ঘুণপোকা,পর্ব_৮

0
690

ঘুণপোকা,পর্ব_৮
মিম

– ডায়েরিটা এখনো আমার কাছে আছে৷ ঐ ডায়েরির ১০৩ নাম্বার পেইজটা আমার ভীষন প্রিয়। প্রতিদিন ঐ পৃষ্ঠায় একবার হলেও চোখ বুলাই।
– কি আছে সেই পৃষ্ঠায়?
– ১০২ নাম্বার পেইজ পর্যন্ত কোথাও আমি ছিলাম না৷ ১০৩ নাম্বার পেইজে রুপুর ডায়েরিতে প্রথমবারের মত জায়গা পেলাম। ঐ পৃষ্ঠার প্রতিটা শব্দ আমার মুখস্থ। শুনবে?
– অবশ্যই।
– শুনেছি ভালোবাসা নাকি জীবনে একবারই আসে৷ আমার বেলায় তো কথাটা মিথ্যে হয়ে গেলো৷ মানুষটা সৈকত। তার বাবার আইডিতে প্রথমবারের মত তাকে দেখলাম। কি মোহ তৈরী হলো আমি জানি না৷ ইচ্ছে হলো তাকে আরেকটু দেখি। আরেকটু দেখতে গিয়েই ঝামেলা বেঁধে গেলো৷ খুঁজে খুঁজে তার আইডিটাও বের করে ফেললাম৷ তারপর…… এক সপ্তাহ ধরে তার আইডিতেই আটকে আছি৷ এক সপ্তাহ পর আজ আবিষ্কার করলাম তাকে ভালোবেসে ফেলেছি৷ শুধু দূর থেকে দেখেই কি করে কেউ কাউকে ভালোবাসে আমি জানি না৷ আপাতত জানতে চাচ্ছিও না৷ শুধু জানি ভালোবাসি। এতটুকুই চোখ বন্ধ করে সবটুকু অনুভূতি অনুভব করতে চাই৷ বহুবছর পর কাউকে খুব করে ভালোবাসতে ইচ্ছে হচ্ছে। তার হাত ধরে আবারও নতুন করে বাঁচার সাধ হচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে ছুটে গিয়ে বলি, আমাকে একটু সমুদ্র পাড়ে নিয়ে যাবে? বহুবছর হয়ে গেলো প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেই না। তুমি আমার হাতজোড়া শক্ত করে ধরে রেখো, আমি প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিবো।
– উনি তখন জানতো আপনি ডিভোর্সি?
– না। পরের পৃষ্ঠায় লিখা ছিলো, ডিভোর্সি কাউকে দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়। ভাবি, আহা! সংসারটা ভেঙে গেলো! এই প্রথম কারো ডিভোর্সের খবর শুনে ভীষণ সুখ সুখ লাগছে। তুমি জানো, আমি তো ভেবেছিলাম আমার ভালোবাসা অপূর্ণ রয়ে যাবে। ভেবেছিলাম তুমি অবিবাহিত। আমার মত মেয়েকে একটা অবিবাহিত ছেলে বিয়ে কেন করবে? তোমার বাবা এসেছিলো বিকেলে। কথায় কথায় বললো তোমার ডিভোর্সের কথা। কি অদ্ভুত আমি তাই না? তোমার ডিভোর্সের কথা শুনে খুশিতে টলমল অবস্থা হচ্ছে আমার৷ প্রেমে পড়লে মানুষ অদ্ভুত আচরন করবে এটা খুব স্বাভাবিক। সুতরাং আমার খুশি হওয়াও স্বাভাবিক।
– বিয়ের প্রস্তাব কি আপনাদের তরফ থেকে দেয়া হয়েছিলো নাকি ভাবীদের তরফ থেকে?
– রুপুদের তরফ থেকে৷ কান্ডটা রুপুই করেছিলো। বাবা কোনো এক কথার প্রসঙ্গে আমার শ্বশুরের সাথে আমার জন্য মেয়ে খোঁজার ব্যাপারে আলাপ করছিলো। রুপু রাহাতের সাথে আমার ব্যাপারটা শেয়ার করেছিলো। সেদিন বাবার কাছে পাত্রী খোঁজার কথা শোনামাত্রই রাহাতকে দিয়ে ওর ভাবীর কাছে জানালো সে আমাকে বিয়ে করতে চায়৷ সেদিনই রাতে ঐ বাসা থেকে আমার বাবাকে ফোন করা হলো।
– আচ্ছা! অপরিচিত মেয়েটা আপনাকে আগে থেকেই ভালোবাসতো তাই বিয়ের রাতে আপনাকে দূরের কিংবা অপরিচিত কেউ ভাবেনি৷ আপনি তো তার কাছে আপন ছিলেন আরো আগে থেকেই৷
– হুম, ভীষণ আপন। ১০৭ নাম্বার পেইজটা লিখেছিলো আমাদের বিয়ের আগ মুহূর্তে।
– কি লিখেছিলো?
