ঘুণপোকা,পর্ব_৯

0
684

ঘুণপোকা,পর্ব_৯
মিম

– আপনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলেন কেন?
– তখন আমার মনের অবস্থা কেমন ছিলো সেটা তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারবো না৷ নোটিশ আমার হাতে আসার পর ভয়াবহ এক মানসিক চাপের মাঝে আমি দিন কাটাচ্ছিলাম। আমাকে সাপোর্ট করার মত কেউ ছিলো না৷ আমার মা-বাবাও না। রুপু আমাকে ফেলে চলে যাবে এটা আমি একদমই মেনে নিতে পারছিলাম না। ভয় হচ্ছে জগতের সবচেয়ে খারাপ মানসিক রোগ। তোমাকে মেরে ফেলার জন্য এটাই যথেষ্ট। রুপুকে হারানোর ভয় আমাকে বাজেভাবে ঘিরে ফেলেছিলো। নিজের অজান্তেই ভালোবাসার গভীর সমুদ্রে আমি তলিয়ে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে উঠে আসার কোনো পথ আমার ছিলো না৷ রুপু ছাড়া সেই সমুদ্রে বেঁচে থাকা সম্ভব না। মনে হতো আমি বুঝি দম আটকে মারা যাবো।
– তারপর? ভাবীকে আসতে বলা হয়েছিলো?
– হুম। আমাকে হসপিটাল নিয়ে গেলো। সেখান থেকে কিছু ট্রিটমেন্ট দিয়ে বাসায় পাঠালো। রুপুকে ফোন করা হয়েছে দুপুর একটায়। আর রুপু আমার কাছে এলো বিকাল সাড়ে চারটায়। আমি ভেবেছিলাম আমার অসুস্থতার কথা শুনেও বোধ হয় ও আসবে না। ডিভোর্স পর্যন্ত যেহেতু এই মেয়ে চলেই গিয়েছে তারমানে ওকে দিয়ে এখন সব সম্ভব। বিকেলে বারান্দায় বসে ছিলাম। বাসার সামনের গলিতে একটা হুড তোলা রিকশা এসে থামলো। ভাড়া মিটিয়ে রিকশা থেকে মানুষটা নামতেই দেখি রুপু এসেছে৷ বারান্দা থেকে ছুটে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।
– কেন?
– আমি রুপুকে বুঝাতে চাচ্ছিলাম আমি ভীষণ অসুস্থ।
– আপনি তো অসুস্থই। নতুন করে আবার কি বুঝাবেন?
– আমি যতটুকু অসুস্থ, চাচ্ছিলাম তারচেয়ে আরো বেশি অসুস্থতার ভান করতে।
– কেন?
– রুপুর যেন একটু দয়ামায়া হয় আমার জন্য৷ আমাকে অসুস্থ দেখলে হয়তো একটু ভাববে আমাকে নিয়ে। সরাসরি তো আর ভালোবাসি বলতে পারবো না৷ আমি ভেবেছিলাম আমাকে খুব অসুস্থ দেখলে হয়তো ও আর স্ট্রং থাকতে পারবে না। রাগ একটু হলেও গলে যাবে৷ এই বাসায় থাকবে হয়তো কিছুদিন। বাসায় না থাকুক এটলিস্ট প্রতিদিন একটা কল হলেও তো করবে। ডিভোর্সের ব্যাপারটা কিছুদিন থেমে থাকবে৷ আমি সেই কয়দিনের সুযোগ নিবো। ঐ কয়টাদিনে আমি রুপুকে হাব-ভাবে বুঝিয়ে দিবো এইযে আমি বিছানায় পড়ে আছি সেটার জন্য রুপু দায়ী এবং আমি তাকে ভালোবাসি। আমাকে
সুস্থ রাখতে চাইলে ও যেন আমাকে ছেড়ে কোথাও না যায়।
– নাটকের কোনো প্রয়োজনই ছিলো না। আপনি এমনিতেই অসুস্থ ছিলেন।
– তবুও আরেকটু করলাম আরকি! টর্নেডোর একটু বাড়তি খেয়াল পাওয়ার লোভেই করলাম।
– পেয়েছিলেন?
– না৷ মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিলো খুব৷ রুপুকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছিলাম।
– ও মা! কেন?
– রুপু খাটের কাছে ছোট টুলটা নিয়ে বসলো। আমি দেখছিলাম মেয়েটাকে। কি শুকিয়ে গিয়েছিল ঐ কয়দিনে! দেখে বুঝতেই পারছিলাম রাতে ঘুমায় না মেয়েটা। চোখের নিচে কালো দাগ আর চেহারায় লেপ্টে থাকা ভীষণ ক্লান্তি সে কথাই জানান দিচ্ছিলো। ইচ্ছে হচ্ছিলো ওকে বলি, এসব রাগ টাগ ছাড়ো তো! নিজে ঘুমাতে পারছো না, আমাকেও ঘুমাতে দিচ্ছো না৷ আসো তো, লেপের ভিতর আসো। দুজনে মিলেমিশে কয়েকঘন্টা আগে আরাম করে ঘুমিয়ে নেই। এরপর কথাবার্তা বলা যাবে।

