফিরে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না আবার স্টেশনে অপেক্ষা করার মত অবস্থাও নেই। উপায় না পেয়ে মেয়েটার সাথে রুপু সব শেয়ার করলো। সব শুনে মেয়েটা রয়ে গেলো রুপুর সাথে। ঐটুকু একটা মেয়েকে স্টেশনে একা রেখে যাওয়ার সাহস বৃষ্টির হয়নি। বৃষ্টি ওকে বারবার বুঝাচ্ছিলো নাদিম চলে গেছে আর ফিরবে না। রুপু বুঝতে চাচ্ছিলো না৷ রুপুর খুব বিশ্বাস ছিলো নাদিমের প্রতি। নাদিম ওর সাথে এমন কিছু করবে এটা কোনোভাবেই সে বিশ্বাস করতে নারাজ। রাত বেড়ে তখন সাড়ে এগারোটা। স্টেশন ফাঁকা হতে শুরু করেছে৷ বৃষ্টি রুপুকে নিয়ে গেলো বৃষ্টির খালার বাসায়৷ রুপু আসতেই চাচ্ছিলো না৷ ওর ধারনা ছিলো নাদিম ফিরে আসবে৷ বৃষ্টি অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে রুপুকে স্টেশন থেকে নিয়ে এসেছে। রাত দুইটায় নাদিম রুপুকে কল করলো। বললো, তোমার সাথে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব না৷ আমি এখনও বেকার। তোমাকে কি খাওয়াবো? তুমি বাসায় ফিরে এসো।
– এটা কেমন কথা হলো? বাসা থেকে পালানোর সময় ওর এই কথা খেয়াল ছিলো না?
– প্রশ্ন তো সেখানেই। ছোট্ট একটা মেয়েকে এই ছেলে স্টেশনে কিভাবে ফেলে চলে এলো? বৃষ্টি মেয়েটা সেদিন ওর পাশে না থাকলে অনেককিছু হতে পারতো। পরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত বৃষ্টি তার খালার বাসায়ই রুপুকে রেখে দিলো।
– নাদিম খোঁজ নেয়নি ভাবীর?
– না।
– কোথায় আছে সেটাও জানতে চায়নি?
– না।
– স্টেশনে কত আজেবাজে লোক থাকে। মেয়েটা কার না কার খপ্পড়ে পড়েছে! বেঁচে আছে না মারা গেছে সেসব কিছুই ভাবলো না নাদিম!
– নাহ্, ভাবেনি। পরদিন রাতে বৃষ্টি নিজে এসে রুপুকে ওর বাসায় রেখে গিয়েছে।
– বাসার লোকজনের রিএ্যাকশন কেমন ছিলো?
– ওর বাবার বিপি হাই হয়ে গিয়েছিল। রুপুর ভাই ওকে খুব বেশিই ভালোবাসে। বোনের কাছ থেকে এমন ধাক্কা সে আশা করেনি। রাগ করে সে বোনের সাথে কথা বলেনি দুইমাস৷ ওর ভাবী ওকে ফেরত পেয়ে ভীষণ খুশি ছিলো। ছয়মাস বয়স থেকে নিজের মেয়ের মত আগলে রেখেছে রুপুকে। রুপু সহি সালামতে আছে এটাই তার কাছে বিশাল ব্যাপার৷ ওর বাসার লোক যতটা না ঝামেলা করছিলো তারচেয়ে বেশি ঝামেলা করেছে রুপুর আত্মীয়রা। বিশেষ করে রুপুর ফুফু।
– নাদিমের মায়ের কথা বলছেন?
– হ্যাঁ।
– বাসায় কি জানাজানি হয়েছিলো নাদিমের সাথে ভাবী পালিয়েছিলো?
– না। রুপু মুখ খুলেনি। ওর ফুফু আর খালা খুব পীড়াপীড়ি করেছে জানার জন্য। ও কাউকেই কিছু বলেনি৷ ওর ভাবী খুব রিকোয়েস্ট করেছে। তবুও মুখ খুলেনি।
– কেন?
– ও চায়নি ওর ফুফুর সাথে বাবার সম্পর্কে কোনো ফাটল ধরুক। রুপু ফিরে আসার পর শুরু হলো মানসিক অত্যাচার। পুরো এলাকায় জানাজানি হলো৷ আত্মীয়দের মাঝে জানাজানি হলো। এক কথায় বলতে পারো সেইসময় আলোচনার মসলাদার বিষয়বস্তু হলো রুপন্তি৷ এলাকার লোকজন, আত্মীয়রা সবাই রুপুর বাবা ভাইকে রাস্তায় দেখা হলে কিংবা ফোন করে রুপুর সম্পর্কে জানতে চাইতো। আমার শ্বশুর এই চাপগুলো নিতে পারেনি৷ সপ্তাহখানেক বাদে উনি স্ট্রোক করলো৷ প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পড়ে রইলো বহুদিন। রুপুকে অনেক আজেবাজে কথা শুনতে হয়েছে৷ ও বাসা থেকে বের হতে পারতো না৷ লোকজন পাশ থেকে ওকে নিয়ে হাসি তামশা করতো৷ এলাকায় ওর যেসব বান্ধবীরা ছিলো ওরা রুপুর সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দিলো। ওদের পরিবারের নিষেধ ছিলো রুপুর সাথে মেলামেশা করতে। কোনো অনুষ্ঠানে যেতে পারতো না। সবাই রুপুকে নিয়ে সমালোচনার আসর জমাতো। কেউ কেউ সামনাসামনি বাজে কথা বলে চলে যেত। বিশেষ করে রুপুর ফুফু ওর জীবনটা নরক বানিয়ে ফেলেছিলো। আমার শ্বশুর স্ট্রোক করার পর থেকে এই মহিলা উঠতে বসতে বলতো, রুপু একটা অলক্ষ্মী। মা খেয়ে হজম করে এখন বাপকে খাওয়ার পায়তারা করছে।
– ছিঃ!