– একটু পরেই নতুন জীবন শুরু হবে৷ একটা সংসার হবে আমার, যেই সংসারের স্বপ্ন অনেকবছর আগে একবার দেখেছিলাম। নতুন একটা জগত হবে। সেই জগতে আমাকে মুখ লুকিয়ে থাকতে হবে না৷ কেউ আমার অতীত নিয়ে কথা শোনাবে না৷ প্রতিদিন নিয়ম করে অপমান সহ্য করতে হবে না৷ সেখানকার মানুষগুলো আমার দোষ জানা সত্ত্বেও আপন করে নিচ্ছে। তাদের কাছে আমি চিরঋণী।
– ভাবী অনেক আশা নিয়ে আপনার সংসারে পা রেখেছিলো৷
– হুম। সবই ঠিক ছিলো। ওর সমস্ত আশা আকাঙ্খাগুলো পূর্ণ হয়ে ছিলো শুধু আমি বাদে। আমি ভাবতাম ও কষ্ট পায় না৷ কোনো কথাই ওকে আঘাত করতে পারে না। আমি ভুল ছিলাম। ওর ডায়েরির পাতাগুলো আমার একের পর এক করতে থাকা অন্যায়গুলোর দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিচ্ছিলো আঘাত রুপন্তিরও লাগে। কষ্ট রুপন্তিরও হয়৷
– ডায়েরির পাতায় লিখা আছে সেসব?
– হুম। বিয়ের রাতে ডায়েরি লিখার পর দুই সপ্তাহ ও ডায়েরি লিখেনি৷ লিখেছে পুরো ১৪ দিন পর।
– কি লিখেছিলো?
– আমি জানি তুমি ইচ্ছে করেই আমার কল রিসিভ করো না৷ বুঝতে পেরেও না বুঝার ভান আমি খুব নিখুঁতভাবে করতে পারি৷ গত দশবছরে এই বিষয়ে আমি বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছি। এক কথায় বলতে পারো, এই বিষয়ে আমি গ্র্যাজুয়েট।
– আর আপনি তো ভেবেছিলেন উনি সত্যিই বুঝে না৷
– রুপুকে নিয়ে আরো কত ভাবনাই তো ভেবেছি! ও বেড়াতে গেলেই সাবিহাকে টানাটানি করে এটা আমার বেশ অপছন্দ ছিলো৷ এটাও রুপু বুঝতে পারতো। ডায়েরিতে সেটাও লিখেছিলো, যা শিক্ষা পাবো সেটাই তো করবো। ভাবী আমাকে ছোট থেকে বুকে আগলে রেখে বড় করেছে। কখনো ভাবেনি আমার কারণে ওদের দুজনের একান্ত সময়গুলো নষ্ট হবে। আমার মত সাবিহারও একটাই ভাই। সৈকত তার দায়িত্ব থেকে কয়েকশো হাত দূরে থাকে৷ তাই বলে আমিও থাকবো? থাকবো না৷ আমি যা শিখে এসেছি আমি তাই করবো৷ বাবা মায়ের পর আমি ছাড়া আছে নাকি আর কেউ আপন করে ওকে আগলে ধরার মত? আমি জানি সৈকত ভীষণ অপছন্দ করে। কেন করে আমি জানি না। সাবিহাকে বাসায় রেখে যেতে আমার মায়া হয় তো আমি কি করবো? শান্তি পাই না ওকে রেখে বেড়াতে যেতে। ওর মুখটা চোখের সামনে ভাসতে থাকে৷ নিজের ছোটবেলা চোখের সামনে ছুটাছুটি করতে থাকে৷ মনে হয় ভাবী যদি আমাকে ফেলে নিজের মত জীবন গুছিয়ে নিতো তাহলে আমার কি হতো?
– উনি হয়তো সাবিহাকে নিজের সাথে তুলনা করতো।
– হ্যাঁ। মা ছাড়া ভাবীর কাছে যত্নে বড় হয়েছে। ওর মাথায় গেঁথে গিয়েছে মা বাবার পর ভাই আর ভাই বউরাই ছায়া হয়ে বোনদের মাথার কাছে দাঁড়ায়৷ সেই ধারণা থেকেই সাবিহার প্রতি এতটা মায়া ছিলো।
– আপনি উনার সাথে এত খারাপ ব্যবহার করতেন সেসব কিছু লিখা ছিলো না?
– হুম ছিলো। অনেক অনেক লিখা আছে আমাকে নিয়ে। রুপন্তি বুঝে গিয়েছিলো সে ভুল মানুষকে ভালোবেসেছে। আমার ব্যবহারে কষ্ট পেতো। আবার নিজেই নিজেকে মনে মনে সান্ত্বনা দিতো, শান্ত হ রুপু। বিপরীত মনের মানুষকে ভালোবাসলে কষ্ট পেতেই হবে৷
– আর নবনী? উনাকে নিয়ে কিছু লিখতো?