হাসলো ইমরান। বললো,

– আপনার শুধু বলতে ইচ্ছাই হয়। বলেননি তো কিছুই। বললেই তো সম্পর্কটা আর ঝুলে থাকে না।
– ঐরকম একটা মুহূর্তে কি রুপুকে এই কথা বলা যেতো? এটা কি শোভা পায়?
– কতকিছুই তো শোভা পায়নি। তবুও তো করেছেন, বলেছেন। একটা অশোভনীয় কথায় যদি ভালোবাসা একটু হলেও প্রকাশ পায়, সম্পর্কের সুতায় একটু হলেও জোড়া লাগে তো বলতে সমস্যা কি?
– অতটা অনুভব ক্ষমতা যদি আমার থাকতো তাহলে হয়তো রুপুর সাথে সেইসব আচরণ করতামই না৷
– ভাবীর সাথে রেগে গিয়েছিলেন কেন বললেন না তো!
– ও আমার পাশে বসে শরীরের কি হাল অবস্থা জিজ্ঞেস করলো। এরপরই চলে গেলো বাবা-মায়ের ঘরে বাবার সাথে দেখা করতে। ওর ফোন আর পার্স আমার রুমে রেখে গেলো। সাইড টেবিলে ছিলো ফোনটা৷ ও ঘর থেকে বের হতেই কল এলো ওর মোবাইলে। কে কল করেছিলো জানো?
– কে?
– নাদিম।
– সে! কেন?
– ওর প্রথম আমি কল রিসিভ করিনি। যতক্ষণ রিং হচ্ছিলো ততক্ষণ আমি স্ক্রিনে ভাসতে থাকা ঐ নামটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। রুপুর মোবাইলে আমি কখনোই হাত দেইনি। ওয়াইফের মোবাইল ঘাটাঘাটি আমার পছন্দ না। কি মনে করে সেদিন রুপুর মোবাইলটা আমি হাতে নিয়ে সোজা ইনবক্সে চলে গেলাম। নাদিমের অগণিত ম্যাসেজ জমা রয়েছে সেখানে।
– নাদিমের ম্যাসেজ? কি ম্যাসেজ? কি চায় সে?
– রুপুকে।
– মানে কি?
– মানে সে রুপুকে ফিরে পেতে চায়। প্রতিটা ম্যাসেজে সে রুপুকে কনভিন্স করার চেষ্টা করেছে। রুপুর সাথে আমার সম্পর্ক ডিভোর্সের পথে সেই খবর জেনে সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি। সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে, রুপুকে ছাড়া সে কষ্টে আছে, রুপুকে সে সব সুখ দিবে আরো হাবিজাবি কত কথা! মাথায় আগুন ধরে গেলো আমার। হঠাৎ কেন যেন মনে হলো এতগুলো বছর পরও নাদিম আজও রুপুর দুর্বলতাই রয়ে গিয়েছে। ভালোবাসা না থাকলে তো দুর্বলতাও থাকতো না। রুপু এখনো নাদিমকে ভালোবাসে। ভালোবাসে বলেই রুপু সেদিন নাদিমের ব্যাপাটায় খোঁচাখুঁচি মেনে নিতে পারেনি। নাদিম এখনো রুপুর সাথে যোগাযোগ করতে পারে। রুপু সেই যোগাযোগের পথ খোলা রেখেছে। নয়তো নাদিমের নাম্বারটা অবশ্যই ব্লক লিস্টে রেখে দিতো। যেহেতু ব্লক করেনি তারমানে রুপু চাচ্ছে নাদিম ওর সাথে যোগাযোগ করুক। রুপু এখনো রেগে আছে তাই নাদিমের ডাকে সাড়া দিচ্ছে না। হয়তোবা সে চাচ্ছে নাদিম ওর রাগটুকু ভাঙিয়ে দিক। তারপর দুজনে মিলে বহুবছর আগে দেখা স্বপ্ন পূরণে ব্যস্ত হবে৷ আর আমি? আমি কেউ না। রুপু আমাকে ভালোবাসে না। এজন্যই সে আমাকে রেখে চলে যেতে চাচ্ছে।