– এই কথাগুলো ওকে আমার সাথে বিয়ে হওয়ার আগ পর্যন্ত শুনতে হয়েছে৷ মহিলাটা ওকে শান্তি দেয়নি৷ প্রচুর জ্বালিয়েছে। আত্মীয়রা সবাই যেখানে একসাথে হয়ে আনন্দ করতো রুপু কখনো সেখানে যেতে পারতো না। ঘরের দরজা আটকে বসে থাকতো৷ দরজার ওপাশ থেকে হাসি আনন্দের শব্দ শুনতো আর কাঁদতো। ঐ ঘটনার পর সবাই ওকে পর করে দিলো৷
– কি আশ্চর্য! ভাবীর পরিবারের কেউ প্রতিবাদ করেনি?
– করেছে। লাভ হয়নি৷ মানুষের মুখ কি বন্ধ রাখা যায়?
– ছোট বয়সে একটা ভুল নাহয় করেছেই। তাই বলে এমন আচরন করবে?
– বাকি আত্মীয় স্বজনরা ভুলে গেলেও রুপুর ফুফু তাদের স্মরণ করাতো৷ উনার বাসায় কেউ গেলেই রুপুর নামে বদনাম শুরু হয়ে যেত।
– ভাবীর উচিত ছিলো উনার ছেলের কথা বলে দেয়া৷
– রুপুকে আমার কখনো কখনো সন্ন্যাসী পর্যায়ের মানুষ মনে হয়। কোনো রাগ নেই, প্রতিবাদ করার ইচ্ছে নেই৷
– আমি উনার জায়গায় থাকলে শুরুতেই সব বলে দিতাম। বাবা ফুফুর সম্পর্ক খারাপ হলে হোক। দরকার নেই এমন বাজে ফুফুর৷
– প্রতিবছর দুই ঈদে ওদের বাসায় গেট টুগেদার হতো৷ সবাই আসতো। বছরে আত্মীয়দের মাঝে দুই একটা বিয়ে হতোই। সবাই সেই বিয়ে এটেন্ড করতো। খুব আনন্দ ফূর্তি চলতো৷ রুপুর খুব ইচ্ছে হতো ওদের সাথে আগের মত মিশতে, আনন্দ করতে। আত্মীয়রা ওকে তেমন একটা কাছে টানতো না৷ এমন ব্যবহার করতো যেন সে উচ্ছিষ্ট পর্যায়ের কিছু একটা! আমার পরিবারকে ও এতখানি আগলে রাখতো কেন জানো?
– কেন?
– আমার সাথে বিয়ে হওয়ার পর ও নতুন একটা পরিবার পেয়েছিলো যারা ওর সব দোষ জেনে আপন করে নিয়েছে। যা কিছু ওর পরিবারের কাছ থেকে বঞ্চিত হয়েছে রুপু চাইতো সেসব অভাব নতুন পরিবারের কাছ থেকে মিটিয়ে নিবে৷ রুপু নতুন করে আলাদা একটা জগত পেয়েছিলো যেখানে একটু নিঃশ্বাস নেয়া যাবে। আবারও প্রাণখুলে বাঁচা যাবে৷
– আর সেখানে বাঁধ সাধলেন আপনি। সরি টু সে, আপনিও ভাবীর ফুফুর চেয়ে কম না৷
– আমি ঐ মহিলার চেয়েও খারাপ। রুপু আমাকে যতটা ভালোবেসেছিলো অতটা ভালো ঐ মহিলাকে সে বাসেনি৷ এতখানি ভালোবাসা পেলে হয়তো ঐ মহিলা রুপুকে এতখানি টর্চার করতো না৷
– ভাবীর সাথে এতসব ঘটে যাচ্ছিলো নাদিমের কি সেগুলো অজানা ছিলো?
– নাদিম জানতো কি না জানি না৷ ঐ ঘটনার চারমাস পর সে লন্ডন চলে গেলো স্টুডেন্ট ভিসায়। এতগুলো বছরে সে আর ফিরেনি৷ তবে যেই চারমাস দেশে ছিলো তখনকার ঘটনা তো জানতোই৷ জানা সত্ত্বেও সে চুপ ছিলো৷ সেদিনের পর রুপু হয়ে গেলো তার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিতা। একবারের জন্যও চোখ তুলে তাকায়নি রুপুর দিকে। এতসব ঘটনার মধ্যে রুপুকে আগলে রেখেছিলো তিনজন। রুপুর ভাবী, রাহাত আর বৃষ্টি। এই মেয়েটা প্রায়ই রুপুকে কল করতো। বছরে দুই চারবার দেখা করতো। যতটা সম্ভব মেন্টাল সাপোর্ট দিতো রুপুকে। এই মানুষগুলো ছিলো বলেই হয়তো রুপু বেঁচে ছিলো। নয়তো মরে যেত কবেই!
(চলবে)