– হুম, লিখতো। ও সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেতো যখন নবনীকে নিয়ে কথা শোনাতাম। প্রথম যেদিন নবনীকে নিয়ে কথা শোনাই সেদিন ও নাকি খুব কেঁদেছিলো।
– ডায়েরিতে লিখেছিলো সেদিনের কথাগুলো?
– হুম।
– কি লিখেছিলো?
– নবনীকে এখনো ভালোবাসো তাই না? কেন বাসো? ও তো তোমাকে রেখে চলে গেলো। ভালোবাসে না তাই চলে গিয়েছে। আমাকে তুমি খুব অবহেলা করো৷ এড়িয়ে চলতে চাও। আমি সব বুঝতে পারি৷ তবুও তো আমি চলে যাইনি৷ আছি তো তোমার সঙ্গেই৷ ভালোবাসি বলেই তো হাসিমুখে সব মেনে নেই৷ ভালোবাসি বলেই কি আমাকে এত অবহেলা সহ্য করতে হয়? ভালোবাসি বলেই কি আমাকে তোমার ভালোবাসতে ইচ্ছে হয় না? হাসিমুখে তোমার সবকিছু মেনে নেই, এখন নবনীকে আজও ভালোবাসো এখন কি এই কথাটাও আমার হাসিমুখে মেনে নিতে হবে সিকু? কষ্টটা কি আজ একটু বেশিই দিয়ে ফেললে না? খুব কাঁদালে আজ। চোখ মুছতে মুছতে চোখের নিচের চামড়া জ্বালা করছে৷ জানো না চোখের নিচের চামড়া পাতলা হয়? বারবার ঘষাঘষি করলে চামড়া জ্বলতে শুরু করে? জেনেশুনেও কেন এভাবে কাঁদালে? এইযে আমার চোখ জ্বালা হচ্ছে এখন এটার সমাধান কি বলতে পারো?
– উনার জন্য কষ্ট হচ্ছে। সত্যিই তো ভাইয়া, কেউ আমাদের মনের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসলে আমরা কেন তাকে তার মতন করে ভালোবাসতে পারি না?
– ঠিক যেই মুহূর্ত থেকে আমরা বুঝে যাই পাশের মানুষটা আমাকে ভীষণ ভালোবাসে, ঠিক তখন থেকেই মনের এককোণে অবহেলাগুলো জায়গা নিতে শুরু করে৷ তাকে দুর্বল ভাবতে শুরু করি আর নিজেকে বিশাল ক্ষমতাসীন কেউ৷ আমরা একপ্রকার ধরে নেই সে কোথাও যাবে না৷ সে আমাকে ছাড়া অচল। থাকতে পারবে না আমাকে ছাড়া, কষ্ট পাবে৷ আমরা বারবার তাকে ছেড়ে যাওয়ার ভয় দেখানো শুরু করি। মানুষটা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকে। তাকে ছেড়ে না যাওয়ার মিনতি করতে থাকে৷ তার সেই ভয় পাওয়া চেহারা, মিনতি আর কান্না দেখে আমরা ভীষণ আনন্দ পাই৷ নিজেকে আরো বেশি ক্ষমতাসীন ভাবতে থাকি আর তাকে আরো বেশি দুর্বল। রুপু চলে যাওয়ার আগে শেষবারের মত কিছু পৃষ্ঠা লিখে গিয়েছিলো। খুব সম্ভবত চলে যাওয়ার চার পাঁচদিন আগে।

তুমি আমার মাঝে নবনীকে খুঁজে বেড়াও। আমি তো নবনী না সিকু৷ আমি রুপন্তি। তোমার নবনী থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একজন মানুষ৷ আমাকে কেন নবনীর মত হতে হবে? আমার কোনোকিছুই তোমার পছন্দ না৷ আমাকে দেখলেই তোমার চোখজোড়া বিষিয়ে উঠে। তোমার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। এত ঘৃনা কেন করো সিকু? আমি বেশি কথা বলি এটাতে তোমার আপত্তি। বলবো না আমি কথা? তোমার সাথে বলবো না তো কার সাথে বলবো? তোমার মা বাবার সাথে বসে মুভি দেখি, হাসতে হাসতে বাবার গায়ে ঢলে পড়ি, মায়ের আঁচলে চোখ মুছি৷ বাসার বৌ হয়ে তোমার মা বাবার সাথে এভাবে মেলামেশা তুমি অপছন্দ করো। তোমার কাছে বাড়াবাড়ি মনে হয়৷ বাড়াবাড়ির কি দেখলে তুমি? আমি তো কখনো শ্বশুর শাশুড়ি ভাবিনি। ভেবেছি আমারই মা বাবা৷ আমার মা আমাকে কোলে নিয়ে মরতে পারেনি৷ তার আগেই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। নাদিমের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার পর বাবা আমাকে আর কখনো মন থেকে কাছে টানেনি৷ হ্যাঁ, বাবা আমার সাথে কথা বলতো। আমার যা