– কয়েকটা ম্যাসেজ পড়েই এতকিছু ভেবে ফেললেন?
– হুম ভাবলাম। কত কি কল্পনাও করে ফেললাম! চোখের সামনে ভাসছিলো রুপু নাদিমের সঙ্গে খুব হাসছে, কথা বলছে। মাঝরাতে ফাঁকা রাস্তায় দুজনে হাত ধরাধরি করে হাঁটছে।
– আরো কিছু?
– ভয়, বুঝলে ইমরান! রুপু চলে যাবে সেটা নিয়ে ভয়ে তো ছিলামই, নাদিমের ম্যাসেজগুলো দেখে এবার ভয়ে আমার আত্মা শুকিয়ে গেলো৷ মনে মনে ধরেই নিলাম নাদিম ফিরে এসেছে তাই রুপু আমাকে ডিভোর্স দিচ্ছে। আমি হচ্ছি রুপুর জীবনে দ্বিতীয় পুরুষ। আর নাদিম হলো তার প্রথম প্রেম। প্রথম স্বপ্নজাল এই মানুষটাকে নিয়েই রুপু বুনেছিলো৷ সেই মানুষটা ওর সামনে দু’হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর আমি রুপুকে বারবার দূরে ঠেলে দিয়েছি। এখন নাদিমের বাড়িয়ে দেয়া হাতটা রুপু যদি শক্ত করে ধরে নেয় তাহলে সেটা কি অবাস্তব কিছু হবে? মোটেই না। কথাগুলো সজোরে মনের কড়া নেড়ে যাচ্ছিলো।
– জানি না গল্পের শেষে কি অপেক্ষা করছে। তবে মনে হচ্ছে আপনার ধারনা ভুল ছিলো। ভাবী নাদিমকে ভুলে আপনাকে ভালোবেসেছে৷ যত কিছুই হোক ভাবী আপনাকেই ভালোবাসে। নয়তো লিগ্যাল নোটিশ পাঠানোর পরও ভাবী আপনাকে দেখতে আসতো না। যাইহোক, ভাবীর সাথে সেদিন কি নাদিমকে নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছিলো?
– ও বাবার ঘর থেকে ফিরে এসে আবারও টুলটাতে বসলো। ওকে কেন যেনো আমার সহ্য হচ্ছিলো না। বিষাক্ত লাগছিলো রুপুকে। মনে হচ্ছিলো এই মেয়েটা আমার জীবনে পা রেখেই
জীবনটা বিষিয়ে তুলেছে। যতদিন আমার কাছে ছিলো ততদিন আমাকে অশান্তি দিয়ে আধমরা করেছে। এখন আমাকে ডিভোর্স দিয়ে একদম মেরে ফেলার বন্দোবস্ত করেছে। ও টুলে বসা মাত্রই ওর সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলাম,

– তুমি এখানে কেন এসেছো? যাও, বাসায় যাও।

রুপু অবাক হয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। আমি আবারও বললাম,

– এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? যাও, বাসায় যাও। এখানে আর এক সেকেন্ডও বসবে না তুমি।

এইবার রুপু মুখ খুললো। খুব বিরক্ত আর শান্তস্বরে বললো,

– আমি কি নিজের ইচ্ছায় এসেছি সৈকত? তুমি আসতে বলেছো তাই এসেছি। আর নয়তো তোমার সামনে আমি কখনোই আসতাম না!