কিছু প্রয়োজন সব বাবা পূরন করতো। কিন্তু অদৃশ্য এক দূরত্ব চলে এলো আমাদের মাঝে। বাবা আর কখনো আমাকে মা বলে ডাকেনি, আমিও কখনো বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারিনি। যার কোলে চড়ে পুরো এলাকা ঘুরে বেড়িয়েছি, যেই মানুষটা কখনো আমার মাথায় হাত না বুলিয়ে ঘুমাতে যায়নি সেই মানুষটা হুট করে আমার পর হয়ে গেলো। একটু না হয় তোমার মা বাবার কাছে ভালোবাসা কুড়াতে গিয়েছিলাম, তাই বলে তুমি এত অভিমান করবে? তোমার অফিসের কলিগরা আমার সাথে যোগাযোগ করে, আমাকে প্রায়ই কফিশপে কিংবা অফিসে গিয়ে কিছুক্ষন গল্প করে আসতে বলে। আমি সাত পাঁচ না ভেবে চলে যাই। আর তুমি বলো জোকার সেজে বিনোদন দিতে যাই। আমার মত অবহেলা পেয়েছো কখনো? পাওনি৷ কত ছটফট করেছি সবার সঙ্গে বসে একটু গল্প করার জন্য! আত্মীয় স্বজনের কাছে একটু মূল্য একটু সম্মান পাওয়ার জন্য! কেউ দিতো না জানো! সবাই কেমন যেনো করতো আমার সাথে। কেউ কেউ তাদের ছেলেমেয়েকে ইশারা করতো আমার কাছ থেকে যেনো দূরে থাকে৷ হয়তো আমার সাথে মেলামেশা করলে তাদের ছেলেমেয়েকেও আমি পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিবো সেই ভয়ে৷ আমি কারো ভয়ের কারণ হতে চাইনি সিকু। কারো বিরক্তির কারণও না। তাই সবার কাছ থেকে দূরে সরে ছিলাম পুরো দশটা বছর৷ তুমি আমাকে যেদিন বিয়ে করলে সেদিন বাবার বাসার দরজা পেরিয়ে আসার সময় মনে হচ্ছিলো আমি মুক্তি পাচ্ছি। নতুন জগতের সব নতুন মানুষের আমার পরিচয় হবে। তোমার সাথে জড়িত সবাইকে আমার খুব কাছের আত্মীয় বানিয়ে ফেলবো। সবার সঙ্গে আমার খুব ভাব হবে। ছোট বড় কেউ বাদ যাবে না৷ দশ বছরের সমস্ত অপ্রাপ্তিগুলো এবার পূর্ণ করবো। কেউ আমার সঙ্গে একটু হাসিমুখে কথা বললে আমার খুব আনন্দ হয়। মনে হয়, মানুষটা আমাকে খুব মূল্য দিচ্ছে। ইচ্ছে হয় তাকে মাথায় করে রাখতে। তোমার অফিসের বড় আপুগুলো, হাসিব ভাইয়া আমাকে খুব আদর করে। মাসে একবার ওদের সাথে দেখা করতে বলে। আমি না করতে পারি না। কারো দেয়া সম্মান কিংবা ভালোবাসা কোনোটাই দূরে ঠেলে দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। আমাকে বকা দেয়া সত্ত্বেও আমি শুধরে যাই না, আমার আত্মসম্মান বলতে কিছুই নেই এই কথা শোনাতেই থাকো। সারাক্ষন আমাকে আত্মসম্মানের জ্ঞান দিতেই থাকো। আমি বুঝিনা কোন আত্মসম্মানের কথা তুমি বুঝাও। যার সামনে গায়ের জামা খুলতে দ্বিধা করিনা তার সঙ্গে কিসের আত্মসম্মান দেখাবো আমি? তোমার চাওয়া আমি পূরণ করতে পারবো না সিকু। আমার পক্ষে নবনী হওয়া সম্ভব না। আমি রুপন্তি, আমি আমার মতই থাকবো। কেউ কারো মত হয় না৷ কারো রূপ ধারণ করা আর মিথ্যা খোলসে নিজেকে ঢেকে নেয়া একই কথা৷ পারবো না আমি সারাক্ষণ মিথ্যা নাটক করতে৷ নবনীর মায়া যেহেতু কাটাতে পারছো না তার মানে ভালোবাসা রয়ে গেছে নিশ্চিত। ভালোই যেহেতু বাসো তাহলে উনাকে ডিভোর্স কেন দিলে? আমাকেই বা বিয়ে কেন করলে? আমার আজকাল কি মনে হয় জানো? আমাদের সংসারটাও বোধ হয় টিকবে না৷ তোমার চোখে ভীষণ বিরক্তির ছায়া দেখতে পাই। বারবার আমাকে চলে যেতে বলো৷ আমি মজা করে হাসতে হাসতে কথার প্রসঙ্গ বদলে ফেলি। তুমি খুব বিরক্ত আর রাগ হয়ে আমার সামনে থেকে চলে যাও৷ মনে হচ্ছে অতি শীঘ্রই তোমার সহ্যসীমা শেষ হয়ে যাবে। রুপন্তি নামক আপদ থেকে দূরে সরে যাবে৷ চলে যাবে হয়তো অন্য কোথাও!
জানি না কেন এই কথাগুলো মনে আজকাল খুব খোঁচায়। আমি চাইনা আমাদের সংসারের ইতি হোক। চাইনা নাদিমের মত তুমিও আমাকে রেখে চলে যাও৷ আমাকে ভালোবাসো প্লিজ। অনেকটুকু না একটুখানি ভালোবাসো,, যতটুকু ভালোবাসলে এই সংসারটা বেঁচে যাবে।

ডায়েরী পড়া শেষ হলো রাত সাড়ে চারটায়। মাথায় চিনচিনে ব্যাথা শুরু হলো। সারারাত জেগে ডায়েরি পড়েছি সেজন্য না৷ ব্যাথা হচ্ছিলো অন্য কারণে। কারণটা রুপন্তি। ডায়েরি যত শেষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো তত আমার অস্থিরতা বাড়ছিলো। আমি অনুতপ্ত হচ্ছিলাম। সেই পৃষ্ঠায় বারবার চোখ বুলাচ্ছিলাম যেখানে রুপু প্রথম লিখেছিলো আমাকে ও ভালোবাসে। শব্দগুলো স্পর্শ করছিলাম। অন্যরকম অনুভূতি ছিলো। অদ্ভুত ক্ষমতা লুকিয়ে ছিলো সেই শব্দগুলোর মাঝে৷ সমস্ত শব্দগুলো একজোট হয়ে আমার ভিতরটা ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছিলো। প্রথম! সেদিনই প্রথম আমার মাঝে আমি রুপুকে খুঁজে পেলাম। কোন এক ফাঁকে এই মেয়ে আমার সবটা দখল করে নিলো আমি বুঝতেই পারলাম না।
– প্রেম তাহলে দ্বিতীয়বারের মত আপনার জীবনেও চলেই এলো।
– সেদিন একটা গুরুত্বপূর্ণ মিথ্যা এবং একটা সত্য আবিষ্কার করেছি।
– কি?
– প্রেম আমার জীবনে একটাই এসেছে। সেটা হলো রুপন্তি। নবনীকে আমি কখনো ভালোবাসিনি৷ ওর আর আমার মাঝে যা ছিলো তা হলো খুব ভালো আন্ডারস্ট্যান্ডিং। সেই থেকে দুজনকে দুজনের ভালো লাগা। ভালো লাগাকে আমরা দুজনে ভেবে নিয়েছিলাম ভালোবাসা। সেজন্যই হয়তো নবনী চলে যেতে চাইলো আর আমি যেতে দিলাম।
– তখনই আমার মনে হয়েছিলো কথাটা। নবনীকে আপনি ভালোবাসেননি৷ বাসলে উনার এ্যাফেয়ার কিংবা ডিভোর্স কোনোটাই এত সহজে মেনে নিতেন না৷
– রুপুকে একটু দেখার জন্য ভীষণ অস্থির লাগছিলো৷ খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো ওকে আমার সামনে বসিয়ে ওর হাতজোড়া ধরে রাখি। ওকে বলি, যা খুশি করো। যত কথা বলতে ইচ্ছে হয় বলো। যত ধরনের পাগলামি করতে ইচ্ছে হয় সব করো৷ আমি আর কখনোই অভিযোগ করবো না।
– কল করেছিলেন ভাবীকে?
– না৷
– কেন?
– রুপুকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি এই কথাটা কাউকে বুঝতে দেয়া যাবে না৷ যাকে এত বকেছি তাকেই ভালোবেসে ফেলেছি ব্যাপারটা খুবই হাস্যকর। ছোট হয়ে যাবো না রুপুর সামনে?

ইমরানের চোখে মুখে একরাশ বিস্ময় জায়গা দখল করে নিলো। কথোপকথনের এই পর্যায়ে এসে সৈকতকে বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছে না সে। নিশ্চুপ তাকিয়ে রইলো সৈকতের দিকে। ইমরানের বোকা বোকা চেহারা দেখে সজোরে হেসে উঠলো সৈকত। বললো,

– আমি একটা ছাগল। তাই না?
– ভাবী আপনাকে ডিভোর্স দেয়ার প্রিপারেশন নিচ্ছে। এমন মুহূর্তে এসে আপনি আবিষ্কার করলেন ভাবীকে আপনি ভালোবাসেন। অথচ আপনি তাকে জানাবেন না ভালোবাসার কথা?
– না, আমি জানাইনি৷
– তাহলে কি চাচ্ছিলেন? ডিভোর্স হয়ে যাক?