রুপু সাইড টেবিলের উপর থেকে ফোন আর পার্স নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আমি রুপুর চলে যাওয়া দেখছিলাম, আমি কষ্ট পাচ্ছিলাম। রুপু চলে গেলো কষ্ট আমি সেজন্য পাইনি, কষ্ট পেয়েছিলাম কারণ আমি রুপুর কাছে সিকু থেকে সৈকতে চলে এসেছি। সম্পর্কে দূরত্ব ঠিক কতটা চলে এসেছে তা আমি ডিভোর্স লেটার হাতে নিয়েও টের পাইনি, টের পেয়েছিলাম রুপুর মুখে সৈকত ডাক শুনে।
– অথচ এই ডাকটা শুনেই কি বিরক্ত হতেন! আমাদের মন খুব রঙ বদলায়।
– হুমম, খুব বদলায়। রুপুকে আমিই চলে যেতে বললাম ওকে সহ্য হচ্ছিলো না তাই৷ যেই না রুপু আমার চোখের আড়াল হলো অমনি আবার আমি অস্থির হয়ে গেলাম রুপুকে নিয়ে। ভয়টা যেনো আরো বেড়ে গেলো। রুপুকে আমি ডেকে এনে আবারও তাড়িয়ে দিলাম। আর অন্যদিকে নাদিম সবধরনের চেষ্টা করে যাচ্ছে রুপুকে কাছে টানার৷ যদি আজই রুপু ফিরে গিয়ে নাদিমের সাথে সম্পর্ক কন্টিনিউ করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন কি হবে? আমি তো রুপুকে আর কখনোই ফিরে পাবো না। এই ভাবনায় আমার প্রান যায় যায় দশা। ভাবলাম ওকে আমার কাছেই রেখে দেয়া উচিত। তাহলেই আর এত দুশ্চিন্তায় ভুগতে হবে না। আত্মসম্মানের উপর পাথর চাপা দিয়ে রুপুকে ফোন করে বাসায় ফিরে আসতে বলার সিদ্ধান্ত নিলাম।
– যাক! অবশেষে আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন। তারপর?
– রুপুকে তিনবার ফোন করেছি। ও আমার কল রিসিভ করেনি৷ বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। সময় বাড়ছিলো, আমার দুশ্চিন্তা বাড়ছিলো। অস্থিরতা বাড়ছে তো বাড়ছেই। শুয়ে শান্তি পাচ্ছি না, বসে শান্তি পাচ্ছি না। কোনোকিছুতেই শান্তি নেই আমার। দুপুরবেলার মত আবারও আমার নিঃশ্বাস আটকে আসছিলো। শীতের মধ্যেও আমি ঘামছিলাম। বাবা কি মনে করে যেনো আমার ঘরে এলো। দেখলো আমি দেয়ালে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে আছি। জোর করে নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করছি বাবা এই ব্যাপারটা খেয়াল করলো। বাবা একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলো। মা কে ডেকে আনলো। দুজনই আমার হাল দেখে বেশ অস্থির হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। মা বাবা দুজনই আমাকে দুপাশ থেকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। মা জিজ্ঞেস করলো, হসপিটাল যাবো কিনা৷ বাবা বললো, জিজ্ঞেস করার কি আছে? ওকে ধরে বিছানায় বসাও। আমি একটা রিকশা ডেকে আনি৷
– আবার হসপিটাল যেতে হয়েছিলো?
– আমি যাইনি৷ বাসায়ই রয়ে গিয়েছিলাম। হসপিটাল গিয়ে লাভ কি? ওখানে কি আমার অসুখের কোনো ট্রিটমেন্ট আছে নাকি?

বাবা মা আমাকে ধরে বিছানায় শোয়ালো। মা আমার হাত পা মালিশ করে দিচ্ছিলো। বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো, বারবার বলছিলো হসপিটাল কেন যাবি না? বাসায় থেকে বিপদ কেন ঘটাতে চাচ্ছিস?
অনেকটা সময় পর বাবাকে বললাম, রুপন্তি আমার কল রিসিভ করছে না৷ তুমি তার খুব প্রিয়। তুমি কল করে আসতে বললে ও না করবে না৷ রুপন্তিকে বলো না এখানে এসে কয়েকদিন থেকে যেতে!