– একদমই না৷ রুপুকে আমি কখনোই ডিভোর্স দিবো না৷ আমি যদি মারা যাই তবেই রুপু আমার কাছ থেকে মুক্তি পাবে। এছাড়া কখনোই সম্ভব না৷
– আপনার উচিত ছিলো ভাবীকে অবশ্যই একটা কল করা। কাজটা একদমই ঠিক হলো না।
– হুম, তা তো হয়ই নি। সতেরো দিন আমার কাছে সতেরো যুগের সমান মনে হচ্ছিলো। ওর সাথে কথা বলার চেয়ে ওকে একটুখানি দেখতে বেশি ইচ্ছে হচ্ছিলো আমার। মনে হচ্ছিলো না দেখতে পারলে আমি মারা যাবো। কিন্তু আমি ওর বাসায় যাবো না৷ আবার না দেখেও থাকতে কষ্ট হচ্ছে। কি করবো, কি করবো ভাবতে ভাবতে উপায় পেয়েই গেলাম।
– কি উপায়?
– জানুয়ারীর শুরুর সময় চলছে তখন৷ বাহিরে কনকনে ঠান্ডা। গায়ে সোয়েটার, জ্যাকেট লাগিয়ে বেরিয়ে পড়লাম রুপুর বাসার উদ্দেশ্যে। ওদের এলাকার রাস্তা পুরো ফাঁকা। রাস্তায় মানুষ তো দূরের কথা, একটা কুকুরও নেই। আমি ভেবেছিলাম ওর জানালায় ঢিল ছুঁড়বো৷ গ্লাস ভাঙার শব্দে নিশ্চয়ই জানালায় এসে উঁকি দিবে কে ভেঙেছে দেখার জন্য।
– জানালায় ঢিল ছুঁড়ে গ্লাস ভেঙে ফেলবেন তবুও দোতলা সিঁড়ি ভেঙে শ্বশুরের বাসায় গিয়ে বউকে এক নজর দেখে আসতে পারবেন না?
– মোটেই না৷ ঝগড়া করার পর এতরাতে শ্বশুরবাড়িতে বউকে দেখতে গেলে সবাই ভাববে আমি বউ পাগলা লোক। হাসাহাসি করবে সবাই। কেন সবার হাসির পাত্র হবো?
– আপনি কি সবসময় প্রয়োজনের চেয়ে দুই লাইন বেশি বুঝেন? হাসতে যাবে কেন? আর হাসলে হাসুক। তাতে আপনার কি? ভাবীকে আবারো বাসায় ফিরিয়ে আনতে হবে এটাই তো মূখ্য।
– হ্যাঁ, রুপুকে ফিরিয়ে আনা জরুরী। তবে নিজে ছোট হয়ে না।
– এত্ত ইগো কিন্তু ঠিক না।
– তখন তো এই ব্যাপারটা রিয়েলাইজ করতে পারিনি৷
– শ্বশুরবাসায় গেলে সবাই আপনাকে নিয়ে হাসবে, আর ঢিল ছুঁড়ে গ্লাস ভাঙলে আপনাকে নিয়ে হাসবে না?
– কিভাবে জানবে গ্লাস আমি ভেঙেছি?
– জানবে না? ভাবী জানালা দিয়ে উঁকি দিলেই তো আপনাকে দেখতে পেতো।
– সুযোগ নেই। জানালা বরাবর গাছ আছে। গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকতাম।
– খুব সহজ একটা ঘটনাকে আপনি জটিল করে ফেললেন। চুপচাপ ভাবীর বাসায় চলে গেলেই হতো। তা না করে ১৬-১৭ বছর বয়সী ছেলেদের মত আচরন করলেন।
– করতে পারিনি৷
– কেন? ঢিল ছুঁড়ার জন্য ইট, পাথর কিছু পাননি?
– সমস্যা ইট পাথর না৷ আমার কষ্ট করে ঢিল ছুঁড়তেই হয়নি। রুপু জানালার পাশেই বসে ছিলো৷ কাঠের ফ্রেমবন্দী জানালার লম্বা লোহার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে বসে ছিলো রুপু। নিয়ন বাতির আলোয় ওর মলিন মুখটা দেখতে পাচ্ছিলাম। পুরো সতেরোদিন পর মেয়েটা আমার চোখের সামনে ছিলো। কি বিষন্নতা ঘিরে রেখেছিলো ওর মুখটা! এতগুলো দিন পর ওকে দেখতে পাচ্ছি, আমার খুশি হওয়ার কথা ছিলো৷ কিন্তু আমি খুশি হতে পারছিলাম না। যেই বিষন্নতা দেখার জন্য আমি মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম সেই বিষন্নতা আমাকে ভীষণ খোঁচাচ্ছিলো। কষ্ট পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিলো আমি একটা হাসিখুশি মেয়েকে মেরে ফেলেছি। আমি এই রুপুকে দেখতে চাইনি। আমি সেই আমার আগের রুপুকে একনজর দেখতে চাচ্ছিলাম। ইচ্ছে হচ্ছিলো চিৎকার করে বলি,

– রুপু, সতেরো যুগ পেরিয়ে গেলো তোমার হাসি দেখি না৷ তোমার হাসির ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছে। আমার তৃষ্ণা মিটিয়ে দিবে প্লিজ!

সৈকতের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো ইমরান। এই লোকটাকে খুব বিরক্তিকর লাগছে। কষ্টে মরে যাবে অথচ বলবেনা ভালোবাসি। এ কেমন ধাঁতের লোক! মুচকি হেসে সৈকত জিজ্ঞেস করলো,

– এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
– ধুর, এগুলো কেমন কথা? কষ্ট পাচ্ছেন অথচ ভাবীকে একবার সরি বলে বাসায় ফিরে আসার কথা বলতে পারলেন না?
– নাহ্, বলিনি। আত্মসম্মান যে খুব আমার!
– প্লিজ এই ফালতু যুক্তিটা আমার সামনে বারবার দাঁড় করাবেন না।
– এই ফালতু যুক্তিকেই তো আমি ভালোবেসে খুব যত্নে মনে গেঁথে রেখেছিলাম।
– সম্পর্কটা ভেঙে যাচ্ছে সৈকত ভাই! ঐ মুহূর্তে এরচেয়ে বড় আর কি হতে পারে?
– রুপন্তি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে এটা আমার বিশ্বাস হয়নি৷ বুঝতে পারছিলাম খুব রাগ করেছে। কিন্তু ডিভোর্স ওর দ্বারা সম্ভব না। চিরতরে আমাকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার মত রাগ ও করতে পারে না৷ ভেবেছিলাম মা হয়তো আমাকে একটু ভয় দেখানোর জন্য কথাটা বলেছে কিংবা মা ভাবছে ডিভোর্সের কথা শুনলে আমি রুপন্তিকে সরি বলবো। পরদিন রুপন্তি আমার সেই ধারণাও মিথ্যা প্রমাণ করলো।
– লিগ্যাল নোটিশ?
– হ্যাঁ। পরদিন বাসায় আসতেই বাবা আমার হাতে খাম ধরিয়ে দিলেন। খাম খুলে দেখি রুপু আমাকে নোটিশ পাঠিয়েছে।
– মানুষটা ভালোবাসতেও জানে, খুব অভিমানও করতে জানে। সবই বুঝলাম। কিন্তু একটা ব্যাপার ধরতে পারছি না। আপনি উনার সাথে এতগুলো দিন এত রুড বিহেভ করলেন, উনি আপনাকে ছেড়ে যায়নি বা কখনো ছেড়ে যাওয়ার কথা বলেনি। হঠাৎ করেই এমন কি হয়ে গেলো যে উনি ডিভোর্স পর্যন্ত চলে গেলো?
– সব মানুষেরই কোথাও না কোথাও একটা দুর্বলতা থাকে৷ সেই দুর্বলতাটা খুব স্পর্শকাতর হয়। কেও সেটা নিয়ে নাড়াচাড়া করুক সেটা তারা পছন্দ করে না। বিশেষ করে খুব প্রিয় কেও যদি ব্যাপারটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করে তাহলে সেটা তারা মানতে পারে না৷ এমনিতে আমার রুপন্তিকে সহজে কোনো বিষয় নাড়া দিতে পারে না৷ যেকোনো কথা হালকাভাবে নেয়ার গুনটা ওর আছে৷ কিন্তু ঐ যে বললাম দূর্বল জায়গা থাকে। ও যেদিন বাসা থেকে বের হয়ে যায় সেদিন আমি একটা মিসটেক করে ফেলেছিলাম। সেটা হচ্ছে নাদিম৷ নাদিমের ইস্যুটা ছিলো রুপুর উইক পয়েন্ট। এত হাসিখুশি একটা মেয়ে যে মনের মধ্যে এতখানি কষ্ট লুকিয়ে রেখেছে আমি কখনো টেরই পাইনি৷ কেও টের পাবেও না৷ ওকে দেখলে মনে হয় জগতের সবচেয়ে সুখী মানুষ। ভেবেছিলাম অন্যসব কথাগুলোর মত নাদিমের কথাগুলোও ও খুব হালকাভাবে নিবে৷ কিন্তু ও নিলো না। সেদিন সত্যি সত্যি রুপন্তি কষ্ট পেলো। কথাগুলো আমি বলেছিলাম তাই হয়তো কষ্টটা একটু বেশিই পেয়েছিলো৷ আমি তো ওর খুব প্রিয় মানুষ। আমার কাছ থেকে এই কথাগুলো ও আশা করেনি৷
যেই রুপন্তিকে আমি চিনতাম এটা সে না, এ যেন অন্য আরেক রুপন্তি। ওর অন্যসব ঘটনা মেনে নিতে পারলেও এই ঘটনা আমি মেনে নিতে পারিনি৷ নোটিশ হাতে নিয়ে আমি কতক্ষণ ঝিম ধরে বসেছিলাম আমি জানি না৷
– বাসার লোকজন কিছু বলেনি আপনাকে?