এতটা সময় বাবা মা আমাকে নিয়ে ভীষণ দুঃশ্চিন্তায় ছিলেন। মা কাঁদছিলো। দুজনের চোখে মুখে পেরেশানী স্পষ্ট৷ আমার আবদার শোনা মাত্রই উনাদের চেহারা থেকে সমস্ত দুঃশ্চিতার ছাপ উধাও। মা আর কাঁদছেনা, হাত পা মালিশ করে দিচ্ছে না৷ বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে না। দুজনই আমার দিকে খুব বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে রইলো। উনাদের দেখে মনে হচ্ছিলো সেই মুহূর্তে উনারা আমার অসুস্থতা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহে ভুগছেন।
– ভাবীকে বাসায় আনার জন্য আপনি নাটক করছেন এমন কিছু সন্দেহ করছিলো?
– হ্যাঁ। মা বেশ রাগ করেই আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

– রুপু কেন এখানে এসে থাকবে?

আমি কোনো উত্তর দেইনি। আমার উত্তর না পেয়ে বাবা একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো। আমার ইচ্ছে হচ্ছিলো অনেক অনেক কথা বলতে। রুপুকে ঘিরে আমার শত শত অনুভূতি জমা হয়েছে৷ আমি অনুতপ্ত হচ্ছি সকাল-বিকেল। প্রতিমুহূর্তে ঐ মেয়েটার প্রেমে ডুবে মরছি৷ ঐ মেয়েটাকে হারানোর ভয়ে বারবার নিঃশ্বাস হারাচ্ছি। আমি ভীষণ অসুস্থ। মরণব্যাধি পেয়েছে আমাকে। আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইলে রুপুকে এনে দাও। আর নয়তো তোমাদের ছেলে অতি শীঘ্রই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করবে।

আমি একটা কথাও বাবাকে বলতে পারিনি। সমস্ত কথা আমার গলা পর্যন্ত এসে আটকে গেলো। সেদিন ঐ মুহূর্তে আমি বোবা মানুষের কষ্ট খুব অনুভব করতে পেরেছি। তারা কতশত কথা বলতে চায় অথচ বলতে পারে না৷ আমারও অনেক কিছু বলার ছিলো অথচ আমি বলতে পারিনি।
– কখনোই মনের কথাগুলো প্রকাশ করতে পারেন না?
– একদমই না। এই ব্যাপারে আমি ভীষণ আনাড়ি। তবে আমি বলতে পারিনি অন্য কারণে। কারো প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা মানেই নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করা। আমি আমার দুর্বলতা কারো কাছেই প্রকাশ করতে চাইনি। আমার মা বাবার কাছেও না।
– আমার কেন যেনো মনে হয় আংকেল আন্টিকে এসব কথা বলেও কোনো লাভ হতো না।
– কিভাবে বুঝলে?
– মনে হচ্ছে আরকি! ভাবী ডিভোর্স দিতে চাচ্ছে, আংকেল আন্টি পুরোদমে সাপোর্ট দিচ্ছে ভাবীকে। বুঝাই যাচ্ছে উনারা ভাবীর পক্ষেই কথা বলবে। তাছাড়া সন্তান হিসেবে যতটুকু জায়গা উনাদের মনে আপনার থাকার কথা ছিলো সেইটুকু জায়গা কিন্তু ভাবী নিজের দখলে নিয়ে নিলো। ছেলের চেয়ে ছেলের বউকেই উনারা কয়েকগুন বেশি ভালোবাসে।
– ঠিকই ধারণা করেছো। বাবা মা রুপুর পক্ষেই ছিলো। রুপু যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাবা মা সবসময় সেটাই মেনে নিয়েছে৷ আমি কি চাচ্ছি সেসবের কোনো মূল্যই মা বাবার কাছে নেই।
– আংকেল কি কল করেছিলো ভাবীকে?
– তোমার কি মনে হয়?
– আমার তো মনে হচ্ছে কল করেনি।
– সত্যিই করেনি। মা কঠিনভাবে আমাকে জানিয়ে দিলো, এসেছিলোই তো তোকে দেখতে। নিজে ডেকে এনে নিজেই বের করে দিলি। এখন আবার ঢঙ করছিস কেন? রুপু আর আসবে না। শরীর খারাপ হয়েছে ডক্টরের কাছে চল। রুপুর এখানে কোনো কাজ নেই। সাবিহার সাথে যার সম্পর্ক চলছে কাল বিকেলে তার বাড়ির লোকজন সাবিহাকে দেখতে আসবে। খুব সম্ভবত আগামীকালই বিয়ের তারিখ ঠিক করে যাবে। রুপু আগামীকাল বিকেলে আসছে। অহেতুক আজ আসতে বলার প্রয়োজন নেই।