– না। সবাই স্বাভাবিক ছিলো। বাসার লোকদের দেখে মনে হচ্ছিল যেন রুপুর সাথে আমার ডিভোর্স হওয়া খুব স্বাভাবিক।
– আপনার মা তো বলেই দিলো উনি চান ভাবী আপনার কাছ থেকে দূরে গিয়ে ভালো একটা জীবন কাটাক। হয়তো বাসার সবাই এটাই চাচ্ছিলো।
– হুম৷ আমি সেদিন রাতেই ল’ইয়ারের সাথে যোগাযোগ করলাম। অবজেকশন পেপার রেডি করতে বললাম। পেপার রেডি করে রুপুর কাছে পাঠালাম। রুপু আমাকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠালো এটা নিয়ে কেউ আমাকে কিছু বললো না অথচ আমি অবজেকশন পেপার পাঠাতেই আমার মা বাবা আমাকে ধরে বসলো।
– কেন?
– আমি কেন ডিভোর্স দিতে চাচ্ছি না সেটা জানার জন্য। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম জানো! আমি ডিভোর্স দিতে চাচ্ছি না এটা জেনে উনাদের খুশি হওয়ার কথা ছিলো৷ খুশি তো হয়নি উল্টো দুজনই রেগে গেলো। বেশ রাগ করেই কথাটা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো।
– কি বলেছিলেন?
– বললাম, আগেও একটা ডিভোর্স হয়েছে৷ এখন কি চাও এবারও ডিভোর্স হোক? মানুষের কাছে মুখ দেখাতে পারবো আমি? বিয়ে হয়েছে দুটো। একজন আড়াইবছরে ডিভোর্স দিলো আরেকজন তো একবছরও পার করলো না। আটমাসেই ডিভোর্স দিলো। আশপাশের লোকদের কাছে কত আজেবাজে কথা শুনতে হবে তা জানো?
– তবুও বললেন না উনাকে আপনি ভালোবাসেন!
– উহুম।
– ভাবী জানতে চায়নি ডিভোর্স কেন দিতে চাচ্ছেন না?
– হুম। পরদিন রুপু ফোন করেছিলো। এতগুলো দিন পর আমি রুপুর কন্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলাম। অফিসে ছিলাম তখন। লাঞ্চ আওয়ারের আগ মুহূর্তে কল করলো। বললো বিকেলে আমার সাথে কোথাও বসে ডিভোর্সের ব্যাপারে কথা বলতে চায়। রুপুকে একনজর কাছ থেকে দেখার জন্য, ওর সাথে একটু কথা বলার জন্য আমি ছটফট তো করছিলামই, রুপুর কল পাওয়ার পর মনে হলো এবার বুঝি অস্থিরতায় আমার নিঃশ্বাসটাই আটকে আসছে। আমি ঠিকমত ওর সঙ্গে কথা বলতে পারছিলাম না৷ জিহ্বায় জড়তা চলে আসছিলো। কোনোমতে হুম, হ্যাঁ বলে ফোন রেখে দিলাম৷ কয়েক মিনিট চেয়ারে চোখ বন্ধ করে ভালোভাবে নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমি পারছিলাম না। বারবার গলার কাছে গিয়ে নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছিলো। জীবনে প্রথমবারের মত অনুভব করলাম কারো জন্য আমার নিঃশ্বাসও আটকে যায়! পাশের ডেস্ক থেকে তামান্না খেয়াল করলো আমাকে। জিজ্ঞেস করলো,

– সৈকত, তুমি কি সিক?

আমি তামান্নাকে কোনো রিপ্লাইও দিতে পারছিলাম না৷ আমার দুনিয়া ভেঙে কান্না পাচ্ছিলো। কিন্তু আমি কাঁদতে পারছিলাম না৷ অস্থিরতা আরো বেড়ে গেলো। এসির মাঝে থেকেও ঘামছিলাম খুব৷আমার শুধু বারবার মনে হচ্ছিলো রুপন্তি আমার কপালে একটু হাত রাখলেই আমি আবার নিঃশ্বাস নিতে পারবো। তামান্না মাঝে আরো দুইবার জিজ্ঞেস করলো। আমি একবারও কিছুই বলতে পারলাম না৷ সৈকত মনে হচ্ছে সেন্সলেস হয়ে যাচ্ছে, কেউ একটু পানি আনো, কথাটা তামান্না চিৎকার করে বলতে লাগলো। আমি হৈ চৈ শুনতে পাচ্ছিলাম। চোখে স্পষ্ট কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না৷ তামান্না আমার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিলো, আমি টের পাচ্ছিলাম। কোনো একভাবে আরেক হাতে তামান্নার হাত টেনে কাছে এনে বললাম,

– রুপন্তিকে একটু আসতে বলবে প্লিজ?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here