মা কথাগুলো বলে বের হয়ে গেল আমার ঘর থেকে। বাবা আমার পাশেই বসে ছিলো৷ আমাকে দেখছিলো খুব মন দিয়ে। হয়তো আমার চোখের ভাষা বুঝার চেষ্টা করছিলো! বাবা আমাকে এভাবে দেখছে ব্যাপারটা আমাকে খুব অস্বস্তিতে ফেলে দিলো। বাবা আমার চোখ দেখে বুঝে ফেলবে আমি রুপুকে ভালোবাসি, ব্যাপারটা নিয়ে আমি ভয় পাচ্ছিলাম। আমি চাইনি কেউ বুঝুক আমি রুপুকে ভালোবাসি। চাইনি কারো হাসির খোড়াক হতে, কাউকে নিজের দুর্বলতা জানাতে। আমি মুখে বালিশ চাপা দিয়ে শুয়ে রইলাম। আমার কান্না পাচ্ছিলো। কিন্তু আমি কাঁদতে পারছিলাম না। আমি কাঁদতে পারি না। খুব কষ্টে ভিতরটা চুরমার হয়ে গেলেও পারি না। আমার মনে হচ্ছিলো আমি একটু কাঁদতে পারলেই আমার কষ্ট কমে যাবে। একটু কাঁদার জন্য খুব চেষ্টা করেছি, আমি পারিনি।
– ভাবীর চোখে একটু পানি দেখার জন্য কতকিছুই না করলেন! অথচ সেই মানুষটার জন্যই কি না কাঁদার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন!

মুখ বাকিয়ে হাসলো সৈকত। বললো,

– অন্যায় রুপুও করেছে। রুপুর উচিত ছিলো আরো আগেই রাগ করে চলে যাওয়া, আমার সাথে ঝগড়া করা। মেয়েটা সবসময় হাসিমুখে সব মেনে নিয়ে আমাকে এতখানি আস্কারা দিয়েছে। আমাকে লিমিট ক্রস করার পারমিশন দিয়েছে। যখন আমি লিমিট ক্রস করলাম তখন আমাকে ফেলে চলে গেল মেয়েটা! আগে আমাকে দুই একটা কড়া করে হুমকি-ধমকি দিলেও তো পারতো তাই না?
– হুমকি-ধমকি দিলে কি আপনি এমন আচরন করতেন না?
– এতটাও বাড়াবাড়ি করতাম না।
– ভাবীকে আর কল করেছিলেন?
– না।
– তাহলে? চিন্তা করতে করতেই রাত কাটিয়ে ফেললেন?
– উহুম। আধাঘন্টা পর কোনো একভাবে এই অসুস্থ শরীরেই বেরিয়ে পড়লাম রুপুর বাসার উদ্দেশ্যে। নাদিমকে আমার বিশাল পীড়া মনে হচ্ছিলো। সহ্য হচ্ছিলো না একদম! রুপুর সাথে এই ছেলের ব্যাপারে কথা বলে সবটুকু ক্লিয়ার না করা পর্যন্ত আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না৷ রুপু নাদিমকে নিয়ে কতটুকু সিরিয়াস সেটা জানা সেই মুহূর্তে খুবই জরুরি ছিলো।
– কাউকে বুঝতে দিবেন না আপনি ভাবীকে ভালোবাসেন। আর এই কাজ করলে কি ভাবি কিংবা উনার বাসার মানুষজন আপনার ভালোবাসা বুঝে ফেলতো না?
– তখন এই কথাগুলো মাথায়ই আসেনি একদম। হঠাৎ মাথায় ভূত চাপলো রুপুর সাথে কথা বলবো, সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেলাম। ঘোরের মাঝে ছিলাম আমি। আধপাগল অবস্থা আমার। পুরো রাস্তা নাদিমকে নিয়েই জল্পনা-কল্পনা করতে করতে পার হয়েছে। আমার ঘোর কাটলো রুপুদের এলাকায় পৌঁছে। এলাকার মোড় পার হয়ে একটু সামনেই মুখোমুখি দুটো এ্যাপার্টমেন্ট আন্ডার কনস্ট্রাকশন। তুলনামূলক অন্ধকার ছিলো জায়গাটা৷ মানুষজনও নেই৷ ঐ পথ ধরে যাওয়ার সময় দেখলাম রুপু রিকশায় বসা৷ এক ছেলে রিকশার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। খুব নীচু স্বরে দুজনে কথা বলে যাচ্ছে। অন্ধকারেও আমি রুপুর কুঁচকে যাওয়া চেহারা কিছুটা বুঝতে পারছিলাম। পরিস্থিতি আমার কাছে ভালো ঠেকেনি। ভাড়া মিটিয়ে আমি রিকশা থেকে নেমে রুপুর কাছে যাবো ঐ মুহূর্তে কোত্থেকে রাহাত দৌঁড়ে এসে ছেলেটাকে এলোপাতাড়ি কিল ঘুষি যা পারে সব দেয়া শুরু করলো। আর অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ তো আছেই৷ রুপুকেও রাহাত বকে যাচ্ছে,

– যে যা খুশি করতে থাকে তুমি কিছু বলো না কেন? কিসের আত্মীয়তা? এমন চুতিয়া আত্মীয় দরকার নাই আমার। দুই গালে চড় লাগাইতে পারো না? তোমার ধারে কাছে আসার সাহস কেমনে করে? তোমার জীবন ধ্বংস করছে এখনও তুমি আত্মীয়তা নিয়া চিন্তা করো?

বুঝলাম ছেলেটা নাদিম। রুপু ততক্ষণে রিকশা ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাথা নিচু করে কাঁদছিলো ও। রুপুর নাক টানার শব্দ পাচ্ছিলাম। ওর পাশে গিয়ে হাত ধরে জিজ্ঞেস করলাম,

– কি হয়েছে? সমস্যা কি?

এবার রাহাত আমাকে বকা শুরু করলো।
– আপনাকেও!
– হ্যাঁ। নাদিমের চুলের মুঠি ধরে ওর মাথা ঘুরাচ্ছিলো আর আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত কিটমিট করে বললো,

– আরেক মা**** হাজির। তুই ফুপ্পির বিয়ে করা বর তাই তোরে মারি না৷ আর নয়তো এইটার মতন তোরেও ধইরা দিতাম। ফুপ্পির অর্ধেক জীবন নষ্ট করছে এই হারামজাদা আর বাকিটা নষ্ট করলি তুই। তোরে আর এই হারামজাদারে আমার কোপায়া টুকরা করতে মন চায়। তুই আবার হাত ধরছোস আমার ফুপ্পির! হাত ছাড় বা*****।
– গালিও দিলো!
– আমাকে কেউ গালি দিবে আর আমি সেটা চুপচাপ শুনবো এটা একটা অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু সেদিন এই কান্ডই ঘটলো৷ আমি রাহাতকে কিছুই বলিনি। চুপ করে শুনে গিয়েছি শুধু। কেন যেন একটা গালিও আমি গায়ে মাখিনি৷ বরং আমার ভীষণ খুশি খুশি লাগছিলো।
– গালি শুনে খুশি লাগছিলো!
– উহুম। নাদিমকে পেটানো হচ্ছে সেই খুশি। ভিতরে অদ্ভুত এক শান্তি টের পাচ্ছিলাম। এতক্ষণ ভুগতে থাকা মানসিক চাপ থেকে একটু হলেও মুক্তি পেয়েছিলাম।
– একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন! হুমকি শুনেও কি ভাবির হাত ধরে রেখেছিলেন?

শব্দ করে হেসে উঠলো দুজনই। টি টেবিলের উপর দুই পা তুলে দিতে দিতে সৈকত বললো,

– নাহ্ ছাড়িনি। ধরেই রেখেছিলাম। রাহাত এসে আমাদের দুজনের হাত ছাড়িয়েছিলো। সেইসঙ্গে বলে গেলো,

– ফুপ্পি তোরে এত ভালোবাসলো আর তুই একটু সম্মান দিলি না মানুষটাকে! তুই একটা আবেগহীন চামার৷ তোর মত চামারের বিয়ে করাই উচিত না।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here